লুতপা খবরটা পেয়েছে টিভি থেকে। খবরটা জানার পর থেকেই সে কাদছে। লুতপার বাবা মেয়েকে শান্ত করার অনেক চেষ্টা করেছেন। কিছুতেই কিছু হয়নি। এখন লুতপা দরজা বন্ধ করে তার ঘরে বসে আছে। রাত প্রায় দশটা। তার জ্বর বেড়েছে। রাতে সে কিছু খায় নি। সে তার বাবাকে জানিয়ে দিয়েছে, রনিকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত সে কিছুই খাবে না। ঘরের দরজাও খুলবে না।
রনি বসে আছে তার স্কুলের ছাদে। স্কুল ছুটি হবার পরপরই সে কাঠগোলাপ গাছ বেয়ে ছাদে উঠে গিয়েছিল। ছাদে উঠার সময় তার মোটেও ভয় লাগেনি। বরং মজা লেগেছিল। সন্ধ্যার পর থেকে খুবই ভয় লাগছে। চারপাশ কী নির্জন–একটা লোক নেই। রাতে স্কুলে দারোয়ান থাকত। দারোয়ানদের পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ায় আজ দারোয়ানও নেই। রনি বেশ কয়েকবার ছাদের রেলিং-এর কাছে গিয়ে এই এই বলে চিৎকার করেছে। কেউ তার কথা শুনে নি। দুবার সে কাঠগোলাপের গাছ বেয়ে নামার চেষ্টা করল। সেটাও পারল না। ছাদটা এত উঁচুতে, ছাদ থেকে গাছ বেয়ে নামা অসম্ভব। যতই রাত বাড়ছে তার কাছে মনে হচ্ছে ছাদটা ততই উঁচু হচ্ছে। ছাদের বা এবং ডান পাশে দুটা উঁচু দালান তৈরি হচ্ছে। সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত সেই দালানে মিস্ত্রি কাজ করছিল। সন্ধ্যার পর তারাও নেই।
আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। অবশ্যই বৃষ্টি হবে। তখন রনি কী করবে। তাকে বৃষ্টিতে ভিজতে হবে। যদি ঝড় হয়? ঝড় হলে কী করবে? স্কুলঘরের বারান্দায় একটা বাতি জ্বলছে কিন্তু ছাদ অন্ধকার। সেই অন্ধকারও বাড়ছে।
স্কুলের ছাদটা বিশাল। ছাদের মাঝখানে বড় বড় তিনটা পানির ট্যাংক। কিছুক্ষণ পর পর পানির ট্যাংকে ঘরঘর শব্দ হচ্ছে। শব্দ শুনে মনে হয় ট্যাংকের ভেতরে বসে কেউ একজন হাসছে। ভৌতিক কোনো ব্যাপার নিশ্চয়ই। দিঘির পানিতে ভূত থাকতে পারলে ট্যাংকের পানিতে থাকবে না কেন? রনি একবার একটা গল্প পড়েছিল, গল্পের নাম পানিভূত। পানিভূতটা দিঘির পানিতে ড়ুব দিয়ে থাকত। কোনো ছোট ছেলেমেয়ে দিঘির কাছে এলে হাত বাড়িয়ে তাকে ধরে পানির নিচে নিয়ে যেত। ট্যাংকের পানিতে কি সে রকম কেউ ড়ুব দিয়ে আছে? সে কি ট্যাংকের ঢাকনা খুলে হাত বাড়িয়ে রনিকে ধরবে?
রনির খুব ক্ষিধে লেগেছে। সে চকলেট পছন্দ করে না, ক্ষিধের কারণে প্রাইজ পাওয়া চকলেটের প্যাকেটের সব চকলেট খেয়ে ফেলেছে। এখন তৃষ্ণা লেগেছে। তার পানির বোতলে এক ফোটা পানি নেই।
সে রেলিং-এ হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ কাদল। এখন সে বড় হয়েছে, কাঁদা ঠিক না। কিন্তু সে কী করবে? কিছুতেই কান্না থামাতে পারছে না। প্রচণ্ড শব্দে খুব কাছে কোথাও বাজ পড়ল। রনি শব্দ করে কেঁদে উঠল।
রনি আছ, রনি!
রনি চমকে উঠল। তাকে কে ডাকছে? কে টর্চের আলো ফেলছে রেলিং-এ! রনি উঠে দাঁড়াল। এখন টর্চের আলো এসে পড়ছে তার মুখে।
কে, রনি?
হুঁ।
ছাদে উঠার ব্যবস্থা কী?
রনি কান্না চাপতে চাপতে বলল, পেছনে একটা কাঠগোলাপ গাছ আছে। গাছ দিয়ে উঠতে হয়।
ভালো ঝামেলার মধ্যে পড়লাম। গাছ কি শক্ত? ডাল ভেঙে নিচে পড়ব না তো?
রনির কান্না থেমে গিয়েছিল। এখন আনন্দে আবারো কান্না পাচ্ছে। এই কান্না আনন্দের। যিনি টর্চের আলো ফেলছেন তার নাম হাব্বত আলি। রনি বলল, আমি যে এখানে আছি আপনি কীভাবে বুঝলেন?
হাব্বত আলি বিরক্ত গলায় বললেন, এটা বোঝার জন্যে ফেলুদা হতে হয় না। স্কুল থেকে বের না হলে তুমি যাবে কোথায়? স্কুলেই থাকবে।
হাব্বত আলি গাছ বেয়ে উঠছেন। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিদ্যুতের আলোয় তাকে দেখা যাচ্ছে। মানুষটার পোশাক অন্যরকম। মাথায় ক্রিকেটারদের মতো ক্যাপ। গায়ে চাদর। চাদরটার রঙ আগে বোঝা যাচ্ছিল না। বিদ্যুৎ চমকানোর পর রঙ দেখা গেল–লাল।
রনি!
জি।
বিরাট একটা ভুল হয়েছে। গাছে উঠা শুরু করার আগে চাদরটা খুলে আসা উচিত ছিল। চাদর ডালে বেঁধে বেঁধে যাচ্ছে।
এখন চাদরটা ফেলে দিন।
এখন কীভাবে ফেলব? দুই হাত দিয়ে ডাল ধরে আছি। আরেকটা বাড়তি হাত থাকলে সেই হাতে চাদর খুলতাম। বাড়তি হাত তো নেই।
আপনি উঠেই পড়েছেন। আর একটু বাকি।
শেষটা পার হওয়াই তো কঠিন। যত উপরের দিকে উঠছি গাছ ততই পিচ্ছিল হচ্ছে, এই কারণটাও তো বুঝলাম না।
হাব্বত আলি ছাদের রেলিং-এ হেলান দিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছেন। গাছ বেয়ে ছাদে উঠতে তাঁর বেশ পরিশ্রম হয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরেই তিনি বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়েছেন। এখন তাঁর নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়েছে। তিনি টর্চটা রনির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, টর্চ জ্বালিয়ে আমার দিকে ধরে থাক। আমি খাওয়া-দাওয়া করব। তোমাকে নিয়ে গাছ বেয়ে নামতে হবে, প্রচুর এনার্জি লাগবে।
রনি টর্চ ধরে আছে। হাব্বত আলি ঝোলা থেকে খাবারের প্যাকেট বের করেছেন। একটা বার্গার, একটা চিকেন ব্রোস্ট। সঙ্গে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আছে টমেটো সস আছে। প্রতিটি খাবারই রনির খুব পছন্দের অথচ তিনি একবারও রনিকে বলছেন না, আমার এখান থেকে নিয়ে কিছু খাও। ক্ষিধের চোটে রনি চোখে অন্ধকার দেখছে। যত ক্ষিধেই লাগুক কারো কাছে খাবার চাওয়া যায় না। তারপরেও রনি ভাবল লজ্জাটজ্জা ভুলে গিয়ে সে বলে, আমি কি কয়েকটা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই পেতে পারি?
রনি!
জি।
তোমার সবচে পছন্দের খাবারগুলি নাম বলো। এক নম্বরে কী আছে?
পিজা।
দুই নম্বর?
বার্গার।
তিন নম্বর?