তাহলে টেলিফোনটা কে করেছে। হাব্বত আলি? রনি টেলিফোন ধরতেই ওপাশ থেকে মিষ্টি গলায় কেউ একজন বলল,
রনি
কনি
মনি
লানি
মিস নাজমা ম্যাডাম যে রকম করে বলতেন অবিকল সেরকম করে বলা। তবে নাজমা ম্যাডাম টেলিফোন করেন নি। অন্য কেউ করেছে। রনি বলল, হ্যালো কে?
আমি লুতপা।
তুমি আমার টেলিফোন নাম্বার কোথায় পেয়েছ?
স্কুল থেকে নিয়েছি। কেন নিয়েছ?
তুমি রাগ করছ কেন?
রনি বলল, কেউ টেলিফোন করলে আমার ভালো লাগে না।
লুতপা বলল, আমার খুব মন খারাপ এইজন্যে তোমাকে টেলিফোন করেছি।
মন খারাপ কেন?
মিস নাজমা ম্যাডাম আমাদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে যা রাইম বলতেন তার অর্থ বের করেছি। তারপর থেকেই আমার মন খারাপ।
রনি বলল, কী অর্থ বের করেছ?
লুতপা বলল, মিস তোমাকে কী বলে ডাকতেন?
রনি!
কনি
মনি
লানি।
কনি মনি লানি এর প্রথম অক্ষরগুলি মিলে কী হয়? কমলা হয় না? ম্যাডাম তোমাকে কমলা ডাকতেন। তোমার গায়ের রঙ টুকটুকে কমলার মতো, এইজন্য কমলা ডাকতেন।
ও আচ্ছা।
পুতুলকে কী ডাকতেন মনে আছে? পুতুলকে ডাকতেন—
পুতুল!
তুতুল
লতুল
তুতুললতুল।
প্রথম অক্ষরগুলি নিলে কী হয়? তুলতুল হয় না? পুতুলকে দেখলেই মনে হয় না–গা তুলতুল করছে?
হ্যাঁ মনে হয়।
আর আমাকে ডাকতেন—
লুতপা!
মতপা
য়তপা
নাতপা
এর মানে কী?
রনি বলল, ময়না।
লুতপা বলল, আমার খুব বুদ্ধি, তাই না?
রনি বলল, হুঁ।
লুতপা বলল, আমার বাবা আমাকে কী ডাকে জানো?
রনি বলল, জানতে চাই না।
লুতপা বলল, এমন কর কেন, শোনো না–আমার বাবা আমাকে ডাকে বুদ্ধিরানী।
রনি বলল, লুতপা শোনো তুমি আর কোনোদিন আমাকে টেলিফোন করবে না।
লুতপা বলল, কেন করব না?
রনি বলল, আমার ভালো লাগে না। আরেকটা কথা শোনো, মিস নাজমা ম্যাডাম মারা যান নি। বেঁচে আছেন।
কে বলেছে? যেই বলুক, ঘটনা সত্যি।
এই বলেই সে টেলিফোন রেখে দিল। অবশ্যি টেলিফোনটা রাখার পর তার একটু মন খারাপ হলো। এমন খারাপ ব্যবহার না করলেই হতো। তার ইচ্ছা করতে লাগল লুতপাকে টেলিফোন করে সরি বলতে। কিন্তু সে তো তার টেলিফোন নাম্বার জানে না। রনি ঠিক করল, আগামীকাল যখন স্কুলে যাবে তখন সে সরি বলবে। কিংবা একটা ফরগিভ মি কার্ড দেবে। কম্পিউটারে সুন্দর সুন্দর কার্ড সে নিজেই তৈরি করতে পারে।
লুতপার কার্ডে একটা ছেলের ছবি থাকবে। ছেলেটার চোখে পানি। নিচে লেখা থাকবে–FORGIVE ME PLEASE.
রনিদের বাড়িতে মোটামুটি হৈচৈ পড়ে গেছে
রনিদের বাড়িতে মোটামুটি হৈচৈ পড়ে গেছে। মিটিং-এর পর মিটিং শুরু হয়েছে। সবাই আলাদা আলাদা করে রনিকে নিয়ে বসছে। প্রথমে বসলেন রনির মা। তিনি কথাবার্তা বলছেন খুব আদুরে গলায়। এমন ভাব যেন কিছুই হয় নি। ছেলের সঙ্গে গল্প করতে বসেছেন।
বাবা, ঠিক করে বলো তো তুমি কার সঙ্গে বাড়িতে এসেছ?
একটা লোকের সঙ্গে।
একটা লোকের সঙ্গে তুমি যে এসেছ সেটা তো আগেই বলেছ। লোকটার নাম কী? নাম বলো।
রনি চুপ করে গেল। নাম সে জানে। হাত আলি। কিন্তু হাব্বত আলির নাম শুনলেই মা রেগে যাবেন। মানুষটাকে আর কখনো বাড়িতে ঢুকতে দেবেন না। কাজেই নাম না বলাই ভালো।
রনি, লোকটার নাম বলো।
নাম মনে নেই।
সে কি তার নাম তোমাকে বলেছিল?
মনে নেই।
তোমার সবকিছু মনে থাকে, এটা কেন মনে নেই? সে তোমাকে রিকশায় করে এনেছে?
হুঁ।
রিকশায় উঠে তোমাকে কি কিছু খেতে দিয়েছিল? শরবত জাতীয় কিছু? যেটা খাওয়ার পর তোমার আর কিছু মনে নেই।
না।
সে রিকশায় করে তোমাকে সরাসরি এই বাড়িতে নিয়ে এসেছে?
না।
তাহলে কোথায় নিয়ে গেছে?
রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে।
কোথায় কোথায় ঘুরেছে মনে করতে পার?
না।
না কেন?
আমি চোখ বন্ধ করে ছিলাম তো।
কী সর্বনাশ! চোখ বন্ধ করে ছিলে কেন?
উনি আমাকে চোখ বন্ধ করে রাখতে বললেন।
আশ্চর্য কথা! চোখ বন্ধ করে থাকতে বলেছে কেন?
রিকশায় চোখ বন্ধ করে থাকলে মনে হবে হাওয়ায় উড়ছি–এইজন্যে চোখ বন্ধ করে থাকতে বলেছেন।
সে কি আবারো তোমার সঙ্গে দেখা করবে এরকম কিছু বলেছে?
হুঁ।
কী বলেছে?
বলেছেন প্রতি বুধবার তার সঙ্গে দেখা হবে।
কী বলছ এইসব? আমার তো হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।
রনির মা মুখ কালো করে ফেললেন। তিনি যে খুবই ভয় পাচ্ছেন এটা রনি বুঝতে পারছে। তাকে ভয় দেখাতে পেরে রনির ভালো লাগছে। এখন তার সবাইকে ভয় দেখাতে ইচ্ছা করছে।
লোকটার সঙ্গে কী কী কথা হয়েছে আমাকে গুছিয়ে বলো। কিছুই বাদ দেবে না।
উনি আমাকে মন ভালো করার কৌশল শিখিয়েছেন।
কী কৌশল?
ঘোঁৎ কৌশল।
সালমা বানু অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
রনির মার পর কথা বলতে এলেন রনির বাবা। তিনি কথাবার্তা বললেন কঠিন গলায়। তাকে তখন মনে হচ্ছিল গোয়েন্দা অফিসার। আর রনি হলো ভয়ঙ্কর এক অপরাধী।
রনি শোনো, আমি তোমার স্কুলের মিসের সঙ্গে কথা বলেছি। তোমাদের প্রিন্সিপ্যালের সঙ্গে কথা বলেছি। তোমাদের মিস বলেছেন তুমি খুব আনন্দের সঙ্গে ঐ লোকের সঙ্গে গেছ। তুমি তোমার মিসকে বলেছ ঐ লোক তোমার আত্মীয়। বলেছ এমন কথা?
না।
তাহলে কি তুমি বলতে চাও তোমার মিস মিথ্যা কথা বলেছেন?
হ্যাঁ।
তুমি অচেনা একজন লোকের সঙ্গে বের হয়ে গেলে কেন?
জানি না কেন।
সে বলল আর তুমি সুড়সুড় করে তার সঙ্গে রিকশায় উঠে গেলে?
হ্যাঁ।
কেন উঠলে?
জানি না।
লোকটা একা ছিল, না তার সঙ্গে দলবল ছিল?
একা ছিল। দলবল নিয়ে একটা রিকশায় করে যে যাবে কীভাবে?