চন্দ্র। আমরা মনে করছি আমাদের সভা থেকে চিরকুমার ব্রতের নিয়মটা উঠিয়ে দেব– আপনি কী পরামর্শ দেন?
রসিক। আমি খুব নিঃস্বার্থভাবেই পরামর্শ দিতে পারব, কারণ, এ ব্রত রাখুন বা উঠিয়ে দিন আমার পক্ষে দুই-ই সমান। আমার পরামর্শ এই যে, উঠিয়ে দিন– নইলে সে কোন্ দিন আপনিই উঠে যাবে। আমাদের পাড়ার রামহরি মাতাল রাস্তার মাঝখানে এসে সকলকে ডেকে বলেছিল, বাবা-সকল, আমি স্থির করেছি এইখানটাতেই আমি পড়ব। স্থির না করলেও সে পড়ত, অতএব স্থির করাটাই তার পক্ষে ভালো হয়েছিল।
চন্দ্র। ঠিক বলেছেন রসিকবাবু, যে জিনিস বলপূর্বক আসবেই তাকে বল প্রকাশ করতে না দিয়ে আসতে দেওয়াই ভালো। আসছে রবিবারের পূর্বেই এই প্রস্তাবটা সকলের কাছে একবার তুলতে চাই।
রসিক। আচ্ছা, শুক্রবারের সন্ধ্যাবেলায় আপনারা আমাদের ওখানে যাবেন, আমি সকলকে সংবাদ দিয়ে আনাব।
চন্দ্র। রসিকবাবু, আপনার যদি সময় থাকে তা হলে আমাদের দেশে গোজাতির উন্নতি-সম্বন্ধে একটা প্রস্তাব আপনাকে–
রসিক। বিষয়টা শুনে খুব ঔৎসুক্য জন্মাচ্ছে, কিন্তু সময় খুব যে বেশি–
নির্মলা। না রসিকবাবু, আপনি ও ঘরে চলুন, আপনার সঙ্গে অনেক কথা কবার আছে। মামা, তোমার লেখাটা শেষ করো, আমরা থাকলে ব্যাঘাত হবে।
রসিক। তা হলে চলুন।
নির্মলা। (চলিতে চলিতে) অবলাকান্তবাবু আমাকে তাঁর সেই লেখাটি পাঠিয়ে দিয়েছেন– আমার অনুরোধ যে তিনি মনে করে রেখেছিলেন সেজন্যে আপনি তাঁকে আমার ধন্যবাদ জানাবেন।
রসিক। ধন্যবাদ না পেলেও আপনার অনুরোধ রক্ষা করেই তিনি কৃতার্থ।
প্রজাপতির নির্বন্ধ ১৫
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
জগত্তারিণী। বাবা অক্ষয়! দেখো তো, মেয়েদের নিয়ে আমি কী করি! নেপ বসে বসে কাঁদছে, নীর রেগে অস্থির, সে বলে সে কোনোমতেই বেরোবে না। ভদ্রলোকের ছেলেরা আজ এখনই আসবে, তাদের এখন কী বলে ফেরাব। তুমিই বাপু, ওদের শিখিয়ে পড়িয়ে বিবি করে তুলেছ, এখন তুমিই ওদের সামলাও।
পুরবালা। সত্যি, আমি ওদের রকম দেখে অবাক হয়ে গেছি, ওরা কি মনে করেছে ওরা–
অক্ষয়। বোধ হয় আমাকে ছাড়া আর কাউকে ওরা পছন্দ করছে না; তোমারই সহোদরা কিনা, রুচিটা তোমারই মতো।
পুরবালা। ঠাট্টা রাখো, এখন ঠাট্টার সময় নয়– তুমি ওদের একটু বুঝিয়ে বলবে কি না বলো। তুমি না বললে ওরা শুনবে না।
অক্ষয়। এত অনুগত! একেই বলে ভগ্নীপতিব্রতা শ্যালী। আচ্ছা, আমার কাছে একবার পাঠিয়ে দাও– দেখি!
[জগত্তারিণী ও পুরবালার প্রস্থান
নৃপবালা ও নীরবালার প্রবেশ
নীরবালা। না, মুখুজ্যেমশায়, সে কোনোমতেই হবে না।
নৃপবালা। মুখুজ্যেমশায়, তোমার দুটি পায়ে পড়ি আমাদের যার তার সামনে ওরকম করে বের কোরো না।
অক্ষয়। ফাঁসির হুকুম হলে একজন বলেছিল, আমাকে বেশি উঁচুতে চড়িয়ো না, আমার মাথাঘোরা ব্যামো আছে– তোদের যে তাই হল। বিয়ে করতে যাচ্ছিস, এখন দেখা দিতে লজ্জা করলে চলবে কেন?
নীরবালা। কে বললে আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি?
অক্ষয়। অহো, শরীরে পুলক সঞ্চার হচ্ছে! কিন্তু হৃদয় দুর্বল এবং দৈব বলবান, যদি দৈবাৎ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে হয়–
নীরবালা। না, ভঙ্গ হবে না।
অক্ষয়। হবে না তো? তবে নির্ভয়ে এসো; যুবক দুটোকে দেখা দিয়ে আধপোড়া করে ছেড়ে দাও– হতভাগারা বাসায় ফিরে গিয়ে মরে থাকুক।
নীরবালা। অকারণে প্রাণিহত্যা করবার জন্যে আমাদের এত উৎসাহ নেই।
অক্ষয়। জীবের প্রতি কী দয়া! কিন্তু সামান্য ব্যাপার নিয়ে গৃহবিচ্ছেদ করবার দরকার কী? তোদের মা-দিদি যখন ধরে পড়েছেন এবং ভদ্রলোক দুটি যখন গাড়ি-ভাড়া করে আসছে তখন একবার মিনিট পাঁচেকের মতো দেখা দিস, তার পরে আমি আছি– তোদের অনিচ্ছায় কোনোমতেই বিবাহ দিতে দেব না।
নীরবালা। কোনোমতেই না?
অক্ষয়। কোনোমতেই না।
পুরবালার প্রবেশ
পুরবালা। আয় তোদের সাজিয়ে দিইগে।
নীরবালা। আমরা সাজব না!
পুরবালা। ভদ্রলোকদের সামনে এইরকম বেশেই বেরোবি? লজ্জা করবে না?
নীরবালা। লজ্জা করবে বৈকি দিদি, কিন্তু সেজে বেরোতে আরো বেশি লজ্জা করবে।
অক্ষয়। উমা তপস্বিনীবেশে মহাদেবের মনোহরণ করেছিলেন, শকুন্তলা যখন দুষ্যন্তের হৃদয় জয় করেছিল তখন তার গায়ে একখানি বাকল ছিল– কালিদাস বলেন সেও কিছু আঁট হয়ে পড়েছিল, তোমার বোনেরা সেই-সব পড়ে সেয়ানা হয়ে উঠেছে, সাজতে চায় না!
পুরবালা। সে-সব হল সত্যযুগের কথা। কলিকালের দুষ্যন্ত মহারাজরা সাজ-সজ্জাতেই ভোলেন।
অক্ষয়। যথা–
পুরবালা। যথা তুমি। যেদিন তুমি দেখতে এলে মা বুঝি আমাকে সাজিয়ে দেন নি?
অক্ষয়। আমি মনে মনে ভাবলেম, সাজেও যখন একে সেজেছে তখন সৌন্দর্যে না জানি কত শোভা হবে!
পুরবালা। আচ্ছা, তুমি থামো, নীরু আয়!
নীরবালা। না ভাই দিদি–
পুরবালা। আচ্ছা, সাজ নাই করলি চুল তো বাঁধতে হবে!
অক্ষয়।
গান
অলকে কুসুম না দিয়ো,
শুধু শিথিলকবরী বাঁধিয়ো।
কাজলবিহীন সজলনয়নে
হৃদয়দুয়ারে ঘা দিয়ো।
আকুল আঁচলে পথিকচরণে
মরণের ফাঁদ ফাঁদিয়ো।
না করিয়া বাদ মনে যাহা সাধ
নিদয়া নীরবে সাধিয়ো।
পুরবালা। তুমি আবার গান ধরলে? আমি কখন কী করি বলো দেখি। তাদের আসবার সময় হল– এখনো আমার খাবার তৈরি করা বাকি আছে।
[নৃপ ও নীরকে লইয়া প্রস্থান
রসিকের প্রবেশ
অক্ষয়। পিতামহ ভীষ্ম, যুদ্ধের সমস্তই প্রস্তুত?
রসিক। সমস্তই– বীরপুরুষ দুটিও সমাগত।
অক্ষয়। এখন কেবল দিব্যাস্ত্র দুটি সাজতে গেছেন। তুমি তা হলে সেনাপতির ভার গ্রহণ করো, আমি একটু অন্তরালে থাকতে ইচ্ছা করি।