অক্ষয়বাবুর প্রস্তাবে চিরকুমার-সভা প্রফুল্ল হইয়া উঠিল। সভাপতি কহিলেন, “সভ্যপদপ্রার্থীদের নাম ধাম বিবরণ–”
অক্ষয়। অবশ্যই তাঁদের নাম ধাম বিবরণ একটা আছেই– সভাকে তার থেকে বঞ্চিত করতে পারা যাবে না– সভ্য যখন পাবেন তখন নাম ধাম বিবরণ-সুদ্ধই পাবেন। কিন্তু আপনাদের এই একতলার স্যাঁৎসেঁতে ঘরটি স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকূল নয়; আপনাদের এই চিরকুমার ক’টির চিরত্ব যাতে হ্রাস না হয় সে দিকে একটু দৃষ্টি রাখবেন।
চন্দ্রবাবু কিঞ্চিৎ লজ্জিত হইয়া খাতাটি নাকের কাছে তুলিয়া লইয়া বলিলেন, “অক্ষয়বাবু, আপনি জানেন তো আমাদের আয়–”
অক্ষয়। আয়ের কথাটা আর প্রকাশ করবেন না, আমি জানি ও আলোচনাটা চিত্তপ্রফুল্লকর নয়। ভালো ঘরের বন্দোবস্ত করে রাখা হয়েছে সেজন্যে আপনাদের ধনাধ্যক্ষকে স্মরণ করতে হবে না। চলুন-না আজই সমস্ত দেখিয়ে শুনিয়ে আনি।
বিমর্ষ বিপিন-শ্রীশের মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। সভাপতিও প্রফুল্ল হইয়া উঠিয়া চুলের মধ্য দিয়া বার বার আঙুল বুলাইতে বুলাইতে চুলগুলাকে অত্যন্ত অপরিষ্কার করিয়া তুলিলেন। কেবল পূর্ণ অত্যন্ত দমিয়া গেল। সে বলিল, “সভার স্থান-পরিবর্তনটা কিছু নয়।” অক্ষয় কহিলেন, “কেন, এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি করলেই কি আপনাদের চির-কৌমার্যের প্রদীপ হাওয়ায় নিবে যাবে?”
পূর্ণ। এ-ঘরটি তো আমাদের মন্দ বোধ হয় না।
অক্ষয়। মন্দ নয়। কিন্তু এর চেয়ে ভালো ঘর শহরে দুষ্প্রাপ্য হবে না।
পূর্ণ। আমার তো মনে হয় বিলাসিতার দিকে মন না দিয়ে খানিকটা কষ্টসহিষ্ণুতা অভ্যাস করা ভালো।
শ্রীশ কহিল, “সেটা সভার অধিবেশনে না করে সভার বাইরে করা যাবে।”
বিপিন কহিল, “একটা কাজে প্রবৃত্ত হলেই এত ক্লেশ সহ্য করবার অবসর পাওয়া যায় যে, অকারণে বলক্ষয় করা মূঢ়তা।”
অক্ষয়। বন্ধুগণ, আমার পরামর্শ শোনো, সভাঘরের অন্ধকার দিয়ে চিরকৌমার্য ব্রতের অন্ধকার আর বাড়িয়ো না। আলোক এবং বাতাস স্ত্রীলিঙ্গ নয়, অতএব সভার মধ্যে ও-দুটোকে প্রবেশ করতে বাধা দিয়ো না। আরো বিবেচনা করে দেখো, এ স্থানটি অত্যন্ত সরস, তোমাদের ব্রতটি তদুপযুক্ত নয়। বাতিকের চর্চা করছ করো, কিন্তু বাতের চর্চা তোমাদের প্রতিজ্ঞার মধ্যে নয়। কী বল, শ্রীশবাবু বিপিনবাবুর কী মত?
দুই বন্ধু বলিল, “ঠিক কথা। ঘরটা একবার দেখেই আসা যাক-না।”
পূর্ণ বিমর্ষ হইয়া নিরুত্তর রহিল। পাশের ঘরেও চাবি একবার ঠুন করিল, কিন্তু অত্যন্ত অপ্রসন্ন সুরে।
প্রজাপতির নির্বন্ধ ০৫
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
অক্ষয় বলিলেন, “স্বামীই স্ত্রীর একমাত্র তীর্থ। মান কি না?”
পুরবালা। আমি কী পণ্ডিতমশায়ের কাছে শাস্ত্রের বিধান নিতে এসেছি? আমি মার সঙ্গে আজ কাশী চলেছি এই খবরটি দিয়ে গেলুম।
অক্ষয়। খবরটি সুখবর নয়– শোনবামাত্র তোমাকে শাল-দোশালা বকশিশ দিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে না।
পুরবালা। ইস, হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে– না? সহ্য করতে পারছ না?
অক্ষয়। আমি কেবল উপস্থিত বিচ্ছেদের কথা ভাবছি নে– এখন তুমি দুদিন না রইলে, আরো কজন রয়েছেন, একরকম করে এই হতভাগ্যের চলে যাবে। কিন্তু এর পরে কী হবে? দেখো, ধর্মকর্মে স্বামীকে এগিয়ে যেয়ো না– স্বর্গে তুমি যখন ডবল প্রোমোশন পেতে থাকবে আমি তখন পিছিয়ে থাকব– তোমাকে বিষ্ণুদূতে রথে চড়িয়ে নিয়ে যাবে, আর আমাকে যমদূতে কানে ধরে হাঁটিয়ে দৌড় করাবে–
গান। পরজ
স্বর্গে তোমায় নিয়ে যাবে উড়িয়ে,
পিছে পিছে আমি চলব খুঁড়িয়ে।
ইচ্ছা হবে টিকির ডগা ধরে
পুরবালা। আচ্ছা, আচ্ছা, থামো।
অক্ষয়। আমি থামব, কেবল তুমিই চলবে। ঊনবিংশ শতাব্দীর এই বন্দোবস্ত?– নিতান্তই চললে?
পুরবালা। চললুম।
অক্ষয়। আমাকে কার হাতে সমর্পণ করে গেলে?
পুরবালা। রসিকদাদার হাতে।
অক্ষয়। মেয়েমানুষ, হস্তান্তর করবার আইন কিছুই জান না। সেইজন্যেই তো বিরহাবস্থায় উপযুক্ত হাত নিজেই খুঁজে নিয়ে আত্মসমর্পণ করতে হয়।
পুরবালা। তোমাকে তো বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হবে না।
অক্ষয়। তা হবে না।
গান। কাফি
কার হাতে যে ধরা দেব প্রাণ;
তাই ভাবতে বেলা অবসান।
ডান দিকেতে তাকাই যখন, বাঁয়ের লাগি কাঁদে রে মন
বাঁয়ের লাগি ফিরলে তখন দক্ষিণেতে পড়ে টান।
আচ্ছা, আমার যেন সান্ত্বনার গুটি দুই-তিন সদুপায় আছে, কিন্তু তুমি
বিরহ-যামিনী কেমনে যাপিবে,
বিচ্ছেদতাপে যখন তাপিবে
এপাশ ওপাশ বিছানা মাপিবে,
মকরকেতনে কেবলি শাপিবে–
পুরবালা। রক্ষে করো, ও মিলটা ঐখানেই শেষ করো।
অক্ষয়। দুঃখের সময় আমি থামতে পারি নে– কাব্য আপনি বেরোতে থাকে। মিল ভালো না বাস অমিত্রাক্ষর আছে, তুমি যখন বিদেশে থাকবে আমি “আর্তনাদবধ কাব্য’ বলে একটা কাব্য লিখব– সখী, তার আরম্ভটা শোনো–
(সাড়ম্বরে)বাষ্পীয় শকটে চড়ি নারীচূড়ামণি
পুরবালা চলি যবে গেলা কাশীধামে
বিকালে, কহ হে দেবী অমৃতভাষিণী
কোন্ বরাঙ্গনে বরি বরমাল্যদানে
যাপিলা বিচ্ছেদমাস শ্যালীত্রয়ীশালী
শ্রীঅক্ষয়!
পুরবালা। (সগর্বে) আমার মাথা খাও, ঠাট্টা নয়, তুমি একটা সত্যিকার কাব্য লেখো-না।
অক্ষয়। মাথা খাওয়ার কথাটা যদি বললে, আমি নিজের মাথাটি খেয়ে অবধি বুঝেছি ওটা সুখাদ্যের মধ্যে গণ্য নয়। আর ঐ কাব্য লেখা, ও কার্যটাও সুসাধ্য বলে জ্ঞান করি নে। বুদ্ধিতে আমার এক জায়গায় ফুটো আছে, কাব্য জমতে পারে না– ফস ফস করে বেরিয়ে পড়ে।