বিপিন। বেশ, বলুন, আমি যাচ্ছি।
[প্রস্থান
পূর্ণ। আমার মতো নির্বোধ জগতে নেই রসিকবাবু!
রসিক। আপনার চেয়ে ঢের নির্বোধ আছে যারা নিজেকে বুদ্ধিমান বলে জানে– যথা আমি।
পূর্ণ। একটু নিরালা পাই যদি, আপনার সঙ্গে অনেক কথা আছে, সভা ভেঙে গেলে আজ রাত্রে একটু অবসর করতে পারেন?
রসিক। বেশ কথা।
পূর্ণ। আজ দিব্য জ্যোৎস্না আছে, গোলদিঘির ধারে– কী বলেন?
রসিক। (স্বগত) কী সর্বনাশ!
শ্রীশ। (নিকটে আসিয়া) ওঃ, পূর্ণবাবু কথা কচ্ছেন বুঝি। আচ্ছা, এখন থাক্। রাত্রে আপনার অবসর হবে রসিকবাবু?
রসিক। তা হতে পারে।
শ্রীশ। তা হলে কালকের মতো– কী বলেন? কাল দেখলেন তো ঘরের চেয়ে পথে জমে ভালো।
রসিক। জমে বৈকি! (স্বগত) সর্দি জমে, কাসি জমে, গলার স্বর দইয়ের মতো জমে যায়।
[শ্রীশের প্রস্থান
পূর্ণ। আচ্ছা রসিকবাবু, আপনি হলে কী বলে কথা আরম্ভ করতেন?
রসিক। হয়তো বলতুম– সেদিন বেলুন উড়েছিল, আপনাদের বাড়ির ছাত থেকে দেখতে পেয়েছিলেন কি?
পূর্ণ। তিনি যদি বলতেন, হাঁ–
রসিক। আমি বলতুম, মনকে ওড়বার অধিকার দিয়েছেন বলেই ঈশ্বর মানুষের শরীরে পাখা দেন নি– শরীরকে বদ্ধ রেখে বিধাতা মনের আগ্রহ কেবল বাড়িয়ে দিয়েছেন–
পূর্ণ। বুঝেছি রসিকবাবু– চমৎকার– এর থেকে অনেক কথার সৃষ্টি হতে পারে।
বিপিন। (নিকটে আসিয়া) পূর্ণবাবুর সঙ্গে কথা হচ্ছে। থাক্ তবে। আমাদের সেই-যে একটা কথা ছিল সেটা আজ রাত্রে হবে, কী বলেন?
রসিক। সেই ভালো।
বিপিন। জ্যোৎস্নায় রাস্তায় বেড়াতে বেড়াতে দিব্যি আরামে– কী বলেন?
রসিক। খুব আরাম। (স্বগত) কিন্তু বেয়ারামটা তার পরে।
অন্যত্র
শৈল। (নির্মলার প্রতি) তা বেশ, আপনি যদি ইচ্ছা করেন আমিও ঐ বিষয়টার আলোচনা করে দেখব। ডাক্তারি আমি অল্প অল্প চর্চা করেছি, বেশি নয়, কিন্তু আমি যোগদান করলে আপনার যদি উৎসাহ হয় আমি প্রস্তুত আছি।
পূর্ণ। (নিকটে আসিয়া) সেদিন বেলুন উড়েছিল, আপনি কি ছাদের উপর থেকে দেখতে পেয়েছিলেন?
নির্মলা। বেলুন?
পূর্ণ। হাঁ, ঐ বেলুন। (সকলে নিরুত্তর) রসিকবাবু বলছিলেন আপনি বোধ হয় দেখে থাকবেন– আমাকে মাপ করবেন– আপনাদের আলোচনায় আমি ভঙ্গ দিলুম– আমি অত্যন্ত হতভাগ্য।
প্রজাপতির নির্বন্ধ ১২
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
পূর্বদিনে পূরবালা তাহার মাতার সহিত কাশী হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে। অক্ষয় কহিলেন, “দেবী, যদি অভয় দাও তো একটি প্রশ্ন আছে।”
পুরবালা। কী শুনি।
অক্ষয়। শ্রীঅঙ্গে কৃশতায় তো কোনো লক্ষণ দেখছি নে।
পুরবালা। শ্রীঅঙ্গ তো কৃশ হবার জন্যে পশ্চিমে বেড়াতে যায় নি।
অক্ষয়। তবে কি বিরহবেদনা বলে জিনিসটা মহাকবি কালিদাসের সঙ্গে সহমরণে মরেছে?
পুরবালা। তার প্রমাণ তুমি। তোমারও তো স্বাস্থ্যের বিশেষ ব্যাঘাত হয় নি দেখছি।
অক্ষয়। হতে দিল কই? তোমার তিন ভগ্নী মিলে অহরহ আমার কৃশতা নিবারণ করে রেখেছিল– বিরহ যে কাকে বলে সেটা আর কোনোমতেই বুঝতে দিলে না।–
গান। পিলু
বিরহে মরিব বলে ছিল মনে পণ।
কে তোরা বাহুতে বাঁধি করিলি বারণ?
ভেবেছিনু অশ্রুজলে, ডুবিব অকূল তলে,
কাহার সোনার তরী করিল তারণ?
প্রিয়ে, কাশীধামে বুঝি পঞ্চশর ত্রিলোচনের ভয়ে এগোতে পারেন না?
পুরবালা। তা হতে পারে, কিন্তু কলকাতায় তো তাঁর যাতায়াত আছে।
অক্ষয়। তা আছে– কোম্পানির শাসন তিনি মানেন না, আমি তার প্রমাণ পেয়েছি।
নৃপবালা ও নীরবালার প্রবেশ
নীরবালা। দিদি!
অক্ষয়। এখন দিদি বৈ আর কথা নেই– অকৃতজ্ঞ! দিদি যখন বিচ্ছেদদহনে উত্তেরোত্তর তপ্তকাঞ্চনের মতো শ্রী ধারণ করছিলেন তখন তোমাদের কটিকে সুশীতল করে রেখেছিল কে?
নীরবালা। শুনছ দিদি! এমন মিথ্যে কথা! তুমি যতদিন ছিলে না আমাদের একবার ডেকেও জিজ্ঞাসা করেন নি– কেবল চিঠি লিখেছেন আর টেবিলের উপর দুই পা তুলে দিয়ে বই হাতে করে পড়েছেন। তুমি এসেছ এখন আমাদের নিয়ে গান হবে, ঠাট্টা হবে, দেখাবেন যেন–
নৃপবালা। দিদি, তুমিও তো, ভাই, এতদিন আমাদের একখানিও চিঠি লেখ নি?
পুরবালা। আমার কি সময় ছিল ভাই? মাকে নিয়ে দিনরাত ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল।
অক্ষয়। যদি বলতে “তোদের ভগ্নীপতির ধ্যানে নিমগ্ন ছিলুম’ তা হলে কি লোকে নিন্দে করত?
নীরবালা। তা হলে ভগ্নীপতির আস্পর্ধা আরো বেড়ে যেত। মুখুজ্যেমশায়, তুমি তোমার বাইরের ঘরে যাও-না। দিদি এতদিন পরে এসেছেন, আমরা কি ওঁকে নিয়ে একটু গল্প করতে পাব না?
অক্ষয়। নৃশংসে, বিরহদাবদগ্ধ তোর দিদিকে আবার বিরহে জ্বালাতে চাস? তোদের ভগ্নীপতিরূপ ঘনকৃষ্ণ মেঘ মিলনরূপ মুষলধারা বর্ষণ-দ্বারা প্রিয়ার চিত্তরূপ লতানিকুঞ্জে আনন্দরূপ কিসলয়োদ্গম করে প্রেমরূপ বর্ষায় কটাক্ষরূপ বিদ্যুৎ–
নীরবালা। এবং বকুনিরূপ ভেকের কলরব–
শৈলের প্রবেশ
অক্ষয়। এসো এসো– উত্তমাধমমধ্যমা এই তিন শ্যালী না হলে আমার–
নীরবালা। উত্তমমধ্যম হয় না।
শৈল। (নৃপ ও নীরর প্রতি) তোরা ভাই, একটু যা তো, আমাদের কথা আছে।
অক্ষয়। কথাটা কী বুঝতে পারছিস তো নীরু? হরিনামকথা নয়।
নীরবালা। আচ্ছা, তোমার আর বকতে হবে না।
[নৃপ ও নীরর প্রস্থান
শৈল। দিদি, নৃপ-নীরর জন্যে মা দুটি পাত্র তা হলে স্থির করেছেন?
পুরবালা। হাঁ, কথা একরকম ঠিক হয়ে গেছে। শুনেছি ছেলে দুটি মন্দ নয়– তারা মেয়ে দেখে পছন্দ করলেই পাকাপাকি হয়ে যাবে।
শৈল। যদি পছন্দ না করে?