Site icon BnBoi.Com

সংখ্যার নাম চার – ময়ূখ চৌধুরী

সংখ্যার নাম চার - ময়ূখ চৌধুরী

০১. বজ্রপাতের পূর্বাভাস

এক বিস্মৃত যুগের বিচিত্র কাহিনী

বাঘের মতো ভয়ংকর একটি মানুষের হাতে হাত মিলিয়েছিল দুঃসাহসী এক কিশোর, মহাশক্তিধর এক মল্লযোদ্ধা, এবং লক্ষ্যভেদে সিদ্ধহস্ত এক তীরন্দাজ!

কিন্তু কেন?

কি তাদের উদ্দেশ্য?…

.

০১. বজ্রপাতের পূর্বাভাস

মহারাজ রুদ্রদমনের রাজত্বে প্রজারা সুখে শান্তিতে বাস করত বটে, কিন্তু প্রবাদবাক্য অনুসারে বাঘে-বলদে এক ঘাটে জলপান করত এমন কথা বলা যায় না। কারণ, বাঘের মতো মানুষগুলো সুযোগ পেলেই বলদ-সদৃশ মানুষের ঘাড় ভেঙে হিংস্র আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে সচেষ্ট হত, তাই মাঝে মাঝে শান্তিভঙ্গের ঘটনা ছিল অনিবার্য।

তবে প্রজাদের শুভ-অশুভ ও নিরাপত্তা সম্পর্কে মহারাজ ছিলেন অতিশয় সচেতন। প্রজারা জানত, রুদ্রদমনের রাজত্বে কুকর্মকারী দুৰ্বত্তের নিস্তার নেই। রাজ্যে প্রচলিত প্রবাদ, মহারাজ অন্তর্যামী, রাজ্যে সংঘটিত যে কোনো ঘটনা সম্পর্কে তিনি অবহিত। দেবাশিত মহারাজের অপ্রীতিভাজন হলে দুবৃত্তের মৃত্যু সুনিশ্চিত।

প্রবাদ কখনো সম্পূর্ণ সত্য হয় না, কিন্তু প্রবাদের মূলে কিছু সত্য থাকে। মহারাজ রুদ্রদমন সম্পর্কে ওই ধরনের প্রবাদ প্রচলিত হওয়ার কারণ ছিল।

প্রজাবৃন্দ দেখেছে কোনো দুৰ্বত্তের অত্যাচারে তারা যখন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, রাজকর্মচারী আইনরক্ষকের দল যখন কিছুতেই শান্তিভঙ্গকারীকে গ্রেপ্তার করতে পারে না, শান্তিপ্রিয় মানুষ যখন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং মহারাজের কর্তব্যবোধ সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়ে সেই সময় হঠাৎ একদিন রাজদরবার থেকে ঘোষিত হয় রাজার আদেশ- উ যেন অবিলম্বে কোতোয়ালের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

রাজাদেশ পালন না করলে দেবরাজ ইন্দ্রের রোষে পূর্বোক্ত দুবৃত্তের মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা আছে একথাও জানিয়ে দেয় রাজদরবার। ওই ঘোষণা মৃত্যুদণ্ডের মতোই চরম। কারণ, রাজদরবারের নির্দেশ ঘোষিত হওয়ার পরও অপরাধী যদি আত্মসমর্পণ না করে অথবা দেশান্তরী না হয়, তবে হঠাৎ একদিন রাজ্যের কোনো না কোনো স্থানে তার মৃতদেহ চোখে পড়ে এবং মৃতের ললাটে বা বক্ষে দেখা যায় রক্তাক্ত ক্ষতস্থানে অঙ্কিত রাজচিহ্নের প্রতীক বাণ!

রুদ্রদমনের উপাস্য ইষ্টদেবতার স্থান গ্রহণ করেছেন দেবরাজ ইন্দ্র। ইন্দ্রের হাতে যে বজ্র থাকে, ওই বাণ হচ্ছে তারই প্রতীক এবং সেই জন্যই রাজচিহ্ন বলে স্বীকৃত।

বজ্ৰপাণি ইন্দ্রের অস্ত্রটি সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত। রুদ্রদমনের মতে ওই অস্ত্রটি এক মারাত্মক বাণ- যে বাণ বিদ্যুৎ চমকের মতো ছুটে এসে শত্রুর প্রাণ সংহার করে। রাজশক্তির প্রতীকরূপে তাই শায়ক-চিহ্ন গৃহীত হয়েছিল রুদ্রদমনের রাজ্যে। বজ্রের মতোই সেই প্রতীক চিহ্ন আঘাত হানে রাজশত্রুর বক্ষে বা ললাট-পটে।

সম্প্রতি যাকে লক্ষ্য করে শায়কচিহ্নিত বজ্র উদ্যত হয়েছে, সেই ভয়ংকর মানুষটির নাম পরন্তপ। সে কোথায় থাকে কেউ জানে না। আজ পর্যন্ত প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে তার চেহারার বর্ণনাও পাওয়া যায়নি। গ্রামে বা নগরে যখন সে হানা দেয়, তখন তার মাথায় জড়ানো থাকে প্রকাণ্ড উষ্ণীষ আর সেই উষ্ণীষ-সংলগ্ন কাপড়ে বাঁধা থাকে মুখের নিম্ন ভাগ। আবরণের নীচে পরন্তপের মস্তক ও মুখ সম্পূর্ণ অদৃশ্য থাকে। উক্ত মস্তক কেশের প্রাচুর্যে উর্বর, অথবা বিরলতৃণ মরুভূমির মতো প্রায়-মসৃণ হয়ে ইন্দ্রলুপ্তের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে, বস্ত্রের আবরণ ভেদ করে তা বোঝার উপায় নেই। নাসিকা ও অধর-ওষ্ঠ একই ভাবে আবৃত আক্রান্ত ব্যক্তির দৃষ্টিপথে শুধু ধরা পড়ে রোমশ বৃশ্চিকের মতো একজোড়া জ্বর নিচে একজোড়া তীব্র চক্ষু!

গ্রামে ও নগরে অবাধে লুণ্ঠন চার্লিয়েছে দস্যু পরন্তপ। মাঝে মাঝে রক্ষীদলের সঙ্গে সংঘর্ষও ঘটেছে। দুই এক সময় হত্যাকাণ্ডও সংঘটিত হয়েছে। তার দলভুক্ত দস্যুরা দুই একবার ধরা পড়েনি এমন নয়, কিন্তু পরন্তপ সম্পর্কে বন্দিদের মুখ থেকে কোনো সংবাদ সংগ্রহ করা যায়নি। দস্যু অসম্ভব ধূর্ত। তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ অনুচর অন্যান্য দস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, সে নিজে কোনো সময়েই সাধারণ দস্যুদের কাছে মুখ দেখায় না। দলের লোকেরা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত থাকে। প্রয়োজন হলে তার অন্তরঙ্গ দুতিনটি অনুচর দলের অন্যান্য লোকদের কাছে পৌঁছে দেয় পরন্তপের আহ্বান। নির্দিষ্ট স্থানে সকলে উপস্থিত হলে মুখ ও মাথা উষ্ণীষের আবরণে ঢেকে তাদের সামনে আসে পরন্তপ, পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেয়, তারপর নির্বাচিত স্থানে হানা দিয়ে লুণ্ঠনকার্য সমাধা করে দ্রুতবেগে অদৃশ্য হয়। দলের দস্যুরা আগে থাকতে জানতে পারে না কোথায় হানা দেওয়ার সঙ্কল্প করছে তাদের দলপতি। লুণ্ঠন-অভিযানে যাত্রা করার পূর্ব মুহূর্তে দস্যুদলকে মানব-মৃগয়ার জন্য নির্বাচিত স্থানটি জানিয়ে দেওয়া হয়। কার্য সমাধা করে সরে পড়ার পর অকুস্থল থেকে অনেক দূরে এসে লুণ্ঠিত দ্রব্য ভাগ করে দেয় পরন্তপ, তারপর যে যার বাসস্থানে চলে যায়। যে সব দস্যু ওই অভিযানে যোগ দেয় তাদের দীর্ঘকাল আর ডাকে না পরন্তপ। এর মধ্যে আবার লুঠতরাজের প্রয়োজন হলে সে আর একটি নতুন দলকে নিযুক্ত করে।

রুদ্রদমনের গুপ্তচর বিভাগ অতিশয় সক্রিয়। কিন্তু এক অভিনব পদ্ধতিতে দলকে পরিচার্লিত করে ধূর্ত পরন্তপ গুপ্তচরদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল।

কোনো সূত্রে বিশেষ কোনো ব্যক্তির উপর সন্দেহ উপস্থিত হলেই গুপ্তচর তার উপর নজর রাখতে থাকে। কিন্তু দীর্ঘকাল পর্যবেক্ষণ চার্লিয়েও সন্দেহভাজন ব্যক্তির কোনো সন্দেহজনক কার্যকলাপ তারা আবিষ্কার করতে পারে না। কারণ আগেই বলেছি- পরন্তপের নিয়ম অনুসারে একই দল বা একই ব্যক্তি কখনো পর পর দু-বার লুণ্ঠন অভিযানে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় না। সন্দেহভাজন ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের উপর নজর রাখতে রাখতে গুপ্তচর যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, সেই সময় হঠাৎ আর এক নতুন জায়গা থেকে আসে পরন্তপ পরিচার্লিত দস্যুবাহিনীর হানা দেওয়ার সংবাদ। যাদের সন্দেহ করা হয়েছিল তাদের নির্দোষ ভেবে অন্যদিকে ছোটে গুপ্তচর, আর চক্রবৎ পদ্ধতিতে পূর্বোক্ত সন্দেহভাজনদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ স্থাপন করে দস্যু পরন্তপ।

এই অভিনব পদ্ধতির জন্যেই রুদ্রদমনের গুপ্তচর-চক্র এবং রক্ষীবাহিনী পরন্তপের সন্ধান পায় না। গ্রামে বা নগরে হানা দেওয়ার সময়ে দৈবাৎ কখনো টহলদারি রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে যখন পরন্তপের সংঘর্ষ ঘটেছে এবং দুই-একটি আহত দস্যু ধরা পড়েছে, তখনই উল্লসিত হয়ে উঠেছে দেশের মানুষ আশা করেছে বন্দি দস্যুদের মুখ থেকেই দস্যু দলপতির যথাযথ পরিচয় ও বাসস্থান জানা যাবে। কিন্তু তাদের আশা সফল হয়নি। রক্ষীদল বন্দি দস্যদের প্রচণ্ড প্রহারে জর্জরিত করেছে, উৎকোচের লোভ দেখিয়েছে কোতোয়াল- কিন্তু সব চেষ্টাই বিফল হয়েছে। শেষ পর্যন্ত। বন্দিরা জানিয়েছে উষ্ণীষের আবরণ খুলে পরন্তপ তাদের মুখ দেখায়নি কখনো। সে কোথায় থাকে তাও তারা জানে না। পরন্তপের অন্তরঙ্গ যে কয়েকটি অনুচর সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে, একমাত্র তারাই পরন্তপের খোলা মুখের চেহারা দেখার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু তাদের সন্ধান করা অসম্ভব। যে লোক একটা দলের সঙ্গে যোগাযোগ করে, সে আর কয়েক বৎসরের মধ্যে ওই দলের সামনে আসে না। আসে নতুন মানুষ। সেখানেও দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে একই লোকের কাছ ঘুরে আসার অভিনব পদ্ধতি প্রয়োগ করে ধূর্ত দস্যু সকলকেই অন্ধকারে রেখেছে। ফলে কয়েকজন দস্যকে গ্রেপ্তার করা সত্ত্বেও রক্ষীবাহিনী দলপতির সন্ধান পায় না।

অতএব, গ্রামে গ্রামে, নগরে নগরে, নগরের উপকণ্ঠে সর্বত্রই চলতে থাকে তাণ্ডবলীলা। দস্যুর অত্যাচারে দেশের লোক যখন অত্যন্ত বিচলিত, সেই সময় হঠাৎ একদিন রাজদরবার থেকে ঘোষণা শোনা যায়- ধরা দাও পরন্তপ, নচেৎ মৃত্যু অনিবার্য।

আশ্চর্য কাণ্ড! ভেরী ও ঢক্কানাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজাদেশ ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দস্যু অন্তর্ধান করল! সেই সঙ্গে অন্তর্হিত হলেন মহারাজ রুদ্রদমন!

.

০২. কিশোর যোদ্ধা

প্রায় সাত মাস হল মহারাজ রুদ্রদমন নিরুদ্দেশ। প্রজারা অবশ্য সেইজন্য বিশেষ উদ্বিগ্ন নয়। তারা জানে মহারাজ মাঝে মাঝে নিখোঁজ হয়ে যান, আবার ফিরে আসেন। মহারাজের অবর্তমানে রাজকার্যের বিঘ্ন হয় না, মন্ত্রী মহাশয় সেই সময়ে রাজকার্য পরিচালনা করেন নিপুণ ভাবে।

না, মহারাজকে নিয়ে প্রজারা চিন্তিত নয়। খুব বেশিদিন রাজা নিখোঁজ থাকলে হয়তো চিন্তার কারণ ঘটত, কিন্তু এক বৎসর রাজ্যে অনুপস্থিত হওয়া রাজা রুদ্রদমনের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। একবার নিখোঁজ হলে তিন থেকে ছয় মাসের আগে মহারাজ সচরাচর ফিরে আসেন না। একাদিক্রমে তিন বছর নিরুদ্দেশ থাকার ঘটনাও ঘটে গেছে আগে। অতএব সাত মাসের অনুপস্থিতি প্রজাবর্গকে বিশেষ বিচলিত করেনি।

পাশাপাশি অন্যান্য রাজ্যের নৃপতিগণ অবশ্য এভাবে নিরুদ্দেশ হলে রাজ্যে হই চই পড়ত। কিন্তু রুদ্রদমনের রাজ্যে রাজার অনুপস্থিতি নিতান্তই স্বাভাবিক। কেন তিনি চলে যান, বা কোথায় যান, এ-বিষয়ে প্রচুর জল্পনা-কল্পনা করেও কেউ স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি তাই এখন আর কেউ এ-বিষয়ে মাথা ঘামায় না।

সমগ্র রাজ্যে একটিমাত্র মানুষ মহারাজের নিরুদ্দেশ যাত্রার কার্যকারণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত। মানুষটির নাম মহাসত্ত্ব- রুদ্রদমনের রাজ্য শ্রাবস্তীর মন্ত্রী।

মহাসত্ত্ব স্পষ্টভাষী। নিরুদ্দেশ-যাত্রার বিপক্ষে ভালো ভালো যুক্তি সহযোগে তার কঠোর মন্তব্যগুলি মহারাজের কানে তুলতে তিনি দ্বিধাবোধ করেননি। কিন্তু রাজনীতি, সমাজনীতি, মানবতাবোধ প্রভৃতি অত্যন্ত জটিল বিষয়বস্তুর সঙ্গে বিবিধ তথ্য ও তত্ত্ব জড়িত করে এক সুদীর্ঘ বক্তৃতার প্রচণ্ড স্রোতে মহারাজ মন্ত্রীবরকে একেবারে ধরাশায়ী করে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন। একই ঘটনার বারংবার পুনরাবৃত্তির ফলে অধুনা মহাসত্ত্ব আর মহারাজের নিরুদ্দেশ যাত্রার প্রস্তাবে আপত্তি করেন না; রুদ্রদমনের নির্দেশ অনুসারে তার অনুপস্থিতির সময়ে গুরুদায়িত্ব পালন করেন বিনা প্রতিবাদে, কিন্তু মন্ত্রীবরের অন্তরে যুগপৎ উদ্বেগ ও ক্রোধের সঞ্চার হয়।

সম্প্রতি মহাসত্ত্ব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু ক্রুদ্ধ হলেও রুদ্রদমনের হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার কারণটা আমাদের খুলে বলবেন না মহাসত্ত্ব। সময়বিশেষে তার কর্ণ হয় বধির এবং জিহ্বা হয় মৌন। বর্তমানে মহাসত্ত্ব উপরিউক্ত অবস্থাপ্রাপ্ত হয়েছেন। সুতরাং বোবা মহাসত্ত্বকে কথা কওয়ানোর দুঃসাধ্য চেষ্টা না করে আমরা বরং রুদ্রদমনের রাজ্যে কিছুক্ষণ বেড়িয়ে আসি…

অপরাহ্ন। শ্রাবস্তীর রাজপথে আনন্দ-উচ্ছল নাগরিকদের স্বচ্ছন্দ গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করলে এবং দোকানে দোকানে ক্রেতা ও বিক্রেতার আলাপ, কলহ ও হাস্যধ্বনি শ্রবণ করলে যে কোনো নবাগত মানুষের ধারণা হবে রুদ্রদমনের রাজ্যে বিশেষ করে রাজধানীতে সুখ ও শান্তি বিরাজ করছে সর্বতোভাবে, এখানে অশান্তি উৎপাতের চিহ্ন অনুপস্থিত।

জনতার মধ্যে পথ করে চলতে চলতে যে কিশোরটি উৎসুক নেত্রে এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করছিল, তা মনেও এমনি ভাবনারই ছায়াপাত ঘটেছিল। বলাই বাহুল্য, কিশোর-পথচারী নগরীতে নবাগত। তার ভাবভঙ্গি দেখলে মনে হয় সে কোনো ব্যক্তির সন্ধান করছে।

হঠাৎ পার্শ্ববর্তী এক বিপণি থেকে পসারির উচ্চ কণ্ঠস্বর ভেসে এল কিশোরের কানে, আসুন! আসুন! অতি অল্পমূল্যে ভালো ভালো সামগ্রী বিক্রয় হচ্ছে। এই সুযোগ হেলায় হারাবেন না। আসুন! আসুন!

কিশোর বিপণির দিকে চাইল। বিভিন্ন সামগ্রীর মধ্যে চর্মরঙ্গুতে আবদ্ধ একটি নগ্ন তরবারির দিকে চোখ পড়তেই অলস দৃষ্টি তীব্র আগ্রহে জ্বলে উঠল- সে এগিয়ে গেল দ্রুত পদে…

পসারি তখনও হাঁক দিচ্ছে, আসুন! আসুন! দেখুন, এই মৃভাণ্ড উৎকৃষ্ট সুরার আধার। ঘোর গ্রীষ্মে এই পাত্রে আসব হিমশতিল থাকবে। এই যে রজতশুভ্র কুম্ভ দেখছেন

বাধা দিয়ে কিশোর বলল, ওই তরবারির মূল্য কত?

পসারি একবার কিশোরের মুখের দিকে তাকাল, ধূর্ত হাসির রেখা জাগল তার অধর-ওষ্ঠে, মধুঝরা গলায় সে বলল, অতি উৎকৃষ্ট অসি। নাম মাত্র দাম। এই নিন।

তরবারির বন্ধন মোচন করে সে কিশোরের দিকে এগিয়ে দিল। কিশোর হাত বাড়াল, অধীরকণ্ঠে প্রশ্ন করল, নামমাত্র দামটি কত?

হে, হে, বিগলিত হাস্যে পসারি জানাল, মাত্র দুটি রজত মুদ্রা।

দুটি রজত মুদ্রা? কিশোরের ভ্রু কুঞ্চিত হল, বড়ো বেশি দাম।

আদৌ নয়, পসারি বলল, হাতে নিয়ে দেখুন কিশোর যোদ্ধার উপযুক্ত অস্ত্র।

কিশোর সাগ্রহে এইবার হাত বাড়াল। কিন্তু সে তরবারি স্পর্শ করার আগেই এক ব্যক্তি দ্রুতপদে এগিয়ে এসে পসারির হাত থেকে অসি টেনে নিল।

পসারির মুখ থেকে একটা অস্ফুট ধ্বনি বেরিয়ে এল, কিন্তু সে কোনো মন্তব্য করল না। কিশোর ক্রেতা সবিস্ময়ে বলে উঠল, এ কি!

লোকটি কোনোদিকে দৃকপাত করল না, আপনমনে অসি পরীক্ষা করতে করতে বলল, এই তরবারি ভালো ইস্পাতে তৈরি সন্দেহ নেই। তবে এটি বালকের খেলার বস্তু নয়।

ক্রুদ্ধস্বরে কিশোর বলল, আমি বালক নই। কিন্তু তুমি হঠাৎ পসারির হাত থেকে অসি ছিনিয়ে নিলে কেন?

আগন্তুক বলল, পসারি তোমার হাতে অসি তুলে দিচ্ছিল, কারণ সে বিক্রেতা। অসির বিনিময়ে অর্থ পেলেই সে খুশি অস্ত্রধারণে ইচ্ছুক ক্রেতার যোগ্যতা নির্ণয় করার ক্ষমতা বা ইচ্ছা তার নেই। কিন্তু আমি শস্ত্রবিদ। অস্ত্রধারীর যোগ্যতা বিচারের ক্ষমতা আমার আছে। তুমি অস্ত্রধারণে অযোগ্য, তাই অসি ছিনিয়ে নিয়েছি। এই অসি উৎকৃষ্ট বটে। আমি এই অসি ক্রয় করব।

কিশোরের ওষ্ঠাধর হিংস্র হাস্যে বিভক্ত হল, আমাকে অস্ত্রধারণে অযোগ্য মনে করার কারণ?

শ্লেষতিক্ত স্বরে উত্তর এল, যে বালক কোমরে শূন্যগর্ভ অসিকোষ রাখে, অস্ত্রধারণের যোগ্যতা তার নেই। নিশ্চয়ই কোনো ব্যক্তি কোষ থেকে অসি ছিনিয়ে নিয়েছে। ভালোই করেছে দুর্বলের অঙ্গে শোভাবৃদ্ধি করার জন্য তরবারির অবস্থান বাঞ্ছনীয় নয়।

এর মধ্যে দুজনকে ঘিরে একটি ছোটোখাটো জনতার সমাবেশ ঘটেছে। আগস্তুকের কথা শুনে সকলেই সকৌতুকে কিশোরের কটিদেশের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল- সত্য বটে; কিশোরের বামদিকে কটিতে আবদ্ধ চর্মবন্ধনীর সঙ্গে ঝুলছে একটি শূন্যগর্ভ অসিকোষ! দক্ষিণপার্শ্বে অবস্থিত অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র আধারটি অবশ্য শূন্য নয়– সেখানে খাপের ওপর দৃশ্যমান হাতলটি সুদীর্ঘ এক ছুরিকার অস্তিত্ব জানিয়ে দিচ্ছে।

কিশোর নীরবে একবার আগন্তুকের কোমরের উপর চোখ বুলিয়ে নিল, তারপর শুষ্কস্বরে বলল, আমার অসিকোষ শূন্য বলেই আমি এই অসি ক্রয় করতে চাই। তোমার কোমরে দেখছি একটি তরবারি ঝুলছে। অনর্থক তুমি আমাকে বঞ্চিত করতে চাইছ কেন? ..

আগন্তুক বলল, আগেই বলেছি আমি শস্ত্রবিদ। বিশেষত অসি আমার প্রিয় অস্ত্র। এই অসি অত্যুত্তম ইস্পাতে নির্মিত। সেইজন্যেই এই অসি আমি রাখব। অর্থাৎ অধিকন্তু ন দোষায়।

কিশোরের দুই চোখ জ্বলে উঠল, তুমি কি জানোনা একটি খাপে দুটি তরবারি প্রবেশ করতে পারে না?… বর্বর! অধিক কথায় কাজ কি? যদি সাহস থাকে পসারির অসি আমার হাতে দিয়ে তোমার নিজস্ব অসি গ্রহণ করে। এখনই বুঝিয়ে দেব অস্ত্রধারণে আমার অধিকার তোমার চাইতে বেশি ছাড়া কম নয়।

অতি উত্তম প্রস্তাব, আগস্তুক সহাস্যে বলল, এই নাও তোমার অস্ত্র।

কিশোর হাত বাড়িয়ে তরবারি গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই নবাগত মানুষটি বিদ্যুৎবেগে তার অসি কোষমুক্ত করল।

জনতা সভয়ে ছিটকে দূরে সরে গেল। এসময় প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছাকাছি থাকা নিরাপদ নয়।

আগন্তুক হেসে বলল, বালক! এইবার তোমার অস্ত্রধারণের যোগ্যতা পরীক্ষা করব।

কিশোর হাসল। তার প্রতিদ্বন্দ্বীর হাসিতে ছিল কৌতুক ও ব্যঙ্গের স্পর্শ, কিন্তু কিশোরের স্মিত অধরে ফুটল দস্তুর শ্বাপদ-হিংসা!

দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরের মাথা থেকে পা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিল। তারা যেন চোখ দিয়ে প্রতিপক্ষের ক্ষমতা মেপে নিচ্ছে।

জনতা নির্বাক। কিন্তু প্রতীক্ষায় অধীর। আতঙ্ক ও কৌতূহলজড়িত দৃষ্টি মেলে তারা এক রোমাঞ্চকর নাটকের রক্তাক্ত অভিনয় দেখার জন্য উদগ্রীব।

হঠাৎ বাধা দিল পসারি, না, না, আমার দোকানের সামনে রক্তপাত করবেন না।

নির্বোধ বণিক, আগন্তুক ধমকে উঠল, আমি শিশুহত্যা করি না। তবে শিশুর দঃসাহস ও স্পর্ধা দেখলে তাকে শাসন করি বটে।… যাও! ওই যে ব্যক্তি অনতিদূরে ফলের পসরা সাজিয়ে বসে আছে, ওর কাছ থেকে তিনটি আম নিয়ে এস।

আম! আম কি হবে?

জনতার ভিতর জাগল বিস্ময়ের গুঞ্জন ধ্বনি, কিন্তু কেউ প্রশ্ন করতে সাহসী হল না– অস্ত্রধারী পুরুষের মেজাজকে বিশ্বাস নেই। নবাগত পুরুষ যে অসিচালনায় দক্ষ সে বিষয়ে কারো সন্দেহ ছিল না। একটু আগে সে যখন খাপ থেকে তলোয়ার টেনে এনেছিল, তখন তার ক্ষিপ্রতা দেখে সবাই বুঝেছিল ওই ব্যক্তি মরণখেলার এক অভ্যস্ত খেলোয়াড়।

এসব লোক উত্তেজিত হলে তার সামনে বেশি বাক্যব্যয় করা সুবুদ্ধির কাজ নয় বিবেচনা করে গুঞ্জরিত জনতা ধীর ধীরে নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

বস্ত্রের ভিতর থেকে কয়েকটি তাম্রমুদ্রা নিয়ে আমের দাম চুকিয়ে দিল আগন্তুক। তারপর আম তিনটিকে পাশাপাশি সাজিয়ে রাখল দোকানের কাষ্ঠাধারের উপর।

হঠাৎ অস্ফুট আর্তনাদ করে পিছিয়ে গেল পসারি– তার নাকের সামনে আলোকস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে আগন্তুকের অসি সবেগে নেমে গেল কাষ্ঠাধারে রক্ষিত আম তিনটির দিকে।

একটি আমকে খণ্ডিত করে অসি উঠল, আবার নামল সারিবদ্ধ আমের উপর বিদ্যুৎবেগে।

তোমরা সবাই দেখ, উর্ধে তরবারি তুলে আগন্তুক চেঁচিয়ে উঠল, মাঝখানের আমটি অটুট আছে। কিন্তু দুপাশের দুটি আমকে ঠিক সমান মাপে দুভাগ করে কেটেছি।

সাধু! সাধু!

বিস্মিত জনতা প্রবল হর্ষধ্বনি করে অভিনন্দন জানাল। কাজটা কঠিন বটে। তিনটি আম প্রায় গায়ে গায়ে লাগিয়ে রাখা হয়েছে, মাঝে ফাঁক খুব কম। মাঝখানের আমে একটু আঁচড় না লাগিয়ে দুপাশের দুটি আমকে সমান মাপে কাটা খুবই কঠিন। আরও আশ্চর্যের বিষয় যে, আগন্তুক লক্ষ্য স্থির করে কোপ মারে নি- তার আসি চার্লিত হয়েছে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো উপযুপরি দুবার।

জনতা সবিস্ময়ে স্বীকার করল হা লোকটার ক্ষমতা আছে বটে।

আগন্তুক এইবার কিশোর প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে তাকাল, বালক! কাজটা খুব সহজ মনে হচ্ছে কি?

কিশোর হাসল, এটা কি খুব কঠিন কাজ? তুমি বিদ্রূপ করে আমায় বালক বললেও আমি প্রকৃতপক্ষে বালক নই। কিন্তু যখন আমি সত্যি বালক ছিলাম, তখনও এমন সহজ একটা কাজ করে প্রশংসা কুড়াতে চেষ্টা করতাম না। অবশ্য ব্যক্তিবিশেষের কাছে এই কাজ খুব কঠিন বলে মনে হতে হবে। অসিচালনার পাঠে যারা অ, আ, ক, খ পড়ছে এই পরীক্ষা তাদেরই উপযুক্ত বটে। বীরযোদ্ধাকে এই ধরনের পরীক্ষা দিতে বললে তাকে অপমান করা হয়, বাক্যবীরদের কথা অবশ্য স্বতন্ত্র।

জনতার ভিতর থেকে একজন মন্তব্য করল, বৎস! এইবার তুমি মাঝের আমটিকে সমান দুভাগে কাটো। আমরা দেখে নয়ন সার্থক করি।

কিশোরের প্রতিদ্বন্দ্বী তিক্তস্বরে বলল, হ্যাঁ, সমান দুইভাগে তো কাটবেই। ওই সঙ্গে একথাও মনে রেখ, তৃতীয় আমটি কাটার সময়ে পাশের আম দুটিতে একটুও আঁচড় লাগতে পারবে না।

তথাস্তু–কিশোর সবেগে অসিচালনা করল।

মুহূর্তের স্তব্ধতা। পরক্ষণেই তুমুল অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল জনতা। কিশোরের প্রতিপক্ষের হাসির শব্দটাই বড়ো বেশি স্পষ্ট।

কোনোমতে হাসি থামিয়ে আগন্তুক বলল, খব তো বড়ো বড়ো কথা বলছিলে। কিন্তু এটা কি হল? আমি তো নিখুঁতভাবে দুটি আমকেই সমান দুভাগে কেটেছি– আর তোমার অসি তৃতীয় আমটিকে স্পর্শও করল না।

কৌতুক-তরল স্বরে কিশোর বলল, কে বলেছে আমার অসি আমটিকে স্পর্শ করেনি?

তুমি কি উন্মাদ নাকি, চোখে দেখতে পাও না? বিস্মিত নেত্রে আবার কিশোরের মুখের পানে তাকিয়ে জনতার দিকে ফিরল আগন্তুক, ভাই সব, তোমরাই বলো মাঝের আমটিকে ওর তরবারি কি স্পর্শ করেছে? অসি লাগলে ফল তৎক্ষণাৎ ছিন্ন হত।

জনতা গর্জন করে উঠল, ঠিক ঠিক! আমরা দেখেছি অসি আমকে স্পর্শ করেনি। আঘাত লাগলে আম নিশ্চয়ই ছিন্ন হত।

কিশোর কোনো কথা না বলে এগিয়ে এসে মাঝের আমটিতে হাত দিল। সঙ্গে সঙ্গে তার আঙুলের মধ্যে উঠে এল আমের কর্তিত অর্ধাংশ!

স্তম্ভিত জনতার দিকে দৃষ্টিপাত করে কিশোর সহাস্যে বলল, আমিও সমান মাপেই কেটেছি। তোমরা ওই দুটি কাটা আমের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারো ওদের মতো আমারটাও ঠিক সমান দুই ভাগে কাটা পড়েছে। প্রভেদ এই যে, আমার আম দ্বিখণ্ডিত হয়েও ছিটকে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েনি।

জনতা স্তম্ভিত, স্তব্ধ!

কিশোরের প্রতিদ্বন্দ্বীর অবস্থাও তথৈবচ।

সত্যি অকল্পনীয়। আমটিকে নিখুঁতভাবে সমান দুইভাগে বিভক্ত করে দিয়েছে কিশোরের তরবারি! কিন্তু আঘাতের ওজন এমনই পরিমিত যে, খণ্ডিত অংশ দুটি ছিটকে পড়ার অবকাশ পায় নি। অতি সূক্ষ্ম রেখায় বিদীর্ণ ফলের দুই অংশ রসসিক্ত হয়ে পরস্পরের সঙ্গে আটকে থেকে দর্শককে বিভ্রান্ত করেছে মনে হয়েছে আমটি অক্ষত ও অটুট অবস্থাতেই বিরাজমান। তরবারি বুঝি আমকে স্পর্শও করেনি।

স্তব্ধতা ভঙ্গ করল কিশোরের প্রতিদ্বন্দ্বী, এমন চমৎকার হাতের কাজ আমি কখনো দেখি নি। অপূর্ব! অদ্ভুত! আমি আমার বাক্য প্রত্যাহার করছি। তুমি যদি অস্ত্রধারণের যোগ্য না হও, তবে সমগ্র আর্যাবর্তে অস্ত্রধারণের যোগ্য পুরুষ একটিও নেই.. কিন্তু কিশোর, আমার একটি প্রশ্ন আছে।

জিজ্ঞাসু নেত্রে কিশোর তার ভূতপূর্ব প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে দৃষ্টিপাত করল।

আমি দীর্ঘকাল শস্ত্রচর্চা করেছি। বিশেষত ধনুর্বাণ ও অসি আমার প্রিয় অস্ত্র, আগন্তুক বলল, আমি জোর করে বলতে পারি উপযুক্ত গুরুর সাহায্য না পেলে এমন ভাবে তরবারিকে আয়ত্ত করা যায় না। শিষ্যের যদি এই নমুনা হয় তো গুরুর হাতের অসি নিশ্চয়ই জীবন্ত সর্পের মতো প্রাণঘাতী।… বলো কিশোর, কে তোমার গুরু? কি তার নাম? তোমার নামটিও জানতে চাই।

প্রতিপক্ষ যখন খাপ থেকে তলোয়ার টেনে নিয়েছিল তখনই অসির বিদ্যুৎ সঞ্চালন দেখে কিশোর বুঝেছিল এই মানুষটি বড়ো সহজ নয়। প্রাণসংশয়ের সম্ভাবনা আছে জেনেই সে তরবারিতে হাত দিয়েছিল। প্রতিপক্ষের প্রশংসা ও বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারে এখন সে সহজ হয়ে উঠছিল, মুখের কঠিন রেখাগুলো মিলিয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে কিন্তু হঠাৎ ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ আসতেই কঠিন রেখাগুলি আবার ফিরে এল মুখের ওপর, চোয়াল হল আড়ষ্ট, দুই চোখে দেখা দিল রোষের স্তিমিত অগ্নি!

নীরস স্বরে সে বলল, নাম-ধামের প্রয়োজন কি? পথের দেখা পথেই শেষ। এই তরবারির ওপর আমার অধিকার আছে কি না এইটুকুই শুধু আমার জিজ্ঞাস্য।

আগন্তুক কয়েক মুহূর্ত বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, তারপর তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল- যোদ্ধৃসুলভ নিস্পৃহ গাম্ভীর্যে কঠিন হয়ে উঠল অধরের রেখা, চোখের দৃষ্টিতে ভেসে উঠল অবরুদ্ধ ক্রোধের আভাস।

ওই অসি তোমার, আগন্তুক শুষ্কস্বরে বলল, অস্ত্রচালনায় তোমার দক্ষতা প্রমাণিত। কিন্তু তোমার অন্তঃকরণ বড়ো নয়। আর্যযোদ্ধার উদার মনোভাব তোমার নেই। আমার পরিচয় দিলে তুমি জানতে পারতে কতখানি সম্মান তুমি পেয়েছিলে, তবে

হঠাৎ আগন্তুকের কণ্ঠস্বরের দারুণ ক্রোধে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, অবরুদ্ধ ক্রোধ ফেটে পড়ল তীব্র ভর্ৎসনায়, তবে জেনে রাখো, যে যোদ্ধা গুরুর কাছে উপযুক্ত ব্যক্তিকে নিয়ে যেতে ভয় পায়, সে কখনো আদর্শ শস্ত্রবিদ হতে পারে না। নিজের সম্বন্ধে তার সংশয় আছে, অপরের। সম্পর্কে ঈর্ষা ও আতঙ্ক। আমি তোমার গুরুর কাছে অস্ত্রচালনা শিক্ষা করতে চাই নি। চেয়েছিলাম এক গুণীকে সম্মান দিতে, আর

ক্রোধের উচ্ছ্বাসে তার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এল, আত্মসংবরণ করে সে কণ্ঠকে সংযত করল, ভিতরের ক্রোধ তবু চাপা রইল না, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিলাম নখর-ভয়াল এক ব্যাঘ্ৰশাবকের দিকে। অরণ্যের পশু হিংস্র বীরত্বের অধিকারী, আর্যযোদ্ধার উদার মনোভাব সে কোথায় পাবে?.. ধিক!

ক্ষণমধ্যে জনতার বেষ্টনী ভেঙে আগন্তুক প্রস্থান করল। সে যদি একবার পিছন ফিরে কিশোরের মুখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করত তাহলে দেখত ক্রোধের পরিবর্তে সেই মুখের ওপর নেমে এসেছে বিষাদের করুণ ছায়া!

.

০৩. ‘অর্থ অনর্থের মূল!’

কিশোরের চমক ভাঙল পসারির কণ্ঠস্বরে, আশ্চর্য কৌশল! তোমার বয়স অল্প বটে, কিন্তু অসিচালনায় তুমি সিদ্ধহস্ত।

কিশোর খানিকক্ষণ নিষ্পলক শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পসারির মুখের দিকে; তারপর চিন্তার জগৎ ছেড়ে তার মন ফিরে এল বাস্তব পৃথিবীর বুকে একবার মুখের ওপর হাত বুলিয়ে নিয়ে সে সহজভাবে তাকাল পসারির দিকে, কি বলছ?

-বলছি আশ্চর্য তোমার কৌশল। এই বয়সেই অসিচালনায় তুমি সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছ।

একবার হাতের তরবারির দিকে দৃষ্টিপাত করে কিশোর জিজ্ঞাসা করল, পসারি! এই অসির জন্যে তোমায় কত দিতে হবে?

–কিছু না। এই অসি তোমায় আমি উপহার দিলাম।

কিশোরের ললাটে জাগল কুঞ্চনরেখা, কণ্ঠস্বরে ফুটল বিরক্তির আভাস, উপহার! তোমার উপহার আমি গ্রহণ করব কেন?

পসারি বিনীত হাস্যে দন্তবিকাশ করল, গুণীকে সম্মান প্রদর্শন করলে উপহার গ্রহণে গুণীর বাধা নেই। এই তরবারি দিয়ে আমি গুণীকে সংবর্ধনা জানাচ্ছি।

ভ্রূকুটির রেখা সরে ললাট মসৃণ হল, তরবারি বারেক নিরীক্ষণ করে কিশোর সেটিকে কোষবদ্ধ করল। তারপর হাসিমুখে পসারির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল, আমি একটি লোকের সন্ধান করছি। নাম জয়দ্রথা বলতে পারো, কোথায় তাকে পাওয়া যাবে?

–মল্লবীর জয়দ্রথ?

–হ্যাঁ।

–তার গৃহের সন্ধান বলতে পারব না। তবে এই অঞ্চলে প্রত্যহ অপরাহ্নে সে ক্রীড়া প্রদর্শন করে, বিনিময়ে নাগরিকদের কাছ থেকে পায় পারিতোষিকস্বরূপ কিছু অর্থ। একটু খুঁজে দেখ। ভাগ্য প্রসন্ন হলে আজও দেখা হতে পারে।

জনতা সরে গিয়েছিল। যারা রোমাঞ্চকর একটি দ্বৈরথ যুদ্ধ দেখার জন্য উদগ্রীব ছিল, তারা সবাই উধাও। কয়েকজন অতিকৌতূহলী ব্যক্তি কিশোরের দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছি। সম্ভবত কিশোরের আকৃতি-প্রকৃতি নিয়ে তারা গবেষণায় ব্যস্ত।

অকস্মাৎ সমবেতমণ্ডলীর ভিতর থেকে এক ব্যক্তি এগিয়ে এল, তুমি জয়দ্রথ নামে মল্লযোদ্ধার সাক্ষাৎ পেতে চাও?

-হ্যাঁ। কোথায় তিনি?

নিকটেই। একটু আগে পূর্বদিকের ওই বিস্তৃত রাজপথের একপাশে দৃশ্যমান রক্তবর্ণ অট্টালিকার পিছন দিকের পথে জয়দ্রথ ক্রীড়াপ্রদর্শনের উদ্যোগ করছিল। আমি আগে অনেকদিন ওর খেলা দেখেছি, তাই দাঁড়াইনি। তুমি যদি ওখানে গিয়ে জয়দ্রথের সাক্ষাৎ পেতে চাও তাহলে আমার সঙ্গে আসতে পারো।

অজস্র ধন্যবাদ, কিশোর এগিয়ে গেল বক্তার দিকে, চলো, কোথায় যেতে হবে।

নির্দিষ্ট স্থানে রক্তবর্ণ অট্টালিকার পাশে দাঁড়িয়ে দূরবর্তী এক জনতার দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে কিশোরের সঙ্গী বলল, ওই যে লোকগুলো দাঁড়িয়ে আছে, ওখানে গেলেই জয়দ্রথের সাক্ষাৎ পাবে। তুমি যাও। আমি ওর খেলা বহুদিন দেখেছি।

ধন্যবাদ! অশেষ ধন্যবাদ!

কিশোরের সঙ্গী অন্যদিকে চলে গেল। কিশোর এগিয়ে গেল জনতার দিকে…

আসুন! দেখুন! জয়দ্রথ তার অসীম শক্তির পরিচয় দিচ্ছে, দণ্ডায়মান মানুষগুলোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ব্যাঘ্রচর্মে সজ্জিত এক ভীমকান্তি পুরুষ ঘোষণা করছিল, জয়দ্রথ আপনাদের কিয়ৎকাল আনন্দ দেবে। বিনিময়ে তাকে আপনারা কিছু পুরস্কার দেবেন বলে সে আশা করে।

জনতার ভিতর থেকে এক রসিক পুরুষ সরস মন্তব্য নিক্ষেপ করল, আনন্দের ধরনটা আগে দেখি। তারপর বিবেচনা করব তোমার প্রাপ্য কি হবে পুরস্কার- না, তিরস্কার!

জয়দ্রথ নামক ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিত মানুষটি জনতার ভিতরে দৃষ্টিকে সঞ্চালিত করল, কিন্তু রসিক ব্যক্তিটিকে আবিষ্কার করতে পারল না।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে সে নীরবতা ভঙ্গ করল, আমি মল্লযোদ্ধা। আমার প্রতিযোগী কোনো মল্ল এখানে উপস্থিত থাকলে আমি মল্লযুদ্ধের কৌশল দেখিয়ে আপনাদের আনন্দ বিতরণ করতে পারতাম। যিনি এইমাত্র আমাকে তিরস্কারের সম্ভাবনা জানিয়ে সতর্ক করেছেন, তার চেহারাটা আমি দেখতে চাই এবং আমাকে তিরস্কার করার ক্ষমতা তিনি রাখেন কি না সেটাও পরীক্ষা করতে চাই। আমার বিশ্বাস, উপস্থিত জনমণ্ডলী তাতে কিছু আনন্দ পাবেন, আর সেই আনন্দের বিনিময়ে দরিদ্র এই মল্লযোদ্ধাকে পুরস্কৃত করতে তাদের আপত্তি হবে না.. কই? কথাটা যিনি বললেন তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? আসুন!

সবাই চুপ। কেউ এগিয়ে এল না। জয়দ্রথ আবার বলল, আপনারা কেউ ব্যবসাবাণিজ্য করেন, কেউ বা বণিকগৃহে অথবা রাজদ্বারে মাসিক বেতনের কর্মচারী। আপনারা বুদ্ধিজীবী; দেশ আপনাদের প্রয়োজন অনুভব করে একথা সত্য। কিন্তু শুধু মস্তিষ্কের শক্তি থাকলেই হয় না, দেহের শক্তিরও প্রয়োজন আছে আমাদের দেশে–একথা ভুললে চলবে না। সুস্থ বলিষ্ঠ দেহ জাতির সম্পদ। আমি শক্তির পূজারী, বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী আমাকে অপমান করার অধিকার আপনাদের নেই।

দণ্ডায়মান মানুষগুলোর মুখের ওপর ঘুরতে লাগল জয়দ্রথের তীব্র দৃষ্টি, কয়েক মুহূর্ত পরে স্তব্ধতা ভঙ্গ করে আবার জাগ্রত হল তার গম্ভীর কণ্ঠ, যদি আমার খেলা দেখে আনন্দ পাবেন বলে মনে করেন, তাহলে দাঁড়িয়ে দেখুন। না হয়তো, চলে যান। কিন্তু আমি খেলা দেখানোর আগেই দেখে নিতে চাই আমি কি পাচ্ছি! প্রয়োজনীয় অর্থ না পেলে আমি বৃথা শক্তিক্ষয় করে দেহের ক্ষতি করতে রাজি নই। আমার দেহ অতিশয় মূল্যবান। বহু চেষ্টায় এই দেহ গড়ে উঠেছে।… যদি খেলা দেখতে চান তো রাজপথে সাধ্য অনুযায়ী অর্থ ফেলুন।

ঠং করে একটি তাম্রমুদ্রা জয়দ্রথের সামনে মাটিতে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই শব্দ। তারপর কিছুক্ষণ ঠং, ঠং, ঠং, ঠং…।

ধাতব শব্দের ঝঙ্কার থেমে যেতেই জয়দ্রথ পথের উপর নিক্ষিপ্ত অর্থ গণনা শুরু করল… কিছুক্ষণ পর মাথা নেড়ে বলল, হবে না। যে যার অর্থ তুলে নিন। ত্রিশ কাহন, পাঁচ নিষ্ক দিয়ে এই দেহের জন্য একবেলার উপযুক্ত খাদ্য সরবরাহ করা যায় না।

কেউ এগিয়ে এল না। নিক্ষিপ্ত মুদ্রা রাজপথ থেকে কুড়িয়ে নেওয়া দাতার পক্ষে সম্মানজনক নয়।

জয়দ্রথ মৃদু হেসে নত হয়ে তাম্রমুদ্রাগুলি (রজতমুদ্রা একটিও ছিল না) কুড়িয়ে নিয়ে কটিবন্ধের চর্মপেটিকায় রাখল, তারপর বলল, আপনারা যখন ওই অর্থ ফিরিয়ে নিতে রাজি নন, তখন আমিই ওগুলো তুলে নিলাম। শক্তিমান পুরুষ দেশের সম্পদ। এই সামান্য অর্থ দান করে আপনারা দেশের প্রতি আপনাদের আনুগত্য প্রমাণ করলেন। বজ্ৰপাণি বাসব আপনাদের কল্যাণ করুন।

জনৈক ব্যক্তি ক্রোধপ্রকাশ করে বলল, তুমি খেলা দেখাবে না?

-খেলা দেখাতেই এসেছিলাম। কিন্তু পূর্বেই বলেছি, ত্ৰিশ কাহন পাঁচ নিষ্ক দিয়ে এই বৃহৎ দেহের উপযোগী একবেলার খাদ্য ক্রয় করা যায় না। কঠিন পরিশ্রমে দেহ শ্রান্ত হলে উপযুক্ত খাদ্য ও বিশ্রাম দিয়ে সেই দেহের পরিচর্যা করলে বলবান হওয়া যায়– অন্যথা বিপরীত অবস্থাই ঘটবে, অর্থাৎ শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে।

জনতার মধ্যে যারা অর্থ নিক্ষেপ করেছিল, তাদের মধ্যে অনেকেই সরোষে অধর দংশন করল। কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করতে সাহসী হল না।

একটি ক্ষুদ্র শকট পথের একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। শকটের একপাশে হাতল লাগানো দেখলেই বোঝা যায় ওই ক্ষুদ্রাকার যান হাতের সাহায্যে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়েছে। শকটের উচ্চতা হাত দুই-এর বেশি নয়। শকটগর্ভে কি আছে জানার উপায় নেই। স্থূল ও কর্কশ রঙিন বস্ত্রে শকটপৃষ্ঠ ঢেকে দেওয়া হয়েছে। তবে বস্ত্রের স্ফীতি দেখে অনুমান করা যায় তার তলায় নিরেট বস্তুপিণ্ডের সমাবেশ ঘটেছে।

শকটের হাতল ঠেলে জয়দ্রথ এগিয়ে গেল। তার চলার পথ ছেড়ে শশব্যস্তে সরে গেল মানুষ।

আচম্বিতে প্রস্থান-উদ্যত জয়দ্রথের পথরুদ্ধ হল- দাঁড়াও!

ভ্রূ কুঞ্চিত করে জয়দ্রথ মুখ তুলল– তার পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে এক সুদর্শন কিশোর।

জয়দ্রথ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে কিশোরের আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করল। বুঝল, বয়স কম হলেও মানুষটি অবহেলার নয়। কটিদেশে লম্ববান তরবারি ও সুদীর্ঘ ছুরিকা বুঝিয়ে দিচ্ছে কিশোর অস্ত্রচালনায় অভ্যস্ত। দেহের গঠন ছিপছিপে; চিতাবাঘের মতো দীর্ঘ, পেশল, প্রাণসার।

জয়দ্রথ গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করল, দাঁড়াব কেন?

কিশোর কথা বলল না; দণ্ডায়মান মল্পের পেশীবহুল দেহের বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে লাগল তার দুই চোখের তীব্র দৃষ্টি।

জয়দ্রথ বিরক্ত হল, কি দেখছ?

–তোমাকে।

-হ্যাঁ, আমার দেহ যে দেখার মতো সেকথা আমিও জানি। কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার চেহারা দেখলে দর্শনী দিতে হবে। তবে তোমাদের হাত তো ভালোভাবে উপুড় হয় না, তাই বলছি পথ ছাড়ো।

কিশোরের মুখে মৃদু হাসির রেখা দেখা দিল, তুমি শক্তিমান?

–সন্দেহ আছে?

–না। কিন্তু তুমি এইমাত্র বলছিলে জয়দ্রথ তার অসীম শক্তির পরিচয় দিচ্ছে। অসীম কথাটা অস্পষ্ট। আমি স্পষ্ট কথা ভালোবাসি। আমি তোমার শক্তির সঠিক পরিমাপ দেখতে চাই।

-তাতে আমার লাভ?

–যদি সত্যিই অসাধারণ শক্তির অধিকারী হও তাহলে লাভ আছে। দেখি তোমার হাত?

বিস্মিত হয়ে জয়দ্রথ হাত এগিয়ে দিল। উর্ধ্বাঙ্গে পরিহিত আঙরাখার ভিতর হাত ঢুকিয়ে কি যেন বার করল কিশোর, তারপর সেই বস্তুটি সমর্পণ করল জয়দ্রথের হাতে– এতে চলবে?

বস্তুটির দিকে তাকিয়ে জয়দ্রথের চক্ষুস্থির। এ কি! এ যে—

বাধা দিয়ে কিশোর বলল, ওটা তোমার। এখন খেলা দেখাও। নাকি, আপত্তি আছে?

–বিলক্ষণ! মূল্য যখন পেয়েছি তখন খেলা দেখাতে আপত্তি করব কেন?

–তাহলে দেখাও।

পথের একপাশে দণ্ডায়মান যে ক্ষুদ্রকার শকটের কথা পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে, তার দিকে এগিয়ে গেল জয়দ্ৰথ। শকটের ওপর বিস্তৃত রঙিন কাপড়টি তুলে নিতেই ভিতরের বস্তুগুলি দর্শকদের দৃষ্টিগোচর হল– কয়েকটি লৌহগোলক, দড়ির স্তূপ, প্রকাণ্ড এক সিন্দুক এবং আরও বিভিন্ন ধরনের বস্তু।

সিন্দুকের দুইপাশে লোহার আংটা বসানো। আংটা ধরে সিন্দুকটিকে মাটিতে রেখে জয়দ্রথ বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল।

শুনুন, জয়দ্রথ হাঁক দিল, আপনাদের মধ্যে যদি কোনো ব্যক্তি এই সিন্দুক মাটি থেকে একহাত উপরে তুলতে পারেন, তবে আমি এইখানে সাত হাত নাকখৎ দেব।

চার-পাঁচ জন বলিষ্ঠ ব্যক্তি জনতার ভিতর থেকে এগিয়ে গেল সিন্দুকের দিকে।

প্রত্যেকেরই চেষ্টা বিফল হল। একহাত তো দূরের কথা, সিন্দুক ভূমিশয্যা ছেড়ে এক আঙুল উপরেও উঠল না। একজন বলিষ্ঠ-দর্শন পুরুষ প্রাণপণ চেষ্টার ফলে সিন্দুক আর ভূমির মধ্যে সামান্য একটু ফাঁক সৃষ্টি করেছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য তারপরই সিন্দুক আবার নেমে এসে মাটি কামড়ে ধরল অনড় হয়ে।

বাহুতে সশব্দে চপেটাঘাত করে হেসে উঠল জয়দ্ৰথ, ওটিকে সিন্দুক বলে ভ্রম করবেন না। সিন্দুকের আকারে নির্মিত হলেও বস্তুটি একেবারে নিরেট।

উপস্থিত জনমণ্ডলীর ওপর একবার দৃষ্টিকে সঞ্চালিত করে জয়দ্রথ এগিয়ে গিয়ে সিন্দুকের দুপাশে আংটা চেপে ধরল, দেখুন, এই গুরুভার বস্তু আমি মাথার উপর তুলব।

জনতা রুদ্ধশ্বাসে দেখতে লাগল। জয়দ্রথের কাধ ও বাহুর মাংসপেশী ফলে ফলে উঠল ধীরে, অতি ধীরে শুন্যে উঠতে লাগল সেই নিরেট সিন্দুক এবং একটু পরেই তার মাথার ওপর দুই প্রসারিত বাহুর দৃঢ়মুষ্টির মধ্যে অবস্থান করতে লাগল।

সেই অবস্থাতেই কিশোরকে সম্বোধন করে জয়দ্রথ বলল, কিশোর, তুমি কি সন্তুষ্ট হয়েছ?

-হয়েছি। তবে আমি আরও কিছু দেখতে চাই।

–নিশ্চয়। একটু অপেক্ষা করো।

সিন্দুকটিকে নিয়ে জয়দ্রথ শকটের মধ্যে রাখল। তারপর সেখান থেকে টেনে নিল একটি স্কুল লৌহদণ্ড।

দণ্ডটিকে আন্দোলিত করে জয়দ্রথ বলল, মহাশয়গণ। আমাকে একটু সময় দিন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেই আমার অসাধারণ শক্তির আর একটি উদাহরণ আপনাদের সামনে উপস্থিত করব।

যারা সিন্দুক নিয়ে টানাটানি করে গলদঘর্ম হয়েছিল, তাদের মধ্যে এক ব্যক্তি কিশোরের পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে বলে উঠল, আমি খুব দুর্বল মানুষ নই! প্রত্যহ ব্যায়াম করি। কিন্তু ওই সিন্দুক তুলতে গিয়ে বুঝলাম অমানুষিক শক্তির অধিকারী না হলে ওই গুরুভার বস্তুকে মাথার ওপর উত্তোলন করা সম্ভব নয়।

কিশোর বলল, মনে হয় ওই বস্তুটির ওজন খুব কম করেও তিন মণ হবে। জয়দ্রথ যে অসাধারণ শক্তির অধিকারী সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

পিছন থেকে মৃদু-গম্ভীর স্বরে একটি মন্তব্য ভেসে এল কিশোরের কানে, ভার উত্তোলনই শক্তির একমাত্র পরিচয় নয়।

সচমকে ফিরে কিশোর দেখল তার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে মুণ্ডিতমস্তক এক বিপুল বপু গেরুয়াধারী পুরুষ।

কিশোর ভ্রূ কুঁচকে প্রশ্ন করল, কথাটা কি আপনি বললেন?

স্মিত হাস্যে উত্তর এল, হ্যাঁ।

বক্তার সর্বাঙ্গে একবার চোখ বুলিয়ে নিল কিশোর দক্ষিণ স্কন্ধের উপর থেকে বক্ষ বেষ্টন করে জানু পর্যন্ত নেমে এসে গেরুয়া কাপড় তার দেহকে আবৃত করেছে; আবরণের তলায় দেহের গঠন অদৃশ্য। শরীরের আয়তন প্রকাণ্ড হলেও কিশোরের মনে হল গেরুয়াধারীর দেহে পেশীর পরিবর্তে চর্বিরই আধিক্য ঘটেছে। তবে হ্যাঁ- গ্রীবা, স্কন্ধ ও বাহু কিছুটা শক্তিমত্তার পরিচয় বহন করছে বটে। কিন্তু জয়দ্রথের পেশী-স্ফীত বিশাল দেহের তুলনায় গেরুয়াধারীর দেহ একেবারেই নগণ্য।

গেরুয়াধারীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নিল কিশোর। দেখুন, জয়দ্রথের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, এই লৌহদণ্ড আমি হাতের চাপে বাঁকা করব। আপনারা ইচ্ছে করলে এই দণ্ডের কাঠিন্য ও দৃঢ়তা পরীক্ষা করতে পারেন।

কিশোর আবার জয়দ্রথের দিকে ফিরল। গেরুয়াধারীর কথায় তার বিরক্তির সঞ্চার হয়েছিল, কিন্তু প্রতিবাদ না করে সে জয়দ্রথের দিকে মনোনিবেশ করল।

আসুন, এগিয়ে আসুন, উচ্চৈঃস্বরে হাঁক দিল জয়দ্ৰথ, এই লৌহদণ্ড কতখানি কঠিন পরীক্ষা করে দেখুন।

এবারও কেউ এগিয়ে এল না। সিন্দুক তুলতে গিয়ে তারা ঠকেছে, দ্বিতীয়বার বিফল হয়ে জনতার হাসির খোরাক হতে রাজি নয়। আচ্ছা, বুঝলাম আমার কথাতেই আপনারা বিশ্বাস করছেন। তবু আমি অন্তত একজনকে এটা পরখ করতে বলব।

এগিয়ে এসে জয়দ্রথ কিশোরের সামনে লৌহখণ্ড প্রসারিত করল। বলল, দেখ। এই লৌহখণ্ডকে যদি কেউ হাতের চাপে বাঁকা করতে পারে, তবে তাকে অসীম শক্তিশালী বলা যায় কি না।

বলিষ্ঠ মানুষের কবজির মতো স্থূল সেই লৌহদণ্ডের দিকে তাকিয়ে কিশোর মাথা নাড়ল, প্রয়োজন নেই। দণ্ডের আকৃতি আর স্থূলত্বই ওর কাঠিন্য প্রমাণ করছে।

-তবু দেখ।

কিশোর হাত বাড়িয়ে লৌহদণ্ড গ্রহণ করল। বস্তুটির ওজন অনুভব করেই সে বুঝল এই দণ্ড হাতের চাপে বাঁকানো সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। দুই প্রান্ত ধরে একবার চাপ দিয়ে সে দণ্ড ফিরিয়ে দিল জয়দ্রথের হাতে।

লৌহদণ্ডটি হাতে নিয়ে মণ্ডলাকারে দণ্ডায়মান জনতার মাঝখানে দাঁড়াল জয়দ্রথ, হাঁক দিয়ে বলল, দেখুন।

দণ্ডের দুই প্রান্ত ধরে শক্তি প্রয়োগ করল সে। জনতা দেখল, তার কঁধ ও বাহুর উপর জেগে উঠেছে সাবলীল মাংসপেশীর তরঙ্গ।… দণ্ড তখনও অবিকৃত!… পেশীগুলি আরও স্ফীত হয়ে উঠল, সর্বাঙ্গ আর মুখ হল রক্তবর্ণ, ললাটে জাগল কুঞ্চনরেখা…

জনতা সবিস্ময়ে দেখল সেই অতি স্থূল দণ্ড ধীরে ধীরে বক্রাকার ধারণ করছে।

কিশোরের মুখে হাসির রেখা দেখা দিল। আপনমনেই মাথা নেড়ে সে বলে উঠল, হ্যাঁ, জয়দ্রথ অসাধারণ বলবান বটে।

পিছন থেকে ভেসে এল পরিচিত কণ্ঠস্বর, অসাধারণ না হলেও বলবান বটে।

সক্রোধে গেরুয়াধারীর দিকে ফিরে দাঁড়াল কিশোর, আপনি গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী, শক্তিমানের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে জানেন না।

-গৈরিকধারণ করলেই সন্ন্যাসী হয় না। আর প্রাপ্য মর্যাদার কথা যদি বলল, তাহলে বলব যার যতটুকু প্রাপ্য ততটুকুই আমি দিতে প্রস্তুত, তার বেশি নয়।

–শক্তিমানের প্রাপ্য মর্যাদা শক্তিমানই দিতে পারে। স্থলোদর মেদসর্বস্ব সন্ন্যাসীর পক্ষে অপরের শক্তির পরিমাপ করা সম্ভব নয়।

-ওহে বালক! আমি মেদসর্বস্ব নই। তুমি এখনও মানুষের দেহ দেখে তার শক্তির পরিমাপ করতে শেখ নি।

গেরুয়াধারীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিদ্রূপতীক্ষ্ণ কণ্ঠে কিশোর বলল, আপনি বলতে চান আপনাকে দেখে আপনার দৈহিক শক্তির পরিমাপ আমি করতে পারি নি? ভালো, এখন বলুন তো, হে শক্তিমান সন্ন্যাসী! ওই লৌহদণ্ড কি আপনি হাতের চাপে বক্র করতে সমর্থ?

কিশোরের বলার ভঙ্গি ও ভাষা অত্যন্ত অপমানকর, কিন্তু গেরুয়াধারীর মুখে ক্রোধের আভাস মাত্র নেই, ওই লৌহদণ্ড আমি বাঁকিয়ে দিতে পারি অনায়াসে।

–আর ওই নিরেট সিন্দুক? ওটিকেও আপনি মাথার উপর তুলতে পারেন নিশ্চয়?

–নিশ্চয়ই পারি।

–তবে একটু আগে জয়দ্রথ যখন জনসমক্ষে সবাইকে শক্তির পরীক্ষা দিতে আহ্বান করেছিল, তখন আপনি চুপ করে ছিলেন কেন?

–প্রয়োজন মনে করিনি। অনর্থক শক্তিক্ষয়ে আমার রুচি নেই।

–বেশ। অনর্থক শক্তিক্ষয় করতে যখন আপনার আপত্তি, তখন অর্থের বিনিময়ে আপনার ক্ষমতার পরিচয় দিন। আমি আপনাকে এখনই একটি সুবর্ণমুদ্রা দেব যদি ওই সিন্দুক আপনি মাথার উপর তুলতে পারেন।

গেরুয়াধারীর দুই চোখে মুহূর্তের জন্য বিস্ময়ের চমক দেখা গেল, পরক্ষণেই আত্মসংবরণ করে সে বলল, অর্থ পেলে মন্দ হয় না। বিশেষত একটি স্বর্ণমুদ্রার প্রলোভন সংবরণ করা আমার ন্যায় দরিদ্র ব্যক্তির পক্ষে খুবই কঠিন। কিন্তু এখানে শক্তির পরীক্ষা দিলে জয়দ্রথের ক্ষতি হবে। এটা তার জীবিকা। আমি কারও জীবিকার ক্ষতি করি না।

ওঃ! কিশোরের কণ্ঠে স্পষ্ট বিদ্রূপ, আপনি অতি মহাশয় ব্যক্তি। তবে মন্দলোকে হয়তো আপনাকে ধূর্ত বাক্যবীর বলেও মনে করতে পারে।

তা মনে করতে পারে বটে।

গেরুয়াধারীর মুখের হাসি আরও প্রশস্ত হল। শ্লেষ ও বিদ্রূপ তাকে স্পর্শ করেছে বলে মনে হল না। কিশোর কি যেন বলতে গেল, তার আগেই জনতার হর্ষধ্বনিতে চমকে সে জয়দ্রথের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল লৌহদণ্ড প্রায় গোলাকার ধারণ করেছে।

এই অসাধারণ শক্তির পরিচয় কিশোরকে মুগ্ধ করে দিল। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে গেরুয়াধারীকে লক্ষ করে আর একটি শ্লেষতিক্ত বিদ্রূপবাণ নিক্ষেপ করতে উদ্যত হল, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে জনতার পিছন থেকে এক প্রচণ্ড কোলাহল ভেসে এসে তার উদ্যত জিহ্বাকে স্তব্ধ করে দিল।

যারা খেলা দেখছিল তারাও কৌতূহলী হয়ে পিছনে তাকিয়ে কোলাহলের কারণ আবিষ্কার করতে সচেষ্ট হল। আচম্বিতে জনতার এক বৃহৎ অংশ সবেগে আলোড়িত হয়ে এদিক ওদিক ছিটকে পড়ল। পরক্ষণেই সকলকে সতর্ক ও সন্ত্রস্ত করে জাগল বহুকণ্ঠের চিৎকার–

সাবধান! সাবধান! সরে যাও। ক্ষিপ্ত অশ্ব ছুটে আসছে! ঝটিকার আকস্মিক আবির্ভাবে

গাছের তলায় ঝরা পাতার রাশি যেমন উড়ে যায়, ঠিক তেমনি ভাবেই রাজপথের উপর দিয়ে সবেগে অদৃশ্য হয়ে গেল পথচারীদের ধাবমান মূর্তি।

কিশোর সচমকে দেখল তার আশেপাশে গেরুয়াধারী ছাড়া আর কেউ নেই। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই লোকারণ্যে আবৃত রাজপথ জনমানবশূন্য হয়ে গেছে।

বাঁচাও! বাঁচাও!

পথের বাঁক ঘুরে একটি বৃহৎ অট্টালিকার তলায় আত্মপ্রকাশ করল দ্রুতবেগে ধাবমান এক বিশাল অশ্ব। অশ্বের কণ্ঠ আলিঙ্গন করে তার পিঠের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে এক স্থূলকায় ব্যক্তি কোনোমতে নিজেকে রক্ষা করছে এবং পরিত্রাহি চিঙ্কারে সাহায্য চাইছে, বাঁচাও! বাঁচাও!

ঈস! কিশোর সভয়ে বলল, লোকটি এখনই পড়ে মরবে যে!

মরুক; দুনিয়ার একটা পাপ বিদায় হবে, গেরুয়াধারীর কষ্ঠ অবিচলিত, তুমি বোধহয় নগরীতে নবাগত, তাই ওকে জানো না। ও হচ্ছে রত্নাকর বণিক। অত্যন্ত লোভী হীনচেতা ব্যক্তি।

-বাঁচাও। সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দেব।

অশ্বপৃষ্ঠ থেকে আবার ভেসে এল আর্তচিৎকার। পরক্ষণেই সেই আর্তনাদকে ডুবিয়ে জাগল অশ্বের তীব্র হেষাধ্বনি।

সহস্র স্বর্ণমুদ্রা? কিশোর বিস্মিত স্বরে বলে উঠল।

সহস্র স্বর্ণমুদ্রা রত্নাকরের কাছে কিছুই নয়, গেরুয়াধারী মন্তব্য করল, কিন্তু সহস্র স্বর্ণমুদ্রার জন্য প্রাণবিপন্ন করবে কে?

পিছন থেকে ভেসে এল উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, আমি।

চমকে উঠে কিশোর দেখল তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে জয়দ্ৰথ। দারুণ উত্তেজনায় তার চোখ জ্বলছে এবং হাত হয়েছে মুষ্টিবদ্ধ।

জয়দ্রথ উত্তেজিত স্বরে বলল, অর্থের পরিমাণ কম নয়। সহস্র স্বর্ণমুদ্রার জন্য আমি বাঘের গুহায় প্রবেশ করতে পারি।

আবার ভেসে এল আর্তনাদ, বাঁচাও! সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দেব। ভয় নেই, চিৎকার করে উঠল জয়দ্ৰথ, আমি তোমাকে রক্ষা করব। পরক্ষণেই সে তীরবেগে ছুটল ধাবমান অশ্বের দিকে। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু, অত্যন্ত দুঃখিত স্বরে মন্তব্য করল গেরুয়াধারী, জগতে অর্থই। সকল অনর্থের মূল।

.

০৪. নগরে নেকড়ের হানা

ছুটতে ছুটতে অশ্বের কাছাকাছি এসে পড়ল জয়দ্ৰথ, তবু শেষরক্ষা হল না। এক ঝটকায় পিঠের জীবন্ত বোঝাকে ছিটকে ফেলে অশ্ব হ্রেষাধ্বনি করে উঠল। রত্নাকর বণিক মাটিতে পড়ে গড়াতে লাগল প্রকাণ্ড এক কুণ্ডের মতো। আর জ্বলন্ত দুই চোখের নির্নিমেষ দৃষ্টি মেলে তাকে লক্ষ করতে লাগল অশ্ব। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে হাতে ভর দিয়ে রত্নাকর উঠে বসল তৎক্ষণাৎ ভীষণ চিৎকার করে দুরন্ত পশু ছুটে এসে পিছনের পায়ে খাড়া হয়ে উঠল।

দারুণ আতঙ্কে দুই চোখ মুদে ফেলল রত্নাকর- এই বুঝি সামনের দুই খুর একজোড়া লৌহমুষলের মতো এসে পড়ে তার দেহের উপর।

একটা তীব্র হেষাধ্বনি কানে এল, রত্নাকরের বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল– কিন্তু নাঃ! অশ্বের পদাঘাতে তো তার দেহের উপর পড়ল না।

আবার, আবার জাগল সেই তীব্র হ্রেষাধ্বনি! কানের পর্দা বুঝি ফেটে যাওয়ার উপক্রম। তবুও দেহের উপর কোনো আঘাত অনুভব করে না রত্নাকর বণিক।

আবার হ্রেষাধ্বনি। স্বর এবার মৃদু, স্তিমিত। তার পরই কানে আসে মনুষ্যকণ্ঠের আওয়াজ, এ যে দেখছি খুনী জানোয়ার। আরোহীকে পিঠ থেকে ফেলেও স্বস্তি নেই–মানুষটাকে পদদলিত করতে চায়।

খুব ধীরে ধীরে আর ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে ফেলল রত্নাকর। দেখল, অশ্বের বলগা ধরে দাঁড়িয়ে আছে ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিত এক প্রকাণ্ড পুরুষ। লোকটির দেহের শক্তি নিশ্চয়ই অসাধারণ বলগার আকর্ষণে তেজস্বী অশ্ব স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে; শুধু ফুরিত নাসারাঙ্কু ও জ্বলন্ত চক্ষুর হিংস্র দীপ্তি থেকে প্রকাশ পাচ্ছে জানোনায়ারের দুরন্ত আক্রোশ।

রত্নাকর সোজা হয়ে উঠে বসল। সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ চিৎকার করে জন্তুটা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করল।

সভয়ে চেঁচিয়ে উঠল রত্নাকর, সাবধান! হাত ফসকালেই বিপদ! একবার যদি—

রত্নাকরের মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই ক্রুদ্ধ অশ্ব আক্রমণ করল। না, রত্নাকরকে নয় যে বলিষ্ঠ-দর্শন মানুষটি অশ্বের বলগা ধারণ করেছিল, মুহূর্তের জন্য বুঝি শিথিল হয়েছিল তার মুষ্টি, এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অশ্ব হাতটা কামড়ে ধরল।

উঃ! তুমি শুধু পদাঘাতেই পটু নও, দংশনেও বিলক্ষণ দক্ষ।

ব্যাঘ্রচর্মে সজ্জিত বিশালদেহী পুরুষ তার ডান হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল না, বাঁহাত দিয়ে মল্লযোদ্ধার অভ্যস্ত কৌশল অশ্বের নাসিকায় প্রচণ্ড আঘাত হানল, তোমার জানা উচিত মল্লযোদ্ধার হাত অশ্বের ভক্ষ্য নয়।

অস্ফুট আর্তনাদ করে অশ্ব হাত ছেড়ে দিল। তৎক্ষণাৎ আবার বজ্রমুষ্টিতে ধরা পড়ল অশ্বের বলগা। আরক্ত চক্ষে একবার হ্রেষাধ্বনি করে অশ্ব স্থির হয়ে গেল। সে বুঝেছে, এ বড়ো কঠিন ঠাই।

অশ্ব ও মানুষের দ্বৈরথ-রণ দেখতে দেখতে পার্শ্ববর্তী গেরুয়াধারীকে উদ্দেশ্য করে কিশোর বলে উঠল, জয়দ্রথ শেষ পর্যন্ত অশ্বকে ধরে ফেলল! দেখুন, দেখুন! ক্ষিপ্ত অশ্বের আবির্ভাবে যে-সব পথচারী আড়ালে সরে গিয়েছিল, তারা আবার নির্ভয়ে মুক্ত রাজপথের উপর এসে দাঁড়িয়েছে- আরে! ওরা আবার কারা!

রাজপথে শুধু পলাতক পথিকরাই ফিরে আসে নি, আরও একদল বিচিত্র মানুষ আবির্ভূত হয়েছে সেখানে। তাদের কটিবন্ধে তরবারি, বাম হস্তে লৌহদস্তানা।

গেরুয়াধারী গম্ভীরভাবে উত্তর দিল, দ্বিপদ নেকড়ে।

–দ্বিপদ নেকড়ে?

হ্যাঁ। কিন্তু বনবাসী চতুষ্পদ নেকড়ের চাইতে এই দ্বিপদ নেকড়ের দল অনেক বেশি ভয়ংকর। ওরা রত্নাকর বণিকের দেহরক্ষী অর্থাৎ বেতনভোগী দস্যু। নগরের বাসিন্দারা ওই দুর্বৃত্তদের ভালোভাবেই জানে। তুমি নগরীতে নবাগত বলেই ওদের জানো না।

-রত্নাকর আর তার সহচর দুর্বৃত্তদের নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে চাই না। আমি কথা বলতে চাই জয়দ্রথের সঙ্গে। এখন রত্নাকরের সঙ্গে ওর পুরস্কারের ব্যাপারটা মিটে গেলেই–

–অত সহজে ব্যাপার মিটবে না। জয়দ্রথের সঙ্গে তোমার কথা বলার সুযোগ হবে কি না সন্দেহ। বিপদ কেটে যাওয়ার পর রত্নাকর বণিক অত টাকা দিতে রাজি হবে বলে মনে হয় না।

গেরুয়াধারীর সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ রেখে কিশোর একটু এগিয়ে গেল। রত্নাকর তখন ভূমিশয্যা ছেড়ে দণ্ডায়মান হয়েছে এবং অশ্বের বলগা ধরে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে জয়দ্ৰথ।

মহাশয়। জয়দ্রথ বিনীত কণ্ঠে বলল, আপনার প্রতিশ্রুত সহস্র স্বর্ণমুদ্রা কি এখানেই দেবেন? না, আপনার গৃহে যাওয়ার প্রয়োজন হবে?

দুই চোখ কপালে তুলে রত্নাকর বণিক বললে, সহস্র স্বর্ণমুদ্রা। বলে কি!

জয়দ্রথের মুখে ফুটল ক্রোধ ও বিস্ময়ের আভাস, একটু আগেই ঘোড়ার পিঠ থেকে যে পুরস্কার ঘোষণা করেছেন, এরই মধ্যে তা বিস্মৃত হয়েছেন?

রত্নাকর সপ্রতিভাবে বলল, পুরস্কারের কথা আমি বিস্মৃত হইনি। যদি তুমি আমাকে ধাবমান অশ্বের পৃষ্ঠ থেকে উদ্ধার করতে তাহলে অবশ্যই ওই পুরস্কার তোমার প্রাপ্য ছিল। কিন্তু তুমি যখন অশ্বের গতিরোধ করলে, তখন

তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে এক ব্যক্তি বলে উঠল, তখন আপনি অশ্বপৃষ্ঠ থেকে ধরাপৃষ্ঠে অবতীর্ণ হয়েছেন, অতএব

পাশের লোকটি তার মুখের কথা লুফে নিয়ে বলল, অতএব পুরস্কারের উল্লেখ করা উচিত নয়।

জয়দ্রথ তাকিয়ে দেখল ওই দুই ব্যক্তির বাঁহাত লোহার দস্তানায় ঢাকা, কটিবন্ধে তরবারি। তাদের পাশে আরও যে দুটি মানুষ নীরবে দাঁড়িয়েছিল, তাদের অস্ত্রসজ্জাও একইরকম। জয়দ্রথ বুঝল এরা একই দলের মানুষ।

রত্নাকর বণিক পূর্বোক্ত চারমূর্তির দিকে তাকিয়ে ক্রোধে ফেটে পড়ল, এই যে অকাল কুম্মাণ্ডের দল! অশ্ব যখন আমাকে বহন করে উধাও হল, তখন কি করছিলে?

প্রথমে যে ব্যক্তি কথা বলেছিল, সে উত্তর দিল, কি করব! ঘোটক যে সম্পূর্ণ বশ মানে নি সে কথা আগেই আপনাকে জানিয়ে ছিলাম। আপনি নিষেধ না শুনে অশ্বারোহণে নগর ভ্রমণ করতে গেলেন।

রত্নাকর তর্জন করে কি যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাকে বাধা দিয়ে জয়দ্রথ বলে উঠল, মহাশয়। নিজের প্রাণ বিপন্ন করে আমি আপনার প্রাণরক্ষা করেছি। অনুগ্রহ করে প্রতিশ্রুত সহস্র স্বর্ণমুদ্রা আগে আমাকে দিন। তর্ক পরে করবেন।

রত্নাকর শুষ্ক স্বরে বলল, আমার বক্তব্য তুমি আগেই শুনেছ। আর আলোচনা অনাবশ্যক।

লৌহ-দস্তানাধারী প্রথম ব্যক্তি বলল, প্রভু! এই ব্যক্তি পলাতক অশ্বকে গ্রেপ্তার করেছে। অতএব, ওকে দুটি রজতমুদ্রা পুরস্কার না দিলে অন্যায় হবে।

ঠিক! ঠিক! রত্নাকর সোৎসাহে বলল, কিঞ্জল! তুমি সর্বদাই উচিত কথা বলো। ওকে অন্তত দুটি রজত মুদ্রা না দিলে ঘোরতর অন্যায় হবে।

কী! দুটি রজতমুদ্রা! সক্রোধে গর্জে উঠল জয়দ্ৰথ, আমি দুটি রজতমুদ্রার প্রত্যাশী নই.. বেশ! এই অশ্বকে আমি বন্দি করেছিলাম, এখন আমিই ওকে মুক্তি দিচ্ছি। ওহে কিঞ্জল! সাধ্য থাকে ঘোটকের গতি রোধ করে তুমি দুটি রজতমুদ্রা উপার্জন করো।

বলার সঙ্গে সঙ্গে অশ্বের পঞ্জরে সশব্দে এক চপেটাঘাত করে বলগা ছেড়ে দিল জয়দ্রথ।

দুরন্ত অশ্ব বিকট হেষাধ্বনি করে সম্মুখে ঝাঁপ দিল। ধাবমান অশ্বের পথ ছেড়ে সভয়ে ছিটকে সরে গেল রত্নাকর, কিঞ্জল ও তাদের তিন সহচর। রাজপথে খুরের বাজনা বাজাতে বাজাতে ঝড়ের বেগে ছুটল অশ্ব এবং দেখতে দেখতে সকলের চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

দুই হাত কোমরে রেখে অট্টহাস্য করে উঠল জয়দ্রথ। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড আঘাতে স্তব্ধ হয়ে গেল তার হাস্যধ্বনি..

পাশের সঙ্গীকে উদ্দেশ্য করে কিশোর কুদ্ধকণ্ঠে বলল, দেখুন! দেখুন! কিঞ্জল নামে নোভাকটা লোহার দস্তানা দিয়ে জয়দ্রথের মুখে আঘাত করল! কী অন্যায়।

গেরুয়াধারী নির্বিকার ভাবে বলল, নেকড়ের স্বভাবই ওই রকম। তবে এবার শক্ত পাল্লায় পড়েছে নেকড়ে। অনেকদিন পরে একটা ভালো খেলা দেখতে পাব।

আকস্মিক আঘাতে জয়দ্রথ স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। মুখের রক্ত হাত দিয়ে মুছে রক্তাক্ত হাতটাকে সে ভালো করে দেখল, তারপর বলল, কিঞ্জল! তুমি লোহার দস্তানা দিয়ে আমার মুখে মুষ্ট্যাঘাত করে রক্তপাত ঘটিয়েছ।

কিঞ্জল রূঢ়স্বরে বলল, নেকড়ের দংশনে রক্তপাত ঘটে থাকে একথা কি তুমি জানো না?

ওরে কিঞ্জল! শোনো, জয়দ্রথের রক্তাক্ত মুখে ফুটল হাসির রেখা, নেকড়ের দংশনে ব্যাঘ্রের দেহে রক্তপাত ঘটতে পারে, কিন্তু ব্যাঘ্রের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে নেকড়ের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী।

আচম্বিতে বাঁ হাত বাড়িয়ে কিঞ্জলের ঘাড় ধরে ফেলল জয়দ্ৰথ, সঙ্গে সঙ্গে তার ডান হাতের কঠিন বাঁধনে ধরা পড়ল প্রতিদ্বন্দ্বীর কটিদেশ!

সচমকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে তলোয়ারের মুঠি চেপে ধরল কিঞ্জল, কিন্তু অস্ত্রকে কোষমুক্ত করতে পারল না। জয়দ্রথ এমনভাবে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল যে, মুষ্ট্যাঘাত করাও সম্ভব ছিল না। তাই কিঞ্জলের বামহস্তের মারাত্মক লৌহদস্তানাও হয়ে পড়ল অকর্মণ্য!

জয়দ্রথ হেসে উঠে বলল, নির্বোধ! মল্লযোদ্ধার আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলে লৌহদস্তানা অথবা তরবারি ব্যবহার করা যায় না।

পরক্ষণেই কিঞ্জলের দেহ সবেগে শূন্যপথে পাক খেয়ে মাটির উপর আছড়ে পরল সশব্দে!

কিশোর বিস্মিত স্বরে বলল, আশ্চর্য! অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী না হলে একটা বলিষ্ঠ পুরুষকে ওভাবে নিক্ষেপ করা সম্ভব নয়। জয়দ্রথ সত্যই নরব্যাঘ্র বটে। কিঞ্জলের আর উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। আশা করি এইবার জয়দ্রথের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাব।

গেরুয়াধারী একবার তার দিকে দৃষ্টিপাত করে বলল, তুমি হঠাৎ জয়দ্রথের সঙ্গে কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছ কেন জানি না। তবে খেলাটা এখনও শেষ হয় নি।

জয়দ্রথ তখন ভূপতিত শত্রুর দিকে তাকিয়ে গর্বিত স্বরে বলছে, কিঞ্জল! আজ তোমাকে লঘুদণ্ড দিয়ে অব্যাহতি দিলাম। ভবিষ্যতে মনে রেখো মল্লযোদ্ধার গায়ে হাত দেওয়া নিরাপদ নয়।

ভূমিশয্যা থেকে কোনোরকমে হাতের উপর ভর করে শরীরটাকে একটু তুলে ধরল কিঞ্জল, বন্ধুগণ! আমরা কি এই অপমান সহ্য করব?

কখনই নয়, একাধিক কণ্ঠে জাগল হিংস্র গর্জন, ওই দুর্বিনীত মল্লকে আমরা উচিত শিক্ষা দেব। পরক্ষণেই লৌহময় বজ্রমুষ্টি তুলে তিন দুর্বৃত্ত ঝাঁপিয়ে পড়ল জয়দ্রথের উপর।

অদ্ভুত কৌশলে শত্রুর আক্রমণ এড়িয়ে প্রতি-আক্রমণ করল জয়দ্ৰথ। লৌহমুষ্টির আঘাত তার দেহের স্থানে স্থানে রক্তাক্ত ও স্ফীত ক্ষতচিহ্নের সৃষ্টি করল বটে, কিন্তু কোনো আঘাতই মারাত্মক হল না। এত দ্রুত সে দেহকে চালনা করছিল যে, শত্রুরা লক্ষ্যস্থির করে আঘাত হানার সুযোগ পাচ্ছিল না। উপরন্তু তার দুই বলিষ্ঠ বাহু দুটি লৌহদ্বারের মতোই শত্রুপক্ষের আঘাত ব্যর্থ করে দিচ্ছিল বারংবার। এরই মধ্যে হাত ও পায়ের ক্ষিপ্র সঞ্চালনে একটি শত্রুকে আহত করল জয়দ্রথ– আহত ব্যক্তি অস্ফুট আর্তনাদ করে ধরাশয্যায় লুটিয়ে পড়ল।

কিশোর উল্লসিত স্বরে বলল, বীর বটে জয়দ্রথ। একটি নিরস্ত্র মানুষের বিক্রমে পর্যদস্ত হয়ে যাচ্ছে লৌহমুষ্টি পরিহিত তিন-তিনটি দুর্বৃত্ত।

তিনটি নয় হে, গেরুয়াধারী হেসে বলল, চারটি দুর্বৃত্ত। ওই দেখ কিঞ্জল ভূমিশয্যা ত্যাগ করেছে।

কিশোর উদ্বিগ্ন নেত্রে দেখল কিঞ্জল উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে আসছে জয়দ্রথের দিকে!…

মল্লযোদ্ধার দক্ষিণ হস্তের করপুট তরবারির মতো এক প্রতিদ্বন্দীর স্কন্ধে আঘাত করে তাকে ছিটকে ফেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে মল্লযোদ্ধার মস্তকে প্রচণ্ডবেগে আঘাত হানল কিঞ্জলের লৌহদস্তানায় আবৃত বজমষ্টি— অতর্কিতে আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল জয়দ্রথ।

তৎক্ষণাৎ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল চারটি দ্বিপদ নেকড়ে…

কিশোর ক্রুদ্ধস্বরে বলল, ঈস! দুরাত্মা কিঞ্জল পিছন থেকে আক্রমণ করে জয়দ্রথকে ধরাশায়ী করল। আরে! আরে! যে দুই দুর্বৃত্ত জয়দ্রথের হাতে মার খেয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছিল তারাও দেখছি উঠে পড়ল… ঈস! সবাই মিলে প্রায় অচেতন মানুষটাকে প্রহারে জর্জরিত করছে আর পথচারী নাগরিকের দল পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছে!… না! নির্বিকার চিত্তে এমন দৃশ্য দর্শন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

ক্ষিপ্রহস্তে কোষ থেকে অসি টেনে আনার জন্য অস্ত্রের হাতল চেপে ধরল কিশোর, সঙ্গে সঙ্গে লোহার সাঁড়াশির মতো কোনো বস্তু কঠিন পেষণে চেপে ধরল তার দক্ষিণ হস্তের মণিবন্ধ। সচমকে তাকিয়ে সে দেখল গেরুয়াধারীর বাঁহাতের আঙুলগুলো তার ডান হাতের কবজিতে চেপে বসেছে।

উঃ! যাতনাকাতর স্বরে বলে উঠল কিশোর, ছেড়ে দিন।

গেরুয়াধারীর হাত সরে গেল তার হাতের উপর থেকে। কিশোর বাঁহাত দিয়ে আহত ডান হাতের পরিচর্যা করতে করতে ক্রুদ্ধ নেত্রে গেরুয়াধারীর দিকে তাকাল।

গেরুয়াধারী তখন মৃদু মৃদু হাসছে।

রুষ্টস্বরে কিশোর বলল, আপনি হাসছেন? আমার হাত যন্ত্রণায় অসাড় হয়ে গেছে। আপনি আমার হাত চেপে ধরলেন কেন?

গেরুয়াধারী বলল, জয়দ্রথকে রক্ষা করার জন্য তুমি তরবারি হাতে মৃত্যর মখে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত হয়েছিলে– তাই তোমাকে নিরস্ত করলাম।

কুঞ্চিত চক্ষে গেরুয়াধারীকে নিরীক্ষণ করতে করতে কিশোর বলল, আপনার দেহে অসুরের শক্তি। কিন্তু ওই শক্তি আমার উপর প্রয়োগ না করে বিপন্ন ব্যক্তির উদ্ধারকার্যে প্রয়োগ করলে ভালো হত। তবে আপনি আমাকে নিরস্ত করতে পারবেন না।

কথা বলতে বলতে গেরুয়াধারীর পাশ কাটিয়ে একটু এগিয়ে গেল কিশোর, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে গর্বিতস্বরে বলল, আপনার কৃপায় আমার ডানহাত অকর্মণ্য হয়ে অসিধারণে অসমর্থ, কিন্তু বাঁহাত সম্পূর্ণ সুস্থ এবং কটিদেশেও ছুরিকাও সুশানিত- আপনি আমাকে বাধা দিতে পারবেন না।

মুহূর্তের মধ্যেই কিশোরের বাঁহাতের মুঠিতে ঝকমক করে জ্বলে উঠল কোষমুক্ত সুদীর্ঘ ছুরিকা। পরক্ষণেই তীরবেগে সে ছুটল সেইদিকে, যেখানে চারটি আততায়ীর কবলে ছটফট করছে মল্লবীর জয়দ্রথ!

দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে গেরুয়াধারী আপনমনেই বলে উঠল, নাঃ! এই বালক বোধহয় আমাকে নিরপেক্ষ থাকতে দেবে না। আমি কলহ পছন্দ করি না বটে, কিন্তু চোখের সামনে নিশ্চেষ্ট হয়ে বালকের মৃত্যু দেখা সম্ভব নয়।

০৫. জল্লাদের আবির্ভাব

জয়দ্রথের সর্বাঙ্গ তখন লৌহদস্তানার মুষ্টিপ্রহারে জর্জরিত। মাটির উপর অর্ধশায়িত অবস্থায় কোনোরকমে সে মুখ আর মাথা রক্ষা করছে।

অকস্মাৎ তার কানে এল কিঞ্জলের কণ্ঠস্বর, সরে যাও। তোমাদের কর্ম নয়। এই বজ্রমুষ্টিতে আমি দুষ্ট মল্লযোদ্ধার মস্তক চূর্ণ করব।

কাঁধের সুদৃঢ় মাংসপেশীর আড়াল থেকে গ্রীবা ঘুরিয়ে জয়দ্রথ দেখল তার মুখ লক্ষ্য করে উদ্যত হয়েছে কিঞ্জলের লৌহময় মুষ্টি। পরক্ষণেই সেই মুষ্টি সবেগে নামল তার মুখ লক্ষ্য করে। হাত তুলে আত্মরক্ষার চেষ্টা করল জয়দ্রথ বাহুর মাংসপেশীর উপর পিছলে কিঞ্জলের লৌহদস্তানা শত্রুর মুখে আঘাত হানল। আঘাতের বেগ বাহুতে লেগে কিছুটা কমে গেল বটে, কিন্তু যেটুকু লাগল তাতেই চোখে অন্ধকার দেখল জয়দ্ৰথ। ক্রমাগত লৌহদস্তানার প্রহারে যে অবসন্ন হয়ে পড়েছিল, কিঞ্জলের মুষ্ট্যাঘাত এবার তার চেতনাকে প্রায় অবলুপ্ত করে দিল তার হাত সরে গেল মুখের উপর থেকে, মাথা ঝুঁকে পড়ল মাটির দিকে।

দ্বিপদ নেকড়ের দল হর্ষধ্বনি করে উঠল। কিঞ্জলের বাম হস্তের লৌহ-আবৃত বজ্রমুষ্টি শূন্যে দুলে উঠল নিষ্ঠুর পুলকে!

কিন্তু চরম আঘাত হানার আগেই তার বাম বাহু অসহ্য যাতনায় অসাড় হয়ে গেল। আর্তনাদ করে ডান হাত দিয়ে বাম বাহু চেপে ধরে কিঞ্জল সম্মুখে দৃষ্টিপাত করল।

আঘাতের কারণ আবিষ্কার করতে বিলম্ব হল না। কিঞ্জলের সঙ্গীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে এক কিশোর তার বাঁহাতে সুদীর্ঘ ছুরিকা নৃত্য করছে জীবন্ত বিদ্যুৎশিখার মত! সঙ্গে সঙ্গে দুর্বৃত্তদের মধ্যে জেগে উঠছে আর্তনাদের পর আর্তনাদ!

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই প্রত্যেকটি দুবৃত্তের বাঁহাত ছুরিকাঘাতে বিদীর্ণ হয়ে গেল– ফলে অকর্মণ্য হয়ে গেল লৌহ-দস্তানার হিংস্র আস্ফালন!

এই বিদ্যুৎচকিত আক্রমণে স্তম্ভিত হয়ে গেল চারটি দুবৃর্ত। ডানহাত দিয়ে বাঁহাতের রক্তাক্ত ক্ষতস্থান চেপে ধরে তারা আক্রমণকারীর দিকে দৃষ্টিপাত করল।

শূন্যে রক্তাক্ত ছুরিকা আন্দোলিত করে কিশোর বলল, শোনো! সামান্য আঘাত দিয়ে আমি তোমাদের সতর্ক করে দিলাম। এখনই স্থানত্যাগ না করলে আমার ছুরিকা বাহু ছেড়ে বক্ষে বিদ্ধ। হবে।

কিঞ্জলের এক সঙ্গী তাকে মৃদুস্বরে বলল, এই কিশোরের পিছনে নিশ্চয়ই অন্য লোক আছে। একাকী আমাদের আক্রমণ করতে ও সাহস পেত না।

কিঞ্জল ক্রুদ্ধস্বরে বলল, সপশিশু এমন অতর্কিতে ছোবল মারল যে, কিছু করার সুযোগ পেলাম না। আমার বাঁহাত ছুরিকাঘাতে অবশ হয়ে গেছে।

আর এক দুর্বৃত্ত বলল, আমার অবস্থাও তোমার মতো।

চতুর্থ ব্যক্তি বলল, আমার বাঁহাতও সম্পূর্ণ অকর্মণ্য। ছুরি হাড় পর্যন্ত কেটে বসে গেছে। কিঞ্জল এখন কি করব?

কিশোরের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, যাও। শীঘ্র স্থানত্যাগ করো।

কিঞ্জলের সঙ্গীরা আদেশের অপেক্ষায় তার মুখের দিকে চাইল।

এক দুর্বৃত্ত জিজ্ঞাসা করল, কিঞ্জল আমরা কি তবে চলে যাব?

হিংস্র হাস্যে কিঞ্জলের ওষ্ঠাধর বিভক্ত হয়ে উঁকি দিল দন্তের সারি, অবশ্যই চলে যাব। কিন্তু যাওয়ার আগে বালকের কোমল মাংসে পথবাসী কুকুরের ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থা করব।

পরক্ষণেই তার কটিবন্ধনের কোষ থেকে সশব্দে বিদ্যুৎবর্ষণ করে চমকে উঠল নগ্ন তরবারি।

এক সঙ্গী উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল, কিঞ্জল! তুমি কি অসি ব্যবহার করবে?

কিঞ্জল বলল, অগত্যা! আমার বামবাহু ছুরিকাঘাতে বিদীর্ণ করে এই বালক নিজের দেহের উপর তরবারির আঘাত ডেকে এনেছে। বালক সশস্ত্র; অতএব তরবারি ব্যবহার করলে শ্রাবস্তীর আইন অনুসারে আমি অপরাধী বলে গণ্য হব না। লৌহ-দস্তানার পরিবর্তে এইবার রক্তপান করবে শাণিত তরবারি।… ওহে বালক! তরবারি কোষমুক্ত করো।

কিশোর কণ্ঠে ধ্বনিত হল দর্পিত ঘোষণা, তরবারির প্রয়োজন নেই। তোমাকে শিক্ষা দেবার জন্য এই ছুরিকাই যথেষ্ট।

ভীষণ গর্জন করে তরবারি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল কিঞ্জল। তীব্র ঝনকার শব্দে অসি প্রতিহত হল। একবার নয়, পর পর দুইবার। বিদ্রুপের হাসি ফুটল কিশোরের মুখে, অত সহজ নয় হে কিঞ্জল, অত সহজ নয়।

জনতার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে কিঞ্জলের অসি বারংবার ব্যর্থ আক্রোশে কিশোর-যোদ্ধার চতুর্দিকে ক্রুদ্ধ ভীমরুলের মতো গুঞ্জন করে ফিরতে লাগল, তীব্র ধাতব শব্দে ঝঙ্কার তুলল ছুরিকায় প্রতিহত হয়ে– কিন্তু কিশোরের অঙ্গ স্পর্শ করতে পারল না।

একজন নাগরিক উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে মন্তব্য করল, ছুরিকার সাহায্যে অসিধারীর আক্রমণ রোধ করছে ওই কিশোর! ধন্য শিক্ষা।

গেরুয়াধারী বক্তার দিকে দৃষ্টিপাত করল, দূরে দাঁড়িয়ে প্রশংসার মূল্য কি? যাও, অস্ত্রহাতে কিশোরের পাশে দাঁড়াও। শ্রাবস্তীর নাগরিকবৃন্দ যদি সশস্ত্র হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তবে নেকড়ের দল এখনই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।

আর একটি নাগরিক বলল, আমরা শান্তিপ্রিয় নাগরিক। প্রয়োজন হলে অস্ত্রধারণ করতে জানি বটে, কিন্তু আমরা ওদের মতো সংঘবদ্ধ নই। ওরা বনবাসী নেকড়ের মতো হিংস্র, নেকড়ের মতোই নিষ্ঠুর। অকারণে অথবা সামান্য কারণে ওরা নরহত্যা করতে পারে। আমরা ওদের ভয় পাই।

আচম্বিতে রাজপথের উপর জেগে উঠল তীব্র আর্তনাদ! তরবারি ফেলে দুই হাত দিয়ে রক্তাক্ত পাঁজর চেপে ধরল কিঞ্জল, তারপর পড়ে গেল মাটির উপর।

রক্তাক্ত ছুরিকা তুলে কিশোর কঠিনস্বরে বলল, তুমি মরবে না কিঞ্চল। তবে কয়েকটা দিন তোমাকে শুয়ে থাকতে হবে।

এইবার অকুস্থলে আত্মপ্রকাশ করল রত্নাকর বণিক, তীক্ষ্ণস্বরে চিৎকার করে বলল, নেকড়ের দল কি নখদন্তহীন? যাও, সবাই একসঙ্গে আক্রমণ করো।

কিঞ্জলের সঙ্গীরা হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা প্রথমে ভেবেছিল অসিধারী কিঞ্জলের হাতে অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করবে দুঃসাহসী কিশোর। ছুরিকার সাহায্যে তরবারির আক্রমণ রোধ করে কোনো ব্যক্তি যে অসিধারীকে আহত করতে পারে এমন অসম্ভব ব্যাপার তারা কল্পনাও করতে পারে নি। এখন রত্নাকর বণিকের আহ্বানে তারা সংবিৎ ফিরে পেল। খাপ থেকে তলোয়ার টেনে নিয়ে গর্জে উঠল কিঞ্জলের তিন সহচর, হারে-রে-রে!

বাঁহাতের ছুরিকাকে অগ্রবর্তী করে কিশোর প্রস্তুত হল চরম মুহূর্তের জন্য। সে বুঝেছিল আজ তার শেষ দিন। ডানহাত এখনও অবশ, ওই হাতে অসিধারণে সে অসমর্থ বাঁহাতে ছুরির সাহায্য তিন-তিনটি রক্তলোপ তরবারির আক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। অতএব, মৃত্যু আজ সুনিশ্চিত। কিন্তু বন্যমার্জার যেমন মৃত্যু অবধারিত জেনেও অসহায়ভাবে দলবদ্ধ নেকড়ের মুখে আত্মসমর্পণ করে না, হিংস্র নখরে শত্রুর দেহ ও মুখ বিদীর্ণ করতে করতে মৃত্যুবরণ করে– এই ছুরিকাধারী কিশোরও তেমনি ভাবে প্রস্তুত হল অবধারিত মৃত্যুর জন্য।

মুক্ত তরবারি হস্তে এগিয়ে এল তিন দুর্বৃত্ত। কিশোর হঠাৎ বাঁদিকে ঘুরল এবং পলকে গতি সংযত করে ছুটল ডানদিকে। অকস্মাৎ গতি পরিবর্তনের ফলে মধ্যস্থলে দণ্ডায়মান দুই ব্যক্তির তলোয়ার ধাবমান শিকারকে স্পর্শ করতে পারল না। ডানদিকে যে ব্যক্তি দাঁড়িয়েছিল, সে সম্মুখবর্তী কিশোরকে লক্ষ্য করে সজোরে অসির আঘাত হানল।

কিশোর ছুরির সাহায্যে আক্রমণ প্রতিরোধের চেষ্টা করল না। অদ্ভুত কৌশলে মাটিতে বসে পড়ে সে শত্রুর আঘাত ব্যর্থ করে দিল! পরক্ষণেই এক সুদীর্ঘ লম্ফত্যাগ করে সে চলে গেল তিনটি তরবারির নাগালের বাইরে।

ক্ষিপ্রপদে তাকে লক্ষ্য করে ধেয়ে এল তিন দুর্বৃত্ত।

একটি বৃহৎ অট্টালিকার স্তম্ভে পিঠ দিয়ে উদ্যত ছুরিকা হাত অপেক্ষা করতে লাগল কিশোর।

ধীরে ধীরে এগিয়ে এল তিন দুর্বৃত্ত। কোণঠাসা শিকারের সামনে গিয়েই তাদের গতি মন্থর হয়ে পড়েছে। বেপরোয়া ভাবে আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস তাদের নেই। কিশোরের হাতের ছুরিকা যে প্রাণঘাতী আঘাতে অসিধারী প্রতিদ্বন্দ্বীকেও বিপর্যস্ত করতে পারে, সে কথা ভালো ভাবেই বুঝে নিয়েছে দ্বিপদ নেকড়ের দল–

ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পণে তারা শিকারকে ঘিরে ফেলল, অপরাহ্নের ম্লান সূর্যালোকে জ্বলে উঠল তিনটি রক্তলোলুপ তরবারি…

আচম্বিতে দুর্বৃত্তদের কানে ভেসে এল রত্নাকর বণিকের আর্তস্বর, মাধব! কবুর! গণপতি! এই মুহূর্তে অস্ত্র সংবরণ করো। তোমরা অসি কোষবদ্ধ না করলে আমার প্রাণসংশয় অবশ্যম্ভাবী।

সচমকে ফিরে তাকাতেই তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠল এক অত্যন্ত অভাবিত দৃশ্য! স্থূলকায় রত্নাকরকে শূন্যে তুলে ধরেছে এক বিপুল বপু গেরুয়াধারী ব্যক্তি!

গেরুয়াধারী হাঁক দিয়ে বলল, ওহে নেকড়ের দল! অসি কোষবদ্ধ না করলে তোমাদের প্রভু রত্নাকরকে আমি সজোরে রাজপথে নিক্ষেপ করব। অতএব তোমরা–

গেরুয়াধারীর বাক্য সমাপ্ত না হতেই রাজপথের উপর প্রচণ্ড শব্দে জাগ্রত হল এক গম্ভীর কণ্ঠস্বর, এখানে কি হচ্ছে?

সকলে চমকে উঠল- রাজপথের উপর আবির্ভূত হয়েছে একদল সশস্ত্র অশ্বারোহী! যে ব্যক্তি তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে, প্রশ্নটা এসেছে তারই কণ্ঠ থেকে, এখানে কি হচ্ছে?

কিশোরকে যারা আক্রমণ করেছিল, তাদের মধ্যে একজন সভয়ে বলে উঠল, সর্বনাশ! নগর-কোটাল কলভবর্মা! শীঘ্র অসি কোষবদ্ধ করা।

তৎক্ষণাৎ তিনটি তরবারি সশব্দে খাপের ভিতর প্রবেশ করল। নগর-কোটাল কলভবর্মা আবার প্রশ্ন করলেন, কি ব্যাপার? এখানে কি হচ্ছে?

কোনো উত্তর না পেয়ে কলভবর্মা গেরুয়াধারীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। গেরুয়াধারী তখন রত্নাকর বণিককে মাটিতে নামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বণিকের একটি হাত সে চেপে ধরেছে শক্ত মুঠিতে।

কলভবর্মা কঠোর স্বরে বললেন, কেউ কথা কইবে না মনে হচ্ছে। তবে এখানে যে শান্তিভঙ্গের কারণ ঘটেছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আপনি দেখছি গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী, আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। সন্ন্যাসীর কর্তব্য সম্পর্কে আমি বিশেষ অবহিত নই বটে, তবে স্থূলোদর বণিককে শূন্যে উত্তোলন করা সন্ন্যাসীর কর্তব্যকর্মের অন্তর্গত বলে মনে হয় না। এ বিষয়ে আপনি কি বলেন?

গেরুয়াধারী বলল, আমি বলি সকল অনর্থের মূল এই রত্নাকর বণিক!

অদূরে আহত জয়দ্রথ তখন প্রহার-জর্জরিত দেহটাকে টেনে নিয়ে শায়িত অবস্থা থেকে উপবিষ্ট অবস্থায় উন্নীত করেছে। সেই দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বলল, ওই যে ব্যাঘ্রচর্মে সজ্জিত এক ব্যক্তি ধরাশয্যা ত্যাগ করার চেষ্টা করছে, তার প্রতি একবার দৃষ্টিপাত করুন।

কলভবর্মা পূর্ববৎ কঠোর স্বরে বললেন, করেছি। কিন্তু আমার দর্শন-ইন্দ্রিয় আপনার সহায্যপ্রার্থী নয়। অনুগ্রহপূর্বক কিছু বচনসুধা পরিবেশনে আমার তৃষিত শ্রবণ-ইন্দ্রিয়কে তৃপ্ত করুন যোগিবর!

বিলক্ষণ, বিনীত হাস্যে বিগলিত হল গেরুয়াধারী, আপনার তীক্ষ্ণদৃষ্টি সম্পর্কে অধমের অজ্ঞানতা নিজগুণে মার্জনা করবেন প্রভু! আচ্ছা, এইবার সব কথা খুলে বলছি..

যা কিছু ঘটেছে তার আদ্যোপান্ত বিবরণী দিয়ে গেরুয়াধারী সহাস্যে বলল, সমস্ত ঘটনা তো শুনলেন। এখন বলুন শান্তিভঙ্গের জন্য কে দায়ী? আমি? ওই পুরস্কার লোভী মল্ল? দুঃসাহসী কিশোর? না, এই বণিক আর তার অনুগত নেকড়ের দল?

–হুম! কিন্তু সেই কিশোরটি কোথায়? আমি তাকে দেখতে চাই।

আমাকে কিছু বলছেন? কলভর্মার কথার উত্তর দিয়ে এগিয়ে এল কিশোর। এর মধ্যেই তার হাতের ছুরি খাপের ভিতর আত্মগোপন করেছে।

কলভবর্মা মাথা নেড়ে সায় দিলেন; কথা বললেন না। তাঁর দুই চক্ষের শ্যেনদৃষ্টি সম্মুখবর্তী কিশোরের সর্বাঙ্গ লেহন করতে লাগল। রাজ্যে প্রবাদ আছে, কলভবর্মা নাকি মানুষের গোপন অভিসন্ধি ইচ্ছা করলেই জানতে পারেন। প্রবাদের মুলে কতটা সত্য আছে বলা যায় না। তবে কলভবর্মার দৃষ্টিবাণ অগ্রাহ্য করে অবিচিলত ভাবে অবস্থান করতে পারে রুদ্রদমনের রাজ্যে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম।

কিন্তু কিশোরের আচরণে ভাব-বৈলক্ষণ্য প্রকাশ পেল না। সে হাসিমুখে ঈষৎ নতদৃষ্টিতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কলভবর্মার সামনে।

নগর-কোটাল নির্বাক, কিন্তু তার চক্ষু ও মস্তিষ্ক তখন তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণে সক্রিয়–

দীর্ঘাকার লঘুদেহ, কিন্তু পেশীবদ্ধ, প্রাণসার;… পায়ের আঙ্গুলে দেহভার রেখে চলাফেরা ও দাঁড়ানোর ভঙ্গি দাঙ্গা-হাঙ্গামায় অভ্যস্ত অসিযোদ্ধার মতন… মুখশ্রী সুন্দর, ললাট বুদ্ধিদীপ্ত… চক্ষে কিঞ্চিৎ উগ্রতার আভাস, তবে কৈশোরের রক্তে অগ্নির অস্তিত্ব স্বাভাবিক… ঊর্ধ্বাঙ্গের নীলাভ আঙরাখা ও নিম্নাঙ্গের ধূলিধূসরিত অথচ দৃঢ়বদ্ধ শ্বেতবস্ত্রে দারিদ্র্যের ছাপ না থাকলেও সচ্ছলতার চিহ্ন নেই… কটিদেশে এই বয়সেই অসি ও ছুরিকার অস্তিত্ব দেখে, আর যেটুকু ঘটনার বিবরণ ইতিমধ্যেই শ্রুতিগোচর হয়েছে, তা থেকে মনে হয় অস্ত্রচালনায় সুদক্ষ এই দুঃসাহসী কিশোর অসি ও ছুরিকা মাত্র সম্বল করে দুনিয়ার দরবারে নিজের ভাগ্যঅন্বেষণ করতে চলেছে..

অবশেষে একসময়ে কলভবর্মার তীব্র দৃষ্টি প্রসন্নতায় সহজ হয়ে উঠল, ওষ্ঠাধারেও দেখা দিল মৃদু হাসির আভাস, তুমিই সেই কিশোর, যার কথা বলছিলেন গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী? তুমি একাকী ছুরিকামাত্র সম্বল করে অসিধারী কিঞ্জল ও তার সহচর তিন দুৰ্বত্তের সম্মুখীন হয়েছিল? বণিক রত্নাকর ও তার কুখ্যাত নেকড়ে-বাহিনীর বহু অপকীর্তির কথা আমার কানে এসেছে, কিন্তু উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ পাইনি বলেই আজ পর্যন্ত দুর্বৃত্তদের দণ্ডবিধানের ব্যবস্থা করতে পারি নি।

একবার রত্নাকর বণিক ও তার সহযোগী তিনটির দিকে তাকালেন কলবর্মা, তারপর গম্ভীরস্বরে বললেন, আজ ওদের হাতে পেয়েছি। এখনই ওদের বন্দি করব। তোমরা তিনজন কোতোয়ালিতে গিয়ে সকল ঘটনা লিপিবদ্ধ করবে। কল্যপ্রভাতেই বিচারালয়ে অপরাধীদের বিচার হবে। বিচারক নহুষ শর্মা শক্ত মানুষ। তোমাদের সাক্ষ্য শুনলে তিনি রত্নাকর ও তার দলবলকে কঠিন শাস্তি দেবেন।

কিশোরের মুখের উপর মুহূর্তের জন্য ভেসে উঠল আতঙ্কের কালোছায়া, অস্ফুটস্বরে আপনমনেই সে বলে উঠল, নহুষ শর্মা! সর্বনাশ!

তারপরই নিজেকে সামলে নিয়ে সে কলভবর্মাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, কোতোয়াল মহাশয়। কাল আমি বিচারালয়ে উপস্থিত থাকতে পারব না। বিশেষ কাজে আমাকে কাল অন্যত্র গমন করতে হবে।

নগরকোটাল কলবর্মার ভ্রু কুঞ্চিত হল, নির্বোধ! তুমি উপস্থিত না থাকলে অভিযোগ প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তোমাকে উপস্থিত থাকতেই হবে।

–ক্ষমা করবেন। কোনোমতেই পূর্বোক্ত ব্যবস্থার অন্যথা হতে পারে না।

–আইন অনুসারে অবশ্য আমি তোমাকে জোর করতে পারি না। তুমি যদি অভিযোগ না জানাও তাহলে রাজপুরুষের কিছু করার নেই। অভিযুক্ত ব্যক্তির উপরই আমরা জোর খাটাতে পারি। তবে বুঝতে পারছি রত্নাকর আর তার নেকড়ে-বাহিনী আরও বেশ কিছুদিন নাগরিকদের উপর অত্যাচার চার্লিয়ে যাবে। এবারও রত্নাকর নিষ্কৃতি পেয়ে গেল। আর মল্লযোদ্ধা জয়দ্রথ বঞ্চিত হল প্রাপ্য পুরস্কার থেকে।

-কোতোয়াল মহাশয়। বিশ্বাস করুন আমি নিরুপায়।

শোনো ভাই, জয়দ্রথ এগিয়ে এসে কিশোরের কাঁধে হাত রাখল, তুমি সাক্ষ্য দিলে আমি সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পাব। প্রতিজ্ঞা করছি ওই অর্থের এক তৃতীয়াংশ তোমাকে দেব। তুমি প্রাণবিপন্ন করে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলে, এখন শেষরক্ষা করবে না?

আমি অর্থের প্রত্যাশী নই, কিশোর মৃদুস্বরে বলল, একটু আগেই তোমাকে ক্রীড়া-প্রদর্শনের জন্য একটি স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছি, ভুলে যেও না।

–ভুলি নি। কিন্তু একটি বা দুটি স্বর্ণমুদ্রার প্রশ্ন তো নয়, সহস্র স্বর্ণমুদ্রা বলে কথা।

যদি আমার কথা শোনো, তবে তোমাকে আমি প্রচুর অর্থের সন্ধান দিতে পারি। সেই সম্পদের কাছে সহস্র স্বর্ণমদ্রা তুচ্ছ।

এখন আমাকে বিচারালয় থেকে তুচ্ছসহস্র স্বর্ণমুদ্রা পেতে সাহায্য করে। প্রচুর অর্থের কথা পরে চিন্তা করা যাবে।

কিশোর বিচলিত হয়ে পড়ল। যেভাবেই হোক তাকে জয়দ্রথের বিশ্বাস অর্জন করতেই হবে। কিন্তু বিচারশালায় গিয়ে তাকে সাহায্য করা সম্ভব নয়। সেখানে মূর্তিমান বিপ্নের মতো অবস্থান করছেন বিচারক নহুষ শর্মা।

কিশোর মনে মনে বলল, বিচারক নহুষ শর্মার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে আমার অস্তিত্ব তো বিপন্ন হবেই, আর সমস্ত পরিকল্পনাও হবে পণ্ড। রত্নাকরের সমবেত নেকড়ে-বাহিনীর চাইতে নহুষ শর্মার উপস্থিতি আমার পক্ষে অনেক বেশি বিপজ্জনক। কিন্তু জয়দ্রথকে হতাশ করলে সে কি আমার কোনো কথায় কর্ণপাত করবে?… তাকেও যে প্রয়োজন!… মহাসমস্যায় পড়লাম!

কলভবর্মা হাঁক দিলেন, কিশোর! মনস্থির করো। বলো, কাল তুমি বিচারালয়ে সাক্ষ্য দিতে রাজি?

বিদ্যুৎচমকের মতো একটি চিন্তা তার মস্তিষ্কে সাড়া দিল- কিশোর অনুভব করল এতক্ষণ পরে তার ডানহাতে রক্ত চলাচল শুরু হয়েছে, এখন সে অসি ধারণে সমর্থ।

জয়দ্রথের বিশ্বাস অর্জনের এই হচ্ছে সুবর্ণ সুযোগ!

অতএব–

স্মিতমুখে কিশোর বলল, কোতোয়াল মহাশয়! আমি আজ রাত্রে বিশেষ কার্যে অন্যত্র গমন করব। কিন্তু বিচারালয়ে না গিয়ে অন্য উপায়ে বর্তমান সমস্যার সমাধান বোধহয় সম্ভব। শুনেছি, এই রাজ্যের আইনে অস্ত্রের সাহায্যে বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান আছে। উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে রাজপ্রতিনিধির সম্মুখে সংঘটিত যুদ্ধে বিজয়ীপক্ষের দাবি মেনে নেওয়া হয়। আমি জয়দ্রথের পক্ষ থেকে বিরোধীপক্ষের সমবেত শক্তিকে একাকী যুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছি।

স্তম্ভিত কলবর্মা কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। রাজপথে দণ্ডায়মান নগরবাসীরাও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল– বলে কি!

কয়েক মুহূর্ত পরেই নীরবতা ভঙ্গ করে জাগল জয়দ্রথের ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর, কিশোর। তুমি কি ভেবেছ? আমার স্বার্থরক্ষার জন্য তুমি একাকী তিনটি তরবারির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লড়াই করবে আর আমি হীনবী কাপুরুষের মতো নিশ্চেষ্ট হয়ে সেই যুদ্ধ দেখব? তোমার প্রাণের মুল্যে আমি লাভ করতে চাইব স্বর্ণমুদ্রা?… না, কিশোর; আমি দরিদ্র হলেও এমন হীনচেত নই। প্রয়োজন হলে আমি স্বর্ণমুদ্রার দাবি প্রত্যাহার করব। কিন্তু অপরের জীবন বিপন্ন করে অর্থলাভ করার হীন মনোবৃত্তি আমার নেই।

জয়দ্রথ। আমি জানি তুমি হীনচেতা নও। জানি, তোমার বিশাল বক্ষের নীচে অবস্থান করছে উদার প্রশস্ত অন্তঃকরণ। তোমার প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির প্রমাণও আমি পেয়েছি। কিন্তু এ হচ্ছে অস্ত্রের মুখে প্রাণ নিয়ে খেলা। অস্ত্র নিয়ে মরণ-খেলার খেলোয়াড় তুমি নও। তাই তোমাকে আমি এই যুদ্ধে ডাকছি না। তুমি বিশ্বাস করো জয়দ্রথ–ওই তিন ব্যক্তির সম্মুখে আমি খুব অসহায় নই। মৃত্যু নিশ্চিত জানলে আমি কি ওই প্রস্তাব দিতাম? ছুরিকামাত্র সম্বল করে আমি কিঞ্জলকে কত অনায়াসে পরাস্ত করেছি সেকথা ভুলে যেও না।

আমার আত্মমর্যাদাবোধ আছে। তোমার কোনো কথাই আমি শুনব না। হয় আমরা দুজনেই লড়ব, আর না হয়তো এ লড়াই হবে না। আমি পুরস্কারের দাবি প্রত্যাহার করব।

-আমি যোদ্ধা। একবার যখন যুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছি, তখন আর পিছিয়ে যাব না। বেশ.. তোমার কথাই রইল। কিন্তু জয়দ্ৰথ, তোমার অস্ত্র?

–সে বিষয়ে চিন্তা করে তোমার মস্তিষ্ককে বিব্রত করো না। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।

আচম্বিতে সমবেত জনমণ্ডলীকে চমকিত করে জাগল কভবর্মার প্রচণ্ড কণ্ঠস্বর, কিশোর! দুঃসাহসেরও সীমা আছে। আমি গেরুয়াধারীর মুখে পূর্ববর্তী ঘটনার বিবরণী শুনে বুঝলাম তুমি অস্ত্রচালনায় অতিশয় নিপুণ। কিন্তু তোমার সঙ্গী অস্ত্রে অনভিজ্ঞ মল্লযোদ্ধা। অসিচালনায় দক্ষ তিন দুবৃত্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে তোমাদের মৃত্যু অনিবার্য।

নগর-কোতোয়াল। আপনার ধারণা ভুল, সামনে এগিয়ে এসে গর্বিত কণ্ঠে জয়দ্রথ বলল, আমি অসিযুদ্ধে অনভিজ্ঞ হলেও যুদ্ধে আমাকে পরাজিত করা সহজ নয়।

যে লৌহদণ্ড একটু আগে তার হাতের চাপে প্রায় গোলাকার বস্তুতে পরিণত হয়েছিল, সেই দণ্ডটি এবার সে মাটি থেকে তুলে নিল, ক্রীড়া-প্রদর্শনের সময়ে এই লৌহদণ্ড আমি বক্র করেছিলাম, এইবার এটাকে আমি অস্ত্রের উপযোগী করে নিচ্ছি। দেখুন…।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল গোলাকৃতি বস্তুটি দীর্ঘ ও সরল এক সুদৃঢ় লৌহদণ্ড হয়ে বিরাজ করছে জয়দ্রথের হাতে।

জয়দ্রথ কলভবর্মাকে উদ্দেশ করে বলল, কোতোয়াল মহাশয়! এই লৌহদণ্ডের সাহায্যে আমি অনায়াসে তিনটি তরবারির আক্রমণ প্রতিহত করতে পারব।

তিনটি নয়, চারটি! বলতে বলতে জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করল কিঞ্জল। তার বিদীর্ণ পঞ্জর থেকে রক্ত ঝরে পরিধেয় বস্ত্র লাল হয়ে উঠেছে, কিন্তু সেদিকে তার দৃষ্টি নেই।

বিস্মিত জনতার ভিতর থেকে জাগল গুঞ্জনধ্বনি, কিঞ্জল! কিঞ্জল!

হ্যাঁ, আমি কিঞ্জল, ক্রুদ্ধস্বরে কিঞ্জল বলল, ছুরিকাঘাতের ফলে দারুণ যাতনায় কিছুক্ষণ। মূৰ্ছিত হয়ে পড়েছিলাম। এখন জ্ঞান ফিরে এসেছে এবং আমিও উঠে এসেছি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে।

কিঞ্জলের দুই চোখের জ্বলন্ত দৃষ্টি ফিরল কিশোরের দিকে, নির্বোধ বালক! তুমি সাধ করে ফাঁদে পা দিয়েছ। এখন আমি ন্যায়যুদ্ধে তোমাকে হত্যা করব। স্বয়ং নগর-কোটালও আমাকে বাধা দিতে পারবেন না।

কলবভর্মা ভগ্নস্বরে বললেন, সত্য বটে! এই যুদ্ধে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। এই রাজ্যের আইন অনুসারে কে? জল্লাদ! তুমি এখানে কি চাও?

জনতার ভিতর থেকে সকলের সামনে আত্মপ্রকাশ করল একটি ভীষণদর্শন মানুষ। তাকে দেখামাত্র দণ্ডায়মান দর্শকদের ভিতর জাগল ভয়ার্ত কণ্ঠের অস্ফুট গুঞ্জরন– অর্থাৎ, মানুষটি নগরবাসীর কাছে সুপরিচিত!

লোকটি ধীরপদে এসে দাঁড়াল কিঞ্জলের পাশে। তার কপালের উপর থেকে একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন বামচক্ষুকে বিলুপ্ত করে গণ্ডদেশ পর্যন্ত নেমে এসেছে। ডানদিকের একটিমাত্র চক্ষু ও মুখের উপর এমন এক নিষ্ঠুর হিংসার ছায়া পরিস্ফুট যে, সেদিকে তাকালে যে-কোনো ভদ্ৰব্যক্তির বুকের ভিতর জেগে ওঠে আতঙ্কের শীতল শিহরন! লোকটির কটিবন্ধে রয়েছে দীর্ঘ তরবারি। তার চেহারা ও চালচলনে বোঝা যায় ওই তরবারি ব্যবহারের জন্য সে সর্বদাই উদগ্রীব।

পূর্বোক্ত ব্যক্তিকেই জল্লাদ নামে সম্বোধন করেছিলেন কলভবর্মা। এমন সার্থকনামা মানুষ খুব কমই দেখা যায় সন্দেহ নেই।

জল্লাদ হাসল, এই যুদ্ধে আমি কিঞ্জলের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে চাই। রাজ্যের আইন অনুসারে বিবদমান দুই পক্ষের দলভুক্ত কোনো ব্যক্তির পরিবর্তে তার স্থান গ্রহণ করে অন্য মানুষ অস্ত্রধারণ করতে পারে। আমি এখন রত্নাকর বণিকের পরিবর্তে যুদ্ধ করতে চাই। আপনি আমাকে বাধা দিতে পারেন না। তবে হ্যাঁ, রত্নাকরের যদি আপত্তি থাকে–

রত্নাকর বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে ঘটনার পরিণতি লক্ষ করছিল। এই মানুষটিকে সে ভালো ভাবেই জানে, কিন্তু হঠাৎ জল্লাদ কি কারণে তার উপর সদয় হয়েছে সেটা বুঝতে না পেরে রত্নাকর হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কারণ যাই হোক, জল্লাদের আচরণে যে তারই লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা সে কথা বুঝতে তার দেরি হল না– তাই জল্লাদের মুখের কথা শেষ হতে না হতেই সোসাহে এগিয়ে এসে চিৎকার করে উঠল রত্নাকর, না, না, আমার কোনো আপত্তি নেই।

জল্লাদ হেসে কলভবর্মাকে বলল, শুনলেন তো? এখন আইন অনুসারে আপনি যুদ্ধের ব্যবস্থা করুন। আমি কিঞ্জলের পক্ষে রত্নাকর বণিকের পরিবর্তে অস্ত্রধারণ করব।

হতবুদ্ধি কলভবর্মা স্খলিতস্বরে বললেন, হ্যাঁ, আইনে একটা ওই ধরনের ব্যবস্থা আছে বটে, তবে–

তবে-টবে নয়, হিংস্র হাস্যে বিকশিত হল জল্লাদের দন্তপঙক্তি, নগরকোটাল! আপনি আইনের প্রতিনিধি; আইন মানতে আপনি বাধ্য।

.

০৬. যুদ্ধ

কিশোরের দিকে ফিরে হাঁক দিল জল্লাদ, কর্ণদেব! আমাকে চিনতে পারছ?

কিশোর নিরুত্তর। হা হা শব্দে হেসে উঠল জল্লাদ।

জয়দ্রথ সবিস্ময়ে বলল, জল্লাদ তোমাকে সম্বোধন করে কথা বলছে। তোমার নাম কর্ণদেব? তোমরা পরস্পরের পরিচিত?… জল্লাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে তোমার সঙ্গে ওর শত্রুতা ছিল। আজ সুযোগ বুঝে সে তোমাকে বিপদে ফেলতে চায়। শান্তিপ্রিয় নাগরিকরা ওকে বাঘের মতো ভয় করে। জল্লাদ শুধু দুরাত্মা কিঞ্জলের বন্ধু নয়, জনশ্রুতি আছে ও নাকি দস্যু পরন্তপের

কিশোর শুস্বরে ধমকে উঠল, জয়দ্রথ! চুপ করো।

জল্লাদ কিঞ্জলের পাশ থেকে একটু এগিয়ে এল, তার একটি মাত্র চক্ষুর জ্বলন্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ হল কিশোরের মুখের উপর, কর্ণদেব! তুমি নীরব কেন? আমাকে দেখে কি ভয়ে তোমার বাগরোধ হয়েছে?

কিশোর কর্ণদেব অবিচলিত স্বরে বলল, ভয় নয়, বিস্ময়। তুমি পুনর্বার আমার সামনে এসেছ দেখে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়েছি। হায় রে নির্বোধ! একটি চক্ষু বিসর্জন দিয়েও তোমার চৈতন্য হল না!

জল্লাদ ক্রুদ্ধস্বরে বলল, পামর! বৃথা গর্ব করিস না। তৃতীয় পক্ষ হস্তক্ষেপ না করলে সেইদিনই তোর প্রাণবধ করতাম। ব্যাঘ্রের আশ্রয়ে ব্যাঘ্ৰশিশুর প্রতাপ প্রকাশ পায়, একাকী ব্যাধের সম্মুখে এলে তার মৃত্যু নিশ্চিত।

কর্ণদেব হাসল, জল্লাদ! তৃতীয়পক্ষ উপস্থিত না থাকলে সেইদিনই তোমার মৃতদেহ ধরণীকে আলিঙ্গন করত… বেশ! অধিক কথায় কাজ কি? ব্যাঘ্র আজ অনুপস্থিত। এস! ব্যাঘ্ৰশিশুর দন্ত ও নখরের ধার পরীক্ষা করো। আমি তোমাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছি।

কিঞ্জল এগিয়ে এসে জল্লাদের পাশে দাঁড়াল, তারপর মৃদুস্বরে ফিস ফিস করে বলল, জল্লাদ। আমি বুঝতে পারছি ওই কিশোরের সঙ্গে তোমার পূর্বশত্রুতা ছিল। তুমি দক্ষ অসিযোদ্ধা, কিন্তু কর্ণদেব নামে ওই কিশোর সাক্ষাৎ শমনের অগ্রদূত। আমি তোমাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে নিষেধ করছি।

জল্লাদর ওষ্ঠাধরে ফুটল কুটিল হাসির রেখা, নতকণ্ঠে সে বলল, অবশ্যই তোমার নিষেধ আমি শুনব। কিঞ্জল! আমার মন্ত্র হচ্ছে মারি অরি, পারি যে কৌশলে। আজ কর্ণদেবের রক্ষা নেই।

কর্ণদেবের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে উচ্চৈস্বরে হাঁক দিল জল্লাদ, শোনো কর্ণদেব! তোমার প্রস্তাবে আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু বন্ধুবর কিঞ্জল ও তার সহচর নেকড়ের দল তোমার উপর প্রতিশোধ নিতে চায়। প্রতিশোধ গ্রহণের আনন্দ থেকে আমি তাদের বঞ্চিত করতে পারি না।

তিক্তস্বরে কর্ণদেব বলল, ভীরু! কাপুরুষ! তুমি ভালোভাবেই জান দ্বন্দ্বযুদ্ধে আমার বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হলে তোমার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। তাই দলবদ্ধ হয়ে আমাকে তুমি আক্রমণ করতে চাও। এই অসম যুদ্ধে আমার মৃত্যু নিশ্চিত। তবে তুমিও জেনে রাখো- আমার অসি আজ একাধিক শত্রুর রক্তপান করবে।

কর্ণদেবের পাশে দাঁড়িয়ে লৌহখণ্ড শূন্যে আন্দোলিত করে জয়দ্রথ তীব্রস্বরে বলে উঠল, কর্ণদেব! আমার এই লৌহদণ্ড যমদণ্ডের ন্যায় শত্রুর মস্তক চুর্ণ করবে। যুদ্ধের ফলাফল অনিশ্চিত; কিন্তু সমগ্র জনমণ্ডলী আজ আমার বাহুবল দর্শন করবে। এই পৃথিবী থেকে হয়তো আমি বিদায় গ্রহণ করতে পারি তবে তার আগে কয়েকটি মূর্তিমান পাপকে এই দণ্ডের আঘাতে যমালয়ে প্রেরণ করব।

জয়দ্রথের কথা শেষ হতে না হতেই কিঞ্জলের অনুচরবর্গের কণ্ঠে জাগল ক্রুদ্ধ রণ-হুঁঙ্কার। কিঞ্জল ও জল্লাদ সম্পূর্ণ নীরব; কেবল তাদের জ্বলন্ত চক্ষের হিংস্র দৃষ্টিতে ফুটল হত্যাকারীর নিষ্ঠুর সঙ্কল্প।

আচম্বিতে অশ্বের হ্রেষাধ্বনির মতো তীব্র তীক্ষ্ণস্বরে চিৎকার করে উঠল রত্নাকর বণিক, অনর্থক বিলম্বে কি প্রয়োজন? নগর-কোটাল অনুমতি দিলেই যুদ্ধ শুরু হতে পারে।

রত্নাকর! রুষ্টস্বরে বললেন কলভবর্মা, হত্যালীলা দেখার জন্য তুমি অধীর হয়ে পড়েছ দেখছি। অনুমতি না দিয়ে অবশ্য আমার উপায় নেই। বেশ, শুরু করো যুদ্ধ।

পলাতক মৃগের পশ্চাদ্ধাবনে উন্মুখ শৃঙ্খলাবদ্ধ কুকুরের দলকে ব্যাধ যখন শৃঙ্খলমুক্ত করে দেয়, তখন তারা যেমন হিংস্র গর্জনে উল্লাস জানিয়ে ছুটে যায় নির্দিষ্ট দিকে ঠিক তেমনি ভাবেই চিৎকার করে পাঁচটি হিংস্র মানুষ নগ্ন তরবারি নিয়ে এগিয়ে গেল– তবে দ্রুতপদে নয়, ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পণে!

পূর্ব-অভিজ্ঞতার ফলে তারা বুঝে নিয়েছে কিশোর কর্ণদেব বড় বিপজ্জনক মানুষ; আর তার পাশে লৌহদণ্ড ধারণ করে দানবের মতো যে বিপুল বপু মল্লযোদ্ধাটি অবস্থান করছে সেও অবহেলার বস্তু নয়–অতএব তারা প্রথম থেকেই সতর্ক হল।

ডানহাতে তলোয়ার আর বাঁহাতে ছুরি ধরে অনুচ্চকণ্ঠে সঙ্গীকে উদ্দেশ করে কর্ণদেব বলল, জয়দ্রথ! ওরা আসছে। বেশি কথার সময় নেই। আমার কথা শোনো–তুমি সরে যাও। অনর্থক প্রাণবিপন্ন করে লাভ কি? যদি আমি জয়লাভ করি, তবে তুমি সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পাবে। আর যদি মৃত্যু ঘটে তাহলেও তোমার বিশেষ ক্ষতি নেই। সেক্ষেত্রে তুমি স্বর্ণমুদ্রা থেকে বঞ্চিত হবে, কিন্তু প্রাণসংশয় ঘটবে না।

জয়দ্রথ গর্জন করে উঠল, কী! আবার ওই কথা! যে আমার জন্য প্রাণ দিতে বসেছে, তাকে ফেলে আমি পলায়ন করব?

নির্নিমেষ দৃষ্টি শত্রুপক্ষের গতিবিধির দিকে নিবদ্ধ রেখে কর্ণদেব বলল, জয়দ্রথ? আমি বিনাস্বার্থে প্রাণবিপন্ন করছি না। যদি যুদ্ধে জয়লাভ করে তোমার হাতে সহস্র স্বর্ণমুদ্রা তুলে দিতে পারি, তবে নিশ্চয়ই তুমি আমার প্রতি অনুরক্ত হবে। জয়দ্রথ! বহুদুর থেকে তোমার সন্ধানে আমি এসেছি, তোমার বন্ধুত্ব আমার একান্ত প্রয়োজন। ওরা আসছে; যুদ্ধে অনিচ্ছা জানিয়ে তুমি সরে যাও। যদি বেঁচে থাকি, যদি জয়লাভ করি, তাহলে আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ তুমি পাবে। কথা শোনো… আচ্ছা, যদি লজ্জা পাও তবে চুপ করে থাকো, আমি তোমার নিরপেক্ষতা ঘোষণা করছি… নগরকোটাল কলভ–

বাঘের থাবার মতো প্রকাণ্ড একটা থাবা কর্ণদেবের মুখের উপর পড়ে তাকে স্তব্ধ করে দিল, পরক্ষণেই অসমাপ্ত সমোধন লুফে নিয়ে জয়দ্রথ কর্ণদেবের বাক্য সমাপ্ত করল, নগরকোটাল কলভবর্মা। আমার বন্ধু এতগুলি বীরপুরুষের সমাগমে কিঞ্চিৎ বিহ্বল হয়ে পড়েছে… তাকে কয়েকটা মুহূর্ত সময় দিন.. আচ্ছা… আশা করি এইবার সে সংবিৎ ফিয়ে পেয়েছে।

জয়দ্রথ তার হাত সরিয়ে নিল! এক মুহূর্তের জন্য তার দিকে ক্রুদ্ধ কটাক্ষপাত করে আবার শত্রুর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল কর্ণদেব।

কিঞ্জলের দল কিছুক্ষণের জন্য বিমুঢ় হয়ে পড়েছিল। দলপতির নির্দেশে তারা আবার কর্ণদেব ও জয়দ্রথকে লক্ষ্য করে অগ্রসর হল।

জল্লাদ উত্তেজিত স্বরে বলল, মল্লযোদ্ধা হঠাৎ কর্ণদেবের মুখ চেপে ধরল কেন? কর্ণদেব বিহ্বল হওয়ার পাত্র নয়। নিশ্চয়ই ওদের কোনো গূঢ় অভিসন্ধি আছে! কিঞ্জল! খুব সাবধান! যেন পালাতে না পারে।

কিঞ্জল হাসল, তুমি নিশ্চিত থাকো জল্লাদ! এই মৃত্যুফাঁদ থেকে ওদের আজ নিস্তার নেই।

আচম্বিতে সকলের শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করল কলবর্মার উচ্চকণ্ঠের আদেশ, দাঁড়াও!

–কী! কী!

–নগরকোটাল কলভবর্মা! যুদ্ধ বন্ধ করার অধিকার আপনার নেই।

সমবেত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল আক্রমণোদ্যত দুবৃত্তের দল।

জনতা নীরব।

স্পষ্টই বোঝা যায় তারা এই অসম যুদ্ধের পক্ষপাতী নয়। কলভবর্মা, রত্নাকর বণিকের কর্কশ চিৎকার শোনা গেল, আপনি যুদ্ধ বন্ধ করতে পারেন না। আমরা আপনার বিরুদ্ধে রাজদ্বারে অভিযোগ করব।

জল্লাদ ও কিঞ্জল সমস্বরে চিৎকার করে উঠল, রাজদ্বারে অভিযোগ করলে আপনার কঠিন শাস্তি হবে। কলবর্মা! স্মরণ রাখবেন, আইনের প্রতিনিধি হয়ে আইন ভঙ্গ করলে চরমদণ্ডের বিধানও রয়েছে।

কলভবর্মা বললেন, আমি যুদ্ধ বন্ধ করার আদেশ দিচ্ছি না। সে অধিকার আমার নেই। আমি শুধু তোমাদের কাছে আবেদন জানিয়ে বলছি যে দুটি নির্দোষ মানুষকে–

চুপ করুন, তীব্রস্বরে জল্লাদ বলল, আমরা কোনো আবেদন-নিবেদন শুনতে চাই না। কিঞ্জল! তোমার সঙ্গীরা দাঁড়িয়ে আছে কেন?

জল্লাদ! জলদগম্ভীর স্বরে কলবর্মা বললেন, তোমাকে আমি আজ সতর্ক করে দিচ্ছি। তোমার বহু অন্যায় ও দুষ্কর্মের কথা আমার কানে আসে। যেদিন তোমাকে প্রমাণসহ গ্রেপ্তার করতে পারব, সেইদিন–

বাধা দিয়ে জল্লাদ বলল, সেইদিন যা খুশি করবেন। কিন্তু আজ আপনি যুদ্ধে বাধা দিচ্ছেন কেন?

তারপরই কলভবর্মাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সে কিঞ্জলের দিকে ফিরে চিৎকার করে উঠল, তোমরা দাঁড়িয়ে আছ কেন? সবাই তরবারি হাতে অগ্রসর হও।

আরে না! না! এত ব্যস্ত হলে চলে? একটি উচ্চ কণ্ঠস্বর ভেসে এল পিছন থেকে।

উদ্যত অস্ত্র সংবরণ করে দুই পক্ষই আশ্চর্য হয়ে দেখল সহাস্যবদনে হাত তুলে চিৎকার করছে গেরুয়াধারী, এত ব্যস্ত হলে চলে? আইন অনুসারে আমারও যুদ্ধে যোগ দেওয়ার অধিকার আছে যে! রত্নাকর বণিককে শুন্যে তুলে নিক্ষেপ করার উদ্যোগ করায় আমিও কলহে লিপ্ত হয়ে পড়েছি, একথা ভুললে তো চলবে না।

বিস্ময় বিস্ফারিত নেত্রে কলভবর্মা বলে উঠলেন, আপনি! আপনি যুদ্ধ করবেন?

অবশ্যই, গেরুয়াধারীর মুখে প্রশান্ত হাসি, আইন বলছে কলহে লিপ্ত যে কোনো ব্যক্তি এই যুদ্ধে যোগ দিতে পারে। তাই নয় কি?

কলভবর্মা এমন আশ্চর্য হয়ে গেলেন যে তার মুখে কথা ফুটল না। কিন্তু দুর্বৃত্তদের কণ্ঠে জাগল প্রবল হাস্যধ্বনি।

-ওই স্থূলকায় মেদসর্বস্ব সন্ন্যাসী যুদ্ধ করবে? হাঃ! হাঃ!

হো! হো! হো

–হি! হি হি!

গেরুয়াধারী নির্বিকার মুখে বলল, আপনাদের হাস্যধ্বনি শ্রবণ করে হৃদয়ে বিমল আনন্দলাভ করলাম। কিন্তু কোতোয়াল মহোদয়– আইন অনুসারে আপনি আমাকে যুদ্ধের অনুমতি দিতে বাধ্য। কারণ, এই কলহে আমিও লিপ্ত ছিলাম।

কলভবর্মা বললেন, যোগিবর! আপনি বলবান এবং রসিক পুরুষ সন্দেহ নেই। কিন্তু কেবলমাত্র দৈহিকবল সম্বল করে শাণিত অসির সামনে রসিকতা করা যায় না। আমি আইন অনুযায়ী যুদ্ধের অনুমতি দিতে বাধ্য থাকলেও আত্মহত্যার অনুমতি দিতে বাধ্য নই। আপনি নিরস্ত্র; সশস্ত্র যোদ্ধার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলে আপনার মৃত্যু অনিবার্য। এমন অবস্থায় আপনাকে আমি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার অনুমতি দিতে পারি না।

–অস্ত্র আমি মুহূর্তের মধ্যে সংগ্রহ করব। নগরকোটাল! আপনি আমাকে যুদ্ধের অনুমতি দিন। এই নেকড়ের দল ক্রমশ মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।নগরীর বুকে ওদের অত্যাচার দিন দিন বর্ধিত হচ্ছে। ওদের কিঞ্চিৎ শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।

কিঞ্জল, জল্লাদ ও নেকড়ে-বাহিনী নামে কুখ্যাত দুর্বৃত্তদের কণ্ঠে জাগল রুষ্ট হুঙ্কারধ্বনি!

–~-কী! এত স্পর্ধা!

-ওই স্থূলকায় মেদসর্বস্ব সন্ন্যাসী আমাদের শিক্ষা দেবে!

–আজ অসির সাহায্যে ওর সর্বাঙ্গে রক্তের আলপনা রচনা করব।

অকস্মাৎ দুর্বৃত্তদের আস্ফালন-ধ্বনি ডুবিয়ে জাগ্রত হল মল্লবীর জয়দ্রথের প্রচণ্ড কণ্ঠস্বর, হে সন্ন্যাসী! আপনার সহৃদয়তা ও সাহস প্রশংসার যোগ্য। আপনি অবলীলাক্রমে স্থলোদর রত্নাকর বণিককে শূন্যে উত্তোলন করে অসাধারণ শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু অস্ত্রধারী দুৰ্বত্তের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র মহাবলীও অসহায়। অতএব আপনি ক্ষান্ত হন।

-জয়দ্রথ! আমি এখনই অস্ত্র সংগ্রহ করে যুদ্ধ করব। তোমার চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই।

–সন্ন্যাসী! নগরবাসী ওই নেকড়ের দলকে ভয় করে। তাদের মধ্যে কেউ আপনার হাতে অস্ত্র তুলে দিতে সাহস করবে না।

জয়দ্রথ! তোমার মস্তিষ্ককে অকারণে ঘর্মাক্ত কোরো না। স্তব্ধ হও।

এইবার এগিয়ে এল কর্ণদেব, মহাশয়! আপনি ক্ষান্ত হন। আমি এই নগরীতে নবাগত, কিন্তু জয়দ্রথ এই নগরের বাসিন্দা নাগরিক-চরিত্র সম্বন্ধে সে অবহিত। সে বলছে এখানে কেউ আপনার হাতে অস্ত্র তুলে দিতে সাহস করবে না। নিরস্ত্র অবস্থায় মহাশক্তিধর হলেও আপনি অস্ত্রধারীর বিরুদ্ধে কি করতে পারেন?… দেখুন, সমবেত জনতার ভিতর থেকে এখন পর্যন্ত একটি মানুষও এগিয়ে এসে আপনার হাতে কোনো অস্ত্র তুলে দিল। অতএব অনুরোধ আপনি ক্ষান্ত হন।

গেরুয়াধারীর ওষ্ঠাধরে হাসির রেখা অধিকতর বিস্তৃত হল, কর্ণদেব! অনর্থক দুশ্চিন্তা ও বাক্যব্যয়ে শক্তিক্ষয় না করে আসন্ন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। আমি কারো কাছে অস্ত্র চাই না। নগরকোটাল অনুমতি দিলে এই রাজপথ থেকেই আমি অস্ত্র সংগ্রহ করব।

কলভবর্মা এতক্ষণ নীরবে কথোপকথন শুনছিলেন, এইবার তিনি মুখ খুললেন, রাজপথ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করবেন…? বুঝেছি, কিন্তু বিপণি থেকে অস্ত্র ক্রয় করার সময় আমি দিতে পারি না।

গেরুয়াধারীর কণ্ঠ অবিচলিত, আমি মুহূর্তের মধ্যে অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারি। আপনি যুদ্ধের অনুমতি দিন।

উদ্যত অসি হস্তে চিৎকার করে উঠল নেকড়ের দল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, যুদ্ধের অনুমতি দিন। কলভবর্মা! আমরা অনর্থক বিলম্ব করতে রাজি নই।

কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ থেকে কলভবর্মা গম্ভীর স্বরে ঘোষণা করলেন, আমি নগরকোটাল কলভবর্মা ঘোষণা করছি-এক থেকে দশ অবধি আমি গণনা করব। ওই সময়ের মধ্যে যদি গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারে তো ভালো, নচেৎ দশ বলার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হবে… এক!

কলভবর্মা! মুহূর্তকাল মুহূর্তকাল অপেক্ষা করুন, গেরুয়াধারী হাঁক দিল, কোনো বিশেষ অস্ত্র সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা আছে কি?

-ধনুর্বাণ ছাড়া যে কোনো অস্ত্রই ব্যবহার করা চলে… দুই! গেরুয়াধারী হঠাৎ পিছন ফিরে রাজপথে দণ্ডায়মান জনতার দিকে এগিয়ে চলল।

কলভবর্মা গুনতে লাগলেন, তিন! চার! পাঁচ! ছয়! জয়দ্রথ প্রশ্ন করল, কর্ণদেব! গেরুয়াধারী রাজপথ থেকে কোন অস্ত্র সংগ্রহ করবে?

কর্ণদেবের ললাটে জাগল কুঞ্চনরেখা, জানি না।

-সাত! আট!

কিঞ্জল ব্যঙ্গভরে বলল, গেরুয়াধারী শুধু ভণ্ড নয়, ও বদ্ধ উন্মাদও বটে!

জল্লাদ বন্ধুর কথায় সায় দিল না, চিন্তিতভাবে বলল, কিন্তু ও কি করতে চায়?… দেখ! ওই যে বৃক্ষের তলায় দণ্ডায়মান জনতা, ওইখানেই এগিয়ে যাচ্ছে গেরুয়াধারী… আরে! ও যে দেখছি বৃক্ষ ধরে টানাটানি করছে।

-নয়। দশ।

কলভবর্মার কণ্ঠে দশ গণনা সম্পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমবেত জনতার কণ্ঠে জাগল কোলাহল-ধ্বনি!

রাজপথে অবস্থিত একটি গাছকে মূলশূদ্ধ টেনে তুলে ফেলেছে গেরুয়াধারী!

আপাতত এই বৃক্ষকেই আমি অস্ত্ররূপে গ্রহণ করলাম, হাত দিয়ে গাছের ডালপালা পরিষ্কার করতে করতে গেরুয়াধারী বলল।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বজ্রমুষ্টির আকর্ষণে ডালপালা আর পাতার রাশি ঝরে পড়ে উৎপাটিত বৃক্ষ এক সুবিশাল দণ্ডের আকার ধারণ করল!

সেই বৃক্ষকে মাথার উপর তুলে সবেগে দুই পাক ঘুরিয়ে গেরুয়াধারী প্রচণ্ড কণ্ঠে যুদ্ধের আহ্বান জানাল, আমি প্রস্তুত। দশ গণনাও শেষ। অতএব হে নেকড়ের দল- রণং দেহি!

কিঞ্জল এক পা পিছিয়ে বলল, জল্লাদ! আমার সঙ্গীরা পলায়ন করছে। আমরা কি করব? ওই বিশাল বৃক্ষ যদি মস্তকে পতিত হয়

জল্লাদ দুই পা পিছিয়ে বলল, তবে মৃত্যু নিশ্চিত!

গেরুয়াধারীর হস্তে বৃক্ষ যমদণ্ডের মতো আন্দোলিত হল, সে আবার হাঁকল, রণং দেহি।

প্রত্যুত্তরে আরও কয়েক পা পিছিয়ে গেল কিঞ্জল ও জল্লাদ। রত্নাকর চেঁচিয়ে উঠল, কিঞ্জল। জল্লাদ! আক্রমণ করো। তোমরা পলায়ন করলে আমাকে সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দণ্ড দিতে হবে।

কর্ণদেব উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, জয়দ্রথ! আমি অসি কোষবদ্ধ করলাম। তুমিও লৌহদণ্ড নামিয়ে রাখতে পারো। বোধহয় বিনাযুদ্ধেই তুমি অর্থলাভ করবে।

জয়দ্রথ বলল, তাই তো মনে হচ্ছে। এই সন্ন্যাসী সাধারণ মানুষ নয়। বলবান বলে গর্ব ছিল, সেই গর্ব আজ চূর্ণ হয়ে গেল। সন্ন্যাসীর তুলনায় আমি নিতান্তই তুচ্ছ।

আবার জাগল রণহুঙ্কার, রণং দেহি!

রণ দেওয়ার বিন্দুমাত্র লক্ষণ না দেখিয়ে জল্লাদ মৃদুস্বরে বলল, কিঞ্জল! আমি রত্নাকর বণিকের বেতনভোগী নই, সুতরাং পালাতে পারি। কিন্তু তোমার পলায়নের উপায় নেই। পলায়ন করলে তোমার প্রভু রত্নাকর ক্রুদ্ধ হবে। কারণ, তাহলে তাকে অর্থদণ্ড দিতে হবে।

গেরুয়াধারীর দিকে চকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিঞ্জল বলল, রত্নাকর বণিকের অর্থের চাইতে আমার প্রাণের মূল্য অনেক বেশি। অন্তত আমার কাছে।

গেরুয়াধারী আর অপেক্ষা করল না।

আমি যুদ্ধ শুরু করছি, বলেই এগিয়ে এসে সেই প্রকাণ্ড বৃক্ষকে লাঠির মতো সবেগে চালনা করল শত্রুর দিকে।

–ওফ!

–হা!

চটপট লাফ মেরে আঘাত এড়িয়ে সরে গেল কিঞ্জল ও জল্লাদ। তারা যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেই জায়গার উপর সশব্দে আছড়ে পড়ল গেরুয়াধারীর গাছ।

একটানে গাছকে আবার তুলে নিয়ে মাথার উপর ঘোরাতে ঘোরাতে গেরুয়াধারী বলল, দ্বিপদ নেকড়ে দেখছি চতুষ্পদের মতোই ক্ষিপ্র! কিন্তু প্রথম আঘাত এড়িয়ে গেলেও দ্বিতীয়বার আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে না!… আরে! আরে! তোমরা যুদ্ধ না করেই পলায়ন করছ? ধিক! ভীরু! কাপুরুষ!

তীরবেগে ছুটতে ছুটতে পার্শ্ববর্তী সঙ্গীকে উদ্দেশ্য করে কিঞ্জল বলল, জল্লাদ! ভণ্ডটা আমাদের ভীরু কাপুরুষ বলছে যে!

গতিবেগ একটুও না কমিয়ে জল্লাদ বলল, বলতে দাও হে, বলতে দাও। কিঞ্জল! মন্দ লোকের কথায় কখনো কান দিতে নেই।

নগরবাসীরা জল্লাদ ও নেকড়ের-বাহিনীর বহু অত্যাচার দেখেছে, অস্ত্রচালনায় তাদের দক্ষতার কথাও তাদের অবিদিত নয়-কিন্তু তারা যে দ্রুতধাবনে বেগবান অশ্বকেও লজ্জা দিতে পারে এই সত্যটি নাগরিকের জানা ছিল না।

দেখতে দেখতে পথের মোড় ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল কিঞ্জল ও জল্লাদ। তাদের পিছনে তাড়া করে ছুটল জনতার হর্ষধ্বনি। সবাই বুঝল বেশ কিছুদিনের মধ্যে নেকড়ে-বাহিনী আর নগরীর বুকে আত্মপ্রকাশ করতে চাইবে না।

অকস্মাৎ কলভবর্মার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল রত্নাকরের দিকে গোলমালের মধ্যে জনতার ভিতর আত্মগোপন করে সে সরে পড়ার চেষ্টা করছে! তৎক্ষণাৎ ঘোড়া চার্লিয়ে কলভবর্মা তার পাশে এসে দাঁড়ালেন, তারপর কঠিন স্বরে বললেন, দাঁড়াও রত্নাকর, কোথায় যাচ্ছ? যুদ্ধে তোমার নেকড়ের দল পরাজিত। নিঃশব্দে পলায়ন করে তুমি আইনকে ফাঁকি দিতে পারবে না। মল্লযোদ্ধাকে প্রতিশ্রুত অর্থ না দিলে আমি তোমাকে গ্রেপ্তার করব। বিচারে তোমার কারাদণ্ড অনিবার্য।

তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে জয়দ্রথ বলল, কেতোয়াল মহাশয়। আপনি যদি ভেবে থাকেন রত্নাকর পলায়নের চেষ্টা করছে, তাহলে আপনি ভুল করেছেন। রত্নাকর অতি দ্রুত গৃহে গমন করছিল প্রতিশ্রুত সহস্র স্বর্ণমুদ্রা এনে আমার হাতে সমর্পণ করার জন্য তাই নয় কি রত্নাকর?

বিব্রত বণিক ব্ৰস্তস্বরে বলে উঠল, যথার্থ! যথার্থ! হাস্যসংবরণ করে কলবর্মা বললেন, বটে! বটে! তাহলে আমিও রত্নাকর আর জয়দ্রথের সঙ্গী হব। আমার সম্মুখে রত্নাকর বণিক মল্লযোদ্ধা জয়দ্রথের হাতে দুই সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দিলে সুখী হব। রত্নাকর! এই ব্যবস্থা কেমন?

ইয়ে-হ্যাঁ-অর্থাৎ, উত্তম ব্যবস্থা।

জয়দ্রথ বলল, কোতোয়াল মহাশয়! সহস্র স্বর্ণমুদ্রার কিয়দংশ কর্ণদেব নামে এই কিশোর এবং গেরুয়াধারীর প্রাপ্য। ওরা না থাকলে আমি– আরে গেরুয়াধারী কোথায়?

জয়দ্রথ! আমি অর্থের প্রত্যাশী নই,কর্ণদেব বলে উঠল, কিন্তু গেরুয়াধারী কোথায় অদৃশ্য হলেন?

জনতার ভিতর থেকে এক বলিষ্ঠদর্শন বৃষস্কন্ধ পুরুষ আত্মপ্রকাশ করল, আমি দেখেছি উনি নগরীর পূর্বদিকে গমন করেছেন। ওইদিকেই ওঁর বাসগৃহ। খুব সম্ভব পুরস্কার গ্রহণে অনিচ্ছুক বলেই বল্লভ নিঃশব্দে স্থানত্যাগ করেছেন। বল্লভ স্বভাবত প্রচারবিমুখ।

কর্ণদেব বলল, ওঁর নাম বল্লভ? তুমি ওঁকে জানো দেখছি। আমি ওই মহাশক্তিধর সন্ন্যাসীর সঙ্গে কথা বলতে চাই। কোথায় তাকে পাব?

বলিষ্ঠ ব্যক্তি বলল, বল্লভ গেরুয়াধারণ করলেও সন্ন্যাসী নন। তবে তার কিছু শিষ্য আছে। স্বল্পসংখ্যক ওই শিষ্যদের মধ্যে আমি অন্যতম। কিন্তু বল্লভের পরিচয় তার মুখ থেকেই পাওয়া ভালো। এই নগরীর পূর্বপ্রান্তে সন্ধান করলে তাকে পাবে। দ্রুত পদচালনা করলে পথেও সাক্ষাৎ হতে পারে।

বক্তার পেশিবদ্ধ বিপুল দেহ নিরীক্ষণ করে কর্ণদেব মনে মনে বলল, বল্লভ সন্ন্যাসী হয়েও কেন গৈরিকধারণ করেন জানি না, তবে তার কার্যকলাপ দেখে আর শিষ্যের বপুদংশন করে মনে হয় আত্মার উন্নতির চাইতে মাংসপেশীর উন্নতিসাধন করতেই বল্লভ সমধিক তৎপর।

সে বল্লভের নির্দেশ অনুসারে নগরীর পূর্বদিক লক্ষ্য করে পদচালনা করল।

কর্ণদেব! পিছন থেকে জয়দ্রথের আহ্বান ভেসে এল, কোথায় চললে? পুরস্কারের অর্থে তোমারও অংশ আছে যে!

কর্ণদেব দুর থেকেই চিৎকার করে বলল, জয়দ্রথ! আমি অর্থ চাই না। পুরস্কারের অর্থ তুমি একাই ভোগ করো।

দ্রুতপদে বল্লভের উদ্দেশে নির্দিষ্ট দিকে অগ্রসর হল কর্ণদেব। তার চিন্তার জগতে তখন ঝড় উঠেছে অসাধারণ মানুষ ওই গেরুয়াধারী বল্লভ। যে ভাবেই হোক আজ তাঁর সঙ্গে দেখা করতেই হবে। সময় আর বেশি নেই। কিন্তু পুরস্কারের অর্থে বল্লভের বীতস্পৃহা দেখে ভয় হচ্ছে তিনি হয়তো আমার প্রস্তাবে সম্মত হবেন না। হয়তো তিনি ধনবান, সেক্ষেত্রে তাকে আমি প্রলুব্ধ করতে পারব কি?… তবে কি আবার আমাকে ফিরে আসতে হবে জয়দ্রথের কাছে?… কিন্তু জয়দ্রথ আর বল্লভ? ফুঃ!… বল্লভের কাছে জয়দ্রথ হচ্ছে মাতঙ্গের কাছে পতঙ্গের মতোই তুচ্ছ। শাস্ত্রে অবশ্য মধুর অভাবে গুড় দেওয়ার উপদেশ প্রচলিত আছে… দেখা যাক।

.

০৭. বিপন্ন বল্লভ

নগরীর পূর্বদিকে একটি পথ ধরে এগিয়ে চলছিল বল্লভ। তার মনে তখন অজস্র প্রশ্ন- জনতার ভিতর থেকে সরে তত পড়লাম… কিন্তু কে ওই কর্ণদেব? বয়সে কিশোর, অথচ অস্ত্র চালনায় সিদ্ধহস্ত!… অপরিচিত মল্লযোদ্ধা জয়দ্রথের সন্ধান করছিল কেন ওই রহস্যময় কিশোর? কি তার উদ্দেশ্য?

আচম্বিতে তার পিছন থেকে ভেসে এল এক তীব্র কণ্ঠস্বর, বল্লভ! ওহে বল্লভ!

বল্লভ চমকে ফিরে দাঁড়াল। তাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে এল শীর্ণকায় এক খর্বাকার ব্যক্তি।

বল্লভের সামনে এসে খর্বকায় ব্যক্তি বলল, এই যে বল্লভ! কোথায় চলেছ?

–গৃহে।

-বেশ, বেশ। কিন্তু আর তিনদিন পরেই সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। আশা করি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তুমি কর্তব্য পালন করবে?

–আমি- আমি– অনুগ্রহপূর্বক আমাকে আরও পক্ষকাল সময় দিন। আমি নিশ্চয় করে বলছি–

–স্তব্ধ হও। তুমি কোনোদিনই কর্তব্য পালনে সমর্থ হবে না। নির্লজ্জ। আজ থেকে তিনদিনের মধ্যে যদি তোমার কথা না রাখতে পারো তবে তোমাকে কুকুরের ন্যায় গৃহ থেকে বিতাড়িত করবে!

সাবধান! পিছন থেকে ভেসে এল অজ্ঞাত কণ্ঠে সতর্কবাণী, বল্লভ সম্মানিত নাগরিক। তাকে পুনরায় অপমান করলে আমি তোমার জিহ্বা ছেদন করব।

খর্বাকায় ব্যক্তি সভয়ে তাকিয়ে দেখল তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে এক কিশোর। কিশোরের কটিবন্ধে তরবারি ও ছুরিকা, সায়াহ্নের অন্ধকারেও দৃষ্টিগোচর হয়।

বল্লভের ভয়ার্ত মুখে ফুটল আনন্দের আভাস, কর্ণদেব! তুমি! তুমি কি পুরস্কার গ্রহণ করতে যাওনি?

কর্ণদেব বলল, না। আমি আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্যই ছুটে আসছি। লোকমুখে আপনার গন্তব্য পথের নির্দেশ গ্রহণ করে পদচালনা করেছি অতি দ্রুতবেগে। ভাগ্যক্রমে পথেই আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। নচেৎ, অনর্থক আপনার গৃহের অনুসন্ধানে বিলম্ব হতো।

খর্বাকার ব্যক্তি শ্যেন দৃষ্টিতে কর্ণদেবকে নিরীক্ষণ করছিল, এবার সে কথা বলল, বল্লভ! আজকাল বুঝি অস্ত্রধারী দুর্বত্তরা তোমার শিষ্যত্ব গ্রহণ করছে?

কর্ণদেব ক্রুদ্ধস্বরে বলল, আমি অস্ত্রধারী বটে, তবে দুর্বৃত্ত নই। বল্লভের শিষ্যত্ব আমি গ্রহণ করি নি, ভবিষ্যতে তার শিষ্য হওয়ার বাসনাও নেই… কিন্তু বল্লভ! আপনার ন্যায় মহাবল পুরুষকে এই দ্বিপদ কৃকলাস অপমান করে কোন সাহসে?

বল্লভ বলল, আমার ভগ্নীর বিবাহ উপলক্ষে আমার পিতা উত্তানপাদ নামক এই কুসীদজীবীর কাছে বসতবাটী বন্ধক রেখে তিন শত স্বর্ণমুদ্রা ঋণস্বরূপ গ্রহণ করেছিলেন। পিতা ছিলেন সওদাগর। তার বাণিজ্যপোত সেই সময়ে দূর দেশে অবস্থান করছিল। হঠাৎ ভালো সম্বন্ধ স্থির হয়ে গেল বলে পিতা তৎক্ষণাৎ কন্যার বিবাহ দিলেন। ঘরে যা অর্থ ছিল তার পরিমাণ কম ছিল না, কিন্তু অত্যধিক আড়ম্বর করার জন্য সঞ্চিত অর্থে টান পড়ল। কয়েক মাসের মধ্যেই। বাণিজ্যপোতগুলি ফিরে আসার কথা তাই পিতা ঋণগ্রহণে ইতস্তত করেননি। পিতার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, মাতৃহারা কন্যার বিবাহের জন্য তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ঋণগ্রহণ করে তাড়াতাড়ি বিবাহ দেওয়ার সেটাও একটা কারণ। কিন্তু ভগ্নীর বিবাহের পরই ঘটল ভাগ্য-বিপর্যয়। কিছুদিন পরেই দুঃসংবাদ এল- ঝড়ের মুখে বাণিজ্যপোতগুলি ধ্বংস হয়ে গেছে। পিতা তার সমস্ত অর্থ ওই বাণিজ্যে নিয়োগ করেছিলেন, অতএব বাণিজ্যপোতগুলি বিনষ্ট হওয়ায় আমরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। ভগ্নস্বাস্থ্য ও ভগ্নহৃদয় নিয়ে পিতা সেই বৎসরেই দেহত্যাগ করলেন। কিন্তু কুসীদজীবী উত্তানপাদের ঋণ রয়ে গেল। আর সেই ঋণ শোধ করার জন্য রইলাম আমি। তিনশত স্বর্ণমুদ্রা দুই বৎসরের মধ্যেই সুদে-আসলে তিনসহস্রে পরিণত হয়েছে। আগামী তিনদিনের মধ্যে ঋণ শোধ করতে না পারলে রাজদ্বারে অভিযোগ জানিয়ে উত্তানপাদ আমার পৈতৃক গৃহ অধিকার করবে। আমি অধমর্ণ– বাধ্য হয়ে উত্তমর্ণের কটুবাক্য সহ্য কবছি।

কর্ণদেব কুসীদজীবীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল, উত্তানপাদ! কাল প্রভাতে বল্লভ তোমার গৃহে তিন সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পৌঁছে দেবেন এবং চুক্তিনামাটি ফিরিয়ে নেবেন। এখন তুমি অন্যত্র গমন করো।

দুজনেই স্তম্ভিত!

সহসা ব্যঙ্গভরে হেসে উঠল উত্তানপাদ, তিন সহস্র স্বর্ণমুদ্রা তুমি দেবে? হাঃহাঃহাঃ! তোমার কাছে তিনটি স্বর্ণমুদ্রাও আছে কিনা সন্দেহ!

নির্বোধ কুসীদজীবী, কর্ণদেব রূঢ়স্বরে বলল, আমার কটিবন্ধে রক্ষিত একটিমাত্র রত্নের উপযুক্ত মূল্য তোমার কোষাগারে আছে কিনা সন্দেহ!

কটিবন্ধের গোপন স্থান থেকে কর্ণদেবের ডান হাতের মুঠিতে আবির্ভূত হল একটি ক্ষুদ্র বস্তু সন্ধ্যারম্লান অন্ধকারে সেই প্রস্তরবৎ বস্তুটি অজস্র আলোক স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে জ্বল জ্বল করে উঠল!

উত্তানপাদ সাগ্রহে হাত বাড়িয়ে দিল, দেখি! দেখি! একবার আমার হাতে দাও।

–দেখ। দেখে নয়ন সার্থক করো।

এ তো দেখছি মহামূল্য বৈদূর্যমণি! এই বস্তুটি তুমি কোথায় পেলে?

অবান্তর প্রশ্ন। এখন অনুগ্রহ করে মণি আমার হাতে ফিরিয়ে দাও।

উত্তানপাদের ওষ্ঠাধরে জাগল ধূর্ত হাসির রেখা, সে মণিটি কর্ণদেবের হাতে দিয়ে বলে উঠল, মণি তুমি কোথায় পেয়েছ এই প্রশ্ন আমার মুখে নিশ্চয়ই অবান্তর! কিন্তু নগরকোটালের কাছে এক নগণ্য কিশোরের কটিবন্ধে মহামূল্য বৈদূর্যমণির অবস্থানের প্রশ্ন বোধহয় নিতান্ত অবান্তর প্রসঙ্গ বলে বিবেচিত হবে না।

কর্ণদেবের ভ্রুকুঞ্চিত হল, বটে?

–তবে কাল প্রভাতে তিন সহস্রের পরিবর্তে যদি ছয় সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পাই, তাহলে এই সংবাদ নগরকোটালের কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে না।

-ওহে উত্তানপাদ, শ্রবণ করো। আমি যেখান থেকে এই মণি পেয়েছি, সেইখানে এইপ্রকার অজস্র মণিমাণিক্য আছে। তোমাকে সন্ধান বলে দিচ্ছি- ইচ্ছা করলে তুমি সেই গোপন স্থান থেকে ওইসব রত্ন আরোহণ করতে পারো, অথবা নগরকোটালকে ওই স্থানের সন্ধান দিতে পারো।

–এইবার তুমি সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছ। ওহে কিশোর, আমি জানি বৈধ উপায়ে এই মণি তোমার হস্তগত হয় নি। যাই হোক, আমি যদি লাভবান হই, তাহলে নগরকোটালের কাছে গিয়ে তোমাকে বিপন্ন করব না। বলো কোথায় আছে ওইসব মূল্যবান মণিমাণিক্য।

এসব গোপন কথা প্রকাশ্যে বলা চলে না। কানে কানে বলছি। শোনো।

উত্তানপাদের কানের কাছে মুখ এনে কর্ণদেব কি যেন বলল। বল্লভ কথা শুনতে পেল না, কিন্তু দেখল উত্তানপাদের সর্বাঙ্গ হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠের মতো শিহরিত হল!

সে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, সেকি! কী ভয়ংকর!… না, না, না, আমি মণিমাণিক্য চাই না।

কর্ণদেবের অধরে জাগল নিষ্ঠুর হাসির রেখা, আর ছয় সহস্র স্বর্ণমুদ্রা?

–না, না। আমি তিন সহস্র পেলেই খুশি।

তিন সহস্র নয়, কর্ণদেব তীব্রস্বরে বলল, তুমি সুদ পাবে না। আসল তিনশত নিয়ে তুমি বল্লভকে নিষ্কৃতি দেবে। নচেৎ–

-ঠিক আছে। ঠিক আছে। আমি তিনশত স্বর্ণমুদ্রার বেশি দাবি করব না।

–আচ্ছা। এখন শীঘ্র এই স্থান ত্যাগ করো।

দ্রুত পদক্ষেপে অন্তর্ধান করল কুসীদজীবী উত্তানপাদ। বল্লভ কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইল, তারপর বলল, ব্যাপারটা কি হল বলল তো কর্ণদেব?

-কুসীদজীবী উত্তানপাদের সুমতি হয়েছে।

–অকস্মাৎ উত্তানপাদের এমন সুবুদ্ধির উদ্রেক হল কেন? কর্ণদেব! তুমি চুপি চুপি ওর কানে কি মন্ত্র দিয়েছ?

-কিছু না। মন্দলোকের কি সুবুদ্ধি হয় না? বল্লভ! পৃথিবীর বুকে অন্ধকার নেমে আসছে। আজ রাত্রে আমি আপনার গৃহে অতিথি হতে চাই। আপত্তি নেই তো?

বিজ্ঞজন বলেন, অজ্ঞাত কুলশীলকে গৃহে স্থান দিতে নেই, কিন্তু আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি। চলো।

কিছুক্ষণ দুজনেই নিঃশব্দে গন্তব্যস্থলের দিকে অগ্রসর হল। প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করল কর্ণদেব, বল্লভ! সামান্য অর্থের জন্য ঘৃণ্য কুসীদজীবী আপনাকে অপমান করতে সাহস পায়? আপনি ইচ্ছা করলেই প্রচুর অর্থের অধিকারী হতে পারেন।

প্রচুর অর্থ? না, প্রচুর অর্থ উপার্জনের যোগ্যতা আমার নেই, কর্ণদেব।

-কেন নয়? আজই তো আপনি জয়দ্রথের পুরস্কারের অর্থে আপনার প্রাপ্য না নিয়েই স্থানত্যাগ করলেন। কিন্তু কেন? আপনার তো অর্থের প্রয়োজন আছে।

-ওই অর্থে যদি ঋণ শোধ করতে পারতাম তাহলে হয়তো ইচ্ছার বিরুদ্ধে পুরস্কারের অংশগ্রহণ করতাম। কিন্তু সহস্র স্বর্ণমুদ্রা থেকে আমি কত পেতাম?… হয়তো তিনশত। তাতে আমার ঋণশোধ হত না। অবশ্য তুমি কোন মন্ত্রবলে নরপিশাচ উত্তানপাদকে বশীভূত করেছ জানি না, তবে সুদ ছেড়ে আসলের তিনশত স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে সে আমাকে অব্যাহতি দিত না কিছুতেই। তাছাড়া আমি নেকড়ে-বাহিনীর বিরোধিতা করেছিলাম একটি কিশোরকে, অর্থাৎ তোমাকে, অপঘাতে মৃত্যু থেকে বাঁচানোর জন্য সেক্ষেত্রে পুরস্কারের অর্থ গ্রহণ করলে দেশের মানুষ আমাকে লোভী মনে করত। বিশেষ করে আমার শিষ্যদের কাছে আমার ভাবমুর্তি ক্ষুণ্ণ হত। সেটা আমার পক্ষে অতিশয় বেদনাদায়ক।

-বল্লভ। আমি আপনার মতো একটি মানুষের সন্ধান করছিলাম।

বল্লভের চলার গতি মন্থর হল। সন্ধ্যার ম্লান অন্ধকার ঘনীভূত হয়ে আসন্ন রাত্রির আভাস পরিস্ফুট। অন্ধকার ভেদ করে সঙ্গীর মুখ দেখার চেষ্টা করল বল্লভ, তারপর গম্ভীর স্বরে বলল, কর্ণদেব! তুমি প্রথমে জয়দ্রথের সন্ধান করছিলে এবং তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছিলে। সে তোমার অপরিচিত, তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য তোমার এত আগ্রহ ছিল কেন? তারপর হঠাৎ তুমি জয়দ্রথ সম্পর্কে নিরুৎসুক হয়ে পড়লে। কারণ, তুমি অধিকতর বলশালী আর একটি মানুষকে অর্থাৎ আমাকে আবিষ্কার করলে। বুঝলাম, যে কারণেই হোক, তুমি অত্যন্ত বলশালী একটি মনুষ্যের সন্ধান করছিলে; বলো কর্ণদেব, আমার অনুমান যথার্থ কি না?

-যথার্থ বটে।

তারপর এখন দেখছি তোমার নিকট প্রচুর অর্থ রয়েছে। শুধু স্বর্ণমুদ্রা নয়, তোমার কাছে রয়েছে মহামূল্যবান বৈদূর্যমণি। তুমি শ্রেষ্ঠী বা সওদাগর নও। অথচ তুমি অবহেলাভরে বহন করছ রাজার ঐশ্বর্য! তোমার চালচলন রহস্যময়। এই নগরীতে তুমি নবাগত, তোমার ব্যবহারে তা প্রমাণিত হয়েছে। কেন, কোন উদ্দেশ্যে, তুমি আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চাইছ জানি না; তবে একটা কথা তোমায় জানিয়ে দিচ্ছি– যদি প্রয়োজন হয় তবে পথবাসী বা বনবাসী হতে রাজি আছি, কিন্তু কোনো কারণেই আমি পাপের পথে অগ্রসর হব না।

–বল্লভ! পাপপুণ্য নিতান্তই আপেক্ষিক শব্দ।

–বাঃ! এই বয়সেই দার্শনিক সুলভ তত্ত্বজ্ঞানের অধিকারী হয়েছে দেখছি! অস্ত্রত্যাগ করে শাস্ত্রচর্চা করলে তুমি বোধহয় লাভবান হতে পারতে- বুঝেছ কর্ণদেব?

– শাস্ত্র ও শস্ত্র দুটি বস্তুর সঙ্গেই আমার কিছু পরিচয় ঘটেছে। একসময় পুস্তক হাতে বিদ্যাভ্যাস ছিল আমার একমাত্র কর্তব্য। পরে বুঝলাম শস্ত্রের ক্ষমতা বেশি, তাই–

তাই মসি ছেড়ে অসি ধরেছে? কিন্তু এই মুহূর্তে অসিতে হাত দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ঘটে নি।

কর্ণদেব লজ্জিত হয়ে বলল, ক্ষমা করবেন। ক্ষণিকের উত্তেজনায় আত্মবিস্মৃত হয়েছিলাম। জেনে রাখবেন অসি নয়, মসিই ছিল এক সময়ে আমার প্রিয় বস্তু। আমি ব্রাহ্মণ সন্তান।

অন্ধকারে বল্লভের হাসির শব্দ শোনা গেল, তুমি দেখছি পরশুরামের নতুন সংস্করণ! কিন্তু পরশুরাম কুঠার ধরেছিলেন ধরণীকে ক্ষত্রিয়শূন্য করার জন্য তুমি ব্রাহ্মণসন্তান হয়ে অসি ধারণ করেছ কেন?

কর্ণদেব বলল, আপনার প্রশ্নের উত্তরে অনেক–কী হল?

হঠাৎ হাত বাড়িয়ে কর্ণদেবের গতিরোধ করে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বল্লভ, তারপর অন্ধকারে তীব্ৰদৃষ্টি মেলে কি যেন দেখতে লাগল।

এক নিষ্ঠুর জগতের কঠিন পাঠশালায় জীবনের পাঠ নিয়েছে কর্ণদেব মুহূর্তে সে বুঝে নিল কোনো কারণে পরিস্থিতি হঠাৎ বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। আর সেইজন্যই তার সঙ্গীর এই ভাবান্তর।

চারদিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি সঞ্চালন করে কর্ণদেব দেখল একটু দূরে আবছা আলো-আঁধারির মধ্যে দেখা দিয়েছে কয়েকটা মনুষ্যমূর্তি। সন্ধ্যা তখন সবে উত্তীর্ণ, রাত্রি গভীর নয়– এসময়ে পথের উপর পথিকের আবির্ভাব নিতান্ত স্বাভাবিক। কিন্তু বল্লভের ভাবভঙ্গিতে কর্ণদেব বুঝল অদূরে দৃশ্যমান ওই মানুষগুলোর সান্নিধ্যে সে নিরাপদ মনে করছে না। কর্ণদেব মুখে কোনো কথা বলল না, কিন্তু তার সর্বশরীর ধনুকের ছিলার মতো টান হয়ে গেল, বাঁ হাতের শক্ত মুঠিতে ধরা পড়ল তলোয়ারের খাপ, আর ডানহাতের আঙুলগুলো প্রসারিত হয়ে মুহূর্তের মধ্যে অস্ত্রকে কোষমুক্ত করার জন্য প্রস্তুত হল।

সঙ্গীর দিকে না তাকিয়ে বল্লভ বলল, কর্ণদেব! তোমার তরবারিকে ব্যস্ত করার প্রয়োজন হবে না।

তারপর কয়েক পা এগিয়ে তীব্রস্বরে হাঁক দিল, বন্ধুগণ! তোমরা আড়ালে দাঁড়িয়ে কেন? সামনে এসো। আমি গেরুয়াধারী বল্লভ– তোমাদের সঙ্গে বাক্যালাপ করার জন্য উৎসুক।

কয়েকটি মুহূর্ত কাটল নিঃশব্দে। তারপরই পথের উপর জাগল ধাবমান পদশব্দ!… পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে গেল দ্রুতবেগে। কর্ণদেব তাকিয়ে দেখল পথের উপর দণ্ডায়মান মনুষ্য মূর্তিগুলো অন্তর্ধান করেছে।

সে বল্লভের দিকে ফিরে প্রশ্ন করল, কারা যেন দ্রুতবেগে পলায়ন করল। বল্লভ! আপনি ওদের জানেন?

উত্তর এল, জানি। ওরা স্থানীয় দুর্বৃত্ত। অন্ধকারে অসহায় পথিকের সর্বস্ব লুণ্ঠন করে। এদিকটা নির্জন। অন্ধকারে আমাকে চিনতে না পেরে ওরা আক্রমণের উদযোগ করছিল।

কর্ণদেব বলল, এই জাতীয় জীব আমার অপরিচিত নয়। কিন্তু সন্ন্যাসী না হয়েও যিনি গৈরিক ধারণ করেন এবং যার নাম শুনেই স্থানীয় দুর্বৃত্তগণ ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করে আমি তার পরিচয় পেতে চাই।

বল্লভ বলল, ব্রাহ্মণ-সন্তান হয়েও প্রবীণ ক্ষত্রিয়-যোদ্ধার ন্যায় যে অসি চালনা করে, অতি সাধারণ বেশে সজ্জিত হলেও যার কটিবন্ধে থাকে মহামূল্য বৈদুর্যমণি- সেই রহস্যময় কিশোরকে আমি জানতে চাই।

কিছুক্ষণ নীরবে পথ চলার পর কিশোর মুখ খুলল, বল্লভ! পরস্পরের পরিচয় জানতে আমরা দুজনেই উগ্রীব। কিন্তু পথে দাঁড়িয়ে বোধহয় বাক্যালাপ করা উচিত হবে না। আমার বক্তব্য অতিশয় গোপনীয়।

নিকটেই আমার গৃহ আর সামনে পড়ে আছে দীর্ঘরাত্রি। অতএব গোপনীয় বিষয় নিয়ে নির্জনে বাক্যালাপের বিশেষ অসুবিধা হবে না।… এই যে! এই কুটিরই হচ্ছে অধমের বাসস্থান।

সম্মুখে অবস্থিত প্রাসাদোপম অট্টালিকার দিকে তাকিয়ে কর্ণদেব সবিস্ময়ে বলল, এই অট্টালিকা আপনার বাসস্থান?

বল্লভ বিনীত কণ্ঠে বলল, এই কুটিরই আমার বাসস্থান।

.

০৮. ব্যাঘ্র ও হস্তী

অট্টালিকার দ্বার বাহির থেকে লৌহকীলকে আবদ্ধ ছিল। কাপড়ের ভিতর থেকে বিশেষভাবে নির্মিত একটি সুবৃহৎ লৌহশলাকা নিয়ে বল্লভ দ্বার অনর্গলমুক্ত করল, তারপর প্রবেশ করল ভিতরে।

অট্টালিকার অভ্যন্তরে ঘন অন্ধকারের গর্ভে অদৃশ্য বল্লভের গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল, কর্ণদেব! ক্ষণেক অপেক্ষা করো। আমি দীপ জ্বালছি।

একটু পরেই জ্বলন্ত মৃৎপ্রদীপ হস্তে দ্বারদেশে আত্মপ্রকাশ করল বল্লভ, কর্ণদেব! অনুগ্রহ করে ভিতরে এসে আমার আতিথ্য গ্রহণ করলে সুখী হব। আমার সামর্থ্য অতি সামান্য। অতএব, অতিথি সৎকারের ত্রুটি মার্জনীয়। তবে আমার সাধ্য অনুযায়ী অতিথিকে সমাদর জানাতে চেষ্টা করব এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।

কর্ণদেব দ্বারের ভিতর পদক্ষেপ করে হেসে উঠল, এই বিশাল অট্টালিকাকে যিনি কুটির বলে অভিহিত করেন, তার অতিথি সকারের সামান্য প্রয়াস যে অপরের কাছে অসামান্য বলে বিবেচিত হবে সে বিষয়েও আমার সন্দেহ নেই।

–ভিতরে এসো।

প্রদীপ হাতে এগিয়ে চলল বল্লভ। তাকে অনুসরণ করল কর্ণদেব। সঙ্কীর্ণ অলিন্দ এবং ক্ষুদ্র ও বৃহৎ বহু কক্ষের মধ্যবর্তী পথ ধরে এগিয়ে যেতে যেতে কর্ণদেব বুঝল অতিশয় ধনবান না হলে এমন একটি অট্টালিকার অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়। দীপের ম্লান আলোতেও সে বুঝতে পারল অত্যন্ত মূল্যবান প্রস্তর, কাষ্ঠ ও ইস্পাত সহযোগে নির্মিত হয়েছে এই বাসগৃহ। বল্লভের পিতা যে একসময় প্রচুর বিত্তের অধিকারী ছিলেন সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হল কর্ণদেব।

…বেশ কিছুক্ষণ পদচালনা করার পর বল্লভকে অনুসরণ করে কর্ণদেব এসে পড়ল একটি সুবৃহৎ কক্ষের অভ্যন্তরে। আসার পথে গৃহের মধ্যে বহু দুর্মূল্য তৈজসপত্র এবং স্ফটিক খচিত দীপাধার প্রদীপের আলোতে কর্ণদেবের দৃষ্টিগোচর হয়েছে কিন্তু এই ঘরটি সর্বপ্রকার বাহুল্য বর্জিত। ঘরের একপাশে একটি মূল্যবান পালঙ্ক রয়েছে। তবে তার উপর বিস্তৃত বস্ত্রটি খুব পরিষ্কার নয়। ঘরের মাঝখানে দারুনির্মিত দীপাধার। গৃহের অন্যান্য স্থানে প্রদীপের ম্লান আলোতেও ধুলোর আধিক্য কর্ণদেবের দৃষ্টিগোচর হয়েছে, কিন্তু এই ঘরটি বেশ পরিচ্ছন্ন।

ঘরের সামনে একটি জলপূর্ণ পাত্র ছিল। সেইদিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বল্লভ বলল, তুমি হাত-মুখ পরিষ্কার করে নাও, তারপর ওই শয্যায় বিশ্রাম গ্রহণ করো। আমি এখনই আসছি।

কক্ষের মধ্যস্থলে অবস্থিত দীপাধারে রক্ষিত দীপে অগ্নিসংযোগ করে বিশাল অট্টালিকার গর্ভে হারিয়ে গেল বল্লভ। দ্বারের বাইরে চর্মপাদুকা রেখে বল্লভের পরামর্শ অনুসারে প্রক্ষালন-পর্ব শেষ করে কর্ণদেব আশ্রয় গ্রহণ করল পালঙ্কের উপর বিস্তৃত শয্যায়।

প্রচণ্ড দৈহিক পরিশ্রম আর মানসিক উত্তেজনার পর কিছুটা নিশ্চিন্ত বিশ্রামের সুযোগ পেয়ে তার ক্লান্ত দেহ শয্যার উপর এলিয়ে পড়তে চাইছিল, কিন্তু সে আত্মসংবরণ করল। অতি অল্প বয়সেই বহু তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে কিশোর কর্ণদেব! শ্বাপদের চেয়েও ভয়ংকর দ্বিপদ মানুষের পরিচয় সে পেয়েছে বারংবার। অতএব, শয্যায় শয়ন করার প্রলোভন সংযত করে সে সোজা হয়ে বসে থাকল, এমনকি কটিবন্ধে আবদ্ধ তরবারি ও ছুরিকা রইল যথাস্থানেই। বল্লভকে সে অবিশ্বাস করে নি, কিন্তু অপরিচিত স্থানে দেহ-সংলগ্ন অস্ত্র তার কাছে প্রিয়বন্ধুর সান্নিধ্যের মতোই আশ্বাসজনক- কোনো কারণেই আত্মরক্ষার উপকরণ সে দূরে রাখতে রাজি নয়।

…অকস্মাৎ তার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করল শলাকাপক্ক মাংসের লোভনীয় গন্ধ! তৎক্ষণাৎ সে অনুভব করল তার দেহের মধ্যে উদর নামে যে স্থানটি রয়েছে, সেটি একেবারেই শূন্য! এতক্ষণ ক্ষুধাতৃষ্ণার কথা তার মনেই হয় নি, কিন্তু শুল্য মাংসের ঘ্রাণ গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই তার মনে হল উদরের শূন্যতাকে অবিলম্বে কিছু স্থূল বস্তুর সাহায্যে পরিপূর্ণ করার প্রয়োজন উপস্থিত হয়েছে। সেই সঙ্গে তার রসনাও হয়ে উঠল রসসিক্ত!…।

কিছুক্ষণ পরেই সহাস্যবদনে দ্বারপথে আবির্ভূত হল বল্লভ। তার দুই হাতে দুটি বৃহৎ স্থালীতে অবস্থান করছে দুটি সুবৃহৎ পাত্র। পাত্র দুটি কক্ষতলে স্থাপন করে বল্লভ বলল, এসো। গৃহে রমণী থাকলে তারা জলসিক্ত বস্ত্র ও সম্মার্জনী সহযোগে এই মণিকুটিম বিশেষ ভাবে পরিষ্কার করে আহার্য পরিবেশন করত কিন্তু আমার গৃহে নারী নেই এবং আমারও বারংবার কক্ষতল পরিষ্কার করার ধৈর্য নেই। দ্বিপ্রহরে গৃহত্যাগ করার পূর্বে এই স্থান আমি জলসিক্ত করে সম্মার্জনী সহযোগে উত্তমরূপে পরিষ্কার করেছি। পুনরায় ওই গৃহকর্মের পুনরাবৃত্তি করতে আমি অনিচ্ছুক। অবশ্য তুমি যদি প্রয়োজন মনে করো–

না, না, কর্ণদেব প্রতিবাদ করল, আমি আদৌ প্রয়োজন বোধ করছি না।… কিন্তু এই কি আপনার সামান্য সামর্থ্যের উদাহরণ?

হে, হে, বল্লভ বিনীত হাস্যে বিগলিত হল, এই যৎসামান্য উপকরণ দিয়েই তোমার দরিদ্র বন্ধু আজ অতিথি সৎকার করতে চাইছে। তুমি অনুগ্রহ করে খাদ্যগ্রহণ করলে আমি কৃতার্থ হব।

কর্ণদেব গম্ভীর স্বরে বলল, এই পর্বত প্রমাণ পিষ্টক, চাপটি আর ওই বৃহৎ পাত্রে অবস্থিত বিপুল পরিমাণ শূল্য মাংস দিয়ে তিন-চারটি বলিষ্ঠ পুরুষের ক্ষুধা-নিবারণ সম্ভব। আমি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত বটে, তবে ওই স্থালী ও পাত্রের যাবতীয় খাদ্য গ্রহণ করলে উদর বিদীর্ণ হয়ে আমার মৃত্যু সুনিশ্চিত।

বল্লভের মতামতের জন্য অপেক্ষা না করে কর্ণদেব একটি স্থালী ও পাত্র থেকে বেশ কিছু খাদ্য নিয়ে অপর স্থালীতে রাখল, তারপর লঘভার স্থালী ও পাত্র সম্মখে স্থাপন করে বলল, বল্লভ! খাদ্য নিয়ে প্রহসন স্থগিত রাখুন! এমন রাজভোগ্য খাদ্য উপভোগ করার সুযোগ আমার জীবনে কমই হয়েছে। এবার শুরু করুন। সম্মুখে ষোড়শ-উপচারে ভোজ্য রেখে খাদ্য নিয়ে বিতর্ক বাঞ্ছনীয় নয়।

কর্ণদেবের ভোজন-পাত্রের দিকে দৃষ্টিপাত করে বল্লভ ক্ষুব্ধস্বরে বলল, অসিযুদ্ধকে যারা জীবিকারূপে গ্রহণ করে, তারা স্বল্পভোজী হয় বটে। তবে তোমার বয়সে এত কম খাওয়া ভালো নয়। ক্ষিপ্রতার সঙ্গে দৈহিক শক্তিরও প্রয়োজন আছে একথা কিশোর অসিযোদ্ধার মনে রাখা উচিত।

কর্ণদেব হাসল, ব্যাঘ্রের পক্ষে হস্তীর সমপরিমাণ আহার্য গলাধঃকরণ করা অসম্ভব। দেহের শক্তিতেও সে হস্তীর সমকক্ষ নয়। কিন্তু বিদ্যুৎ গতিবেগ ও প্রখর নখদন্তের সহায়তায় সে কখনো কখনো তার চাইতে বহুগুণে শক্তিশালী হস্তীকেও পরাস্ত করতে সমর্থ হয় একথা কি আপনি জানেন না?

বল্লভ সহাস্যে বলল, তোমার যুক্তি অকাট্য। কিন্তু শলাকাপক্ক মাংস শতীল হলে বিস্বাদ হয়। ভোজনপর্ব শেষ হলে ব্যাঘ্র ও হস্তীর চাইতে অধিকতর প্রয়োজনীয় প্রসঙ্গ নিয়ে আমরা আলোচনা করব। এখন বাক্যালাপ স্থগিত রেখে দক্ষিণ হস্তের সদ্ব্যবহার করা যাক কী বলে?

আমি আপনার সঙ্গে একমত। শুন্য উদরে কোনো প্রসঙ্গই ভালো লাগে না।

.

০৯. বিশ্বস্ত অনুচর

দীপাধারে জ্বলছে প্রদীপ। বাতায়ন পথে তারকাখচিত অন্ধকার আকাশে দৃষ্টি প্রসারিত করে পালঙ্কের উপর উপবিষ্ট বল্লভ ও কর্ণদেব সম্পূর্ণ নির্বাক। উচ্ছিষ্ট ভোজনপাত্রগুলি একটু আগেই স্থানান্তরে রেখে এসেছে বল্লভ। তার মনে প্রশ্নের ঝড় কিন্তু আহার্য দ্রব্যে অতিথির তৃপ্তি হয়েছে জেনেই সে নীরব হয়ে গেছে, ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের অবতারণা করেনি একবারও মনোগত ইচ্ছা- অতিথির দিক থেকেই যেন আলোচনার উত্থাপন হয়।

অপর পক্ষে কর্ণদেবও মৌন। বল্লভের প্রশ্নের উত্তরে সে জানিয়েছে, এমন সুস্বাদু খাদ্য আর এমন আকণ্ঠ ভোজনের অভিজ্ঞতা তার জীবনে খুবই কম- সেই সঙ্গে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতেও ভুল হয়নি কিন্তু তারপরই সে মৌনব্রত ধারণ করেছে।

বল্লভ একবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাল অতিথির মুখের দিকে। কম্পিত দীপশিখা আর নক্ষত্রের আলোতে সেই মুখ রহস্যময়। মুখ দেখে মুখের অধিকারীর মনোভাব অনুমান করা দুঃসাধ্য। কেবল মাঝে মাঝে ম্লান দীপালোকে মসৃণ ললাটপটে কুঞ্জনরেখার ক্ষণিক আবির্ভাব এবং ওষ্ঠাধরের মৃদু কম্পনে বোঝা যায় অতিথির দেহ স্থির থাকলেও মন অস্থির হয়ে বিচরণ করছে চিন্তার জগতে।

অকস্মাৎ স্তব্ধতা ভঙ্গ করল কর্ণদেব, আপনি আমার পরিচয় জানতে উৎসুক। আমিও পরিচয় দিতে চাই এবং আপনার সম্পূর্ণ পরিচয় পেতে চাই। তবে একটা কথা–

—বলো।

আমি কি আপনার গৃহে নিরাপদ?

-অবশ্যই। বল্লভের গৃহে তার অতিথি সর্বদাই নিরাপদ। হঠাৎ নিরাপত্তার প্রশ্ন তোমার মনে এল কেন জানি না। যাই হোক, আমার মনেও কিছু প্রশ্নের উদয় হয়েছে। ধীর ভাবে আমার কথা শুনে উত্তর দাও।

–বলুন।

-একটু আগেই তুমি উত্তানপাদকে বলেছ আগামী কাল প্রত্যূষেই আমি নাকি তিনশত স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে তার গৃহে উপস্থিত হচ্ছি এবং উক্ত অর্থের বিনিময়ে ফিরিয়ে আনছি বন্ধকি ভদ্রাসনের চুক্তিপত্র। বলাই বাহুল্য, আমরা দুজনেই ধরে নিয়েছি ওই অর্থ দিচ্ছ তুমি। আমি তোমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করিনি, কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্য হয়েছি নিঃস্বার্থ ভাবে এত অর্থ কেউ অপরিচিত ব্যক্তিকে দান করে না। আমার কাছে তোমার কৃতজ্ঞ থাকার কিছু কারণ অবশ্য ঘটেছে। তবু বলব, তিনশত স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করার স্বপক্ষে কারণটা যথেষ্ট নয়। ওই অর্থের বিনিময়ে তুমি আমার কাছে কিছু চাও। কিন্তু আমার মতো দরিদ্রের কাছে তুমি কি চাইতে পারো?… আচ্ছা, এবার তাহলে কার্যকারণ বিশ্লেষণ করা যাক– কোনো অজ্ঞাত কারণে জয়দ্রথের সঙ্গে তুমি ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছিলে, পরে আমার দৈহিক শক্তিতে মুগ্ধ হয়ে জয়দ্রথের সাহচর্য ত্যাগ করে তুমি আমার নিকটে এসে আমার বন্ধুত্ব অর্জনের চেষ্টা করছ। দৈহিক শক্তি ছাড়া জয়দ্রথের কোনো বৈশিষ্ট্য নেই এবং পূর্বোক্ত মল্লযোদ্ধার চাইতে অধিকতর শক্তিমান বলেই আমি তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি! অতএব অনুমান করছি এমন কোনো কঠিন কার্যসাধন করার জন্য তুমি আমার সাহায্য চাও, যে কাজে সাফল্য অর্জন করতে হলে অসামান্য দৈহিক শক্তির প্রয়োজন। আশা করি আমার বিশ্লেষণ ও অনুমান ভুল হয়নি?

সঠিক বিশ্লেষণ! নির্ভুল অনুমান!

-কিন্তু তোমার কার্য সাধনে আমি অসমর্থ হলে বা অনিচ্ছা প্রকাশ করলে নিশ্চয়ই ওই তিনশত স্বর্ণমুদ্রা তুমি আমাকে দিতে রাজি হবে না?

এইবার আপনার ভুল হল। প্রতিশ্রুত তিনশত স্বর্ণমদ্রার সঙ্গে আমার প্রস্তাবের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি উত্তানপাদকে কথা দিয়েছি। প্রতিশ্রুত অর্থ আপনার হাত থেকে কাল প্রভাতেই সে পাবে!

বল্লভের গলার ভিতর থেকে ঘুষ্কার-ধ্বনির ন্যায় অস্ফুট শব্দ নির্গত হল। সে কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু অক্ষম বাগযন্ত্রে কোনো বাক্য উচ্চারিত হল না।

কর্ণদেব হাসল, আপনি বিস্মিত হয়েছেন। হওয়াই স্বাভাবিক। ব্যবসাতে অর্থ লগ্নি করার নিয়ম আছে। মনে করুন, এই তিনশত স্বর্ণমুদ্রা আমি লগ্নি করছি। আপনি যদি আমার প্রস্তাবে অসম্মত হন তাহলে জানব ব্যবসাতে নেমে তিনশত স্বর্ণমুদ্রা আমি হারিয়েছি। ব্যবসাতে লাভ-ক্ষতি আছে, এইটুকু ক্ষতি আমি অনায়াসে সহ্য করতে পারব। আর যদি আমার প্রস্তাবে সম্মতি দেন, তাহলে আমরা যা লাভ করব, সেই লাভের অঙ্ক আপনার কল্পনাতীত।

বল্লভের ভ্রূ কুঞ্চিত হল, আমরা? অর্থাৎ তুমি আর আমি?… অবশ্য কাজটা যদি অন্যায় না হয়, তাহলে দুঃসাধ্য হলেও আমি তা করতে রাজি আছি। বলো– কাজটা কি?

বলব বলেই তো আজ রাত্রে আপনার গৃহে অতিথি হয়েছি। তবে তার আগে আপনার বিষয় আপনার মুখ থেকেই কয়েকটা কথা জানতে চাই। আপনার পূর্ব-ইতিহাস বা দুর্দৈব সম্পর্কে আমি এখন অবহিত, কিন্তু বর্তমান সম্পর্কে বিশেষ সচেতন নই। বিশেষত আপনার চালচলনও কিয়ৎ পরিমাণে রহস্যময়, সে বিষয়ে

বাধা দিয়ে বল্লভ বলে উঠল, আমার চালচলন রহস্যময়? কি বলছ তুমি?

-ঠিকই বলছি। আপনি সন্ন্যাসী নন, অথচ গৈরিকধারণ করেছেন এবং সন্ন্যাসী শ্রেণির ন্যায় মুস্তক মুণ্ডন করেছেন কিন্তু কেন? রাজপথে দাঁড়িয়ে লোকমুখে শুনলাম আপনার কিছু শিষ্য আছে। কুসীদজীবী উত্তানপাদের মুখেও শিষ্যদের প্রসঙ্গ শুনেছি। গৈরিকধারী গৃহীর কাছে ওই শিষ্যরা কোন ধর্মচারণের দীক্ষা গ্রহণ করতে আসে?

সশব্দ হাস্যে ফেটে পড়ল বল্লভ, হো! হো! হো! এই কথা!… হা! হা!… গৈরিকধারণের সঙ্গে সন্ন্যাস গ্রহণের সম্পর্ক থাকতেই হবে এমন কথা তোমাকে শিখিয়েছে কোন বলীর্বদ?.. আরে, শ্বেতবস্ত্র অতি শীঘ্রই মলিন হয়ে দৃষ্টিকটু হয়ে ওঠে, তাই ঘন ঘন বস্ত্র ধৌত করার প্রয়োজন হয়। অনর্থক পরিশ্রম আমি পছন্দ করি না, রজকের শরণাপন্ন হলেও অর্থব্যয় অনিবার্য অতএব শ্বেতবস্ত্রের পরিবর্তে আমি গৈরিকধারণ করেছি। লাল, নীল, সবুজ প্রভৃতি রংও সহজে মলিন হয় না। কিন্তু ওইসব রং তরলমতি তরুণ-তরুণীরা পছন্দ করে বলে উজ্জ্বল বর্ণ বর্জন করে আমি গেরুয়াকেই প্রাধান্য দিয়েছি। এতে রহস্যের কি আছে বাপু?… আর শিষ্যদের কথা জিজ্ঞাসা করছ? হ্যাঁ, আমার কিছু শিষ্য আছে বটে। তারা আমার কাছে ধর্মাচরণের দীক্ষা নিতে আসে না;- আসে, মল্লযুদ্ধ শিক্ষা করতে। মল্লযুদ্ধে সুবিধা হয় বলেই আমি মস্তক মুণ্ডন করেছি। মল্লবীরদের মধ্যে কোনো কোনো ব্যক্তি যে মস্তক মুণ্ডন করে থাকে, সে কথা নিশ্চয়ই তোমার অজ্ঞাত নয়?

–আপনি কি মল্লযোদ্ধা?

–বাল্যকাল থেকেই আমি মল্লযুদ্ধের প্রতি আসক্ত। শক্তিচর্চার সঙ্গে বিদ্যাভ্যাসও করেছি নিয়মিত, তাই পিতা আমাকে শক্তিচর্চায় বাধা দেননি। আমি বলিষ্ঠ দেহ নিয়েই জন্মগ্রহণ করেছিলাম। তার উপর ধনী পিতার অর্থে যাবতীয় পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করে এবং বিভিন্ন মল্লবীরের আখড়ায় মৃত্তিকা মর্দন করে কয়েক বৎসরের মধ্যেই অমানুষিক শক্তির অধিকারী হলাম। পরে অবস্থা যখন মন্দ হল, তখন মল্লবিদ্যার সাহায্যেই গ্রাসাচ্ছাদন সংগ্রহ শুরু করলাম।

ও! আপনি এখন পেশাদার মল্লযোদ্ধা? অর্থের বিনিময়ে মল্লযুদ্ধের শিক্ষা দিয়ে থাকেন?

–না, না। আমি উচ্চবংশের সন্তান হয়ে মল্লযুদ্ধের মাটি থেকে অর্থ উপার্জন করতে পারি। তাছাড়া ওইভাবে অর্থ উপার্জনে গুরুরও নিষেধ ছিল। আমি কয়েকটি বিশিষ্ট শিষ্যকে মল্লযুদ্ধ সম্পর্কে শিক্ষা দিয়ে থাকি। শিষ্যরা আমাকে গুরুদক্ষিণাস্বরূপ তণ্ডুল, গোধুম, দুগ্ধ, মাংস প্রভৃতি সরবরাহ করে। শিষ্যদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ আছে। কৃষিজীবী কৃষক, দুগ্ধ ব্যবসায়ী গোপ এবং মাংস ব্যবসায়ী ব্যাধ প্রভৃতি সকল শ্রেণির মানুষই আমার শিষ্যদের মধ্যে বর্তমান।

বল্লভ মুহূর্তের জন্য থামল, তারপর বিমর্ষভাবে বলল, না, ভুল বললাম। সকল শ্রেণির মানুষ আমার শিষ্য-সমাজে নেই। আজ পর্যন্ত কোনো ধীবর আমার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে আসেনি। অথচ মৎস্য আমার অতিশয় প্রিয় খাদ্য। বললে বিশ্বাস করবে না বৎসরাধিকাল আমি মৎস্য থেকে বঞ্চিত। মৎস্যের স্বাদও বুঝি ভুলে গেছি।

কর্ণদেব গম্ভীর স্বরে বলল, আমার প্রস্তাবে সম্মত হলে আপনি প্রত্যহ প্রচুর পরিমাণে মৎস্য ভক্ষণ করতে পারবেন। মৎস্যের জন্য ধীবর শিষ্যের প্রয়োজন হয় না, নগদ অর্থের বিনিময়ে ধীবর পল্লির সর্বোৎকৃষ্ট মৎস্য আপনার রসনার তৃপ্তিসাধন করবে। কাল প্রভাতে আপনি ঋণমুক্ত হচ্ছেন, অতএব সে বিষয়েও আপনার দুশ্চিন্তার প্রয়োজন নেই।

দুশ্চিন্তার অবকাশ অবশ্যই আছে, বল্লভ দৃঢ়স্বরে বলল, আমি কারও অনুগ্রহের দান গ্রহণ করিনি, করব না। এই বসতবাটি থেকে যদি ঋণের দায়ে বিতাড়িত হই, তাহলেও বিপুলা এই ধরণীতে আশ্রয়ের অভাব আমার হবে না। মল্লযুদ্ধের কল্যাণে অন্নজলের জন্য আমার দুর্ভাবনা নেই। কোনো কারণে নগদ অর্থের প্রয়োজন হলে বন থেকে আমি কুঠারের সাহায্যে কাষ্ঠ সংগ্রহ করি। আমি সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান, তাই বিপণিতে দাঁড়িয়ে সংগৃহীত কাষ্ঠ জনসমক্ষে বিক্রয় করতে পারি না। কাঠুরিয়াদের কাছে অপেক্ষাকৃত সুলভ মূল্যে ওই কাষ্ঠ বিক্রয় করে আমি প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করি। অতএব বুঝতেই পারছ গৃহহারা হওয়ার ভয়ে আমি ভীত নই। যে গৃহে আমার পিতা-মাতা দেহরক্ষা করেছেন, যে গৃহের সঙ্গে আমার স্নেহময়ী ভগ্নীর স্মৃতি জড়িত সেই গৃহ হস্তান্তরিত হয়ে অপরের বাসস্থান হবে এই চিন্তাই আমাকে কিঞ্চিৎ বিচলিত করে তুলেছে।

কর্ণদেব বলল, বিচলিত হলেই বা উপায় কি? যতদুর মনে হয় তিনসহস্র তো দূরের কথা তিনশত স্বর্ণমুদ্রা সংগ্রহ করাও আপনার সাধ্যাতীত। না হলে, ঋণশোধ করে বসতবাটী রক্ষার চেষ্টা কি আপনি করতেন না?

–চেষ্টা করেছি বৈকি। প্রায় সফলও হয়েছিলাম। কিন্তু বিধি বাম, কি করব বল?

কর্ণদেব কোনো উত্তর দিল না। কিন্তু তার ওষ্ঠাধরে যে সূক্ষ্ম ব্যঙ্গের হাসিটি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল সেটি বল্লভের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারল না।

বল্লভ উত্তেজিত স্বরে বলল, তুমি ভাবছ আমি মিথ্যা বাগাড়ম্বর করছি। তাই না?… না, না, প্রতিবাদ করে লাভ নেই। কর্ণদেব! আমাকে নিতান্ত নির্বোধ ভাবলে তুমি ভুল করবে। আমি নিশ্চেষ্ট পুরুষ নই। ঋণশোধের জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম।

কর্ণদেব বিনীত স্বরে বলল, মার্জনা করবেন। স্বীকার করছি আপনার কথা আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। আমার বোঝা উচিত ছিল আপনার মত মানুষ মিথ্যা বাগাড়ম্বর বিস্তার করে না।

বল্লভ বলল, তবে শোনো, তোমাকে দুঃখের কাহিনি বলি। আমার পরিচিত জনৈক কাষ্ঠব্যবসায়ী আমাকে জানিয়েছে আগামী পক্ষকালের মধ্যেই মহারাজ রুদ্রদমনের এক মিত্ররাজ্যে কয়েকটি দুর্গকে দুর্ভেদ্য ও অলঙ্কৃত করার জন্য শ্রাবন্তী থেকে দুর্মূল্য প্রস্তর ও কাষ্ট প্রচুর পরিমাণে উক্ত রাজ্যে প্রেরিত হবে। ওই ব্যবসায়ী আমাকে আশ্বাসদান করে বলেছে, রাজদরবার যদি তাকে কাষ্ঠ সরবরাহের ভার দেয়, তাহলে প্রচুর পরিমাণে শাল সেগুন প্রভৃতি বৃক্ষের কাষ্ঠ সে আমার কাছেই ক্রয় করতে রাজি আছে। কিছু কিছু উৎকৃষ্ট কাষ্ঠ এর মধ্যেই আমি ওই ব্যবসায়ীকে দিচ্ছিলাম এবং মূল্য তার কাছেই জমা রাখছিলাম। তিনসহস্র স্বর্ণমুদ্রা অবশ্য সংগ্রহ করতে অনেক বিলম্ব ছিল। কারণ, দুর্গ বা প্রাসাদোপম অট্টালিকা নির্মাণের উদ্যোগ খুব কমই হয়। আর ওই ধরনের বৃহৎ কার্য না হলে আমার পক্ষে কাষ্ঠ সংগ্রহ করে এককালীন অধিক অর্থের সংস্থান করা অসম্ভব। হঠাৎ মিত্ররাজ্যে কাষ্ঠ সরবরাহের সংবাদ শুনে উৎফুল্ল হয়েছিলাম। আশা ছিল ওই সরবরাহকার্যে যে অর্থ পাব, তার সঙ্গে পূর্বে অর্জিত অর্থ একত্র করে হয়তো আমি ঋণমুক্ত হতে পারব। কিন্তু দুরাত্মা উত্তানপাদ আমাকে সেটুকু সময় দিতে সম্মত হল না। কর্ণদেব! বুঝতেই পারছ, আমি নিতান্ত নিশ্চেষ্ট নই, অক্ষমও নই– ভাগ্যের পরিহাসে আজ সর্বস্ব হারাতে বসেছি। তবে দুর্নীতি অবলম্বন করে আমি বসতবাটী মুক্ত করতে চাই না। তোমার প্রস্তাবে যেন অন্যায়ের গন্ধ আছে বলে মনে হয়। সুতরাং দুশ্চিন্তার প্রয়োজন নেই বললেই আমি দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হব না। যদি তোমার প্রস্তাব ন্যায়সঙ্গত হয় তাহলে আমি নিশ্চয়ই সানন্দে সম্মত হব। আর যদি প্রস্তাব অসঙ্গত মনে করি, তাহলে তোমার কাছ থেকে তিনশত স্বর্ণমুদ্রা দূরের কথা এক কপর্দকও গ্রহণ করব না। তাতে যদি আমার গৃহ হস্তান্তরিত হয়, তবে তাই হোক। আমি চিরকাল ন্যায়পথে থেকেছি, থাকব। এখন বলো কর্ণদেব– কি তোমার প্রস্তাব?

কর্ণদেব বলল, ন্যায়-অন্যায় নিতান্তই আপেক্ষিক শব্দ। একের কাছে যা ন্যায়, অপরের কাছে তা অন্যায় বলে বিবেচিত হতে পারে।

বল্লভ অধীর স্বরে বলল, আমি অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হয়ে আছি। এই মুহূর্তে তোমার তত্ত্বকথা আমি শুনতে চাই না, শুনতে চাই প্রস্তাব।

বল্লভের মুখের উপর কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে রইল কিশোরের তীব্র দৃষ্টি, তারপর সে ধীরে ধীরে বলল, আমিও আমার স্বার্থচিন্তা করে অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছি। আপনার ইচ্ছা অনিচ্ছা বা বিবেচনার উপর একাধিক মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। কিন্তু আমি ভাবছি কথাটা কিভাবে বলব–।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে কর্ণদেব শুস্বরে বলল, বল্লভ! অনিশ্চিত অবস্থায় আর কালক্ষেপ করা যায় না। তবে আপনাকে আমার প্রস্তাব জানানোর আগে আর একটা কথা বলতে চাই।

-বলো।

–একটু আগেই আপনার গৃহে আমার নিরাপত্তা সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলাম। আপনি হয়তো ভেবেছিলেন আমার কাছে মূল্যবান রত্ন ও প্রচুর অর্থ আছে, তাই তস্কর বা দস্যুর আকস্মিক আক্রমণের সম্ভাবনা আমাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। আপনি নিতান্ত লঘুভাবেই জানিয়েছিলেন, বল্লভের গৃহে তার অতিথি সর্বদাই নিরাপদ। কিন্তু আমি বহিরাগত দস্যু তস্করের ভয় করিনি। আপনার সান্নিধ্যে আমার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে কিনা সেইটাই ছিল আমার প্রশ্ন। প্রশ্নের অর্থ আপনি সম্যক উপলব্ধি করতে পারেননি। আমি বলতে চাই

বাধা দিয়ে বল্লভ ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠল, তুমি কি বলতে চাও আমি বুঝতে পেরেছি। আমার সান্নিধ্যে তোমার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে কিনা এইটাই যদি তোমার প্রশ্ন হয়, তাহলে বুঝতে হবে আমার সততা সম্পর্কে তোমার সন্দেহ আছে। নির্বোধ কিশোর। আমার সততায় সন্দিহান হয়ে কোন সাহসে তুমি আমার অতিথি হলে? আমার শক্তির পরিচয় তুমি পেয়েছ। তুমি কি জানো না, ইচ্ছা করলে এক মুষ্ট্যাঘাতে তোমাকে বধ করে আমি তোমার ধনরত্ন লুণ্ঠন করতে পারি?

মুহূর্তের জন্য কর্ণদেবের চোখে-মুখে দেখা দিল আহত বিস্ময়ের চমক, পরক্ষণেই বিস্ময়ের অভিব্যক্তিকে গ্রাস করে উপস্থিত হল ক্রোধের করাল ছায়া

শ্লেষতিক্ত হাসির ফাঁকে জাগল বিদ্রূপশাণিত কণ্ঠস্বর, বল্লভ! বয়স অল্প হলেও মানব-চরিত্রে আমার কিছু অভিজ্ঞতা আছে। অর্থের লোভে যে-মানুষ নির্বিকার চিত্তে নির্দোষ ব্যক্তিকে হত্যা করতে পারে, এমন এক বিবেকহীন হন্তারকের ভূমিকায় আপনাকে আমি একবারও কল্পনা করিনি। তবে মানুষের অবচেতন মনের অন্ধকারে যে হিংস্র পশু ঘুমিয়ে থাকে, রাতের অন্ধকারে তার হঠাৎ জাগ্রত হওয়ার সম্ভাবনা আছে একথাও আমি অস্বীকার করি না। সেটুকু বিপদের ঝুঁকি আমি নিয়েছি বইকি। আপনি মহাশক্তিরধর বটে, কিন্তু আমিও নিতান্ত নিবীর্য নই। একটু আগেই ব্যাঘ্র ও হস্তীর তুলনামূলক আলোচনা আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই?…হ্যাঁ, হস্তীর পদতলে পিষ্ট ব্যাঘ্রের মৃত্যুবরণের সম্ভাবনা থাকে বটে, কিন্তু ক্ষিপ্রগামী ব্যাঘ্রের নখদন্তে বিদারিতকুম্ভ গজরাজের প্রাণত্যাগের ঘটনাও খুব বিরল নয়।

কর্ণদেবের অঙ্গুলিস্পর্শে কটিবন্ধের তরবারিতে জাগল মৃদু ঝনকার শব্দ!

তৎক্ষণাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো উঠে দাঁড়াল বল্লভ! প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জ্যামুক্ত তীরের মতো দণ্ডায়মান হল কর্ণদেব!

বল্লভের দুই চক্ষু দারুণ ক্রোধে জ্বলন্ত এবং দুই হস্ত মুষ্টিবদ্ধ!

কর্ণদেবের অধরে ক্লিষ্ট হাসির রেখা হাত কটিবন্ধের অস্ত্রে সংলগ্ন নয়, কিন্তু ডান হাতের পাঁচটি আঙুল বাজপাখির ছোঁ মামার ভঙ্গিতে স্থির হয়ে আছে তরবারির হাতল থেকে একটু দূরে!

বল্লভ সেদিকে দৃকপাত করল না, ক্রুদ্ধস্বরে গর্জন করে বলল, অতিথিকে আমাদের বংশে কেউ কোনোদিন অপমান করেনি, কিন্তু তোমার উপস্থিতি আমি সহ্য করতে পারছি না। অনুগ্রহ করে এই মুহূর্তে তুমি আমার গৃহত্যাগ করো। নচেৎ–

দারুণ ক্রোধে তার কণ্ঠরুদ্ধ হল।

কিছুক্ষণ বিমূঢ় অবস্থায় রইল কর্ণদেব, তার ওষ্ঠাধরে ক্লিষ্ট হাসির ক্ষীণ রেখাঁটি হঠাৎ উদার হাস্যে প্রশস্ত হল, পরক্ষণেই সে প্রচণ্ড অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল, আমি যাব না। সাধ্য থাকে, বলপ্রয়োগ করে অতিথিকে গৃহ থেকে দূর করে দাও।

ক্ষিপ্রহস্তে সে খুলে ফেলল কোমরের চর্মবন্ধনী- মণিকুট্টিমের উপর নিক্ষিপ্ত হল কটিবন্ধসমেত কোষবদ্ধ ছুরিকা ও তরবারি! পাষাণ ও ইস্পাতের সংঘাতে জাগল তীব্র ঝঞ্জনা-ধ্বনি!

বল্লভ হতবুদ্ধি হয়ে গেল! এমন অদ্ভুত আচরণ তার কল্পনাতীত!

দুই বাহু বক্ষে আবদ্ধ করে কর্ণদেব গর্বিত স্বরে বলল, তোমার সততা সম্পর্কে আমি সন্দেহ প্রকাশ করিনি। কিন্তু আমার বক্তব্য পরিষ্কার করে বলার সুযোগও তুমি আমাকে দাওনি। অর্ধসমাপ্ত বাক্যের বিকৃত ব্যাখ্যা করে তুমি আমাকে অপমান করেছ। দাম্ভিক মল্ল! শক্তির দম্ভে আত্মহারা হয়ে তুমি অসিযোদ্ধার মর্যাদায় আঘাত করেছিলে– তাই তোমাকে বুঝিয়ে দিলাম তরবারির সঙ্গে যে-মানুষ বন্ধুত্ব স্থাপন করেছে, সে কখনো ব্যক্তিবিশেষের শারীরিক শক্তির কথা ভেবে ভীত হয় না। ব্যাঘ্রের নখদন্ত যেমন তার ইচ্ছায় পরিচার্লিত হয়ে তার চেয়ে বহুগুণ বলশালী গজরাজের দেহ বিদীর্ণ করতে পারে নিপুণ অসিচালকের অসিও তেমনই আজ্ঞাবাহী সহচরের ন্যায় চালকের ইচ্ছানুযায়ী চার্লিত হয়ে মহাবলবান শত্রুকে ছিন্নভিন্ন করতে পারে।

একটু থেমে উত্তেজিত কণ্ঠকে সংযত করে কর্ণদেব আবার বলতে লাগল, নিরাপত্তার প্রশ্নে তুমি উত্তেজিত হলে কেন? আমি তোমার কাছ থেকে আক্রমণের আশঙ্কা করিনি, তবে অবাঞ্ছনীয় পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম বটে। প্রকৃতপক্ষে আমি বলতে চেয়েছিলাম আমার গোপন কথা তোমাকে জানানোর পর কোনো কারণে যদি তুমি আমার উপর অসন্তুষ্ট হও, তাহলে ওই গোপন কথা কি গোপনই থাকবে? যদি নিশীথে রাজপথে বিচরণরত প্রহরীদের কাছে তুমি চিৎকার করে আমার পরিচয় ঘোষণা করে দাও, তাহলে আমার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমি তাই তোমার কাছে আশ্বাস চেয়েছিলাম। আমার প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলেও আমার পরিচয় তুমি জনারণ্যে প্রকাশ করবে না; ঘৃণার উদ্রেক হলে বাক্যালাপ বন্ধ করবে, কিন্তু রাজপুরুষের কাছে আমার পরিচয় দিয়ে আমাকে বিপন্ন করবে না এইটুকু আশ্বাস, এইটুকু অঙ্গীকার আমি শুনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সব কথা খুলে বলার আগেই তুমি আমাকে গৃহ হতে বহিষ্কার করতে উদ্যত হয়েছ।

বল্লভ নির্বাক। তার দৃষ্টি কক্ষতলে নিবদ্ধ। কর্ণদেবের কণ্ঠ আবার নিস্তব্ধ কক্ষে প্রতিধ্বনিত হল, আমি অস্ত্রত্যাগ করেছি। তোমার মতো মহাবলিষ্ঠ পুরুষের কাছে নিরস্ত্র অবস্থায় আমি নিতান্ত অসহায়। কিন্তু বেত্রাহত কুকুরের ন্যায় তোমার গৃহত্যাগ করতে রাজি নই, তোমার যা খুশি করতে পারো।

বল্লভ স্খলিত স্বরে বলল, আমি কোপনস্বভাব নই। কিন্তু উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় আমি বিচলিত। আর তুমিও ভালোভাবে তোমার কথা বলতে পারোনি। যাই হোক, আমার দুর্ব্যবহারের জন্য আমি লজ্জিত। আশা করি আমার মানসিক অবস্থার কথা ভেবে আমায় ক্ষমা করবে।

কর্ণদেব কথা বলল না। তার মুখের কঠিন রেখাগুলো মিলিয়ে যেতে লাগল। সে আবার পালঙ্কের উপর উপবেশন করল।

বল্লভ কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে বলল, কর্ণদেব তুমি আমার কাছে কোনো প্রস্তাব করবে কি করবে না সেটা তোমার বিবেচ্য। কিন্তু আমি ভাবছি তোমার মতো সুদর্শন কিশোরের এমনকী গোপন কথা, এমনকী গোপন পরিচয় থাকতে পারে যে কথা রাজপুরুষের কানে এলে তোমার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে?

কর্ণদেব নীরব। কেবল তার ওষ্ঠাধরে অনুপস্থিত হাসির রেখা আবার ফিরে আসার উপক্রম করল!

বল্লভ বলল, যাই হোক, আমি শপথ করে বলছি তোমার গোপন কথা আমার গোচরে এলে সেই কথা কোনোক্রমেই তৃতীয় ব্যক্তির শ্রুতিগোচর হবে না।

-এইটুকুই শুনতে চেয়েছিলাম। এবার আমি নিশ্চিন্ত হলাম… আচ্ছা! যে প্রস্তাব করার জন্য আমি উগ্রীব আর যে প্রস্তাব শোনার জন্য তুমি উৎকণ্ঠিত– এখন সেই প্রস্তাব তোমার সম্মুখে উপস্থিত করছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা জানতে পারব মৃত্যুভয়াল এক বন্ধুর পথে আমরা পরস্পরের বন্ধু হব না, চিরকালের মতো বিচ্ছিন্ন হব।.. হ্যাঁ, আমার বক্তব্য শুনলেই তুমি বুঝবে আমার প্রস্তাবে সম্মতি না দিলে আমাদের বিচ্ছেদ অনিবার্য। এমনকী, সুদূর ভবিষ্যতে আমাদের সাক্ষাৎকার ঘটলে আমরা পরস্পরের সঙ্গে অপরিচিতের মতো ব্যবহার করব।

কর্ণদেব! বল্লভ বলল, তোমার প্রস্তাবে যদি সম্মত না হই, তাহলে আমরা পরিচয় অস্বীকার করব কেন?

–কারণ, আমার প্রস্তাবে অসম্মত হলে বুঝতে হবে আমাকে তুমি ঘৃণা করছ।

–তবে তোমার প্রস্তাব ঘৃণ্য?

–না। কিন্তু এই প্রস্তাবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়। সেই পরিচয় ব্যক্তিবিশেষের কাছে ঘৃণ্য বলে পরিগণিত হতে পারে।

কর্ণদেব! মানুষের মুখ দর্পণের মতো। তোমার মুখশ্রী সুন্দর; বাচনভঙ্গি মার্জিত; তোমার কার্যকলাপ উচ্চবংশজাত আর্যযোদ্ধার পরিচয় বহন করছে। কোনো ভদ্ৰব্যক্তির পক্ষে তোমাকে ঘৃণা করার সঙ্গত কারণ থাকতে পারে বলে মনে হয় না।

-যদি বলি আমি এক দুস্যুর অনুচর? তাহলেও কি তুমি আমাকে ঘৃণা করবে না?

-তুমি দস্যুর অনুচর? … অসম্ভব! তোমার মুখ চোখ, তোমার ব্যবহার উচ্চবংশজাত আর্যপুরুষের পরিচয় জানিয়ে দিচ্ছে…

– বল্লভ! আমিও তোমাকে জানিয়ে দিচ্ছি উচ্চবংশজাত কোনো আর্যপুরুষের পক্ষে দস্যু পরন্তপের দলে যোগ দিতে বাধা নেই।

–দস্যু পরন্তপ!

–হ্যাঁ। আমি পরন্তপের বিশেষ স্নেহের পাত্র। সর্বাপেক্ষা বিশ্বস্ত অনুচর!

১০. কর্ণদেবের কাহিনি

অনেকক্ষণ পরে স্তব্ধতা ভাঙল বল্লভ, কুসীদজীবী উত্তানপাদের হঠাৎ সুমতি হওয়ার কারণটা এতক্ষণে বুঝালাম।

কর্ণদেব নীরব।

বল্লভ আবার বলল, কিন্তু তোমার সত্য পরিচয় উত্তানপাদকে জানিয়ে ভালো করনি। রাজপুরুষের কাছে সে যদি সব কথা বলে দেয় তবে তুমি বিপদে পড়বে। কর্ণদেব! আজ রাত্রেই যদি সে কভবর্মার কাছে গিয়ে তোমার সত্য পরিচয় জানিয়ে দেয়, তাহলে কিছুক্ষণের মধ্যেই রক্ষীদল এসে তোমাকে বন্দি করবে।

কর্ণদেব হাসল, বল্লভ! পরন্তপের ন্যায় দুর্দান্ত দস্যুর সঙ্গে যে ব্যক্তি দিনের পর দিন অতিবাহিত করে তার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছে, তাকে নির্বোধ ভাবা উচিত নয়। মনুষ্যচরিত্রে আমার অভিজ্ঞতা আছে। উত্তানপাদ আমার নামে অভিযোগ করতে সাহস পাবে না। বিশ্বাসঘাতকতা করলে পরন্তপের প্রতিহিংসা থেকে রাজশক্তি যে তাকে রক্ষা করতে পারবে না, সেকথা আমি তাকে জানিয়ে দিয়েছি। তাছাড়া আপনার গৃহে আমি যে রাত্রিযাপন করছি সেই সংবাদও তার জানা নেই। অতএব উত্তানপাদ সম্পর্কে আপনার ভীতি অমূলক।

বল্লভের ভ্রু কুঞ্চিত হল, হঠাৎ সম্বোধনের পরিবর্তন ঘটল কেন?

কর্ণদেব মাথা নত করল, ক্রোধের বশে তুমি বলে অন্যায় করেছিলাম। মার্জনা করবেন।

বল্লভের ওষ্ঠাধরে ক্ষীণ হাসির আভাস দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল, তোমার প্রস্তাবটা এবার শুনতে চাই। কিন্তু তার আগে জানতে চাই ব্রাহ্মণসন্তান কেমন করে দস্যুর বিশ্বস্ত অনুচরে পরিণত হল।

কর্ণদেব কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল, তারপর মাথা তুলে বাতায়নপথে অন্ধকার আকাশের দিকে দুই চোখের দৃষ্টিকে প্রসারিত করে গভীরস্বরে আত্মকাহিনি শুরু করল, মহারাজ রুদ্রদমনের রাজ্যে এক ক্ষুদ্র গ্রামে আমার পিতা অধ্যাপনার কার্যে ব্যাপৃত থাকতেন। আমার জননীও বিবিধ শাস্ত্রে পারদর্শিতা লাভ করে পিতার যোগ্য সহধর্মিণী হয়ে উঠেছিলেন। আমি ছিলাম তাদের একমাত্র সন্তান। সুতরাং পিতা ও মাতা উভয়েই আমার শিক্ষার বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। আমি মেধাবী ছাত্র ছিলাম। মাত্র দশ বৎসর বয়সেই আমি বিভিন্ন শাস্ত্র ও গণিতবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠলাম। পিতার আশা ছিল তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমিও শিক্ষাদানের মহৎ কার্যে ব্রতী হব। কিন্তু মাতার ইচ্ছা ছিল অন্যরকম– মহারাজ রুদ্রদমনের সভাপণ্ডিত হয়ে রাজসভা অলঙ্কৃত করব, এই ছিল তার বাসনা। আমার নিজস্ব মতামত তখনও গঠিত হয়নি। তবে বিদ্যার্জনের আগ্রহ প্রবল ছিল বলে আমি প্রাণপণে বিভিন্ন শাস্ত্র আয়ত্ত করতে সচেষ্ট ছিলাম। ওইভাবে চললে পরবর্তীকালে আমি পিতার আশা পূর্ণ করতাম, অথবা মাতার সন্তোষবিধানে সমর্থ হতাম বলা কঠিন, কিন্তু অকস্মাৎ এক দুর্ঘটনার ফলে আমরা জীবনের গতি পরিবর্তিত হল। মাত্র তিনদিনের জ্বরে আমার পিতৃদেব দেহত্যাগ করলেন। শিশুপুত্রকে নিয়ে আমার জননী অত্যন্ত অসহায় হয়ে পড়লেন। আশ্রয়গ্রহণ করা যায় এমন কোনো আত্মীয়স্বজন নিকটে ছিল না। আমার মাতুলালয় ছিল কৌশাম্বী রাজ্যে। তাদের সঙ্গে আমার পিতার সদ্ভাব না থাকায় মাতার সঙ্গেও তাঁর ভ্রাতা বা পিতা-মাতার যোগযোগ ছিল না। তথাপি নিরুপায় হয়েই আমাকে নিয়ে মাতা দূর কৌশাম্বী রাজ্যে মাতুলালয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে মনস্থ করলেন। সেইসময় গ্রামের শ্রেষ্ঠী গণপৎ মাকে নিষেধ করে জানালেন, পিতার অবর্তমানে তিনিই আমাদের রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। শ্ৰেষ্ঠী একসময়ে পিতার ছাত্র ছিলেন– গুরুপত্নী ও নাবালক গুরুপুত্রের যাবতীয় দায়দায়িত্ব তিনি স্বহস্তে গ্রহণ করলেন। পূর্বেই বলেছি আমার মাতা বিদুষী ছিলেন। পিতার অবর্তমানে মাতা স্বয়ং আমার শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে প্রবৃত্ত হলেন। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম অতি অল্প সময়ের মধ্যেই শিক্ষা সম্পূর্ণ করে রাজসভায় কার্যগ্রহণ করে মাতার দুঃখ দূর করব। কিন্তু বিধি প্রতিকুল— পিতৃবিয়োগের এক বৎসর পরেই অকস্মাৎ দারুণ বিসুচিকা রোগে আক্রান্ত হয়ে আমার জননী মৃত্যুবরণ করলেন। মাত্র দ্বাদশ বৎসর বয়সেই আমি পিতৃমাতৃহারা অনাথ বালকে পরিণত হলাম। গণপৎ নামে যে-শ্ৰেষ্ঠী আমাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন, তিনি আমাকে নানাভাবে প্রবোধ দিয়ে বললেন কর্তব্যে অবহেলা অনুচিত, অতএব আমি যেন বিদ্যাভ্যাসে বিরত না হই। আমি শোক সংবরণ করে পুনরায় অধ্যয়নে আত্মনিয়োগ করতে সচেষ্ট হলাম। নিকটবর্তী এক গ্রামের জনৈক আচার্য আমার প্রতি সহানুভূতি-পরবশ হয়ে আমাকে অধ্যয়নে সাহায্য করতে সম্মত হলেন। কিন্তু ভাগ্য যার প্রতিকূল তার পক্ষে নিশ্চিত জীবনযাপন সম্ভব নয়। হঠাৎ এক রাত্রে বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মতো শ্ৰেষ্ঠী গণপতের প্রাসাদে হানা দিল একদল দস্যু। বেতনভোগী প্রহরীদের প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে দস্যুদলের অভিযান সম্পূর্ণ সফল হল না, কিন্তু কিছু মূল্যবান রত্নালঙ্কার ও স্বর্ণ লণ্ঠন করে তারা পলায়ন করতে সমর্থ হল। সেই যুদ্ধে দুটি দস্য নিহত হয়েছিল। আমাদের পক্ষেও হতাহত হয়েছিল কয়েকজন প্রহরী। মঘবা নামে অষ্টাদশ বর্ষীয় কিশোর-প্রহরী সেই যুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করে সকলকে চমৎকৃত করে দিয়েছিল। শ্ৰেষ্ঠী পত্নী সর্বসমক্ষেই বললেন, কেবল পুঁথিগত বিদ্যা অর্জনের কি সার্থকতা আছে? গৃহকর্তার সর্বনাশ উপস্থিত হলেও যে-ব্যক্তি নিশ্চেষ্ট থাকে, তাকে গৃহ হতে দূর করে দেওয়াই কর্তব্য।

স্পষ্টভাবে আমার নাম উল্লেখ না করলেও সকলেই বুঝল আমাকে কটাক্ষ করেই শ্রেষ্ঠীপত্নী ওইকথা বলেছেন।

বিশেষত কিশোর মঘবা যখন আমার দিকে দৃষ্টিপাত করে সহাস্যে দন্তবিকাশ করল, তখন অতিশয় অপমানিত বোধ করলাম। সেই মুহূর্তে উপলব্ধি করলাম শাস্ত্রের চাইতে শস্ত্রের ক্ষমতা অনেক বেশি। গৃহের দাসদাসী, গ্রামের অধিবাসীবৃন্দ প্রভৃতি সকলেই মঘবার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিনি বলে অনেকেই আমার প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করল। শ্রেষ্ঠী অবশ্য আমাকে কিছু বলেননি, কিন্তু মঘবাকে তিনি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে প্রশংসা জানালেন এবং আমার প্রতি কটাক্ষ করে শ্রেষ্ঠীপত্নীর মন্তব্যের কোনো প্রতিবাদ করলেন না।

পরের দিন প্রভাতেই আমি গৃহত্যাগ করলাম। কি করব, কোথায় যাব কিছুই স্থির করিনি— লোকালয় ছেড়ে বনপথে ভ্রমণ করতে করতে ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর হয়ে একসময়ে তৃণশয্যায় লুণ্ঠিত হয়ে পড়লাম। ক্রমশ সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। বনে হিংস্র জন্তুর ভয় আছে মনে করে স্থির করলাম একটি বৃক্ষে আরোহণ করে রাত্রি যাপন করব। কিন্তু মনের ইচ্ছা কার্যে পরিণত করার আগেই সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতের ন্যায় আমার সম্মুখে আবির্ভূত হল এক প্রকাণ্ড ব্যাঘ্র! আমি সভয়ে ইষ্টনাম জপ করতে শুরু করলাম। ব্যাঘ্র আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার উপক্রম করল। অকস্মাৎ মনুষ্যকণ্ঠের এক তীব্র চিৎকার আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করল। তাকিয়ে দেখলাম এক দীর্ঘকায় অসিধারী পুরুষ বনপথের উপর দিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে আসছে। হিংস্র শাপদ তৎক্ষণাৎ আমাকে ছেড়ে অসিধারী পুরুষের দিকে ঘুরে দাঁড়াল এবং ভীষণ গর্জন করে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে তরবারির প্রচণ্ড আঘাতে তার গ্রীবা থেকে ছিটকে পড়ল তপ্ত রক্তের ধারা। মরণাহত পশু দারুণ আক্রোশে আবার ঝাঁপ দিল শত্রুর দিকে। আবার ব্যর্থ হল নখদন্তের নিশানা, কিন্তু শাণিত তরবার পুনরায় শ্বাপদের রক্তপান করল। উপর্যুপরি কয়েকবার আঘাতের পর রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ল নরখাদকের মৃতদেহ। আমি সবিস্ময়ে দেখলাম অসিধারী পুরুষের অসি পর পর তিনবারই অব্যর্থ সন্ধানে স্কন্ধের দুইপাশে আঘাত করে ব্যাঘের মুণ্ডকে প্রায় দেহচ্যুত করে দিয়েছে।

ব্যাঘ্রের হন্তারক এগিয়ে এসে নিহত শ্বাপদের দেহে তরবারি ঘর্ষণ করে অস্ত্র থেকে শোণিতচিহ্ন লুপ্ত করে ফেলল। তারপর নিষ্কলঙ্ক অসি কোষবদ্ধ করে আমার সম্মুখে দণ্ডায়মান হল।

কিছুক্ষণ আমাকে স্থিরদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে ওই ব্যক্তি বলল, বালক! এই অঞ্চলে কোনো মানুষ একাকী ভ্রমণ করে না। নরখাদক ব্যাঘ্ৰ অধ্যুষিত এই অরণ্যে তুমি সন্ধ্যাকালে কেন এসেছ? বোধহয় তোমার পথ ভুল হয়েছ। তুমি কোথায় যেতে চাও?

আগন্তুকের কণ্ঠস্বর গভীর, কিন্তু স্নেহের স্পর্শে কোমল। ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম তার ঊর্ধ্ব-অঙ্গে পীতাভ আঙরাখা, নিম্ন-অঙ্গ আগুলফ আচ্ছাদিত যোদ্ধৃসুলভ শ্বেতবস্ত্রে। আবরণের ভিতর থেকেও তার স্কন্ধ ও বক্ষের স্ফীত মাংসপেশী চোখে পড়ে। আবরণ-মুক্ত দুই বাহু দৃঢ় পেশীবদ্ধ এবং শুষ্ক ক্ষত চিহ্নে চিহ্নিত। তীক্ষ্ণ নাসা, পরিপূর্ণ ওষ্ঠাধর, মাংসহীন কঠিন চোয়াল, আর কুঞ্চিত কেশদামের নীচে অপ্রশস্ত ললাটের উপর এক জোড়া রোম জ্বর তলায় জ্বলছে এক জোড়া প্রখর চক্ষু! সব মিলিয়ে মানুষটিকে সুপুরুষ হয়তো বলা যায় না, তবে তার চেহারার মধ্যে যে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কোমলে কঠিনে মেশা সেই আশ্চর্য সৌন্দর্যকে অনুভব করা যায়, ভাষায় সাহায্যে ব্যক্ত করা যায় না।

আগন্তুক আবার কোমল-গম্ভীর স্বরে বলল, বালক, ভয় নেই। ব্যাঘ্র নিহত হয়েছে। বলল, তুমি কোথায় যাবে? আমি স্বয়ং তোমাকে যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে আসব।

বললাম, জানি না। এই পৃথিবীতে আমার যাওয়ার কোনো স্থান নেই।

আগন্তুকের তীব্র দৃষ্টি তীব্রতর হল, সে প্রশ্ন করল, সে কি! তোমার কি কেউ নেই?

আমি তখন সংক্ষেপে আমার ইতিহাস ব্যক্ত করে বললাম, তুমি আমাকে আশ্রয় দাও! আমি ভোমার কাছে অস্ত্র চালনার শিক্ষা গ্রহণ করতে চাই।

আগন্তুক সকৌতুকে বলল, বিনিময়ে তুমি আমাকে কি দেবে?

বললাম, আমার আনুগত্য।

মর্মভেদী দৃষ্টি মেলে আগন্তুক আমার চোখের দিকে চাইল। তারপর গভীর স্বরে বলল, বেশ। এই কথাই রইল। যদি শিখতে চাও তবে এমন করেই শেখাব যে, হাতের তরবারি তোমার ইচ্ছাপূরণ করবে আজ্ঞাবাহী ভৃত্যের মতো। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করে বিনা প্রতিবাদে সর্বদা আমার আদেশ পালন করবে?

বললাম, না, এমন প্রতিজ্ঞা করতে পারব না। কিন্তু শপথ করে বলছি কখনো তোমার বিরুদ্ধাচরণ করব না।

আগন্তুক বলল, তোমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও মুখের গঠনে বোঝা যায় তুমি উচ্চবংশের সন্তান। আশা করি প্রতিশ্রুতি তোমার মনে থাকবে?

বললাম, যদি তোমার কাছে অস্ত্রশিক্ষায় সুযোগ পাই, তবে আমরণ কৃতজ্ঞ থাকব।

আগন্তুক বলল, আমি দীর্ঘকাল অস্ত্র চালনা করেছি। মানুষের শরীর দেখে তার সম্ভাবনা বুঝতে পারি। তোমার দেহের গঠন দেখে বুঝতে পারছি নিয়মিত অনুশীলন করলে তুমি নিপুণ যোদ্ধা হতে পারবে। আমি তোমাকে সযত্নে সর্বপ্রকার রণবিদ্যায় শিক্ষিত করব। এখন বলো, তোমার নাম কি?

নাম জানিয়ে আমি আমার প্রাণদাতার পরিচয় জানতে চাইলাম। আগন্তুক মৃদু হেসে বলল, আমার নাম পরন্তপ।

আমি সচমকে বললাম, দস্যু পরন্তপ!

আগন্তুক স্মিতমুখে বলল, লোকে আমার নামের আগে ওই বিশেষণটি প্রয়োগ করে বটে। বালক! তুমি কি ভয় পাচ্ছ?

বললাম, না, তুমি আমার প্রাণদাতা, তোমাকে ভয় করব কেন? তাছাড়া শুনেছি পরন্তপ অকারণে নরহত্যা করে না।

আগন্তুক বলল, ঠিক শুনেছ। শোনো বালক, তোমাকে দেখে আমার হৃদয়ে স্নেহের সঞ্চার হয়েছে। আমি স্বহস্তে কোনো ব্যক্তিকে অস্ত্রশিক্ষা দিই না। প্রয়োজনে অস্ত্রবিদ মানুষের সাহায্য নিয়ে থাকি, প্রয়োজন শেষ হলেই ওই সকল মানুষের সাহচর্য ত্যাগ করি। কিন্তু তোমাকে আমি মনের মতন করে শিক্ষা দেব। বালক! তুমি হবে আমার বিশ্বস্ত অনুচর।

বললাম, আমি চিরকাল তোমার প্রতি বিশ্বস্ত থাকব। তোমার পাশে দাঁড়িয়ে অস্ত্রধারণ করব। কিন্তু নিতান্ত প্রয়োজন না হলে দুস্যদলের অভিযানে যোগ দেব না।

পরন্ত সহাস্যে বলল, তথাস্তু।

তারপর কেটে গেল কয়েকটি বৎসর। অস্ত্র চালনায় আমি অতিশয় নিপুণ হয়ে উঠলাম। বিশেষ করে তরবারি চালনায় আমার গুরুকেও ছাড়িয়ে গেলাম। কিন্তু একটি বিষয়ে আমি কিছুতেই তার সমকক্ষ হতে পারিনি।

কর্ণদেব একটু থামতেই বল্লভ প্রশ্ন করল, কোন্ বিষয়ে তুমি তার সমকক্ষ নও?

-বহুদূর থেকে অব্যর্থ সন্ধানে ছুরিকা নিক্ষেপ করে লক্ষ্যভেদ করতে পারে পর্যুপ। দীর্ঘকাল অনুশীলন করেও ঐ বিদ্যাটি আমি আয়ত্ত করতে পারিনি! পরন্তপের কাছে শুনেছি শৈশব থেকেই ক্রমাগত অনুশীলননের ফলে সে ছুরিকা নিক্ষেপে সিদ্ধহস্ত।

এখন জানলাম ব্রাহ্মণ সন্তান কেমন করে দস্যুর অনুচরে পরিণত হল। এবার বলো কি তোমার প্রস্তাব?

বলছি। কিন্তু আত্মকাহিনি যখন শুরু করেছি, তখন আরও কয়েকটা কথা বলতে চাই। বিশেষ করে জল্লাদ নামে যে মানুষটি আজ আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিল তার সম্পর্কেও কয়েকটা কথা আপনার জানা দরকার। ওই সঙ্গে আরও একটি ঘটনার উল্লেখ করব। ঘটনাটি অতি তুচ্ছ হলেও পরবর্তীকালে ওই ঘটনার জন্যই আমার জীবন বিপন্ন হয়েছিল। প্রথমে ওই ঘটনার কথা বলছি, পরে জল্লাদের কথা বলব। পরস্পর বিচ্ছিন্ন ওই দুটি ঘটনার ফলেই আজ আমি প্রাণ হারাতে বসেছিলাম।

পরন্তপের কাছে প্রায় তিন বৎসর শিক্ষাগ্রহণ করার পর আমি যখন অস্ত্রচালনায় বিশেষ করে তরবারি ব্যবহারে দক্ষ হয়ে উঠেছি, সেই সময় এক অলস মধ্যাহ্নে কিঞ্চিৎ মাধ্বীপানের উদ্দেশে নিকটবর্তী এক গ্রামের পানশালায় গমন করলাম। প্রসঙ্গত জানাচ্ছি, বনের মধ্যে পরন্তপের একটি স্থায়ী বাসগৃহ ছিল, কিন্তু আমি ছাড়া দলের কেউ ওই গৃহের সন্ধান জানত না। আমি ছিলাম তার সর্বপেক্ষা বিশ্বস্ত সহচর, একান্ত স্নেহের পাত্র। দলের কোনো কোনো ব্যক্তি আমাকে ঈর্ষা করত। কিন্তু প্রকাশ্য কলহে অবতীর্ণ হতে কেউ সাহস পেত না! কারণ, বন্ধুভাবে অসিক্রীড়া করার সময়েই তারা আমার ক্ষমতার পরিচয় পেয়েছিল একাধিকবার। তাছাড়া, পরন্তপ সম্পর্কে নিদারুণ ভীতি তাদের প্রকাশ্য শত্রুতা থেকে নিরস্ত করেছিল। পরন্তপ আমাকে ভালোবাসত তার সন্তানের মতো। দেশের মানুষ তাকে ঘৃণা করতে পারে, কিন্তু আমি তার যে পরিচয় পেয়েছি

বাধা দিয়ে বল্লভ বলল, অপ্রয়োজনীয় আলোচনার সময় নেই। তোমার কথা বলো। পরন্তপের কথা শুনতে চাই না।

-ঠিক! ঠিক! হঠাৎ ভাবপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। এই আকস্মিক দুর্বলতার জন্য ক্ষমা করবেন। যে দুস্য সমগ্র দেশে আতঙ্কের সঞ্চার করেছে, তার সম্পর্কে আপনার ন্যায় সৎ নাগরিকের অনীহা থাকা নিতান্তই স্বাভাবিক।

কিন্তু আমি জানি পরন্তপ শুধু নরঘাতক দুস্য নয়, তার নিজস্ব জীবন-দর্শন আছে। নিজের আত্মার কাছে সে নিষ্কলুষ, ভাবের ঘরে চুরি সে কখনো করে না। যাই হোক তার প্রসঙ্গ ছেড়ে এবার আমার কথাই বলছি, ধৈর্য ধরে শুনুন।

পানশালায় গিয়ে দেখলাম কয়েকটি গ্রাম্য যুবক শীতল পানীয় ও খাদ্য সহযোগে অবসর বিনোদন করছে। আমি কারও দিকে দৃকপাত না করে এক পাত্র মাধ্বী ও কিছু শূল্য মাংস নিয়ে পানাহার শুরু করলাম। হঠাৎ সেইস্থানে এক দরিদ্র ব্যক্তি এসে বিপণির অধিকারীর কাছে কিছু খাদ্য ও পানীয় চাইল। অধিকারী জানাল এটা দাঁতব্য প্রতিষ্ঠান নয়। অতএব উপযুক্ত মূল্য না পেলে সে খাদ্য বা পানীয় দিতে অপারগ। লোকটি সর্বস্ব গণনা করে দেখল তার কাছে মাত্র এক পাত্র মাধ্বীর মূল্য আছে। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে সে বলল, বহুদুর থেকে আসছি। আরও কয়েকটি গ্রামের পরে আমার মাতুলের গৃহ। সেখানে উপস্থিত হলে আমার কোনো অসুবিধা থাকবে না। কিন্তু এখন ক্ষুৎপিপাসায় আমি নিতান্ত কাতর, পথ চলার ক্ষমতা আর নেই! আচ্ছা, এই অর্থের বিনিময়ে এক পাত্র মাধ্বী দাও। আশা করি মাধ্বী পান করে কিছুটা সতেজ হব এবং বাকি পথ অতিক্রম করতে সমর্থ হব। তবে ঋণস্বরূপ যদি কিছু খাদ্য দাও, তবে ফেরার সময়ে আমি মূল্য শোধ করে দেব অঙ্গীকার করছি।

অধিকারী বলল, তুমি অপরিচিত। তোমার অঙ্গীকারের মূল্য কি?

গ্রাম্য যুবকদের মধ্যে একজন সহাস্যে মন্তব্য করল, এটা তোমার মাতুলালয় বা শ্বশুরালয় নয়। নগদ অর্থ দিতে না পারলে সোজা পথ দেখ।

খাদ্যসম্ভারের দিকে ক্ষুধার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে লোকটি বলল, তাহলে আমাকে একপাত্র মাধ্বীই দাও। সুরার প্রভাবে হয়তো ক্লান্তি দূর হতে পারে।

আমার কাছে প্রচুর অর্থ ছিল। দস্যুদের লুণ্ঠন-অভিযানে আমি যোগ দিতাম না বটে, কিন্তু অর্থাভাব আমার ছিল না। স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্রমুদ্রা মিলিয়ে বেশ কিছু অর্থ পরন্তপ আমার কাছে রেখে দিয়েছিল এবং সেই অর্থ প্রয়োজনবশে ব্যয় করার অনুমতিও আমার ছিল। অর্থব্যয় করার জন্য কোনো কৈফিয়ত আমি দিতাম না, বা সেও কৈফিয়ত চাইত না। সুতরাং আমার কাছে সর্বদাই কিছু না কিছু অর্থ তো থাকতই, এমনকি কখনো কখনো মূল্যবান রত্নাদিও থাকত। ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে তৃপ্ত করার জন্য সেই অর্থ থেকে কিছু ব্যয় করতে মনস্থ করলাম। অধিকারীর দিকে তাকিয়ে বললাম, ওর ইচ্ছামতো খাদ্য দাও। মূল্য আমি দেব।

আমার আদেশ পালিত হল। লোকটি আমাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে দক্ষিণ হস্তের সদ্ব্যবহার শুরু করল। কিয়ৎকাল পরে তৃপ্ত হয়ে সে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রস্থান করল। আমার এবং তার খাদ্য ও পানীয়ের মূল্য অধিকারীকে দিয়ে আমিও স্থানত্যাগ করতে উদ্যত হলাম। হঠাৎ উপবিষ্ট গ্রাম্য তরুণদের মধ্যে একজন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, মহাশয়! আপনার ন্যায় দাতাকর্ণ এই দেশে বিরল। তা আমাদের প্রতি কিঞ্চিৎ কৃপা প্রদর্শন করুন। আমরাও ক্ষুৎপিপাসায় কাতর। অধিকারীকে বলে আমাদের ক্ষুধাতৃষ্ণা নিবারণের ব্যবস্থা করুন।

ওই তরুণটি বোধহয় দলের নায়ক। তার কথা শুনে সকলের মুখেই ব্যঙ্গের চাপা হাসি ফুটল। আমি বুঝলাম আমকে নিয়ে তারা একটু মজা লুঠতে চায়। সম্ভবত তারা ভেবেছিল এক নিঃসঙ্গ কিশোর অপরিচিত পরিবেশের মধ্যে একদল তরুণের সঙ্গে কলহে প্রবৃত্ত হতে সাহসী হবে না। আমাকে তারা ইচ্ছামতো লাঞ্ছিত করতে পারবে। তাদের ভ্রম-সংশোধন করতে উদ্যোগী হলাম, বললাম, মহাশয়! পিতামাতা আমার নাম রেখেছিলেন কর্ণদেব। দাতাকর্ণ নামে আমাকে কেউ অভিহিত করে না। কিন্তু আপনার কথাবার্তার ধারা দেখে আশঙ্কা হচ্ছে, আপনার কর্ণের সঙ্গে আমার হস্তের যোগাযোগ ঘটতে পারে যে কোনো মুহূর্তে।

ক্রুদ্ধ গর্জন করে তরুণটি কাষ্ঠাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তার সঙ্গীদের মুখেও ফুটল ক্রোধের আভাস। আমি তাকিয়ে দেখলাম সবসুদ্ধ সেখানে রয়েছে পাঁচটি গ্রাম্য তরুণ। দ্রুত চিন্তা করে বুঝে নিলাম এই পাঁচজন যদি একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাহলেও তাদের হতাহত করে আমি বেরিয়ে যেতে পারব। অধিকাংশ মানুষই তখন গ্রামের বাইরে, যারা গ্রামে আছে তারাও দিবানিদ্রায় মগ্ন গোলমাল শুনে সকলে সমবেত হওয়ার আগেই এই পাঁচটি তরুণকে ধৃষ্টতার দণ্ড দিয়ে গ্রামত্যাগ করতে আমার অসুবিধা হবে না।

কলহের জন্য প্রস্তুত হয়ে বললাম, আপনাদের আচরণে যদি আমি ধৈর্যচ্যুত হই, তাহলে সেটা আপনাদের পক্ষে নিতান্ত দুঃখের কারণ হবে। অতএব, অনুমতি করুন– আমি অন্যত্র গমন করি।

যে-তরুণটি আমাকে দাতাকর্ণ নামে বিদ্রূপ করেছিল, সে একলাফে আমার সামনে এসে ক্রুদ্ধস্বরে বলল, ওরে বর্বর! এই গ্রাম থেকে অত সহজে তুই যেতে পারবি না। আমাদের গ্রামে এসে আমাদেরই বিদ্রূপ করিস তোর এত স্পর্ধা!

আমি সহজভাবে বললাম, স্পর্ধা তো আপনাদেরই দেখছি। পথ ছাড়ুন। নচেৎ শাস্তি পেতে হবে।

তরুণটি সহসা আমার মুখ লক্ষ্য করে মুষ্ঠাঘাত করল। প্রস্তুত ছিলাম, একহাতে আঘাত প্রতিহত করে অপর হাতে তার কর্ণমূলে সজোরে আঘাত করতেই সে সশব্দে ভূমিশয্যা গ্রহণ করল। পরন্তপের কাছে হাতাহাতি যুদ্ধের তালিম নেওয়ার পর এমনভাবে নিজের বিদ্যা ও শক্তিপরীক্ষার সুযোগ আগে কখনও ঘটেনি বিদ্যুৎবেগে হাত ও পায়ের সদ্ব্যবহার করতে করতে পিছু হটে আমি পানাগারের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। পাঁচটি তরুণই তখন অল্পবিস্তর আহত, দুজনের আর উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। হঠাৎ তাদের দলপতি ভূমিপৃষ্ঠ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল এবং দ্রুতবেগে বিপণির ভিতর একটি কক্ষে প্রবেশ করল মুহূর্তপরে সে যখন আবার ঘরের বাইরে আত্মপ্রকাশ করল, তখন তার হাতে রয়েছে একটি লৌহদণ্ড!

আমার বস্ত্রের অভ্যন্তরে ছিল সুদীর্ঘ ছুরিকা। বিপদ বুঝে আমি গোপন স্থান থেকে ছুরিকা টেনে নিয়ে রুখে দাঁড়ালাম। বল্লভ! আপনি দেখেছেন অসিধারী কিঞ্জলকে আমি ছুরিকার সাহায্যে পরাস্ত করেছি- রণবিদ্যায় অনভিজ্ঞ গ্রাম্য তরুণ লৌহদণ্ড নিয়ে আমার কি করতে পারে? কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তাকে ছুরিকাহত করে আমি তার হাত থেকে লৌহদণ্ড ছিনিয়ে নিলাম। আঘাত মারাত্মক হয়নি, কিন্তু আহত তরুণ রক্তাক্ত স্কন্ধদেশ চেপে ধরে ছটফট করতে লাগল– তার চারটি সঙ্গী ও পানাগারের অধিকারী সভয়ে চিৎকার করে গ্রামবাসীদের সাহায্য চাইতে শুরু করল। একহাতে লৌহদণ্ড আর অন্যহাতে ছুরিকা তুলে গ্রামের পথে ছুটতে ছুটতে তারস্বরে ঘোষণা করলাম, আমার সম্মুখে যে আসবে, তাকেই আমি হত্যা করব।

আমি নিশ্চয়ই সেদিন নিরাপদে গ্রামের সীমানা অতিক্রম করতে পারতাম, কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য– হঠাৎ সেইসময় গ্রামের ভিতর উপস্থিত হল একদল অশ্বারোহী সীমান্তরক্ষী। আমি বন্দি হলাম। দেশের আইন-অনুসারে আমার বিচার হল গ্রাম-পঞ্চায়েতের সভায়। সব শুনে গ্রাম-পঞ্চায়েতের মাতব্বররা স্থির করলেন আমার বয়স কম, অতএব বেত্রাঘাত করে আমাকে রেহাই দেওয়া যেতে পারে।

ক্রোধে আমার রক্ত ফুটতে লাগল– প্রকাশ্য সভায় বেত্রাঘাত! এই অপমান অসহ্য।

সভামধ্যে উঠে দাঁড়িয়ে আমি বললাম, এই কি পঞ্চায়েতের বিচার? আমি ভিন্ গাঁয়ের মানুষ; এই গ্রামের তরুণরা আমাকে অপমান করেছে। আমি তার প্রতিবাদ করেছিলাম সেই অপরাধে তারা দলবেঁধে আমাকে আক্রমণ করল! আমি নিরুপায় হয়ে ছুরিকার সাহায্যে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছি সেইজন্য প্রকাশ্য সভায় বেত্রাঘাত? আমিও জানিয়ে দিচ্ছি আমার দেহে যে ব্যক্তি বেত্রাঘাত করবে, তাকে আমি হত্যা করব। আজ আমি বেত্ৰাহত হয়ে ফিরে যাব বটে, কিন্তু একদিন ফিরে আসব সেদিন আঘাতকারীকে তো হত্যা করবই, গ্রাম-পঞ্চায়েতের মাতব্বর ব্যক্তিরাও আমার কবল থেকে নিস্তার পাবেন না। আমার মনের দর্পণে আপনাদের সকলের প্রতিকৃতি স্থায়ীভাবে অঙ্কিত হয়ে গেছে কারুকেই আমি ভুলব না।

সেই মুহূর্তে পরন্তপ এবং কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে সত্যই সেই গ্রামে হানা দেওয়ার সঙ্কল্প করেছিলাম। নিঃসঙ্গ এক কিশোরের স্পর্ধিত বাক্যে সমবেত গ্রামবাসী স্তম্ভিত হয়ে গেল, তারপরই জনতার ভিতর জাগল ক্রুদ্ধ কোলাহল।

পক্ককেশ গ্রামপ্রধান উঠে বললেন, বালক! তোমার স্পর্ধা অসহ্য। এখনই তোমাকে বেত্রাঘাতে জর্জরিত করা হবে।

আমি হেসে উঠে বললাম, পরিণাম স্মরণ রাখবেন। ডাকুন, দেখি কে আমার দেহে কশাঘাত করে?… মনে রেখো ভাই যে-ব্যক্তি আমার দেহে বেত্রাঘাত করবে, আজ থেকে দ্বাদশ দিবসের মধ্যেই আমার তরবারি তার বক্ষে বিদ্ধ হবে।

গ্রাম-প্রধানের আহ্বানে এক বলিষ্ঠ পুরুষ কশাহস্তে এগিয়ে এল, কিন্তু আমার কথা শুনে আর আমর চোখের দিকে তাকিয়ে তার মনে আতঙ্কের সঞ্চার হল সে ইতস্তত করতে লাগল।

সহসা জনতার ভিতর থেকে আত্মপ্রকাশ করলেন এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ, বিনীতভাবে পঞ্চায়েতকে অভিবাদন জানিয়ে তিনি বললেন, এখানে অবশ্য আমার কিছু বলার অধিকার নেই। আমি এই গ্রামে এসেছি আমার আত্মীয়ের গৃহে অবসর যাপন করতে। তবে আপনারা যদি অধিকার দেন তাহলে আমি কয়েকটি কথা বলতে পারি।

জনতার ভিতর জাগল গুঞ্জনধ্বনি। গ্রাম-পঞ্চায়েতের বিচারকরা উপবিষ্ট অবস্থা থেকে হঠাৎ দণ্ডায়মান হয়ে শশব্যস্তে বলে উঠলেন, বিলক্ষণ! বিলক্ষণ! আপনি গ্রামের মানুষ না হলেও আপনার পদধূলি পেয়ে গ্রামবাসী কৃতার্থ। বলুন, আপনার কি বক্তব্য?

মানুষটি এগিয়ে এসে সভার মধ্যস্থলে দাঁড়ালেন, তারপর গম্ভীরস্বরে বললেন, আমি সমস্ত ঘটনাই শুনেছি। একটিমাত্র কিশোরের বিরুদ্ধে যে পাঁচটি তরুণ সমবেতভাবে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাদেরই আগে শাস্তি হওয়া উচিত। আরও লজ্জার কথা সকলে মিলেও এই কিশোরটিকে পরাস্ত করতে পারেনি। বরং তার হাতে মার খেয়ে সাহায্য প্রার্থনা করেছে। সীমান্তরক্ষীর দল হঠাৎ অকুস্থলে উপস্থিত না হলে এই কিশোর ওদের লাঞ্ছিত করে পলায়ন করতে সমর্থ হতো। কী লজ্জা!

আমার বিরুদ্ধে যারা কলহে প্রবৃত্ত হয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করল, ওর হাতে অস্ত্র ছিল যে!

আমি বক্তার দিকে তাকালাম– সে ওই তরুণদের দলপতি। তার কাঁধের উপর জড়ানো ছিল কাপড়ের আবরণ, কাপড়ে শুষ্ক রক্তের চিহ্ন।

সেই রক্তচিহ্নিত স্থান দেখিয়ে সে বলল, দেখুন, ও আমার স্কন্ধে ছুরিকাঘাত করেছে। আমরা নিরস্ত্র অবস্থায় কি করতে পারি?

মধ্যবয়স্ক পুরুষ আমার দিকে ফিরলেন, একথা সত্য?

বললাম, সম্পূর্ণ সত্য নয়। আমি একাকী ওদের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র অবস্থায় লড়াই করেছিলাম এবং ওদের বিধ্বস্ত করে পানাগারের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। ওদের মধ্যে কেউ তখন আমার সম্মুখে আসতে ভরসা পায়নি। হঠাৎ এই তরুণটি পানাগারের ভিতর থেকে একটি লৌহদণ্ড নিয়ে আমাকে আক্রমণ করল। বাধ্য হয়ে আমি তখন ছুরিকা ব্যবহার করেছি।

প্রশ্নকর্তা জ্বলন্ত নেত্রে তরুণের দিকে তাকালেন। সে মাথা নত করে মাটির দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করল। প্রশ্নকর্তা কাঠোর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি প্রথম থেকে সব শুনেছি। এই দুর্ঘটনার জন্য তোমরাই দায়ী।

কলহে জড়িত আরও চারটি তরুণ সেইখানেই দাঁড়িয়েছিল, তিনি এবার তাদের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলেন, ওকে ব্যঙ্গ করে তোমরাই প্রথম কলহ শুরু করেছ। তারপর দল বেঁধে ওকে আক্রমণ করলে। কিছুতেই যখন সুবিধা করতে পারলে না, তখন পাঁচ-পাঁচটি তরুণ বয়ঃকনিষ্ঠ এই কিশোরের হাতে মার খেয়ে লৌহদণ্ড নিয়ে তাকে আক্রমণ করলে। ও যদি আত্মরক্ষার জন্য ছুরিকা ব্যবহার করে থাকে তাতে দোষ কি? তোমরা অতিশয় নির্লজ্জ, ভীরু, কাপুরুষ। তোমরা দেশের তরুণ সমাজের কলঙ্ক।

এই প্রচণ্ড ভৎর্সনার প্রতিবাদে কেউ একটি কথাও বলল না। পঞ্চায়েতের বিচারকমণ্ডলী, জনতা এবং কলহে জড়িত পাঁচটি তরুণ সম্পূর্ণ নির্বাক।

মধ্যবয়স্ক পুরুষ এইবার গ্রাম-পঞ্চায়েতেকে সম্বোধন করে বললেন, ভদ্রমহোদয়গণ, আমি পঞ্চায়েতের কেউ নই। এখানে কথা বলার অধিকারও আমার নেই। কিন্তু আপনারা আমাকে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করার অধিকার দিয়েছেন বলেই বলছি আমার বিচারে এই দুর্ঘটনার জন্য গ্রামের পাঁচটি তরুণ-ই দায়ী- এই কিশোরের অপরাধ বিশেষ গুরুতর নয়। পরকে শাসন করার আগে ঘরকে শাসন করলেই ভালো করবেন। আমার বক্তব্য আপনারা শুনলেন, এখন যথাকৰ্তব্য করুন।

পঞ্চায়েতের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বয়স্ক মানুষটি আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, নহুষ শর্মা। আপনি শ্রাবন্তী রাজ্যের রাজধানীতে প্রধান বিচারকের পদে অধিষ্ঠিত। এই গ্রামে আপনার শ্বশুরালয়; সেই সুবাদে আপনি গ্রামের জামাতা। এই কিশোর এবং পাঁচটি তরুণের বিচার আপনি করুন। গ্রাম-পঞ্চায়েত আপনাকে সেই অধিকার দিচ্ছে। পঞ্চায়েতের মুখপাত্র হয়ে আমি বলছি আপনার বিচার বুদ্ধির উপর আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে।

নহুষ শর্মা মাথা নত করে পঞ্চায়েতকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন, মহাশয় পুলোম যা বললেন আশা করি তাতে আপনাদের সম্মতি আছে।

জনতা সোৎসাহে জানাল নহুষ শর্মার উপর তাদের আস্থার অভাব নেই।

নহুষ শর্মা তখন বললেন, গ্রামবাসী এবং পঞ্চায়েতের আদেশ অনুসারে আমি কিশোর ও পাঁচটি তরুণের বিচারের ভার গ্রহণ করেছি। শোনো! তোমরা পাঁচটি তরুণই এই কিশোরের হাতে অল্পবিস্তর প্রহার লাভ করেছ, তাই তোমাদের আর শাস্তি দিতে চাই না। আশা করি এই শিক্ষা তোমাদের মনে থাকবে এবং ভবিষ্যতে দলে ভারি হয়ে কারও উপর অত্যাচার করতে যাবে না… আর কিশোর, তোমার অপরাধ তত গুরুতর নয়। কিন্তু আমার একটি প্রশ্ন আছে।

বললাম, বলুন। কি প্রশ্ন?

নহুষ শর্মার দুই চোখের দৃষ্টি আমার মুখের উপর পড়ল, একটু আগেই বিচারসভার সম্মুখে তুমি তোমার নাম জানিয়েছ। কর্ণদেব! তোমার দেব উপাধি থেকে বুঝতে পারছি তুমি ব্রাহ্মণ সন্তান। কিন্তু ব্রাহ্মণ সন্তান হয়েও তুমি মল্লযুদ্ধ ও মুষ্টিযুদ্ধে এমন দক্ষতা অর্জন করেছ যে, তোমার চাইতে বয়সে বড়ো পাঁচটি বলিষ্ঠ তরুণকে তুমি হাতাহাতি যুদ্ধে পরাস্ত করতে সমর্থ। ব্রাহ্মণ সন্তানের এমন ক্ষত্রিয়ের মতো আচরণ আমাকে আশ্চর্য করে দিয়েছে। তাছাড়া আরও একটা কথা- তোমার বস্ত্রের ভিতর লোকচক্ষুর অগোচরে তুমি শাণিত ছুরিকা বহন করেছিলে। তোমার আচরণ ব্রাহ্মণ জনোচিত নয়। তুমি কি সত্যই ব্রাহ্মণ সন্তান?

আমি আঙরাখার ভিতর থেকে উপবীত সূত্র দেখিয়ে বললাম, আমার বাক্যে যদি বিশ্বাস না হয় তবে এই সূত্র দেখুন। মল্লযুদ্ধ, অসিক্রীড়া প্রভৃতি পুরুষোচিত ক্রীড়াকলাপ আমার ভালো লাগে, তাই বাল্যকাল থেকেই অনুশীলন করে ওই সকল রণবিদ্যায় কিঞ্চিৎ পারদর্শিতা লাভ করেছি। সঙ্গে ছুরিকা রাখার কারণ আছে। আমার সঙ্গে কিছু অর্থ রয়েছে। স্ব-অপহারক দুস্যতস্কর কর্তৃক হঠাৎ আক্রান্ত হলে ধনপ্রাণ রক্ষার জন্য ছুরিকা বহন করছি। যতদূর জানি, দেশের আইনে ব্রাহ্মণ সন্তানের পক্ষে শাস্ত্রচর্চা বা অস্ত্রবহন নিষিদ্ধ নয়। প্রবাদ আছে- যে ব্যক্তি রন্ধন করিতে পারে, সে কেশের পরিচর্যাতেও সমর্থ! অতএব শাস্ত্রচর্চার সঙ্গে শস্ত্রচর্চা করতেই বা বাধা কিসের?

নহুষ শর্মার মুখে হাসির রেখা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল, কিশোর! তুমি বাপটু বটে। তোমার বাচনভঙ্গি থেকে বোঝা যায় তুমি শিক্ষিত এবং সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান। শাস্ত্র ও শস্ত্র সম্পর্কে তোমার বক্তব্য মেনে নিলেও তোমার কৈফিয়ত সম্পূর্ণ সন্তোষজনক নয়। তুমি কোথায় থাকো? সঙ্গে অর্থ ও অস্ত্র নিয়ে কোথায় গমন করেছিলে?… এইসব প্রশ্ন করলে তার উত্তর সন্তোষজনক হবে কি না জানি না তবে এই মুহূর্তে তোমাকে নিয়ে আমি মস্তিষ্ককে বিব্রত করতে ইচ্ছুক নই। রাজকার্য ছেড়ে কয়েকদিন বিশ্রামলাভের আশায় এখানে আমার শ্বশুরালয়ে এসেছি, তোমাকে নিয়ে অনুসন্ধান করতে গেলে আমার বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটবে। তবে তোমার সম্পর্কে আমার কৌতূহল রইল। ভবিষ্যতে যদি তোমাকে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় জড়িত দেখি, তাহলে হয়তো এত সহজে নিষ্কৃতি পাবে না। আরও একটা কথা বেত্রাঘাতের সম্ভাবনায় উত্তেজিত হয়ে তুমি যেভাবে প্রতিশোধ গ্রহণের সঙ্কল্প ঘোষণা করেছিল, সেটাও খুব উদ্বেগজনক। আমি ওই ধরনের কথা পছন্দ করি না।

বললাম, মহাশয়! এক অসহায় কিশোরের নিষ্ফল ক্রোধের উক্তি কি আপনি ক্ষমা করতে পারেন না?

নহুষ শর্মা বললেন, পারি। কিন্তু তোমার কথার মধ্যে এমন এক ভয়ংকর সঙ্কল্পের আভাস ছিল, যাকে নিষ্ফল বাগাড়ম্বর বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যাই হোক, তোমার সুন্দর মুখশ্রী ও বাচনভঙ্গি আমার মনে স্নেহের উদ্রেক করেছে তোমার কার্যকলাপ সমর্থন করতে না পারলেও তোমার বীরত্ব ও তেজস্বিতা আমায় মুগ্ধ করেছে সেইজন্য এবং আমার বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটবে বলে তোমার সম্পর্কে বিশেষ অনুসন্ধান না করেই তোমাকে আজ অব্যাহতি দিচ্ছি। কিন্তু মনে রেখো, ভবিষ্যতে যদি এই ধরনের কোনো ঘটনায় তোমাকে জড়িত দেখতে পাই, তাহলে তুমি সহজে নিষ্কৃতি পাবে না। এখন তুমি যেতে পারো।

বল্লভ! কাল অপরাহ্নে নহুষ শর্মার দরবারে রত্নাকরের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে উপস্থিত হলে আমার বিপদ হত। অনুসন্ধানের ফলে হয়তো পরন্তপের সঙ্গে আমার সম্পর্ক গোপন থাকত না। আর কিছু না হোক– নহুষ শর্মা সন্দেহবশে বেশ কিছুদিন আমাকে বন্দি করে রাখতেন। এখন যদি সাতটা দিনও আমি বন্দি থাকি তাহলে আমরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হব…।

বাধা দিয়ে বল্লভ বলল, তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে? অর্থাৎ দস্যুদলের ক্ষতি হবে?

কর্ণদেব ক্ষুব্ধস্বরে বলল, আমি দস্যুদলের অন্তর্ভুক্ত নই। পূর্বেই বলেছি আমি পরন্তপের বিশ্বস্ত অনুচর। আমরা অর্থাৎ আমি আর পরন্তপ ক্ষতিগ্রস্ত হব। তাছাড়া আমি যদি নিষ্ক্রিয়ভাবে কয়েকটা দিন বন্দিশালায় থাকি, তবে হয়তো আরও একটি মানুষের অপমৃত্যু ঘটতে পারে।

বটে! বটে! আমার কৌতূহল উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে সেই মানুষটি কে? কার অপমৃত্যুর সম্ভাবনায় তুমি উৎকণ্ঠিত?

–ধীরে, বল্লভ, ধীরে! সব কথাই যথাসময়ে বলব। এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছেন কেন আমি নেকড়েবাহিনীর দুর্বৃত্তদের সম্মুখীন হয়েছিলাম? দুর্বৃত্তদের তরবারির চাইতে নহুষ শর্মা আমার পক্ষে অনেক বেশি বিপজ্জনক!

-বুঝলাম। কিন্তু জল্লাদের ব্যাপারটা পরিষ্কার হল না। তোমার সঙ্গে তার যে কথাবার্তা হয়েছিল তাতে বুঝেছিলাম পূর্বে তোমার সঙ্গে তার বিবাদ হয়েছিল। সেই বিবাদ শুধু বাকযুদ্ধেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তোমার অস্ত্রাঘাতে সে একটি চক্ষুও হারিয়েছিল। সুযোগ বুঝে কাল সে নেকড়েবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়ে তোমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু তোমার সঙ্গে জল্লাদের শত্রুতা হল কেন?

–সেই কথাই তো বলতে চাইছি। আপনি আমাকে বলতে দিচ্ছেন কই?

–দুঃখিত। এই আমি মৌনব্রত অবলম্বন করলাম। এবার জল্লাদের কাহিনি বলো।

কর্ণদেব আবার আত্মকাহিনি শুরু করল, আপনাকে বলেছি পরন্তপের অনুচর হলেও আমি সক্রিয়ভাবে কখনও হত্যা বা লুণ্ঠনকার্যে যোগ দিইনি–তবে কখনো কখনো দলপতির দেহরক্ষী হয়ে দস্যুদের সঙ্গে অকুস্থলে গিয়েছি বটে। ওই সময় জল্লাদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তার স্বভাবচরিত্র আমার ভালো লাগেনি। সেও আমাকে পছন্দ করত না। কিন্তু দৈবক্রমে হঠাৎ একবার তার সঙ্গে যোগ দিয়ে দস্যুবৃত্তি করতে বাধ্য হয়েছিলাম। ঘটনাটা কি করে ঘটল সেই কথাই বলছি।

এক নির্ধারিত তারিখে সদ্যবিহাহিতা এক বন্ধু যখন স্বামীর সঙ্গে পতিগৃহে যাবে, সেই সময়ে পথিমধ্যে সেই দম্পতির উপর হানা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল পরন্তপ। কিন্তু সমবেত দস্যুদলের ভিতর থেকে একটি দুর্বিনীত দস্যু হঠাৎ কথায় কথায় পরন্তপকে অপমান করে। ক্রুদ্ধ পরন্তপ তৎক্ষণাৎ তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানায়। যুদ্ধে সেই দস্যুর মৃত্যু ঘটে। পরন্তপও  প্রতিদ্বন্দ্বীর অসিতে আহত হয়। আঘাত খুব মারাত্মক না হলেও আমি তাকে অভিযানে যোগ দিতে নিষেধ করি। সদ্যবিবাহিতা সালঙ্কারা বধূ ও তার স্বামীর সঙ্গে অস্ত্রধারী প্রহরীদের অবস্থান স্বাভাবিক- যদি যুদ্ধ বাধে এবং পরন্তপের আহত স্থানে যদি অস্ত্রাঘাত হয়, তাহলে রক্তপাতের ফলে তার প্রাণবিপন্ন হতে পারে মনে করেই আমি নিষেধ করেছিলাম। পরন্তপ প্রথমে আমার কথায় কান দেয়নি, কিন্তু আমি যখন ক্রোধপ্রকাশ করে জানালাম, আমার কথা না শুনলে তার সাহচর্য ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ যাত্রা করব, তখন সে ভীত হল। পরন্তপ জানত আমি বৃথা বাগাড়ম্বর করি না। আমাকে সে পুত্ৰাধিক স্নেহ করে, তাই আমার নিরুদ্দেশ যাত্রার সঙ্কল্প শুনে অভিযানে যোগ দেওয়ার অভিসন্ধি ত্যাগ করল। তখন জল্লাদের নেতৃত্বে সমবেত দস্যুদল নির্দিষ্ট স্থানে হানা দিতে প্রস্তুত হল। দলপতির প্রতিনিধি হয়ে আমিও দস্যুদের সঙ্গে যোগ দিলাম। কারণ, লুষ্ঠিত দ্রব্যে দলপতির প্রাপ্য অংশ বুঝে নেওয়ার মতো বিশ্বস্ত দ্বিতীয় কোনো অনুচর পরন্তপের ছিল না।

আমরা জানতাম সন্ধ্যার প্রাক্কালে বর তার নিজস্ব গ্রামে পৌঁছাবে। সেখানে গিয়ে তাদের আক্রমণ করা খুবই কঠিন। তাই প্রকাশ্য দিবালোকেই তাদের উপর চড়াও হওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। গ্রাম হতে গ্রামান্তরে যাওয়ার পথে প্রখর সূর্যালোকে দুস্যর আক্রমণের সম্ভাবনা কেউ চিন্তাই করতে পারেনি। তাই বনের ভিতর গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে এসে আমরা যখন অতর্কিতে আক্রমণ করলাম, তখন দম্পতির সঙ্গে যে সশস্ত্র প্রহরীর দল ছিল, তারা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। ব্যাপারটা ভালো করে বোঝার আগেই অধিকাংশ প্রহরী দস্যুদের অস্ত্রাঘাতে হতাহত হয়ে ভূমিশয্যায় শায়িত হল, বাকি সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালিয়ে বাঁচল। বর ও বধু পালাতে পারেনি। তাদের সঙ্গে যে পেটিকায় স্বর্ণলঙ্কার ও মণিমুক্তা ছিল, সেই পেটিকাটি অবিলম্বে অধিকার করল জল্লাদ। তারপর বধুর গায়ে হাত দিয়ে তার অলঙ্কার খুলে নিতে সচেষ্ট হল। স্বামী এতক্ষণ নিরুপায় হয়ে চুপ করে ছিল, কিন্তু সদ্যবিবাহিতা পত্নীর দেহে দস্যুর হাত পড়তেই সে আর আত্মসংবরণ করতে পারল না- সক্রোধে ধাক্কা দিয়ে জল্লাদকে সরিয়ে দিয়ে বলে উঠল, সাবধান! গায়ে হাত দিও না। অলঙ্কার আমি খুলে দিচ্ছি।

জল্লাদ হিংস্রভাবে দন্তবিকাশ করে বলল, তোর এত স্পর্ধা! আমার গায়ে হাত! ওই হাত আমি তোর দেহ থেকে খুলে নেব।

তরবারি তুলে সে এগিয়ে এল, সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ করে বধূ তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, না, না, ওকে হত্যা করো না। যথাসর্বস্ব খুলে দিচ্ছি।

কর্কশ হাস্যে চারিদিক কাঁপয়ে জল্লাদ বলল, সুন্দরি! তোমার যথাসর্বস্ব তত আমরা গ্রহণ করবই। কিন্তু যে-হাত দিয়ে তোমার স্বামী আমাকে আঘাত করেছে, সেই হাতটিও যে আমার চাই।

বধূ আকুল স্বরে কেঁদে উঠে বলল, দয়া করো। ওগো, দয়া করো। ওকে হত্যা করো না।

নির্মম কণ্ঠে হেসে উঠে জল্লাদ বলল, না, না, ওকে আমি হত্যা করতে চাই না। হাতটিকে কেটে নিয়ে তোমার স্বামীকে আবার তোমার কাছেই ফিরিয়ে দেব।

রমণী উচ্ছ্বসিত ক্রন্দনে ফেটে পড়ল। আমি আর সহ্য করতে পারলাম না, বলে উঠলাম, জল্লাদ! তুমি সার্থকনামা পুরুষ। কিন্তু আমি তোমাকে এদের উপর অত্যাচার করতে দেব না। লুষ্ঠিত দ্রব্য নিয়ে এখান থেকে প্রস্থান করে। পরে পূর্বনির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে দলপতির অংশ আমি তোমার কাছ থেকে বুঝে নেব। এই নারীর অঙ্গে যে অলঙ্কার আছে তাতে হাত দেওয়ারও প্রয়োজন নেই।

খোঁচা খাওয়া বাঘের মতো আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে জল্লাদ বলল, বালক! দলপতির অংশ তুই বুঝে নিতে এসেছিস, সেটা তোকে বুঝিয়ে দেব। কিন্তু তুই অনধিকারর্চা করিস কেন? এই নারীর অলঙ্কার এখন দলের সম্পত্তি। আর ওই যে পুরুষ আমাকে অপমান করেছে, ওকে আমি উচিত শাস্তি দেব। অধিক বাক্যব্যয় করলে তুইও নিষ্কৃতি পাবি না।

দারুণ ক্রোধে আমার দেহের রক্ত মাথায় উঠে গেল, মনে হল আমার ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে যেন অজস্র অগ্নিশিখা নৃত্য করছে দ্রুতপদে এগিয়ে এসে জল্লাদের মুখে সজোরে মুষ্টাঘাত করলাম।

রক্তাক্ত মুখে সে ছিটকে পড়ল মাটির উপর। ক্ষণমধ্যে আত্মসংবরণ করে উঠে দাঁড়াল। তারপরই ভীষণ চিৎকার করে তরবারি হাতে আমাকে আক্রমণ করল। আমি প্রস্তুত ছিলাম। চকিতে অসি কোষমুক্ত করে তাকে বাধা দিলাম। দস্যুরা সরে দাঁড়িয়ে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্য রণাঙ্গন প্রশস্ত করে দিল।

পরন্তপের কাছে দীর্ঘকাল অনুশীলনের ফলে অসি চালনায় আমি সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিলাম। জল্লাদের আঘাত কয়েকবার প্রতিহত করে আমি বিদ্যুৎবেগে প্রতি-আক্রমণ করলাম। কোনোরকমে সরে গিয়ে সে প্রাণ বাঁচাল বটে কিন্তু আমার অসির অগ্রভাগ তার একটি চক্ষুকে মুখের উপর থেকে লুপ্ত করে দিল। আর্তনাদ করে সে মাটির উপর বসে পড়ল। ইচ্ছা করলে সেই মুহূর্তে তাকে বধ করতে পারতাম। কিন্তু অসহায় শত্রুকে হত্যা করতে প্রবৃত্তি হল না। যে-কোনো সাধারণ মানুষ ওই অবস্থায় পড়লে অচেতন হয়ে পড়ত- তবে জল্লাদের কথা স্বতন্ত্র, সে হচ্ছে অমানুষিক মানুষ কয়েক মুহূর্ত পরে তরবারি তুলে নিয়ে সে আবার আমাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হল।

আমিও তখন তাকে বধ করতে কৃতসঙ্কল্প, তরবারি আন্দোলিত করে চরম আঘাত হানতে যাব সহসা আমার শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করল পরিচিত কণ্ঠস্বর, ক্ষান্ত হও! এসব কি হচ্ছে?

সচমকে মুখ তুলে দেখলাম অশ্বপৃষ্ঠে আবির্ভূত হয়েছে পরন্তপ। তার মস্তক আবৃত করে অবস্থান করছে বিরাট উষ্ণীষ এবং উষ্ণীষ-সংলগ্ন বস্ত্রের তলায় অদৃশ্য হয়েছে মুখের নিম্নভাগ। সমস্ত মুখের মধ্যে দৃষ্টিগোচর হয় রোমশ জ্বর নীচে একজোড়া জ্বলন্ত চক্ষু!

পরন্তপ আবার হাঁক দিল, এসব কি কাণ্ড? নিজেদের মধ্যে হানাহানি কেন?

একজন দস্যু সংক্ষেপে সমস্ত ঘটনা বিবৃত করল।

পরন্তপ জল্লাদের দিকে তাকিয়ে কঠোর স্বরে বলল, তোমার নিষ্ঠুর স্বভাবের জন্য অনেকবার তোমাকে আমি তিরস্কার করেছি, সাবধান করে দিয়েছি। তোমার হাতে দলের নেতৃত্ব দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারিনি, তাই ছুটে এসেছি। অনর্থক নিষ্ঠুরতা আর নির্যাতন বিশেষ করে নারী-নির্যাতন আমি পছন্দ করি না; আমার দলে এই ধরনের ঘটনা কখনই ঘটতে দেব না। জল্লাদ। তোমার মতো মানুষের স্থান আমার দলে হবে না- যাও! দূর হও!

আমার দিকে একটিমাত্র চক্ষের অগ্নিময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জল্লাদ বলল, কর্ণদেব! আজ তুমি বেঁচে গেলে! কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে। পরন্তপের অসি তোমাকে সর্বদা রক্ষা করতে পারবে না।

আমি অট্টহাস্য করে বললাম, অপরের অসির সাহায্যে যে আমার প্রয়োজন হয় না, একথা কি এখনও বুঝতে পারোনি? জল্লাদ! পুনরায় তোমার সাক্ষাৎলাভের জন্য আমিও উদগ্রীব হয়ে রইলাম।

বল্লভ! এই হল জল্লাদের সঙ্গে আমার কলহের পূর্ব-ইতিহাস! পাঁচটি গ্রাম্য তরুণের সঙ্গে আমার বিরোধের ঘটনা আপনাকে আগেই বলেছি। এখন জল্লাদের সঙ্গে আমার দ্বন্দ্বযুদ্ধের কাহিনিও শুনলেন। দুটি ঘটনা পরস্পর বিচ্ছিন্ন। কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে যোগসুত্র না থাকলেও ওই দুটি ঘটনার জন্যই আমার জীবন বিপন্ন হয়েছিল। প্রথম ঘটনার ফলে নহুষ শর্মার সঙ্গে আমার যে-ভাবে পরিচয় ঘটেছিল, তাতে পরবর্তীকালে সশস্ত্র সংঘর্ষে আমার অস্ত্রচালনায় দক্ষতার সংবাদ শুনলে তিনি আমার সম্পর্কে সন্দিগ্ধ হয়ে উঠতেন। তার ভয়ে বিচারালয়ে না গিয়ে নেকড়েবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যাপৃত হয়ে সমস্যার সমাধান করতে চাইলাম এবং তার ফলে জল্লাদের কবলে পড়লাম। আপনি না থাকলে আমার আজ রক্ষা ছিল না। পাষণ্ড জল্লাদ যে রাজধানীতেই আশ্রয় গ্রহণ করেছে সে কথা আমি জানতাম না।

বল্লভ বলল, ওর কিছু কিছু কুকীর্তির কথা আমার কানেও এসেছে। কিঞ্জলের সঙ্গে ওর সখ্য আছে। তবে ও নেকড়েবাহিনীর কেউ নয়।

কর্ণদেব বলল, জল্লাদ সাময়িকভাবে সমাজবিরোধী কয়েকটি দুৰ্বত্তের সাহায্য নিতে পারে বটে, কিন্তু বৃহৎ দল গঠন করে দস্যুবৃত্তি করা সম্ভব নয়।

-কেন?

-ওইরকম হিংস্র আর স্বার্থপর মানুষ বৃহৎ দল গঠন করতে পারে না। দলপতির চরিত্রে বহুবিধ গুণ থাকা প্রয়োজন। শুধু অসিচালনা করতে জানলে দলপতি হওয়া যায় না।

স্বীকার করছি, দস্যুদল এবং তাদের নায়ক সম্পর্কে আমার ধারণা নিতান্তই সীমাবদ্ধ। কিন্তু এই প্রসঙ্গ বন্ধ করে প্রয়োজনীয় কথা বলো- আমাকে তোমার প্রস্তাব জানাও।

-তাহলে ধরে নিতে পারি আমার ব্যক্তিগত পরিচয় আর ইতিহাস আপনার মনে ঘৃণার উদ্রেক করেনি?

আদৌ নয়। এখন আমি তোমার প্রস্তাব শুনতে চাই।

–তবে শুনুন। এই রাজ্যের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত বনভূমির মধ্যে শল্য নামে এক দস্যু-দলপতিকে বন্দি করেছে তার দলভুক্ত কয়েকজন দস্যু। শল্য আমাদের দলপতি পরন্তপের মতো অমিতব্যয়ী নয়। সে প্রভূত ধনসম্পদ সঞ্চয় করে লুকিয়ে রেখেছে এই রাজ্যের উত্তরাংশে অবস্থিত পর্বতবেষ্টিত অরণ্যের কোনো এক গোপন স্থানে। তার দলের দস্যুরা ওই অর্থ আত্মসাৎ করতে চায়। পরন্তপ চাইছে শল্যকে উদ্ধার করতে। শলোর মুখ থেকে ওই ধন-সম্পদের সন্ধান সে নিশ্চয়ই পাবে। তখন…।

বাধা দিয়ে বল্লভ বলল, শল্য যে পরন্তপকে ওই অর্থের সন্ধান দেবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? সে তো দলের লোককেই গুপ্ত ধনভাণ্ডারের সন্ধান বলে দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পারে।

কর্ণদেব হাসল, না। শল্য জানে তার দলের লোকেরা যখন বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তখন অর্থের সন্ধান পেলেও তাকে তারা জীবিত রাখবে না। কারণ, জীবিত থাকলে শল্য পরবর্তীকালে প্রতিহিংসা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু পরন্তপ যদি শল্যকে মৃত্যুর মুখ থেকে উদ্ধার করতে পারে, তবে কৃতজ্ঞ শল্য তাকে সম্পদের অর্ধেক দিতে আপত্তি করবে না।

–আমার ধারণা অন্যরকম। শল্য জানে ধন-রত্নের সন্ধান পেলেই তার দলভুক্ত দস্যুরা তাকে হত্যা করবে। পরন্তপও যে তার গুপ্তধনের সন্ধান পেলে তাকে হত্যা করবে না একথা শল্য কেন বিশ্বাস করবে? আমি নিজেও মনে করি অর্থের সন্ধান পেলে পরন্তপ কে হত্যা করে সমস্ত অর্থ আত্মসাৎ করতে সচেষ্ট হবে।

আপনি সেকথা মনে করলেও শল্য নিশ্চয়ই পরন্তপের কথা বিশ্বাস করবে। দস্যুমহলে সকলেই জানে পরন্তপ কখনো বিশ্বাসভঙ্গ করে না। শল্য একসময়ে পরন্তপের অধীনে দস্যুবৃত্তি করেছে, অতএব পরন্তপের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ অবহিত। প্রাণরক্ষার প্রতিশ্রুতি পেলে শল্য নিশ্চয়ই পরন্তপকে সম্পদের অর্ধাংশ ছেড়ে দিতে সম্মত হবে। সর্বনাশ উপস্থিত হলে বুদ্ধিমান ব্যক্তি অর্ধাংশ ত্যাগ করে থাকেন। শল্য নির্বোধ নয়।

-কর্ণদেব! পরন্তপ সম্পর্কে তোমার উচ্চ ধারণা থাকতে পারে, কিন্তু আমি বলব এই দস্যু অতিশয় অর্থলোলুপ। সে বহুকাল ধরে দস্যুবৃত্তি করছে। তার কাছে নিশ্চয়ই যথেষ্ট ধনরত্ন সঞ্চিত আছে। তার মাথার উপর এখন বিপদের খঙ্গ রাজদরবার থেকে তাকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। এখন যে কোনো দিনই দেবরাজ বাসবের রোষে ললাটে বা বক্ষে শায়কচিহ্ন নিয়ে তার মৃত্যু ঘটতে পারে। রুদ্রদমনের রাজ্যে এই ঘটনাই ঘটেছে বারংবার। এমন অবস্থায় তার যথাসম্ভব শীঘ্র এই রাজ্য ত্যাগ করা উচিত। তা না করে সে আরও অর্থ সংগ্রহ করতে সচেষ্ট। এই ব্যক্তিকে অতিশয় অর্থগৃধু মনে করাই স্বাভাবিক নয় কি?

-না। পরন্তপ কখনো সঞ্চয় করে না। হাতে বেশ কিছু অর্থ এলেই সে কৌশাম্বী, উজ্জয়িনী, কৌশল প্রভৃতি রাজ্যে গিয়ে বিলাস ব্যসনে দিন অতিবাহিত করে। সে অতিশয় মূল্যবান বসনভূষণ ব্যবহার করতে ভালোবাসে। কিন্তু এই রাজ্যে মহার্ঘ্য বসন-ভূষণে সজ্জিত হলে গুপ্তচরের দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে বলে সে শ্রাবন্তী রাজ্যে খুব সাধারণ অবস্থায় দিন যাপন করে। অন্য রাজ্যে ইচ্ছামতো অর্থব্যয় করে বিলাসী ব্যক্তির ন্যায় দিন যাপন করলেও পরদেশী ধনীর প্রতি কেউ সন্দেহ প্রকাশ করে না। সঞ্চিত সম্পদ যখন শেষ হয়ে আসে, তখনই সে আবার দস্যুবৃত্তি করতে উদ্যোগী হয়। এখন যে তার জীবন বিপন্ন, সে বিষয়ে সে সম্পূর্ণ সচেতন। তাই শল্যের ধনভাণ্ডার থেকে বেশ কিছু ধনরত্ন হস্তগত করে সে দেশত্যাগের সঙ্কল্প করেছে। আমাকে সে যথেষ্ট অর্থ দিয়ে যাবে। ওই অর্থ পেলে নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে আমি বাকি জীবনটা সৎভাবে কাটিয়ে দিতে পারব। আমি পরন্তপের সঙ্গ ত্যাগ করতে চাইনি, কিন্তু সে বলেছে তার সাহচর্য আর আমার পক্ষে নিরাপদ নয়। তার সনির্বন্ধ অনুরোধে আমি সাময়িকভাবে তার সাহচর্য ত্যাগ করে এই রাজ্যে বসবাস করতে সম্মত হয়েছি। পরন্তপ একথাও জানিয়েছে যে, ভবিষ্যতে সে দুস্যবৃত্তি ত্যাগ করে ভালোভাবে জীবন যাপন করতে চায়। গুপ্তধনের কিয়দংশ তার হস্তগত হলে সে ভিন্ন রাজ্যে গিয়ে ওই অর্থ দিয়ে ব্যবসাবাণিজ্য শুরু করবে। কিংবা হয়তো অপর রাজ্যে রাজসেনা দলে যোগ দিতে পারে। যে-কোনো রাজ্যের সেনাবাহিনী তার মতো নিপুণ শস্ত্রবিদকে সাদরে গ্রহণ করবে। তবে আমার মনে হয় পরন্তপের ন্যায় স্বাধীনচেতা ব্যক্তির পক্ষে সৈন্যদলের শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন মেনে নেওয়া সম্ভব হবে না। বোধহয় শেষ পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্যেই সে আত্মনিয়াগ করবে।

বল্লভ বলল, সাধু সঙ্কল্প। কিন্তু এইসব ব্যাপারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কোথায়?

-বলছি। শল্যকে যারা বন্দি করেছে সেই দস্যুদল সংখ্যায় দশ-বারো জন হবে। পরন্তপ একদল অনুচর নিয়ে তাদের হাত থেকে শল্যকে ছিনিয়ে আনতে পারে বটে, কিন্তু তাহলে ঐ অনুচরদের মধ্যে সমস্ত সম্পদ বণ্টন করতে হবে। অতগুলি লোকের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হলে ব্যক্তিগত অর্থের পরিমাণ কমে যাবে। অল্প কয়েকজনের মধ্যে ভাগ হলে প্রত্যেকই অধিক পরিমাণে ধনরত্ন হস্তগত করতে পারবে। তাছাড়া, শল্যকে উদ্ধার করলেই সমস্যার শেষ হল না। আরও সমস্যা আছে। শল্যের ধনভাণ্ডার যেখানে লুকানো আছে, সেই স্থানটি ভীষ্মক নামক অনার্য জাতির রাজ্যের অন্তর্গত। ভীষ্মক জাতির রাজা মূলক আমাদের রাজা রুদ্রদমনের অন্তরঙ্গ বান্ধব। বল্লভ! তুমি জানো এই রাজ্যের সকল সীমানাতেই অবস্থান করছে দুর্ধর্য সীমান্তরক্ষীর দল। কিন্তু উত্তরের কোশাম্বী ও রুদ্রদমনের রাজ্য শ্রাবন্তীর মাঝখানে সীমান্তরক্ষীর অস্তিত্ব নেই। কারণ, অনার্যরাজ মূলকের অধীনে দুরন্ত ভীষ্মক জাতি ওই সীমান্ত অঞ্চল পাহারা দেয়। তাদের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে দুই-চারজন সতর্ক মানুষ কোনোক্রমে ওই অঞ্চল দিয়ে যাতায়াত করতে পারে; কিন্তু অধিকসংখ্যক মানুষের পক্ষে অনার্য প্রহরীদের ফাঁকি দিয়ে ওই এলাকায় চলাফেরা করা অসম্ভব। সেই জন্যই পরন্তপ চাইছে তিনটি দুর্ধর্ষ মানুষ যাদের বিশ্বাস করা যায়। আমাকে বাদ দিলে আরও দুটি মানুষের প্রয়োজন। অনেক চিন্তা করে পরন্তপ স্থির করেছে মল্লবীর জয়দ্রথ আর তীরন্দাজ শায়নই হবে আমাদের উপযুক্ত সঙ্গী। এরা দুজনেই শ্রাবন্তী রাজ্যে অল্পবিস্তর খ্যাতিলাভ করেছে। জয়দ্রথের দৈহিক শক্তি প্রচণ্ড; শায়ন অসি ও ধনুবিদ্যায় সিদ্ধহস্ত। আপনি আমাদের সঙ্গে যোগ দিলে জয়দ্রথকে আর প্রয়োজন হবে না। বাকি রইল শায়ন। গতকাল শায়নের গৃহে তার দ্বার বাহির থেকে অর্গলবদ্ধ দেখে এসেছি। শুনেছি দূরে কোথাও গেলে তার গৃহদ্বারে লিখিত লিপি থেকে সন্ধান পাওয়া যায় কিন্তু শায়নের গৃহদ্বারে কাল কোনোও লিপি আমার চোখে পড়েনি। তাই রাত্রি প্রভাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি তার গৃহে গমন করব। আশা করছি—

-আশা করছ তাকে পাবে? হ্যাঁ, আমারও মনে হয় প্রত্যূষে গেলে তার সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে। শায়নের খ্যাতি আমারও কানে এসেছে। নিকটে বা দুরে অরণ্যসন্নিহিত কোনো গ্রামে যদি নরখাদক শ্বাপদের আর্বিভাব হয়, অথবা মদমত্ত হস্তী বা বন্য মহিষ যদি উপদ্রব করতে থাকে– তবে সেই অঞ্চলের মানুষ অর্থের বিনিময়ে শায়নের সাহায্য নেয়। সে অত্যন্ত সাহসী ও অস্ত্রচালনায় নিপুণ। বিশেষত ধনুর্বাণে তার লক্ষ্যভেদের ক্ষমতা নাকি বিস্ময়কর।… হ্যাঁ, এই অভিযানের পক্ষে শায়ন উপযুক্ত সঙ্গী বটে। কিন্তু সে কি দস্যুদের হাতে হাত মিলাতে রাজি হবে?

কর্ণদেব ঈষৎ চিন্তিতভাবে বলল, জানি না। তবে আমরা তো তাকে দুস্যবৃত্তি করতে বলছি না। এই ধরনের মানুষ তীব্র উত্তেজনার মধ্যে দিনযাপন করতে ভালোবাসে। তাই মনে হয় সে রাজি হতেও পারে। কিন্তু বল্লভ, আপনি কি আমাদের দলে যোগ দিতে সম্মত?

–হ্যাঁ। একটি মানুষকে মৃত্যুর মুখ থেকে উদ্ধার করে যদি সারাজীবন নিশ্চিন্তে বসে থাকার মতো পর্যাপ্ত অর্থ পাই, তাহলে আপত্তি করব কেন? অর্থের পরিমাণ তো যথেষ্ট হবে বলেই মনে হয়।

–নিশ্চয়! সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন। দস্যুদের অভিযানের ফলে যে অর্থ পাওয়া যায়, সেই লুণ্ঠিত সম্পদের অর্ধেক গ্রহণ করে পরন্তপ স্বয়ং, বাকি অর্ধেক সমভাবে বণ্টন করা হয় লুণ্ঠনে যোগদানকারী দুস্যদের মধ্যে। কিন্তু শল্যের ধনভাণ্ডার থেকে যে ধন আমদের হাতে আসবে, তা সমান চারভাগে বিভক্ত হবে। বলুন আপনার আর কিছু জানার আছে?

—আর একটি কথা জানতে চাই। কবে যাত্রা করতে হবে?

–দুই-চার দিনের মধ্যেই। শল্যের উপর বিদ্রোহী দুস্যরা অত্যাচার শুরু করেছে। অত্যাচারের মাত্রা বর্ধিত হলে হয় সে মারা পড়বে, নয়তো ধনভাণ্ডারের সন্ধান জানিয়ে দিতে বাধ্য হবে। অতএব যা কিছু করার তা সত্বর করতে হবে। তবে চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী আমি নই। আগামীকাল সন্ধ্যার প্রাক্কালে পরন্তপের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ হবে; সেখানেই সে আপনার সম্বন্ধে তার মতামত আপনাকেই জানিয়ে দেবে।

বল্লভের ভ্রূকুঞ্চিত হল, ওঃ! তা কোথায় দেখা হবে? তুমি এসে আমাকে যথাস্থানে নিয়ে যাবে তো?

কর্ণদেব বলল, না। এই নগরীর উত্তরদিকে অরণ্য যেখানে শুরু হয়েছে, সেই অরণ্য ও জনপদের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে একটি পুরাতন বটবৃক্ষ। জনশ্রুতি আছে, বিশাল ওই বৃক্ষের ছায়ায় নাকি পঞ্চপাণ্ডব অজ্ঞাতবাসের সময়ে কিয়ৎকাল বিশ্রাম করেছিলেন। সেই বট বক্ষের

বল্লভ বলে উঠল, জানি শ্রাবন্তীর রাজধানী ও নিকটবর্তী গ্রামের সকল বাসিন্দাই ওই বৃক্ষ সম্পর্কে অবহিত। ওই বটবৃক্ষের তলায় আগামী কাল সায়াহ্নে পরন্তপ আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে?

-যদি আপনার আপত্তি না থাকে।

–তুমিও থাকবে তো?

নিশ্চয়ই। আপনারা পরস্পরের অপরিচিত, আমি না থাকলে চলবে কেন? বল্লভ! ওই দেখুন, বাতায়নপথে পূর্বাকাশে ঊষার আভাস দেখা যায়। আমি এখনই শায়নের গৃহ অভিমুখে যাত্রা করব। বিলম্ব হলে তাকে পাব না।… এটা ধরুন। এই অর্থ দিয়ে কুসীদজীবী উত্তানপাদের কবল থেকে আপনার বসতবাটী উদ্ধার করুন।

-কিন্তু শেষ পর্যন্ত যদি এই অভিযানে না যাই? যদি পরন্তপের বিচারে আমি অযোগ্য প্রতিপন্ন হই? তা হলে? এই অর্থ তা হলে কবে এবং কখন তোমাকে প্রত্যার্পণ করতে হবে?

–পরন্তপের বিচারে আপনার অমনোনীত হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। তবু সেরকম ঘটনা যদি ঘটে, তা হলেও আপনার চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমি আপনাকে ঋণস্বরূপ এই অর্থ দিলাম। যখন পারবেন, যতদিনে পারবেন, ঋণশোধ করবেন। এ বিষয়ে কোনো শর্ত রইল না।

কর্ণদেব! পৃথিবীতে তোমার মতো মানুষও আছে, আবার কুসীদজীবী উত্তানপাদের মতো মানুষও আছে!

-বল্লভ! অনুমতি করুন, এবার বিদায় গ্রহণ করি। একটু দাঁড়াও, বল্লভ এগিয়ে এসে কর্ণদেবের দুই কাঁধে হাত রেখে তার মুখের উপর দৃষ্টি স্থাপম করল, কর্ণদেব! ক্রোধের বশে আমাকে তুমি সম্বোধন করেছিলে, স্নেহের বশে কি ওই সম্বোধনে ফিরে যাওয়া যায় না?

বল্লভ!আবেগরুদ্ধ স্বরে কর্ণদেব বলল, পিতামাতার মৃত্যুর পর একটি দুর্ধর্ষ মানুষ আমাকে ভালবেসেছে, কিন্তু আর কেউ আমার প্রতি এতটুকু স্নেহ বা সহানুভূতি প্রদর্শন করেনি। তুমি আমার প্রাণ রক্ষা করেছ একথা আমি কোনোদিনই ভুলব না। আজ থেকে তোমাকে আমি জ্যেষ্ঠভ্রাতার মতোই মনে করব।

কর্ণদেব!আ স্বরে বলল, মতো কেন, আজ হতে আমি সত্যই তোমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা হলাম। আচ্ছা ভাই এস। কাল সন্ধ্যায় দেখা হবে।

–নিশ্চয়।

.

১১. অসি ও শায়ক

বল্লভের গৃহ থেকে বহির্গত হয়ে কর্ণদেব যখন রাজপথে পদার্পণ করল নগরী তখনও নিদ্রামগ্ন। অন্ধকারকে বিতাড়িত করে পৃথিবীর বুকে আলোর আবির্ভাব ঘটেছে বটে, কিন্তু অধিকাংশ নাগরিকই এখনও শয্যা ত্যাগ করেনি। পথের ধারে কয়েকটি গৃহ থেকে শিশুর ক্রন্দন ও নারী-পুরুষের কণ্ঠস্বর কর্ণদেবের শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করল, কৃচিৎ দুই একটি পথিকের দেখাও সে পেল কিন্তু জনজীবনের কোলাহলে কর্মব্যস্ত রাজধানীর জাগরণের যে বেশ বিলম্ব আছে, সে কথা সহজেই বুঝল কর্ণদেব।

নির্দিষ্ট লক্ষ্য অভিমুখে সবেগে পদচালনা করতে করতে পথের দুইদিকে দৃষ্টিকে সঞ্চালিত করে কর্ণদেব দেখল রাজধানীর মধ্যস্থলে অবস্থিত প্রস্তর ও কাষ্ঠ-সংযোগে নির্মিত বৃহৎ অট্টালিকার প্রাচুর্য এই অঞ্চলে নেই। ছোটো ছোটো কাঠের বাড়ির সংখ্যাই বেশি। মাঝে মাঝে দই-একটি পাষাণ-গহ চোখে পড়লেও তাদের সংখ্যা নগণ্য। এই দিক দিয়ে কর্ণদেব নগরে প্রবেশ করেনি, তবু তার মনে হল নগরীর উপকণ্ঠে যেদিক থেকে সে রাজধানীতে প্রবেশ করেছিল, সেখানকার ঘরবাড়ির চেহারাও এই ধরনের। তখনও পর্যন্ত রাজধানীর মধ্যস্থলে বিরাজমান সুবৃহৎ অট্টালিকা ও স্নানাগারসমূহ তার চোখে পড়েনি। এখন সে বুঝল রাজধানীর মধ্যভাগে আশ্রয় গ্রহণ করেছে ধনী ও উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়, উপকণ্ঠে বাস করে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষ। আরও কিছুদূর এগিয়ে যেতেই তার চোখে পড়ল শ্যামল প্রান্তর ও বৃক্ষের আধিক্য কাষ্ঠনির্মিত গৃহের পরিবর্তে দেখা দিল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পর্ণকুটির। কর্ণদেব জানে, এখানে বাস করে অতি দরিদ্র কিছু শ্রমজীবী অথবা অত্যন্ত স্বাধীনচেতা শবরশ্রেণির কয়েকজন মানুষ যারা শবরপল্লীর নিয়ম ও সামাজিক বিধি মেনে নেয়নি, কিন্তু মৃগয়ালব্ধ পশুমাংস ও চর্ম বিক্রয় করে জীবিকা নির্বাহ করে।

এখান থেকেই শুরু হয়েছে অরণ্যের রাজত্ব। বনপথ ধরে এগিয়ে চলল কর্ণদেব। বল্লভের নির্দেশ অনুসারে আরও একটু অগ্রসর হতেই পূর্ব-পরিচিত পথের দেখা পেল সে। কর্ণদেব উল্লসিত হয়ে উঠল– আর বেশিদূর নয়, শায়নের গৃহের নিকটেই সে এসে পড়েছে দ্বিগুণ বেগে পা চার্লিয়ে দিল সে।

আচম্বিতে চাবুকের মতো কি একটা বস্তু তার দেহের উপর আছড়ে পড়ল, পরক্ষণেই প্রবল আকর্ষণে মাটির উপর ছিটকে পড়ল কর্ণদেব সঙ্গে সঙ্গে তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করল এক প্রচণ্ড অট্টহাস্য!

আঘাতের বেগ সামলে কর্ণদেব দেখল, তার দুই হাতকে দেহের সঙ্গে আবদ্ধ করে অবস্থান করছে একটি দড়ির ফাঁস!

কোনোমতে উঠে বসে সে দেখল অদূরবর্তী একটি ঝোপের আড়াল থেকে হাসিমুখে আত্মপ্রকাশ করল জল্লাদ! তার সঙ্গে আরও দুটি অপরিচিত মানুষের সাক্ষাৎ পেল কৰ্ণদেব। অপরিচিত দুই ব্যক্তির মধ্যে একজনের হাতে ছিল দড়ির ফাঁসের অপর প্রান্ত।

উপবিষ্ট কর্ণদেবের সামনে এসে কটিতে দুই হাত স্থাপন করে জল্লাদ হাসিমুখে বলল, কর্ণদেব! খুব আশ্চর্য হয়ে গেছ, তাই না?

কর্ণদেব উত্তর দিল না। জল্লাদ হৃষ্টস্বরে বলতে লাগল, কাল আমার অনুচর দুটি তোমাকে অলক্ষ্যে অনুসরণ করেছিল। বল্লভের গৃহে প্রবেশ করতেই আমাকে একজন যথাস্থানে গিয়ে তোমার সংবাদ দিয়েছে, অপর ব্যক্তি পাহারা দিয়েছে সারারাত ধরে। সংবাদ পেয়ে আমি বল্লভের গৃহের নিকটে উপস্থিত হলাম। প্রত্যূষে তুমি গৃহত্যাগ করে পথে বহির্গত হতেই অলক্ষ্যে তোমাকে অনুসরণ করলাম। এই পথে সকাল-সন্ধ্যায় আমি প্রায়ই শিকারের সন্ধানে অপেক্ষা করি। পথচলতি দলছাড়া পথিকের অর্থ গ্রহণ করে তার মৃতদেহ মাটিচাপা দিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিই। তোমার আশেপাশে এমন অনেক হতভাগ্য মানুষের দেহই মাটির তলায় লুকিয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তোমার শরীরটাও ছিন্নভিন্ন হয়ে মাটির তলায় আত্মগোপন করবে। কর্ণদেব! তুমি নীরব কেন? একবার নতজানু হয়ে প্রাণভিক্ষা চাও, হয়তো আমি তোমায় ক্ষমা করতে পারি।

কর্ণদেবের ওষ্ঠাধরে ফুটল হাসির রেখা। সে কথা বলল না। জল্লাদ বলল, এত ভোরে এই পথে লোকসমাগম হয় না। মধ্যাহ্নের কিছু পূর্বে লোক চলাচল শুরু হয়, সন্ধ্যার প্রাক্কালে আবার পথিকের সংখ্যা বিরল হয়ে পড়ে। অতএব, হঠাৎ মানুষজন এসে পড়ে তোমার প্রাণরক্ষা করবে এমন সম্ভাবনাও নেই। তোমার মতো দুই-একজন পথিক অবশ্য কখনো কখনো অসময়ে এই পথে ভ্রমণ করে তবে দৈবাৎ সেরকম কোনো পথিকের আবির্ভাব ঘটলেও তোমার প্রাণরক্ষার আশা নেই;- তোমার সঙ্গে সেই পথিকও যমালয়ে প্রেরিত হবে।… কর্ণদেব! তুমি নীরব যে!.. নতজানু হয়ে প্রাণভিক্ষা করো, হয়তো তোমাকে ছেড়ে দিতেও পারি।… এখনও নীরব! তোমার মৃত্যু দেখছি অনিবার্য… আচ্ছা! প্রথমে তোমার একটি চক্ষুকে উৎপাটিত করব, দেখি, তোমার কণ্ঠ কেমন নীরব থাকে—

জল্লাদ এগিয়ে আসতেই তার এক সঙ্গী বাধা দিয়ে বলল, জল্লাদ! অধিক বিলম্ব করা বিপজ্জনক। অনেক সময় ধনুর্বাণধারী শবরগণ দলবদ্ধ হয়ে মৃগয়াল মাংস বিক্রয় করার জন্য এই পথে প্রত্যূষেই নগরীতে প্রবেশ করে- দৈবাৎ তাদের একটি দল যদি এসে পড়ে তাহলে এই ব্যক্তিকে ফেলে পলায়ন করতে আমরা বাধ্য হব।

জল্লাদ ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে তার সঙ্গীর দিকে ফিরল, মূঢ়! তুই চুপ কর। যদি ভীত হয়ে থাকিস, তবে স্থানান্তরে গমন কর।

অপর সঙ্গীটি বলে উঠল, এই কিশোরের কাছে মহামূল্য রত্ন ও স্বর্ণমুদ্রা আছে। কাল রাত্রে কুসীদজীবী উত্তানপাদকে এই কিশোর একটি রত্ন দেখিয়েছে। ওর সঙ্গে ওই কুসীদজীবীর কথাবার্তা শুনে বুঝেছি এর কাছে প্রচুর স্বর্ণমুদ্রাও আছে। জল্লাদ! সেসব কথা তোমাকে বলেছি। এখন যদি একে হত্যা করতে চাও, তবে সত্বর সেই কার্য সমাপ্ত করো। এই কিশোরের মৃতদেহ মৃত্তিকার গর্ভে স্থাপন করে ওর ধনরত্ন নিয়ে আমাদের যথাসম্ভব শীঘ্র এই স্থান পরিত্যাগ করা উচিত। বিলম্বে সত্যই বিপদ ঘটতে পারে।

জল্লাদ তার দুই সঙ্গীর মুখের দিকে একবার তাকাল, তারপর বলল, তবে আগে দেখি এর বস্ত্রের মধ্যে কত স্বর্ণমুদ্রা আর কোন্ মহামূল্য রত্ন লুক্কায়িত আছে।

সে নত হয়ে কর্ণদেবের আঙরাখার ভিতর হাত দেওয়ার উপক্রম করল। তৎক্ষণাৎ হাত বাঁধা অবস্থাতেই মাটির উপর শুয়ে পড়ল কর্ণদেব এবং সজোরে পদাঘাত করল জল্লাদের পায়ে। অতর্কিত আঘাতে ভারসাম্য হারিয়ে জল্লাদ ভূমিশয্যায় ছিটকে পড়ল সশব্দে! যে ব্যক্তি বন্ধনরঙ্কু ধরে দাঁড়িয়েছিল, সে সজোরে দড়িতে টান মারল– দড়ির ফাঁস আরও শক্ত হয়ে কর্ণদেবের দুই হাত চেপে ধরল দেহের সঙ্গে।

সগর্জনে উঠে দাঁড়িয়ে জল্লাদ অসি কোষমুক্ত করল, পামর! আগে তোক হত্যা করব। তারপর তোর সর্বস্ব গ্রহণ করব।

প্রভাত সূর্যের আলোতে ঝকমক জ্বলে উঠল শূন্যে আন্দোলিত তরবারি নিজের অজ্ঞাতসারেই দুই চোখ মুদে ফেলল কর্ণদেব। কিন্তু দেহের উপর অস্ত্রাঘাতের যাতনা অনুভব করার পরিবর্তে তার শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করল জল্লাদের কাতর আর্তনাদ এবং কঠিন মাটির উপর তরবারির ঝনৎকার শব্দ!

সচমকে দুই চোখ খুলে সে আশ্চর্য হয়ে দেখল জল্লাদের দক্ষিণ বাহু ভেদ করে থর থর কাঁপছে একটি তীর, আর বাঁ হাত দিয়ে আহত ডান হাত চেপে ধরে আর্তনাদ করছে জল্লাদ।

জল্লাদ ও তার দুই সঙ্গীর ভীত দৃষ্টি অনুসরণ করে কর্ণদেব দেখল একটু দূরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে ধনুর্বাণধারী এক ব্যক্তি। প্রথম তীরে জল্লাদকে বিদ্ধ করেই সে আর একটি তীর ধনুকে লাগিয়ে নিয়েছে। আগন্তুক শুধু ধনুর্বাণধারী নয়, তার কটিদেশে রয়েছে সুদীর্ঘ তরবারি।

আগন্তুকের মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল কর্ণদেব– এই ব্যক্তি তো তার অপরিচিত নয়! রাজধানীর বিপণিতে প্রথমেই যে লোকটির সঙ্গে তার অসি নিয়ে কলহ হয়, এ সেই লোক।

আগন্তুক এগিয়ে এসে কর্ণদেবের মুখের দিকে তাকিয়ে সবিস্ময়ে বলে উঠল, আরে! তুমি!… তোমাকে দেখছি ভারি বিপদে ফেলে দিয়েছে এরা!

জল্লাদ তার একটিমাত্র চক্ষুর জ্বলন্ত দৃষ্টি আগন্তুকের উপর নিক্ষেপ করে বলল, আমাদের ব্যক্তিগত কলহে তুমি হস্তক্ষেপ করছ কেন?

আগন্তুক সহাস্যে বলল, একজনকে দড়ির ফঁসে বন্দি করে যখন আততায়ী তাকে বধ করতে উদ্যত হয়, তখন সেটাকে আর ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে আমি উপেক্ষা করতে পারি না। ওটা হত্যাকাণ্ড! আর, চোখের সামনে হত্যাকাণ্ড ঘটার উপক্রম হলে আমি সাধ্যমতো বাধা দিয়ে থাকি।

ক্ষতমুখ থেকে সবলে তীরটিকে উৎপাটিত করল জল্লাদ। ফিনকি দিয়ে তপ্ত রক্তধারা ছুটে এসে তার সর্বাঙ্গ সিক্ত করে দিল। সেদিকে ক্রুক্ষেপ না করে জল্লাদ বলল, শোনো! এই কিশোরের কাছে প্রচুর ধনসম্পদ আছে। এসো! ওকে হত্যা করে ওই সম্পদ আমরা ভাগ করে নিই।

আগন্তুকের চোখে এক মুহূর্তের জন্য ক্রোধের আগুন দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেল, সে তরল স্বরে বলল, আমি তোমাদের মতো পরস্ব অপহারক দস্যু নই। তাহলে ব্যক্তিগত কলহ নয়– দস্যুবৃত্তি!

এতক্ষণে মৌনব্রত ভঙ্গ করে কথা বলল কৰ্ণদেব, না, নিছক দস্যুবৃত্তি নয়। ওই এক চক্ষুবিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে আমার পূর্বশত্রুতা ছিল। আমি এই পথে ভ্রমণ করছিলাম, অকস্মাৎ অন্তরাল থেকে দড়ির ফাঁসি নিক্ষেপ করে ওরা আমাকে বন্দি করেছে। তারপর যা ঘটেছে, তা তোমার অজ্ঞাত নয়।

শ্লেষতিক্ত স্বরে আগন্তুক বলল, এই বালককে হত্যা করতে তোমরা তিনজনেও অপারগ! তাই অতর্কিতে তাকে রজ্জতে আবদ্ধ করে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলে?

কেউ উত্তর দিল না।

আগন্তুক আবার বলল, আমি অবশ্য অসিচালনায় এই কিশোরের নৈপুণ্য দেখেছি, কিন্তু রক্তধারায় সেই দক্ষতার পরীক্ষা হয়নি। এইবার দেখব যুদ্ধে এই কিশোরের পারদর্শিতা কেমন।

আততায়ী দড়ির প্রান্ত ছেড়ে দিলেও কর্ণদেবের দুই হাত আর দেহকে বেষ্টন করে তখনও অবস্থান করছিল নাগপাশের মতো দড়ির ফাস।

আচম্বিতে জাগল ধনুকের টঙ্কারধ্বনি- জ্যামুক্ত শর সবেগে কর্ণদেবের ডান হাতের উপরিভাগে বন্ধনরকে দংশন করে ভূমিতে বিদ্ধ হল। সকলে সবিস্ময়ে দেখল শাণিত তিরের ফলা হাত ঘেঁষে দড়ির বাঁধন কেটে দিয়েছে, কিন্তু কর্ণদেবের হাত সম্পূর্ণ অক্ষত! ধনুর্বিদ্যার এমন আশ্চর্য উদারহণ দেখে সকলেই স্তম্ভিত হয়ে গেল!

নীরবতা ভঙ্গ করে জাগল আগন্তুকের কণ্ঠস্বর, কিশোর! তুমি বন্ধন-মুক্ত। কাল বিপণিতে যে অসি লাভ করেছে, সেই অসির ধার পরীক্ষা করার সময় উপস্থিত।

মুহূর্তের মধ্যে খাপ থেকে তলোয়ার টেনে নিয়ে কর্ণদেব গর্জে উঠল, জল্লাদ! অসি গ্রহণ করো। এইবার দেখব তোমার বীরত্ব।

জল্লাদ বলল, আমার দক্ষিণ বাহু বাণাঘাতে বিদীর্ণ। আমি এখন অসি ধারণে অসমর্থ।

কর্ণদেব বলল, সেজন্য আমি দায়ী নই। যাই হোক, তোমার বামবাহু অক্ষত, ওই হাতেই অসি নিয়ে আমার সম্মুখীন হও। আমিও বামহস্তে তরবারি ধারণ করছি।

জল্লাদ বিপন্ন হয়ে বলল, আমি তোমার মতো দুই হাতে তরবারি চালনায় অভ্যস্ত হইনি।

আগন্তুক ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, কিন্তু গুপ্তঘাতকের ন্যায় অতর্কিতে নরহত্যা করতে অভ্যস্ত হয়েছ। এই কিশোর তোমাকে যথেষ্ট সুযোগ দিয়েছে। এখনই যদি তরবারি নিয়ে তুমি দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ না হও, তবে আমার বাণ তোমার বাহু ছেড়ে বক্ষে বিদ্ধ হবে।

নিরুপায় জল্লাদ বাঁ হাতে কোষ থেকে অসি আকষর্ণ করল।

কর্ণদেব বলল, জল্লাদ। প্রস্তুত হও, এই আমি আক্রমণ করলাম।

অপটু বামহস্তে তরবারি তুলে জল্লাদ আত্মরক্ষার চেষ্টা করল। অসির সঙ্গে অসির সংঘাতে কয়েকবার ঝনৎকার শব্দ উঠল, তারপরই কর্ণদেবের তরবারি আমূল বিদ্ধ হল জল্লাদের বক্ষে।

রক্তাক্ত তরবারির শূন্যে নাচিয়ে জল্লাদের দুই সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে কর্ণদেব আগন্তুককে উদ্দেশ্য করে বলল, এই দুই দস্যুকে নিয়ে কি করা যায়?

দুর্বৃত্তদের দিকে ধনুর্বাণের নিশানা উদ্যত রেখে দাঁড়িয়েছিল আগন্তুক, কর্ণদেবের প্রশ্নের উত্তরে বলল, এরা পরস্ব-অপহারক দস্যু।নরহত্যায় এদের দ্বিধা নেই কিছুমাত্র। সুযোগ পেলেই এরা তোমাকে হত্যা করত।

জানি, কর্ণদেব বলল, এদের অসিযুদ্ধে হত্যা করতে আমার বিশেষ অসুবিধা হবে না। তবে, হাতে সময় নেই– অতএব এদের মুক্তি দেওয়াই ভালো।

আগন্তুক হাসল, কিশোর! ঋণ, অগ্নি আর শত্রুর শেষ রাখতে নেই। তাছাড়া তোমার অসিচালনায় নৈপুণ্য আমি ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারলাম না। জল্লাদ নামে যে দুর্বত্তকে তুমি এখনই হত্যা করলে, সে বামহস্তে অসি চালনা করতে অভ্যস্ত ছিল না– তবে তোমার রণকৌশল দেখে বুঝলাম তুমি বামহস্তে অসিচালনায় অভ্যস্ত। অপটু শত্রুকে তুমি হত্যা করেছ অতি সহজেই। অতএব ওই যুদ্ধে তোমার ক্ষমতার যথার্থ পরীক্ষা হয়নি। এই দুই দুৰ্বত্তের সঙ্গে একে একে উপর্যুপরি যুদ্ধ করে যদি জয় লাভ করতে পারো, তবে বুঝব তোমার ক্ষমতা আছে।

কর্ণদেব বলল, আমার ক্ষমতার পরিচয় দেওয়ার জন্য নরহত্যা করতে হবে?

আগন্তুক বলল, এদের আমি মানুষ বলেই গণ্য করি না। এরা নরখাদক হিংস্র শ্বাপদের মতো বধ্য। তবে তুমি যদি ভীত হয়ে থাকো, সে কথা স্বতন্ত্র।

কর্ণদেব বলল, আমি ভীত নই। এরা নিষ্ঠুরতায় অভ্যস্ত নির্বোধ দস্যু। অসি চালনার সূক্ষ্ম কলাকৌশল এরা কখনো শিক্ষা করেনি। এদের হত্যা করতে কতক্ষণ?… তবে হ্যাঁ, ভবিষ্যতে এরা আমার শত্রুতাচারণ করতে পারে বটে। তোমার সতর্কবাণী অগ্রাহ্য করা অনুচিত।

জল্লাদের দুই সঙ্গীকে উদ্দেশ্য করে কর্ণদেব বলল, আমি তোমাদের হত্যা করব। তোমরা মিলিতভাবে আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো- দেখ, যদি বাঁচতে পারো।

বামহস্তে ছুরিকা আর দক্ষিণ হস্তে তরবারি নিয়ে এগিয়ে গেল কৰ্ণদেব। অপর পক্ষে দুই দুর্বৃত্ত কটি থেকে তরবারি টেনে নিয়ে প্রস্তুত হল যুদ্ধের জন্য।

ধনুর্বাণধারী আগন্তুক হাঁক দিল, দুই-এর বিরুদ্ধে এক!… চমৎকার! কিশোর! নিজের ক্ষমতার উপর তোমার যথেষ্ট বিশ্বাস আছে দেখছি। আশা করি তোমার এই সাহস বৃথা দুঃসাহস বলে প্রমাণিত হবে না।

তীব্র ধাতব শব্দে ঝংকার তুলে তিনটি তরবারি মিলিত হল, পরক্ষণেই বিদ্যুৎ ঝলকের ন্যায় কিশোরের বাঁ হাতের ছুরি একটি শত্রুর রক্তপান করতে পিছিয়ে এসে আর্তনাদ করে আহত দস্যু বারেক নিজের ক্ষতস্থান দর্শন করে বেপরোয়া আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ততক্ষণে কর্ণদেবের তরবারি অপর দুর্বত্তের স্কন্ধদেশে দংশন করেছে নিষ্ঠুর পুলকে।

দুই দস্যুই বুঝলে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বয়সে নবীন হলেও অসিচালনায় সাতিশয় দক্ষ। তারা প্রাণপণে যুদ্ধ করতে লাগল। কিন্তু যুদ্ধ বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। অল্পক্ষণের মধ্যেই অস্ত্রাঘাতে ছিন্নভিন্ন দুই দুৰ্বত্তের রক্তাক্ত মৃতদেহ ধরণীকে আলিঙ্গন করল। রক্তাক্ত অসির শোণিতধারা শত্রুর পরিধেয় বসনে বিলুপ্ত করে নিষ্কলঙ্ক অসিকে পুনরায় কোষবদ্ধ করল কর্ণদেব।

বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে এতক্ষণ যুদ্ধ দেখছিল ধনুর্বাণধারী আগন্তুক, এইবার সে বলে উঠল, সাধু! সাধু! অসি চালনার এমন কৌশল খুব কমই দেখা যায়। কিন্তু এই দুটি অনডান অসি ধরতেই শেখেনি। এরা তোমার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী নয়।

জ্বলন্ত চক্ষে কর্ণদেবকে নিরীক্ষণ করতে করতে সে বলল, তোমার ন্যায় প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে মৃত্যুবরণেও সুখ আছে।

কর্ণদেব সহাস্যে বলল, কিন্তু তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে আমি অনিচ্ছুক।

আগন্তুক গম্ভীর স্বরে বলল, তোমার এবং তোমার গুরুর পরিচয় জানতে চেয়েছিলাম মনে আছে? তুমি রূঢ় ভাষায় আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলে।

কর্ণদেব বলল, অন্যায় করেছিলাম। আমার নাম কর্ণদেব। অস্ত্রগুরুর নাম বলতে পারব না। গুরুর নিষেধ।

আগন্তুক হতাশকণ্ঠে বলল, আমি আশা করেছিলাম তুমি উদ্ধত ভঙ্গিতে পুনরায় আমাকে রূঢ় উত্তর দেবে। কিন্তু অন্যায় স্বীকার করেই তুমি বিভ্রাটের সৃষ্টি করেছ।

বিস্মিত স্বরে কর্ণদেব বলল, কিন্তু আমি তো সত্যই অন্যায় করেছিলাম। সেই স্বীকারোক্তিতে বিভ্রাটের কি হল?

আগন্তুক পূর্ববৎ হতাশ ভঙ্গিতে বলল, তুমি রূঢ় উত্তর দিলে আমি অপমানিত বোধ করে তোমাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাতে পারতাম। কিন্তু অন্যায় স্বীকার করেই তুমি সব মাটি করে দিয়েছ।

কৌতুক-উচ্ছল স্বরে কর্ণদেব বলল, আমার সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করার জন্য তুমি এত উৎসুক কেন?

আগন্তুক বলল, আমি আর্যাবর্তের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছি। কোথাও আমার সমকক্ষ ধনুর্ধর বা অসিযোদ্ধার সাক্ষাৎ পাইনি। তোমার অসি চালনার কৌশল দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলাম। মনে হয়েছিল এতদিনে বুঝি যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বীর সাক্ষাৎ পেলাম। কিন্তু তুমি আমাকে হতাশ করলে!

-অস্ত্র চালনায় দক্ষতা প্রদর্শন করে যদি আত্মপ্রসাদ লাভ করতে চাও, কর্ণদেব বলল, তবে বোধহয় তোমাকে সেই সুযোগ আমি দিতে পারব।

আগন্তুক সাগ্রহে প্রশ্ন করল, কবে? কোথায়? কখন?

ধীরে, বন্ধু, ধীরে। স্মরণ রেখো আমি বোধহয় বলেছি। তিরন্দাজ শায়নের গৃহে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছি। যদি তার দেখা পাই, তাহলে তোমাকে খুশি করতে পারব না। আর যদি তার সাক্ষাৎ না পাই

বাধা দিয়ে আগন্তুক বলে উঠল, তিরন্দাজ শায়নের গৃহে তার সাক্ষাৎ তুমি পাবে না।

কর্ণদেবের ভ্রু কুঞ্চিত হল, কেন?

–সে গৃহে নেই।

-তুমি কি করে জানলে সে গৃহে নেই? তুমি তো তার গৃহের বিপরীত দিক থেকে অর্থাৎ রাজধানী থেকে আসছ!

–এই মুহূর্তে সে কোথায় আমি জানি।

কোথায়?

–তোমার সম্মুখে।

স্তম্ভিত নেত্রে কিছুক্ষণ আগন্তুকের মুখের দিকে চেয়ে রইল কর্ণদেব, তারপর উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল, তুমিই শায়ন?… হ্যাঁ, তাই হবে। বাহুকে অক্ষত রেখে বাহুর উপরজড়িত রঞ্জুকে যে শরাঘাতে ছিন্ন করতে পারে, এমন তিরন্দাজ শায়ন ভিন্ন আর কে আছে?

শায়ন হাসিমুখে বলল, কর্ণদেব! এবার বলো, অস্ত্রচালনায় আমার দক্ষতা প্রদর্শন করার উপযুক্ত ক্ষেত্র কোথায় আছে? সেখানে গেলে আমি কি উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দীর সাক্ষাৎ পাব?

–তোমার সমকক্ষ তিরন্দাজ শ্রাবস্তী রাজ্যে আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু অসিচালনায় তোমারই মতো নিপুণ আর একটি মানুষের সাক্ষাৎ তুমি নিশ্চয়ই পাবে।

–ভালো। সমকক্ষ অসিযোদ্ধার সঙ্গে শক্তিপরীক্ষা করতে আমি সর্বদাই ইচ্ছুক।

–উঁহু। সেই দক্ষ অসিযোদ্ধা তোমার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায় না, বন্ধুত্ব করতে চায়।

–বন্ধুত্ব চায়? যে আমাকে চোখেও দেখে নি, সে আমার বন্ধুত্ব চাইছে কেন?

–এক কঠিন কার্যে সিদ্ধিলাভ করার জন্য তোমার ন্যায় নিপুণ অসিযোদ্ধা এবং লক্ষ্যভেদে সিদ্ধহস্ত তিরন্দাজের সাহায্য একান্ত প্রয়োজন মনে করেই তোমার কাছে আমাকে প্রেরণ করেছে আমার অস্ত্রগুরু। তিরন্দাজ শায়নের নাম শ্রাবস্তী রাজ্যে লোকের মুখে মুখে ফেরে। সুতরাং আমার গুরুর কানেও তোমার নাম গেছে।

-তোমার গুরু! যার কাছে তুমি অসিচালনা শিক্ষা করেছ?

–হ্যাঁ।

সাধু! সাধু! আমি তার সঙ্গে দেখা করতে উগ্রীব। কোথায় তিনি?

–বলছি। কিন্তু তার আগে বলো– রাজধানীতে যখন তোমার সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম, তখন তোমার কটিতে তরবারি থাকলেও পৃষ্ঠে ধনুর্বাণ ছিল অনুপস্থিত। এখন দেখছি, ধনুর্বাণ তোমার অঙ্গশোভা বৃদ্ধি করছে। এই ধনুক আর শরপূর্ণ তূণীর কি তাহলে তুমি রাজধানী থেকে ক্রয় করেছ?

-আরে না, না। রাজধানীতে বন্ধুগৃহে একটি দিন ও একটি রাত অতিবাহিত করতে গিয়েছিলাম। রাজপথে ধনুর্বাণ নিয়ে চলাফেরা করে কেবল সৈনিক ও মাংস ব্যবসায়ী শবর। আমি শবরও নই, সৈনিকও নই, অনর্থক লোকের কৌতূহলী চক্ষুর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই না– তাই বন্ধুগৃহে ধনুর্বাণ রেখেই রাজপথে ভ্রমণ করছিলাম। এখন গৃহে ফিরে যাচ্ছি, তাই সঙ্গের ধনুর্বাণ আবার অঙ্গে উঠেছে।

তুমি বুঝি প্রায়ই রাজধানীতে গিয়ে কালক্ষেপ করো?

–গুরুত্বপূর্ণ কার্যে প্রাণসংশয় ঘটার সম্ভাবনা থাকলে বন্ধুগৃহে যাই এবং রাজধানীতে বিবিধ আমোদ-প্রমোদে আত্মাকে তৃপ্ত করে গৃহে এসে কিয়ৎকাল বিশ্রাম করি– তারপর যথাস্থানে গমন করি কর্তব্য পালন করতে।

-তাহলে বর্তমানে প্রাণসংশয় ঘটার মতো কোনো বিপজ্জনক কার্যে তুমি যোগ দিতে যাচ্ছ?

-হ্যাঁ। কিন্তু তার আগে তোমার বক্তব্য শুনতে চাই। তোমার গুরু এক কঠিন কার্যে আমাকে নিয়োগ করতে ইচ্ছুক হয়েছেন শুনে অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে উঠেছি। সত্বর আমার কৌতূহল নিবারণ করো।

–তার আগে তোমার কাছে আমি মাত্র একটি প্রতিশ্রুতি চাই।

–কি প্রতিশ্রুতি?

–প্রতিজ্ঞা করো, আমার প্রস্তাবে সম্মত না হলেও কোনো তৃতীয় ব্যক্তিকে এই বিষয়ে কিছু বলবে না।

-কর্ণদেব! আমি প্রতিজ্ঞা করছি তোমার প্রস্তাব আমার মুখ থেকে কোনো তৃতীয় ব্যক্তির কর্ণগোচর হবে না। এখন বলল, কি তোমার প্রস্তাব?

অতঃপর কর্ণদেব শায়নকে যা বলল সেইসব কথা আমরা পূর্বেই তার মুখ থেকে বল্লভের গৃহে শুনেছি। এখানে পুনরুক্তি অনাবশ্যক। সব কথা শুনে শায়ন কিছুক্ষণ নীরবে চিন্তা করল, তারপর বলল, তাহলে পরন্তপই তোমার অস্ত্রশিক্ষার গুরু?… ভাল; দস্যু পরন্তপ যে দক্ষ যোদ্ধা সেই তথ্য আমার অবিদিত নয়। দস্যুবৃত্তিকে আমি সমর্থন করি না কিন্তু যে কাজে পরন্তপ আমার সাহায্য প্রার্থী, সেই কাজে তাকে সাহায্য করতে আমার আপত্তি নেই। বিশেষত অর্থের প্রয়োজন কার না আছে? আমি তোমার প্রস্তাবে সম্মত। কর্ণদেব! বলল- কবে, কোথায়, কখন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে?

-যে বটবৃক্ষের তলদেশে পঞ্চপাণ্ডব আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে, সেই বৃক্ষের তলায় আজ সন্ধ্যার প্রাক্কালে পরন্তপের সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ হতে পারে।

-আজ সন্ধ্যার প্রাক্কালে? অসম্ভব।

অসম্ভব? কেন?

এখান থেকে তিন চার ক্রোশ দূরে এক গ্রামে সিংহের উপদ্রব শুরু হয়েছে। বহু গো-মহিষ ও মানুষ ওই সিংহের কবলে প্রাণ হারিয়েছে। সপ্তাহকাল পূর্বে প্রতিনিধি স্বরূপ কয়েকজন ব্যক্তি এসে আমার সাহায্য প্রার্থনা করে। সিংহটিকে হত্যা করতে পারলে তারা আমাকে দশটি স্বর্ণমুদ্রা পারিশ্রমিক দিতে প্রতিশ্রুত হয়েছে। অগ্রিম মূল্যস্বরূপ তিনটি স্বর্ণমুদ্রা তারা আমাকে দিয়ে গেছে। আজ দ্বিপ্রহরের মধ্যেই তাদের গ্রামে আমার পৌঁছনোর কথা। ওই নরমাংসলোপ খাপদকে বধ না করে আমি এখন অন্যত্র গমন করতে পারি না।

–এইখান থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে গমন করলে বোধহয় ওই গ্রামে পৌঁছনো যায়। ঐ গ্রামের কিছু আগে বোধ হয় একটি বৃহৎ পর্বতের অস্তিত্ব আছে?

-হ্যাঁ, তুমি ওই গ্রামে গিয়েছে?

তা গিয়েছি বটে। শায়ন! তুমি স্বচ্ছন্দে সন্ধ্যাকালে পরন্তপের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারো। ওই সিংহ আর জীবিত নেই।

–সিংহ জীবিত নেই? তুমি কি করে জানলে?

–ঠিক দুই দিন আগে মধ্যাহ্নকালে তরবারির আঘাতে পশুরাজের মৃত্যু ঘটেছে।

তরবারির আঘাতে সিংহকে হত্যা করল কে! আর সে সংবাদ তুমিই বা জানলে কি করে?

–শোনো বলছি। রাজধানীতে আসার জন্য বনপথ অতিক্রম করে চলতে চলতে সিংহের অত্যাচারে সন্ত্রস্ত গ্রামটির মধ্যে এসে পড়েছিলাম। গ্রামবাসী আমাকে নিকটেই নরখাদক সিংহের অস্তিত্ব জানিয়ে সাবধান করে দেয়। নিকটবর্তী পর্বত দেখিয়ে তারা বলে সিংহ নাকি ওই পর্বতেরই এক গুহাতে বাস করে– অতএব উক্ত গিরিপথে ভ্রমণ না করে অন্য পথে ঘুরে যাওয়াই আমার পক্ষে নিরাপদ পন্থা বলে তারা মতপ্রকাশ করে। আমি তাদের সঙ্গে বিতর্কে ব্যাপৃত না হয়ে তাদের কথাতেই সায় দিলাম। কিন্তু কার্যত ওই পর্বতের গিরিপথ ধরেই অগ্রসর হলাম। কারণ, অন্য পথে ঘুরে গেলে রাজধানীতে পৌঁছতে বিলম্ব হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। সিংহের ভয়ে বিলম্ব করতে আমার অহঙ্কারে বাধল। তাছাড়া প্রখর দিবালোকে সিংহ হয়তো আক্রমণ করতে সাহসী হবে না একথাও মনে হয়েছিল। কিন্তু মধ্যাহ্নের তীব্র সূর্যালোকের মধ্যেই নরখাদক আমাকে আক্রমণ করল। বোধ হয় গ্রামের লোক অত্যন্ত সতর্ক থাকার ফলে পশুরাজ গ্রাম থেকে মাংসের খাজনা আদায় করতে পারেনি, তাই ক্ষুধার্ত হয়ে অপেক্ষা করছিল শিকারের জন্য। যে কারণেই হোক, প্রকাশ্য দিবালোকেই সিংহ আমাকে আক্রমণ করল। তরবারির দ্রুত সঞ্চালনে শ্বাপদের আক্রমণ ব্যর্থ করলাম। আহত ও ক্রুদ্ধ সিংহ পিছনের দুই পায়ে দাঁড়িয়ে আমাকে নখদন্তের আলিঙ্গনে বন্দি করতে সচেষ্ট হল। আমি সজোরে আঘাত হানলাম- তরবারি আমূল প্রবেশ করল সিংহের বক্ষে। আমার তরবারি বক্ষে ধারণ করে মরণাহত পশুরাজ ছিটকে পড়ল পর্বতের তলদেশে। আমি তাড়াতাড়ি পদচালনা করে পৌঁছলাম রাজধানীতে। শায়ন! সেই জন্যই তুমি আমার কটিবন্ধে শূন্যগর্ভ অসিকোষ দেখতে পেয়েছিলে।

শায়ন এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় কর্ণদেবের কাহিনি শুনছিল, এইবার সজোরে তার স্কন্ধে চপেটাঘাত করে বলে উঠল, সাধু! সাধু! কর্ণদেব আজ সন্ধ্যায় আমি নিশ্চিত ওই বটবৃক্ষের তলায় উপস্থিত থাকছি। কিন্তু এখন আমার গৃহে কিছুক্ষণের জন্য আতিথ্য গ্রহণ করতে তোমার আপত্তি আছে কি? গৃহে তণ্ডুল ও মৃগমাংস আছে। তাতে হয়তো…

বাধা দিয়ে কর্ণদেব বলল, না। পরন্তপ আমার জন্য উদ্বিগ্ন চিত্তে অপেক্ষা করছে। তাকে সমস্ত সংবাদ অবিলম্বে জানানো প্রয়োজন। আরও একটা কথা–

-বলো।

–বল্লভের কথা তোমাকে আগেই বলেছি। সন্ধ্যাকালে তাকেও তুমি পূর্বোক্ত স্থানে দেখতে পাবে। আশা করি বল্লভকে সঙ্গী হিসাবে নিতে তোমার আপত্তি হবে না।

–কি যে বোল। গেরুয়াধারী বল্লভের প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির খ্যাতি আমার কানেও এসেছে। অবশ্য বল্লভ সম্পর্কে খুব বেশি অবহিত নই। কারণ, বল্লভ কিছুটা প্রচারবিমুখ। এমন একটি মানুষকে বিপজ্জনক পথে সঙ্গীরূপে পেলে খুশি হব।

-তবে এখন বিদায় গ্রহণ করছি। সন্ধ্যাকালে পুনরায় দেখা দেখা হবে।

-হ্যাঁ। সন্ধ্যাকালে দেখা হবে। তোমার অস্ত্রগুরু পরন্তপের সঙ্গেও আশা করি সাক্ষাৎ হবে?

–বলাই বাহুল্য।

» ১২. সংখ্যার নাম চার

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। বিশাল বটবৃক্ষের তলদেশে দাঁড়িয়ে আছে তিন ব্যক্তি কর্ণদেব, বল্লভ, শায়ন। শায়নের আচরণে অস্থিরতার চিহ্ন পরিস্ফুট। সে ইতস্তত পদচালনা করছে, কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়াচ্ছে, আবার পদচালনা করছে। তাকে দেখে পিঞ্জরে আবদ্ধ শার্দুলের কথা মনে পড়ে।

অকস্মাৎ কর্ণদেবের সম্মুখে দাঁড়িয়ে শায়ন অসহিষ্ণু স্বরে বলে উঠল, কর্ণদেব। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ। এখনো যে পরন্তপের দেখা নেই?

কর্ণদেব উত্তর দেওয়ার আগেই পিছন থেকে ভেসে এল গম্ভীর কণ্ঠস্বর, পরন্তপ যথাসময়েই উপস্থিত হয়েছে।

সচমকে ফিরে দাঁড়িয়ে বল্লভ ও শায়ন দেখলে তাদের পিছনে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে এক দীর্ঘকায় পুরুষ! উক্ত পুরুষের মাথা ও মুখ কৃষ্ণবর্ণ উষ্ণীষ ও উষ্ণীষ সংলগ্ন বস্ত্রের আবরণে অদৃশ্য, উর্ধ্বাঙ্গে আঙরাখা ও নিম্নাঙ্গে পারসিকদের মতো সেলাই করা পরিচ্ছদ ও কৃষ্ণবর্ণে রঞ্জিত; কটিদেশে লম্বিত রয়েছে দীর্ঘ তরবারি এবং বক্ষস্থলের বামপাশ্ব থেকে দক্ষিণ কটিতট অবধি বেষ্টন করে পিঠের উপর দিয়ে ঘুরে গেছে একটি চমবন্ধনী– ওই বন্ধনীর সঙ্গে ধনুর্বাণের পরিবর্তে সংলগ্ন রয়েছে অনেকগুলি ছুরিকা!

প্রদোষের প্রায়ান্ধকার প্রান্তরের বুকে ওই অপরূপ মূর্তির আকস্মিক উপস্থিতি বল্লভ ও শায়নকে চমকিত করে দিল।

প্রথম কথা বলল বল্লভ, সন্ধ্যার প্রাক্কালে তোমার এখানে আসার কথা ছিল। পরন্তপ! তুমি কথা রাখতে পারোনি।

আবরণের অন্তরাল থেকে মৃদু হাসির শব্দ ভেসে এল, সন্ধ্যার প্রাক্কালে এলে দেখা হবে এই কথাই ছিল। তোমরা ওই সময়ে এসেছ এবং আমার সঙ্গে সাক্ষাৎও হয়েছে। আমি সন্ধ্যার পূর্বে দেখা দেব এমন কথা নিশ্চয়ই কর্ণদেব বলেনি বলেছে কি?

ক্ষণকাল নীরব থেকে বল্লভ বলল, পরন্তপ! তুমি যথার্থ বলেছ বটে। কিন্তু অন্ধকার এখনও ঘনীভূত হয় নি। তুমি কোথা থেকে কেমন করে হঠাৎ আমাদের চোখের সামনে এসে উপস্থিত হলে সেকথা ভেবে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। মুহূর্ত পুর্বেও তোমার অস্তিত্ব আমরা বুঝতে পারি নি। তোমার চালচলন সত্যই রহস্যময়।

পরন্তপ আবার হাসল, রহসময় না হলে মহারাজ রুদ্রদমনের গুপ্তরচবর্গ বহু পূর্বেই আমায় বন্দি করে ফেলত। অথবা একদিন বক্ষে বা ললাটে শায়কচিহ্ন ধারণ করে পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করতাম।

হঠাৎ শায়নের তিরকণ্ঠ বেজে উঠল, প্রদোষের অন্ধকারে ভূমির উপর শায়িত অবস্থায় হাত ও জানুর উপর ভর দিয়ে অগ্রসর হলে চলমান মানুষের অস্তিত্ব দণ্ডায়মান মানুষের চোখে সহসা ধরা পড়ে না। মৃগয়ার সময়ে আমরা অভীষ্ট পশুর দিকে ওইভাবেই অগ্রসর হই। এটা এমন কিছু রহস্যময় ব্যাপার নয়। পরন্তপ! অনর্থক নিজেকে রহস্যের আবরণে ঢেকে রাখার চেষ্টা করো না।

পরন্তপ বলল, শায়ন! তুমি মৃগয়ায় অভ্যস্ত বলেই এই ধরনের গতিবিধি সম্পর্কে অবহিত। অনভিজ্ঞ ব্যক্তির কাছে ওইভাবে আত্মপ্রকাশ করলে সে বিস্ময়ে অভিভূত হবে সন্দেহ নেই।

বল্লভ বলল, আমি সত্যই বিস্মিত হয়ে পড়েছিলাম। পরন্তপ কিছুমাত্র অত্যক্তি করেনি। তা ছাড়া, দস্যু দলপতির পক্ষে রহস্যের আবরণ সৃষ্টি করার প্রয়োজন আছে।

শায়ন বলল, আমরা দস্যু নই। পরন্তপ বর্তমান অভিযানের নেতা হলেও তাকে এখন দস্যু দলপতি বললে ভুল হবে।

পরন্তপ বলল, নিশ্চয়। এবার কাজের কথা বলি। শায়ন! তোমার পরিচয় নিষ্প্রয়োজন। শ্রাবস্তী রাজ্যে তুমি খ্যাতনামা তিরন্দাজ! অসিচালনাতেও তোমার খ্যাতি আছে। তুমি যদি আমাদের দলে যোগ দাও, তাহলে আমি সুখী হব। কর্ণদেবের মুখে সব কিছুই শুনেছ তো?

-শুনেছি। আমি এই অভিযানে যোগ দিতে রাজি আছি।

সাধু! সাধু! এসো, তোমার করমর্দন করি।

হাত বাড়িয়ে পরন্তপ ও শায়ন পরস্পরের করগ্রহণ করল। বেশ কিছুক্ষণ তারা ওইভাবেই অবস্থান করল, তারপর পরন্তপ উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, বড়োই সুখী হলাম। শক্তিমান পুরুষের হাতে হাত মিলিয়ে আনন্দ পাওয়া যায়।

পরন্তপ হাত টেনে নিল। তার কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক হলেও ঈষৎ কম্পিত। মনে হয়, শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি হঠাৎ দ্রুত হয়ে পড়েছে।

শায়ন সম্পূর্ণ স্তব্ধ। তবে করমর্দনের পরেই তার ললাটে কয়েকটি স্বেদবিন্দুর আবির্ভাব ঘটেছে।

এইবার বল্লভকে সম্বোধন করে পরন্তপ বলল, বল্লভ! আমি তোমাকে জানি না। তবে কর্ণদেবের মুখে যা শুনলাম, তাতে বুঝলাম তুমি জয়দ্রথের চাইতে অনেক বেশি শক্তিমান।… বল্লভ! তুমি তাহলে ওই অভিযানে যোগ দিতে রাজি?

আমি রাজি, বল্লভ হাসল, এখন তুমি আমাকে মনোনীত করবে কি না সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।

তোমার ন্যায় মহাবলী পুরুষ আমাদের দলে যোগ দিলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব,দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করে পরন্তপ হাসল, বল্লভ। এসো, বন্ধুত্বের শপথ নিয়ে আমরা করমর্দন করি।

বল্লভও হাত বাড়াল। কিন্তু তাদের হাত মিলিত হওয়ার আগেই কর্ণদেব সভয়ে এগিয়ে এসে ধাক্কা দিয়ে বল্লভের হাত সরিয়ে দিল। ক্রুদ্ধভঙ্গিতে কর্ণদেবের দিকে ফিরে পরন্তপ বলল, এই অদ্ভুত আচরণের অর্থ কি কর্ণদেব?

কর্ণদেব গম্ভীরস্বরে বলল, করমর্দন করে বল্লভের শক্তিপরীক্ষা করতে চাও?… পরন্তপ! ওই কর্মটি করো না। করমর্দনের ফলে তোমার করতল চুর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যদি তা না হয়, তাহলেও অন্তত কয়েকটা দিন ওই হাতে অস্ত্রধারণ করা তোমার পক্ষে সম্ভব হবে না।

তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে একবার বল্লভের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে পরন্তপ বলল, আমাদের কিশোর বন্ধু কর্ণদেবের আজ্ঞা শিরোধার্য। এই মুহূর্তে দক্ষিণ হস্তটি আমার পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বস্তু। ওই বস্তুটিকে অটুট রাখার জন্য বল্লভের সঙ্গে করমর্দনের দুর্লভ আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করলাম।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে পরন্তপ আবার বলল, তাহলে শল্যকে উদ্ধার করার জন্য আমরা চারজন যাত্রা করছি? অর্থের বণ্টন বিষয়ে যে ব্যবস্থা ধার্য হয়েছে, সে কথা নিশ্চয়ই কর্ণদেব তোমাদের বলেছে। তাহলেও আমি আবার বলছি- গুপ্তধন উদ্ধার করতে সমর্থ হলে ওই সম্পদ সমান চারভাগে ভাগ হবে। আশা করি ওই ব্যবস্থায় তোমাদের আপত্তি নেই?

বল্লভ ও শায়ন সমস্বরে জানাল ওই ব্যবস্থায় তাদের কিছুমাত্র আপত্তি নেই।

আরো একটা কথা, পরন্তপ বলল, শল্যের উদ্ধারকার্য যে খুব সহজে হবে না একথা নিশ্চয়ই তোমরা বুঝতে পারছ। দুস্যরা আমাদের চাইতে সংখ্যায় অনেক বেশি এবং প্রাণ দেওয়া-নেওয়ার খেলা খেলতে তারা সর্বদাই প্রস্তুত। তাদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে আমাদের পক্ষেও হতাহত হওয়ার আশঙ্কা আছে একথা বলে আমি পূর্বেই তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। ভেবে দেখ– যদি কারও প্রাণের ভয় থাকে, তার এখনও সরে যাওয়ার সময় আছে।

শায়ন এগিয়ে এসে রূঢ়স্বরে বলল, পরন্তপ! আমরা শিশু নই। শল্যকে দস্যুদের কবল থেকে উদ্ধার করতে গেলে তারা যে আমাদের পাদ্য-অর্ঘ দিয়ে অভ্যর্থনা করবে না এটুকু উপলদ্ধি করার মতো বুদ্ধি আমাদের আছে। আমি দস্যুবৃত্তি করি না। কিন্তু ধনুর্বাণ ও অসি সম্বল করে নরখাদক সিংহ, ব্যাঘ্র অথবা মদোন্মত্ত হস্তীর আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছি বারংবার। প্রাণ দেওয়া-নেওয়ার খেলায় আমি অভ্যস্ত। শুধু হিংস্র পশু নয়– একাধিক পশুবৎ হিংস্র মানুষও আমার অসি ও শায়কের চিহ্ন দেহে ধারণ করে যমালয়ে ভ্রমণ করতে গেছে। অতএব মিছেমিছি বিপদের কথা না বলে এখন আমাদের কি কর্তব্য সে কথাই বলো।

পরন্তপ বলল, শায়ন! আমি তোমাকে ভালোভাবেই জানি। তবু কর্তব্যবোধে আসন্ন বিপদের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। দস্যুদলের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হয়ে শল্যকে উদ্ধার করলেও বিপদের কবল থেকে আমরা মুক্তি পাচ্ছি না। বনপথে হিংস্র জন্তুর ভয় আছে। তার চেয়েও ভয়ানক অনার্য যোদ্ধার দল উদ্যত ধনুর্বাণ হস্তে পাহারা দিচ্ছে সীমান্ত অঞ্চলে। তাদের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে গুপ্তধন উদ্ধার করা খুবই কঠিন। আমি জানি তোমরা সাহসী মানুষ, সেইজন্যই তোমাদের সাহায্য চেয়েছি। তবু অভিযানের নেতা হিসাবে এই সকল বিপদ-আপদের সম্ভাবনা জানিয়ে আমি তোমাদের সতর্ক করে দেব। সব জেনেও যদি তোমরা আমার সঙ্গে যোগ দাও, তাহলে আমি আনন্দিত হব। মনে রেখো- এই কাজে পদে পদে প্রাণের আশঙ্কা বর্তমান।

শায়ন বলল, আমার অভিমত পুর্বেই তোমাকে জানিয়েছি। এবিষয়ে আর আলোচনা না করে ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি অবিলম্বে স্থির করা প্রয়োজন।

পরন্তপ বলল, বল্লভের মতামত আমি এখনও শুনতে পাইনি। বল্লভ! তুমি নীরব কেন? বিপদের কথা শুনে তোমার মনে আতঙ্কের সঞ্চার হয়েছে? তাহলে বলল, এখনও ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

বল্লভ শান্তস্বরে বলল, আমি মৌন ছিলাম, তার কারণ মৌনই সম্মতির লক্ষণ। এখন জানতে চাই শল্যকে উদ্ধার করতে আমরা কখন যাত্রা করব।

–এখনই।

বল্লভ ও শায়ন একসঙ্গে বলে উঠল, এখন! সেকি!

পরন্তপ বলল, শুভস্য শীঘ্রং। বিলম্বে প্রয়োজন কি?

শায়নের পৃষ্ঠে রক্ষিত ধনুর্বাণ ও কটিদেশে বিলম্বিত তরবারির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে সে বলল, শায়ন তো দেখছি সশস্ত্র হয়েই এসেছে। তবে বল্লভের কাছে অস্ত্র নেই এটা চিন্তার কথা। কিন্তু আমাদের কিশোর বন্ধু কর্ণদেব চেষ্টা করলে মধ্যযামের আগেই বল্লভের উপযুক্ত অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।

বল্লভ বলল, কর্ণদেবকে ব্যতিব্যস্ত করার প্রয়োজন হবে না। অস্ত্র আমার সঙ্গেই আছে। কর্ণদেবই আমাকে অস্ত্র নিয়ে আসতে বলেছিল।

পরন্তপ বলল, কোথায়? কোথায় তোমার অস্ত্র?

নত হয়ে পায়ের তলা থেকে বল্লভ তার অস্ত্র তুলে ধরল। ম্লান অন্ধকারে অনাবৃত প্রান্তরের উপর বস্তুটি এতক্ষণ পরন্তপের দৃষ্টিগোচর হয়নি। সবিস্ময়ে বল্লভের হাতের দিকে তাকিয়ে পরন্তপ বলল, কুঠার! এত বড়ো?

কর্ণদেব ও শায়ন পূর্বেই সুবিশাল ওই কুঠারটি দেখেছিল। তারা কোনো মন্তব্য প্রকাশ করল না। কুঠারফলকের একপাশে সস্নেহে হস্ত স্থাপন করে বল্লভ বলল, এইটি আমার অস্ত্র। দণ্ড ও কুঠার ছাড়া অন্য অস্ত্র ব্যবহারে আমি অভ্যস্ত নই। বর্তমান অভিযানে দণ্ডের চাইতে কুঠারই অধিকতর প্রয়োজনীয় মনে হয়।

পরন্তপ বিস্মিত হয়ে বলল, এই গুরুভার কঠার নিয়ে তুমি কি যুদ্ধ করতে পারবে?

উত্তরে সুবিশাল কুঠারটিকে বিদ্যুৎবেগে মাথার উপর কয়েকবার ঘুরিয়ে কুঠারফলক মাটিতে স্থাপন করল বল্লভ– তারপর কুঠারদণ্ডের উপর ভর দিয়ে পরন্তপের মুখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।

বিস্ময়-বিহ্বল স্বরে পরন্তপ বলল, তুমি অমিত শক্তিধর পুরুষ। তোমার ক্ষমতা সম্পর্কে আমার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নেই।

শায়ন বলল, তাহলে আমরা এখনই অভীষ্ট স্থান অভিমুখে যাত্রা করছি?

-হ্যাঁ। এখন যাত্রা করলে কাল প্রত্যূষে অথবা পূর্বাহ্নে আমরা যথাস্থানে পৌঁছে যাব। সেখানে পৌঁছে অবস্থা অনুসারে ব্যবস্থা হবে।

অভীষ্ট স্থান কতদুরে জানতে পারি কি?

প্রায় ছয় ক্রোশ।

ছয় ক্রোশ!

বল্লভ সভয়ে বলল, আমি পঞ্চাশটি যোদ্ধার সঙ্গে এককভাবে যুদ্ধ করতে ভয় পাই না। কিন্তু ছয় ক্রোশ পথ আজ রাত্রে অতিক্রম করতে হলে আমার ন্যায় স্থূলকায় মানুষ নির্ঘাত মৃত্যুবরণ করবে। দ্রুত পদচালনায় দীর্ঘ পথ অতিক্রম করা আমার পক্ষে অসম্ভব।

শায়ন বলল, আমি দ্রুত ধাবন ও ভ্রমণে অভ্যস্ত। তবু এক রাতের মধ্যে পদব্রজে ছয় ক্রোশ পথ অতিক্রম করা আমার পক্ষেও কঠিন।

কে বলল আমরা পদব্রজে যাব? পরন্তপ গম্ভীরস্বরে বলল, অশ্ব প্রস্তুত আছে। আমরা অশ্বারোহণে যাত্রা করব।

একটু থেমে সে আবার বলল, আরও একটা কথা, সময় বিশেষে আমাদের সঙ্গে অন্যান্য লোকজনের সাক্ষাৎ হতে পারে। পরন্তপ নামে আমাকে সম্বোধন করলে বহু মানুষের মনে সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে। যদিও শ্রাবস্তী রাজ্যে এই নামে বহু মানুষ আছে, তবু অনর্থক সন্দেহের বিষয়বস্তু হয়ে নিজেদের বিপন্ন করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। অতএব, এখন থেকে তোমরা আমাকে দারুক নামেই সম্বোধন করবে। নিজেদের মধ্যে পরন্তপ নামে সম্বোধন করলে বিপত্তির ভয় নেই, কিন্তু মানুষ অভ্যাসের দাস– অপর ব্যক্তির সম্মুখে পরন্তপসম্বোধন সময় বিশেষে ভীষণ বিপদের সূচনা করতে পারে। তাই এখন থেকে সর্বদাই তোমাদের কাছে আমি দারুক। কথাটা যেন মনে থাকে।

থাকবে, শায়ন বলল, কিন্তু আমার একটি প্রশ্ন আছে।

–বলো।

আমরা তোমার সঙ্গে এমন এক অভিযানে যোগ দিচ্ছি, যার পরিণামে আমাদের পক্ষে কোনো কোনো ব্যক্তির, এমনকি সকলেরই মৃত্যু ঘটা অসম্ভব নয়।

-সে কথা তো আগেই বলেছি। সব জেনেই তোমরা আমার সঙ্গী হতে সম্মত হয়েছ।

-নিশ্চয়। কিন্তু আমাদের অধিনায়কের মুখের চেহারা আমরা দেখতে চাই। কি বলল বল্লভ?

–আমিও ওইকথা বলতে যাচ্ছিলাম। শায়ন! তুমি আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়েছ।

পরন্তপ ইতস্তত করতে লাগল।

দারুক, গম্ভীরস্বরে শায়ন বলল, আমার অনুরোধ না রাখলে আমি এখান থেকেই ফিরে যাব।

বল্লভ বলল, আমারও সেই কথা।

বেশ, পরন্তপ বলল, কিন্তু পরবর্তীকালে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলেও তোমরা অপরিচিতের ন্যায় ব্যবহার করবে। শপথ করো- কার্যসিদ্ধি হলে কখনো আমার সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করবে না। দৈবক্রমে যদি আমার সঙ্গে কখনও সাক্ষাৎ হয়, তাহলেও বাক্যালাপের চেষ্টা করবে না।

শায়ন বলল, আমি শপথ করছি ভবিষ্যতে কখনো তোমার মুখদর্শন করার চেষ্টা করব না। দেখা হলেও বাক্যালাপ থেকে বিরত থাকব।

বল্লভ বলল, আমারও সেই কথা।

উষ্ণীষ ও তৎসংলগ্ন বস্ত্রের আবরণ মুক্ত হল। সকলের চোখের সামনে ভেসে উঠল এক মধ্যবয়স্ক পুরুষের মুখ। অন্ধকারের মুখের রং ভালো বোঝা যায় না, তবু মনে হল উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, রৌদ্রদগ্ধ হয়ে তাম্রবর্ণ ধারণ করেছে। মস্তকে কৃষ্ণ কেশরাশি, ললাট অপ্রশস্ত, রোমশ জ্বর তলায় না-ছোটো না বড় দুই চোখে তীব্র দৃষ্টি, গুম্ফরেখার নীচে পরিপূর্ণ ওষ্ঠাধরে ক্ষীণ হাসির আভাস চিবুক ও মুখমণ্ডল ক্ষৌরকর্মের কল্যাণে পরিচ্ছন্ন ও পরিমার্জিত।

বল্লভ ও শায়ন তীব্র দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেও যোদ্ধা সুলভ কাঠিন্য ও দৃঢ়তায় চিহ্নিত সেই মুখে দস্যুজনোচিত বর্বর হিংসার ছায়া আবিষ্কার করতে পারল না।

মুখের অধিকারী হেসে বলল, আশা করি ভোমারা সন্তুষ্ট হয়েছে।

মৌনমুখে দুজনেই মাথা নেড়ে জানাল তারা সন্তুষ্ট হয়েছে।

–অনুগ্রহ করে আমার সঙ্গে এসো।

তিনজনেই নীরবে পরন্তপকে অনুসরণ করল। একটু দূরে অন্ধকার আচ্ছন্ন ঝোপের মধ্যে চারটি অশ্ব দৃষ্টিগোচর হল। একটি গাছের সঙ্গে ঘোড়া চারটিকে বেঁধে রাখা হয়েছিল। পরন্তপের ঈঙ্গিতে তাদের বন্ধন মুক্ত করে তিনজন তিনটি অশ্বে আরোহণ করল। চতুর্থ অশ্বটির পৃষ্ঠে একলক্ষে উপবিষ্ট হয়ে পরন্তপ বাহনকে সবেগে ছুটিয়ে দিল…।

অশ্বপৃষ্ঠে তাকে অনুসরণ করল আর্যাবর্তের তিনটি দুর্ধর্য মানুষ…।

.

১৩. অপরিচিত আগন্তুক

উচ্চভূমির উপর থেকে নীচে সমতল ভূমিতে অবস্থিত একটি সুবৃহৎ পর্ণকুটিরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে পরন্তপ বলল, ওইখানে রয়েছে শল্য। ওই কুটিরের ভিতর থেকেই ওকে উদ্ধার করতে হবে।

তার তিন সঙ্গী নির্দিষ্ট দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল–

কুটিরের নিকটেই অলস বাক্যালাপে সময় অতিবাহিত করছে পাঁচটি বিভিন্ন বয়সের মানুষ। প্রত্যেকেই সশস্ত্র। কটিবন্ধে ছুরিকা ও তরবারি রয়েছে। একজনের পৃষ্ঠে ধনুর্বাণও দেখা গেল।

শায়ন বলল, আমরা তো নিশ্চয়ই রাত্রে আক্রমণ করব?

দলের অধিনায়ক পরন্তপ বলল, না। রাত্রে শল্যকে নিয়ে পলায়নের অসুবিধা আছে। ওই অঞ্চলের বনপথ তোমাদের পরিচিত নয়। তাছাড়া এই অরণ্য হিংস্র শ্বাপদের প্রিয় বাসভূমি। অন্ধকারে বন্যপশু কর্তৃক আক্রান্ত হলে আমরা আত্মরক্ষা করতে পারব না।

বল্লভ প্রশ্ন করল, ওই পাঁচটি দস্যু যদি শল্যকে বন্দি করে রেখে থাকে, তাহলে উদ্ধার কার্য নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। ইচ্ছা করলে এখনই ওদের বিধ্বস্ত করে আমরা শল্যকে উদ্ধার করতে পারি।

পরন্তপ বলল, না পাঁচজন নয়- যতদূর জানি বিদ্রোহী দস্যুদের সংখ্যা আট কি দশ হবে। ওই কুটির ছিল শল্যের গোপন বাসস্থান। বর্তমানে তার বাসস্থানই তার কারাগারে পরিণত হয়েছে। কুটিরের মধ্যে অন্যান্য দস্যুরা রয়েছে কিনা, অথবা থাকলেও কতজন আছে, এখান থেকে তা অনুমান করা সম্ভব নয়। কেউ কেউ হয়তো শিকারের সন্ধানে নিকটস্থ অরণ্যের মধ্যে প্রবেশ করেছে। তবে দ্বিপ্রহরে মধ্যাহ্ন ভোজনের সময়ে সকলেই এখানে সমবেত হবে। দস্যুদল একত্রে ভোজন করে। সেইটাই পদ্ধতি। খুব সম্ভব, কুটিরের নিকট কোনো বৃক্ষের তলদেশে ওরা সমবেত হয়ে ভোজন করবে। সেইটাই হবে আক্রমণের উপযুক্ত সময়।

বল্লভ বলল, মধ্যাহ্ন ভোজনের এখনো যথেষ্ট বিলম্ব আছে। সূর্য এখনও প্রখর হয়নি। আপাতত আমরা কি করব?

পরন্তপ বলল, শুধু ওদের উপর দৃষ্টি রাখা ছাড়া আপাতত আর কোনো কাজ নেই।

শায়ন বলল, একটু দূরে গাছের তলায় চারটি ঘোড়া বাঁধা আছে। মনে হয়, সর্বসমেত দস্যুদলে ছয়জন আছে।

পরন্তপ বলল, ঘোটকের সংখ্যা দিয়ে দস্যুদের সংখ্যা নির্ণয় করার চেষ্টা করলে ভুল হবে। প্রত্যেক দস্যুই যে অশ্বারোহী তা নয়। ওই যে শ্বেতবর্ণ অশ্বটি দেখছ, ওই অশ্বের প্রকৃত অধিকারী হচ্ছে শল্য- তবে আমার মনে হয় বর্তমানে শ্বেত অশ্বটিকে অধিকার করেছে বিদ্রোহী দস্যুদের দলপতি স্বয়ং।

বল্লভ বলল, যুদ্ধের এখনও বিলম্ব আছে। এই অবসরে কিছু ভক্ষণ করতে পারলে ভালো হত। আমার বিলক্ষণ ক্ষুধার উদ্রেক হয়েছে। পরন্তপ ভ্রু কুঞ্চিত করল।

কর্ণদেব হাসল, দারুক! বল্লভের ক্ষুধা কিন্তু বেশি। অবিলম্বে ওই ক্ষুধাকে প্রশমিত করতে না পারলে যথাসময়ের বল্লভের বিক্রম সম্যক প্রকাশিত হবে না।

পরন্তপ বলল, আমার অশ্বের পৃষ্ঠদেশে বেশ কিছু ফল ও শলাকাপক্ক শুষ্ক মাংস আছে। অসময়ে প্রয়োজন হতে পারে বলে ওই খাদ্য আমি সঙ্গে এনেছি। কিন্তু এত শীঘ্র যে বল্লভের উদরে অগ্নি প্রজ্বলিত হবে সে কথা ভাবিনি। বল্লভ! এখন ওই মাংস ও ফলের কিয়দংশ দিয়ে তোমার ক্ষুধাকে শান্ত করে। কিন্তু সমুদয় আহার্য উদরসাৎ করো না।

বল্লভ হেসে বলল, না, না। আমি অত স্বার্থপর নই।

যে উচ্চভূমিতে আশ্রয় দিয়ে চারটি দুর্ধর্ষ মানুষ তলদেশের পটভূমির উপর নজর রাখছিল, সেই উচ্চভূমির এক পাশে একটি প্রকাণ্ড পাথরের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল চারটি অশ্বকে। বল্লভ সেইদিকে পা বাড়িয়ে আবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

নিকটবর্তী অরণ্যের ভিতর থেকে একটি বাণবিদ্ধ হরিণের মৃতদেহ বহন করে প্রান্তরের উপর আত্মপ্রকাশ করেছে তিনটি সশস্ত্র পুরুষ!

যে পাঁচটি মানুষ এতক্ষণ নিবিষ্টচিত্তে বাক্যালাপ করছিল, তারা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সোল্লাসে শিকারিদের অভ্যর্থনা জানাল। কুটিরের দ্বারপথে মুখ বাড়িয়ে মৃগয়ালব্ধ হরিণটিকে দেখে চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করল।

পরন্তপ ও তার তিন সঙ্গী বুঝল পূর্বোক্ত তিন ব্যক্তি দস্যুদের দলের মানুষ, তারা অরণ্যে প্রবেশ করেছিল সকলের জন্য মাংসের ব্যবস্থা করতে এখন মৃগয়ালব্ধ মৃগমাংস দেখে দস্যুদল আসন্ন ভোজের সম্ভাবনায় উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে।

কিছুক্ষণ তাদের উল্লাসধ্বনি শ্রবণ করে বল্লভ আবার ফিরল অশ্বপৃষ্ঠ থেকে আহার্য সংগ্রহের জন্য। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কুটিরের ভিতর থেকে একটা কাতর আর্তনাদ ভেসে আসতেই সে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল।

কয়েক মুহূর্তে পরেই কুটিরের দ্বারপথ দিয়ে বাহিরে এল তিন ব্যক্তি। একজনের কোমরে দড়ি বাঁধা। দড়ির প্রান্ত একব্যক্তির হাতে, অপরজন মুষ্টিবদ্ধ হাত আস্ফালন করে রজ্জবদ্ধ মানুষটিকে ভর্ৎসনা করছে এবং মাঝে মাঝে প্রহার করছে। প্রহৃত ব্যক্তি সম্পূর্ণ মৌন, আঘাতের যন্ত্রণা অসহ্য হলে আর্তনাদ করে উঠেই আবার স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে।

তারা প্রান্তরের উপর এগিয়ে আসতেই তাদের কথাবার্তা পরন্তপ ও তার সঙ্গীদের শ্রুতিগোচর হল। যে ব্যক্তি আস্ফালন সহকারে বন্দিকে প্রহার করছিল, সে বন্দিকে উদ্দেশ করে ক্রুদ্ধস্বরে বলল, শল্য! আজই তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদি ধনভাণ্ডারের সন্ধান দাও, তাহলে প্রাণে বাঁচবে। না হলে, এইখানেই তোমাকে আমরা হত্যা করব।

উচ্চভূমিতে অপেক্ষমাণ চারটি মানুষ বুঝল ওই বন্দি হচ্ছে শল্য নামক দস্যু। যে ব্যক্তি বদ্ধমুষ্টি আস্ফালন করে শল্যকে প্রহার করছিল, সে নিশ্চয়ই বিদ্রোহী দস্যুদের দলপতি।

শল্য কোনো উত্তর দিল না। দেখে আরও ক্রুদ্ধ হয়ে দলপতি শল্যের মুখে প্রচণ্ড বেগে মুষ্টাঘাত করল। কাতর আর্তনাদ করে রক্তাক্ত মুখে শল্য ধরাশায়ী হল।

দলপতি বলল, তুমি সহজে মুখ খুলবে না। আচ্ছা, তোমার ব্যবস্থা করছি।

ঘুরে দাঁড়িয়ে নিকটস্থ এক দস্যুকে উদ্দেশ করে দলপতি বলল, রাঘব! কুটিরের ভিতর থেকে একটি কুঠার নিয়ে এস।

তৎক্ষণাৎ কুটিরের ভিতর থেকে একটি কুঠার নিয়ে রাঘব ফিরে এল। আর একটি দস্যুকে ডেকে দলপতি বলল, রাঘব আর কঞ্জুক, তোমরা আমার সঙ্গে বনের ভিতর চলো।

দুই দস্যুকে নিয়ে দলপতি বনের ভিতর প্রবেশ করল। শল্য হেঁটমুণ্ডে বসে রইল প্রান্তরের উপর। তাকে ঘিরে রঙ্গরসিকতা করতে লাগল অন্যান্য দস্যবৃন্দ।

বল্লভ ফিসফিস্ করে জিজ্ঞাসা করল, দারুক! দলপতি কুঠার নিয়ে দুই দস্যুর সঙ্গে বনমধ্যে প্রবেশ করল কেন?

কঠিন স্বরে পরন্তপ বলল, দেখতেই পাবে। এখন চুপ করে থাকো। কর্ণদেব! তোমার অশ্বের পৃষ্ঠে আমি ধনুক আর শরপূর্ণ তুণীর রেখে দিয়েছি। ওইগুলি নিয়ে এস। বোধহয় শীঘ্রই ধনুর্বাণ ব্যবহারের প্রয়োজন হবে।

কর্ণদেব নীরবে অধিনায়কের আজ্ঞা পালন করল।… কিছুক্ষণ পরেই দস্যু দলপতি তার দুই সহচরের সঙ্গে বনের ভিতর থেকে এসে প্রান্তরের উপর দাঁড়াল। তার এক সহচরের মাথায় শুকনো কাঠের বোঝা অপর ব্যক্তি বহন করছে দুটি বৃক্ষশাখা। শাখা দুটি সাত-আট হাত দীর্ঘ এবং অতিশয় স্থূল। দলপতির নির্দেশে দুস্যরা শাখা দুটিকে মাটিতে পুঁতে দিল। দুটি শাখার মধ্যবর্তী দূরত্ব চার-পাঁচ হাতের বেশি নয়।

এইবার শল্যকে টেনে এনে তার দুই হাত শক্ত করে দুই বৃক্ষশাখার সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হল। দলপতির নির্দেশে শুকনো কাঠ স্তূপকারে সাজিয়ে দেওয়া হল শল্যের পায়ের কাছে।

শল্য! দলপিত হেসে বলল, তোমাকে ধীরে ধীরে অগ্নিদগ্ধ করা হবে। দেখ, যদি গুপ্তধনের সন্ধান দাও, তাহলে এখনই নিষ্কৃতিলাভ করতে পারো। নচেৎ শলাকাপ মৃগমাংসের ন্যায় তোমাকে অগ্নিপক্ক করা হবে।

শল্য নীরব। দলপতি হাঁক দিয়ে দস্যুদের বলল, তোমরা কাষ্ঠে অগ্নিসংযোগ করো।

উচ্চভূমির উপরে পরন্তপ তার সঙ্গীদের উদ্দেশ করে বলল, আমি এইখান থেকে সজোরে ছুরিকা নিক্ষেপ করে দলপতিকে বিদ্ধ করব। সঙ্গে সঙ্গে শায়ন ও কর্ণদেব তির নিক্ষেপ করে দস্যুদের হত্যা করতে থাকবে। দস্যুদের মধ্যে দুই ব্যক্তির সঙ্গে ধনুর্বাণ রয়েছে, অপর সকলেরই তরবারি ও ছুরিকা সম্বল। তোমরা প্রথমেই ধনুর্বাণধারী দুই দস্যুকে তিরবিদ্ধ করবে। অতর্কিত বাণাঘাতে বিপর্যস্ত দস্যুদল পলায়নের চেষ্টা করবে। আশা করি প্রথম আক্রমণেই আমরা ওদের পাঁচজনকে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিতে পারব। বাকি পাঁচজন প্রাণ নিয়ে পালাতে চেষ্টা করবে, কিন্তু ওদের পালাতে দিলে পরবর্তীকালে আমরা বিপন্ন হতে পারি– অতএব বাণবিদ্ধ দস্যরা ধরাশায়ী হতে না হতেই এই স্থান হতে লাফিয়ে পড়ে আমি অন্যান্য দস্যুদের আক্রমণ করব। বল্লভ! তুমি কুঠার হস্তে আমার সহযাত্রী হবে এবং প্রথম সুযোগেই শল্যকে বহন করে এই উচ্চভূমির উপর নিয়ে আসবে। আচ্ছা, এইবার প্রস্তুত হও। মনে রেখো আমি ছুরিকা নিক্ষেপ করার সঙ্গে সঙ্গে তোমরাও শর নিক্ষেপ করবে। তার আগে কিন্তু আরে! আরে! ও আবার কে!

পূর্ণকুটিরের পশ্চাৎবর্তী অরণ্য ভেদ করে যে মানুষটি হঠাৎ প্রান্তরের উপর এসে দাঁড়িয়েছে, তাকে দেখেই পরন্তপের বিস্ময়-চকিত উক্তি– ও আবার কে!

আগন্তুকের চেহারা দেখলেই মনে হয় তরবারি ও তৃণীর সম্বল করে যে সকল ভাগ্যান্বেষী যোদ্ধা আর্যাবর্তের বুকে বিচরণ করে, এই ব্যক্তি তাদেরই একজন।

আগন্তুক সশস্ত্র। পষ্ঠে ধনুর্বাণ, কটিতে অসি ও ছুরিকা। গায়ের রং তপ্ত কাঞ্চনের মতো, দাড়িগোঁফ আর ঘন কেশের অরণ্যে আবৃত মখমণ্ডল ও মস্তক– দীর্ঘ উন্নত দেহ, পেশীবদ্ধ গ্রীবা, বিশাল বাহু এবং বৃষবৎ স্কন্ধের প্রশস্ত বিস্তার মানুষটির অসধারণ দৈহিক শক্তির পরিচয় দিচ্ছে। বক্ষের বামদিক বেষ্টন করে দক্ষিণ কটি পর্যন্ত নেমে এসে একটি সবুজ উত্তরীয় উর্ধ্বাঙ্গের নগ্নতা নিবারণ করছে, অধমাঙ্গে পীতাভ বস্ত্র যোদ্ধৃসুলভ ভঙ্গিতে দৃঢ়ভাবে পরিহিত। পায়ে চর্মরঙ্গুতে আবদ্ধ চর্মপাদুকা।

দস্যুরা শল্যকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল, আগন্তুককে তারা দেখতে পায়নি। মানুষটি ধীর পদে এগিয়ে এসে যখন শুল্যের নিকট দণ্ডায়মান হল, তখনই তারা সচমকে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হল।

দলপতি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল, কে তুমি?

আগন্তুক উত্তর দিল, আমি পথিক। কিন্তু এখানে কি হচ্ছে?

একজন দস্যু কর্কশ স্বরে বলল, এখানে যাই হোক, তাতে তোমার কি?

যে দস্যুটি চকমকি পাথর ঠুকে অগ্নিসংযোগ করার চেষ্টা করছিল, তার দিকে তাকিয়ে আগন্তুক বলল, তোমরা কি নরমাংস ভক্ষণ করো নাকি? এই ব্যক্তিকে অগ্নিদগ্ধ করে তোমরা ক্ষুধা নিবারণ করবে?

ভীষণ গর্জন করে দলপতি তার কোষ থেকে তরবারি আকর্ষণ করল, ওরে নির্বোধ! এখানে অধিকক্ষণ থাকলে তোরও এই দশা হবে। যা, এই স্থান ত্যাগ করে পলায়ন কর।

আগন্তুক এক পা পিছিয়ে বলল, যথা আজ্ঞা। আমি এখনই এই স্থান ত্যাগ করছি। আমার বিবেচনায় এই স্থান অতিশয় অস্বাস্থ্যকর।

সে বামদিকে অরণ্য অভিমুখে পদচালনা করল এবং দেখতে দেখতে বনমধ্যে অদৃশ্য হল তার সুদীর্ঘ দেহ।

কিছুক্ষণ সেইদিকে তাকিয়ে থেকে দলপতি বলল, গর্দভটাকে শেষ করে দিলেই ভালো হত।

একজন দস্যু বলল, আমাদের দলে লোকসংখ্যা তাহলে কিছু কমে যেত।

দলপতি ভ্রু কুঞ্চিত করল, মাধব! তোর চাইতে ঐকটা ইঁদুরেরও বেশি বুদ্ধি আছে। মারব ওই লোকটাকে, আর লোক কমবে আমাদের দলে?

মাধব নামে দস্যুটি হেসে বলল, লোকটাকে দেখে কি মনে হয়, ওই লোক মার না দিয়ে মার খাওয়ার মানুষ? তুমি এখনো মানুষ চেন না? এতগুলো লোকের পাল্লায় পড়লে মানুষটা মারা পড়ত ঠিকই, কিন্তু যমরাজের কাছে যাওয়ার সময় আমাদের দল থেকে কয়েক জনকে সঙ্গে নিয়ে যেত।

দস্যুদের মধ্যেও কয়েকজন বক্তার কথায় সায় দিল।

দলপতি রুষ্টস্বরে বলল, বাজে কথা রেখে এইবার আসল কাজে মন দে। নে, আগুন লাগা।

চকমকির ছোঁয়ায় এতক্ষণে কাঠের স্তূপে আগুনের ঝলক দেখা দিল।

উচ্চভূমিতে পরন্তপের ডান হাত একটা ছুরির হাতলে চেপে বসল। শায়ন ও কর্ণদেব ধনুকে বাণ লাগিয়ে নিল। বল্লভ তার প্রকাণ্ড কুঠারের হাতল চেপে ধরল শক্ত মুঠিতে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে প্রান্তরের বুকে জাগল ঘন ঘন অশ্বখুরধ্বনি!

নীচে দস্যুদল আর উপরে পরন্তপেরদল চমকে উঠে দেখল দস্যুদের বাঁধা ঘোড়াগুলি হঠাৎ মুক্ত হয়ে প্রান্তরের উপর দিয়ে ছুট অরণ্যের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে! শুধু একটি ঘোড় তীরবেগে ছুটে আসছে দুস্যদের দিকে এবং তার পিঠের উপর তরবারি হাতে উপবিষ্ট হয়েছে পূর্বে উল্লিখিত আগন্তুক।

.

১৪. ধন্য শায়ন ধন্য

ঘটনাটা কি ঘটছে ভালো করে উপলব্ধি করার আগেই ঝড়ের বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে আগন্তুক এসে পড়ল দস্যুদলের মধ্যে প্রথমেই তার তরবারির আঘাতে প্রাণ হারিয়ে ধরাশায়ী হল দলপতি, তারপরই আর দুজন দস্যুর রক্তাক্ত দেহ মৃত্যুশয্যায় লুটিয়ে পড়ল।

ভীত আর্তনাদে চারদিক কাঁপিয়ে দস্যুরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে তরবারির দ্রুত সঞ্চালনে শল্যের বন্ধনরঙ্কু ছিন্ন করে আগন্তুক তাকে ঘোড়ার পিঠে তুলে নিল এবং সবেগে বাহনকে চালনা করল পশ্চাৎবর্তী অরণ্যের অভিমুখে।

দস্যুদলে অবস্থিত ধনুর্বাণধারী দুই দুবৃত্তের মধ্যে একজন আগেই আগন্তুকের অসির আঘাতে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়েছিল– অপর ব্যক্তি পলায়মান অশ্বের আরোহীদের লক্ষ্য করে চকিতে শরনিক্ষেপ করল। জ্যা-মুক্ত বাণ শল্যের দেহে বিদ্ধ হল। পরক্ষণেই আগন্তুক ও বাণহত শল্যকে বহন করে অশ্ব অরণ্যের গর্ভে অদৃশ্য হল।

অশ্ব যে-পথে অন্তর্ধান করেছে, সেই দিকে তাকিয়ে বিমূঢ় অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল দস্যুর দল। প্রথম সংবিৎ ফিরে পেল কৰ্ণদেব। সঙ্গীদের উদ্দেশ করে সে বলে উঠল, বল্লভ! শায়ন! দারুক। তোমরা এস, অশ্বপৃষ্ঠে আমরা ওদের অনুসরণ করব। যেভাবেই হোক শল্যকে উদ্ধার করতেই

আত্মবিস্মৃত কর্ণদেবের উচ্চকণ্ঠ নিকটবর্তী দস্যুদের মধ্যে কয়েকজনের শ্রুতিগোচর হয়েছিল। শব্দ অনুসরণ করে মুখ তুলতেই পাথরের আড়াল থেকে চারটি মানুষের মাথা তাদের চোখে পড়ল। একজন চিৎকার করে উঠল, সাবধান! চারদিকে শত্রু! তোমরা

কথা শেষ হওয়ার আগেই শূন্যপথে উড়ে গিয়ে পরন্তপের নিক্ষিপ্ত ছুরি বক্তার কণ্ঠকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিল।

আর একটি ছুরি শুন্যে তুলে প্রচণ্ড কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল পরন্তপ, শায়ন! কর্ণদেব! ওদের হত্যা করো। ওরা বেঁচে থাকতে আমরা নিরাপদ নই।

পরক্ষণেই সূর্যালোকে বিদ্যুৎবর্ষণ করে ছুটে গেল শাণিত ছুরিকা ও ধনুমুক্ত বাণ এবং ভূমিপৃষ্ঠকে রক্তাক্ত করে তুলল আরও তিনটি দস্যুর মৃতদেহ।

হতাবশিষ্ট দস্যুরা অরণ্যের নিরাপদ আশ্রয় লক্ষ্য করে ছুটল। কিন্তু শায়নের ধনুক দ্রুত বাণবর্ষণ করে তাদের ইহলীলা সাঙ্গ করে দিল।

ছুটে গিয়ে অশ্বকে বন্ধনমুক্ত করে একলাফে পরন্তপ তার পিঠে উঠে বসল, তারপর উচ্চৈঃস্বরে বলল, বন্ধুগণ! আমাদের একটি সমস্যা মিটে গেল। দুরাত্মা দস্যুর দল আর আমাদের বিরক্ত করতে পারবে না। কিন্তু সম্মুখে আর এক সমস্যা অপরিচিত অশ্বারোহীর কবল থেকে শল্যকে উদ্ধার করতে হবে। শীঘ্র চলো, পলাতক অশ্বারোহীকে অনুসরণ করো।

কথা শেষ করেই পরন্তপ সবেগে বাহনকে চালনা করল এবং ঢালুপথে নীচে না নেমে উপর থেকেই অশ্বপৃষ্ঠে অবতীর্ণ হল তলদেশে অবস্থিত সমতলভূমির উপর!

মুহূর্তমাত্র অপেক্ষা না করে যে-পথে অজ্ঞাত অশ্বারোহী শল্যকে নিয়ে অন্তর্ধান করেছে, সেই দিকেই ঘোড়া ছুটিয়ে দিল পরন্তপ।

বল্লভ সবিস্ময়ে দেখল একই ভঙ্গিতে অশ্বকে চালনা করে উপর থেকে নীচে লাফ দিয়ে নেমে গেল শায়ন ও কর্ণদেব এবং একটুও না থেমে পরন্তপকে অনুসরণ করল বায়ুবেগে!

ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে বল্লভ আপনমনেই বলল, ওরা রাগ করুক আর যাই করুক, আমি অমনভাবে এই পাহাড়ি পথে ঘোড়া ছোটাতে পারব না।

বল্লভ সহজভাবেই ঢালু পথ বেয়ে অশ্বপৃষ্ঠে সমভূমির বুকে অবতরণ করল, তারপর যে-পথে বন্ধুদের ধাবমান অশ্বগুলি অরণ্যের অন্তরালে অদৃশ্য হয়েছে, সেই পথ ধরে অপেক্ষাকৃত দ্রুতবেগে অগ্রসর হল…।

বল্লভ যখন তার বন্ধুদের কাছে পৌঁছল, সে দেখল ঘোড়া থামিয়ে তারা গভীর গবেষণায় ব্যস্ত। কেউ তার দিকে দৃকপাত করল না। অথচ সে ভেবেছিল বিলম্বের জন্য তিরস্কৃত হবে। মনে মনে কৈফিয়ত তৈরি করেই সে এসেছিল, কিন্তু তিরস্কার থেকে নিষ্কৃতিলাভ করেও সে খুশি হতে পারল না বরং বন্ধুরা তার প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করছে ভেবে সে মনে মনে অপমানিত বোধ করল। কিছুক্ষণ অন্যমনস্কর ভান করে সে আলোচনা থেকে নিরস্ত রইল, কিন্তু শ্রবণেন্দ্রিয়কে সজাগ রেখে বন্ধুদের কথাবার্তা শুনতে লাগল উত্তর্ণ হয়ে।

পলাতক অশ্বের পদচিহ্ন ধরে এতখানি পথ এসেছে তিন অশ্বারোহী, কিন্তু সম্মুখে কঙ্কর ও প্রস্তরাকীর্ণ কঠিন ভূমির উপর আর পায়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না বলেই পলাতক কোন্ পথে গেছে তাই নিয়ে তর্ক করছে পরন্তপ ও কর্ণদেব। শায়ন সম্পূর্ণ নীরব। অশ্বের বপ্পা কর্ণদেবের হাতে দিয়ে সে ইতস্তত পদচালনা করছে, মাঝে মাঝে নত হয়ে কি যেন দেখছে ভূমিপৃষ্ঠে, আবার ঊর্ধ্বমুখে অদূরবর্তী পর্বতের দিকে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে গভীর মনোযোগর সঙ্গে…।

হঠাৎ ফিরে এসে কর্ণদেবের হাত থেকে অশ্বের বা গ্রহণ করে শায়ন বলে উঠল, সন্ধান পেয়েছি। অশ্বারোহী শল্যকে নিয়ে ওইদিকে গেছে।

সে যেদিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করল সেদিকে সবুজ অরণ্যের পরিবর্তে বিরাজ করছে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ অসংখ্য প্রস্তর এবং ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কয়েকটি কণ্টকপূর্ণ প্রায়-শুষ্ক বৃক্ষ। প্রস্তর ও শুষ্ক বৃক্ষে সজ্জিত সেই ঊষর ভূমির উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে দুটি বৃহৎ পর্বত।

ওই পর্বতের দিকেই শল্যকে নিয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তি পলায়ন করেছে বলে অনুমান করছে শায়ন।

বিপরীত দিকে তৃণাবৃত প্রান্তর ও ঘন অরণ্যের দিকে তাকিয়ে পরন্তপ অবিশ্বাসভরে মস্তক সঞ্চালন করল, অসম্ভব! ওদিকে কোথায় যাবে ওরা? ওই পর্বত দুটির মধ্যে দ্বিতীয়টিতে আরোহণ করা প্রায় অসম্ভব। দক্ষিণপার্শ্বে যে পর্বতটি রয়েছে, ওই পাহাড়ের গিরিপথ ধরে কোনোক্রমে দুটি মানুষ পাশাপাশি উঠতে পারে কিন্তু অশ্বারোহণে ওই গিরিপথ ধরে উপরে ওঠা সম্ভব নয়।

শায়ন চিবুকের উপর অঙ্গুলি ঘর্ষণ করতে করতে বলল, অশ্বারোহণে তারা নাও যেতে পারে। পর্বতের তলদেশে ঘোড়া ছেড়ে দিয়েছে। দুটি পাহাড়ের মাঝখানে যে সঙ্কীর্ণ পথ রয়েছে, সেই পথে হয়তো অশ্ব অন্তর্হিত হয়েছে। অথবা ওই স্থান থেকে ভারমুক্ত অশ্ব পাহাড়ের সমান্তরাল রেখা ধরে ছুটতে ছুটতে দূর অরণ্যে আত্মগোপন করেছে।

পরন্তপ বলল, সবই অনুমান। তবে আহত মানুষকে নিয়ে অশ্বারোহণে বনপথের উপর ভ্রমণ করাই নিরাপদ ও স্বাভাবিক। দুরারোহ পার্বত্য পথ ধরে একটি আহত মানুষকে নিয়ে ঊর্ধ্বে আরোহণ করতে গেলে পদস্খলিত হয়ে মৃত্যুবরণের সম্ভাবনা আছে। অতএব, স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যায় ওরা অরণ্যের দিকেই পলায়ন করেছে। তৃণাবৃত প্রান্তর শুরু হওয়ার আগে ভূমিপৃষ্ঠ অতি কঠিন বলে অশ্বের পদচিহ্ন লক্ষিত হচ্ছে না। আমার বিশ্বাস ওই প্রান্তরের বুকে সন্ধান করলে আমরা ঘোটকের পায়ের দাগ দেখতে পাব।

শায়নের ওষ্ঠধর ব্যঙ্গের হাসি দেখা দিল, দারুণ! এটাও তোমার অনুমান মাত্র। প্রমাণ নয়।

শায়নের ব্যঙ্গজড়িত হাসির আভাস পরন্তপের মনে ক্রোধের উদ্রেক করল, সে তপ্তস্বরে বলল, আমার অনুমানের পিছনে স্বাভাবিক যুক্তির প্রয়োগ আছে। তোমার অনুমান কষ্টকল্পিত, তাতে যুক্তি বা প্রমাণ নেই।

ঊর্ধ্বে পর্বত শিখরের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে শায়ন বলল, প্রমাণ না পেয়ে আমি কথা বলি না। তারা কোন দিকে গেছে সেই প্রমাণ আগেই পেয়েছি। আর এখন যে কোথায় আছে সেই সংবাদও এইমাত্র আমার কাছে পৌঁছে গেছে।

বিদ্রূপ জড়িত স্বরে পরন্তপ বলল, কোথায় সেই প্রমাণ? আমরা তো চর্মচক্ষে কোনো প্রমাণ। দেখতে পাচ্ছি না, কোনো সংবাদও কেউ আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়নি। বোধ করি পর্বতবাসী। কোনো প্রেতাত্মা পলাতকদের সংবাদ তোমাকে দিয়ে গেছে!

–আমার সঙ্গে এসো।

পর্বত অভিমুখে কিছুদূর অগ্রসর হয়ে একস্থানে ভূমির দিকে পরন্তপের দৃষ্টি আকর্ষণ করে শায়ন বলল, কিছু দেখতে পাচ্ছ?

তীক্ষ দৃষ্টিতে স্থানটি পর্যবেক্ষণ করতে করতে পরন্তপ বলল, প্রায় একহাত উঁচু ছোটো ছোটো চারাগাছগুলির মধ্যে পলাতকদের সন্ধান করার কোনো উপায় তো দেখছি না।

শায়ন হাসল, প্রিয় পরন্তপ না, না, দারুক!–ঈশ্বর তোমাকে একজোড়া চোখ দিয়েছে, কিন্তু তুমি সেই চোখের ব্যবহার জানো না। ভালো করে চেয়ে দেখ একটি গুল্মের শাখা ভগ্ন হয়ে তরল নির্যাস নির্গত হচ্ছে।

তপ্তস্বরে পরন্তপ বলল, তা থেকে কি বুঝব?

-বুঝবে এই যে, আকস্মিক আঘাতের ফলেই চারাগাছটির এই দুর্দশা। হঠাৎ এই গুল্মটির উপর আঘাত আসবে কোথা থেকে? একমাত্র ধাবমান অশ্বের পদাঘাতেই চারাগাছটির এই অবস্থা হতে পারে। অশ্ব এই পথে ছুটলে পর্বত অভিমুখেই যাবে সন্দেহ নেই। এখন বলো, আমার ধারণার স্বপক্ষে এটা কি যথেষ্ট প্রমাণ নয়?

না। আমি এটাকে যথেষ্ট প্রমাণ মনে করতে পারছি না। বন্য ছাগ বা হরিণের পদাঘাতেও চারাগাছটি ওই ভাবে ভাঙতে পারে।

–বন্য ছাগ এই অঞ্চলে বাস করে না। হরিণের পদাঘাতে চারা গাছ ভাঙতে পারে, কিন্তু এমনভাবে বিধ্বস্ত হবে না। অরণ্যে মৃগয়ার সন্ধানে ঘোরাঘুরি করে পশুচরিত্র সম্পর্কে কিছু অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে জানি এই গুল্ম হরিণের প্রিয় খাদ্য। অথচ কোনস্থানে গুল্মের উপর হরিণের দন্তাঘাতের চিহ্ন নেই। প্রিয় খাদ্যে ক্ষুন্নিবৃত্তি না করে তাকে পদদলিত করবে এমন হরিণ বোধ হয় আজও মৃগবংশে জন্মগ্রহণ করেনি।

–এই সামান্য প্রমাণ সম্বল করে তুমি যদি পর্বত-অভিমুখে যাত্রা করতে চাও, তাহলে আমি তোমার সঙ্গী হতে আপত্তি করব না; কিন্তু সমস্ত পরিশ্রমই পণ্ডশ্রমে পরিণত হবে বলে মনে হয়। এখন বলো– ওই দুটি পর্বতের মধ্য নিকটবর্তী পর্বতেই ওরা আশ্রয় নিয়েছে বলে তুমি মনে করো কি? নাকি, দ্বিতীয় পর্বতটিতেই তুমি আবোহণ করতে চাও?

খুব স্বাভাবিক যুক্তিতেই বোঝা যায় নিকটবর্তী পর্বতেই পলাতকরা আশ্রয় নিতে চেষ্টা করবে। কিন্তু যুক্তি দিয়ে বিচার করার প্রয়োজন নেই। নিকটস্থ পর্বতের কোনো স্থানে তারা আশ্রয় গ্রহণ করেছে, তাও আমার জানা হয়ে গেছে।

–বলো কি! শায়ন! তোমাকে দক্ষ তিরন্দাজ বলেই জানতাম, কিন্তু তুমি যে অন্তর্যামী হয়ে উঠেছ সে কথা জানতাম না।

অন্তর্যামী হইনি দারুক, অন্তর্যামী হইনি। গিরিপথ আর বনভূমির বুকে মৃগয়ার সন্ধানে বিচরণ করতে করতে আমি পশুচরিত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি এবং দৃষ্টিশক্তিকে ব্যবহার করতে শিখেছি। বনের পশু এর মধ্যেই আমাকে পলাতকদের সংবাদ জানিয়ে দিয়েছে।

বল্লভ এতক্ষণ নীরব ছিল, হঠাৎ সে বলে উঠল, শায়ন! তুমি যে আজকাল পশুজগৎ থেকে সংবাদ আহরণ করতে শিখেছ সেই তথ্য আমারও জানা ছিল না। কিন্তু কথা হচ্ছে তোমাকে সংবাদটি পরিবেশন করল কে? এতক্ষণ তোমার পাশে দাঁড়িয়ে আছি, কোনো জীবজন্তুকে তো ধারে কাছে আসতে দেখি নি।

শায়ন স্মিতমুখে বলল, সেই দেখার কথাই তো বলছি। মল্লযোদ্ধার চোখে দেখলে প্রকৃতির বুক থেকে সংবাদ আহরণ করা যায় না। অভিজ্ঞ শিকারির চোখ থাকলে দেখতে পেতে কেমন করে কোন সংবাদ বহন করে আনে প্রকৃতির সন্তান।

হঠাৎ ধৈর্য হারিয়ে কটুস্বরে কর্ণদেব বলে উঠল, ভণিতা রেখে বলো কোথায় আছে ওরা? আর তুমি সে কথা জানলেই বা কি করে?

নাটকীয়ভাবে পর্বতশিখরে অবস্থিত এক গুহার দিকে আঙ্গুলিনির্দেশ করে শায়ন বলল, পলাতকরা ওই গুহাতেই এখন আশ্রয় নিয়েছে।

সন্দেহজড়িত স্বরে কর্ণদেব প্রশ্ন করল, তুমি কি করে জানলে?

তবে শোন, শায়ন বলতে লাগল, একটু আগেই যখন পলাতকরা কোন পথে গেছে সে বিষয়ে আলোচনা করে তোমরা মস্তিষ্ককে তপ্ত করে তুলছিলে, সেই সময়ই প্রথম আমি ভগ্ন গুল্মটিকে আবিষ্কার করি। তৎক্ষণাৎ বুঝলাম ওই পাহাড়েই ওরা গমন করেছে। অশ্বপৃষ্ঠে আহত মানুষ নিয়ে কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি দুরারোহ ওই পর্বতে আরোহণের চেষ্টা করবে না সে কথা সহজেই বুঝলাম। শল্যের উদ্ধারকর্তা যে শল্যকে নিয়ে পদব্রজে ওই পাহাড়ে উঠেছে সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হলাম। সেইসঙ্গে একথাও বুঝলাম ওই বৃহৎ পর্বতের অন্দরে কন্দরে বিভিন্ন গুহা-গহ্বরে হানা দিয়ে পলাতকদের সন্ধান করা অসাধ্য না হলেও অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ কিন্তু অনুসন্ধান চালাতে চালাতেই যদি আহত শল্যের মৃত্যু হয়, তাহলে সকল পরিশ্রমই হবে পণ্ডশ্রম! ভাবছি কি করি, এমন সময়ে গিরিপথ বেয়ে এক বিপুল বপু চিত্রকের আবির্ভাব! চিতাবাঘটি অলস-মন্থর। গতিতে ওই গহ্বরের ভিতর প্রবেশ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। তারপর পিছন ফিরে তিরবেগে ছুটে গিরিপথের এক প্রান্ত দিয়ে পর্বতের অপরপার্শ্বে অন্তর্ধান করল। আমি জানি চিতাবাঘ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর জীব। সিংহ বা শার্দুলের সম্মুখীন হলে সে পলায়নের চেষ্টা করে, কিন্তু বনবাসী অন্যান্য শ্বাপদকে সে ভয় পায় না। গুহামধ্যে চিত্রকের ভীতিপ্রদ কোনো পশু থাকলে সে নিশ্চয়ই তাকে আক্রমণ করতে ছুটে এসে গুহামুখে আত্মপ্রকাশ করত, অথবা সগর্জনে বিরক্তি প্রকাশ করত– কিন্তু আমি কোনো হিংস্র পশুকে গুহার মুখে দেখতে পাইনি, অথবা শ্বাপদকণ্ঠের গর্জন ধ্বনিও আমার কর্ণে প্রবেশ করেনি। তবে চিত্ৰক পলায়নে তৎপর হল কেন? ব্যাঘ্রাদি কয়েকটি পশু ছাড়া আরও একটি জীবকে চিতাবাঘ ভয় পায় সেই জীবটি হচ্ছে অস্ত্রধারী মানুষ এই স্থানে আহত শল্য ও তার উদ্ধারকর্তা ছাড়া অন্য কোনো অস্ত্রধারী পুরুষের অস্তিত্বের প্রমাণ আমরা পাইনি, অতএব বুঝলাম ওই গুহার ভিতরই স্থান গ্রহণ করেছে আহত শল্য ও তার উদ্ধারকর্তা।

পরন্তপ বলল, একটি ভগ্ন গুল্ম ও একটি চিতাবাঘের সচকিত পলায়ন দেখেই তুমি ওইখানে পলাতকদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে ফেললে। ধন্য শায়ন ধন্য!

শায়ন বলল, দীর্ঘকাল গিরিকান্তারে বন্য পশুর সংসর্গে জীবন যাপন করার ফলে একটি ভগ্ন গুল্ম ও একটি চিতাবাঘের আচরণ দেখে পলাতকদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে সমর্থ হয়েছি– দস্যুবৃত্তি করে সময় অতিবাহিত করলে অবশ্যই এমন পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতার অধিকারী হতাম না।

পরন্তপ সক্রোধে গর্জন করে উঠল, শায়ন! সাবধান! তুমি দক্ষ তিরন্দাজ ও অসিযোদ্ধা সন্দেহ নেই, কিন্তু পরপকে ব্যক্তিগত ভাবে অপমান করলে তুমিও নিস্তার পাবে না। মনে রেখো– প্রবল প্রতাপশালী মহারাজ রুদ্রদমনের রাজ্যেও পরন্তপের নাম সন্ত্রাসের সৃষ্টি করে।

শায়নের দুই চক্ষু প্রখর হয়ে উঠল, সে শীতল স্বরে বলল, আমি কোনো ব্যক্তিকে অপমান করতে চাই না। কিন্তু আমাকে বিদ্রূপ করলে আমি সমুচিত উত্তর দিয়ে থাকি। আরও একটা কথা তুমি জেনে রাখো পরন্তপ কোনো দুরাত্মার নাম আমার অন্তরে সন্ত্রাসের সৃষ্টি করতে পারে না। আমার তরবারি যে-কোনো দুরাত্মাকে মুহূর্ত মধ্যে প্রেতাত্মায় পরিণত করতে পারে।

–সাবধান! শায়ন!

–সাবধান! পরন্তপ!

চকিতে ঝনকার শব্দে কোষমুক্ত হল দুটি তরবার–মধ্যাহ্নের সূর্যালোক আলোক-স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে জ্বলে উঠল শাণিত ইস্পাত-ফলকে!

তৎক্ষণাৎ দুই যুযুধানের মধ্যে হস্ত প্রসারিত করে দাঁড়াল বল্লভ ও কর্ণদেব।

বল্লভ গম্ভীর স্বরে বলল, তোমরা দুজনেই বালকোচিত আচরণ করছ। পরন্তপ! না, না– দারুক! শায়নকে বিদ্রূপ করে তুমি অন্যায় করেছে। আর শায়ন- তোমারও দোষ আছে। এই অভিযানের যে অধিনায়ক, তাকে অপমান করা গর্হিত কর্ম। আশা করি তোমরা পরস্পরের কাছে অন্যায় আচরণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে।

কর্ণদেব তিক্তস্বরে বলল, দারুক! সামান্য কারণে উত্তেজিত হয়ে তুমি নিজেকেই হাস্যাস্পদ করেছ। অসিচালনায় তোমার দক্ষতা শায়নের চাইতে বেশি কি না সেকথা বলতে পারি না, তবে তোমার ভদ্রতাবোধ যে শায়নের চাইতে উন্নতমানের নয়, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। আর শায়ন মুহূর্তের উত্তেজনায় এভাবে আত্মবিস্মৃত হলে কখনো বন্ধুত্ব হয় না। তুমি তাকে হত্যা করে ক্ষমতার পরিচয় দিতে চাইছ? প্রতিমুহূর্তে মৃত্যু যেখানে তোমাকে গ্রাস করার জন্য অপেক্ষা করছে, সেই মৃত্যুভয়াল পথের এক বিশ্বস্ত সঙ্গীকে হত্যা করে তুমি আত্মপ্রসাদ লাভ করতে চাও? ধিক!

দুজনেই লজ্জিত হয়ে মাথা হেঁট করল। দুটি তরবারি আবার কোষের মধ্যে আত্মগোপন করল। প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করল শায়ন, আমি অন্যায় করেছি। শুধু তোমাকে অপমান করিনি, ক্রোধের বশে ভুল করে তোমাকে নিষিদ্ধ নামে সম্বোধনও করেছি। এই ত্রুটি ক্ষমার অযোগ্য। দারুক! তবু তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

-আমারও অন্যায় হয়েছে। তোমার বিশ্লেষণে ভুল থাকলেও তোমাকে বিদ্রূপ করা অনুচিত। শায়ন! তুমিও আমাকে ক্ষমা করো।

সগর্বে মুখ তুলে শায়ন বলল, আমি অন্যায় করেছি; ভুল করিনি! ওই গিরিগুহার সম্মুখে গেলেই বুঝবে আমার অনুমান নির্ভুল।

বেশ, তবে তুমিই অগ্রবর্তী হয়ে পথ দেখাও। আমরা তোমাকে অনুসরণ করছি।

অশ্বপৃষ্ঠে পর্বতের পাদদেশে এসে তারা দেখল অতি সঙ্কীর্ণ গিরিপথ উপর দিকে উঠে গেছে। সে পথে অশ্ব চালনা নিরাপদ নয় বিবেচনা করে তারা পাহাড়ের নীচে একটি বৃক্ষের সঙ্গে অশ্ব চারটিকে রজ্জবদ্ধ করে পর্বতারোহণ শুরু করল…।

নির্দিষ্ট গুহামুখ থেকে তারা যখন প্রায় দশবারো হাত দুরে, সেই সময় হঠাৎ বল্লভের অসতর্ক পদক্ষেপের ফলে একটি প্রস্তর স্থানচ্যুত হয়ে ছিটকে পড়ল। ওই পাথরটির সংঘাতে আরও কয়েকটি ছোটোবড়ো পাথর স্থানত্যাগ করে গড়িয়ে পড়তে লাগল প্রচণ্ড শব্দের তরঙ্গ তুলে…।

সেই শব্দতরঙ্গ স্তব্ধ হওয়ার আগেই গুহামুখ থেকে ভেসে এল সুগম্ভীর কণ্ঠস্বর, তোমরা কারা? এখানে কি চাও?

সচমকে মুখ তুলে চারটি দুর্ধর্ষ মানুষ দেখল গুহার সম্মুখে অপরিসর স্থানটির উপর আবির্ভূত হয়েছে শুল্যের উদ্ধারকতা! এবং, তার হাতের ধনুর্বাণ উদ্যত লক্ষ্যে স্থির হয়ে আছে চার বন্ধুর দিকে!

অকস্মাৎ শায়নের দিকে ফিরে অভিভূত স্বরে পরন্তপ বলল, অদ্ভুত তোমার ক্ষমতা। তোমাকে বারংবার সাধুবাদ জানাচ্ছি। ধন্য! শায়ন! ধন্য!

১৫. পরন্তপের শপথ

আগন্তুক আবার প্রশ্ন করল, তোমরা এখানে কি চাও?

পরন্তপ বলল, আমরা পথিক। পর্বত অতিক্রম করে বিপরীত দিকে যেতে চাই।

নীচে দুই পাহাড়ের মাঝখানে পথের দিকে নির্দেশ করে আগন্তুক বলল, বিপরীত দিকে যেতে হলে ওই পথে যাওয়াই সুবিধা। অনর্থক পর্বত পার হওয়ার প্রয়োজন কি?

অসহিষ্ণুস্বরে পরন্তপ বলল, তোমাকে অত কৈফিয়ত দেব না। ধনুর্বাণ নামাও। আমাদের যেতে দাও।

আগন্তুকের মুখে হাসির আভাস দেখা দিল, তোমাদের গতিবিধি সন্তোষজনক নয়। উপরে উঠে তোমরা আমাকে আক্রমণ করতে পারো। বিশেষত আমার এক সঙ্গী অসুস্থ অবস্থায় গুহার ভিতর বিশ্রাম করছে। তার নিরাপত্তার কথাও আমি ভাবছি। অতএব, তোমাদের আমি উপরে উঠতে দেব না।

কর্ণদেব হঠাৎ বলে উঠল, পথিক! পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তুমি আমাদের উপর অত্যাচার করছ। অতর্কিতে ধনুর্বাণ উদ্যত করায় আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। অসি হস্তে সম্মুখীন হলে তোমাকে উচিত শাস্তি দিতাম।

আগন্তুকের মুখের হাসি বিস্তৃত হল, চারজনের বিরুদ্ধে একাকী যুদ্ধে ব্যাপৃত হলে আমি যে বিপন্ন হব সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সেইজন্যই তো তোমাদের উপরে উঠতে দেব না।

তারপর পরন্তপের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে এই দলের নেতা মনে হচ্ছে। এই বালক দস্যুটিকে কোথা থেকে সংগ্রহ করলে?

শায়ন ও বল্লভ চিৎকার করে উঠল, আমরা দস্যু নই।

কর্ণদেব ক্রুদ্ধস্বরে বলল, তোমাকে বিপন্ন করার জন্য চারজনের প্রয়োজন নেই। ধনুর্বাণ ফেলে অসি গ্রহণ করলে আমি একাকী তোমাকে সমুচিত দণ্ড দিতে পারি। এস। অসি গ্রহণ করো। তোমাকে আমি দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করছি।

আগন্তুক হাসিমুখে বলল, পরিকল্পনাটি ভাল। তোমার সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেই তোমার সঙ্গীরা উপরে উঠে আমাকে ঘিরে ফেলতে পারে। বালক! তোমার প্রস্তাবে সম্মত হওয়ার মতো নির্বোধ আমি নই।

কর্ণদেব বলল, আমি শপথ করছি আমার সঙ্গীরা যুদ্ধে বাধা দেবে না। ধনুর্বাণ সংবরণ করে অসি হাতে নাও।

আগন্তুক বলল, দস্যর শপথে আমি বিশ্বাস করি না।

কর্ণদেব কি যেন বলতে যাচ্ছিল, তাকে বাধা দিয়ে পরন্তপ বলল, বারংবার আমাদের তুমি দস্যু বলছ কেন? আমরা যে দস্যু তার কোনো প্রমাণ আছে?

-আছে। আমার সঙ্গীর উপর একদল দস্যু অত্যাচার করছিল। আমার সঙ্গী যে এক সময়ে ঐ দস্যুদলেরই দলপতি ছিল, সে কথাও সে আমাকে বলেছে। তার অন্তিমকাল উপস্থিত। তাই তার নাম আর পরিচয় আমাকে জানাতে সে দ্বিধাবোধ করেনি। আমার বিশ্বাস শল্যকে হত্যা করার জন্যই তোমরা এসেছ। যাদের কবল থেকে আমি ওকে উদ্ধার করেছি, তোমরা নিশ্চয়ই সেই দুস্যদলের অন্তর্ভুক্ত। নচেৎ, সমতল ভূমিতে সহজ পথ থাকতেও তোমরা পর্বতে আরোহণ করছ কেন?

চিন্তিতস্বরে পরন্তপ বলল, শল্য তোমাকে তার নাম জানিয়েছে বুঝতে পারছি। সে যে দস্যুদলের অধিপতি ছিল, সেকথাও গোপন করেনি। অন্তিমকাল উপস্থিত দেখে উদ্ধারকর্তাকে তার প্রকৃত পরিচয় দিতে সে ইতস্তত করে নি। কিন্তু সব কথা সে কি তোমায় বলেছে?

–আর কি কথা থাকতে পারে? তার ব্যক্তিগত জীবনের তথ্য জানার আগ্রহ আমার নেই।

পরন্তপ এক মুহূর্ত হেঁটমুণ্ডে চিন্তা করল, তারপর সহস্য মুখ তুলে বলে উঠল, শোনো; আমরা তার সন্ধানেই এসেছি তোমার এই অনুমান সত্য। কিন্তু আমরা তাকে হত্যা করতে আসিনি। তার বিপদের সংবাদ পেয়ে তাকে উদ্ধার করতেই এসেছিলাম। কিন্তু আমরা কিছু করার আগেই তুমি শল্যকে দুস্যদের কবল থেকে মুক্ত করেছ। সে যে আহত হয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে, এই কথা শুনে আমি অতিশয় চিন্তিত। তুমি আমার নাম জানিয়ে শল্যকে জিজ্ঞাসা করো সে আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চায় কি না– যদি সে অসম্মতি জানায়, তাহলে আমরা ফিরে যাব। আশা করি এই প্রস্তাবে তোমার আপত্তি হবে না।

আগন্তুক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল, তারপর বলল, তোমার প্রস্তাব মেনে নিচ্ছি। যদি সত্যই তোমরা তার মিত্র হও, তাহলে অন্তিমকালে শেষ সাক্ষাঙ্কারে বাধা দেওয়া আমার পক্ষে অনুচিত। বললো, কি তোমার নাম?

– পরন্তপ।

আগন্তুকের ললাট ও ভ্রূ কুঞ্চিত হল, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক তোমরা ক্ষণকাল বিলম্ব করো। আমি শল্যকে জিজ্ঞাসা করে আসছি।

গুহামধ্যে তার দেহ অদৃশ্য হতেই কর্ণদেব বলল, তোমার নাম বলে ভুল করেছে পরন্তপ।

উপায় কি? পরন্তপও বলল, শল্যের অনুমতি ছাড়া ওই ব্যক্তি কিছুতেই আমাদের উপরে উঠতে দেবে না। আরও একটা কথা– এই রাজ্যে পরন্তপ নামে একাধিক ব্যক্তির অস্তিত্ব থাকতে পারে, আমিই যে দস্যু পরন্তপ সে-বিষয়ে সে নিশ্চিত হবে কেমন করে?

কর্ণদেব বলল, ওই ব্যক্তি জানে শল্য দস্যু-দলপতি। দস্যু পরন্তপের নাম এই দেশে কারও অবিদিত নয়। খুব স্বাভাবিক যুক্তি দিয়েই সে ধরে নিতে পারে এক দস্যুর সঙ্গে আর এক দস্যুর পরিচয় বা মিত্রতা ঘটতে পারে। সুতরাং–

কর্ণদেবের কথা শেষ হওয়ার আগেই গুহার মুখে আবির্ভূত হল আগন্তুকের দীর্ঘ দেহ। সে বলল, পরন্তপ! শল্য তোমাকে দেখা করার অনুমতি দিয়েছে। তুমি একাকী নিরস্ত্র ভাবে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারো। তোমার সঙ্গীদের ওখানেই থাকতে হবে।

নিঃশব্দে অস্ত্রত্যাগ করে উপরে উঠে গেল পরন্তপ, তারপর গুহার মধ্যে প্রবেশ করল।

পরন্তপের তিন সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে আগন্তুক বলল, তোমরা যেখানে আছ, সেখানেই থাকো। উপরে ওঠার চেষ্টা করলে বিপদ ঘটবে। আমি গুহার ভিতর থেকে নজর রাখছি।

সে গুহার ভিতর অদৃশ্য হল।

পরন্তপ তখন আহত শল্যের পাশে বসে পড়েছে, তার চোখে মুখে উৎকণ্ঠা পরিস্ফুট।

শল্যের পিঞ্জরে বিদ্ধ বাণটির দিকে তাকিয়ে সে বলল, ওটাকে ক্ষতমুখ থেকে টেনে ফেলে দিলে হয়তো তুমি স্বস্তি পাবে।

ম্লান হেসে শল্য বলল, এখন আর কোনো চেষ্টা করে লাভ নেই। আমার আয়ু সীমিত। মৃত্যুর পদধ্বনি আমি শুনতে পাচ্ছি।

পাশ থেকে আগন্তুক বলে উঠল, ক্ষতমুখ থেকে বাণ উৎপাটিত করলে প্রবল বেগে রক্তপাত হয়ে এখনই প্রাণসংশয় ঘটতে পারে।

অতিকষ্টে শাসগ্রহণ করতে করতে শল্য বলল, আমার মৃত্যু অনিবার্য। বাণ তুলে ফেলার চেষ্টা করলে দারুণ যন্ত্রণা হবে। অনর্থক কষ্টভোগ করাতে চাই না… পরন্তপ! আমার আয়ু ফুরিয়ে এসেছে। বলল, কি বলতে চাও?

পরন্তপ অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আগন্তুকের দিকে কটাক্ষ করল। আগন্তুক সেই দৃষ্টির অর্থ বুঝল কি না বলা যায় না, কিন্তু সে যথাস্থানে দাঁড়িয়ে রইল অটল হয়ে।

শল্যের ওষ্ঠাধরে ক্লিষ্ট হাসির রেখা দেখা দিল, পরন্তপ! আমি জানি তুমি গুপ্ত ধনভাণ্ডারের সন্ধানে এসেছ- তাই নয় কি?

পরন্তপ সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে সায় দিল।

শল্য বল্ল, তুমি নিশ্চয় আমার বিপদের সংবাদ পেয়ে আমাকে উদ্ধার করতে এসেছিলে? শুনলাম, তোমার সঙ্গে অস্ত্রধারী অনুচর আছে?

পরন্তপ আবার সায় দিল।

শল্য বলল, আমি ওদের গুপ্তধনের সন্ধান দিতে রাজি হইনি, তোমাকে সন্ধান দেব এমন কথা তুমি ভাবছ কেন?

পরন্তপ বলল, ওরা তোমার উপর অত্যাচার করছিল। আমি তোমাকে উদ্ধার করতাম এবং গুপ্তধনের সন্ধান পেলে তোমাকে অর্ধাংশ দিতে সম্মত হতাম। ওদের প্রতিশ্রুতির কোনো মূল্য নেই। গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া মাত্র প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করে ওরা তোমাকে হত্যা করত। কিন্তু আমি কখনো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করি না। আমাদের সাহায্যে তোমার প্রাণরক্ষা হলে, আমার প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রেখে তুমি স্বয়ং আমাদের যথাস্থানে নিয়ে যেতে বলেই আমার মনে হয়।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে শল্য বলল, সত্য। পরন্তপ কখনো বিশ্বাসভঙ্গ করে না একথা দস্যুমহলে সবাই জানে। কিন্তু আমি এখন মৃত্যুপথযাত্রী; তোমাকে যথাস্থানে নিয়ে যাওয়ার আগেই আমার মৃত্যু হবে।

পরন্তপ বলল, তা বটে। তবে যদি গুপ্তধনের সন্ধান দাও, তাহলে আমরা ওই ধন উদ্ধার করতে প্রাণপণ করব। তোমার কোনো আত্মীয়-স্বজন থাকলে তার নাম-ধাম আমাকে জানাও। আমি শপথ করছি তোমার প্রাপ্য অর্ধাংশ–

বাধা দিয়ে শল্য বলল, আমার কোনো আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধব নেই। কিন্তু

একটু থেমে হাত বাড়িয়ে দণ্ডায়মান আগন্তুকের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে শল্য বলল, কিন্তু এই অপরিচিত ব্যক্তিকে আমি পরমাত্মীয় জ্ঞান করি। আমাকে উদ্ধার করার জন্য এই ব্যক্তি নিজের প্রাণ বিপন্ন করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। পরন্তপ! আমি বাঁচব না। যদি আমার অর্ধাংশ ওকে দিতে সম্মত হও, তাহলে আমি তোমাকে গুপ্তধনের সন্ধান দিয়ে যাব। বলল, আমার প্রস্তাবে তুমি সম্মত?

একটু ইতস্তত করে পরন্তপ বলল, হ্যাঁ।

শল্য বলল, প্রতিজ্ঞা করছ?

পরন্তপ একবার পাশেই দণ্ডায়মান আগন্তুকের মুখের উপর দৃষ্টিনিক্ষেপ করল। সেই মুখ পাথরের মতো ভাবলেশহীন নির্বিকার; মনে হল গুপ্তধন সংক্রান্ত কোনো কথাই তার কানে যায় নি, অথবা কানে গেলেও এ বিষয়ে তার কিছুমাত্র আগ্রহ নেই।

শল্য বলল, পরন্তপ! আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। শপথ করো, আমার প্রাপ্য অর্ধাংশ এই ব্যক্তিকে দেবে? শপথ না করলে ধনভাণ্ডারের সন্ধান পাবে না।

পরন্তপ দৃঢ়কণ্ঠে বলল, শপথ করছি, যদি গুপ্তধনের সন্ধান পাই, তাহলে অর্ধাংশ এই ব্যক্তির হাতে সমর্পণ করব। আমার কথার অন্যথা হবে না।

তবে শোন, অতিকষ্টে শ্বাস নিতে নিতে শল্য বলল, উত্তর-পশ্চিম দিক ধরে অগ্রসর হলে শ্রাবস্তী ও কৌশাম্বী রাজ্যের সীমানায় একটি পাহাড়ের গুহায় ওই ধনভাণ্ডার লুকানো রয়েছে। ওই অঞ্চলের পর্বতমালার মধ্যে বিশেষ পর্বতটিকে সনাক্ত করার উপায় আমি বলে দিচ্ছি। পাহাড়টির চেহারা অবিকল মাংসহীন নরমুণ্ডের মতো। কঙ্কাল-করোটির আকার বিশিষ্ট ওই পর্বতের গুহামুখে– অর্থাৎ, নরমুণ্ডের মুখের মধ্যে প্রবেশ করলে গুহার গায়ে আমার নামের আদ্যাক্ষর খোদিত আছে দেখবে। ওইখানে পপ-পশ–ওঃ! পরক্তপ! বড়ো কষ্ট- একটু জল!

জল। পরন্তপ বিব্রত মুখে বলল, জল এখানে কোথায় পাব?

শল্যের সমস্ত দেহ ধনুকের মতো বেঁকে গিয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল; অধর প্রান্তে উঠে এল একঝলক রক্ত। তারপর মুখের দুইপাশে চোয়াল বেয়ে ঝরে পড়ল সেই রক্তের ধারা। শল্যের দেহের উপর ঝুঁকে পড়ে পরন্তপ ডাকল, শল্য! শল্য!

আগন্তুক বলল, কাকে ডাকছ? তোমার বন্ধুর মৃত্যু হয়েছে।

ঘুরে দাঁড়িয়ে আগন্তুকের মুখের উপর দুই চোখের দৃষ্টি মেলে পরন্তপ বলল, তুমি সব কথাই শুনেছ। গুপ্তধন পাওয়া গেলে অর্ধাংশ তোমাকে নিশ্চয়ই দেব। পথের আপদ-বিপদ সম্পর্কে তোমাকে সতর্ক করা নিষ্প্রয়োজন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তোমার নির্ভীক চরিত্রের পরিচয় আমরা পেয়েছি। তবে–

-তবে কি?

শ্রাবস্তী ও কোশলের সীমান্ত বহু ক্রোশ ধরে বিস্তৃত। ওই কঙ্কালকররাটির আকার-বিশিষ্ট পর্বতের সন্ধান পেতে বেশ বিলম্ব হবে। চারদিকে অনার্যপ্রহরীর দল সর্বদাই

বাধা দিয়ে আগন্তুক বলল, পাহাড়টি বহু কাল পূর্বেই আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ওই পথে আমি বহুকাল ধরে যাতায়াত করছি। স্থানীয় বনপথে চলাচলের অভিজ্ঞতা আমার আছে। কোন পথে কিভাবে চললে অনার্যসেনার দৃষ্টিকে ফাঁকি দেওয়া যাবে তা আমি জানি। নিতান্তই যদি ধরা পরি, তাহলে যথাসময়ে যথাকৰ্তব্য করা যাবে। এখন থেকে সম্ভাব্য বিপদের কথা ভেবে দুশ্চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।

স্থির দৃষ্টিতে আগন্তুকের মুখের দিকে তাকিয়ে পরন্তপ বলল, তুমি পরন্তপের যোগ্য সঙ্গী বটে। তোমার নাম?

আমার নাম শশক।

আগন্তুকের পেশীবদ্ধ বিপুল বপুর দিকে তাকিয়ে পরন্তপ সবিস্ময়ে বলে উঠল, তোমার নাম শশক? আশ্চর্য!

নিজের দেহের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বিব্রত মুখে শশক বলল, আমি সার্থকনামা মানুষ নই। শশক নামটিও আমি পছন্দ করি না।

পছন্দ হওয়ার কথা তো নয়, পরন্তপ হেসে বলল, কিন্তু নামকরণের উপর আমাদের তো হাত নেই। জনক-জননী বা আত্মীয়-স্বজনই আমাদের নামকরণ করে থাকেন। তবে তোমার ন্যায় শক্তিশালী পুরুষের নাম শশক হওয়া অনুচিত একথা বলতে পারি।… শশক! যদি অনুমতি দাও, তাহলে আমার সঙ্গীদের আমি উপরে আসতে বলি। আজ থেকে তুমিও যে আমদের সহচর সেকথা তাদের জানানো প্রয়োজন।

আগন্তুক কিছু বলতে গেল, কিন্তু সে কথা বলার আগেই পার্বত্যপথের নীচ থেকে কর্ণদেবের উচ্চকণ্ঠ ভেসে এল, পরন্তপ! পরন্তপ! সতর্ক হও! সামনে সমূহ বিপদ!

পরক্ষণেই তাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করল এক ভয়াবহ আতধ্বনি! সেই আর্তনাদের কেশ স্তব্ধ হওয়ার আগেই পাহাত্মে সানুদেশে গুহার নিকটবর্তী স্থান থেকে ভেসে এল রক্তজল করা শব্দের তরঙ্গ!

.

১৬. গিরিপথে মৃত্যুর হানা

শশক তার ধনুর্বাণ পৃষ্ঠদেশে স্থাপন করেছিল, এখন ঝটিতি পিঠ থেকে ধনুক নিয়ে তাতে শর যোজনা করে বলে উঠল, নেকড়ের আর্তনাদ! নেকড়ের চিৎকার!

পরন্তপ বলল, অনেকগুলো নেকড়ের চিৎকার! প্রথম যে নেকড়েটা আর্তনাদ করেছিল, সেটা নিশ্চয়ই আমার সঙ্গীদের তিরের আঘাতে আহত হয়েছিল।

উত্তর না দিয়ে শশক একলাফে গুহার বাইরে এসে দাঁড়াল। বিনা বাক্যবয়ে তার সঙ্গী হল পরন্তপ। শশকের নির্দেশ অনুসারে সে গুহার মধ্যে নিরস্ত্র অবস্থায় প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছিল, এখন পরিত্যক্ত অস্ত্রে কথা তার মনে হল;- দ্বিধা মুহূর্তের জন্য অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করতে না জানলে মহারাজ রুদ্রদমনের রাজ্যে এতকাল দুস্যবৃত্তি করতে পারত না পরন্তপ-শশকের সঙ্গ নেওয়ার আগে গুহাতল থেকে একটি প্রস্তর তুলে নিতে তার ভুল হয়নি। প্রস্তরটিকে দৃঢ়মুষ্টিতে ধারণ করে পরন্তপ গুহার বাইরে এসে দাঁড়াল।

গুহার দক্ষিণে যে স্বল্প-পরিসর স্থান বৃত্তাকারে ঘুরে গেছে, সেইদিকে তাকিয়ে তারা দেখতে পেল পাঁচ-ছয়টি নেকড়ে সেখানে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে আছে লোলুপ দৃষ্টিতে! তাদের ক্ষুধিত-দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে পরন্তপের তিন সঙ্গীকে! সামনে জ্যান্ত খাবার দেখেও নেকড়ের দল গিরিপথ ধরে কেন নামছে না এই রহস্যের সমাধান পড়ে আছে গুহার অনতিদূরে- তীরবিদ্ধ একটি নেকড়ের মৃতদেহ থেকে ঝরে পড়ছে রক্তের ধারা!

নীচে গিরিপথের উপর ধনুকে বাণ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শায়ন ও কর্ণদেব। তাদের পাশেই প্রকাণ্ড কুঠার হস্তে অবস্থান করছে গেরুয়াধারী বল্লভ।

শায়ন ও কর্ণদেব আবার তীর নিক্ষেপ করল। দুটি নেকড়ে চিৎকার করে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে পড়ল। অন্যান্য জন্তুগুলি তাড়াতাড়ি পিছিয়ে পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিল।

পরন্তপ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করল

গুহার অদুরে দুটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী শূন্যস্থানকে পরিপূর্ণ করে সেতুর আকারে বিরাজ করছে দুটি প্রকাণ্ড বৃক্ষকাণ্ড। খুব সম্ভব গিরিপথে যাতায়াত করার জন্য স্থানীয় মানুষ অথবা কোনো শিকারি ওইভাবে গাছ কেটে সেতু প্রস্তুত করেছিল। পরন্তপ ও তার সঙ্গীরা যে পাহাড়টায় রয়েছে, তার পাশের পাহাড়ে ওই গাছের গুঁড়ির পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো নেকড়ে। নেকড়েবাহিনীর অগ্রবর্তী একটা ছোটো দল পার্শ্ববর্তী পর্বত অতিক্রম করার সময়ে সম্ভবত পরন্তপের সঙ্গীদের দেখতে পেয়েছে, আর তার ফলেই এই বিপত্তি। নেকড়েরা শিকার দেখলে চিৎকার করে সঙ্গীদের জানিয়ে দেয়- অগ্রবর্তী দল যখন চিৎকার করে পশ্চাৎবর্তী বাহিনীকে শিকারের সংবাদ জানাচ্ছিল, সেই ভয়ংকর জান্তব উল্লাসের ধ্বনি একটু আগে শুনতে পেয়েছিল পরন্তপ ও শশক। তার আগেই আক্রমণোদ্যত নেকড়েদের দেখে শায়ন অথবা কর্ণদেব তির নিক্ষেপ করে একটি পশুকে হত্যা করেছে শাপদ-কণ্ঠের সেই মৃত্যুকাতর আর্তনাদ শশক ও পরন্তুপের শ্রুতিগোচর হয়েছে প্রথমেই।

হঠাৎ একটি নেকড়ে মুখ তুলে চিৎকার করে উঠল আক্রমণের পূর্ব-সংকেত! সঙ্গে সঙ্গে গাছের গুঁড়ির সেতু বেয়ে ছুটে এল অনেকগুলি জানোয়ার;- এধারে পাথরের আড়ালে যে নেকড়েগুলি দাঁড়িয়েছিল, তারাও সঙ্গীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ধেয়ে এল নীচে গিরিপথে দণ্ডায়মান তিনটি মানুষের দিকে!

গিরিপথ আর গুহার মাঝখানে সঙ্কীর্ণ চাতালের মতো জায়গাটাতে পৌঁছানোর আগেই তলা থেকে তিরের পর তির ছুটে এসে আক্রমণে উন্মুখ নেকড়েবাহিনীর অধিকাংশকেই মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিল। দুটি জানোয়ার গিরিপথের মুখে এসে পৌঁছাল বটে, কিন্তু নীচের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই শশক অব্যর্থ সন্ধানে শরনিক্ষেপ করে একটি জন্তুকে হত্যা করল। আবার ধনুকে বাণ লাগানোর সুযোগ পেল না শশক- দ্বিতীয় নেকড়েটা হিংস্রভাবে দন্তবিকাশ করে নতুন শত্রুর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পরন্তপ শক্ত মুঠিতে পাথরটা চেপে ধরে শূন্যে হাত তুলল, কিন্তু উদ্যত মুষ্টি যথাস্থানে আঘাত করার পূর্ব মুহূর্তেই শশকের প্রচণ্ড পদাঘাতে নেকড়েটা ছিটকে পড়ল পাহাড় থেকে নীচে।

হঠাৎ দুইদিক থেকে আক্রান্ত হয়ে নেকড়ে বাহিনী চমকে গেল। তিরের নাগালের বাইরে ছোটো বড়ো পাথরের আড়াল থেকে তারা মানুষগুলোর উপর নজর রাখতে লাগল।

উপর থেকে হাঁক দিয়ে পরন্তপ বলল, শায়ন! কর্ণদেব! তোমরা উপরে উঠে এসো। আমার সঙ্গী তোমাদের বাধা দেবে না।

শায়ন বলল, তোমার সঙ্গী বাধা না দিলেও আমরা এখন উপরে উঠে গুহার মধ্যে প্রবেশ করব না।

–কেন? ভিতরে এলে তোমরা কিছুটা নিরাপদ হবে।

না। সেই নিরাপত্তা সাময়িক। আমরা গুহায় প্রবেশ করলেই জন্তুগুলো গুহামুখ থেকে শুরু করে গিরিপথের চারধারে ছড়িয়ে পড়বে, আর সকলেই হব গুহার মধ্যে বন্দি। এখন দুদিক থেকে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে ওরা গুহার সামনে এসে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে পারছে না।

কর্ণদেব বলল, শয়ান! আমরা কতক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকব?

পরন্তপ কিছু বলার আগেই বল্লভের উদাত্তকণ্ঠ ভেসে এল, তোমরা উপরে উঠে যাও। আমি যা করার করছি।

পরন্তপ সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল, কি করতে চাও বল্লভ?

কোনো উত্তর না দিয়ে বল্লভ সঙ্কীর্ণ গিরিপথ বেয়ে উপরে উঠে এসে গুহার মুখে দাঁড়াল, একবার শশকের দিকে দৃষ্টিপাত করল, তারপর দৃঢ়মুষ্টিতে কুঠার ধরে বৃক্ষকাণ্ডে গঠিত সেতুর দিকে অগ্রসর হল।

নেকড়েরা এতক্ষণ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মানুষগুলোর গতিবিধি লক্ষ করছিল। বল্লভ তাদের কাছাকাছি আসতেই পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে সগর্জনে তেড়ে এল। সেতুর ওপারে যে নেকড়েগুলো দাঁড়িয়েছিল, তারাও দলে দলে সেতু পার হতে শুরু করল।

তির ছুড়লে বল্লভের গায়ে লাগতে পারে তাই, শায়ন ও কর্মদেব ধনুর্বাণ নামিয়ে ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বল্লভের দিকে। শশক একবার বল্লভের দিকে দৃষ্টিপাত করল, তারপর খাপ থেকে তলোয়ার খুলে পিছন পিছন এগিয়ে গেল।

কিন্তু শশকের তরবারিতে এক ফোঁটা রক্তের দাগও পড়ল না। বল্লভের প্রচণ্ড কুঠার ঘুরতে লাগল বিদ্যুদ্বেগে এবং পাহাড়ের গায়ে রক্তের স্রোত ছুটিয়ে ছিটকে পড়তে লাগল নেকড়েদের ছিন্ন ভিন্ন মৃতদেহ! কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ! হতাবশিষ্ট নেকড়েগুলি গাছের গুঁড়ির সেতু পার হয়ে অপর দিকে পাহাড়ে তিরবেগে পলায়ন করল। বল্লভ তবু থামল না, সেতুর সামনে এসে সে কুঠার তুলল। রক্তাক্ত কুঠার ফলক সবেগে নেমে এল বৃক্ষকাণ্ডে নির্মিত সেতুর উপর। উপরি-উপরি দুবার আঘাত করতেই বিশাল বৃক্ষ দুটি খণ্ডিত হয়ে তলায় ছিটকে পড়ল।

কুঠার নামিয়ে সঙ্গীদের দিকে দৃষ্টিপাত করে বল্লভ বলল, আপদ শান্তি। ওরা এখন আর আমাদের বিরক্ত করবে না।

তারপর পিছন ফিরে তরবারি হাতে শশককে দেখে হেসে বলল, আমাকে সাহায্য করতে এসেছ বলে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তবে এ যাত্রা তোমার তরবারি ব্যবহারের প্রয়োজন হল না।

কর্ণদেব ও শায়ন ততক্ষণে উঠে এসেছে গুহার মুখে। সকলকে ডাক দিয়ে পরন্তপ বলল, বন্ধুগণ! এদিকে এসো।

শশকের সঙ্গে বল্লভ এসে দাঁড়াল পরন্তপের সম্মুখে। তাদের পাশেই দণ্ডায়মান হল শায়ন ও কর্ণদেব।

তোমরা শোন, পরন্তপ বলল, এই ব্যক্তির নাম শশক। আজ থেকে এই অভিযানে শশকও আমাদের সঙ্গী।

এই অভাবিত ঘোষণায় সকলেই চমকে উঠল, কিন্তু কেউ কোনো অভিমত প্রকাশ করল না।

কর্ণদেব জিজ্ঞাসা করল, শল্য কোথায় যাবে?

পরন্তপ বলল, শল্যের মৃত্যু হয়েছে। অন্তিমকালে তার অনুরোধেই আমি শশককে দলভুক্ত করেছি এবং শল্যের প্রাপ্য অর্ধাংশ শশককে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি।

শশক! সবিস্ময়ে বল্লভ বলল, এই বৃষস্কন্ধ ব্যঢ়োরস্ক প্রকাণ্ড পুরুষের নাম শশক?

শায়ন আর কর্ণদেব শশকের নামকরণ সম্পর্কে তাদের মতামত প্রকাশ করতে উদ্যত হল, কিন্তু তাদের মুখের কথা মুখেই থেকে গেল–

বল্লভ ভ্রূ কুঞ্চিত করে বলল, নেকড়েরা হঠাৎ চিৎকার করছে কেন? ওরা কি তলা থেকে এই পাহাড়ে উঠে আমাদের আক্রমণ করতে চায়?

পরন্তপ বলল, বোধহয় না। একবার আমাদের আক্রমণ করতে এসে ওদের যা অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে দ্বিতীয়বার ওরা এদিকে আসতে সাহস করবে বলে মনে হয় না।

কর্ণদেব বলল, আমারও তাই মনে হয়। তবে নেকড়ের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান নিতান্তই সীমাবদ্ধ।

শায়ন এতক্ষণ স্থির হয়ে বসে নেকড়ের চিৎকার শুনছিল। সে বলল, নেকড়েরা বিভিন্ন ধরনের শব্দে বিভিন্ন প্রকার মনোভাব প্রকাশ করে। এখন ওদের চিৎকারের ধরন শুনে বুঝতে পারছি শিকারের সন্ধান পেয়ে ওরা উল্লাস প্রকাশ করছে।

তা হবে, পরন্তপ বলল, কোন বন্যপশুকে লক্ষ্য করে ওরা যদি উল্লাস জানায় আমার আপত্তি নেই। আমাদের উপর ওদের দৃষ্টি আকৃষ্ট না হলেই মঙ্গল। মাংসাহারী শ্বাপদের ভক্ষ্য হয়ে অনেক জীবই জন্মগ্রহণ করেছে, সেইরকম কোনো

হঠাৎ থেমে গিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে পরন্তপ বলে উঠল, আমাদের চারটি অশ্ব পাহাড়ের নীচে রজ্জবদ্ধ আছে। তাদের লক্ষ্য করে ওরা চিৎকার করছে না তো?

সচমকে পিঠ থেকে ধনুর্বাণ টেনে নিয়ে শায়ন বলল, তাই তো! খুব সম্ভব তোমার আশঙ্কা

একলাফে গুহার বাইরে এসে দ্রুতবেগে গিরিপথ বেয়ে নামতে লাগল শায়ন। বিনা বাক্যব্যয়ে তাকে অনুসরণ করল সবাই। গিরিপথের উপর থেকে পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র তুলে নিয়ে পরন্তপও পাহাড় থেকে নামতে লাগল দ্রুতবেগে।…

আশঙ্কা সত্য। রজ্জবদ্ধ অশ্বদের লক্ষ্য করে ছুটতে ছুটতে হিংস্র উল্লাসে চিৎকার করছে নেকড়ে পাল।

পরন্তপ ও তার সঙ্গীরা পায়ের গতি বাড়িয়ে দিল। প্রাণ বিপন্ন করে বিপজ্জনক সঙ্কীর্ণ পথ বেয়ে তারা ক্ষিপ্রচরণে নীচে নামতে লাগল।…

হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে হতাশ কণ্ঠে পরন্তপ বলল, বৃথা চেষ্টা। আমরা কাছাকাছি যাওয়ার আগেই নেকড়ের দল ঘোড়াগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

একটি অশ্ব প্রাণপণ চেষ্টায় বন্ধনরঙ্কু ছিন্ন করে ছুটে পালাল। অন্য তিনটি জানোয়ার দারুণ আতঙ্কে হ্রষাধ্বনি করতে লাগল বারংবার।

অধর দংশন করে কর্ণদেব ধনুর্বান তুলল। মুহূর্তে ছুটে গেল তির। একটি নেকড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। নেকড়েরা ফিরেও তাকাল না। আবার ছুটল তির- একবার শায়নের ধনুক থেকে। আরও একটি নেকড়ে তিরবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুযাতনায় ছটফট করতে লাগল। নেকড়েবাহিনীর ভ্রূক্ষেপ নেই। তারা খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে। এখনই তীক্ষ্ণ শ্বাপদদন্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে তিনটি অশ্বের দেহ।

শায়ন হঠাৎ ধনুর্বাণ তুলে অশ্বতিনটির দিকে লক্ষ্যস্থির করল। পরন্তপ বিস্মিত কণ্ঠে চিৎকার করে বলল, শায়ন! ও কি করছ?

পরক্ষণেই শায়নের ধনুক থেকে জ্যামুক্ত তির ছুটে গিয়ে একটি অশ্বের বন্ধনরঙ্কু ছিন্ন করে দিল! মুক্ত পশু প্রাণপণে ছুটে পলায়ন করতে লাগল। তীব্রতর কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল নেকড়ের দল।

ধনুকে তির লাগিয়ে আবার নিশানা স্থির করতে লাগল শায়ন। অকস্মাৎ তার কানের কাছে। বেজে উঠল ধনুকের টঙ্কার ধ্বনি- বিদ্যুঝলকের মতো একটি বাণ ছুটে গিয়ে আর একটি অশ্বের বন্ধনরঙ্কু কেটে তাকে মুক্তি দিল!

চমকে উঠে সবিস্ময়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে শায়ন দেখল তুণীর থেকে আর একটি তির টেনে নিয়ে ধনুকে যোজনা করছে শশক।

আবার ধনুষ্টঙ্কার! শশকের নিক্ষিপ্ত দ্বিতীয় তীর শেষ অশটিকে রজ্জ্বর বন্ধন থেকে নিষ্কৃতি দিল। ভীষণ চিৎকারে চারদিকে কাঁপয়ে নেকড়ের পাল অশ্বটিকে অনুসরণ করল। কিন্তু বেগবান অশ্ব তখন প্রাণভয়ে ছুটছে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সারিবদ্ধ বৃক্ষ আর উদ্ভিদের অন্তরালে সে আত্মগোপন করল। তার পশ্চাদ্ধাবন করে অরণ্যগর্ভে অদৃশ্য হল নেকড়ের দল।…

শশকের দিকে তাকিয়ে শায়ন বলল, তুমি আশ্চর্য ধনুর্ধর! লক্ষ্যভেদে সিদ্ধহস্ত এমন তিরন্দাজ আগে কখনও দেখিনি।

শশক হেসে বলল, এতখানি বয়সেও তুমি কখনও দর্পণ ব্যবহার করোনি, জেনে বিস্মিত হলাম।

শায়ন লজ্জিতভাবে বলল, দর্পণ ব্যবহার করব না কেন?… গর্ব ছিল আমার তুল্য তিরন্দাজ এই রাজ্যে নেই। তুমি আমার সেই দর্প চূর্ণ করেছ।

পরন্তপ বলল, একথা সত্য। শায়নের ধনুর্বিদ্যার খ্যাতি আমার কানেও এসেছে। তাই আজ তার লক্ষ্যভেদের ক্ষমতা দেখে আশ্চর্য হলেও খুব বেশি বিস্মিত হইনি। তুমি আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছ। ধনুর্বিদ্যায় তোমার ক্ষমতা শায়নের চাইতে কম নয়।

এই ব্যক্তির নাম শায়ন? শশক শায়নের দিকে দৃষ্টিপাত করল, তিরন্দাজ শায়নের অদ্ভুত ক্ষমতার কথা আমিও শুনেছি। শুধু ধনুর্বিদ্যায় নয়– অসিচালনাতেও শায়নের খ্যাতি শ্রাবস্তী রাজ্যে জনশ্রুতিতে পরিণত হয়েছে। আজ এই আশ্চর্য পুরুষের সাক্ষাৎলাভ করে ধন্য হলাম।

কর্ণদেব বলল, অসিচালনায় শশকও কিছু কম নয়। শল্যকে উদ্ধার করার সময়ে যে দস্যু-দলপতিকে শশক অসির আঘাতে হত্যা করেছিল, তার মৃতদেহ আমি দেখেছি। মৃত দলপতির ব্রহ্মতালু থেকে চিবুকের উপরার্ধ পর্যন্ত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। আসুরিক শক্তির সঙ্গে অসামান্য দক্ষতার যোগাযোগ ঘটলেই ওইভাবে আঘাত করা সম্ভব।

শশক চমকে উঠে বলল, তোমরা আমাকে ওই সময়ে দেখেছ?

পরন্তপ বলল, হ্যাঁ। আমরা দুর্বৃত্তদের আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিলাম; অকস্মাৎ বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মতো আবির্ভূত হয়ে তুমি আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা পণ্ড করে দিয়েছ। তবে সব ভালো যার, শেষ ভালো তার– তোমার মতো নিপুণ যোদ্ধাকে দলভুক্ত করে আমাদের শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে।

আমিও বীর্যবান পুরুষদের সাহচর্যে এসে নিজেকে ধন্য মনে করছি; কিন্তু পরন্তপ! একটা কাজ তোমার ভালো হয়নি, কর্ণদেবের দিকে দৃষ্টিপাত করে শশক বলল, এই বালককে দলভুক্ত করা অন্যায় হয়েছে।

কর্ণদেবের মুখ ক্রোধে আরক্ত হল। অপাঙ্গে সেইদিকে তাকিয়ে পরন্তপ বলল, শশক! বয়স কম বলে কর্ণদেবকে অবজ্ঞা করো না। অসিচালনায় ওর সমকক্ষ যোদ্ধা খুব কমই আছে।

সায় দিয়ে শায়ন বলল, সত্য কথা। আমি ওকে অসিচালনা করতে দেখেছি। পরন্তপের উক্তি আদৌ অত্যুক্তি নয়।

বল্লভ বলল, কর্ণদেবকে আমি তরবারি ব্যবহার করতে দেখিনি। কিন্তু আমার চোখের সামনে ও বামহস্তে ছুরিকা ধরে তিনটি লৌহদস্তানাধারী দুর্বৃত্তকে পর্যুদস্ত করেছে এবং কিঞ্জল নামে এক অসিধারী দুর্বৃত্তকে বামহস্তের ওই ছুরির সাহায্যেই দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাস্ত করেছে। বামহস্তে ছুরিকা নিয়ে যে এমন অসাধারণ ক্ষমতার পরিচয় দিতে পারে, দক্ষিণহস্তে তরবারি গ্রহণ করলে, সে কি করতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

বিস্ময়-বিস্ফারিত দৃষ্টিতে কর্ণদেবকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে শশক বলল, তোমার নাম। কর্ণদেব?… তুমি সার্থকনামা সন্দেহ নেই। যা শুনলাম তা যদি সত্য হয়, তবে তমি মহাভারতে কর্ণের মতোই নিপুণ যোদ্ধা। কিন্তু আমি তোমার ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করিনি। এদের মুখে তোমার বিক্রমের পরিচয় পাওয়ার আগেই আমি ধনুর্বিদ্যায় তোমরা ক্ষমতা স্বচক্ষে দর্শন করেছি- তোমার নিক্ষিপ্ত বাণ নির্ভুল নিশানায় অনেকগুলো নেকড়ের ভবলীলা সাঙ্গ করে দিয়েছে। কিন্তু এত অল্প বয়সে তোমাকে দস্যুদলে যোগ দিতে দেখে আমি বিরক্ত হয়েছি। তোমার বলবিক্রমে সন্দিগ্ধ হয়ে তোমাকে বালক সম্বোধন করিনি।

কর্ণদেব বলল, ওই সম্বোধনটি আমি অত্যন্ত অপছন্দ করি। পুনরায় আমাকে বালক সম্বোধনে অভিহিত করলে আমি তোমাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাতে বাধ্য হব শশক! আমি তোমার ক্ষমতা দেখেছি কিন্তু অসিহস্তে তোমার বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে আমি ভয় পাই না। আরও একটা কথা তুমি আমাকে দুস্যবৃত্তি করতে দেখনি, শুধু দস্যুর সাহচর্যে আছি বলেই আমাকে দস্যু মনে করলে কেন? তিরন্দাজ শায়ন এবং মহাবলী বল্লভও আজ পরন্তপের সঙ্গী তারাও কি দস্যু?

শাশক বলল, কর্ণদেব! সে সম্বোধন তুমি পছন্দ করো না, সেই সম্বোধন তুমি ভবিষ্যতে কখনো আমার মুখে শুনতে পাবে না। তোমাকে দস্যু মনে করে যদি ভুল করে থাকি, তাহলে বলব দস্যুর সহচরকে সহজ বুদ্ধিতে দস্যু বলেই মনে করা স্বাভাবিক। তবে তোমাদের যোগাযোগ অতি অদ্ভুত- যোদ্ধা, সন্ন্যাসী ও প্রিয়দর্শন এক কিশোরের সঙ্গে দস্যু দলপতির যোগাযোগ চিন্তা করা যায় না।

কর্ণদেব বলল, পৃথিবীতে তোমার অচিন্ত্যনীয় অনেক কিছুই ঘটতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলছি- গেরুয়াধারী বল্লভ গেরুয়া ধারণ করলেও সন্ন্যাসগ্রহণ করেনি।

সবিস্ময়ে শশক বলল, এত অল্প সময়ের মধ্যে বারংবার এমনভাবে চমকিত হওয়ার মতো তথ্য এর আগে কখনো সংগ্রহ করতে পারিনি। বল্লভ! একথা সত্য? তুমি সন্ন্যাসী নও?

বল্লভ হেসে বলল, না। শ্বেতবস্ত্র শীঘ্রই মলিন হয়। বারংবার বস্ত্র ধৌত করার পরিশ্রমে আমি অনিচ্ছুক, তাই গেরুয়াকে অঙ্গে ধারণ করেছি। অন্যান্য রং আমি পছন্দ করি না।

কর্ণদেব বলল, দস্যুবৃত্তির স্বপক্ষে ও বিপক্ষে বিস্তর যুক্তি থাকতে পারে; ব্যক্তিবিশেষের পেশা বা বৃত্তি দেখে তার সঙ্গীর স্বভাব-চরিত্রের বিচার কার অনুচিত। জানো তো–উত্তম নির্ভয়ে চলে অধমের সাথে, তিনিই মধ্যম যিনি থাকেন তফাতে।

শশক ভ্রূকুঞ্চিত করে বলল, একই দিনের মধ্যে এতবার চমকে চমকে উঠলে আমার দুর্বল হৃৎপিণ্ডের গতি হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে। কর্ণদেব! তোমার কথা শুনে বুঝতে পারছি তুমি শুধু অস্ত্রচালনাতেই শিক্ষালাভ করোনি, পুঁথিপত্র নিয়ে দস্তুরমতো বিদ্যাভ্যাসও করেছ।

পরন্তপ বলল, কর্ণদেব আমার প্রিয় সহচর বটে, কিন্তু দস্যু নয়। ও ব্রাহ্মণ-সন্তান। অস্ত্র-অভ্যাস করার আগে দীর্ঘকাল বিদ্যাভ্যাস করেছে। ওর কথা এখন থাক। তোমার কথা বলল। তুমি আমাদের দলের প্রত্যেকটি মানুষেরই পরিচয় পেয়েছ, কিন্তু তোমার নাম ছাড়া আর কিছুই আমরা জানি না। বলো তুমি কোথায় থাকো? কি উপায়ে জীবিকানির্বাহ করো? আত্মীয়-স্বজন কে কোথায় আছে?

দূর আকাশে দৃষ্টি মেলে দাস স্বরে শশক বলল, সমগ্র আর্যাবর্তে আমার বাসস্থান। যত্রতত্র ঘুরে বেড়াই, কোনো নির্দিষ্ট স্থানে স্থায়ীভাবে বাস করি না। জীবিকানির্বাহের জন্য কোনো বিশেষ, বৃত্তি গ্রহণ করি নি। প্রয়োজনে তরবারি ও ধনুর্বাণ ব্যবহার করি বটে। আর আত্মীয়স্বজন? আমি যাদের সাহচর্যে আসি তারাই আত্মার সঙ্গী, আমার আপনার জন অর্থাৎ স্বজন। কেবলমাত্র রক্তের বন্ধনে আমি বিশ্বাসী নই।

পরন্তপ বলল, শশক! তুমি পরিহাস করছ। বুঝলাম, সঠিক পরিচয় দিতে তুমি সম্মত নও। বেশ, আমরা শুধু তোমার নামটি জেনেই খুশি থাকার চেষ্টা করব।

শশক বলল, আমি পরিহাস করি নি। সত্য কথাই বলেছি। কিন্তু শল্যের মৃতদেহ যে পড়ে আছে, সেকথা ভুলে যেও না। মৃতের সকার করতে হবে।

পরন্তপ বলল, অবশ্যই। উপর থেকে মৃতদেহ বহন করে নীচে আনা খুবই কষ্টকর। সেই চেষ্টা করব না। পর্বতশিখরেই মৃতদেহের সৎকার করব। অদূরবর্তী অরণ্যে বৃক্ষের অভাব নেই এবং বন্ধুবর বল্লভও কুঠার হাতে নিকটেই বর্তমান অতএব অরণ্য থেকে কাঠ সংগ্রহ করে উপরে গিয়ে সৎকারকার্য সমাধা করতে বিশেষ অসুবিধা হবে না।

বল্লভ বলল, পরন্তপ! আমার একটি দুর্বলতার কথা তোমার জেনে রাখা ভালো। আমি যুদ্ধ করতে পারি, যে-কোনো বিপদের সম্মুখীন হতে পারি নির্ভয়ে কিন্তু ক্ষুধার যাতনা আদৌ সহ্য করতে পারি না। আমি এখন অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। কাল সন্ধ্যা থেকে এখন পর্যন্ত আমি অভুক্ত। কিছু খাদ্য না পেলে আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়।

কর্ণদেব বলল, আমিও অত্যন্ত ক্ষুধার্ত।

শায়ন বলল, আমার অবস্থাও তোমারই মতো।

পরন্তপ বিপন্ন হয়ে বলল, আমারও ক্ষুধার উদ্রেক হয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে খাদ্য কোথায় পাব? কিয়ৎ পরিমাণে শূল্য মেষমাংস এবং আম, কলা প্রভৃতি কিছু ফল আমার ঘোড়ার পিঠে একটি বস্ত্রের ভিতর নিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু পলাতক অশ্বের সঙ্গে সেগুলিও অন্তর্ধান করেছে। এখন নিকটস্থ অরণ্যে কিছু ফলমূল পাওয়া যায় কি না, সেই চেষ্টাই করো।

বল্লভ বলল, আমি ভীষণ ক্ষুধার্ত। ফলের সন্ধানে অরণ্যে ছুটোছুটি করতে পারব না। আর ফলাহারে আমার প্রচণ্ড ক্ষুধা তৃপ্ত হবে বলে মনে হয় না।

শায়ন ও কর্ণদেব কথা বলল না। কিন্তু তাদের মুখ দেখে মনে হল অরণ্যে প্রবেশ করে ফলাহারের প্রস্তাব তাদের মনঃপুত হয় নি।

পরন্তপ বিব্রতভাবে এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করতে লাগল, যদি ফলভারে সমৃদ্ধ কোনো বৃক্ষ দৈবাৎ চোখে পড়ে এই আশায়।

তোমরা খাদ্যের জন্য বৃথা চিন্তা করছ, খাদ্য তো কাছেই আছে, শশক বলল, বরং পানীয় জলের জন্য একটু কষ্ট হতে পারে। গিরিপথের ধারে একস্থানে বৃষ্টির জল জমে আছে দেখেছি। অবশ্য এতগুলো লোকের ভালোভাবে তৃষ্ণা-নিবারণ করার মতো যথেষ্ট পরিমাণ জল বোধহয় ওখানে হবে না। তবে নিকটবর্তী অরণ্যে নিশ্চয়ই জলের সন্ধান পাওয়া যাবে। আমি জানি, কাছেই একটা নদী আছে।

বল্লভ বলল, জলের সংবাদ শুনে বিশেষ আশ্বস্ত হলাম না। জলপান করে তো ক্ষুধা শান্ত হবে না। আহার্য কোথায়?

শশক বলল, দগ্ধ মাংসেই ক্ষুন্নিবৃত্তি করা যাবে। সেজন্য চিন্তা কিসের?

চারটি কণ্ঠ একসঙ্গে বলে উঠল, মাংস পেলে তো দগ্ধ করব। মাংস কোথায়?

শশক বলল, এতগুলো নেকড়ের মৃতদেহ থাকতে মাংসের ভাবনা কি?

কর্ণদেব বিস্মিতস্বরে বলল, নেকড়ের মাংস? তা কি খাওয়া যায়?

পরন্তপ বলল, অনার্যরা নেকড়ের মাংস খায় শুনেছি। কিন্তু কোনো আর্য-সন্তান কখনো নেকড়ের মাংস ভক্ষণ করেছে কি না জানি না। আমার মনে হয় নেকড়ের মাংস আর্যপুরুষের গ্রহণযোগ্য নয়। শায়ন! তুমি কি বলে?

শায়ন স্খলিতস্বরে বলল, আমি নিজে কখনও ওই মাংস ভক্ষণ করি নি। তবে অনার্যরা যে নেকড়ের মাংস খায় সেকথা সত্য।

শশক বলল, আমি একবার বনমধ্যে অত্যন্ত ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলাম। হরিণ, বরাহ, প্রভৃতি কোনো পশু তখন আমার চোখে পড়েনি। হঠাৎ একটি নেকড়ে আমার দৃষ্টিগোচর হল। তৎক্ষণাৎ তির নিক্ষেপ করে নেকড়েটাকে বধ করলাম। সেই নেকড়ের মাংস অগ্নিদগ্ধ করে ক্ষুধা নিবারণ করলাম। নিতান্ত মন্দ লাগে নি। অন্তত অখাদ্য বলে তো মনে হয়নি। এই মুহূর্তে আমিও তোমাদের মতোই ক্ষুধার্ত। একটি নেকড়েকে দগ্ধ করে আমি ক্ষুন্নিবৃত্তি করব। তোমাদের রুচি না হয়, অভুক্ত থাকো।

পাহাড়ের তলায় একটি তিরবিদ্ধ নেকড়ের মৃতদেহ লক্ষ্য করে শশক অগ্রসর হল।

উপবিষ্ট অবস্থা থেকে একলম্ফে দণ্ডায়মান হয়ে বল্লভ বলল, আমার রুচি আছে। আমিও নেকড়ের মাংস খাব।

সঙ্গীদের দিকে না তাকিয়ে বল্লভ পাহাড় থেকে নামতে শুরু করল।

শায়ন, কর্ণদেব ও পরন্তপ অর্থপূর্ণভাবে দৃষ্টি বিনিময় করল, তারপর তারাও নিঃশব্দে সঙ্গী দুজনকে অনুসরণ করল…

দগ্ধ মাংস চর্বন করতে করতে পরন্তপ জানাল নেকড়ের মাংসের স্বাদ তার খুব খারাপ লাগছে না!

শশক নীরবে অগ্নিকুণ্ড থেকে একটুকরো মাংস তুলে নিল। শায়ন, কর্ণদেব ও বল্লভ সোৎসাহে জানাল নেকড়ের মাংস সম্পর্কে পরন্তপের সঙ্গে তারা একমত।

.

১৭. অভাবিত বিপত্তি

অতিবাহিত হয়েছে দশটি দিন, দশটি রাত্রি। মাথার উপর অগ্নিবর্ষণ করেছে প্রচণ্ড মধ্যাহ্ন-সূর্য, এসেছে পার্বত্য অঞ্চলের হিমশীতল রাত্রি; পথিমধ্যে একদিন সগর্জনে আবির্ভূত হয়েছে প্রচণ্ড ঝঞ্জাবর্ত; পাঁচটি দুর্ধর্ষ মানুষ তবুও এগিয়ে চলেছে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে অটল চরণে!

অরণ্যও তাদের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে বারংবার। কন্টকময় বনভুমি তাদের পা আর দেহকে করে দিয়েছে রক্তাক্ত। পাহাড় থেকে নামতে গিয়ে কর্ণদেবের পা এমন মচকে গেছে যে, দুদিন সে আর মাটিতে পা ফেলতে পারে নি। কিন্তু অভিযান স্থগিত থাকেনি মুহূর্তের জন্যও। প্রথমে বল্লভ, তারপর শশক কর্ণদেবকে স্কন্ধে বহন করেছে এবং সেই অবস্থায়ই অতিক্রম করেছে। ক্রোশের পর ক্রোশ। দিবাভাগে প্রখর রবিরশ্মি আর রজনীতে বনভূমির শীতার্ত বায়ুর আলিঙ্গনে পরন্তপের অবস্থা বেশ কাহিল- যদিও সেকথা সে কিছুতেই স্বীকার করতে চায় না। বনের ফল অধিকাংশই অখাদ্য, তাই মৃগয়ালব্ধ পশুমাংসই অভিযাত্রীদের একমাত্র আহার্য। সব সময় ভালো শিকার পাওয়া যায় না, তাই বল্লভের উদর প্রায়ই ক্ষুধার্ত থাকে। এমন ভাবে শূন্য উদরে ক্রোশের পর ক্রোশ চলা যে তার স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর, সেই তথ্য ক্রমাগতই সঙ্গীদের কর্ণকুহরে পরিবেশন করতে করতে অনবরত পা চার্লিয়ে এগিয়ে চলেছে বল্লভ– কারণ, ক্লান্ত হলেও থামলে চলবে না। শুধু দুটি মানুষ কোনো অভিযোগ না করে নিঃশব্দে অক্লান্তপদে অতিক্রম করছে দুর্গম পথ, তাদের মুখে কিংবা দেহে একমুহূর্তের জন্যেও ক্লান্তি বা অবসাদের চিহ্ন দেখা যায় না– শশক ও শায়ন!

বনের পশুরাও পাঁচ বন্ধুর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি। একটা বিষাক্ত সাপ অতর্কিতে পরন্তপের পায়ে ছোবল মারতে ফণা তুলেছিল, সদাসতর্ক শায়ন যদি যথাসময়ে সাপটাকে দেখে তলোয়ারের আঘাতে বধ না করত, তাহলে সেইদিনই শেষ হয়ে যেত পরন্তপের ভবলীলা। আর এক রাত্রে অগ্নিকুণ্ডের ধারে অনেকগুলো মানুষকে শুয়ে থাকতে দেখে একটা প্রকাণ্ড বাঘ কৌতূহলী হয়ে ব্যাপারটা কি দেখতে এল। শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে সমবেতভাবে নিদ্রিত হলে সেই নিদ্রা চিরনিদ্রায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আছে মনে করে প্রহরে প্রহরে পালা করে অভিযাত্রীরা জেগে থাকত। ব্যাঘ্রের আবির্ভাব যখন ঘটল, সেইসময় প্রহরায় ছিল কর্ণদেব। অগ্নিকুণ্ড থেকে একটা জ্বলন্ত কাঠ ছুঁড়ে ব্যাঘ্রকে বিতাড়িত করতে চাইল সে। তুচ্ছ মানুষের এমন স্পর্ধা দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে সগর্জনে কর্ণদেবকে আক্রমণ করল শার্দুল। গর্জন শুনে সকলেরই ঘুম ভেঙে গেল। এতগুলো মানুষের আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ব্যাঘ্র রণে ভঙ্গ দিল। পাছে সে ফিরে এসে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে সচেষ্ট হয়, সেই ভয়ে রাতটা সকলে জেগেই কাটিয়ে দিল।

আর একদিন একটা পাহাড়ের উপর দিয়ে পথ চলার সময়ে বল্লভের সামনে এগিয়ে এল বিরাট এক ভল্লুক! খুব সম্ভব, বল্লভের বপু দেখে সে তাকে মল্লযোদ্ধা বলে বুঝে নিয়েছিল, আর সেইজন্যেই মল্লযুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে পিছনের দুই পায়ে দাঁড়িয়ে বল্লভকে আলিঙ্গন করতে উদ্যত হয়েছিল। কিন্তু ভল্লুকের নখর-ভয়াল থাবার আলিঙ্গন আর ভয়ংকর দাঁতের বিপজ্জনক সান্নিধ্য বল্লভের পছন্দ হল না- সে তার প্রকাণ্ড কুঠার তুলে সজোরে আঘাত হানল। দৈবক্রমে আঘাতটা মাথার উপর সোজাসুজি পড়ে নি, একটা কান উড়িয়ে দিয়ে মাথার চামড়ার কিছু অংশ ছিঁড়ে নিয়ে গেল কুঠার-ফলক। কাপুরুষ মানুষের বর্বর আচরণে ক্ষুণ্ণ হয়ে চিৎকার করতে করতে ভল্লুক স্থান ত্যাগ করল তিরবেগে।

এই ধরনের বিপদ-আপদ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ মাথায় করে অভিযাত্রীরা যখন দশটা দিন আর দশটা রাত্রি পার করে দিয়েছে, সেইসময় একাদশ দিবসের মধ্যাহ্নে শশক ঘোষণা করল, তারা অভীষ্ট স্থানের খুব কাছেই এসে পড়েছে।

সংবাদ শুনে সকলেই উৎফুল্ল। বল্লভের আনন্দ সবচেয়ে বেশি। কারণ, ঠিক সেই সময়েই তাদের দৃষ্টিগোচর হল তিনটি হরিণ এবং শূল্য মৃগমাংসের কল্পনায় বল্লভের ক্ষুধার্ত জঠর হয়ে উঠল আরও বেশি ক্ষুধার্ত!

অভিযাত্রীরা যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেই জায়গাটা ছিল ঘন লতাগুল্ম আর বৃক্ষের ছায়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। সম্মুখে উন্মুক্ত প্রান্তরের বুকে বিচরণ করতে করতে মহানন্দে তৃণ ভক্ষণ করছিল তিনটি হরিণ। প্রান্তরের উপর দিয়ে হেঁটে গেলে হরিণরা আততায়ীদের দেখতে পেয়ে পালিয়ে যাবে- তাই ভূমিপৃষ্ঠে অর্ধশায়িত অবস্থায় জানু আর হাতের উপর ভর দিয়ে অগ্রসর হল শায়ন ও শশক। কর্ণদেব, পরন্তপ ও বল্লভমৃগয়া সম্পর্কে অনভিজ্ঞ, তাই তারা যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।

শৃঙ্গধারী পুরুষ হরিণটির দিকেই নিবদ্ধ ছিল শিকারিদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। হরিণী ও হরিণ শাবককে তারা বধ্য মনে করেনি। জানু আর হাতে ভর করে অগ্রসর হতে হতে কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা হরিণদের নিকটবর্তী হল– হরিণরা তখনও বিপদের আভাস পায়নি। আচম্বিতে টঙ্কারধ্বনি তুলে একসঙ্গে বাণ বর্ষণ করল দুটি ধনুক। পরক্ষণেই তিরবিদ্ধ পুরুষ হরিণটি মাটির ওপর ছিটকে পড়ে মৃত্যুযাতনায় ছটফট করতে লাগল। হরিণী ও হরিণশাবক দ্রুতবেগে ছুটে পশ্চাৎবর্তী অরণ্যের গর্ভে আত্মগোপন করল।

আসন্ন ভোজের সম্ভাবনায় উৎফুল্ল বল্লভ প্রচণ্ড উল্লাসে সিংহনাদ করে উঠল– তারপরই ঝড়ের মতো ছুটল ভূপতিত শিকারের দিকে…

হঠাৎ শায়নের মুখের দিকে তাকিয়ে বল্লভ গতি সংবরণ করল। তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে, হাত তুলে দক্ষিণ দিক দেখিয়ে সে যেন কিছু বলার চেষ্টা করল। নির্দিষ্ট দিকে ফিরতেই বল্লভের নির্ভীক অন্তরেও জাগল আতঙ্কের শিহরন

দক্ষিণ দিকে অরণ্য ভেদ করে আত্মপ্রকাশ করেছে প্রকাণ্ড হস্তী, এবং দ্রুতবেগে এগিয়ে আসছে বল্লভকে লক্ষ্য করে! বল্লভের চিৎকারেই সে আকৃষ্ট হয়েছে সন্দেহ নেই।

মুহূর্তে পিছন ফিরে বল্লভ ছুটল। পরন্তপ ও কর্ণদেব সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেইখানেই সে পৌঁছতে চাইছিল। ওখানে কেবল তার বন্ধুরাই নেই, ওখানে রয়েছে নিবিড় অরণ্যের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ আশ্রয়। উন্মুক্ত প্রান্তরের উপর ক্ষিপ্ত হস্তীর কবল থেকে আত্মরক্ষা করা অসম্ভব। অসংখ্য মহীরুহ আর ঘন উদ্ভিদের আবরণে আচ্ছন্ন অরণ্যের গর্ভে আত্মগোপন করে হয়তো গজরাজকে ফাঁকি দেওয়া যায়

প্রাণপণে ছুটল বল্লভ পশ্চাত্বর্তী অরণ্যের অভিমুখে…

ছুটছে বল্লভ। পিছনে বৃংহণশব্দে অরণ্যকে মুখরিত করে ছুটছে মত্ত হস্তীও। শায়ন যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখান থেকে ধাবমান হস্তীর পশ্চাৎভাগ ছাড়া দেহের অন্যান্য অংশ চোখে পড়ে না– অত দূর থেকে ক্রোধে ক্ষিপ্ত হস্তীর নিতম্বে বা পিছনের পায়ে বাণাঘাত করে তার গতিরোধ করা যাবে না বুঝে শায়ন ধনুর্বান নিয়ে হস্তীর পশ্চাদ্ধাবন করল– উদ্দেশ্য, যদি কাছাকাছি এসে দানবের মর্মস্থানে শরনিক্ষেপ করা যায়।

কিন্তু পিছন থেকে দৌড়ে ধাবমান হস্তীর নিকটস্থ হওয়া মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। শায়ন দেখল তার সঙ্গে হস্তীর দুরত্ব ক্রমশ বর্ধিত হচ্ছে এবং বল্লভের সঙ্গে হস্তীর দুরত্ব হ্রাস পাচ্ছে মুহূর্তে মুহূর্তে বল্লভের অপমৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে শায়ন হতাশ হৃদয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, আর ঠিক সেই সময়ে তার চোখে পড়ল এক আশ্চর্য দৃশ্য—

উদ্যত ধনুর্বাণ হস্তে ছুটতে ছুটতে ধাবমান গজরাজের খুব কাছে পৌঁছে গেছে শশক! সেই বিশালদেহী পুরুষ যেন মাটিতে পা ফেলছে না, তার প্রকাণ্ড দেহ যেন মাটির উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে শরীরী বিদ্যুতের মতো…

কর্ণদেবের ধনুক থেকে পর পর অনেকগুলো বাণ ছুটে গিয়ে হস্তীর ললাট, বক্ষ ও গণ্ডদেশকে বিদ্ধ করল, কিন্তু মত্ত মাতঙ্গের গতিরুদ্ধ হল না। পরন্তপ কয়েকটি ছুরিকা নিক্ষেপ করল সজোরে। ছুরিকা হস্তীর দেহে বিদ্ধ হল। গজরাজ সেই আঘাত গ্রাহ্যই করল না। তার বিশাল দেহে ছুরিকার আঘাত বোধহয় মানব দেহে মশক দংশনের মতোই তুচ্ছ। তীব্র বৃংহনে চারদিক কাঁপিয়ে বল্লভের নিকটস্থ হল মত্ত মাতঙ্গ,… কাছে, কাছে,… আরও কাছে..

বল্লভের পায়ের তলায় মাটি কাঁপছে দানবের পদভারে, কর্ণকুহরকে বধির করে জাগছে ঘন ঘন তীব্র বৃংহণ-ধ্বনি- বল্লভ অনুভব করল মৃত্যুদূত একেবারে তার কাছে এসে পড়েছে, আর বুঝি রক্ষা নেই!

হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বল্লভ, কুঠার তুলে রুখে দাঁড়াল। ক্ষুদ্র মানুষের স্পর্ধা দেখে হিংস্র বৃংহণে ক্রোধ প্রকাশ করল দানব, হত্যার উদগ্র আগ্রহে শূন্যে দুলে উঠল যমদণ্ডের ন্যায় প্রকাণ্ড শুণ্ড–

কিন্তু সেই আঘাত যথাস্থানে পড়ার আগেই ছুটে এসে হস্তীর দক্ষিণ পার্শ্ব থেকে বাণ নিক্ষেপ করল শশক। সঙ্গে সঙ্গে আর্ত চিৎকার করে থমকে দাঁড়াল মৃত্যুদূত– তার দক্ষিণ চক্ষু ভেদ করেছে শশকের বাণ!

আঘাতের ফলে হস্তীর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য অপেক্ষা করল না শশক— একলাফে হস্তীর সম্মুখে এসে পড়ল সে এবং সেখান থেকে আর একলাফে বামপার্শ্বে- পরক্ষণেই জ্যা-মুক্ত বাণ অব্যর্থ সন্ধানে হস্তীর বামচক্ষুতে বিদ্ধ হল।

ভয়ংকর বৃংহণ-শব্দে আকাশ বুঝি ফেটে পড়তে চায়! অন্ধ গজরাজ বিষম আক্রাশে এগিয়ে এল, জান্তব অনুভূতি দিয়ে শত্রুর অবস্থান নির্ণয় করে সজোরে শুণ্ডাঘাত করল।

এক সদীর্ঘ লক্ষে স্থান ত্যাগ করল বল্লভ, সঙ্গে সঙ্গে তার পরিত্যক্ত স্থানে সশব্দে আছড়ে পড়ল হস্তীর ভয়ংকর শুণ্ড!

স্থূলকায় মল্ল অবিশ্বাস্য বেগে ছুটে গেল হস্তীর পিছন দিকে, দুই হাতে কুঠার তুলে ভীমবেগে আঘাত হানল দানবের পিছনে একটি পায়ের উপর। শাণিত কুঠারফলক পশ্চাৎভাগের দক্ষিণ চরণটিকে প্রায় দ্বিধাবিভক্ত করে মাংসের মধ্যে গম্ভীর হয়ে বসল, ফিনকি দিয়ে তপ্ত রক্তধারা সিক্ত করে দিল বল্লভের সর্বাঙ্গ! ভীষণ আর্তনাদ করে মাটিতে জানু পেতে বসে পড়ল হস্তী!

আবার ছুটে এল বল্লভ–এবার পিছনে নয়, সামনে, হস্তীর মস্তকের দক্ষিণপার্শ্বে আবার শূন্যে দুলে উঠল রক্তাক্ত কুঠার, তারপর নিদারুণ বেগে নেমে এল মাথার উপর, প্রচণ্ড আঘাতে বিদীর্ণ হয়ে গেল করিকুম্ভ! ছিটকে পড়ল খণ্ড খণ্ড অস্তি, মজ্জা, মেদ; এবং ধরণীকে লোহিতবর্ণে রঞ্জিত করে ছুটল রক্তনদীর স্রোত!

অস্ফুট আর্তনাদ করে তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করল গজরাজ!…

ছুটতে ছুটতে আর ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে বল্লভের পাশে এসে দাঁড়াল শায়ন, তারপর বলল, খুব বেঁচে গেছ বল্লভ! মদস্রাব ঘটলে পুরুষ হস্তী উন্মত্ত হয়ে বিচরণ করে-হস্তিনী ছাড়া অন্য যে-কোনো জীবকেই ওই সময়ে সে হত্যা করতে সচেষ্ট হয়। এই হস্তীও মত্ত অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছিল। এই দেখ, চক্ষুর তলায় ক্ষুদ্র ছিদ্র থেকে ঘন পীতাভ নির্যাস বা মদ নির্গত হয়ে গণ্ডদেহকে প্লাবিত করেছে। মদনিঃস্রাবে সিক্তগণ্ড এই গজরাজ তোমার চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে তোমাকে আক্রমণ করেছিল। অরণ্যে অনর্থক চিৎকার করলে বিপদ ঘটতে পারে একথা মনে রেখো।

পরন্তপ বলল, আজকের ঘটনা আমার চিরকাল মনে থাকবে। ধনুর্বাণে শশকের আশ্চর্য নিশানা আর বল্লভের প্রচণ্ড শক্তির যে পরিচয় পেলাম, তা জীবনে ভুলব না।

শায়ন বলল, শশকের নিশানা দেখে আমি চমকিত হয়েছি। আক্রমণোদ্যত ধাবমান হস্তীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে নির্ভুল লক্ষ্যে তার দুই চক্ষুকে বিদ্ধ করতে আমিও পারব না।

কর্ণদেব বলল, বল্লভের কৃতিত্বও কম নয়। কুঠারের আঘাতে হস্তীকে বধ করা কি সহজ কর্ম?

পরন্তপ বলল, একথা সত্য। কেউ কারও চাইতে কম নয়।

বল্লভ বলল, না। শশকের ক্ষমতা আমার চাইতে বেশি। আমার পক্ষে হস্তীর দই চক্ষক বাণবিদ্ধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমি যা করেছি শশকের পক্ষে সেই কাজ অসম্ভব বলে মনে হয় না।

কর্ণদেব বলল, শশক নীরব কেন? কি ভাবছ?

নির্বিকার কণ্ঠে শশক বলল, ভাবছি, হস্তীমাংসেই আজ ক্ষুন্নিবৃত্তি করব।

স্খলিত স্বরে হাস্য করে বল্লভ বলল, একটু আগেও আমি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত ছিলাম। কিন্তু এখন আদৌ ক্ষুধাবোধ করছি না।

শায়ন বলল, আহার্যের কথা চিন্তা করলেই আমার বিবমিষা আসছে।

কর্ণদেব বলল, আজ সারাদিনের মধ্যে কোনো বস্তু গলাধঃকরণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

শশক বলল, আমি ক্ষুধার্ত। মৃগমাংসের পরিবর্তে এই হস্তীমাংস অগ্নিতে দগ্ধ করে ক্ষুধানিবারণ করব। শুল্য গজমাংস অতি উপাদেয় আহার্য। একবার এর স্বাদ গ্রহণ করলে জীবনে ভুলতে পারবে না। তোমরা আমার সঙ্গে গজমাংসের ভোজ যোগ দাও।

সমবেত কণ্ঠে উচ্চারিত হল, অসম্ভব।

বন্যহস্তীর আকস্মিক আবির্ভাব এবং রক্তপাতের দৃশ্য তোমাদের স্নায়ুর উপর বিষম প্রতিক্রয়া সৃষ্টি করেছে; ফলে এই ক্ষুধামান্দ্য, শশক হেসে বলল, কিন্তু আমি তোমাদের এমন একটি সংবাদ দিতে পারি, যা শ্রবণ করলই পলাতক জঠরাগ্নি আবার তোমাদের উদরে ফিরে আসবে।

সকলেই জিজ্ঞাসু নেত্রে শশকের মুখের পানে দৃষ্টিপাত করল।

বিশ্বাস হচ্ছে না? শশক বলল, তবে শোনো। আমরা যে করোটি পর্বতের কাছে এসে পড়েছি সেকথা তো আগেই বলেছি। কিন্তু কাছে বলতে কত কাছে, সে ধারণা তোমাদের নেই। একদিন! আর মাত্র একদিনের পথ চললেই আমরা যথাস্থানে পৌঁছে যাব।

–অহো! অপূর্ব বার্তা!

–সাধু! সাধু!

-ঈশ্বর তোমাকে দীর্ঘজীবী করুন!

মধু! মধু! তোমার রসনা যেন মধুবৰ্ষণ করল!

সকলে সবিস্ময়ে আবিষ্কার করল পলাতক জঠরাগ্নি আবার যথাস্থানে প্রত্যাবর্তন করেছে।

১৮. পর্বতশিখরে বিপর্যয়

শল্যের বর্ণনায় একটু ভুল ছিল। পাহাড়টি নরমুণ্ডের মতো নয়। তবে তার বৈশিষ্ট্য রয়েছে সানুদেশে। গিরিচূড়ায় অবিস্থত প্রশস্ত প্রাঙ্গণের ন্যায় বিস্তৃত পাষাণ-চত্বরের উপর থেকে উঠে গেছে প্রস্তর ও মৃত্তিকায় জড়িত নরমুণ্ডসদৃশ একটি স্তূপ। ভাস্করের ছেনি ও বাটালির আঘাতে গঠিত হয়নি ওই নরমুণ্ড- প্রকৃতির আশ্চর্য খেয়ালে যুগ যুগ ধরে বৃষ্টির ধারা, সূর্যতাপ, বজ্রপাত ও নানাবিধ দুর্যোগে ক্ষতবিক্ষত ওই ভূপটি ধীরে ধীরে মাংসহীন ব্যাদিতবদন নরমুণ্ডের আকার ধারণ করেছে। দূর থেকে মনে হয় বিকট হাস্য মুখব্যাদন করে আছে সুবিশাল এক কঙ্কালমুণ্ড!

ওই মুখবিবরই হচ্ছে গুহার প্রবেশপথ। ওইখানেই রয়েছে শল্যের লুণ্ঠিত সম্পদ; যে সম্পদের লোভে মরণ তুচ্ছ করে ছুটে এসেছে চারটি দুঃসাহসী মানুষ, এবং পরবর্তীকালে রহস্যময়ী নিয়তির চক্রান্তে ওই চার সংখ্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও একটি সংখ্যা পাঁচ!

সন্ধ্যার প্রাক্কালে পূর্বোক্ত পাঁচটি জীবন্ত সংখ্যা এসে দাঁড়াল ব্যাদিতহাস্য কঙ্কালমুণ্ডের সম্মুখে।

আকাশের দিকে তাকিয়ে পরন্তপ বলল, সন্ধ্যা আগত। এখনই সব অন্ধকার হয়ে যাবে।

শায়ন বলল, তবে চলো, ভিতরে প্রবেশ করি। অন্ধকার হওয়ার আগেই একবার ভিতরে ঢুকে দেখতে পারি ওখানে কি আছে।

তার কণ্ঠস্বরে উত্তেজনার রেশ গোপন রইল না।

কর্ণদেব বলল, হ্যাঁ, আমিও একবার ভিতরে প্রবেশ করতে চাই। একটু পরেই অন্ধকার এসে আমাদের দৃষ্টিকে অন্ধ করে দেবে।

বল্লভ বলল, এত অধৈর্য হওয়ার কি প্রয়োজন? অগ্নির সাহায্যে অন্ধকারের বুকে অনায়াসেই আলোকপাত করা যায়।

কর্ণদেব বলল, তোমার যেন বিশেষ আগ্রহ নেই মনে হচ্ছে?

বল্লভ বলল, আগ্রহ না থাকলে এতদুর প্রাণবিপন্ন করে ছুটে আসব কেন? তবে আমার বয়সে অল্পবয়স্ক কিশোরের ন্যায় চাঞ্চল্য প্রকাশ করা অশোভন।

শায়ন বলল, আমি অল্পবয়স্ক কিশোর নই– কিন্তু গুহায় প্রবেশ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছি একথা বলতে লজ্জাবোধ করছি না।

পরন্তপ বলল, দিনের আলো নিবে গেছে। এখানে মুক্ত আকাশের নীচে আমরা এখনও আলোর দেখা পাচ্ছি বটে, কিন্তু গুহার মধ্যে যে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। আগুন না জ্বাললে ওখানে অন্ধকারের মধ্যে কিছুই খুঁজে পাব না।

শায়ন চট করে এগিয়ে গিয়ে গুহার ভিতর দৃষ্টিপাত করেই পিছিয়ে এসে বলল, পরন্তপ। তুমি ঠিকই বলেছ; আগুন না জ্বাললে ওখানে কিছুই আমাদের দৃষ্টিগোচর হবে না…! বল্লভ! আগুনের ব্যবস্থা করো।

কঠিন শুষ্ক মৃত্তিকা ও প্রস্তরের বুক থেকে কোনোক্রমে রস আহরণ করে এখানে-ওখানে কয়েকটি গুল্ম ও তৃণগুচ্ছ আত্মপ্রকাশ করেছে। তাদেরই মধ্যে কিছু উদ্ভিদকে সমূলে উৎপাটিত করে শুষ্ক বৃক্ষশাখা দিয়ে মশাল প্রস্তুত হল– তারপর সেই জ্বলন্ত মশাল দিয়ে সকলে প্রবেশ করল গুহার মধ্যে।

তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে গুহার চারদিক বারংবার নিরীক্ষণ করে পরন্তপ বলল, শল্য দেখছি মৃত্যুকালে আমার সঙ্গে পরিহাস করেছে।

কর্ণদেব বলল, তাই বটে। তোমার মুখে শুনেছি গুহার একস্থানে তার নামের আদ্য-অক্ষর খোদিত আছে। কিন্তু এখানে দেখছি চারদিকেই শ অক্ষরের ছড়াছড়ি।

শায়ন বলল, চিহ্নিত স্থানগুলিতে আঘাত করে দেখ। তাতে বিলম্ব হলেও গুপ্তকক্ষ ও গুপ্তধনের সন্ধান নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।

তিক্তস্বরে পরন্তপ বলল, হয়তো পাওয়া যাবে না। কিন্তু মরণকালে পরিষ্কার নির্দেশ না দিয়ে সে আমাদের সমস্যায় ফেলল কেন? চারদিকে রাশি রাশি খোদিত শ অক্ষরের মধ্যে কোথায় কতক্ষণে আমরা গুপ্তধনের সন্ধান পাব?…হাতে অফুরন্ত সময় আছে একথা ভাবলে তোমরা ভুল করবে। অনার্য প্রহরীদের সাক্ষাৎ আমরা পাইনি বটে, কিন্তু যে কোনো সময়ে তারা আমাদের ঘিরে ফেলতে পারে।

এই ভয়াবহ সম্ভাবনার কথা শুনে সকলেই চঞ্চল হয়ে উঠল।

শশক বলল, পরন্তপ! অনার্য প্রহরীরা সাধারণত রাত্রে বনপথে চলাচল করে না, একথা তোমার জানা উচিত। আর গুহার মধ্যে রাশি রাশি শ অক্ষর নিয়ে মস্তিষ্ককে ঘর্মাক্ত না করলেও চলবে। আমার বিশ্বাস, গুহার পশ্চিম দেয়ালে সন্ধান করলে ধনভাণ্ডারের সন্ধান পাওয়া যাবে।

পরন্তপ বলল, পশ্চিম দেয়ালে অবশ্য শ অক্ষরের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু সবদিক ছেড়ে হঠাৎ পশ্চিম দেয়ালে খুঁজলে গুপ্তধন পাওয়া যাবে এমন কথা তোমার মনে হল কেন?

শশক কোনো কথা না বলে বল্লভের হাত থেকে মশাল নিয়ে গুহার পশ্চিম দেয়ালের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত পদচালনা করল। তারপর হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে একস্থানে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে উঠল, বোধহয় এইখানেই অভীষ্ট বস্তু অবস্থান করছে। বল্লভ! তুমি হাত চার্লিয়ে দেখতে পারো।

বল্লভ এগিয়ে এসে নির্দিষ্ট স্থানে কয়েকবার হস্তচালনা করে সোল্লাসে চিৎকার করে উঠল, পাথরের জোড়ে আমার আঙুল পড়েছে। এইখানেই আছে গুপ্তধন।

সকলে তাকিয়ে দেখল গুহাগাত্রে দুই হাত দিয়ে বল্লভ কিছু যেন আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে, .. একটু পরেই গুহার দেয়ালে ফাঁক দেখা দিল, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই প্রবল শব্দে গুহার ভিতর ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে একটা মস্ত পাথর সরে গিয়ে দেয়ালের গায়ে একটা গহুর আত্মপ্রকাশ করল!

তৎক্ষণাৎ মহা উল্লাসে চিৎকার করে ছুটে গেল শায়ন, কর্ণদেব ও বল্লভ তাদের লুব্ধ দৃষ্টির সম্মুখে দেখা দিয়েছে তিনটি বিশাল সিন্দুক!

কর্ণদেব এক লাফে ছুটে গিয়ে একটি সিন্দুকের ডালা টেনে খুলে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে ঝকমক করে উঠল রাশি রাশি মণি-মুক্তা, অজস্র স্বর্ণমুদ্রা ও অলঙ্কার।

অন্য সিন্দুক দুটির ডালা খুলে দেখা গেল সেই দুটির মধ্যেও রয়েছে প্রভূত ধনসম্পদ!…

অকস্মাৎ স্তব্ধতা ভঙ্গ করে হো হো শব্দে হেসে উঠল কর্ণদেব। পরক্ষণেই সেই হাসি যেন রোগজীবাণুর মতো ছড়িয়ে পড়ল। প্রচণ্ড অট্টরোলে গুহার ভিতর প্রতিধ্বনি তুলে হেসে উঠল শায়ন, তারপরই সেই হাসির শব্দকে ডুবিয়ে জাগল বল্লভের প্রচণ্ড অট্টহাস্য।

হোহোহো! হা-হা-হা!অট্টহাস্যের তরঙ্গ ফেটে পড়তে লাগল গুহা-গহ্বরের মধ্যে। ধীরস্থির গম্ভীর বল্লভও সঙ্গীদের সঙ্গে অট্টহাসির পাল্লা দিতে লাগল মহা-উৎসাহে!…

পরন্তপ গম্ভীর মুখে তাকাল শশকের দিকে। শশকের মুখেও হাসি নেই। একবার পরন্তপের সঙ্গে দৃষ্টিবিনিময় করেই সে মুখ ঘুরিয়ে গুহার বাইরে দৃষ্টিকে সঞ্চালিত করল।

অট্টহাসির বেগ যখন কমে এসেছে, স্নায়ুর প্রবল উত্তেজনা শান্ত হওয়ায় সকলেই যখন অল্প-বিস্তর প্রকৃতিস্থ, সেই সময় হঠাৎ ধ্বনিত হল পরন্তপের গভীর কণ্ঠস্বর, শশক! গুহার পশ্চিম দেয়ালে কোন জায়গায় গুপ্তধন আছে সেকথা তুমি জানলে কি করে?

খুব সহজেই, শশক বলল, তোমার হয়তো মনে নেই মৃত্যুর আগে গুপ্তধনের সন্ধান বলতে বলতেই হঠাৎ শল্যের বাক্‌রোধ হয়ে গিয়েছিল। কয়েকবার প-প-পশ বলেই সে জলের জন্য আর্তনাদ করে উঠেছিল। তখন ব্যাপারটাকে গুরত্ব দিইনি। ভেবেছিলাম তোমাকে নাম ধরে সম্বোধন করার চেষ্টা করছিল সে। পরে বুঝলাম তা নয়।

-তা নয়! তবে? তবে কি বলতে চেয়েছিল শল্য?

-পশ্চিম দিকে গুপ্তধন লুকানো আছে এইকথাই সে বলতে চেয়েছিল। এখন বুঝলাম, পরন্তপ নয় পশ্চিম কথাটাই উচ্চারণ করতে গিয়ে মৃত্যুর স্পর্শে তার বাকরোধ হওয়ার উপক্রম করেছিল। তাই কথার খেই হারিয়ে সে জলের জন্য আর্তনাদ করে উঠেছিল।

কিন্তু গুহার পশ্চিম দিকের দেওয়ালেও অন্তত চার পাঁচটি শ অক্ষর আছে। পাথরের জোড় এমন কৌশলে দেয়ালের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয়েছিল যে, ফাটলের চিহ্ন চোখে পড়ে নি। তুমি কোনো চেষ্টা না করে দেয়ালে হাত না দিয়ে একবারেই গুপ্তস্থান আবিষ্কার করেছ। এটা কি করে সম্ভব হল?

–পরন্তপ! মস্তিষ্ককে চালনা করতে জানি বলেই এটা সম্ভব হল। শল্য চারদিকের দেয়াল শ অক্ষরের চিহ্নত করেছিল, তার কারণ আছে। দৈবক্রমে কোনো পথিক যদি এখানে এসে এক জায়গায় একটি মাত্র অক্ষর খোদিত দেখতে পায় এবং কৌতূহল বশে সেইস্থানে নাড়াচাড়া করতে থাকে– তাহলেই সর্বনাশ! গুপ্তধন আবিষ্কৃত হবে তৎক্ষণাৎ! সেইজন্যই চারদিকে শ অক্ষরের ছড়াছড়ি। পশ্চিম দেয়ালে অক্ষরের সংখ্যা কম। তার মধ্যেও যে অক্ষরটি সবচেয়ে অস্পষ্ট, সেইটির দিকে সহজে দর্শকের চোখ পড়বে না। ওই কথা বুঝেই উক্ত অক্ষরকে সবচেয়ে অস্পষ্ট করে খোদাই করেছিল শল্য। আশা করি এখন বুঝতে পারছ কেমন করে আমি গুপ্তধন অতি সহজেই আবিষ্কার করেছি।

সকলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শশকের বক্তৃতা শুনছিল। এবার বল্লভ মুগ্ধকণ্ঠে বলে উঠল, তুমি অসাধারণ মানুষ। শশক! তোমার দেহ এবং মস্তিষ্ক সমান শক্তিশালী।

কর্ণদেব বলল, বল্লভের কথা সত্য। পেশীর শক্তি ও মস্তিষ্কের শক্তির এমন আশ্চর্য সমন্বয় দেখা যায় না। শশক! মহারাজ রুদ্রদমনের গুপ্তচরবিভাগে কাজ করলে তুমি মন্ত্রী মহাসত্ত্বের প্রিয়পাত্র হয়ে প্রভূত অর্থ উপার্জন করতে পারবে।

শশক চমকে উঠল, তারপর মৃদুহেসে বলল, কর্ণদেব! তোমার উপদেশ আমি মনে রাখার চেষ্টা করব।

শায়ন বলল, এই বিপুল সম্পদ বহন করে শ্রাবস্তীর রাজধানীতে নিয়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে এখন সম্ভব নয়। অবশ্য কিছু রত্ন ও কয়েক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা আমরা পরিধেয় বস্ত্রে বন্ধন করে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু এই বিপুল সম্পদের তুলনায় সে আর কতটুকু? আমরা কি তবে একই সঙ্গে নগরীতে গিয়ে অশ্ব সংগ্রহ করে আবার দলবদ্ধ হয়ে ফিরে আসব অবশিষ্ট সম্পদের জন্য? এ ছাড়া আর কি ব্যবস্থা হতে পারে? আমরা প্রত্যেকেই এখন স্থানটি জেনে ফেলেছি। আমাদের পক্ষে যে-কোনো ব্যক্তি গোপনে এসে সমুদয় ধনরত্ন নিয়ে পলায়ন করতে পারে। এতএব, সম্পদ যথাযথ ভাবে বণ্টন না হওয়ার আগে আমাদের পরস্পরের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া অনুচিত। অবশ্য আমি কারও সততায় সন্দেহ প্রকাশ করছি না, কিন্তু তবু সতর্ক থাকা উচিত। কি বলো পরন্তপ?

পরন্তপ বলল, এই সম্পদের অর্ধাংশ শশকের প্রাপ্য। শস্যের অনুরোধে তার প্রাপ্য অংশ শশককে দিতে আমি প্রতিশ্রুত। সমস্ত ধনসম্পদের হিসাব নিয়ে চুল চেরা ভাগ করার সময় নেই। তাই মোটামুটিভাবে বণ্টনের যে ব্যবস্থা ভেবেছি, তা তোমাদের বলছি। তিনটি সিন্দুকের ভিতর একটি সিন্দুক শশক পাবে। অপর দুটি সিন্ধুকের ধনরত্ন আমাদের চারজনের মধ্যে ভাগ হবে। আমার এবং কর্ণদেবের অংশ তোমদের সম্মতিক্রমে এখনই গ্রহণ করছি।

শায়ন বলল, এখনই!… এত তাড়া কিসের?

উত্তর না দিয়ে কয়েকটি মণি-মাণিক্য ও হীরক তুলে নিল পরন্তপ, তারপর বলল, তোমরা দেখে নাও। কর্ণদেব আর আমি আমাদের অংশ গ্রহণ করছি। আশা করি তোমাদের আপত্তি নেই?

শায়ন সবিস্ময়ে বলল, কয়েকটি রত্ন নিয়েই তোমরা সন্তুষ্ট? তোমাদের নায্য অংশের সিকি পরিমাণও তোমরা গ্রহণ করা নি!

কর্ণদেবও বিস্মিতচক্ষে পরন্তপের দিকে চাইল। সেদিকে তাকিয়ে শায়ন বলল, কর্ণদেব! কয়েকটি মাত্র রত্ন নিয়ে তুমি তোমার প্রাপ্য অংশের দাবি ছেড়ে দেবে?

কর্ণদেব বলল, পরন্তপের সিদ্ধান্তের উপর আমি কথা বলব না।

পরন্তপ বলল, আমরা অল্পেই সন্তুষ্ট। যা নিয়েছি এর বেশি আর কিছু চাই না।

শায়ন বলল, তিনটি সিন্ধুকের মধ্যে একটি শশককে দিতে তুমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। অপর দুটি সিন্ধুকের যাবতীয় বস্তু বল্লভ আর আমার মধ্যে ভাগ হবে?

পরন্তপ বলল, হ্যাঁ। আমাদের অংশ আমরা বুঝে নিয়েছি। অবশিষ্ট অংশ তোমার ভাগ করে নাও।

বল্লভ ও শায়ন পরস্পরের মুখের দিকে চাইল। অর্থের প্রতি দস্যু পরন্তপের এমন তাচ্ছিল্য ও বীতরাগ দেখে তারা আশ্চর্য হয়ে গেল।

শায়নকে উদ্দেশ করে বল্লভ বলল, ওরা যদি স্বেচ্ছায় ওইটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট হয়, তাহলে আমাদের কি বলার আছে? আমরা তো ওদের বঞ্চিত করছি না। কি বলো, শায়ন?

শায়ন বলল, যথার্থ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বিশাল এই গুরুভার সিন্দুক দুটিকে আমরা কখন এবং কি উপায়ে স্থানান্তরিত করব?

বল্লভ বলল, সেবিষয়ে চিন্তা করার সময় পাওয়া যাবে। আপাতত আমি কিছুক্ষণ বিশ্রাম করতে চাই। প্রায় সপ্তাহকাল ধরে যে পরিশ্রম করেছি, তার তুলনা নেই। এখন কার্যসিদ্ধি হয়েছে। মনও দুশ্চিন্তামুক্ত- অতএব নিশ্চিন্তে বিশ্রাম গ্রহণ করতে পারব। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হচ্ছে যে, অনার্য প্রহরীদের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়নি! সেরকম কিছু ঘটলে হয়তো আমরা নরহত্য করতে বাধ্য হতাম। নররক্তে হস্ত রঞ্জিত না করেও অভীষ্ট সিদ্ধ হয়েছে বলেই বিশেষ করে আনন্দলাভ করছি।

শায়ন বলল, যুদ্ধ করলেই একসময়ে নরহত্যা করতে হবে। তুমিও যোদ্ধা। অসি বা ধনুর্বাণ নিয়ে তুমি যুদ্ধ না করলেও তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই তোমার অস্ত্রস্বরূপ ব্যবহৃত হয় কারণ, তুমি মল্লযোদ্ধা। মল্লযুদ্ধও যুদ্ধ। বল্লভ! তুমি কি কখনও কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করেনি?

অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে বল্লভ বলল, জীবনে একবারই আমার হাতে প্রতিদ্বন্দ্বীর মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু আমি তাকে হত্যা করতে চাইনি।

শায়ন সোৎসাহে বলল, আমি যুদ্ধ করতে ভালোবাসি, যুদ্ধ দেখতে ভালোবাসি, যুদ্ধের গল্প শুনতেও ভালোবাসি। যে যুদ্ধে দৈবক্রমে তোমার প্রতিদ্বন্দ্বীর মৃত্যু হয়েছে, সেই যুদ্ধের কাহিনি আমি শুনতে চাই।

কর্ণদেব বলল, আমিও বল্লভের কাহিনি শুনতে উৎসুক।

পরন্তপ ও শশক কোনো অভিমত প্রকাশ না করলেও তাদের চোখমুখের ভাবভঙ্গিতে স্পষ্টই বোঝা গেল গল্প শোনার আগ্রহ তাদেরও কিছু কম নয়।

তবে শোন, বল্লভ শুরু করল, বেশ কয়েক বৎসর আগে আমি যখন কর্ণদেবের মতো অল্প ব্যস্ক কিশোর, সেই সময় আমায় এক বন্ধু এসে জানাল মহারাজ প্রসেনজিতের রাজ্য মিথিলায় যোদ্ধাদের জন্য এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে– তরবারি, ভল্ল, ধনুর্বাণ প্রভৃতি অস্ত্রধারী যোদ্ধাদের মতো মল্লবীরগণও ওই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন। আমি বরাবরই একটু অলস প্রকৃতির, তাই সহসা দেশভ্রমণে ইচ্ছুক হলাম না। অনিচ্ছার আরও একটা কারণ ছিল নিজের প্রচণ্ড দৈহিক শক্তি সম্পর্কে আমি অত্যন্ত সচেতন ছিলাম, উত্তেজনার বশে প্রতিদ্বন্দ্বী মল্লকে যদি মর্মান্তিক ভাবে আহত করে ফেলি, সেই ভয়ে ওই প্রতিযোগিতায় আমি কখনো অংশগ্রহণ করতাম না। কিন্তু বন্ধুর সনির্বন্ধ অনুরোধে শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে মিথিলায় গমন করলাম। তবে শর্ত ছিল- ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হব না। বন্ধু বলল আমাকে প্রতিযোগিতায় নামতে সে অনুরোধ করবে না, আমার সাহচর্য পেলেই সে খুশি। আমার শর্তে রাজি হওয়ায় তার সঙ্গী হতে আমি আপত্তি করলাম না এবং নির্দিষ্ট দিনে মিথিলার মল্লভূমিতে উপস্থিত হলাম…।

যথাসময়ে অন্যান্য প্রতিযোগিতার সঙ্গে মল্লযুদ্ধও শুরু হল।প্রতিদিনই বিভিন্ন রাজ্যের মল্লগণ ওই স্থানে মল্লযুদ্ধে ব্যাপৃত হয়ে বিভিন্ন ও বিচিত্র রণকৌশল প্রদর্শন করত। প্রতিযোগিতায় বিজয়ী মল্লকে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থাও ছিল। কয়েকদিন মল্লযুদ্ধ দেখার পর একদিন হঠাৎ আমার বন্ধু দর্শকের ভূমিকা ত্যাগ করে সক্রিয়ভাবে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করল।

বন্ধুর প্রতিদ্বন্দ্বী মিথিলার স্থানীয় অধিবাসী। তার বয়স অল্প, কিন্তু অভিজ্ঞতা অল্প ছিল না। উক্ত মল্পের দেহটি ছিল সত্যই দর্শনীয় কবাটবক্ষ, সিংহকটি, আজানুলম্বিত বিশাল বাহুর সমানুপাতে গঠিত কদলীবৃক্ষের ন্যায় স্কুল পেশীবদ্ধ দুই উরু অসাধারণ শক্তির পরিচায়ক। মল্লটি যে শুধু শক্তির অধিকারী ছিল তা নয়– তার রণকৌশলও অপূর্ব। বন্ধুর সঙ্গে মল্লযুদ্ধ শুরু হতে না হতেই উক্ত যোদ্ধা বন্ধুবরকে পরাস্ত করল। চারদিক থেকে ধিক্কার-ধ্বনি শোনা যেতে লাগল। আবার বন্ধু দ্বিতীয়বার মল্লভূমিতে অবতীর্ণ হল। কয়েকমুহূর্তের মধ্যেই অদ্ভুত কৌশলে তাকে পুনরায় পরাজিত করল মিথিলার মল্লযোদ্ধা। দর্শকরা সোল্লাসে বিদ্রূপ বর্ষণ করতে লাগল। প্রতিযোগিতায় নামলে প্রতিদ্বন্দ্বীরা কে কোন্ দেশের অধিবাসী সেকথা ঘোষণা করা হয়– দর্শকবৃন্দ ব্যঙ্গ করে বলতে লাগল শ্রাবস্তী রাজ্যের মল্লগণ যে অতিশয় দুর্বল এই ব্যক্তিকে দেখেই তা বোঝা যায়– মিথিলার মল্লভূমিতে অংশগ্রহণ করার উপযুক্ত তারা নয়।

ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে বন্ধু আবার মিথিলার মল্লবীরকে দ্বৈরথ রণে আহ্বান জানাল। সেবারেও ওই মল্লযোদ্ধা অতি সহজেই আমার বন্ধুকে পরাস্ত করল। বার বার তিনবার পরাজিত হয়ে বিরস বদনে বন্ধুবর মল্লভূমির বাইরে এসে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে বিজয়ী মল্ল- হ্যাঁ, হ্যাঁ, তার নামটিও এখন মনে পড়েছে হৈহয়! হ্যাঁ, হৈহয় নামে ওই বিজয়ী মল্ল আমার বন্ধুকে মিথিলার মল্লভূমিতে অবতীর্ণ হওয়ার আগে পর্যাপ্ত পরিমাণে মাতৃদুগ্ধ পান করে আসার পরামর্শ দিল। পূর্বেই আমার মনে ক্রোধের সঞ্চার হয়েছিল বন্ধুর প্রতি বিদ্রুপের উক্তি সেই ক্রোধের আগুনে ঘৃতাহুতি দিল;- দর্শকের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে জানালাম আমিও শ্রাবস্তীর নাগরিক এবং প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করতে চাই। মধ্যস্থ অনুমতি দিতেই মল্লভূমিতে বাহ্বাস্ফোট করে সদম্ভে অবতীর্ণ হলাম। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী আমাকে আলিঙ্গনবদ্ধ করতেই দর্শকদের মধ্যে কয়েকজন বিদ্রূপ করে বলল, শ্রাবস্তীর মল্পের জন্য এইবার চিকিৎসককে আহ্বান জানাতে হবে। তুমুল অট্টহাস্য আর বিদ্রুপাত্মক ধ্বনিতে আমার মাথায় আগুন জ্বলতে লাগল, তার উপর আমার প্রতিদ্বন্দ্বী যখন আমার গ্রীবা আকর্ষণ করে সবলে পেষণ করতে শুরু করল, তখনই আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। দারুণ ক্রোধে দক্ষিণ কবপুট দিয়ে তরবারি চালানোর ভঙ্গিতে তার ঘাড়ে আঘাত করলাম। সেই আঘাতেই ঘাড় ভেঙে তার মৃত্যু হল।

কর্ণদেব সাগ্রহে প্রশ্ন করল, তারপর?

বল্লভ বলল, তারপর আর কি? ওইভাবে আঘাত করা মল্লযুদ্ধের নিয়ম-অনুসারে অন্যায় নয়। আমাকে বিজয়ী বলে ঘোষণা করা হয়েছিল বিধিসম্মতভাবে। মৃত্যুকে দৈব-দুর্ঘটনা বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল।

পরন্তপ বলল, এটা তো দুর্ঘটনাই বটে। তুমি তো ইচ্ছাপূর্বক হত্যা করনি।

শায়ন আর কর্ণদেবের সঙ্গে কখন যে পরন্তপ আর শশকও গল্পের আসরে শ্রোতার ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তা লক্ষ করেনি বল্লভ; পরন্তপের কথা শুনে সে বুঝল অনেকক্ষণ ধরেই তার কাহিনি মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করেছে পরন্তপ শশক মৌন থাকলেও তার চোখ-মুখের অভিব্যক্তিতে শ্রোতার কৌতূহল ও উত্তেজনা অতিশয় স্পষ্ট।

ইচ্ছা করে হত্যা করিনি বটে, বল্লভ বলল, কিন্তু নিজের দৈহিক শক্তি সম্পর্কে সচেতন থাকায় জানতাম, ওইভাবে আঘাত করলে প্রতিদ্বন্দ্বীর মৃত্যুর সম্ভাবনা আছে। তা সত্ত্বেও মুহূর্তের উত্তেজনায় দুর্ঘটনা ঘটল। আমি মল্লযুদ্ধের সূক্ষ্ম কলাকৌশল ভালোবাসি, হত্যার পক্ষপাতী নই। পেশাদার মল্লযোদ্ধা অবশ্য অনেক সময় প্রতিযোগীকে হত্যা করতে ইতস্তত করে না।

শায়ন বলল, পেশাদার মল্ল না হলেও তুমি এক নির্দোষ প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করেছ। হ্যাঁ, এটাকে হত্যাই বলব- তুমি নিজমুখেই স্বীকার করেছে ওইভাবে আঘাত করলে মৃত্যু ঘটতে পারে সে কথা তোমার জানা ছিল।

বল্লভ বলল, এটাকে সঠিকভাবে হত্যা বলা যায় না, তবে আমি তো নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলছি না।

-তাহলে দোষ স্বীকার করছ?

–অস্বীকার তো করিনি।

–অপরাধ করেছ। তার জন্য দণ্ডগ্রহণ করাও তো উচিত। তাই না বল্লভ?

বল্লভ সবিস্ময়ে বলল, তুমি কি বলছ শায়ন? বহুদিন আগের অনিচ্ছাকৃত এক অপরাধের জন্য আজ দণ্ডগ্রহণ করব?

বহুদিন ধরে কোনো অপরাধী যদি আইনকে ফাঁকি দেয়, তবে তার অপরাধের মাত্রা লঘু হয় না, শায়নের অস্বাভাবিক কণ্ঠস্বর সকলকে চমকিত করল, তার দুই চোখে জ্বলে উঠল অবরুদ্ধ রোষের হিংস্র দীপ্তি, বল্লভ! হৈহয়ের মৃত্যু-সংবাদ পেয়ে আমি শিশুর মতো ক্রন্দন করেছিলাম। ভেবেছিলাম, মল্লক্রীড়া করতে গিয়ে দৈবাৎ আঘাত পেয়ে তার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তাকে যে হত্যা করা হয়েছে তা জানা ছিল না।

বল্লভ বিল স্বরে বলল, তুমি হৈহয়কে জানো? সে তোমার পরিচিত?

উত্তর এল, হৈহয় আমার ভাই। সহোদর নয়, মাতুলপুত্র।

গুহার মধ্যে নেমে এল অসনীয় স্তব্ধতা। কিছুক্ষণ পরে স্তব্ধতা ভঙ্গ করে জাগল শায়নের ভয়াবহ কণ্ঠস্বর, আমার শৈশব অতিবাহিত হয়েছে মাতুলালয়ে। বাল্যকালে হৈহয় ছিল আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় সঙ্গী। বল্লভ! তাকে তুমি হত্যা করেছ! আমি তোমাকে নিষ্কৃতি দেব না।

বল্লভ বলল, তুমি অনর্থক উত্তেজিত হচ্ছ। শায়ন! এটা দৈব দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়।

একটি দুর্ঘটনা আর একটি দুর্ঘটনার কারণ হবে, উপবিষ্ট অবস্থা থেকে দণ্ডায়মান হয়ে ভয়ঙ্কর স্বরে শায়ন বলল, বল্লভ! মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও।

শায়ন তরবারিকে কোষমুক্ত করল।

একবার শায়নের দিকে তাকিয়ে বল্লভ অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিল। তার দুই হাত আগের মতোই স্থির হয়ে রইল জানুর উপর।

অধীর স্বরে শায়ন বলল, অস্ত্র নাও, বল্লভ!

মৃদুগম্ভীর স্বরে বল্লভ বলল, শায়ন! আমি যুদ্ধ করব না। ইচ্ছা করলে তুমি আমাকে হত্যা করতে পার।

ক্রুদ্ধস্বরে শায়ন বলল, নিরস্ত্র মানুষকে বধ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

বল্লভ বলল, আমার পক্ষেও তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়।–

-বল্লভ! কুঠার গ্রহণ করো।

–শায়ন! আমার বক্তব্য তুমি শুনেছ।

-তুমি যদি যুদ্ধ করতে না রাজি হও, তাহলে অবশ্য আমি তোমায় হত্যা করতে পারব না, শায়ন এগিয়ে এল, কিন্তু এই অসি দ্বারা তোমাকে এমনভাবে চিহ্নিত করে দেব, যা চিরকাল তোমার মনে থাকবে।

ঘটনার অভাবনীয় পরিস্থিতি তিনজন দর্শককে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। হঠাৎ কৰ্ণদেব বলে উঠল, শায়ন! তুমি কি উন্মাদ হয়েছ? বহু বৎসর আগে মল্লভূমিতে তোমার মাতুলপুত্র ন্যায়সঙ্গত দ্বৈরথ-রণে নিহত হয়েছে- সেইজন্য তুমি বিশ্বস্ত এক সহচরের অঙ্গে অস্ত্রাঘাত করতে চাও? না, না, এমন কাজ আমি তোমায় করতে দেব না।

কর্ণদেব সামনে এগিয়ে আসার উপক্রম করতেই একলাফে পিছিয়ে গিয়ে শায়ন হিংস্রকণ্ঠে গর্জে উঠল, কর্ণদেব! আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার হাত দিও না। সাবধান!

কর্ণদেব ক্রুদ্ধস্বরে বলল, শায়ন! তুমি কাকে সাবধান করছ? বল্লভ তোমার ধৃষ্টতা ক্ষমা করতে পারে, কিন্তু আমি করব না।

জ্বলন্ত চক্ষে তার দিকে তাকিয়ে শায়ন বলল, কর্ণদেব! তোমার স্পর্ধা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মনে রেখো আমার ধৈর্য অসীম নয়।

তরবারির মুষ্টিতে হাত রেখে কর্ণদেব তপ্তস্বরে বলল, আমিও ধৈর্যের শেষ সীমায় উপস্থিত হয়েছি।

অকস্মাৎ কর্ণদেবের দক্ষিণ বাহু দৃঢ়মুষ্টিতে চেপে ধরে পরন্তপ বলে উঠল, কর্ণদেব! এটা শায়নের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তোমার হস্তক্ষেপ এখানে অবাঞ্ছনীয়।

গম্ভীর স্বরে শশক বলল, আমারও তাই মনে হয়। হয়তো বলপূর্বক শায়নকে নিরস্ত্র করা সম্ভব, কিন্তু

সিংহের মতো গর্জন করে শায়ন বলল, তোমরা সমবেতভাবে চেষ্টা করলে আমায় বধ করতে পারবে, কিন্তু বলপূর্বক আমাকে নিরস্ত্র করতে পারবে না।

শায়নের কথায় কান না দিয়ে শশক বলল, শায়নকে নিরস্ত্র করা সম্ভব, কিন্তু অন্ধ আক্রোশের নিবৃত্তি ঘটবে না– অদূর ভবিষ্যতে আবার এই ঘটনার পুরনাবৃত্তি অনিবার্য। সুতরাং দ্বন্দ্বযুদ্ধেই এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব।

বিমর্ষভাবে মস্তক সঞ্চালিত করে বল্লভ বলল, আমি অস্ত্রগ্রহণ করব না। শায়ন ক্রোধে অন্ধ হয়ে গেছে, এখন সে উন্মাদ-তুল্য। সাময়িক উত্তেজনা প্রশমিত হলে সে তার ভুল বুঝতে পারবে।

আর্যযোদ্ধা যুদ্ধে ভীত। কাপুরুষকে হত্যা করে না, কঠোর স্বরে শায়ন বলল, কিন্তু বল্লভ! তোমাকে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।

চকিতে বিদ্যুৎশিখার মতো শায়নের তরবারি বল্লভের মুখের কাছ থেকে ফিরে এল। সকলে সচমকে দেখল বল্লভের দক্ষিণ কর্ণ মুখের উপর থেকে বিলুপ্ত ক্ষতমুখ থেকে ছুটছে তপ্ত রক্তস্রোত।

কয়েকমুহূর্ত নিশ্চল হয়ে বসে রইল বল্লভ, একবার ক্ষতস্থানে হাত দিল, তারপর চোখের সামনে রক্তাক্ত হাতটি ধরে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে নির্বোধের মতো শায়নের দিকে দৃষ্টিপাত করল ঘটনাটা যেন এখনো তার বোধগম্য হয়নি, নিজের চোখকেও যেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না…।

ধীরে অতি ধীরে, তার মুখের উপর ফুটল যন্ত্রণার চিহ্ন, তারপরই ক্রোধের আবির্ভাবে মুছে গেল যন্ত্রণার চিহ্ন মুখের উপর থেকে, দারুণ আক্রোশে জ্বলে উঠল দুই চক্ষু, দণ্ডায়মান শায়নের মুখের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভীষণবণ্ঠে চিৎকার করে উঠল আহত মল্ল…

সেই ভয়ংকর অমানুষিক ধ্বনি অসিযোদ্ধাকে বিহ্বল করে দিল, আর সঙ্গে সঙ্গে উপবিষ্ট অবস্থা থেকেই বল্লভের বিশাল দেহ জ্যা-মুক্ত তীরের মতো ছিটকে গেল শায়নের দিকে! অসিযোদ্ধায় অভ্যস্ত স্নায়ু যন্ত্রচার্লিতের মতো কাজ করল, তীক্ষ্ণ তরবারি দংশন করল বল্লভের মস্তকে পরক্ষণেই পেশীস্ফীত দুই বিশাল বাহুর মরণবাঁধনে বন্দি হল শায়নের মস্তক, স্কন্ধ ও গ্রীবাদেশ!

মট করে একটা শব্দ; শায়নের মাথা হেলে পড়ল, বল্লভের বাহুর বাঁধন সরে গেল, সশব্দে গুহাতলে লুটিয়ে পড়ল শায়নের দেহ!

মাথার উপর বিদ্ধ তরবারিকে টেনে আনার চেষ্টা করল বল্লভ। পারল না; শাণিত অস্ত্র ব্রহ্মতালু ভেদ করে বসে গেছে। বল্লভের দুই হাত শিথিল হয়ে ঝুলে পড়ল। ধীরে ধীরে সে বসে পড়ল, তারপর মাটিতে পড়ে স্থির হয়ে গেল। গুহাতলে মাটি ও পাথরের উপর ছুটল রক্তের স্রোত।

স্তম্ভিত দর্শকদের মধ্যে প্রথম সংবিৎ ফিরে পেল শশক। নিঃশব্দে এগিয়ে এসে মৃতদেহ দুটিকে পরীক্ষা করে সে মন্তব্য করল, সব শেষ। বল্লভের মস্তক অসির আঘাতে বিদীর্ণ, শায়নের ঘাড় ভেঙে গেছে মল্লযোদ্ধার আলিঙ্গনে। ইহজীবনে ওরা আর কলহ করবে না।

বিস্ফারিত নেত্রে মৃতদেহ দুটিকে নিরীক্ষণ করতে লাগল কর্ণদেব। অভাবিত এই ঘটনার ভয়াবহ পরিণতি তার রসনাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল।

দুই হাত কোমরে রেখে কঠোর হাস্য করে পরন্তপ বলল, চারটি জীবন্ত সংখ্যার মধ্যে দুটি সংখ্যা অবলুপ্ত হল মৃত্যুর করাল গ্রাসে। অপর দুটি সংখ্যার মধ্যে একটির অস্তিত্ব এখন বিপন্ন এবং অপরটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

পরন্তপের দিকে তাকিয়ে কর্ণদেব স্খলিতস্বরে বলল, পরন্তপ! আমাদের দুটি বন্ধু শোচনীয়ভবে মৃত্যুবরণ করেছে। এখন কি তোমার পরিহাসের সময়?

পরন্তপ গম্ভীর স্বরে বলল, আমি আদৌ পরিহাস করছি না।

প্রথম দুটি সংখ্যা সম্পর্কে তোমার বক্তব্য বুঝলাম, কর্ণদেব বলল, কিন্তু কে বিপন্ন আর কার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত সে কথা বুঝতে পারছি না।

আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি, পরন্তপর বলল, যদি কোথাও বুঝতে অসুবিধা হয়, তাহলে আমাদের সুযোগ্য বন্ধু শশকের সাহায্য চাইলেই সে তোমায় সহজভাবে সব কিছু বুঝিয়ে দেবে।

পরন্তপ! শশকের কণ্ঠস্বর গম্ভীর, তোমার কথা আমি নিজেও কিছু বুঝতে পারছি না। কিন্তু এসব হেঁয়ালি ছেড়ে মৃত বন্ধু দুটির সৎকার কার্যে মনোনিবেশ করা উচিত অবিলম্বে।

পরন্তপ হেসে বলল, তা তো করতেই হবে। তবে তার আগে আমার কয়েকটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলে ক্ষতি কি?

জিজ্ঞাসু চক্ষে পরন্তপের দিকে তাকাল কর্ণদেব। গুহার দ্বারপথে আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেল শশক।

» ১৯. অসি বাজে ঝন্‌ ঝন্

গুহার মধ্যস্থলে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড থেকে রক্তাভ আলোকধারা ছড়িয়ে পড়ছে অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে… আলোছায়ার খেলায় কয়েকটা ভৌতিক ছায়া লাফিয়ে উঠছে উপবিষ্ট তিনটি মানুষের মুখের উপর, দেহের উপর… অদুরে গুহাতলে নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে দুটি মৃতদেহ… একটি মৃতদেহের মস্তক বিদীর্ণ করে আড়াআড়িভাবে অবস্থান করছে একটি শাণিত তরবার এবং গুহাতলে শুষ্ক মৃত্তিকা ও কঠিন প্রস্তরের বুক ভাসিয়ে ছুটছে বিদারিত ক্ষতস্থান থেকে তপ্ত রক্তের ধারা…

সেই ভয়াবহ পরিবেশের স্তব্ধতা ভঙ্গ করে জাগল পরন্তপের কণ্ঠস্বর, কিছুদিন ধরেই আমি দুঃস্বপ্ন দেখছি। শুধু রাত্রে নয়, দিবালোকেও জাগ্রত অবস্থায় ওই স্বপ্ন আমাকে তাড়া করে ফিরছে। এতদিন বলতে পারি নি। কিন্তু এবার বলার সময় হয়েছে। মনে হয়, বন্ধুবর শশক আমাকে এই দুশ্চিন্তার কবল থেকে মুক্ত করতে পারবে।

একটু থেমে শশকের দিকে রহস্যময় ভঙ্গিতে কটাক্ষ করল পরন্তপ। বিভ্রান্তের মতো একবার পরন্তপ আর একবার শশকের মুখের দিকে চাইল কর্ণদেব পরন্তপের ইঙ্গিত তার বোধগম্য হচ্ছে না, কিন্তু কি যেন এক দুর্বোধ্য রহস্যের আভাস রয়েছে দস্য দলপতির কণ্ঠস্বরে।

শশকের মুখ পাথরের মত নির্বিকার। তার চোখের দৃষ্টি সঞ্চরণ করছে গুহার বাইরে অন্ধকার বনভূমির বুকে;- পরন্তপের দিকে না তাকিয়েই সে উদাস স্বরে বলল, প্রিয়বন্ধু পরন্তপকে দুশ্চিন্তার কবল থেকে মুক্তি দেওয়া আমার সাধ্য নয়। আমি জ্যোতিষী নই– যোদ্ধা।

বন্ধুবর শশকের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির উপর আমার অগাধ আস্থা, পরন্তপ সহাস্যে বলল, আর সে যে কী, আর কী সে নয়- তা আমি এখনও বুঝতে পারি নি তবে বুঝতে চেষ্টা করছি। যাই হোক, দুঃস্বপ্নের বৃত্তান্ত তোমাদের বলে হয়তো কিছুটা শান্তি পাব।

কর্ণদেবের মুখে ফুটল বিরক্তির আভাস, পরন্তপ! তোমার চিত্ত দুর্বল হয়ে পড়ছে। দুঃস্বপ্ন দেখে বিচলিত হওয়ার মতো দুর্বল মানুষ তো তুমি ছিলে না।

হয়তো তোমার কথা সত্য, পরন্তপের মুখের হাসি রহস্যময়, তবু অনুগ্রহ করে আমার কথা শোন। আমার বিশ্বাস, সকল বৃত্তান্ত শ্রবণ করলে তোমরা দুজনেই আমার চিত্তের দুর্বলতা দূর করতে সমর্থ হবে।

শশক পূর্বের মতোই নীরব। কর্ণদেব বলল, বেশ, শুনি তোমার দুঃস্বপ্নের বৃত্তান্ত।

পরন্তপ বলতে লাগল, একদিন স্বপ্ন দেখলাম এক পার্বত্যপথের উপর দিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ চোখে পড়ল পাহাড়ের গায়ে গা মিলিয়ে বসে আছে এক অনার্য প্রহরী! তার সম্পূর্ণ দেহ আমার দৃষ্টি সীমার মধ্যে ধরা না পড়লেও লোকটির অস্তিত্ব আমার কাছে গোপন রইল না। আমি জানি, ওরা এককভাবে থাকে না; আশে-পাশে নিশ্চয়ই অন্যান্য যোদ্ধারা অপেক্ষা করছে পাহাড় ও অরণ্যের অন্তরালে লুক্কায়িত হয়ে। চিৎকার করে তোমাদের সতর্ক করার চেষ্টা করলাম না। কারণ, তাহলে তারা আমাদের চারদিকে থেকে বেষ্টন করবে; আর একবার পরিবেষ্টিত হলে আত্মসমর্পণ অথবা যুদ্ধ ছাড়া নিষ্কৃতি লাভের অন্য উপায় থাকবে না। আত্মসমর্পণ করলে অনার্যরাজের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে এবং সেই কৈফিয়ত সন্তোষজনক না হলে সীমান্ত অভিমুখে আমাদের চলার পথ বন্ধ হয়ে যাবে অনার্যরাজের আদেশে। যুদ্ধের কথা ভাবলাম, ফল খুব আশাপ্রদ হবে বলে মনে হল না। সঙ্কীর্ণ গিরিপথে দুর্ধর্ষ অনার্য সেনার সঙ্গে যুদ্ধ করে যদি তাদের বহভেদ করতে পারি, তাহলেও আমরা সকলে অক্ষতদেহে মুক্তি পাব কিনা সন্দেহ। বিশেষ করে শশকের কিছু হলে সমূহ বিপদ- কারণ, নরমুণ্ডের পাহাড়ের অবস্থিতি সে ছাড়া আর কারও জানা নেই। অনার্যদের সঙ্গে একবার যুদ্ধ করার পর তাদের অধিকারভুক্ত অঞ্চলে চলাফেরা করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। সেই অবস্থায় অনুসন্ধান করে করোটি পাহাড়কে আবিষ্কার করা শুধু দুঃসাধ্য নয়, প্রায় অসম্ভব। ভাবলাম, ধীরে ধীরে এক এক করে তোমাদের পাশে গিয়ে নতস্বরে সকলকে সাবধান করে দেব। একবার সমতল ভূমিতে পড়লে বিপদের আশঙ্কা কম– অন্তত পলায়নের পথ কিছুটা সহজ হবে। কিন্তু তোমাদের কাছে গিয়ে কিছু বলার দরকার হল না;- হঠাৎ দেখলাম বন্ধুবর শশকের সঙ্গে ওই অনার্য প্রহরীর দৃষ্টি বিনিময় ঘটল। আমি অন্যমনস্ক হওয়ার ভান করলাম। শশক জানতেও পারল না আমি তাকে লক্ষ্য করেছি। তারপর

বাধা দিয়ে উত্তেজিত স্বরে কর্ণদেব বলল, এই ঘটনার একটাই অর্থ হতে পারে। শশকের সঙ্গে নিশ্চয়ই অনার্যদের যোগযোগ আছে। আর্যযোদ্ধা শশকের সঙ্গে অনার্য-প্রহরীর এমনকি সম্প্রীতির কারণ থাকতে পারে?… শশক! তুমি কি অনার্যরাজের গুপ্তচর?

শশক কিছু বলার আগেই পরন্তপ বলে উঠল, আহা! এটা তো স্বপ্ন। অত্যন্ত দুর্বিষহ এক দুঃস্বপ্ন। কিন্তু যদি এটা স্বপ্ন না হয়ে বাস্তব সত্য হয়, তাহলে বুঝতে হবে অনার্যদের সঙ্গে এমন সম্প্রীতির একটাই কারণ থাকতে পারে।

কর্ণদেব প্রশ্ন করল, কি কারণ?

পরন্তপ বলল, এই পথে বারংবার যাতায়াতের ফলে শশকের সঙ্গে অনার্যদের বন্ধুত্ব হতে পারে। কিন্তু যত বন্ধুত্বই থাক, চারটি সশস্ত্র মানুষকে শশকের সঙ্গে সীমান্তের দিকে যেতে দেখলে অনার্য-প্রহরী তাদের পথরোধ করবেই করবে। অনার্যরাজ মূলক এই অঞ্চলে অধিক সংখ্যক অস্ত্রধারী ব্যক্তির অস্তিত্ব পছন্দ করে না। কারণ, রাজদ্রোহী প্রজা অথবা শত্রুপক্ষের গুপ্তচরের পক্ষে এই অঞ্চলের কোনো ধ্বংসাত্মক কার্যে লিপ্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়, এবং সেই রকম কিছু ঘটলে শ্রাবস্তী রাজ্য হবে বিপন্ন। আমরা জানি মহারাজ রুদ্রদমনের অন্তরঙ্গ সুহৃদ এই অনার্যরাজ শ্রাবস্তীর আপদ-বিপদ সম্পর্কে অতিশয় সচেতন। তাই এই অঞ্চলে অধিক সংখ্যক সশস্ত্র পুরুষ চলাফেরা করলেই প্রচলিত প্রথা অনুসারে তার প্রহরীরা আগন্তুকদের পথরোধ করে প্রশ্ন করবে- প্রশ্নের উত্তর সন্তোষজনক না হলে তাদের নিয়ে যাবে রাজ সকাশে। শশকের সান্নিধ্য যদি এই নিয়মের অন্যথা হয়, তাহলে বুঝতে হবে সে মহারাজ রুদ্রদমনের গুপ্তচর, অনার্যদের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। গুপ্তধন আবিষ্কারের পরেই সম্ভবত অনার্যরা আমাদের বন্দি করবে।

দারুণ উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠে কর্ণদেব বলল, কি নিদারুণ বার্তা! শশক! তুমি মহারাজ রুদ্রদমনের গুপ্তচর?

শান্ত স্বরে শশক বলল, তাহলে তো বহু পূর্বেই আমার ইঙ্গিতে অনার্য সেনা তোমাদের বন্দি করত।

আশ্বস্ত হয়ে কর্ণদেব বলল, হ্যাঁ, এটা যুক্তিসঙ্গত কথা।

পরন্তপ বলল, আমাদের বন্দি না করার পিছনে অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে। অনার্যদের হাতে বন্দি হলে দৈবক্রমে আমাদের মধ্যে কেউ গুপ্তধনের সংবাদ বলে ফেলতে পারে এই সম্ভাবনার বিষয় চিন্তা করেই হয়তো শশক আমাদের বন্দি করতে দেয়নি। অথবা আরও গাঢ় গোপন উদ্দেশ্য থাকতে পারে।

বিচলিত হয়ে কর্ণদেব বলল, আরও গুঢ় উদ্দেশ্য?… নাঃ! যা শুনলাম, তাতেই আমি চমকিত হয়েছি। এখন তো তাহলে

বাক্য অসম্পূর্ণ রেখে সে শশকের দিকে দৃষ্টিপাত করল, দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত হল তরবারির হাতলের দিকে।

শশক বাক্য ব্যয় করল না। অটল হয়ে বসে রইল। কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি এখন দুরমনস্কের মতো নয়, নিবিষ্টচিত্তে সে সঙ্গীদের লক্ষ্য করছে তার দেহের ভঙ্গি লক্ষন-উদ্যত ব্যাঘ্রের ন্যায় ঈষৎ সঙ্কুচিত- স্থির, কিন্তু প্রতীক্ষায় ভয়ঙ্কর।

সেইদিকে একবার তাকিয়েই কর্ণদেবের দিকে ফিরল পরন্তপ, শান্ত হও কর্ণদেব। স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন হলেও স্বপ্ন; তার সঙ্গে বাস্তবের যোগাযোগ নেই।

ভ্রূ কুঞ্চিত করে কর্ণদেব বলল, কিন্তু তোমার স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের যোগাযোগ আছে মনে হয়।

আহা! তুমি অনর্থক উত্তেজিত হচ্ছ, পরন্তপ বলল, স্বপ্নের কথা শুনে যদি কেউ উত্তেজিত হয়, তাহলে আমি তাকে দুর্বলচিত্ত মানুষ বলব। তুমিও একটু আগে আমকে দুর্বলচিত্ত বলে দোষারোপ করেছ- নয় কি কৰ্ণদেব?

-সত্য। কিন্তু তোমার দুঃস্বপ্ন যে আমাকেও ভীত করে তুলেছে।

অথচ আমাদের বন্ধু শশক কেমন নির্বিকার দেখেছ? আমার দুঃস্বপ্নের আতঙ্ক তাকে স্পর্শমাত্র করেনি। শশক আদর্শ পুরুষ। দেহের মত তার মনও বলিষ্ঠ।

শশক কোনো কথা বলল না। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। কিন্তু তার বসার ভঙ্গি শিথিল নয়- শ্বাপদের ন্যায় ঋজু, সতর্ক।

একবার সেইদিকে দৃষ্টিপাত করে পরন্তপ কর্ণদেবের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, আর একটি স্বপ্ন বৃত্তান্ত বলছি, শোনো। দেখলাম সন্ধ্যাকালে তির নিক্ষেপ করে শশক একটি বন্য বরাহকে হত্যা করল। তারপর সেই মৃত পশুকে স্কন্ধে বহন করে সে যখন ফিরে আসছে, সেই সময় অরণ্য ভেদ করে তার সামনে এসে দাঁড়াল কয়েকজন অস্ত্রধারী অনার্য সেনা। তাদের সঙ্গে শশকের কথাবার্তা আমি শুনতে পাইনি। দেখলাম, একটু পরেই সে ফিরে এল তোমাদের কাছে। তোমরা একটি নদীতটে বিশ্রাম করছিলে। শশকের স্কন্ধে বরাহ দেখে সকলেই আসন্ন ভোজের সম্ভাবনায় সোল্লাসে অভিনন্দন জানালে। তারপর কি হল মনে নেই, কারণ, তখনই আমার স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিল।

কর্ণদেব উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল, আমার মনে আছে একদিন সন্ধ্যায় আমরা যখন নদীতটে বসেছিলাম, সেই সময় সত্যই তিরবিদ্ধ এক বরাহের মৃতদেহ নিয়ে এসেছিল শশক এবং সেই মাংসে আমরা ক্ষুন্নিবৃত্তি করেছিলাম। আমার একথাও মনে আছে–শশক মৃগয়ার জন্য বনমধ্যে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই তুমি হঠাৎ ফলাহারের ইচ্ছা প্রকাশ করলে এবং সুমিষ্ট ফলের সন্ধানে অদৃশ্য হলে অরণ্যগর্ভে। শশক বরাহ নিয়ে প্রত্যাবর্তন করার একটু পরেই শুন্য হাতে ফিরে এসে তুমি জানিয়েছিলে ফলের সন্ধান পাওয়া যায়নি। সেদিন হঠাৎ অরণ্যজাত ফলের উপর তোমার অস্বাভাবিক আকর্ষণ দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম, কিন্তু আজ বুঝতে পারছি তুমি গোপনে শশককে অনুসরণ করেছিলে। সম্ভবত তার আগেই অনার্য প্রহরীর সঙ্গে শশকের দৃষ্টিবিনিময় তোমাকে শশকের গতিবিধি সম্পর্কে সন্দিহান করে তুলেছিল।… কিন্তু কি ভয়ানক ব্যাপার! শশক। পরন্তপের অভিযোগ শোনার পর তোমার কি বলার আছে?

শশক নির্বিকার স্বরে বলল, কিছু না। কারও স্বপ্ন-বৃত্তান্ত নিয়ে মতামত প্রকাশ করতে আমি রাজি নই।

কর্ণদেব ক্রুদ্ধস্বরে বলল, তুমি গুপ্তচর!

শশক কিছু বলার আগেই পরন্তপ বলে উঠল, ভুল ধারণা। আমি জানি শশক গুপ্তচর নয়।

পরস্পর বিরোধী মন্তব্যে হতচকিত কর্ণদেব বিহ্বল স্বরে বলল, গুপ্তচর নয়?

দৃঢ়স্বরে পরন্তপ বলল, না। শশক যে গুপ্তচর নয় এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।

স্তম্ভিত কর্ণদেব জিজ্ঞাসা করল, তবে সে কী? তুমি এতক্ষণ যা যা বললে তাতে তো তাকে, গুপ্তচর বলেই সন্দেহ হয়।

পরন্তপ হাসল, বন্ধুবর শশক যা বলল, আমি সেই কথারই পুনরুক্তি করব। স্বপ্ন-বৃত্তান্ত শুনে কোনো ব্যক্তিকে দোষারোপ করা যায় না।

কর্ণদেব কি যেন বলতে গেল, কিন্তু তাকে মুখ খোলার সুযোগ না দিয়ে পরন্তপ বলে উঠল, শ্রাবস্তী রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি এবং মহারাজ রুদ্রদমনের গতিবিধি সম্পর্কে তোমার কি মনে হয় কর্ণদেব?

কর্ণদেব রুষ্টস্বরে বলল, আমার মনে হয় মদ্যপান না করেও তুমি আজ নেশাগ্রস্ত হয়েছে। স্বপ্নবৃত্তান্ত ছেড়ে হঠাৎ মহারাজ রুদ্রদমন আর শ্রাবস্তী রাজ্যের প্রসঙ্গ তোমার মাথায় এল কেন? এমন অসংলগ্ন কথাবার্তার অর্থ কি?

অসংলগ্ন নয় হে, অসংলগ্ন নয়, পরন্তপ হাসল, আমার স্বপ্ন-বৃত্তান্তের সঙ্গে মহারাজ রুদ্রদমন আর শ্রাবস্তী রাজ্যের প্রসঙ্গ জড়িত আছে। কণ! তুমি নিশ্চয়ই জানো, যখন কোনো ব্যক্তিকে রাজদরবার থেকে সমাজবিরোধী আখ্যা দিয়ে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়, তখন সেই ব্যক্তি যদি রাজাদেশ পালন না করে, অথবা দেশান্তরী না হয় তাহলে

বাধা দিয়ে কর্ণদেব বলল, তাহলে একদিন সেই সমাজবিরোধী ব্যক্তির মৃতদেহ রাজ্যের মধ্যেই কোনো এক স্থানে আবিষ্কৃত হয় এবং দেখা যায় ওই মৃতদেহের ললাটে বা বক্ষে আঁকা আছে রক্তাক্ত শায়ক চিহ্ন। লোকে বলে দেবরাজ বাসব স্বহস্তে ওই দুবৃত্তের প্রাণদণ্ড দিয়ে তার দেহে শায়ক চিহ্নের প্রতীক অঙ্কিত করেন। যে কথা এই রাজ্যের শিশুরাও জানে, এই মুহূর্তে সেই প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করছ কেন?

পরন্তপ বলল, জানা বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে কখনো কখনো অজানা রহস্যেরও সমাধান হয়। কর্ণদেব। তুমি শিক্ষিত সাধারণ শিক্ষা নয়, পণ্ডিত পিতার তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন শাস্ত্র ও দর্শন অধ্যয়ন করেছ তুমি কি বিশ্বাস করো দেবরাজ ইন্দ্র স্বহস্তে রাজশত্রুকে হত্যা করে সেই ব্যক্তির ললাটে বা বক্ষে প্রতীক চিহ্ন অঙ্কন করেন?

ক্ষণকাল চিন্তা করে কর্ণদেব বলল, না। ও কথা আমি বিশ্বাস করি না।

পরন্তপ আবার প্রশ্ন করল, তাহলে শায়ক চিহ্নে কেন চিহ্নিত হয় নিহত ব্যক্তির ললাট বা বক্ষ? সকলের অজ্ঞাতে ওই দুরূহ কর্মটি কে সমাধা করে?

চিন্তিত স্বরে কর্ণদেব বলল, তা বলতে পারি না। তবে কোনো অদৃশ্য দৈবশক্তি যে এই সকল ঘটনার সঙ্গে জড়িত, সে কথা আমি বিশ্বাস করি না। যে ভাবেই হোক কোনো ব্যক্তি জনসাধারণের অজ্ঞাতসারে দুর্বৃত্তদের সন্ধান নিয়ে তাদের সম্মুখীন হয়, তারপর গোপনে তাদের হত্যা করে চলে যায়। তবে যে ব্যক্তি এই কাজ করে, সে যেমন চতুর, রণবিদ্যায় তেমনই দক্ষ। কারণ, জনারণ্যে লুক্কায়িত দুৰ্বত্তের সন্ধান পাওয়া খুবই কঠিন। তারপর তাকে সম্মুখযুদ্ধে হত্যা করাও সহজ কাজ নয়। নিহত ব্যক্তিদের যে অতর্কিতে আক্রমণ করে গুপ্তভাবে হত্যা করা হয় না, সেই প্রমাণও আছে। ওই সকল নিহত ব্যক্তির দেহে অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন পরীক্ষা করে অভিজ্ঞ প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন যে ওই ধরনের ক্ষতচিহ্নের উৎপত্তি হতে পারে দ্বন্দ্বযুদ্ধের ফলে– গুপ্তঘাতকের আঘাতে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয় তার ধরন অন্যরকম। তাছাড়া, গুপ্তঘাতক সাধারণত ছুরিকা ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু শায়ক চিহ্নিত ব্যক্তিদের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করে দেখা গেছে অধিকাংশ সময়েই তারা মৃত্যুবরণ করেছে তরবারির আঘাতে। মৃত্যুর পর হন্তারক নিহতের দেহে অঙ্কন করেছে শায়ক চিহ্ন। দুই একটা ব্যতিক্রম আছে। প্রায় তিন বৎসর আগে রাজধানীর পথপ্রান্তে দস্যু বিলোমের যে মৃতদেহ ছিল, তাতে অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন ছিল না। ললাটে ও বক্ষে উভয় স্থানেই ছিল রক্তাক্ত শায়ক চিহ্ন। কিন্তু এই সকল আলোচনার প্রয়োজন কি পরন্তপ?

কর্ণদেবের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পরন্তপ বলল, বিলোমের মৃত্যু আমার মনে আছে। আরও কয়েক বৎসর আগে কল্মষপাদ নামে এক দস্যুর মৃতদেহ দেখেছিল আমার এক অনুচর। তার মুখে শুনেছি ওই দস্যর ললাটে ছিল শায়ক চিহ্ন আঁকা, কিন্তু তার দেহে ছিল না অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন। এখন বলো তো কর্ণদেব– শুধু মাত্র ললাটে রক্তাক্ত একটি চিহ্ন ধারণ করে কোনো ব্যক্তি যদি মৃত্যুবরণ করে, তাহলে দেবরোষে তার মৃত্যু ঘটেছে একথা বলা যায় কিনা?

কর্ণদেব বলল, না। আমি যুক্তিবাদী, প্রত্যক্ষ যুক্তি ছাড়া কিছু বিশ্বাস করি না। আমি জানি প্রচণ্ড শক্তিশালী কোনো পুরুষের মুষ্ট্যাঘাতের ফলে হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আহত ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে; কিন্তু সেই আঘাতের চিহ্ন মৃতের দেহে লক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনাই নেই। খুব সম্ভব ওই ভাবেই দস্যু বিলোম আর কল্মষপাদ প্রাণ হারিয়েছে। হত্যার পর হন্তারক নিহতদের শায়ক চিহ্নে চিহ্নিত করে স্থান ত্যাগ করেছে।

ঠিক বলেছ, পরন্তপ বলল, এখন বলো তো নিহত ব্যক্তির ললাটে বা বক্ষে শায়ক চিহ্নের উৎপত্তি কি করে হতে পারে?

একটু চিন্তা করে কর্ণদেব বলল, বলতে পারছি না।

আরও একটি বিষয় ভেবে দেখা উচিত, পরন্তপ বলল, শায়ক চিহ্নে চিহ্নিত মৃতদেহ যখন দেখা যায়, সেই সময় রুদ্রদমন রাজ্যে উপস্থিত থাকেন না। আরও বিশদভাবে বললে বলতে হয়, মহারাজের রাজবপু যতক্ষণ সিংহাসনে শোভা পায়, ততক্ষণ অবাঞ্ছিত দস্য নিরাপদ। মহারাজ সিংহাসন ত্যাগ করে রাজ্য থেকে অন্তর্হিত হওয়ার পরেই অপরাধীর প্রাণসংশয় ঘটে। কর্ণদেব। মহারাজের সিংহাসন ত্যাগ করে অন্তর্ধান করার সঙ্গে অপরাধীর মৃত্যু আর শায়ক চিহ্নের রহস্য জড়িত আছে। এইবার সব রহস্যের মীমাংসা করো। দেখি, তুমি কেমন বুদ্ধিমান?

কিছুক্ষণ নীরব থেকে কর্ণদেব বলল, না, পরালাম না।

পারবে, পরন্তপ বলল, বন্ধুবর শশকের বামহস্তের অঙ্গুরীয়টি পরীক্ষা করলেই রহস্যের সমাধান করতে পারবে।

নিকটেই উপবিষ্ট শশকের বামহস্তের অনামিকাতে পরিহিত অঙ্গুরীয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে কর্ণদেব বলল, অঙ্গুরীয়টির মধ্যে আমি কোনো বৈশিষ্ট্য দেখতে পাচ্ছি না। অধিকাংশ ব্যক্তি অবশ্য স্বর্ণ বা রৌপ্য নির্মিত অঙ্গুরীয় পরিধান করে থাকে, তবে অন্যান্য ধাতুতে গঠিত অঙ্গুরীয় মাঝে মাঝে দৃষ্টিগোচর হয়। তবে অঙ্গুরীয়ের মধ্যস্থলে প্রস্তর বা রত্ন না থাকলেও সাধারণত ওই অংশটি চতুষ্কোণ বা বৃত্তাকারে স্ফীত হয়ে থাকে। কিন্তু শশকের অঙ্কুরীয়তে কোথাও চতুষ্কোণ বা বৃত্তাকার স্ফীতি নেই, আগাগোড়া সুগোল। ওই ধরনের অঙ্গুরীয় সংখ্যায় কম হলেও একেবারে বিরল এ কথা বলা যায় না। বিশেষত শ্রমজীবী দরিদ্র শ্রেণির মানুষের আঙুলে ওই প্রকার ধাতুনির্মিত অঙ্গুরীয় অনেক সময়েই চোখে পড়ে। আমি তো শশকের অঙ্গুরীয়তে কোনো বৈশিষ্ট্য দেখতে পাচ্ছি না।

কর্ণদেব! হাতের উপরিভাগে কোনো বৈশিষ্ট্য তুমি দেখতে পাবে না, পরন্তপ বলল, কিন্তু বন্ধুবর শশক যদি করতল প্রসারিত করে, তাহলে আমার বিশ্বাস অঙ্গুরীয়তে কিছু বৈশিষ্ট্য তুমি আবিষ্কার করতে পারবে।

তাই নাকি? কর্ণদেব সবিস্ময়ে বলল, দেখি! দেখি! শশক স্থির হয়ে বসে রইল, হাত উলটিয়ে কর্ণদেবের কৌতূহল নিবারণের চেষ্টা করল না।

পরন্তপ বলল, উঁহু, বন্ধুবর তোমার সম্মুখে করতল প্রসারিত করতে রাজি হবে মনে হয় না। অঙ্গরীয়টি আদৌ সলোল বা সড়োল নয়, মধ্যস্থলের স্ফীত অংশটি সযত্নে ঘরিয়ে করতলে আবৃত আছে- পাছে তোমাদের দৃষ্টি ওদিকে পড়ে।

কর্ণদেব বলল, আমাদের দৃষ্টি পড়লে ক্ষতি কি? মধ্যস্থলের স্ফীত অংশটি ঢেকে রাখার চেষ্টাই বা কেন?

ক্ষতি আছে বৈকি, পরন্তপ বলল, মধ্যস্থলের স্ফীত অংশটি ঢেকে রাখার কারণ ঐখানেই খোদিত আছে শায়ক চিহ্ন।

শায়ক চিহ্ন! প্রায় চিৎকার করে উঠল কর্ণদেব, ওই চিহ্ন তো সাধারণ মানুষের ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। শায়ক চিহ্নই তো রাজশক্তির প্রতীক। শশক তাহলে সত্যই মহারাজ রুদ্রদমনের বিশ্বস্ত গুপ্তচর!

পরন্তপ বলল, তুমি নিতান্তই মূর্খ। তুমি দেখেছ শল্যের উদ্ধারপর্বে আর নেকড়েবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে এই ব্যক্তি অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেছে; দূর থেকে একাধিক অশ্বের বলগা বাণাঘাতে ছিন্ন করে এবং আক্রমণোদ্যত হস্তীর দুই চক্ষুকে অব্যর্থ সন্ধানে তিরবিদ্ধ করে অত্যাশ্চর্য ধনুর্বিদ্যার পরিচয় দিয়েছে– সর্বশেষে গুহাগাত্রে খোদিত আদ্য-অক্ষরের জটিল রহস্য ভেদ করে গুপ্তধন আবিষ্কার করেছে অনায়াসে। দেহে-মনে এমন অসাধারণ শক্তিধর উচ্চাভিলাষী না হয়ে গুপ্তচরের ঘৃণ্য ও তুচ্ছ বৃত্তি অবলম্বন করবে?… কর্ণদেব! তুমি নির্বোধ!… তোমার সম্মুখে শশক নামে অভিহিত মানুষটি হলেন মহারাজ রুদ্রদমন।

বিস্ময়-অভিভূত কণ্ঠে কর্ণদেব বলে উঠল, তুমি– আপনি, মহারাজ রুদ্রদমন?

মৃদুহাস্যে ওষ্ঠাধর রঞ্জিত করে শশক বলল, না, কর্ণদেব আমি মহারাজ রুদ্রদমন নই। আমার মতো সামান্য ব্যক্তিকে মহারাজ সম্বোধনে সম্মান প্রদর্শন করলে শ্রাবস্তীর অধিপতি মহারাজ রুদ্রদমনকে অপমান করা হয়। তাই রাজভক্ত প্রজার কর্তব্য অনুসারে প্রতিবাদ জানিয়ে বলছি- আমি শশক, মহারাজ রুদ্রদমন নই। যোদ্ধার ছদ্মবেশে ভ্রাম্যমাণ এক গুপ্তচর পরন্তপের শ্যেনদৃষ্টিতে ধরা পড়েছে একথা স্বীকার করলেই বন্ধুবর পরন্তপের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও বিশ্লেষণ শক্তিকে যথেষ্ট স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু গুপ্তচর শশককে ছদ্মবেশী মহারাজ মনে করলে বন্ধুবরের মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্পর্কে যে-কোনো ব্যক্তি সন্দেহ প্রকাশ করবে।

দ্বিধাজড়িত স্বরে কর্ণদেব বলল, শশক! স্বীকার করছ তুমি।

শশক বলল, আমি মহারাজের নিযুক্ত গুপ্তচর। পরন্তপের সন্ধানে বিচরণ করছি দেশের বিভিন্ন স্থানে। আমার বুদ্ধি, শক্তি ও অস্ত্রচালনার দক্ষতায় প্রশংসা করে পরন্তপ বলেছে আমার ন্যায় দেহে-মনে অসাধারণ শক্তির অধিকারী কোনো ব্যক্তি উচ্চাভিলাষী না হয়ে গুপ্তচরের তুচ্ছ বৃত্তিতে আত্মনিয়োগ করতে পারে না। বন্ধুবর পরন্তপের উক্ত মন্তব্যের বিরুদ্ধে বিনীত প্রতিবাদ জানিয়ে বলছি, উচ্চাভিলাষী বিশেষণটি নিতান্তই আপেক্ষিক। আমি ব্যক্তিগতভাবে গুপ্তচরবৃত্তিকে ঘৃণ্য বা তুচ্ছ মনে করি না। দেশের শুভঅশুভ জানার জন্যে এবং অন্তর্ঘাতী কার্যকলাপ রোধ করার জন্যে গুপ্তচরের প্রয়োজন আছে। বীরযোদ্ধাকে দেশের মানুষ শ্রদ্ধা করে দেশের কার্যে আত্মনিয়োগ করে যে যোদ্ধা নিহত হয়, সে সমগ্র দেশবাসীর শ্রদ্ধার পাত্র; কিন্তু যে গুপ্তচর দেশবাসীর কল্যাণের জন্য মৃত্যুবরণ করে, তার উদ্দেশে একটি সহানুভূতির বাক্য পর্যন্ত উচ্চারিত হয় না। অথচ লোকচক্ষুর অন্তরালে ওই গুপ্তচরবৃন্দ প্রতি মুহূর্তে প্রাণ বিপন্ন করছে দেশেরই কল্যাণ কামনায়। এই নীরব আত্মদান, এই নীরব দেশসেবা যদি ঘৃণ্য ও তুচ্ছ হয়, তাহলে মহৎ কার্য কাকে বলব?… না, কর্ণদেব! গুপ্তচরবৃত্তি ঘৃণ্য নয়, তুচ্ছ নয়। আমার সামান্য শক্তি দিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে আমি এইভাবেই দেশসেবা করে যাব– এই আমার অভিলাষ। এই অভিলাষকে যদি কেউ উচ্চ-অভিলাষ আখ্যা দিতে রাজি না হয়, তবে সেটা ব্যক্তিগত মতামতের ব্যাপার। কিন্তু রণক্ষেত্রে সহস্র মানুষের বাহবার সম্মুখে স্ফীতবক্ষ প্রশংসালুব্ধ কোনো উচ্চাভিলাষী বীরপুরুষের তুলনায় আমি নিজেকে কোনো অংশে হীন মনে করি না। গুপ্তচরবৃত্তির জন্য আমি লজ্জিত নই কিছুমাত্র। লজ্জা এই যে, আমার চাইতে অধিকতর বুদ্ধিমান এক ব্যক্তির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার প্রকৃত স্বরূপ ধরা পড়ে গেছে।

কর্ণদেব বিব্রতস্বরে বলল, শশক! তুমি যে গুপ্তচর একথা তাহলে সত্য। আমাদের অস্তিত্ব এখন বিপন্ন। তোমাকে হত্যা করাই এখন আমাদের কর্তব্য।

শশক হেসে বলল, যদি কোনো সীমান্তরক্ষী বা নগররক্ষী তোমাদের হাতে প্রাণ হারায়, তাহলে দেশের মানুষ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলবে দস্যুকে বন্দি করতে গিয়ে যে রক্ষী মৃত্যুবরণ করে, তার কর্তব্যবোধের তুলনা হয় না। কিন্তু দেখ, আজ তোমাদের হাতে প্রাণ হারালে আমার নাম পর্যন্ত কোথাও উচ্চারিত হবে না। অথচ রক্ষীদের মতো আমিও তোমাদের বন্দি করার জন্যই প্রাণ বিপন্ন করছি। অতএব দেখছ, গুপ্তচরের দেশপ্রেমের কোনো পুরস্কার নেই।

কর্ণদেব বলল, গুপ্তচরবৃত্তি ভালো কি খারাপ সেটা নিয়ে আদৌ চিন্তা করছি না। আমি চিন্তিত হয়েছি আমাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে। বর্তমানে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তাতে মনে হয় তোমাকে হত্যা করতে পারলে আমরা নিরাপদ কিন্তু ওই চিন্তাকে কার্যে পরিণত করার প্রবৃত্তি হচ্ছে না।

শশক বলল, তোমাদের নিরাপত্তা আদৌ বিপন্ন নয়। মহারাজ রুদ্রদমনের কাছে আমি এমন বার্তা নিয়ে যাব না, যাতে তোমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। এই ধনভাণ্ডার থেকে পরন্তপ যদি তার প্রাপ্য অংশ নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে অন্য রাজ্যে পলায়ন করে, তবে আমি তাকে বাধা দেব না। অতএব, নিরাপত্তা সম্পর্কে তোমাদের ভীত হওয়ার কারণ নেই।

–তুমি বাধা না দিলেও অনার্যসেনা আমাদের বন্দি করতে পারে।

-করবে না। বন্ধুবর পরন্তপের স্বপ্নবৃত্তান্ত শুনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ ওই প্রহরীদের উপর আমার কিছু প্রভাব আছে। সুতরাং, মাভৈঃ!

পরন্তপ হেসে বলল, আমার কিশোর বন্ধু কর্ণদেব নিশ্চয়ই মহারাজের আশ্বাসবাক্যে আশ্বস্ত হয়ে নিরাপদ বোধ করছে। কিন্তু আমি পুরাতন পাপী, আমার মনোভাব ভিন্ন। এই বিপুল সম্পদের ভিতর থেকে আমাদের প্রাপ্য অংশ নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে কৌশাম্বী রাজ্যে পদার্পণ করা বর্তমানে আমাদের পক্ষে অসম্ভব। কারণ, আমাদের সঙ্গে অশ্ব নেই। কিছু অর্থ নিয়ে কৌশাম্বীতে গিয়ে সেখান থেকে অশ্ব ক্রয় করে এখানে আমরা ফিরে আসতে পারি, কিন্তু সেটা হবে পণ্ডশ্রম। ততক্ষণে এই সম্পত্তি যে মহারাজ রুদ্রদমনের অধিকারভুক্ত হবে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। তাছাড়া, বর্তমানে শশকের ছদ্মবেশে মহারাজ রুদ্রদমন আমাদের নিরাপদে দেশান্তরী হওয়ার সুযোগ দিলেও পরবর্তীকালে সীমান্ত অতিক্রম করে পুনরায় এইস্থানে প্রত্যাবর্তন করলে তিনি আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন বলে মনে হয় না। কি বলেন মহারাজ?

শশক বলল, মহারাজ রুদ্রদমন তার রাজ্যসীমার মধ্যে তোমার উপস্থিতি বাঞ্ছনীয় মনে করেন না, ভবিষ্যতেও করবেন না। কিন্তু তার অযোগ্য সেবক শশকের ধারণা পরন্তপের মতো মানুষ দস্যুবৃত্তি করলেও সে অনন্যসাধারণ ব্যক্তি– অতএব, উক্ত পরন্তপকে শ্রাবস্তীর বাইরে সভাবে জীবনযাপনের একটা সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। তাই পুনরায় প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা ত্যাগ করে মূল্যবান কিছু রতন নিয়ে পরন্তপের কাল প্রত্যূষেই পলায়ন করা কর্তব্য। রত্নাদি বহন করার জন্য অশ্বের প্রয়োজন হবে না। কৌশাম্বী রাজ্যে গিয়ে ওই সকল রত্ন বিক্রয় করে যে অর্থ পাওয়া যাবে, তা দিয়ে একটি বা দুটি মানুষ নতুন ভাবে জীবন শুরু করতে পারে অনায়াসে। এই চিন্তা বোধহয় অনেক আগেই পরন্তপের মনে এসেছে, তাই কারও পরামর্শ ছাড়াই মূল্যবান কিছু রত্ন সে এর মধ্যেই হস্তগত করেছে। প্রত্যূষে পরন্তপের নিরাপদে সীমান্ত অতিক্রম করার ব্যবস্থা এই অধম করে দিতে পারবে বলেই মনে হয়।

ঊর্ধ্বাঙ্গ নত করে অভিবাদন জানিয়ে পরন্তপ বলল, মানুষ নিজের অবস্থায় সর্বদাই অসন্তুষ্ট। ক্ষুধার্ত ব্যক্তি অযাচিত ভাবে আহার্যের সন্ধান পেলেও সুখী হয় না, তৎক্ষণাৎ শয়নের ব্যবস্থা করার জন্য সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মানব-চরিত্রের ওই চিরন্তন দুর্বলতা থেকে আমিও মুক্ত নই। একটু আগেও বন্ধুবর শশক যা বলল, সেই রকম আমার পরিকল্পনাই ছিল। আর সেইজন্যই কয়েকটি মহার্ঘ রত্ন নিয়ে আমি প্রত্যূষে সকলের অজ্ঞাতসারে কর্ণদেবের সঙ্গে স্থান ত্যাগ করার সঙ্কল্প করেছিলাম। পরিবেশের এখন কিছু পরিবর্তন ঘটেছে, তাই বর্তমানে পূর্ব-সঙ্কল্প ত্যাগ করাই উচিত মনে করছি। শশকের যথার্থ পরিচয় শায়ন ও বল্লভের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হতো কি না সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই— তাদের অমতে তাদেরই সম্মুখে শশক অর্থাৎ মহারাজ সম্পর্কে স্বাধীন ভাবে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব হত না। সেইজন্যই কোনো কথা না বলে আমি স্থানত্যাগের পরিকল্পনা করেছিলাম। আকস্মিকভাবে ওই দুই ব্যক্তির মৃত্যু হওয়ায় পরিবেশ পরিবর্তিত; এবং আমিও পূর্বসঙ্কল্প ত্যাগ করে নতুন এক সিদ্ধান্তে উপস্থিত হয়েছি। ইহজীবনে বহু কুকর্ম করায় প্রাণান্তে নরকবাস আমার নিশ্চিত কিন্তু স্বর্গাধিপ ইন্দ্রের প্রিয়পাত্র মহারাজ রুদ্রদমনের হস্তে যুদ্ধে নিহত হলে নিশ্চয়ই স্বর্গে আরোহণের সুযোগ পাব। অতএব, মহারাজ! অসি নিষ্কাষিত করে আমাকে উদ্ধার করুন।

কথা শেষ করেই সশব্দে তরবারি কোষমুক্ত করল পরন্তপ। কর্ণদেব সবিস্ময়ে বলে উঠল, পরন্তপ। এই ব্যক্তি মহারাজ রুদ্রদমন অথবা গুপ্তচর শশক তা আমি জানি না। কিন্তু বিনা প্রয়োজনে তুমি যুদ্ধে লিপ্ত হতে চাইছ কেন? আমাদের যাত্রাপথ নির্বিঘ্ন, অনর্থক এই ব্যক্তির সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই।

পরন্তপ বলল, প্রয়োজন আছে কিনা সেটা আমি বুঝব। তুমি চুপ করো।

কর্ণদেব বলল, না। শশকের প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে আমি কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারি নি। কিন্তু এই ব্যক্তি আমাদের বন্ধুস্থানীয়। এই ভয়ঙ্কর যাত্রাপথে সে ছিল আমাদের অপরিহার্য সঙ্গী। আজ প্রয়োজন ফুরিয়েছে বলেই তাকে তুমি হত্যা করতে চাও?… না। আমি তোমাকে এমন অসঙ্গত কাজ করতে দেব না, পরন্তপ।

পরন্তপ রূঢ়স্বরে বলল, কর্ণদেব! মনে রেখো– আমি তোমাকে ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের গ্রাস থেকে রক্ষা করেছি। শ্রাবস্তীর আতঙ্ক দস্যু পরযুপের বিরুদ্ধাচরণ করতে আজ তুমি ভীত নও- কিন্তু কার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তোমার এত সাহস? কে তোমায় অস্ত্রচালনার শিক্ষা দিয়েছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর? কার শিক্ষার গুণে এক ভীরু বালক কৈশোরে পদার্পণ করে ব্যাঘ্রবৎ বিক্রমের অধিকারী?

তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল পরন্তপের উগ্র কণ্ঠ, কর্ণদেব! আজ আমার জন্যই তোমার এই রূপান্তর। মেষশাবক আজ আমারই শিক্ষার গুণে ব্যাঘশাবকে পরিণত- কিন্তু কর্ণদেব! আমার গুরুদক্ষিণা কোথায়?… নীরব কেন কর্ণদেব?… আচ্ছা, তুমি নীরব ও নিরপেক্ষ হয়ে অবস্থান করলেই আমার গুরুদক্ষিণা দেওয়া হবে। মহারাজ! প্রস্তুত হন, আমি আপনাকে আক্রমণ করছি।

পরন্তপ এক পা অগ্রসর হয়ে অসি উদ্যত করতেই শশক বলল, আমি রুদ্রদমন নই, আমি নিতান্তই শশক। পরন্তপ! অকারণ যুদ্ধে পরস্পরের প্রাণ বিপন্ন করার কি প্রয়োজন?

মহারাজ রুদ্রদমন! আপনার বাগজালে কিশোর কর্ণদেব বিভ্রান্ত হতে পারে, পরন্তপ বলল, কিন্তু আমি আপনার কথায় ভুলব না। দীর্ঘ এই পদযাত্রায় আপনার গতিবিধি আমি লক্ষ করেছি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এমন নির্ভীক রাজোচিত পদক্ষে, সিংহাবলোকনে দৃষ্টিপাত এবং উদ্ধত গ্রীবাভঙ্গির এমন অপূর্ব সমন্বয়ের অধিকারী হবে ছিদ্রান্বেষী এক গুপ্তচর?… অসম্ভব। আর অকারণ যুদ্ধের কথা যদি বলেন, তাহলে বলব কারণ-অকারণে বিচার নিতান্তই আপেক্ষিক একের বিচারে যেকর্ম অবশ্য করণীয়, অপরের বিচারে তা নিরর্থক।

ক্ষান্ত হও পরন্তপ, গম্ভীর স্বরে শশক বলল, আমি তোমাকে হত্যা করতে চাই না।

কিন্তু আমি আপনাকে হত্যা করতে চাই, পরন্তপের ওষ্ঠাধরে কঠিন হাসির রেখা, মহারাজ রুদ্রদমন আর দস্যু পরন্তপের একই রাজ্যে স্থান হতে পারে না। আমি এই রাজ্যেই বাস করতে চাই। অতএব, আপনাকে হত্যা করতে আমি সচেষ্ট হব। প্রস্তুত হন মহারাজ এই আমি আক্রমণ করলাম।

তরবারিকে অগ্রবর্তী করে আক্রমণ করল পরন্তপ বিদ্যুৎ শিখার ন্যায় ছুটে এল শাণিত অস্ত্র শশকের বক্ষ অভিমুখে! সঙ্গে সঙ্গে এক পায়ের উপর ভর দিয়ে ঘুরে গেল শশকের দেহ- ক্ষিপ্র আকর্ষণে কোষ হতে অর্ধ-উত্থিত তরবারিতে ঘর্ষিত হয়ে লক্ষ্যস্থল থেকে সরে গেল পরন্তপের অস্ত্র ব্যর্থ আক্রোশে শূন্যে দংশন করল শোণিত পিপাসায় অতৃপ্ত তরবার!

পরক্ষণেই শশকের কোষ থেকে অর্ধ-উত্থিত তরবারি সম্পূর্ণ বহির্গত হয়ে ঝলসে উঠল!

এমন ক্ষিপ্র আক্রমণ, আর এমন চকিত প্রতিরোধের ক্ষিপ্রতর সঞ্চালন আগে কখনও দেখে নি কর্ণদেব! বিস্ময়ে বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে সে দেখতে লাগল এক ভয়ংকর দ্বৈরথ যুদ্ধ!

অগ্নিকুণ্ডের রক্তিম আলোতে বিদ্যুৎবর্ষণ করে সশব্দ সংঘাতে পরস্পরকে বারংবার আলিঙ্গন করল দুটি ঘূর্ণিত তরবারি তবু যুযুধানদের অস্ত্রের ফলকে পড়ল না রক্তের রেখা, ব্যর্থ আক্রোশে ঘুরতে লাগল দুটি শাণিত তরবারি হিংস্র আক্রোশে বিকশিত শ্বাপদ-দন্তেরমতো!….

পরন্তপের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করার সময়ে বহুদিন তার অস্ত্রচালনার কৌশল দেখেছে কর্ণদেব, একাধিকবার তাকে ব্যাপৃত হতে দেখেছে দ্বন্দ্বযুদ্ধে কিন্তু আজকের লড়াই দেখে সে বুঝল অস্ত্রগুরুর আশ্চর্য দক্ষতার পরিচয় সে আগে কখনও পায় নি! প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রচণ্ড আক্রমণকে অপূর্ব কৌশলে বার বার বিফল করে দিচ্ছে পরন্তপ!

নিজের ক্ষমতার উপর কর্ণদেবের আস্থা ছিল, ক্রমে ক্রমে সেই আস্থার উপর অহঙ্কারের প্রলেপ পড়েছিল, ধারণা হয়েছিল অসিযুদ্ধে আজ তার ক্ষমতা বুঝি গুরুর চাইতেও বেশি কিন্তু আজ সে বুঝল পরন্তপের কাছে সে নিতান্ত শিশু মাত্র!

ব্যাঘ্রের ন্যায় ক্ষিপ্র এবং হস্তীর ন্যায় বলশালী শত্রুর আক্রমণ এড়িয়ে বারংবার প্রতি আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ছে পরন্তপ! অপরপক্ষ কম নয়- দুই-দুইবার পরন্তপের ভয়ংকর আঘাত ব্যর্থ করে দিল শশক, তরবারির ক্ষিপ্র সঞ্চালনে…

আচম্বিতে দুটি তরবারির হাতল প্রচণ্ড সংঘাতে মিলিত হল। পরন্তপ তাড়াতাড়ি নিজের তরবারি টেনে নেওয়ার চেষ্টা করল। পারল না। গুহার দেয়ালে তাকে সজোরে চেপে ধরে শশক বলে উঠল, পরন্তপ! আত্মসমর্পণ না করলে এইবার আর রক্ষা নেই। যদি বাঁচতে চাও, অস্ত্রত্যাগ করো।

পরন্তপের মুখ ঘর্মাক্ত হল। প্রচণ্ড পেষণে তার দেহ তখন গুহাগ্ৰাত্রে নিষ্পিষ্ট। শশক আবার বলল, আত্মসপৰ্মণ করো। পরন্তপ উত্তর দিল না। তার মুখের ভাব কঠিন হয়ে উঠল। শ্বাস-প্রশ্বাসের বেগ বর্ধিত হল…

হঠাৎ যে কি ঘটল বুঝতে পারল না কর্ণদেব– যোদ্ধাদের দেহ দুটি পাক খেযে ছিটকে গেল- পরক্ষণেই সে দেখল গুহার দেয়াল থেকে ছিটকে গুহার প্রায় মধ্যস্থলে এসে দাঁড়িয়ে ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী!

হা হা শব্দে হেসে উঠল পরন্তপ, মহারাজ! আমার ললাট বা বক্ষ শায়ক চিহ্ন গ্রহণ করতে রাজি নয়।

অকস্মাৎ পরন্তপের তরবারি শত্রুর দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়েই বিদ্যুচ্চমকের মতো বামদিকে সঞ্চালিত হল– মুহূর্তের মধ্যে রক্তাক্ত হয়ে উঠল শশকের দক্ষিণ জানু।

এতক্ষণে, অট্টহাস্য করে উঠল পরন্তপ, এতক্ষণে রাজরক্ত দর্শন করলাম।

শত্রুর মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করেই স্তব্ধ হয়ে গেল পরন্তপ শশকের ওষ্ঠাধরে ভয়াবহ হাসি, চক্ষে আহত শার্দুলের ক্রুদ্ধ জিঘাংসা!

স্তম্ভিত বিস্ময়ে কর্ণদেব দেখল অগ্নিকুণ্ডের আলোকে জীবন্ত তড়িৎশিখার মতো জ্বলে জ্বলে উঠল শশকের তরবার সামনে, পিছনে, দক্ষিণে, বামে প্রতিদ্বন্দ্বীর অসিতে প্রতিহত হয়ে ঝনৎকার তুলল বারংবার সেই তীব্র আক্রমণের ঝড়ে বিপর্যস্ত বিহ্বল পরন্তপ পিছিয়ে গেল দ্রুতপদে!

এই প্রথম পরন্তপের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছায়া দেখতে পেল কৰ্ণদেব!

ক্রমাগত পশ্চাৎপদ হতে হতে গুহার মুখে এসে পড়ল পরন্তপ, তারপর হঠাৎ এক প্রচণ্ড লক্ষে গুহার বাইরে এসে দাঁড়াল।

তৎক্ষণাৎ উদ্যত তরবারি হাতে ঝড়ের বেগে গুহার প্রবেশপথে লঙ্ঘন করল শশক। গুহার ভিতর থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীদের আর দেখতে পেল না কর্ণদেব কেবল কানে ভেসে এল। সংঘাতমুখরিত অসির ঝনৎকার!

একমুহূর্ত নিশ্চল থেকে তাড়াতাড়ি শব্দ লক্ষ্য করে ছুটল কর্ণদেব। গুহার মুখে দাঁড়াতেই মুহূর্তের জন্য দ্বৈরথ-রণে ব্যাপৃত দুই যোদ্ধার দেহ তার দৃষ্টিগোচর হল, পরমুহূর্তেই তার পায়ের তুলায় দুলে উঠল পৃথিবী এবং ভারসাম্য হারিয়ে সে লম্বমান হল ভূমির উপর সঙ্গে সঙ্গে তার শ্রবণেন্দ্রিয়কে প্রায় বধির করে জাগল এক ভয়ংকর শব্দ, তারপরই মাথায় প্রচণ্ড আঘাত।

মুহূর্তের জন্য কর্ণদেব অনুভব করল তার দেহকে বেষ্টন করছে দুটি বলিষ্ঠ বাহু, পরক্ষণেই তার চেতনাকে লুপ্ত করে নামল মূৰ্ছার অন্ধকার…

২০. রাজা ও মন্ত্রী

মন্ত্রী মহাসত্ত্ব বললেন, মহারাজ! যদি অনুমতি দেন, তবে কয়েকটা প্রশ্ন করি।

দর্পণের সম্মুখে দাঁড়িয়ে একটি ক্ষুর হাতে গভীর মনোযোগের সঙ্গে মহারাজ রুদ্রদমন স্বহস্তে মুণ্ডিত মুখমণ্ডল পরিদর্শন করছিলেন, মহাসত্ত্বের কথার উত্তরে বললেন, মন্ত্রীবর! আমি বোধহয় একবারও নিজেকে অসুস্থ বলে ঘোষণা করিনি, অথবা আপনার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে অনিচ্ছা বা অক্ষমতাও প্রকাশ করিনি।

মহাসত্ত্বের ভ্রু কুঞ্চিত হল, মহারাজ! আপনি গভীর রাত্রে প্রাসাদে প্রবেশ করেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই আপনাকে শ্রান্ত ক্লান্ত মনে করেছিলাম। অতএব আজ রাত্রে আপনাকে উপযুক্ত বিশ্রামের সুযোগ দিয়ে কাল প্রভাতেই প্রয়োজনীয় বিষয়ের আলোচনা করব মনস্থ করেছিলাম। কিন্তু দেখলাম, মুহূর্ত মাত্র বিশ্রাম না করেই শ্মশ্রুরাশিকে মুখমণ্ডল থেকে বিলুপ্ত করতে আপনি বদ্ধপরিকর। তখন ভাবলাম, সম্ভবত আপনি বিশেষ ক্লান্ত নন, ক্ষৌরকর্ম শেষ হলে হয়তো কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিতে আপনি বিরক্তিবোধ করবেন না।

মহারাজ নিবিষ্টচিত্তে মুখগুল পরিদর্শন করছিলেন, দর্পণের মধ্যে প্রতিবিম্বের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বললেন, মন্ত্রীবর! আমি বিরক্তিবোধ করলেই যে আপনি প্রশ্নবাণ নিক্ষেপে বিরত হবেন এমন তো মনে হয় না।

—সে-কি মহারাজ! আপনি বিরক্তিবোধ করলে আমি কি আপনাকে কোনো প্রশ্ন করতে পারি?

–পারেন। অন্তত কিছুদিন আগেও পেরেছিলেন। কিন্তু অতীতের উদাহরণ দিয়ে বর্তমানকে ভারাক্রান্ত করতে চাই না। অনুগ্রহপূর্বক আপনার বক্তব্য প্রকাশ করুন।

আপনার অবর্তমানে রাজ্যে কিছু কিছু বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে রাজ্যত্যাগ করে দীর্ঘকাল নিরুদ্দেশ হওয়া রাজ্যের পক্ষে নিরাপদ নয়।

-মন্ত্রী মহাসত্ত্ব থাকতে রাজ্য সম্পর্কে আমার কিছুমাত্র দুশ্চিন্তা নেই। আপনার পরবর্তী বক্তব্যের প্রসঙ্গ ধরে বলছি, প্রজার সম্পর্কে রাজার কিছু কর্তব্য ও দায়িত্ব আছে মনে করি বলেই মাঝে মাঝে আমাকে নিরুদ্দেশ হতে হয়।

-আপনার দায়িত্ববোধ সম্পর্কে কিছু বলার ধৃষ্টতা আমার নেই, তবে দায়িত্ব পালনের পদ্ধতি সম্পর্কে আপনার সঙ্গে আমার মতভেদ আছে। ছদ্মবেশে রাজ্য মধ্যে বিচরণ করে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা আদৌ নিরাপদ নয়।… ভালো কথা, পরন্তপের কোনো সংবাদ পেয়েছেন?

মন্ত্রী মহাসত্ত্বের কথার উত্তর না দিয়ে মহারাজ জিজ্ঞাসা করলেন, মন্ত্রীবর! আপনার কাছে কর্ণদেব নামে জনৈক কিশোরের একটি লিপি নিয়ে আসার কথা ছিল। সে এসেছে কি?

হ্যাঁ, এসেছিল, মহাসত্ত্ব বললেন, উক্ত লিপির নির্দেশ অনুসারে পূর্ব সীমান্তের রক্ষীবাহিনীর অধিনায়ক বিষাণ বর্মার নিকট তাকে প্রেরণ করেছি। কিন্তু মহারাজ

-বলুন।

ওই সুকুমার-দর্শন কিশোরের পক্ষে সীমান্তের রক্ষীবাহিনীতে যোগ দেওয়া আত্মহত্যারই নামান্তর মনে হয়। অন্তর্ঘাতী কার্যকলাপে নিযুক্ত গুপ্তশত্রু, অথবা শত্রুভাবাপন্ন ভয়ংকর অনার্য বাহিনীর চকিত আক্রমণের সম্মুখীন হলে ওই কিশোরের মৃত্যু অনিবার্য। সীমান্তবাহিনীতে যোগদানে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে যেভাবে কঠিন পরীক্ষার ভিতর দিয়ে যোগ্যতার পরিচয় দিতে হয়, এই ক্ষেত্রে সেইভাবে পরীক্ষাও করা হল না– কারণ, পত্রে লিখিত ছিল কোনো পরীক্ষা না করেই অবিলম্বে যেন তাকে সীমান্তের রক্ষিবাহিনীতে নিযুক্ত করা হয়। আপনার নির্দেশ অনুসারে তাকে বিষান বর্মার নিকট

বাধা দিয়ে মহারাজ রুদ্ৰদমন বলে উঠলেন, আমার নির্দেশ? অপনি কি বলছেন মন্ত্রিবর?

বিমূঢ় দৃষ্টিতে মহারাজের মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন মহাসত্ত্ব, তারপরই তার অধর-ওষ্ঠে ক্ষীণ হাসিররেখা দেখা দিল, না, আপনার নির্দেশ নয়- শশক নামে এক ভ্রাম্যমাণ পেশাদার যোদ্ধার নির্দেশ অনুসারে তাকে বিষান বর্মার নিকট প্রেরণ করেছি। তিনদিন পুর্বে সংবাদ পেয়েছি তাকে পূর্বদিকের সীমান্তবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

সন্তুষ্ট হয়ে মহারাজ হৃষ্টস্বরে বললেন, ভালোই হয়েছে; তবে শশক নামে কোনো পেশাদার ভ্রাম্যমাণ যোদ্ধা মন্ত্রীবরকে তার অনুরোধ জানাতে পারে। কিন্তু শ্রাবস্তী রাজ্যের মন্ত্রীকে উক্ত ব্যক্তি নির্দেশ দেবে এমন ধৃষ্টতার প্রকাশ আমি কল্পনা করতে পারি না। মন্ত্রী মহাসত্ত্বের ওষ্ঠাধরে ক্ষীণ হাসি প্রশস্ত হল। মহারাজ আবার বললেন, মন্ত্রীবর! কর্ণদেব নামে ওই কিশোরের যোগ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকুন। সীমান্তবাহিনীতে রক্ষীদলের মধ্যে তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাস্ত করতে পারে এমন ক্ষমতা কোনো রক্ষীর আছে কিনা সন্দেহ।

মহাসত্ত্বের ললাটে জাগল মৃদু কুঞ্চনরেখা, মহারাজের কথার প্রতিবাদ করা উচিত নয়। তবু বলছি, এটা যেন অতিশয়োক্তি মনে হচ্ছে।

রুদ্রদমন হাসলেন, মন্ত্রীবর!জল্লাদ নামে এক কুখ্যাত দস্যু তার দুই সঙ্গীকে নিয়ে কর্ণদেবকে আক্রমণ করেছিল। যুদ্ধের ফলে জল্লাদ ও তার দুই সঙ্গী প্রাণ হারিয়েছে কর্ণদেব নামক ওই কিশোরের অসির আঘাতে। আরও একটা কথা মনে রাখবেন– কিশোর কর্ণদেব ছিল দস্যু পরন্তপের সর্বপেক্ষা বিশ্বস্ত অনুচর।

মহামন্ত্রী সচমকে বলে উঠলেন, ওই কিশোর দস্যু পরন্তপের বিশ্বস্ত অনুচর! কি আশ্চর্য মহারাজ, আপনি সকল তথ্য অবগত হয়েও তাকে সীমান্ত বাহিনীতে নিযুক্ত করার ব্যবস্থা করলেন? ওই বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত রক্ষী ইচ্ছা করলে গুপ্তশত্রুর নিকট হতে উৎকোচ গ্রহণ করতে পারে অথবা অর্থলোভে অন্তর্ঘাতমূলক কার্যে ব্যাপৃত হয়

বাধা দিয়ে মহারাজ বললেন, আবার আপনি ভুল করলেন। মন্ত্রীবর। কর্ণদেবকে সীমান্তবাহিনীতে নিযুক্ত করার অনুরোধ এসেছে শশকের কাছ থেকে এবং সেই অনুরোধ রক্ষা করেছেন আপনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই ঘটনার সঙ্গে আদৌ জড়িত নই। তবে এটুকু বলতে পারি-~শশকের পরামর্শে কাজ করলে রাজ্যের অমঙ্গল হবে না।

গম্ভীর কণ্ঠে মহাসত্ত বললেন, শশকের অনরোধ আমার কাছে মহারাজ রুদ্রদমনের আদেশের সমতুল্য।… হ্যাঁ, একটি প্রশ্নের উত্তর আমি আপনার কাছে পাইনি। মনে হয়, ওই প্রশ্নটি মহারাজকে বিব্রত করেছে। তবু এই রাজ্যের গুরুদায়িত্ব আমার স্কন্ধে রয়েছে বলেই শ্রাবন্তীর মঙ্গলের জন্য উক্ত প্রশ্নটি আবার আপনার সম্মুখে উপস্থিত করছি। আশা করি আপনি বিব্রত বা ক্রুদ্ধ হবেন না।

–আমার ক্রোধের ভয়ে মহামন্ত্রীকে কোনোদিন বিচলিত দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। মন্ত্রীবর! অনর্থক কালক্ষেপ না করে আপনার বক্তব্য উপস্থিত করুন।

দস্যু পরন্তপের কি সংবাদ? আপনার পরম সুহৃদ শশক আশা করি নিরুদ্দিষ্ট পরন্তপের সন্ধান পেয়েছে?

-হ্যাঁ।

–সে কোথায়?

–বলতে পারি না।

–মহারাজ! আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না। শশক নাকি পলাতক পরন্তপের সন্ধান পেয়েছে, অথচ আপনি জানেন না ওই দস্যু এখন কোথায়! এ কি হেঁয়ালি!

মন্ত্রীবর! মহারাজ বললেন, সম্প্রতি ভূমিকম্পের ফলে রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত একটি পর্বত ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। ব্যাদিতবদন কঙ্কালমুণ্ডের ন্যায় ওই পর্বতের সানুদেশে যে প্রকাণ্ড গুহাগহ্বর আছে, সেই গুহামুখ ভীষণ ভূমিকম্পের ফলে রাশি রাশি প্রস্তরে আবৃত হয়েছে। ওই গিরিগুহার ভিতর

বাধা দিয়ে মহাসত্ত্ব অসহিষ্ণু ভাবে বললেন, মহারাজ! আপনার কথায় বাধা দিয়ে অমার্জনীয় ধৃষ্টতা প্রকাশ করলাম, তবু নিজগুণে ক্ষমা করবেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয় সম্পর্কে এই মুহূর্তে আমি আলোচনা করতে চাই নি, আমি চেয়েছিলাম

–আপনি যে দস্যু পরন্তপের সন্ধান জানতে চাইছেন সে বিষয়ে আমি অবগত। অনুগ্রহ করে আমার বক্তব্য শেষ করতে দিন। যা বলছিলাম- ওই গিরিগুহার ভিতর গুপ্তধন আবিষ্কার করার পর দস্যু পরন্তপ ও আমার বন্ধু শশকের মধ্যে মহারাজ রুদ্রদমন সম্পর্কে কিছু আলোচনা হয়। আলোচনার ফলে উত্তেজিত হয়ে দুজনেই যখন গুহার বাইরে আসে, তখন হঠাৎ ভূমিকম্প শুরু হয়। ভূমিকম্পের প্রচণ্ড তাড়নায় চারদিকে রাশি রাশি প্রস্তর নিক্ষিপ্ত হতে থাকে এবং পর্বতশিখরের কিয়দংশ চূর্ণবিচুর্ণ হয়ে যায়। ওই প্রাকৃতিক বিপ্লবের মধ্যে শশক আর পরন্তপ পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেইসময় নিকটেই দণ্ডায়মান কর্ণদেব নামে কিশোরটি হঠাৎ একটি প্রস্তরের আঘাতে মস্তকে আহত হয়ে জ্ঞান হারায় এবং শশক তাকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থানে এনে শুশ্রূষা করতে সচেষ্ট হয়। ভূমিকম্পের পরে পরন্তপের কোনো সন্ধান পায় নি শশক। সুতরাং বুঝতেই পারছেন যে, ওই দস্যু এখন কোথায় অবস্থান করছে আমার পক্ষে তা বলা সম্ভব নয়। পর্বতের তলদেশে রাশি রাশি প্রস্তর ও ভূমিকম্পে বিদীর্ণ গিরিপথের ফাটলে ফাটলে পরন্তপের মৃতদেহ সন্ধান করেছিল শশক ও কর্ণদেব কিন্তু দস্যর কোনো সন্ধান পাওয়া। যায়নি। তবে পর্বতের পাদমূলে রাশি রাশি প্রস্তরের স্তূপে সমাহিত একটি মানবদেহের সন্ধান পাওয়া খুবই কঠিন। হয়তো প্রস্তরস্তূপের মধ্যেই লুক্কায়িত রয়েছে দস্যর মৃতদেহ, আর না হয়তো সে ভুমিকম্পের সময়ে সকলের অজ্ঞাতসারে স্থানত্যাগ করেছে। তবে এই মুহূর্তে পরন্তপকে নিয়ে আমি বিশেষ বিব্রত বোধ করছি না। যদি সে বেঁচেও থাকে, বেশ কিছুদিনের মধ্যে সে আর দস্যুবৃত্তি করতে ইচ্ছুক হবে না।

মহারাজ! মহাসত্ত্ব বললেন, আপনি যে গুপ্তধনের কথা বলেছিলেন, তার সন্ধান নিশ্চয়ই শশক আপনাকে জানিয়েছে?

–হ্যাঁ। আমি দুই-এক দিনের মধ্যেই এক সেনাদল নিয়ে ওই গুপ্তধন উদ্ধার করব।

–সেনাদল। কেন? ওই স্থান তো আপনার পরম সুহৃদ অনার্যরাজ মুলকের অধিকারভুক্ত।

যুদ্ধের জন্য নয়; গুহামুখ থেকে প্রস্তররাশিকে অপসারিত করার জন্যই সৈন্যদলের প্রয়োজন। ওই অর্থ দিয়ে রাজ্যের উন্নতিসাধন করা যাবে।

হু, তাহলে রাজ্যের সংবাদ একরকম ভালই, মহাসত্ত্ব বললেন, তবে দস্যু পরন্তপের মৃত্যুসংবাদ পেলে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হতে পারতাম।

পরন্তপের মৃত্যুতে আপনি খুশি হতে পারেন, রুদ্রদমন বললেন, কিন্তু শশক আশা করে বন্ধুবর পরন্তপ ওই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়েছে।

–বন্ধুবর পরন্তপ! মহারাজ, আপনি রসিকতা করেও দস্যু পরন্তপকে বন্ধু বলে অভিহিত করবেন না।

–শশকের বন্ধু বলেই বন্ধুবর বিশেষণে ভূষিত করেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে পরন্তপকে বন্ধু বলে স্বীকার করিনি।

দস্যু পরন্তপ শশকের বন্ধু! মহারাজ! এ আপনি কি বলছেন!

ঠিকই বলছি, রুদ্রদমন বললেন, শশকের সঙ্গে পরন্তপের বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়েছিল। রাজা রুদ্রদমনের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ নিয়ে মতান্তর উপস্থিত না হলে গুহামধ্যে আবিষ্কৃত গুপ্তধনের কিয়দংশ গ্রহণ করে পরন্তপ স্বচ্ছন্দে সীমানা অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী রাজ্যে গমন করতে পারত। অবশ্য ভূমিকম্পের ব্যাপারটা স্বতন্ত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিণাম নিয়ে কোনো কথা বলা চলে না।

মহাসত্ত্ব বললেন, আপনি বলছেন ভূমিকম্পের কবল থেকে পরন্তপ যদি আত্মরক্ষা করতে পারত এবং মহারাজের প্রসঙ্গ নিয়ে যদি শশকের সঙ্গে তার মতভেদ না ঘটত, তাহলে সীমানা অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী রাজ্যে গমন করতে তার অসুবিধা ছিল না? শশক তাকে গুপ্তধনের কিছু অংশ আত্মসাৎ করে প্রস্থান করতে বাধা দিত না?

রুদ্রদমন বললেন, কেন বাধা দেবে? গুপ্তধনের সন্ধান তো পরন্তপই দিয়েছিল। শশকের ধারণা, দস্য হলেও পরন্তপ খুব খারাপ লোক নয়। সুতরাং শ্রাবস্তী রাজ্যে উৎপাত না করে সে যদি গুপ্তধন থেকে তার ন্যায্য অংশ নিয়ে দেশান্তরী হত, তাহলে শশক নিশ্চয়ই আনন্দলাভ করত। শশক মনে করে পরন্তপের মতো মানুষকে সত্তাবে জীবনযাপনের একটা সুযোগ দেওয়া উচিত।

মহাসত্ত্ব এমন আশ্চর্য হয়ে গেলেন যে, কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। মহারাজ রুদ্রদমন পুনরায় গভীর অভিনিবেশ সহকারে নিজের মুখমণ্ডল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। ক্ষপণকের সাহায্যে না নিয়ে নিবিড় শ্মশ্রুরাশিকে স্বহস্তে নির্মূল করে সম্ভবত আত্মপ্রসাদ উপভোগ করছিলেন তিনি।

মন্ত্রী মহাসত্ত্ব হঠাৎ কণ্ঠ মধ্যে একটি অস্ফুট শব্দ করলেন, তারপর বললেন, মহারাজ!

দর্পণ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মহাসত্ত্বের দিকে জিজ্ঞাসু চক্ষে তাকালেন রুদ্রদমন।

–মহারাজ! আম্রপালী থেকে রাজদূত এসেছিলেন।

দূতের আগমন সংবাদ জানিয়েই আবার নীরব হলেন মহাসত্ত্ব।

রুদ্রদমন একটু আশ্চর্য হয়ে বললেন, আম্রপালীর রাজদূত! হঠাৎ!… কি সংবাদ?

মহাসত্ত্ব বললেন, আম্রপালী রাজ্যে রাজকন্যার স্বয়ংবর সভা বসছে আগামী ফাল্গুন মাসের সাত তারিখে। সেই সংবাদ দিতে এসেছিলেন রাজদূত।

রুদ্রদমন হঠাৎ আবিষ্কার করলেন তাঁর ক্ষুর এবং দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে কয়েকটি অবাঞ্ছিত কেশ মুখের একপাশে এখনও অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। তাড়াতাড়ি ক্ষুর উদ্যত করে তিনি মুখের সংস্কার-সাধনে তৎপর হলেন।

মহাসত্ত্ব বললেন, মহারাজ রাজ্যে অনুপস্থিত শুনে দূত মহাশয় বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু নিমন্ত্রণলিপি দিয়ে বলে গেছেন, মহারাজ রুদ্রদমন যদি স্বয়ংবর শুরু হওয়ার আগে রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন, তবে তিনি যেন অনুগ্রহপূর্বক স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত থেকে আম্রপালী রাজ্যকে কৃতার্থ করেন।

রুদ্রদমন সম্পূর্ণ নীরব। মুখমণ্ডলে শারাশিকে নির্মূল করার পরেও যে দুই একটি অবাঞ্ছিত কেশ মহারাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, পুনর্বার ক্ষুরের স্পর্শে এখন তারাও বিলুপ্ত; এখন, গুম্ফটিকে আরও সূক্ষ্ম করলে ফলাফল সন্তোষজনক হতে পারে কিনা সেই চিন্তাতেই মগ্ন হয়ে গেছেন রুদ্রদমন।

কণ্ঠ মধ্যে ঘুৎকারধ্বনির ন্যায় একটি শব্দ করে মহাসত্ত্ব বললেন, স্বয়ংবর সভা শুরু হতে এখনো প্রায় দশ দিন বিলম্ব আছে। আম্রপালীর রাজকন্যার রূপের খ্যাতি

বাধা দিয়ে রুদ্রদমন বলে উঠলেন, মন্ত্রীবর! পথশ্রমে আমার শরীর এত ক্লান্ত যে, একাদিক্রমে অন্তত একমাস সম্পূর্ণ বিশ্রামের প্রয়োজন। এখনই নিদ্রায় অভিভূত হয়ে পড়েছি, আর দাঁড়াতে পারছি না। এখন শয্যাগ্রহণ করতে চললাম।

মহাসত্ত্বের দিকে একবারও দৃষ্টিপাত না করে প্রাসাদের মধ্যে অন্তর্ধান করলেন রুদ্রদমন। তার গমনপথের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মন্ত্রী মহাসত্ত্ব।

Exit mobile version