“কিছুকাল থেকে এই ভয়ংকর ট্র৻াজেডির চেহারা আমার কাছেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে অন্তু। গৌরবের আহ্বানে নেমেছিলেম কিন্তু লজ্জা বেড়ে উঠছে প্রতিদিন। এখন আমরা কী করতে পারি বলো আমাকে।”
“সব মানুষের সামনেই ধর্মক্ষেত্রে ধর্মযুদ্ধ আছে, সেখানে মৃতো বাপি তেন লোকত্রয়ং জিতং। কিন্তু অন্তত আমাদের কজনের জন্যে এ-যাত্রায় সে-ক্ষেত্রের পথ বন্ধ। এখানকার কর্মফল এখানেই নিঃশেষে চুকিয়ে দিয়ে যেতে হবে।”
“সব বুঝতে পারছি, তবু অন্তু আমাদের দেশের কাজ নিয়ে কিছুদিন থেকে এমন কঠিন ধিক্কার দিয়ে তুমি কথা বল, সে আমাকে বড়ো বাজে।”
“তার কারণ কী সে-কথা এখন আর না বললেও হয়, সময় চলে গেছে।”
“তবু বলো।”
“আমি আজ স্বীকার করব তোমার কাছে,–তোমরা যাকে পেট্রিয়ট বলো আমি সেই পেট্রিয়ট নই। পেট্রিয়টিজ্মের চেয়ে যা বড়ো তাকে যারা সর্বোচ্চে না মানে তাদের পেট্রিয়টিজ্ম কুমিরের পিঠে চড়ে পার হবার খেয়ানৌকো। মিথ্যাচরণ, নীচতা, পরস্পরকে অবিশ্বাস, ক্ষমতালাভের চক্রান্ত, গুপ্তচরবৃত্তি একদিন তাদের টেনে নিয়ে যাবে পাঁকের তলায়। এ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এই গর্তর ভিতরকার কুশ্রী জগৎটার মধ্যে দিনরাত মিথ্যের বিষাক্ত হাওয়ায় কখনোই নিজের স্বভাবে সেই পৌরুষকে রক্ষা করতে পারব না যাতে পৃথিবীতে কোনো বড়ো কাজ করতে পারা যায়।”
“আচ্ছা অন্তু, তুমি যাকে আত্মঘাত বল সে কি আমাদেরই দেশে?”
“তা বলি নে। দেশের আত্মাকে মেরে দেশের প্রাণ বাঁচিয়ে তোলা যায় এই ভয়ংকর মিথ্যে কথা পৃথিবীসুদ্ধ ন্যাশনালিস্ট আজকাল পাশবগর্জনে ঘোষণা করতে বসেছে, তার প্রতিবাদ আমার বুকের মধ্যে অসহ্য আবেগে গুমরে গুমরে উঠছে–এই কথা সত্যভাষায় হয়তো বলতে পারতুম, সুরঙ্গের মতো লুকোচুরি করে দেশ-উদ্ধারচেষ্টার চেয়ে সেটা হত চিরকালের বড়ো কথা। কিন্তু এ-জন্মের মতো বলবার সময় হল না। আমার বেদনা তাই আজ এত নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে।”
এলা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে, বললে, “ফিরে এস অন্তু।”
“আর ফেরবার পথ নেই।”
“কেন নেই?”
“অজায়গায় যদি এসে পড়ি সেখানকারও দায়িত্ব আছে শেষ পর্যন্ত।”
এলা অতীনের গলা জড়িয়ে ধরে বললে, “ফিরে এস, অন্তু। এত বছর ধরে যে-বিশ্বাসের মধ্যে বাসা নিয়েছিলুম তার ভিত তুমি ভেঙে দিয়েছ। আজ আছি ভেসে-চলা ভাঙা নৌকো আঁকড়িয়ে। আমাকেও উদ্ধার করে নিয়ে যাও। –অমন চুপ করে বসে থেকো না, বলো অন্তু, একটা কথা বলো। এখনই তুমি হুকুম করো আমি ভাঙব পণ। ভুল করেছি আমি। আমাকে মাপ করো।”
“উপায় নেই।”
“কেন উপায় নেই? নিশ্চয় আছে।”
“তীর লক্ষ্য হারাতে পারে তূণে ফিরতে পারে না।”
“আমি স্বয়ংবরা, আমাকে বিয়ে করো অন্তু। আর সময় নষ্ট করতে পারব না– গান্ধর্ব বিবাহ হোক, সহধর্মিণী করে নিয়ে যাও তোমার পথে।”
“বিপদের পথ হলে নিয়ে যেতুম সঙ্গে। কিন্তু যেখানে ধর্মনষ্ট হয়েছে সেখানে তোমাকে সহধর্মিণী করতে পারব না।–থাক্ থাক্ ও-সব কথা থাক্। এ-জীবনের নৌকোডুবির অবসানে কিছু সত্য এখনও বাকি আছে। তারই কথাটা শুনি তোমার মুখে।”
“কী বলব?”
“বলো, তুমি ভালোবেসেছ।”
“হাঁ বেসেছি।”
“বলো, আমি তোমাকে ভালোবেসেছি সে-কথা তোমার মনে থাকবে আমি যখন থাকব না তখনও।”
এলা নিরুত্তরে চুপ করে বসে রইল, জল পড়তে লাগল দুই চোখে। অনেকক্ষণ পরে বাষ্পরুদ্ধ গলায় বললে, “আবার বলছি, অন্তু, কিছু নাও আমার হাত থেকে–নাও এই আমার গলার হার।”
এই বলে পায়ের উপর রাখল হার।
“কিছুতেই না।”
“কেন, অভিমান?”
“হাঁ, অভিমান। এমন দিন ছিল তখন যদি দিতে, পরতুম গলায়–আজ দিলে পকেটে, অন্নাভাবের গর্তটার মধ্যে। ভিক্ষে নেব না তোমার কাছে।”
এলা অতীনের পায়ের কাছে লুটিয়ে বললে, “নাও আমাকে তোমার সঙ্গিনী করে।”
“লোভ দেখিয়ো না, এলা। অনেকবার বলেছি আমার পথ তোমার নয়।”
“তবে সে-পথ তোমারও নয়। ফিরে এস, ফিরে এস।”
“পথ আমার নয়, আমিই পথের। গলার ফাঁসকে গলার গয়না কেউ বলে না।”
“অন্তু, নিশ্চয় জেনো, তুমি চলে গেলে একমুহূর্ত আমি বাঁচব না। তুমি ছাড়া আর কেউ নেই আমার, এ-কথায় আজ যদি বা সন্দেহ কর, একান্ত মনে আশা করি মৃত্যুর পরে সে সন্দেহ সম্পূর্ণ ঘোচাবার একটা কোনো রাস্তা কোথাও আছে।”
হঠাৎ অতীন লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। তীরের মতো তীক্ষ্ণ হুইস্লের শব্দ এল দূর থেকে। চমকে বলে উঠল, “চললুম।”
এলা তাকে জড়িয়ে ধরলে, বললে, “আর-একটু থাকো।”
“না।”
“কোথায় যাচ্ছ?”
“কিচ্ছু জানি নে।”
এলা অতীনের পা জড়িয়ে ধরে বললে, “আমি তোমার সেবিকা, তোমার চরণের সেবিকা, আমাকে ফেলে যেয়ো না, ফেলে যেয়ো না।”
একটুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রইল অতীন। দ্বিতীয়বার হুইস্লের শব্দ এল। অতীন গর্জন করে বললে, “ছেড়ে দাও।” বলে নিজেকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেল।
তখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। এলা মেঝের উপর উপুড় হয়ে পড়ে। তার বুকের ভিতরটা শুকিয়ে গেছে, তার চোখে জল নেই। এমন সময় গম্ভীর গলায় ডাক শুনতে পেল, “এলা।”
চমকে উঠে বসল। দেখলে ইলেকট্রিক টর্চ হাতে ইন্দ্রনাথ। তখনই উঠে দাঁড়িয়ে বললে, “ফিরিয়ে আনুন অন্তুকে।”
“সে-কথা থাক্। এখানে কেন এলে?”
“বিপদ আছে জেনেই এসেছি।”
তীব্র ভর্ৎসনার সুরে ইন্দ্রনাথ বললেন, “তোমার বিপদের কথা কে ভাবছে? এখানকার খবর তোমাকে কে দিলে?”
“বটু।”
“তবু বুঝলে না মতলব?”
“বোঝবার বুদ্ধি আমার ছিল না। প্রাণ হাঁপিয়ে উঠেছিল।”