কাগজ কুঁচকে ভাঁজ হয়ে আছে। দুই হাত দিয়ে ঘষে ভাজ ঠিক করল। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইল। তারপর অতি দ্রুত ছবি এঁকে ফেলে রনির দিকে কাগজটা এগিয়ে দিয়ে বলল–দেখ তো খোকা, কেমন হয়েছে?
রনির মন বলছিল লোকটা খুব ভালো ছবি আঁকে। দেখা গেল আসলেই সুন্দর ছবি। রাগী মুখে রনির মা বসে আছেন।
রনি বলল, ছবিটা খুব সুন্দর।
তোমার কি মনে হয় এই ছবি দেখে আমাকে চাকরি দেবে?
না।
আমারো মনে হয় না। আমার চেহারা তোমার মার পছন্দ হয়নি। মেয়েরা চেহারার ওপর খুব গুরুত্ব দেয়। শেভ করে ভালো কাপড়-চোপড় পরে আসা দরকার ছিল। নামটাও সমস্যা করেছে। মুহাব্বত আলি পছন্দ করার মতো নাম না। যাই হোক, কফি খেয়ে বিদায় নিই। তোমার নাম কী?
আপনি তো আমার নাম জানেন। যখন দরজা খুললাম তখন বললেন, কেমন আছ রনি।
রনি নাম জানি। এর মধ্যে নাম বদলে গেল কি-না সেইজন্যে জিজ্ঞেস করা। দেখ না আমার নাম ছিল মুহাব্বত আলি, তিন মিনিটের মধ্যে হয়ে গেল হাব্বত আলি।
রনি হেসে ফেলল এবং বুঝতে পারল এই আর্ট টিচারকে তার খুবই পছন্দ হয়েছে।
তোমার বুদ্ধি কেমন? ধাঁধা জিজ্ঞেস করলে পার? মাঝে মাঝে পারি।
যে-সব ধাঁধা পার তার দুই একটা বলো তো। তাহলে বুঝব কোন ধরনের ধাঁধা পার।
কোন মাছি উড়ে না–ঘামাছি। কোন স্টেশনে গাড়ি থামে না–রেডিও স্টেশন। এইসব।
এইসব সহজ ধাঁধা। কঠিন একটা জিজ্ঞেস করি। বলো দেখি—
কহেন কবি কালিদাস শৈশবের কথা।
নয় লক্ষ তেঁতুলগাছে কয় লক্ষ পাতা।
পারব না!
আমিও পারি না। নয় লক্ষ তেঁতুলগাছে কয় লক্ষ পাতা–কীভাবে বলব? একটা তেঁতুলগাছে কয়টা পাতা থাকে গুণে অবশ্যি দেখা যেতে পারে। সময়সাধ্য ব্যাপার।
রহিমা বুয়া কফির কাপ নিয়ে ঢুকল। সঙ্গে পিরিচের উপর দুটা বিসকিট। রনি দেখল লোকটা খুব আগ্রহ করে বিসকিট দুটা খেল। কিছু বিসকিটের গুঁড়া পিরিচে পড়ে ছিল। আঙুল দিয়ে জড়ো করে সেগুলিও মুখে দিল। কফির কাপে চুমুক দিয়ে আরামের শব্দ করল। তার মুখভর্তি হাসি। রহিমা বুয়া বলল, কফি খাইয়া আম্মা আফনেরে চইল্যা যাইতে বলছে।
আচ্ছা চলে যাব। আপনি এই ছবিটা ম্যাডামকে দেবেন?
রহিমা বুয়া ছবি হাতে নিয়ে রনির দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইজান, আপনেরে চইল্যা আসতে বলছে।
রনির ইচ্ছা করছে লোকটার সঙ্গে গল্প করতে। সব মানুষের সঙ্গে গল্প করতে তার ভালো লাগে না। এই মানুষটার সঙ্গে গল্প করতে ভালো লাগবে তা বোঝাই যাচ্ছে।
মুহাব্বত আলি কফির কাপে শব্দ করে চুমুক দিল। মা থাকলে ভুরু কুঁচকে তাকাতেন। শব্দ করে যে-কোনো জিনিস খাওয়াই অভদ্রতা।
রনি মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছে। মুহাব্বত আলি এবার তাকালেন রহিমার মার দিকে। গম্ভীর গলায় বললেন, রহিমার মা শোনো। তোমার ম্যাডাম বলেছিল একশ টাকা দেবেন। দোতলায় উঠে মনে হয় ভুলে গেছেন। দোতলার মানুষ একতলার মানুষকে সহজে ভুলে যায়। তুমি উনার কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে এসো। আমি চলে যাব।
রহিমা বুয়া বিরক্ত মুখে চলে যাচ্ছে। বিড়বিড় করে আবার কী যেন বলল। রনি বুঝতে পারছে না রহিমা বুয়া এত বিরক্ত হচ্ছে কেন? এত বিরক্ত হবার মতো কিছু তো এই মানুষটা বলে নি।
রনির মনে ছোট্ট একটা খটকাও লাগছে–মানুষটা রহিমা বুয়ার নাম জানল কীভাবে? এত সহজভাবে বলেছে যেন রহিমা বুয়াকে সে অনেকদিন থেকে চেনে।
রনি মুহাব্বত আলির দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে আমি কী ডাকব? কিছু ডাকতে হবে না। আমি যদি তোমার আর্ট টিচার হতাম, তাহলে স্যার ডাকতে বলতাম।
রনি বলল, আপনি রহিমা বুয়ার নাম জানলেন কীভাবে?
মুহাব্বত আলি হেসে ফেলে বললেন, তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ আমার সুপারম্যানদের মতো ক্ষমতা-টমতা আছে। এসবের কোনো কারবারই আমার নেই। আমি তোমাদের গেটের দারোয়ানের কাছে সবার নাম জেনে নিয়েছি।
কেন?
বলা তো যায় না কখন কোন কাজে লাগে। কাজে তো লাগল। রহিমা বুয়াকে ডাকতে পারলাম। ভালো কথা, তোমার মা টাকা পাঠাতে দেরি করছে কেন? দেবে না নাকি?
একবার যখন বলেছে তখন দেবে।
তাহলে অপেক্ষা করি, কী বলো?
অপেক্ষা করুন।
টিভিটা ছাড়া তো, বসে বসে টিভি দেখি।
এখন টিভি ছাড়লে মা রাগ করবে।
রাগ করলে থাক।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, রহিমা বুয়া টাকা নিয়ে দোতলা থেকে নামল। মুহাব্বত আলি টাকাটা ব্যাগে রেখে উঠে দাঁড়ালেন। রনির দিকে তাকিয়ে বললেন, আসি?
রনির খুব ইচ্ছা করছে বলে, আবার আসবেন। শেষ পর্যন্ত বলল না। মানুষটাকে আবার দেখলে মা অবশ্যই রাগ করবেন। মা রাগ করলে বাবা রাগ করবেন। সে কাউকেই রাগাতে চায় না।
রনির স্কুল দুপুর দুইটায় ছুটি হয়
রনির স্কুল দুপুর দুইটায় ছুটি হয়। আজ ছুটি হয়ে গেল এগারোটায়। স্কুলের একজন টিচার মিস নাজমা মারা গেছেন, এইজন্যেই ছুটি। মিস নাজমা রনিদের জিওগ্রাফি ম্যাডাম ছিলেন। ক্লাসে সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকতেন। ছাত্রদের কেউ কোনো শব্দ করলেই ভুরু কুঁচকে বলতেন, Thear some noise. এতেই সবাই চুপ। মিস নাজমা কাউকে কোনো বকা দিতেন না, কারো সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলতেন না, তারপরেও সবাই তার ভয়ে অস্থির হয়ে থাকত। ক্লাসের কারো সঙ্গে যখন কথা বলতেন, তখন গম্ভীর গলায় একটা মজা করতেন। নামের সঙ্গে মিল দিয়ে চার-পাঁচটা শব্দ বলতেন। যেমন রনিকে বলতেন
রনি
কনি
মনি
লানি
আবার পুতুলকে বলতেন—
পুতুল
তুতুল
লুতুল