রসিক। বিলক্ষণ! ক্ষমা চেয়ে অপরাধিনীদের আর অপরাধ বাড়াবেন না। এঁদের অল্প বয়স, মান্য অতিথিদের কিরকম সম্ভাষণ করা উচিত তা যদি এঁরা হঠাৎ ভুলে গিয়ে নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকেন তা হলে আপনাদের প্রতি অসদ্ভাব কল্পনা করে এঁদের আরো লজ্জিত করবেন না। নৃপদিদি, নীরদিদি– কী বল ভাই! যদিও এখনো তোমাদের চোখের পাতা শুকোয় নি, তবু এঁদের প্রতি তোমাদের মন যে বিমুখ নয় সে কথা কি জানাতে পারি? (নৃপ ও নীর লজ্জিত-নিরুত্তর) না, একটু আড়ালে জিজ্ঞাসা করা দরকার। (জনান্তিকে) ভদ্রলোকদের এখন কী বলি বলো তো ভাই? বলব কি, তোমরা যত শীঘ্র পার বিদায় হও!
নীরবালা। (মৃদুস্বরে) রসিকদাদা, কী বকো তার ঠিক নেই, আমরা কি তাই বলেছি! আমরা কি জানতুম এঁরা এসেছেন?
রসিক। (শ্রীশ ও বিপিনের প্রতি) এঁরা বলছেন–
সখা, কী মোর করমে লেখি!
তপত বলিয়া তপনে ডরিনু,
চাঁদের কিরণ দেখি!
এর উপরে আপনাদের কিছু বলবার আছে?
নীরবালা। (জনান্তিকে) আঃ রসিকদাদা, কী বলছ তার ঠিক নেই! ও কথা আমরা কখন বললুম!
রসিক। (শ্রীশ ও বিপিনের প্রতি) এঁদের মনের ভাবটা আমি সম্পূর্ণ ব্যক্ত করতে পারি নি বলে এঁরা আমাকে ভর্ৎসনা করছেন। এঁরা বলতে চান, চাঁদের কিরণ বললেও যথেষ্ট বলা হয় না– তার চেয়ে আরো যদি–
নীরবালা। (জনান্তিকে) তুমি অমন কর যদি তা হলে আমরা চলে যাব।
রসিক। সখি, ন যুক্তম্ অকৃতসৎকারম্ অতিথিবিশেষম্ উজ্ঝিত্বা স্বচ্ছন্দতো গমনম্! (শ্রীশ ও বিপিনের প্রতি) এঁরা বলছেন এঁদের যথার্থ মনের ভাবটি যদি আপনাদের কাছে ব্যক্ত করে বলি, তা হলে এঁরা লজ্জায় এ ঘর থেকে চলে যাবেন।
[নৃপ ও নীরর প্রস্থানোদ্যম
শ্রীশ। রসিকবাবুর অপরাধে আপনারা নির্দোষদের সাজা দেবেন কেন? আমরা তো কোনোপ্রকার প্রগল্ভতা করি নি।
[নৃপ ও নীরর ‘ন যযৌ ন তস্থৌ’ ভাব
বিপিন। (নীরকে লক্ষ্য করিয়া) পূর্বকৃত কোনো অপরাধ যদি থাকে তো ক্ষমা প্রার্থনার অবকাশ কি দেবেন না?
রসিক। (জনান্তিকে) এই ক্ষমাটুকুর জন্যে বেচারা অনেক দিন থেকে সুযোগ প্রত্যাশা করছে–
নীরবালা। (জনান্তিকে) অপরাধ কী হয়েছে যে ক্ষমা করতে যাব?
রসিক। (বিপিনের প্রতি) ইনি বলছেন, আপনার অপরাধ এমন মনোহর যে তাকে ইনি অপরাধ বলে লক্ষ্যই করেন নি! কিন্তু আমি যদি সেই খাতাটি হরণ করতে সাহসী হতেম তবে সেটা অপরাধ হত– আইনের বিশেষ ধারায় এইরকম লিখছে।
বিপিন। ঈর্ষা করবেন না রসিকবাবু! আপনারা সর্বদাই অপরাধ করবার সুযোগ পান এবং সেজন্যে দণ্ডভোগ করে কৃতার্থ হন, আমি দৈবক্রমে একটা অপরাধ করবার সুবিধা পেয়েছিলুম, কিন্তু এতই অধম যে দণ্ডনীয় বলেও গণ্য হলেম না, ক্ষমা পাবার যোগ্যতাও লাভ করলেম না!
রসিক। বিপিনবাবু, একেবারে হতাশ হবেন না। শাস্তি অনেক সময় বিলম্বে আসে কিন্তু নিশ্চিত আসে। ফস্ করে মুক্তি না পেতেও পারেন।
ভৃত্যের প্রবেশ
ভৃত্য। জলখাবার তৈরি।
[নৃপ ও নীরর প্রস্থান
শ্রীশ। আমরা কি দুর্ভিক্ষের দেশ থেকে আসছি রসিকবাবু? জলখাবারের জন্যে এত তাড়া কেন!
রসিক। মধুরেণ সমাপয়েৎ।
শ্রীশ। (নিশ্বাস ফেলিয়া) কিন্তু সমাপনটা তো মধুর নয়। (জনান্তিকে বিপিনের প্রতি) কিন্তু বিপিন, এঁদের প্রতারণা করে যেতে পারব না!
বিপিন। (জনান্তিকে) তা যদি করি তবে আমরা পাষণ্ড।
শ্রীশ। (জনান্তিকে) এখন আমাদের কর্তব্য কী।
বিপিন। (জনান্তিকে) সে কি আর জিজ্ঞাসা করতে হবে?
রসিক। আপনারা দেখছি ভয় পেয়ে গেছেন! কোনো আশঙ্কা নেই, শেষকালে যেমন করেই হোক আপনাদের উদ্ধার করবই।
[সকলের প্রস্থান
অক্ষয় ও জগত্তারিণীর প্রবেশ
জগত্তারিণী। দেখলে তো বাবা, কেমন ছেলে দুটি?
অক্ষয়। মা, তোমার পছন্দ ভালো, এ কথা আমি তো অস্বীকার করতে পারি নে।
জগত্তারিণী। মেয়েদের রকম দেখলে তো বাবা! এখন কান্নাকাটি কোথায় গেছে তার ঠিক নেই!
অক্ষয়। ঐ তো ওদের দোষ। কিন্তু মা, তোমাকে নিজে গিয়ে আশীর্বাদ দিয়ে ছেলে দুটিকে দেখতে হচ্ছে।
জগত্তারিণী। সে কি ভালো হবে অক্ষয়? ওরা কি পছন্দ জানিয়েছে?
অক্ষয়। খুব জানিয়েছে। এখন তুমি নিজে এসে আশীর্বাদ করে গেলেই চট্পট্ স্থির হয়ে যায়!
জগত্তারিণী। তা বেশ, তোমরা যদি বল তো যাব। আমি ওদের মার বয়সী, আমার লজ্জা কিসের।
পুরবালার প্রবেশ
পুরবালা। খাবার গুছিয়ে দিয়ে এসেছি। ওদের কোন্ ঘরে বসিয়েছে, আমি আর দেখতেই পেলুম না।
জগত্তারিনী। কী আর বলব পুরো, এমন সোনার চাঁদ ছেলে!
পুরবালা। তা জানতুম। নীর-নৃপর অদৃষ্টে কি খারাপ ছেলে হতে পারে।
অক্ষয়। তাদের বড়দিদির অদৃষ্টের আঁচ লেগেছে আর-কি।
পুরবালা। আচ্ছা, থামো। যাও দেখি, তাদের সঙ্গে একটু আলাপ করোগে। — কিন্তু শৈল গেল কোথায়?
অক্ষয়। সে খুশি হয়ে দরজা বন্ধ করে পুজোয় বসেছে।
প্রজাপতির নির্বন্ধ ১৬
ষোড়শ পরিচ্ছেদ
অক্ষয়। ব্যাপারটা কী? রসিকদা, আজকাল তো খুব খাওয়াচ্ছ দেখছি। প্রত্যহ যাকে দু বেলা দেখছ তাকে হঠাৎ ভুলে গেলে?
রসিক। এঁদের নূতন আদর, পাতে যা পড়ছে তাতেই খুশি হচ্ছেন। তোমার আদর পুরোনো হয়ে এল, তোমাকে নতুন করে খুশি করি এমন সাধ্য নেই ভাই!
অক্ষয়। কিন্তু শুনেছিলেম, আজকের সমস্ত মিষ্টান্ন এবং এ পরিবারের সমস্ত অনাস্বাদিত মধু উজাড় করে নেবার জন্যে দুটি অখ্যাতনামা যুবকের অভ্যুদয় হবে– এঁরা তাঁদেরই অংশে ভাগ বসাচ্ছেন না কি? ওহে রসিকদা, ভুল কর নি তো?