“কোন্টা লক্ষ্য কোন্টা উপলক্ষ্য বাইরে থেকে বিচার করো না অন্তু। শাস্তির যোগ্য আমি, কিন্তু অন্যায় শাস্তির না। মনে নেই তোমার, সেইবারকার জন্মদিনেই অতীন্দ্রবাবু আমার মুখে নাম নিলেন অন্তু? সেটা তো খুব ছোটো কথা নয়। তোমার অন্তু নামের ইতিহাসটা বলো শুনি।”
“সখী, তবে শ্রবণ করো। তখন বয়স আমার চার পাঁচ বছর, মাথায় ছিলুম ছোটো, কথা ছিল না মুখে, শুনেছি বোকার মতো ছিল চোখের চাহনি। জ্যেঠামশায় পশ্চিম থেকে এসে আমাকে প্রথম দেখলেন। কোলে তুলে নিলেন, বললেন, এই বালখিল্যটার নাম অতীন্দ্র রেখেছে কে? অতিশয়োক্তি অলংকার, এর নাম দাও অনতীন্দ্র। সেই অনতি শব্দটা স্নেহের কণ্ঠে অন্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। তোমার কাছেও একদিন অতি হয়েছে অনতি, ইচ্ছে করে খুইয়েছে মান।”
হঠাৎ অতীন চমকে উঠে থেমে গেল। বললে, “পায়ের শব্দ শুনছি যেন।”
এলা বললে, “অখিল।”
আওয়াজ এল, “দিদিমণি।”
ছাদে আসবার দরজা খুলে দিয়ে এলা জিজ্ঞাসা করলে, “কী।”
অখিল বললে, “খাবার।”
বাড়িতে রান্নার ব্যবস্থা নেই। অদূরবর্তী দিশি রেস্টোরাঁ থেকে বরাদ্দমত খাবার দিয়ে যায়।
এলা বললে, “অন্তু, চলো খেতে।”
“খাওয়ার কথা বলো না। না খেয়ে মরতে মানুষের অনেকদিন লাগে। নইলে ভারতবর্ষ টিঁকত না। ভাই অখিল, আর রাগ রেখো না মনে। আমার ভাগটা তুমিই খেয়ে নাও। তার পরে পলায়নেন সমাপয়েৎ–দৌড় দিয়ো যত পার।”
অখিল চলে গেল।
দুজনে ছাদের মেঝের উপর বসল। অতীন আবার শুরু করলে। “সেদিনকার জন্মদিন চলতে লাগল একটানা, কেউ নড়বার নাম করে না। আমি ঘন ঘন ঘড়ি দেখছি, ওটা একটা ইঙ্গিত রাতকানাদের কাছে। শেষকালে তোমাকে বললুম, সকাল সকাল তোমার শুতে যাওয়া উচিত, এই সেদিন ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে উঠেছ। –প্রশ্ন উঠল, “কটা বেজেছে?’ উত্তর “সাড়ে দশটা।’ সভা ভাঙবার দুটো-একটা হাইতোলা গড়িমসি-করা লক্ষণ দেখা গেল। বটু বললে, বসে রইলেন যে অতীনবাবু? চলুন একসঙ্গে যাওয়া যাক্। –কোথায়? না, মেথরদের বস্তিতে; হঠাৎ গিয়ে পড়ে ওদের মদ খাওয়া বন্ধ করতে হবে। –সর্বশরীর জ্বলে উঠল। বললুম, মদ তো বন্ধ করবে, তার বদলে দেবে কী।–বিষয়টা নিয়ে এতটা উত্তেজিত হবার দরকার ছিল না। ফল হল, যারা চলে যাচ্ছিল তারা দাঁড়িয়ে গেল। শুরু হল–আপনি কি তবে বলতে চান–তীব্রস্বরে বলে উঠলুম–কিছু বলতে চাই নে।–এতটা বেশি ঝাঁজও বেমানান হল। গলা ভারি করে তোমার দিকে আধখানা চোখে চেয়ে বললুম, তবে আজ আসি। দোতলায় তোমার ঘরের সামনে পর্যন্ত এসে পা চলতে চায় না। কী বুদ্ধি হল বুকের পকেট চাপড়িয়ে বললুম, ফাউন্টেন পেনটা বুঝি ফেলে এসেছি। বটু বললে, আমিই খুঁজে আনছি– বলেই দ্রুত চলে গেল ছাদে। পিছু পিছু ছুটলুম আমি। খানিকটা খোঁজবার ভান করে বটু ঈষৎ হেসে বললে, দেখুন তো বোধ করি পকেটেই আছে। নিশ্চিত জানতুম আমার ফাউন্টেন পেনটা আবিষ্কার করতে হলে ভূগোল সন্ধানের প্রয়োজন আমার নিজের বাসাতেই। স্পষ্ট বলতে হল, এলাদির সঙ্গে বিশেষ কথা আছে। বটু বললে, বেশ তো অপেক্ষা করছি। আমি বললুম, অপেক্ষা করতে হবে না, যাও। বটু ঈষৎ হেসে বললে, রাগ করেন কেন অতীনবাবু, আমি চললুম।”
আবার পায়ের শব্দ শুনে অতীন চমকে উঠে থামল। অখিল এল ছাদে। বললে, “কে একজন এই চিরকুট দিয়েছে অতীনবাবুকে। তাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখেছি।
এলার বুক ধড়াস করে উঠল, বললে, “কে এল?”
অতীন বললে, বাবুকে ঢুকতে দাও ঘরে।” অখিল জোরের সঙ্গে বললে, “না, দেব না।”
অতীন বললে, “ভয় নেই, বাবুকে তুমি চেন; অনেকবার দেখেছ।”
“না চিনি নে।”
“খুব চেন। আমি বলছি, ভয় নেই, আমি আছি।”
এলা বললে, “অখিল, যা তুই মিথ্যে ভয় করিস নে।”
অখিল চলে গেল।
এলা জিজ্ঞাসা করলে, “বটু এসেছে না কি?”
“না বটু নয়।”
“বলো না, কে এসেছে। আমার ভালো লাগছে না।”
“থাক্ সে-কথা, যা বলছিলুম বলতে দাও।”
“অন্তু, কিছুতেই মন দিতে পারছি নে।”
“এলা, শেষ করতে দাও আমার কাহিনী। বেশি দেরি নেই।–তুমি উঠে এলে ছাদে। মৃদুগন্ধ পেলুম রজনীগন্ধার। ফুলের গুচ্ছটি সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলে একলা আমার হাতে দেবে বলে। আমাদের সম্বন্ধের ক্ষেত্রে অন্তুর জীবনলীলা শুরু হল এই লাজুক ফুলের গোপন অভ্যর্থনায়, তার পর থেকে অতীন্দ্রনাথের বিদ্যাবুদ্ধি গাম্ভীর্য ক্রমে ক্রমে তলিয়ে গেল অতলস্পর্শ আত্মবিস্মৃতিতে। সেইদিন প্রথম তুমি আমার গলা জড়িয়ে ধরলে, বললে, এই নাও জন্মদিনের উপহার–সেই পেয়েছি প্রথম চুম্বন। আজ দাবি করতে এসেছি শেষ চুম্বনের।”
অখিল এসে বললে, “বাবুটি দরজায় ধাক্কা মারতে শুরু করেছে। ভাঙল বুঝি। বলছে, জরুরি কথা।”
“ভয় নেই অখিল, দরজা ভাঙবার আগেই তাকে ঠাণ্ডা করব। বাবুকে ওইখানেই অনাথ করে রেখে তুমি এখনই পালাও অন্য ঠিকানায়। আমি আছি এলাদির খবর নিতে।”
এলা অখিলকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে তার মাথায় চুমো খেয়ে বললে, “সোনা আমার, লক্ষ্ণী আমার, ভাই আমার, তুই চলে যা। তোর জন্যে কখানা নোট আমার আঁচলে বেঁধে রেখেছি, তোর এলাদির আশীর্বাদ। আমার পা ছুঁয়ে বল্, এখনই তুই যাবি, দেরি করবি নে।”
অতীন বললে, “অখিল আমার একটি পরামর্শ তোমাকে শুনতেই হবে। যদি তোমাকে কখনো কোনো প্রশ্ন কেউ জিজ্ঞাসা করে তুমি ঠিক কথাই বলবে। বলো এই রাত এগারোটার সময় আমিই তোমাকে জোর করে এ-বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি। চলো কথাটাকে সত্য করে আসি।”