নীরবালা। দেখো রসিকদাদা, তুমি যদি আমাকে বিরক্ত কর তা হলে গলাবদ্ধ পাবে না বলছি। দেখো দেখি দিদি, তুমিও যদি রসিকদার কথায় ঐরকম করে হাস তা হলে ওঁর আস্পর্ধা আরো বেড়ে যায়।
রসিক। দেখেছিস ভাই শৈল, নীরু আজকাল ঠাট্টাও সইতে পারছে না, মন এত দুর্বল হয়ে পড়েছে। নীরুদিদি, কোনো কোনো সময় কোকিলের ডাক শ্রুতিকটু বলে ঠেকে এইরকম শাস্ত্রে আছে, তোর রসিকদাদার ঠাট্টাকেও কি তোর আজকাল কুহুতান বলে ভ্রম হতে লাগল?
নীরবালা। সেইজন্যেই তো তোমার গলায় গলাবদ্ধ জড়িয়ে দিতে চাচ্ছি– তানটা যদি একটু কমে।
শৈল। নীরু, আর ঝগড়া করিস নে– আয়, এখনই সবাই এসে পড়বে।
[উভয়ের প্রস্থান
পূর্ণর প্রবেশ
রসিক। আসুন পূর্ণবাবু–
পূর্ণ। এখনো আর কেউ আসেন নি?
রসিক। আপনি বুঝি কেবল এই বৃদ্ধটিকে দেখে হতাশ হয়ে পড়েছেন। আরো সকলে আসবেন পূর্ণবাবু!
পূর্ণ। হতাশ কেন হব রসিকবাবু?
রসিক। তা কেমন করে বলব বলুন। কিন্তু ঘরে যেই ঢুকলেন আপনার দুটি চক্ষু দেখে বোধ হল তারা যাকে ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছে সে ব্যক্তি আমি নই।
পূর্ণ। চক্ষুতত্ত্বে আপনার এতদূর অধিকার হল কী করে?
রসিক। আমার পানে কেউ কোনোদিন তাকায় নি পূর্ণবাবু, তাই এই প্রাচীন বয়স পর্যন্ত পরের চক্ষু পর্যবেক্ষণের যথেষ্ট অবসর পেয়েছি। আপনাদের মতো শুভাদৃষ্ট হলে দৃষ্টিতত্ত্ব লাভ না করে অনেক দৃষ্টি লাভ করতে পারতুম। কিন্তু যাই বলুন পূর্ণবাবু, চোখ দুটির মতো এমন আশ্চর্য সৃষ্টি আর কিছু হয় নি– শরীরের মধ্যে মন যদি কোথাও প্রত্যক্ষ বাস করে সে ঐ চোখের উপরে।
পূর্ণ। (সোৎসাহে) ঠিক বলেছেন রসিকবাবু! ক্ষুদ্র শরীরের মধ্যে যদি কোথাও অনন্ত আকাশ কিম্বা অনন্ত সমুদ্রের তুলনা থাকে সে ঐ দুটি চোখে।
রসিক।
নিঃসীমশোভাসৌভাগ্যং নতাঙ্গ্যা নয়নদ্বয়ং
অন্যোহন্যালোকনানন্দবিরহাদিব চঞ্চলং–
বুঝেছেন পূর্ণবাবু?
পূর্ণ। না, কিন্তু বোঝবার ইচ্ছা আছে।
রসিক।
আনতাঙ্গী বালিকার শোভাসৌভাগ্যের সার নয়নযুগল
না দেখিয়া পরস্পরে তাই কি বিরহভরে হয়েছে চঞ্চল?
পূর্ণ। না রসিকবাবু, ও ঠিক হল না। ও কেবল বাক্চাতুরী। দুটো চোখ পরস্পরকে দেখতে চায় না।
রসিক। অন্য দুটো চোখকে দেখতে চায় তো? সেইরকম অর্থ করেই নিন-না! শেষ দুটো ছত্র বদলে দেওয়া যাক–
প্রিয়চক্ষু-দেখাদেখি যে আনন্দ তাই সে কি খুঁজিছে চঞ্চল?
পূর্ণ। চমৎকার হয়েছে রসিকবাবু!
প্রিয়চক্ষু-দেখাদেখি যে আনন্দ তাই সে কি খুঁজিছে চঞ্চল?
অথচ সে বেচারা বন্দী খাঁচার পাখির মতো কেবল এ পাশে ও পাশে ছট্ফট্ করে– প্রিয়চক্ষু যেখানে, সেখানে পাখা মেলে উড়ে যেতে পারে না।
রসিক। আবার দেখাদেখির ব্যাপারখানাও যে কিরকম নিদারুণ তাও শাস্ত্রে লিখেছে–
হত্বা লোচনবিশিখৈর্গত্বা কতিচিৎ পদানি পদ্মাক্ষী
জীবতি যুবা ন বা কিং ভূয়ো ভূয়ো বিলোকয়তি।
বিঁধিয়া দিয়া আঁখিবাণে
যায় সে চলি গৃহপানে,
জনমে অনুশোচনা–
বাঁচিল কি না দেখিবারে
চায় সে ফিরে বারে বারে
কমলবরলোচনা!
পূর্ণ। রসিকবাবু, বারে বারে ফিরে চায় কেবল কাব্যে।
রসিক। তার কারণ, কাব্যে ফিরে চাবার কোনো অসুবিধে নেই। সংসারটা যদি ঐরকম ছন্দে তৈরি হত তা হলে এখানেও ফিরে ফিরে চাইত পূর্ণবাবু– এখানে মন ফিরে চায়, চক্ষু ফেরে না।
পূর্ণ। (সনিশ্বাসে) বড়ো বিশ্রী জায়গা রসিকবাবু! কিন্তু ওটা আপনি বেশ বলেছেন– প্রিয়চক্ষু-দেখাদেখি যে আনন্দ তাই সে কি খুঁজিছে চঞ্চল?
রসিক। আহা পূর্ণবাবু, নয়নের কথা যদি উঠল ও আর শেষ করতে ইচ্ছা করে না–
লোচনে হরিণগর্বমোচনে
মা বিদূষয় নতাঙ্গি কজ্জলৈঃ।
সায়কঃ সপদি জীবহারকঃ
কিং পুনর্হি গরলেন লেপিতঃ?
হরিণগর্বমোচন লোচনে
কাজল দিয়ো না সরলে!
এমনি তো বাণ নাশ করে প্রাণ,
কী কাজ লেপিয়া গরলে?
পূর্ণ। থামুন রসিকবাবু, থামুন। ঐ বুঝি কারা আসছেন।
চন্দ্রবাবু ও নির্মলার প্রবেশ
চন্দ্র। এই-যে অক্ষয়বাবু–
রসিক। আমার সঙ্গে অক্ষয়বাবুর সাদৃশ্য আছে শুনলে তিনি এবং তাঁর আত্মীয়গণ বিমর্ষ হবেন। আমি রসিক।
চন্দ্র। মাপ করবেন রসিকবাবু– হঠাৎ ভ্রম হয়েছিল।
রসিক। মাপ করবার কী কারণ ঘটেছে মশাই! আমাকে অক্ষয়বাবু ভ্রম করে কিছুমাত্র অসম্মান করেন নি। মাপ তাঁর কাছে চাইবেন। পূর্ণবাবুতে আমাতে এতক্ষণ বিজ্ঞানচর্চা করছিলুম চন্দ্রবাবু!
চন্দ্র। আমাদের কুমারসভায় আমরা মাসে একদিন করে বিজ্ঞান-আলোচনার জন্যে স্থির করব মনে করেছিলুম। আজ কী বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছিল পূর্ণবাবু?
পূর্ণ। না, সে কিছুই নয় চন্দ্রবাবু!
রসিক। চোখের দৃষ্টি সম্বন্ধে দু-চার কথা বলাবলি করা যাচ্ছিল।
চন্দ্র। দৃষ্টির রহস্য ভারি শক্ত রসিকবাবু!
রসিক। শক্ত বৈকি– পূর্ণবাবুরও সেই মত।
চন্দ্র। সমস্ত জিনিসের ছায়াই আমাদের দৃষ্টিপটে উল্টো হয়ে পড়ে, সেইটেকে যে কেমন করে আমরা সোজাভাবে দেখি সে সম্বন্ধে কোনো মতই আমার সন্তোষজনক বলে বোধ হয় না।
রসিক। সন্তোষজনক হবে কেমন করে। সোজা দেখা বাঁকা দেখা এই-সমস্ত নিয়ে মানুষের মাথা ঘুরে যায়। বিষয়টা বড়ো সংকটময়।
চন্দ্র। নির্মলার সঙ্গে রসিকবাবুর পরিচয় হয় নি? ইনিই আমাদের কুমারসভার প্রথম স্ত্রীসভ্য।
রসিক। (নমস্কার করিয়া) ইনি আমাদের সভার সভালক্ষ্মী। আপনাদের কল্যাণে আমাদের সভায় বুদ্ধিবিদ্যার অভাব ছিল না, ইনি আমাদের শ্রী দান করতে এসেছেন।