রনি বলল, দিন।
হাব্বত আলি রনিকে সবুজ রঙের একটা ললিপপ কিনে দিলেন। রনি বলল, থ্যাংকস।
হাব্বত আলি বললেন, সবুজ রঙটা দেখে একটা কথা মনে পড়েছে। তোমার মিসকে যে গাড়িটা ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে গেছে সেটার রঙ ছিল সবুজ। তোমাদের বাসায় তো অনেকগুলি গাড়ি–সবুজ রঙের কোনো গাড়ি কি আছে?
রনি বলল, না।
রিকশা চলতে শুরু করেছে। হাব্বত আলি রোদে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন।
রনির বাবা মজিদ সাহেব
রনির বাবা মজিদ সাহেব রনিকে নিয়ে লাইব্রেরি ঘরে বসেছেন। তাঁর মুখ গম্ভীর। তিনি একটু পর পর আঙুল দিয়ে তার কপাল টিপে ধরছেন। রনির ধারণা তাঁর প্রচণ্ড মাথা ব্যথা। মাথা ব্যথা হলেই মানুষ এইভাবে টিপে।
রনি!
জি।
পুলিশ অফিসার আফসারউদ্দিন সাহেব এসেছেন। তিনি তোমার সঙ্গে আলাদা বসবেন। তার আগে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব। প্রতিটি প্রশ্নের ঠিক জবাব দেবে।
জি।
টিফিন টাইমে তুমি আজ স্কুল থেকে পালিয়ে গেছ? পা
লিয়ে যাই নি। উনার সঙ্গে গেছি।
আগে যে লোক তোমাকে নিয়ে গিয়েছিল সেই লোক?
রনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, না, অন্য একজন।
অন্য একজন মানে? কী বলো এইসব! লোকটা দেখতে কেমন?
উনার গায়ের রঙ খুব ফর্সা। মাথায় ক্রিকেটারদের মতো ক্যাপ। গায়ে লাল চাদর।
মজিদ সাহেবের মুখ হা হয়ে গেল। তিনি নড়েচড়ে বসলেন। এদিকওদিক তাকালেন। রনি স্পষ্ট বুঝতে পারছে তার এই মিথ্যা কথা উনাকে কাবু করে ফেলেছে। রনি ঠিক করল, এই মিথ্যাই সে চালিয়ে যাবে।
লোকটা তার কোনো পরিচয় তোমাকে দিয়েছে?
না।
পুরো ঘটনা বলো। কীভাবে তুমি স্কুল থেকে বের হলে? কীভাবে তার সঙ্গে চলে গেলে? কোনো ডিটেল বাদ দেবে না। এইভাবে পা দুলিও না। পা দোলালে আমার কনসেনট্রেসন কেটে যায়। এখন বলো।
কী বলব?
কীভাবে তুমি লোকটার সঙ্গে গেলে?
উনি রিকশা নিয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। আমাকে দেখেই বললেন, এই ব্যাটা উঠে আয়। আমি রিকশায় উঠে গেলাম।
তোমাকে ব্যাটা বলল?
জি।
আর তুমি সঙ্গে সঙ্গে রিকশায় উঠে গেলে?
জি।
উনাকে আমার খুবই পরিচিত মনে হচ্ছিল তো এইজন্যে।
পরিচিত মনে হচ্ছিল?
জি।
তোমরা কী করলে?
আমরা অনেকক্ষণ রিকশায় করে ঘুরলাম। উনি আমাকে ললিপপ কিনে দিলেন। ললিপপ খেলাম। উনি ছড়া বললেন।
কী ছড়া বললেন?
উনি বললেন–টাবে টাবে, দুটা ভাত খাবে।
আবার বলো।
টাবে টাবে
দুটা ভাত খাবে।
তারপর কী হলো?
আমরা নাজমা মিসকে দেখতে হাসপাতালে গেলাম।
নাজমা মিসটা কে?
আমাদের একজন মিস। সবুজ রঙের একটা গাড়ি উনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। উনি খুবই অসুস্থ। হাসপাতালে আছেন।
লোকটা তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল?
জি।
কেন?
একটু আগেই তো বলেছি–নাজমা মিসকে দেখতে নিয়ে গেলেন।
সে তোমাকে বাসায় না নামিয়ে চলে গেল কেন?
সেটা তো আমি জানি না।
তুমি রিকশা করে একা একা এসেছ?
জি।
ভয় পাও নি?
একটু একটু ভয় পাচ্ছিলাম। তবে উনি আমাকে ভয় না পাবার একটা মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছিলেন। মন্ত্রটা মনে মনে পড়লে ভয় কেটে যায়।
কী মন্ত্র? ঘোঁৎ মন্ত্র। আবার বলো, কী মন্ত্র? ঘোঁৎ মন্ত্র।
আচ্ছা ঠিক আছে, আমি তোমাকে আর প্রশ্ন করব না। পুলিশ ইন্সপেক্টর আফসারউদ্দিন সাহেব তোমার সঙ্গে কথা বলবেন। তার আগে হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা খাও। আফসার সাহেবকে আমি তোমার ঘরে পাঠিয়ে দেব।
আচ্ছা।
রনি লাইব্রেরি ঘর থেকে চলে যাচ্ছে, মজিদ সাহেব একদৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁকে অসম্ভব চিন্তিত মনে হচ্ছে। চিন্তার প্রধান কারণ রনি যে ছড়াটা বলল সেই ছড়া। এই ছড়া রনির আসল বাবা বলতেন। রনিকে কোলে নিয়ে দোলাতে দোলাতে বলতেন–টাবে টাবে দুটা ভাত খাবে। রনির এই ছড়া মনে থাকার কোনো কারণ নেই। তাহলে ব্যাপারটা কী? ভৌতিক কোনো ব্যাপার অবশ্যই না। তিনি মনে করেন না–রনির মৃত বাবা রনিকে নিয়ে রিকশায় ঘুরছেন। তবে কিছু একটা ঘটছে। সেই কিছুটা কী?
রনিকে নাশতা দেবার সময় ইদরিস মিয়া গলা নিচু করে বলল, আফনেরে রিকশায় নিয়া যে ঘুরছে সে কে জানেন?
রনি বলল, না।
কাউরে যদি না বলেন তাইলে বলতে পারি।
আমি কাউরে বলব না।
আল্লাহর নামে কসম কাটেন। বলেন, আল্লাহর কসম, কাউরে বলব না।
আল্লাহর কসম, কাউরে বলব না।
আফনেরে রিকশায় নিয়া ঘুরছে আফনের আসল পিতা।
উনি তো মারা গেছেন।
ঘটনা তো ঐখানেই। বড়ই জটিল ঘটনা।
মৃত মানুষ কি ফিরে আসতে পারে?
ক্ষেত্র বিশেষে পারে ভাইজান। ক্ষেত্র বিশেষে পারে। আমি একদিন বড় সাহেবরে আপনের ঘরে দেখেছি। চেয়ারে বইসা দোল খাইতেছেন।
সত্যি?
যদি মিথ্যা বলি আমার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হয়। বড় সাহেবের সঙ্গে আমার কথাবার্তাও হইছে।
কী কথা হইছে?
আমারে জিজ্ঞাসা করেছেন–ইদরিস মিয়া, আছ কেমন? আরো অনেক আলাপ হইছে, সেইসব আপনেরে বলা যাবে না। খুবই জটিল অবস্থা ভাইজান। খুবই জটিল অবস্থা। বাড়িতে পুলিশ আনা হইছে–সিআইডি, ডিআইবি কোনো লাভ নাই।
লাভ নাই কেন?
এইটা এখন পুলিশের বিষয় নাই। অন্য বিষয় হইয়া গেছে। মুনশি মওলানা কিছু করলেও করতে পারে। দেখি আপনের জন্যে কোনো তাবিজ কবচের ব্যবস্থা নিতে পারি কি-না। তাড়াতাড়ি নাশতা শেষ করেন। আপনের ঘরে পুলিশের অফিসার বসা।
আফসারউদ্দিন সাহেব রনির ঘরে ঢুকে খুবই মজা পাচ্ছেন। আগ্রহ নিয়ে রনির খেলনা দেখছেন। একটি খেলনা তাঁর মন হরণ করেছে। কাচের একটা পাখি তার সামনে রাখা বাটিতে চুমুক দিয়ে পানি খেয়েই যাচ্ছে। পাখির তৃষ্ণা দূর হচ্ছে না।