এলা আর-একবার অখিলকে কাছে টেনে নিয়ে বললে, “আমার জন্যে ভাবিস নে ভাই। তোর অন্তুদা রইল, কোনো ভয় নেই।”
অখিলকে যখন ঠেলে নিয়ে অতীন চলেছে এলা বললে,”আমিও যাই তোমার সঙ্গে অন্তু।”
আদেশের স্বরে অতীন বললে, “না, কিছুতেই না।”
ছাদের ছোটো পাঁচিলটার উপর বুক চেপে ধরে এলা দাঁড়িয়ে রইল–কণ্ঠের কাছে গুমরে গুমরে উঠতে লাগল কান্না, বুঝলে আজ রাত্রে ওর কাছ থেকে চিরকালের মতো অখিল গেল চলে।
ফিরে এল অতীন। এলা জিজ্ঞাসা করলে, “কী হল, অন্তু?”
অতীন বললে “অখিল গেছে। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছি।”
“আর সেই লোকটি?”
“তাকেও দিয়েছি ছেড়ে। সে বসে বসে ভাবছিল কাজে ফাঁকি দিয়ে আমি বুঝি কেবল গল্পই করছি। যেন নতুন একটা আরব্য উপন্যাস শুরু হয়েছে। আরব্য উপন্যাসই বটে। সমস্তটাই গল্প, একেবারেই আজগবি গল্প। ভয় করছে এলা? আমাকে ভয় নেই তোমার?”
“তোমাকে ভয়, কী যে বল।”
“কী না করতে পারি আমি! পড়েছি পতনের শেষ সীমায়। সেদিন আমাদের দল অনাথা বিধবার সর্বস্ব লুঠ করে এনেছে। মন্মথ ছিল বুড়ীর গ্রামসম্পর্কে চেনা লোক–খবর দিয়ে পথ দেখিয়ে সে-ই এনেছে দলকে। ছদ্মবেশের মধ্যেও বিধবা তাকে চিনতে পেরে বলে উঠল, মনু, বাবা তুই এমন কাজ করতে পারলি? তার পরে বুড়ীকে আর বাঁচতে দিলে না। যাকে বলি দেশের প্রয়োজন সেই আত্মধর্মনাশের প্রয়োজনে টাকাটা এই হাত দিয়েই পৌছেছে যথাস্থানে। আমার উপবাস ভেঙেছি সেই টাকাতেই। এতদিন পরে যথার্থ দাগি হয়েছি চোরের কলঙ্কে, চোরাই মাল ছুঁয়েছি, ভোগ করেছি। চোর অতীন্দ্রের নাম বটু ফাঁস করে দিয়েছে। পাছে প্রমাণাভাবে শাস্তি না পাই বা অল্প শাস্তি পাই সেইজন্য পুলিস-সুপারিন্টেণ্ডেন্টের মারফত সে-মকদ্দমা ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে দায়ের না হয়ে যাতে বাঙালি জয়ন্ত হাজরার এজলাসে ওঠে কমিশনরের কাছ থেকে সেই হুকুম আনাবে বলে মন্ত্রণা করে রেখেছে। সে নিশ্চিত জানে, কাল ধরা পড়বই। ইতিমধ্যে ভয় করো আমাকে, আমি নিজে ভয় করি আমার মৃত আত্মার কালো ভূতটাকে। আজ তোমার ঘরে কেউ নেই।”
“কেন, তুমি আছ।”
“আমার হাত থেকে বাঁচাবে কে?”
“নেই বা বাঁচালে।”
“তোমারই আপন মণ্ডলীতে একদিন যারা ছিল এলাদির সব দেশভাই–ভাইফোঁটা দিয়েছ যাদের কপালে প্রতিবৎসর–তাদেরই মধ্যে কথা উঠেছে যে তোমার বেঁচে থাকা উচিত নয়।”
“তাদের চেয়ে বেশি অপরাধ আমি কী করেছি?”
“অনেক কথা জান তুমি, অনেকের নামধাম। পীড়ন করলে বেরিয়ে পড়বে।”
“কখনোই না।”
“কী করে বলব যে-মানুষটা এসেছিল আজ, এই হুকুম নিয়েই সে আসে নি? হুকুমের জোর কত সে তো জান তুমি।”
এলা চমকে উঠে বললে, “সত্যি বলছ অন্তু, সত্যি?”
“একটা খবর পেয়েছি আমরা।”
“কী খবর?”
“আজ ভোররাত্রে পুলিস আসবে তোমাকে ধরতে।”
“নিশ্চিত জানতুম একদিন পুলিস আমাকে ধরতে আসছে।”
“কেমন করে জানলে?”
“কাল বটুর চিঠি পেয়েছি, সে খবর দিয়েছে পুলিস আমাকে ধরবে, লিখেছে–সে এখনও আমাকে বাঁচাতে পারে।”
“কী উপায়ে?”
“বলছে, যদি তাকে বিয়ে করি তাহলে সে আমার জামিন হয়ে আমার দায় গ্রহণ করবে।”
অন্ধকার হয়ে উঠল অতীনের মুখ, জিজ্ঞাসা করলে, “কী জবাব দিলে তুমি?”
এলা বললে, “আমি সেই চিঠির উপর কেবল লিখে দিলুম পিশাচ। আর-কিছু নয়।”
“খবর পেয়েছি, সেই বটুই আসবে কাল পুলিসকে সঙ্গে নিয়ে। তোমার সম্মতি পেলেই বাঘের সঙ্গে রফা করে তোমাকে কুমিরের গর্তে আশ্রয় দেবার হিতব্রতে সে উঠে পড়ে লাগবে। তার হৃদয় কোমল।”
এলা অতীনের পা জড়িয়ে ধরে বললে, “মারো আমাকে অন্তু, নিজের হাতে। তার চেয়ে সৌভাগ্য আমার কিছু হতে পারে না।” মেঝের থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অতীনকে বার বার চুমো খেয়ে বললে, “মারো এইবার মারো।” ছিঁড়ে ফেললে বুকের জামা।
অতীন পাথরের মূর্তির মতো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
এলা বললে, “একটুও ভেবো না অন্তু। আমি যে তোমার, সম্পূর্ণই তোমার– মরণেও তোমার। নাও আমাকে। নোংরা হাত লাগতে দিয়ো না আমার গায়ে, আমার এ দেহ তোমার।”
অতীন কঠিন সুরে বললে, “যাও এখনই শুতে যাও, হুকুম করছি শুতে যাও।”
অতীনকে বুকে চেপে ধরে এলা বলতে লাগল।–“অন্তু, অন্তু আমার, আমার রাজা, আমার দেবতা, তোমাকে কত ভালোবেসেছি আজ পর্যন্ত সম্পূর্ণ করে তা জানাতে পারলুম না। সেই ভালোবাসার দোহাই, মারো, আমাকে মারো।”
অতীন এলার হাত জোর করে ধরে তাকে শোবার ঘরে টেনে নিয়ে গেল, বললে, “শোও, এখনই শোও। ঘুমোও।”
“ঘুম হবে না।”
“ঘুমোবার ওষুধ আছে আমার হাতে।”
“কিচ্ছু দরকার নেই অন্তু। আমার চৈতন্যের শেষ মুহূর্ত তুমিই নাও। ক্লোরোফর্ম এনেছ? দাও ওটাকে ফেলে। ভীরু নই আমি; জেগে থেকে যাতে মরি তোমার কোলে তাই করো। শেষ চুম্বন আজ অফুরান হল অন্তু। অন্তু।”
দূরের থেকে হুইস্লের শব্দ এল।