শ্রীশ। সেই ভালো।
বনমালী। কুমারটুলির নীলমাধব চৌধুরি মশায়ের দুটি পরমাসুন্দরী কন্যা আছে– তাঁদের বিবাহযোগ্য বয়স হয়েছে–
শ্রীশ। হয়েছে তো হয়েছে, আমাদের সঙ্গে তার সম্বন্ধটা কী!
বনমালী। সম্বন্ধ তো আপনারা একটু মনোযোগ করলেই হতে পারে। সে আর শক্ত কী। আমি সমস্তই ঠিক করে দেব।
বিপিন। আপনার এত দয়া অপাত্রে অপব্যয় করছেন।
বনমালী। অপাত্র! বিলক্ষণ! আপনাদের মতো সৎপাত্র পাব কোথায়। আপনাদের বিনয়গুণে আরো মুগ্ধ হলেম।
শ্রীশ। এই মুগ্ধভাব যদি রাখতে চান তা হলে এই বেলা সরে পড়ুন। বিনয়গুণে অধিক টান সয় না।
বনমালী। কন্যার বাপ যথেষ্ট টাকা দিতে রাজি আছেন।
শ্রীশ। শহরে ভিক্ষুকের তো অভাব নেই। ওহে বিপিন, একটু পা চালিয়ে এগোও– কাঁহাতক রাস্তায় দাঁড়িয়ে বকাবকি করি? তোমার আমোদ বোধ হচ্ছে, কিন্তু এরকম সদালাপ আমার ভালো লাগে না।
বিপিন। পা চালিয়ে পালাই কোথায়? ভগবান এঁকেও যে লম্বা এক জোড়া পা দিয়েছেন।
শ্রীশ। যদি পিছু ধরেন তা হলে ভগবানের সেই দান মানুষের হাতে পড়ে খোওয়াতে হবে।
প্রজাপতির নির্বন্ধ ০৩
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
“মুখুজ্যেমশায়!”
অক্ষয় বলিলেন, “আজ্ঞে করো।”
শৈল কহিল, “কুলীনের ছেলে দুটোকে কোনো ফিকিরে তাড়াতে হবে।”
অক্ষয় উৎসাহপূর্বক কহিলেন, “তা তো হবেই।” বলিয়া রামপ্রসাদী সুরে গান জুড়িয়া দিলেন–
দেখব কে তোর কাছে আসে!
তুই রবি একেশ্বরী, একলা আমি রইব পাশে।
শৈল হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “একেশ্বরী?”
অক্ষয় বলিলেন, “নাহয় তোমরা চার ঈশ্বরীই হলে, শাস্ত্রে আছে অধিকন্তু ন দোষায়।”
শৈল কহিল, “আর, তুমিই একলা থাকবে? ওখানে বুঝি অধিকন্তু খাটে না?”
অক্ষয় কহিলেন, “ওখানে শাস্ত্রের আর-একটা পবিত্র বচন আছে– সর্বমত্যন্ত-গর্হিতং।’
শৈল। কিন্তু মুখুজ্যেমশায়, ও পবিত্র বচনটা তো বরাবর খাটবে না। আরো সঙ্গী জুটবে।
অক্ষয় বলিলেন, “তোমাদের এই একটি শালার জায়গায় দশশালা বন্দোবস্ত হবে? তখন আবার নূতন কার্যবিধি দেখা যাবে। ততদিন কুলীনের ছেলেটেলেগুলোকে ঘেঁষতে দিচ্ছি নে!”
এমন সময় চাকর আসিয়া খবর দিল, দুটি বাবু আসিয়াছে। শৈল কহিল, “ঐ বুঝি তারা এল। দিদি আর মা ভাঁড়ারে ব্যস্ত আছেন, তাঁদের অবকাশ হবার পূর্বেই ওদের কোনোমতে বিদায় করে দিয়ো।”
অক্ষয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী বকশিশ মিলবে?”
শৈল কহিল, “আমরা তোমার সব শালীরা মিলে তোমাকে শালীবাহন রাজা খেতাব দেব।”
অক্ষয়। শালীবাহন দি সেকেণ্ড?
শৈল। সেকেণ্ড হতে যাবে কেন? সে শালীবাহনের নাম ইতিহাস থেকে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তুমি হবে শালীবাহন দি গ্রেট।
অক্ষয়। বল কী? আমার রাজ্যকাল থেকে জগতে নূতন সাল প্রচলিত হবে? এই বলিয়া অত্যন্ত সাড়ম্বর তান-সহকারে ভৈরবীতে গান ধরিলেন–
তুমি আমায় করবে মস্ত লোক!
দেবে লিখে রাজার টিকে প্রসন্ন ওই চোখ!
শৈলবালার প্রস্থান। ভৃত্য আদিষ্ট হইয়া দুটি ভদ্রলোককে উপস্থিত করিল। একটি বিসদৃশ লম্বা, রোগা, বুট-জুতা পরা, ধুতি প্রায় হাঁটুর কাছে উঠিয়াছে, চোখের নীচে কালী-পড়া, ম্যালেরিয়া রোগীর চেহারা– বয়স বাইশ হইতে বত্রিশ পর্যন্ত যেটা খুশি হইতে পারে। আর একটি বেঁটেখাটো, অত্যন্ত দাড়ি-গোঁফ-সংকুল, নাকটি বটিকাকার, কপালটি ঢিবি, কালোকোলো, গোলগাল।
অক্ষয় অত্যন্ত সৌহার্দ্যসহকারে উঠিয়া অগ্রসর হইয়া প্রবল বেগে শেকহ্যাণ্ড করিয়া দুটি ভদ্রলোকের হাত প্রায় ছিঁড়িয়া ফেলিলেন। বলিলেন, “আসুন মিস্টার ন্যাথানিয়াল, আসুন মিস্টার জেরেমায়া, বসুন বসুন! ওরে বরফ-জল নিয়ে আয় রে, তামাক দে!”
রোগা লোকটি সহসা বিজাতীয় সম্ভাষণে সংকুচিত হইয়া মৃদুস্বরে বলিল, “আজ্ঞে, আমার নাম মৃত্যুঞ্জয় গাঙ্গুলি।”
বেঁটে লোকটি বলিল, “আমার নাম শ্রীদারুকেশ্বর মুখোপাধ্যায়।”
অক্ষয়। ছি মশায়! ও নামগুলো এখনো ব্যবহার করেন বুঝি? আপনাদের ক্রিশ্চান নাম?
আগন্তুকদিগকে হতবুদ্ধি নিরুত্তর দেখিয়া কহিলেন, “এখনো বুঝি নামকরণ হয় নি? তা, তাতে বিশেষ কিছু আসে যায় না, ঢের সময় আছে।”
বলিয়া নিজের গুড়গুড়ির নল মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে অগ্রসর করিয়া দিলেন। সে লোকটা ইতস্তত করিতেছে দেখিয়া বলিলেন, “বিলক্ষণ! আমার সামনে আবার লজ্জা! সাত বছর বয়স থেকে লুকিয়ে তামাক খেয়ে পেকে উঠেছি। ধোঁওয়া লেগে লেগে বুদ্ধিতে ঝুল পড়ে গেল! লজ্জা যদি করতে হয় তা হলে আমার তো আর ভদ্রসমাজে মুখ দেখাবার জো থাকে না।”
তখন সাহস পাইয়া দারুকেশ্বর মৃত্যুঞ্জয়ের হাত হইতে ফস করিয়া নল কাড়িয়া লইয়া ফড় ফড় শব্দে টানিতে আরম্ভ করিল। অক্ষয় পকেট হইতে কড়া বর্মা চুরোট বাহির করিয়া মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে দিলেন। যদিচ তাহার চুরোট অভ্যাস ছিল না, তবু সে সদ্যস্থাপিত ইয়ার্কির খাতিরে প্রাণের মায়া পরিত্যাগ করিয়া মৃদুমন্দ টান দিতে লাগিল এবং কোনো গতিকে কাসি চাপিয়া রাখিল।
অক্ষয় কহিলেন, “এখন কাজের কথাটা শুরু করা যাক। কী বলেন?”
মৃত্যুঞ্জয় চুপ করিয়া রহিল, দারুকেশ্বর বলিল, “তা নয় তো কী? শুভস্য শীঘ্রং!” বলিয়া হাসিতে লাগিল, ভাবিল, ইয়ার্কি জমিতেছে।
তখন অক্ষয় গম্ভীর হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মুর্গি না মটন!”
মৃত্যুঞ্জয় অবাক হইয়া মাথা চুলকাইতে লাগিল। দারুকেশ্বর কিছু না বুঝিয়া, অপরিমিত হাসিতে আরম্ভ করিল। মৃত্যুঞ্জয় ক্ষুব্ধ লজ্জিত হইয়া ভাবিতে লাগিল, এরা দুজন তো বেশ জমাইয়াছে, আমিই নিরেট বোকা!