তুতুল
লতুল
রনি একবার সাহস করে নাজমা ম্যাডামকে বলেছিল, মিস আপনি আমাদের এইভাবে ডাকেন কেন?
নাজমা ম্যাডাম বললেন, এইভাবে ডাকার পেছনে আমার সুন্দর একটা কারণ আছে। যেদিন তোমরা এই ক্লাস থেকে পাশ করে ওপরের ক্লাসে যাবে সেদিন কারণটা বলব। তোমাদের মজা লাগবে।
কারণটা না জানিয়ে ম্যাডাম মারা গেলেন। কোনোদিনই আর কারণটা জানা যাবে না।
রনিদের ক্লাস টিচার (মিস দিলশাদ) করুণ করুণ মুখ করে বললেন, তোমরা ক্লাসে চুপচাপ বসে থাকো। হৈচৈ করবে না। প্লে গ্রাউন্ডেও যেতে পার তবে খেলাধুলা করবে না। তোমাদের একজন টিচার মারা গেছেন, এইসময় কি আনন্দ করা উচিত? তোমাদের সবার বাড়িতে ফোন করা হবে, যাতে তোমাদের গার্জিয়ানরা এসে তোমাদের নিয়ে যায়। ঠিক আছে লিটিল এনজেলস? মিস দিলশাদ সবার সঙ্গে খুব মিষ্টি করে কথা বলেন। তিনি সবার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। তবু কেউ তাকে পছন্দ করে না।
রনিদের ক্লাসের একটি মেয়ে (লুতপা, খুব ভালো ম্যাথ জানে। ম্যাথে সে সবসময় একশতে একশ পায়। তাকে সবাই ডাকে লুতপাইন। আইনস্টাইনের নামের সঙ্গে মিল করে লুতপাইন)। লুতপাইন বলল, নাজমা ম্যাডাম কীভাবে মারা গেছেন?
দিলশাদ মিস বললেন, কীভাবে মারা গেছেন সেটা বড়দের ব্যাপার। তোমরা ছোটরা এইসব নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাবে না। ঠিক আছে মেয়ে?
লুতপাইন বলল, আমার জানতে ইচ্ছা করছে।
লিটল এনজেল, একবার তো বলেছি কিছু ব্যাপার বড়রা জানবে। কিছু জানবে ছোটরা। এই নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন না।
নাজমা ম্যাডাম কীভাবে মারা গেছেন কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা সবাই জেনে গেল। স্কুলের দারোয়ান-আয়া সবাই বলাবলি করছে। উনি মারা গেছেন রোড এক্সিডেন্টে। রিকশা করে যাচ্ছিলেন, পেছন থেকে একটা প্রাইভেট গাড়ি তাকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়।
রনির অসম্ভব মন খারাপ হলো। কান্না পেতে লাগল। ক্লাসের এতগুলি ছেলেমেয়ের সামনে কেঁদে ফেলা খুব খারাপ। সে চেষ্টা করতে লাগল যেন কাঁদে। সে ঠোঁট কামড়ে ধরে ক্লাসঘরের সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইল। চোখের পাতা ফেলল না। এতে চোখে যে পানি জমে আছে তা শুকিয়ে যাবার কথা। রনির পাশেই বসেছে লুতপাইন। লুতপাইন অবাক হয়ে বলল, কী দেখ?
রনি বলল, ফ্যান দেখি।
ফ্যান দেখ কেন?
এমনি দেখি।
লুতপাইনও রনির মতো ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইল। লুতপাইন খুব ভালো মেয়ে কিন্তু তার কিছু খারাপ অভ্যাস আছে। রনি যা করবে সেও তাই করবে। এখন যদি রনি চোখ নামিয়ে জানালা দিয়ে তাকায়, লুতপাইনও জানালা দিয়ে তাকাবে।
রনিদের ক্লাসে কে কোথায় বসবে সব ঠিক করা। যদি ঠিক করা না থাকত তাহলে অবশ্যই রনি অন্য কোথাও বসত। লুতপাইনের পাশে বসত না।
লুতপাইন বলল, তুমি কাঁদছ কেন?
রনি বলল, কাঁদছি না তো।
তোমার চোখে পানি। তোমার কি মিস নাজমা ম্যাডামের জন্য খারাপ লাগছে?
রনি বলল, হুঁ।
খারাপ লাগছে কেন?
জানি না।
লুতপাইন বলল, আমি জানি। ম্যাডাম আমাদের সবার নাম দিয়ে ছড়া বানাতেন। কেন বানাতেন সেটা তিনি বলবেন বলেছিলেন–এইজন্য তোমার খারাপ লাগছে। কারণ তিনি তো আর বলতে পারবেন না।
রনি বলল, আমার সঙ্গে এত কথা বলবে না। আমার ভালো লাগে না।
লুতপাইন বলল, আচ্ছা আর কথা বলব না।
রনি বলল, আমার দিকে এইভাবে তাকিয়েও থাকবে না। কেউ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমার ভালো লাগে না।
আচ্ছা।
গার্জিয়ানরা আসতে শুরু করেছেন। একে একে ছেলেমেয়েরা সব চলে যাচ্ছে। ক্লাসরুম ফাঁকা। এখন ক্লাসে আছে শুধু রনি আর লুতপাইন। বাকিরা প্লে গ্রাউন্ডে খেলছে। ধরাধরি খেলা। একজন বলবে ধর আমাকে ধর, ওমনি বাকি সবাই তাকে ধরার জন্য তার পেছনে পেছনে ছুটতে থাকবে। ক্লাস টিচার আজকে খেলতে নিষেধ করেছেন তারপরও সবাই খেলছে।
রনি উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে লুতপাইনও উঠে দাঁড়াল। রনি জানে এখন সে যদি প্লে গ্রাউন্ডে যায়, লুতপাইনও তার সঙ্গে সঙ্গে যাবে। আবার সে যদি গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, লুতপাইনও তাই করবে। মেয়েটার এমন নকল করা অভ্যাস। সবসময় রনিকে নকল করবে।
বারোটা বাজার আগেই স্কুল খালি। রনি শুধু একা বসে আছে। তাকে কেউ নিতে আসে নি। রনিকে কেউ নিতে আসে নি বলে তাদের ক্লাস টিচারও বাসায় যেতে পারছেন না। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি খুব বিরক্ত। যদিও তিনি মুখ হাসি হাসি করে রেখেছেন। রনি প্লে গ্রাউন্ডে একটা কাঠ-গোলাপ গাছের নিচে বসে ছিল। দিলশাদ মিস তার কাছে এসে মিষ্টি গলায় বললেন, ব্যাপার কী বলো তো? তোমাদের বাসায় কেউ টেলিফোন ধরছে না কেন?
রনি বলল, ম্যাডাম আমি তো জানি না।
তোমার বাবার অফিসের নাম্বার জানো?
জি না।
জানো না কেন? গুরুত্বপুর্ণ নাম্বার মনে রাখবে না? তোমার একার জন্যে আমাকে দুটা পর্যন্ত বসে থাকতে হবে এটা কেমন কথা?
এখন দিলশাদ ম্যাডামের রাগ টের পাওয়া যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তিনি এখন রনিকে ধমক দেবেন। রনির ভয় ভয় করছে। কান্না কান্নাও পাচ্ছে।
রনি বলল, ম্যাডাম আপনি চলে যান।
আমি কী করব না করব সেটা আমার ব্যাপার, তোমাকে জ্ঞান দিতে হবে না। ফাজিল ছেলে।
রনি বুঝতে পারছে না ম্যাডাম তাকে কেন ধমকাচ্ছেন। তাদের বাসার কেউ টেলিফোন ধরছে না, সেটা তো বাসার সমস্যা।
ম্যাডাম যেভাবে হনহন করে এসেছিলেন ঠিক সেইভাবে হন হন করে চলে গেলেন। পনের মিনিট পর আবার উপস্থিত হলেন। আগের মতোই রাগী রাগী গলায় বললেন, তোমার কোনো আত্মীয়স্বজনের টেলিফোন নাম্বার জানা আছে, জানা থাকলো বলো–তাদের কাউকে টেলিফোন করে বলি তোমাকে নিয়ে যেতে।