টুন টিন, টুন টিন করে কলিং বেল বাজছে। রনি ড্রয়িংরুমে বসে ছিল। কলিং বেলের শব্দ শুনে অবাক হলো। যেই আসুক দারোয়ান গেট থেকে ইন্টারকম করে আগে জানাবে কে এসেছে। শুধু তিনজনের বেলায় এই নিয়ম খাটে না। সেই তিনজন হলো রনি আর তার বাবা, মা। তিনজনের মধ্যে দুজন সে এবং মা বাড়িতেই আছে।
তাহলে কে এসেছে? বাবা? তিনি তো চিটাগাং। সোমবার আসবেন।
আজ মাত্র শুক্রবার। রনি দরজা খুলল। অপরিচিত এক লোক দাঁড়িয়ে GI
লোকটা তার দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন আছ রনি?
রনি বলল, ভালো। অপরিচিত লোক তার নাম জানে এতে সে বিস্মিত হলো না। রনি দেখেছে অনেক অপরিচিত লোকই তার নাম জানে।
যাও খোকা তোমার মা-কে খবর দাও। আমি তোমার নতুন আর্ট টিচার। ইন্টারভু দিতে এসেছি। শুনেছি তিনি ইন্টার ছাড়া কাউকে রাখেন না।
ঠিকই শুনেছেন। আসুন, ভেতরে এসে বসুন।
এটা তোমাদের ড্রয়িংরুম?
জি।
যে রুমে ড্রয়িং করা হয় না তার নাম ড্রয়িংরুম কেন বলো তো?
জানি না কেন।
ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে সোফায় আরাম করে বসলেন। রনি তার মা-কে খবর দিতে গেল। রনির মা সালমা বানু টিচারের ইন্টার নিচ্ছেন। সব টিচারকেই এই ইন্টারভু দিতে হয়। যারা ইন্টারভ্যুতে পাস করে তারাই শুধু পড়াতে পারে। নতুন এই আর্ট টিচারকে দেখেই রনির মনে হচ্ছে ইনি পাস করতে পারবেন না। কেমন আউলা ঝাউলা গরিব চেহারা। গাল ভাঙা। ভদ্রলোক এ বাড়িতে আসার আগে নিশ্চয়ই শেভ করেছেন। শেভ ভালো হয়নি। গালের বেশ কয়েকটা জায়গায় খাবলা খাবলা কাঁচাপাকা দাড়ি বের হয়ে আছে। হাতের নখ লম্বা। রনি নখ দেখেই বলে দিতে পারছে দুসপ্তাহ কাটা হয়নি। এই গরমেও গায়ে চাদর। চাদরটা এমনভাবে জড়ানো যে দেখে মনে হয় তার জ্বর এসেছে।
ভদ্রলোক কথা বলা শুরু করার আগেই চাদরের ভেতর থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সালমা বানু বললেন, এ বাড়িতে সিগারেট খেতে পারবেন না।
ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে সিগারেটের প্যাকেট চাদরের নিচে লুকিয়ে ফেলে বোকার মতো দাঁত বের করে হাসতে লাগলেন। রনি তখনি বুঝে গেল, এই লোকের চাকরি হবে না। তার একটু খারাপ লাগল। কোনো কারণ ছাড়াই লোকটাকে তার পছন্দ হয়েছে।
সালমা বানু বললেন, আপনার নাম কী?
আমার নাম মুহাব্বত আলি।
এটা আবার কেমন নাম?
বাবা শখ করে রেখেছে। আপনার যদি এই নামে ডাকতে অসুবিধা হয়, তাহলে মু-টা বাদ দিয়ে হাব্বত আলী ডাকতে পারেন। হাব্বত আলি নামটা খারাপ না।
সালমা বানু বললেন, মুহাব্বত আলি নামে তো কারোর আসার কথা না। আমাকে বলা হয়েছিল আর্ট টিচারের নাম–সেরাজুল সালেহিন।
উনি আসতে পারবেন না। এই একমাস উনি খুবই ব্যস্ত। আমাকে বলেছেন একমাস প্রক্সি দিতে। একমাস পর থেকে উনি নিয়মিত আসবেন।
সরি, কিছু মনে করবেন না। আপনাকে আমার পছন্দ হচ্ছে না। একমাস আর্ট টিচার না থাকলেও আমাদের অসুবিধা হবে না। সেরাজুল সালেহিন সাহেবের কাছে রনি ছবি আঁকা শিখবে।
আমি কিন্তু ছবি খুব ভালো আঁকি। আমার নামটা হয়তো আপনার কাছে খারাপ লাগছে। ছবি খারাপ না।
আপনি যদি মদিলিয়ানির মতো ছবিও আঁকেন, তাহলেও আমি আপনাকে রাখব না।
তাহলে আর কী করা! একটা চাকরির খুবই প্রয়োজন ছিল। আপনি যখন মদিলিয়ানির মতো আর্টিস্টকেও রাখবেন না–তখন আমি মুহাব্বত আলি কোন ছার!
মদিলিয়ানি কে জানেন?
জানি। উনার ভালো নাম আমেদো মদিলিয়ানি। ইতালির চিত্রশিল্পী এবং ভাস্কর। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বেশ কয়েকটি ছবিই তার আঁকা। আঠার শ চুরাশি সনে তার জন্ম। মারা যান প্যারিসে উনিশ শ বিশ সনে।
ঠিক আছে আপনি যেতে পারেন।
এক কাপ কফি খেয়ে যাই। শুধু মুখে চলে গেলে পরে আপনার নিজেরই খারাপ লাগবে। কফি খেতে খেতে আমি চট করে আপনার একটা স্কেচ করে ফেলি। স্কেচটা যদি আপনার পছন্দ হয়, আপনি আমার কাছ থেকে কিনে নিতে পারেন। আমি খুবই খারাপ অবস্থায় আছি। একশ টাকা পেলেও আমার লাভ।
স্কেচ করতে হবে না। আমি আপনাকে একশ টাকা দিচ্ছি। কফি খাওয়ানো সম্ভব না। কাজের লোকজন ব্যস্ত।
আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে পারি। তাদের ব্যস্ততা কমুক। আসলে আমার তেমন কাজকর্ম নেই। আমার জন্যে এখানে বসে থাকা যা, রাস্তায় হাঁটাহাঁটিও তা। বরং এসি ঘরে বসে থাকাটা ভালো।
লোকটার কথাবার্তায় রনি খুব মজা পাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না মা শেষপর্যন্ত লোকটাকে কফি খাওয়াবে কি-না। মনে হচ্ছে খাওয়াবে না। রনি যেমন লোকটার কথাবার্তায় মজা পাচ্ছে, মা পাচ্ছে না। মা খুবই বিরক্ত হচ্ছে।
আপা, আমি কি বসব কফির জন্যে?
সালমা বানু উঠে দাঁড়ালেন। আর্ট টিচার ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে খুবই আগ্রহের সঙ্গে বলল–চিনি বেশি দিতে বলবেন। আমি তিন-চার চামচ চিনি খাই। এরচে বেশি হলেও আমার অসুবিধা হয় না। ডায়াবেটিস যখন হবে তখন হবে। এখন থেকে চিনি খাওয়া ছাড়ার কোনো মানে হয় না।
সালমা বানু জবাব না দিয়েই ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। লোকটা রনির দিকে তাকিয়ে বলল, এই ফাঁকে তোমার মার একটা ছবি এঁকে ফেলা যাক, কী বলো? ভদ্রমহিলা তো আমার ওপর খুবই রেগে আছেন, ছবি দেখে যদি রাগটা কমে।
রনি বলল, আপনার জন্যে পেন্সিল আর কাগজ নিয়ে আসব?
লোকটা বলল, কিছু আনতে হবে না। আমার চাদরের নিচে সবকিছু থাকে। বলেই সে প্রথমে একটা পেন্সিল বের করল। তারপরই বের করল কাগজ।