আজাদের মায়ের মৃত্যুর পরে, মালিবাগের শ্বশুরবাড়িতে বসে কচির মনে পড়ে, ‘৭২ সালে মাঝে মধ্যে আম্মাকে সে গান গেয়ে শোনাত৷ এই সময় আম্মার প্রিয় গান ছিল, আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি…
কচি গলা ছেড়ে গাইত৷ মা, ঘরে কুপি জ্বলছে, আলো নড়ছে, মায়ের মুখে আলো পড়ছে আর নড়ছে, চুপচাপ পাটিতে বসে গান শুনছেন :
আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!
ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।।
ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে, বাঁ হাতে তোর শঙ্কাহরণ,
দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরন৷
ওগো মা, তোমার কী মুরতি আজি দেখি রে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।।
তোমার মুক্তকেশের পুঞ্জ মেঘে লুকায় অশনি,
তোমার আঁচল ঝলে আকাশ তলে রৌদ্রবসনী!
ওগো মা তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।।
যখন অনাদরে চাইনি মুখে ভেবেছিলাম দুঃখিনী মা
আছে ভাঙা ঘরে একলা পড়ে দুঃখের বুঝি নাইকো সীমা৷
কোথা সে তোর দরিদ্র বেশ, কোথা সে তোর মলিন হাসি-
আকাশে আজ ছড়িয়ে গেল ওই চরণের দীপ্তিরাশি!
ওগো মা, তোমার কী মুরতি আজি দেখি রে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।।
আজি দুখের রাতে সুখের স্রোতে ভাসাও ধরণী-
তোমার অভয় বাজে হৃদয়মাঝে হৃদয়হরণী!
ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।।
কচি গান গায় আর তার ভারি কান্না পায়৷ গানের কথাগুলো কি রবীন্দ্রনাথ আম্মাকে নিয়েই লিখে রেখেছিলেন ? এই মা কি আম্মা, নাকি দেশ ? আমার সোনার বাংলা, যাকে আমরা খুব ভালোবাসি, যাকেও আমরা মা বলে ডাকি ? বলি, মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়নজলে ভাসি… কী জানি, কচির ছোট মাথায় হিসাব মেলে না৷ কিন্তু দ্যাখো, রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, আজি দুখের রাতে সুখের স্রোতে ভাসাও তরণী, এ তো তাদের আম্মারই রূপ৷ কোথা সে তোর দরিদ্র বেশ, কোথা সে তোর মলিন হাসি, এও তো তাদের আম্মাকেই কেবল বলা যায়৷
কুপির সলতে জ্বলে, কুপির শিখাটা এমন যে শিখার ছায়া পড়েছে মেঝেতে, আশ্চর্য না, আলোর নিজের ছায়া পড়ে! আর আম্মাকে দেখা যাচ্ছে কী! মনে হচ্ছে, পিতলের তৈরি এক মাতৃমূর্তি৷ সত্যি তিনি আজ দুখের রাতে সুখের স্রোতে ধরণী ভাসিয়ে দিচ্ছেন, আম্মা বলেন, ‘আজাদ বেঁচে আছে, দেখিস, ও আসবে, আর দ্যাখ, দেশটা তো স্বাধীন হয়েছে, জুলুম অত্যাচার তো বন্ধ হয়েছে, এখন তো আর সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় না, আজাদ যেদিন আসবে, কত খুশি হবে সে…’
১৯৮৫ সালে, স্বামিগৃহে বসে, স্মৃতিতাড়িত কচি তার নিজের ছোট ছোট মেয়েদের ডেকে বলে, ‘আম্মা আর আমি আর কী করতাম জানিস ?’
তারা আধো আধো স্বরে বলে, ‘কী করতা ?’
‘আম্মা যখন আমার ওপরে রাগ করতেন, আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইতেন না, আমি তার দরজায় দাঁড়িয়ে গান গাইতে আরম্ভ করে দিতাম :
বড় আশা করে এসেছি গো, কাছে টেনে লও,
ফিরায়ো না জননী
দীনহীনে কেহ চাহে না, তুমি তারে রাখিবে জানি গো৷
আর আমি যে কিছু চাহি নে, চরণতলে বসে থাকিব৷
আর আমি যে কিছু চাহি নে, জননী বলে শুধু ডাকিব৷’
কচি গুনগুন করে গান গেয়ে চলে, মাকে গান গাইতে দেখে তার দুই মেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, কচি বলে, ‘আম্মা চুপ করে এই গান শুনত, গান শেষ হলে দেখতাম তার রাগ আর নাই৷’
কচির চোখ জলে টলমটল করে৷
তার ছোট ছোট মেয়েরা অবাক হয়ে দেখে তাদের মা কাঁদছে৷
৬১. মা
আজাদের মা থাকেন মালিবাগের বাসায়, আর ভাড়া পরিশোধ করেন মগবাজারের বাসারও৷ এইভাবে যায় কিছুদিন৷ তারপর এক সময় মগবাজারের বাসার ভাড়া দেওয়ার সঙ্গতি চলে যায় তাঁর৷ মালিবাগের বাসাও তাঁরা ছেড়ে দেন, বাসা ছেড়ে দিয়ে ওঠেন বিক্রমপুরে আরেক বোনের ছেলের বাড়িতে, কিছুদিন চলে যায়, সেখান থেকে এসে ভাড়া নেন খিলগাঁওয়ের এক বাসা, যাকে ঠিক হয়তো বাসা বলা যাবে না, বলতে হবে বস্তিঘর, অন্তত যে রাজপ্রাসাদে তিনি একদা থাকতেন, তার তুলনায় এ তো বস্তিই, নর্দমার গন্ধ ঘরের মধ্যে, কাঁচা বাঁশের বেড়া, চারদিকে গরিব মানুষের কোলাহল-খিস্তিখেউড়, জায়েদ কাজ নেয় গাড়ির ওয়ার্কশপে, সারা দিন কাটে তার কালিঝুলি মেখে গাড়ির নিচে৷ এই সময় আজাদের মায়ের কাছে আসতেন খোঁজখবর করতেন তাঁর খালাতো বোনের ছেলে শুভ, খুদু, খোঁজ নিতেন তাঁর খালাতো দুলাভাই আবদুস সালাম৷
জাহানারা ইমাম এ বাসায় আসেন, আজাদের মায়ের অবস্থা দেখে তাঁর বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে, এতটা খারাপ অবস্থা কারো হতে পারে এ তাঁর কল্পনারও অতীত, দারিদ্র্যের কশাঘাতের চিহ্ন ঘরজুড়ে, আজাদের মায়ের চেহারাও খুবই খারাপ হয়ে গেছে, শুকিয়ে তিনি অর্ধেক হয়ে গেছেন, অথচ এই মহিলা একদিন এই শহরে রাজরানী ছিলেন৷ তার মনে পড়ে, ইস্কাটনের প্রাসাদোপম বাড়িতে বা ফরাশগঞ্জের বাড়িতে সাফিয়া বেগমের সুখী পরিতৃপ্ত সেই বেশটা, গা ভরা গয়না, আঁচলে চাবি, মুখে হাসি… তিনি দীর্ঘশ্বাস গোপন করেন৷
জাহানারা ইমাম তাঁর ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করে দেন সাফিয়া বেগমের হাতে, বলেন, ‘আপা, কিছু মনে করবেন না, এটা রাখেন৷’
সাফিয়া বেগম শান্তস্বরে বলেন, ‘এটা কী ?’
‘কিছু টাকা আছে৷’
‘আপা, আপনি কিছু মনে করবেন না, এটা আমি নিতে পারব না৷’ এমন স্পষ্ট উচ্চারণে সাফিয়া কথা বলেন যে জাহানারা ইমাম খামটা ফেরত নিয়ে ব্যাগে রাখেন৷
আজাদের মায়ের দু-একজন আত্মীয়স্বজন এসে তাঁকে বলেন, ‘আপনার নামে না অনেক অনেক সম্পত্তি, ইস্কাটনের বাড়ি, ফরাশগঞ্জের বাড়ি, এসব বিক্রি করলেও তো টাকা আসে, বিক্রি করে দেন, দখল নেওয়ার দায়িত্ব আমাদের৷’
আজাদের মা বলেন, ‘দ্যাখো বাপু, ওসব সম্পত্তি আমার নামে বটে, কিন্তু ওসব তো আসলে চৌধুরীর, আমার নামে থাকলেই ওগুলো আমার হয়ে যায় না৷ ও চৌধুরীরই৷ উনি যা করার করবেন, আমি ওসবে লোভ করি না৷ তোমরাও এ নিয়ে কোনো কিছু বলতে এসো না৷’
সৈয়দ আশরাফুল হক আসে এই বাসায়, ভুরু কুচকে চারদিকে তাকিয়ে বলে, ‘মা, তোমার এ কি অবস্থা, তুমি এইটা কোন জায়গায় উঠছ ?’
‘কোন জায়গায় উঠেছি ?’
‘এই যে, এইটা তো বস্তি৷ ঢোকা যায় না, এইখানে তুমি থাকো কেমন কইরা ?’
‘আমার তো অসুবিধা হয় না৷’
‘তোমার আত্মীয়স্বজন কই ?’
‘আত্মীয়স্বজন দিয়ে কী হবে ?’
‘তোমাকে কেউ সাহায্য করব না ? তুমি যে এদের জন্যে এত কিছু করলা ?’
‘আমি কারো সাহায্য নিলে তো বাবু৷’
‘আচ্ছা কাউরে লাগব না৷ তুমি আমার সাথে চলো আমার লগে থাকবা৷’
মা হাসেন৷ কিছু বলেন না৷
‘কি চলো ?’
‘যাও, পাগলামি কোরো না৷ আমি কারো সাহায্য চেয়েছি কখনও ? কেন নেব ?’
‘তাহলে তোমাকে এর চেয়ে ভালো জায়গায় থাকতে হবে৷’
মা এ কথার জবাবেও শুধু হাসেন৷ সৈয়দ আশরাফুল হক তাকে কিছু টাকা দিলে তিনি সেটা গ্রহণ করেন৷ তারপর বলেন, ‘শোনো, আজাদের খবর পেয়েছি৷ ওই খায়রুল আছে না বিক্রমপুরের, তার ভায়রার বড় ছেলে, ও লন্ডনে দেখে এসেছে, টিউবে ওর পাশে বসেছিল, হুবহু এক চেহারা, আরেকটু নাকি ফরসা হয়েছে…’
আশরাফুলের মনে হয় মাকে বলে, মা, আজাদ ভাই বেঁচে থাকলে তো তোমাকে চিঠি লিখতে পারত, তোমাকে ছাড়া আজাদ ভাই একদণ্ড থাকার ছেলে নাকি, কিন্তু সে কিছু বলে না৷ মহিলা একটা বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন, থাকুন…
মাঝে মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কাজী কামাল আসে, সে তো আবার আজাদের সহপাঠী, তাকে তো আর তিনি ‘না’ করতে পারেন না, কাজী কামাল স্মৃতিতর্পণ করে, ‘মাঝে মধ্যে জুয়া খেইলা হয়তো পাইলাম ৫০০ টাকা, তারে দিয়া আসলাম, জুয়ার টাকা সেইটা অবশ্য কই নাই…’
আজাদের আরেক বন্ধু হিউবার্ট রোজারিও এসে তাঁকে মা বলে ডাকে, সাফিয়া বেগম তার মাথায় হাত বোলান, সে তখন জোর করে তাঁর হাতে কিছু টাকা গছিয়ে দেয়, তিনি সেটাও গ্রহণ করেন৷ না, ভাত তিনি আর কোনোদিনই খান না, দুটো পাতলা রুটি, একটু সব্জি হলেই তাঁর দিন চলে যায়, কি শীত কি গ্রীষ্ম, তার বিছানা মেঝেতে, পাটি বিছিয়ে, খুব শীতের রাতে গায়ের ওপরে দুটো শাড়ি ভাঁজ করে ঢেকে দেওয়া থাকে৷
জাহানারা ইমাম আবার আসেন তাঁর বাসায়, বলেন, ‘আপনার এই কাহিনী আমি লিখতে চাই, আপনি আজাদের ফটো দেন, আপনার ফটো দেন’, তিনি বলেন, ‘না, আমি ইতিহাস হতে চাই না৷ কোনো কিছু লিখবেন না৷’
কী জানি, হয়তো তিনি চৌধুরীর কাছে নিজেকে ছোট করতে চাননি৷
‘আপনি শহীদের মা৷ আপনার কথা সবাইকে জানাতে হবে৷ এটা আপনার জন্যে নয়, সারা দেশের মানুষের ভালোর জন্যে জানাতে হবে’-জাহানারা ইমাম যুক্তি দেখান৷
সাফিয়া বেগম হেসে বলেন, ‘কিন্তু আপা, আমার আজাদ তো শহীদ হয়নি৷ ও তো বেঁচে আছে৷ ও ফিরে আসবে৷’
জাহানারা ইমাম চোখ মুছে সেই বস্তিঘর ত্যাগ করেন৷
জাহানারা ইমামের কাছে তাঁর সম্পর্কে লেখার প্রস্তাবটা শুনে সাফিয়া বেগম এক রাতে তাঁর ছেলের চিঠিগুলো বের করেন৷ সেখান থেকে আলাদা করেন আজাদের একটা বিশেষ চিঠি৷
মা,
কেমন আছ ? আমি ভালোভাবেই পৌঁছেছি৷ এবং এখন ভালোই আছি৷ হরতাল বন্ধ হয়ে গেছে৷ রীতিমতো ক্লাস হচ্ছে৷ পরীক্ষা শীঘ্রই শুরু হবে৷ দোয়া কোরো৷ তোমার দোয়া ছাড়া কোন উপায় নাই৷ আমি নিজে কী ধরনের মানুষ আমি নিজেই বুঝতে পারি না৷ আচ্ছা তুমি বল ত সব দিক দিয়ে আমি কী ধরনের মানুষ৷ আমি তোমাকে আঘাত না দেওয়ার অনেক চেষ্টা করি৷ তুমি আমার মা দেখে বলছি না; তোমার মতো মা পাওয়া দুর্লভ৷ এই বিংশ শতাব্দীতে তোমার মতো মা যে আছে কেউই বিশ্বাস করবে না৷ আমি এগুলি নিজ হৃদয় থেকে বলছি, তোমার কাছে ভালো ছেলে সাজবার জন্য নয়৷ যদি আমি পৃথিবীতে তোমার দোয়ায় বড় বা নামকরা হতে পারি, তবে পৃথিবীর সবাইকে জানাব তোমার জীবনী, তোমার কথা৷
আমি ভালো পড়াশুনা করার চেষ্টা করছি৷
এবং অনেক দোয়া দিয়ে চিঠির উত্তর দিও৷
ইতি তোমার
অবাধ্য ছেলে
আজাদ
আজাদ লিখেছিল, সে যদি নামকরা হয় কোনো দিন, সে লিখবে তার মায়ের জীবনী৷ পৃথিবীকে জানাবে তার মায়ের কথা৷ আজাদ যদি বেঁচে থাকে, যদি ফিরে আসে, অবশ্যই সে বেঁচে আছে, অবশ্যই সে ফিরে আসবে, নিশ্চয় এই কাজ সে-ই করবে৷ তিনি তো এই কাজ অন্য কাউকে করতে দিতে পারেন না৷
৬২. মা
জাহানারা ইমাম একা খোঁজখবর করেন আর সব শহীদের মায়ের, সময়ের চাকা ঘুরছে, পৃথিবী ঘুরছে, জীবনের চক্রে পড়ে কোথায় ছিটিয়ে পড়ছেন শহীদ জুয়েলের মা, শহীদ বদির মা, শহীদ বাকেরের মা, কত কত শহীদ এই দেশে, তাদের কতজনের মা, অভিযোগহীন, দুঃখ সয়ে পাথর হয়ে যাওয়া কখনো উচ্চবাচ্য না করা একেকজন মা!
চৌধুরী আবার প্রস্তাব পাঠান সাফিয়া বেগমকে বাসায় নিয়ে যেতে, কাকুতি-মিনতি করেন, তাঁর নিজেরও শরীর ভেঙে আসছে, তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন নিজের অতীত আনন্দময় সুখের জীবনের কথা ভেবে ভেবে, কিন্তু সাফিয়া বেগম রাজি হন না, রাজি হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না৷ ইতিমধ্যে আরো বিয়ে করেছেন চৌধুরী, চট্টগ্রামে পেতেছেন আরেক সংসার, তার কাছে যাওয়ার চিন্তাও তো অবান্তর৷ এখনও ইস্কাটনের বাসা সাফিয়া বেগমেরই নামে, ফরাশগঞ্জের বাসা, এবং ঢাকায় আরো অনেক জমাজমি…
জুরাইনের এক ঘোরতর বস্তিঘরে গিয়ে ওঠেন মা৷ সেখানে একদিন গিয়ে হাজির হয় সৈয়দ আশরাফুল হক৷
‘মা, তুমি এইসব জায়গা খুঁইজা বাইর করো কেমনে ? এইসব জায়গায় আসা যায় ?’
‘এসো না৷’
‘না, আসুম না তো৷ তুমি এমন জায়গায় থাকবা যাতে আসা না যায়, আসুম ক্যান ? চলো আইজকাই তোমারে নিয়া যামু৷ কাম অন৷ স্টে উইথ মি৷’
‘তোমাকে আসতেও হবে না, নিয়ে যেতেও হবে না৷ এখন তো তুমি এভাবেই কথা বলবে৷ অন্য সবাই যেভাবে কথা বলে, তুমিও যদি সে রকমই বলো… এসো না…’
সাফিয়া বেগম মৃদু হেসে তাকিয়ে থাকেন সৈয়দ আশরাফুলের চোখের দিকে৷ এরপর আর তাঁকে কিছু বলা যায় ?
৬৩. মা
১৯৮৫ সাল৷ আগস্ট মাস৷ আগস্ট মাস এলেই ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের মাথার ভেতরটা কেমন করতে থাকে৷ জায়েদের হাত-পা ঘামতে থাকে দরদর৷ সারা শরীরের জ্বলুনিটা বেড়ে যায়৷ ২৯শে আগস্ট দিবাগত রাতে আজাদ চলে গিয়েছিল৷ ১৪ বছর আগে৷
সেই রাতটা কাছে আসছে৷ এদিকে শাহজাহানপুরের এক দীনহীন বাসায় থাকা আজাদের মার শরীরটা খুবই খারাপ হচ্ছে৷ হাঁপানির টান যখন ওঠে, তখন তিনি এত কষ্ট পান যে মনে হয় এর চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়৷ এর মধ্যে একটা দিনের জন্যেও, সেই ১৯৬১ থেকে, তিনি স্বামীর মুখ দেখেননি৷ নিজের মুখও তাকে দেখতে দেননি৷ আজাদের মা জায়েদকে ডেকে বলেন, ‘আমার আর সময় নাই৷’
জায়েদ বলে, ‘আম্মা, ডাক্তার ডাকি৷’
মা বলেন, ‘ডাকো৷ এত দিন ধরে আমাদের দেখছেন, বিদায় নিই৷’
তাঁকে যে ডাক্তার দেখতেন, টাঙ্গাইলের লোক, ডাক্তার এস. খান, তাঁকে ডাকা হয়৷ ডাক্তার এসে দেখেন, আজাদের মা শুয়ে আছেন স্যাঁতসেঁতে মেঝের ওপরে বিছানো একটা পাটিতে৷ তিনি বিস্মিত হন না৷ কারণ তিনি জানেন, কেন এই ভদ্রমহিলা মেঝেতে শোন৷ তবে ঘরের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তাঁকে চিন্তিত করে৷ গলিটা ময়লা, একধারে নর্দমা উপচে উঠেছে, দুর্গন্ধ ঘরের ভেতরে পর্যন্ত এসে ঢুকছে৷ ঘরটাতেও আলো তেমন নাই৷
তবে সাফিয়া বেগমের মুখখানা তিনি প্রশান্তই দেখতে পান৷ তিনি তাঁর নাড়ি পরীক্ষা করেন, স্টেথোস্কোপ কানে দিয়ে তাঁর বুকের ভেতরের হাপরের শব্দের মর্ম অনুধাবন করেন৷ রোগীর অবস্থা বেশি ভালো নয়৷ এখনই ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে একটা শেষ চেষ্টা করা যায়৷
ডাক্তার বলেন, ‘বোন, কী করবা!’
মা বলেন, ‘আপনাকে দেখলাম৷ দেখতে ইচ্ছা করছিল৷ তাই ডেকেছি৷ আপনার আর কী করার আছে! আমার সময় হয়ে এসেছে৷ আমাকে বিদায় দিন৷ ভুলত্রুটি যা করেছি, মাফ করে দেবেন৷’
‘হসপিটালে যাওয়া দরকার৷’
‘না৷ দরকার নাই৷’
‘আল্লাহ!’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাক্তার কিছু ওষুধ দিয়ে বিদায় হন৷
মা বলেন, ‘উকিল ডাকো৷ গেন্ডারিয়ার জমিগুলো আমি লেখাপড়া করে দেব৷’
উকিল ডাকা হয়৷
তিনি গেন্ডারিয়ার জমি তাঁর ভাগ্নে-ভাগি্নদের নামে আর জুরাইনের মাজারের নামে দলিল করে দেন৷
২৯শে আগস্ট পেরিয়ে যায়৷ আসে ৩০শে আগস্ট৷ আজাদের ধরা পড়ার ১৪ বছর পূর্ণ হওয়ার দিন৷ তিনি ভাগ্নে-ভাগি্নদের ডাকেন৷ জায়েদকে বলেন, ‘শোনো, আমার মৃত্যুর পরে কবরে আর কোনো পরিচয় লিখবে না, শুধু লিখবে-শহীদ আজাদের মা৷ বুঝলে!’
‘জি৷’ জায়েদরা কাঁদতে শুরু করে৷
তিনি বলেন, ‘শোনো, আসলে আজাদ যুদ্ধের সময়ই শহীদ হয়েছে৷ ওর বউয়ের জন্যে আমি কিছু গয়না রেখেছিলাম৷ এগুলো রেখে আর কোনো লাভ নাই৷ আজাদ তো আসলে যুদ্ধের সময়ই শহীদ হয়েছে৷ এগুলো তোমাদের দিয়ে গেলাম৷ তোমরা বড় হুজুরের সাথে আলাপ করে সৎকাজে এগুলো ব্যয় কোরো৷ আমার যাওয়ার সময় হয়েছে, আমি যাই বাবারা, মায়েরা…’
জায়েদ, টিসু, টগর, তাদের বউ-বাচ্চা, যারা তাঁর পাশে ছিল, তারা কাঁদতে থাকে৷
তিনি ইশারা করে বলেন, ‘কেঁদো না৷’ তিনি একটা ট্রাঙ্কের চাবি জায়েদের হাতে তুলে দেন৷ পরে, জায়েদ সেই ট্রাঙ্ক খুলে প্রায় একশ ভরি সোনার গয়না দেখতে পায়! আশ্চর্য তো মহিলা, এতটা কষ্ট করলেন, কিন্তু ছেলের বউয়ের জন্য রাখা গয়নায় এই ১৪টা বছর হাত দিলেন না!
১৩ই জিলহজ্ব, ৩০শে আগস্ট ১৯৮৫ বিকাল পোনে ৫টায় আজাদের মা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷
জায়েদ অন্যান্য কৃত্যের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা কাজী কামাল বীরবিক্রমকে খবরটা দেওয়ার কর্তব্যটাও পালন করে৷ সেখান থেকে খবরটা পান জাহানারা ইমাম৷ তিনি আবার একে একে খবর দেন ঢাকার আরবান গেরিলাদের৷ হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক, হ্যারিস, বাচ্চু, ফতেহ, উলফত, শাহাদত চৌধুরী, চুল্লু, আলভী, আসাদ, শহীদুল্লাহ খান বাদল, হিউবার্ট রোজারিও…
পরদিন সকালে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় জুরাইন গোরস্তানে৷ জাহানারা ইমাম রয়ে যান গাড়ির ভেতরে, গোরস্তানের গেটের বাইরে৷
জনা-তিরিশেক মুক্তিযোদ্ধা আর কিছু নিকটাত্মীয়ের শবযাত্রীদলটি কফিন বয়ে নিয়ে চলেন৷
লাশ গোরে নামানোর পরে হঠাৎই রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ থেকে বৃষ্টি নামতে থাকে৷ একটা অচেনা মিষ্টি গন্ধে পুরো গোরস্তানের বাতাস আচ্ছন্ন হয়ে থাকে৷ অনেক মুক্তিযোদ্ধারই মনে হয়, তাদের সহযোদ্ধা শহীদেরা আজ অনেকেই একত্র হয়েছে এই সমাধিক্ষেত্রে, যেন তারা পুষ্পবৃষ্টি বর্ষণ করছে বেহেশত থেকে, যেন তারা মাটি দিচ্ছে কবরে৷ শহীদ জুয়েল, শহীদ বদি, শহীদ বাকের, শহীদ আলতাফ মাহমুদ, শহীদ রুমী, শহীদ বাশার প্রমুখ আর শহীদ আজাদ এখানে উপস্থিত৷
সহযোদ্ধা শহীদের মাকে সমাহিত করতে এসে ঢাকার আরবান গেরিলা দলের সদস্যরা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন, ঘোরগ্রস্ত হয়ে পড়েন, তাড়িত বোধ করেন; স্মৃতি তাদের দখল করে নেয়, স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্ন তাদের জাগিয়ে তোলে, নিশি-পাওয়া মানুষের মতো তারা হাঁটাহাঁটি করেন, ত্রিকালদর্শী বৃদ্ধের মতো তারা একবার কাঁদেন, একবার হাসেন৷ তারা স্মৃতিতর্পণ করেন৷ আজাদের মায়ের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়ে যাবার পরের কটা দিন তারা একা একা, জোড়ায় জোড়ায়, কিংবা ছোট ছোট গ্রুপে বসে এই কাহিনী স্মরণ করেন৷ বলাবলি করেন৷ ঘাঁটাঘাঁটি করেন৷
বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদত চৌধুরীর চশমার পুরু লেন্স ঝাপসা হয়ে আসে বাষ্পে, তিনি কান্না লুকাতে পারেন না, আরেকটু সাবধান বোধহয় হওয়া উচিত ছিল, এই নির্দেশ হয়তো তাঁরই দেওয়া উচিত ছিল, আর আমরা কী রকম বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিলাম, ভেবে দ্যাখো, একদিন প্রকাশ্য দিবালোকে আমরা গাড়িতে যাচ্ছি আর ছেলেমানুষের মতো বাজি ধরছি, চল, এসএমজি পাশে রেখে নিয়ে যাই তো, দেখি না কী হয়, আর সত্যি আমরা এসএমজি পাশে রেখে ট্রিগারে আঙুল ধরে যাচ্ছি, সামাদ ভাই নির্বিকার গাড়ি চালাচ্ছেন, এটা তো ছিল শুধুই অ্যাডভেঞ্চার, খালেদ মোশাররফ বলতেন, কাউবয় অ্যাডভেঞ্চার৷ কাজী কামালের মনে হয়, অবশ্যই প্রত্যেকটা হাইড আউটে সেন্ট্রি রাখা উচিত ছিল, আর ওই রাতে এলএমজির দখলটা পুরোপুরি নিয়ে নিতে পারলে… জুয়েল, আজাদ, বাশার সবাইকে নিয়েই তো বেরিয়ে আসা যেত, হয়তো… সৈয়দ আশরাফুল হকের মনে হয়, কেন তিনি ছাড়তে গেলেন জুয়েলকে, ওই রাতে, আর কেনই বা বদি শেষের দুই রাত তাদের বাসায় না থেকে অন্য জায়গায় থাকতে গেল ? জায়েদ হাহাকার করে ওঠে : ‘দাদা ক্যান আমার কথা বিশ্বাস করল না, কামরুজ্জামানরে দেইখাই তো আমি বুইঝা ফেলছিলাম, ওই বেটা ক্যান ঘুরঘুর করে আমগো বাড়ির চারদিকে৷’ ইব্রাহিম সাবেরের মনে পড়ে, ওইদিন দুপুরবেলা দোকানে তিন যুবকের চোখমুখ দেখেই তিনি বুঝেছিলেন এরা ইনফরমার হতে পারে, তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন আজাদকে, আজাদ শোনেনি… শহীদুল্লাহ খান বাদল হিসাব মেলাতে পারেন না, ২৭শে মার্চ তারা রওনা দিলেন চার জন, যুদ্ধশেষে ফিরে এলেন দুজন, ‘বদি যে আমাদের দুজনের হাত কেটে রক্তের সঙ্গে রক্ত মিশিয়ে বলে গেল আজ থেকে আমরা রক্তের ভাই, সে কেন আর আসে না, আশফাকুস সামাদ আশফি ভুরুঙ্গামারীর যুদ্ধে শহীদ হয়েছে, সে তো আর আসবে না… যেন এখনও বাদল শুনতে পান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত আশফির শহীদ হওয়ার সংবাদটা, সেক্টর টু’তে বসে তারা খবরটা শোনেন, তোপধ্বনি করা হয় এই বীরের সম্মানে, স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলেন হায়দার, তাঁর নিজের হাতে গড়া ছেলে!
নিদ্রাহীনতায় জেগে ওঠেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, যখন তিনি তাকান বিগত ১৪টা বছরের দিকে, খেই খুঁজে পান না, খালেদ মোশাররফ বলতেন, স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলার চেয়ে পছন্দ করে শহীদ যোদ্ধাদের, কোথায় গেল সেই যুদ্ধ, কোথায় সেই আগুনের পরশমণি ছোঁয়ানো দিনগুলো, যুদ্ধের পরে শুধু ধ্বংসের শব্দ, শুধু অবক্ষয়ের চিত্র, একে একে মরে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধারা, রক্ষীবাহিনীর হাতে মরল মুখতার, এখানে ওখানে কতজন মরল, কয়েকজন অধঃপাতে গেল, চোখের সামনে একে একে কেবল মুক্তিযোদ্ধাদেরই চলে যাওয়ার ছবি, সার সার৷
টগরের মাথার ওপর দিয়ে সব পাখি একে একে বিদায় নেয়, যাওয়ার আগে যেন শেষতম পাখিটা বলে যায় বঙ্গবন্ধু নাই, তাজউদ্দীন আহমদসহ চার নেতা নাই, খালেদ মোশাররফ নাই, হায়দার নাই, জিয়াউর রহমান নাই, কে আছে আর মুক্তিযোদ্ধাদের…
নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ঘুমুতে পারেন না, বহু মুক্তিযোদ্ধা বিহ্বলের মতো আচরণ করে, চারপাশের মানুষগুলো তাদের বুঝতে পারে না…তারাও বুঝে উঠতে পারে না চারপাশের জগতকে৷
ঘোর লাগা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু যান শাহাদত চৌধুরীর বাসায়৷ ‘বাচ্চু আসো, বসো’-শাচৌ বলেন৷
বাচ্চু বলেন, ‘শাহাদত ভাই, আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এলাম৷’
‘বসো৷ বসে বলো, কী তোমার কথা ?’ শাচৌ বলেন৷
বাচ্চু বলেন, ‘শাহাদত ভাই, আচ্ছা বলেন তো এই দেশে আম্মা, মানে জাহানারা ইমামের মতো মা আছেন ?’
‘হ্যাঁ৷ বলো৷’
‘আজাদের মায়ের মতো মা ছিলেন ?’
শাচৌ চুপ করে তাকিয়ে থাকেন বাচ্চুর মুখের দিকে৷
‘তাঁরা তাদের ছেলেদের হাসিমুখে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন, দেশের জন্যে, মানুষের জন্যে, আমাদের সবার ভালো থাকার জন্যে…’ বাচ্চু বলে চলেন৷
শাচৌ মাথা নাড়েন৷ ‘হ্যাঁ…’
‘তাহলে বীরের এ রক্তস্রোত, মায়ের এ অশ্রুধারা, এসব কি ধরার ধুলায় হারা হয়ে যাবে ? শাহাদত ভাই, ইতিহাসে এটা কি হতে দেখেছেন… এত এত লোক আত্মত্যাগ করল, নিজের জীবনের চেয়ে বড় আর কী হতে পারে, সেই জীবন দিয়ে দিল, আর মায়ের কাছে ছেলের চেয়ে বড় ধন আর কী, মায়েরা হাসিমুখে ছেলেদের তুলে দিলেন মৃত্যুর হাতে, সব বৃথা যাবে ?’
পুরোটা ঘরে তখন অসহ্য নীরবতা৷
বাচ্চু বলেন, ‘শাহাদত ভাই, আবুল হাসানের একটা কবিতা আছে না, তোমরা আমার না পাওয়াগুলো জোড়া দাও, আমি তোমাদের ভালো থাকা হবো, আছে না ? আছে৷ তাহলে আজাদের মায়ের না পাওয়াগুলো জোড়া দিলে আমাদের সবার ভালো থাকার দিন আসে না ? এই দেশটার ভালো হবে না ? শাহাদত ভাই বলেন৷’
শাহাদত চৌধুরী মাথা নিচু করে থাকেন৷ বাচ্চুর এই প্রশ্নের জবাব নিশ্চয়ই ‘হ্যাঁ’৷ এই দেশটার একদিন ভালো হবে, এই দেশের মানুষের সবার ভালো হবে, আমাদের সন্তানেরা সবাই দুধভাতে থাকবে, এত এত মানুষের এত এত আত্মত্যাগ বৃথা যেতে পারে না৷ কিন্তু কই, সেই সুসময় তো আসে না…
নীরবতা, পাথরের মতো নীরবতা নেমে আসে ওই ঘরটায়, তাদের বুকের ওপর, সমস্তটা দেশের ওপর৷ শাহাদত চৌধুরীর মনে পড়ে, আলমও প্রায়ই বলে, ‘আমরা তো যুদ্ধ শেষেই পাস্ট টেন্স হয়ে গেছি৷ এখন আমার পরিচয় কী ? হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক, মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন৷ ১৭ ডিসেম্বর থেকেই আমাদের অতীত ইতিহাস করে দেওয়া হয়েছে৷’ শাহাদত চৌধুরীরও মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধকে জাতির সত্তায় বপন করতে দেওয়া হয়নি৷ খালেদ মোশাররফ তো বলতেনই, স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চাইবে না, তার চাই শহীদ…
খানিকক্ষণ নীরব থেকে শাচৌ বলেন, ‘বাচ্চু, তুমি বসো৷ তোমার মনের কথাগুলো লিখে ফেলো৷ সামনে আমার বিজয় দিবস সংখ্যা, ওতে আমি তোমার এই কথাগুলো ছাপব৷’
তাকে টেবিলে বসিয়ে কাগজ কলম ধরিয়ে দেন তিনি৷
সারা রাত জেগে বাচ্চু লিখে ফেলেন তাঁর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আবেগময় স্মৃতিগাথা : ঘুম নেই৷
৬৪. মা
আজাদের মাকে দাফন করে এসে জাহানারা ইমাম কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে বসেন৷ কারণ তিনি মা৷ একটা লোক যখন মরে যায়, ভাইয়ের কাছে সেটা চলে যাওয়া, বোনের কাছে সেটা শূন্যতা, বাবার কাছে তার নিজেরই ধারবাহিকতার ছেদ, বন্ধুর কাছে সেটা অতীত স্মৃতি আর বিস্মৃতির দোলাচল, পড়শির কাছে তা দীর্ঘশ্বাস, দেশের কাছে কালের কাছে হয়তো তা প্রিয়তম পাতার ঝরে যাওয়া, কিন্তু মায়ের কাছে ? মায়ের কাছে সন্তানের মৃত্যু হলো সমস্ত সত্তাটাই মৃতের দ্বারা দখল হয়ে যাওয়া, মায়ের স্মৃতি, মায়ের অস্তিত্ব, তাঁর নিদ্রা, তাঁর জেগে থাকা, তাঁর স্বপ্ন, সবটা জুড়েই পুনর্বার জন্ম নিয়ে বিপুলভাবে বেড়ে উঠতে থাকে তাঁর গতায়ু সন্তানটিই৷ তাঁর পরিপাশর্্ব, তাঁর চারপাশের জগৎ একজন সন্তানহারা মায়ের এই গোপন বিপুল রক্তক্ষয়ী নিজস্ব সংগ্রামটাকে বুঝতে পারে না, আমলে আনে না৷
সন্তান নাই এই সত্যটা মেনে নিতে না পেরে মা করে চলেন তাঁর নিজস্ব সংগ্রাম, বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম; বিলাপ করে, সন্তানের স্মৃতি বয়ান করে, তার ছবি বুকের মধ্যে, ঘরের মধ্যে, ট্রাঙ্কের মধ্যে সংরক্ষণ করে, তার নামে কুরবানি দিয়ে, তার নামে গাছ লাগিয়ে, ফল ফলিয়ে তিনি চালিয়ে যান এই তাঁর এই একাকী নিজস্ব ব্যক্তিগত সংগ্রাম৷ তা-ই করতে বসেন জাহানারা ইমাম, লিখে চলেন একাত্তরের ডায়েরি, বুকে পাথর বেঁধে, দিনের পর দিন, পৃষ্ঠার পরে পৃষ্ঠা৷ নিশ্চয় শহীদ জুয়েলের মা, শহীদ বদিউল আলমের মা, শহীদ বাশারের মা, শহীদ বাকেরের মা, বাংলাদেশের আর লাখো শহীদের মা, নিজ নিজ ধরনে বিস্মৃতির সুষুপ্তির বিরুদ্ধে একা জেগে থাকেন৷ আর তাঁদের সেই একাকী স্মরণসংগ্রামের প্রতীক হয়ে শহীদ মিনারের মধ্য মিনারটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, মায়ের দুপাশে চারটা সন্তানসমেত, দিন নাই, রাত্রি নাই, কি রোদে, কি বৃষ্টিতে!
৬৫. মা – উপসংহার
আজাদ ধরা পড়ার পর ৩১ বছর পরে, আজাদের মাকে দাফন করার ১৭ বছর পরে একজন ক্ষুদ্র-সামর্থ্য লেখক, আরেক ৩০ আগস্টে আরম্ভ করে আজাদের অপূর্ণ একটা ইচ্ছা পূর্ণ করার অসম্ভব কাজটি : আজাদের মায়ের কথা সবাইকে জানানো, আজাদের মায়ের জীবনী রচনা করা৷ আজাদ মাকে লিখেছিল সে যদি নামকরা হয়, বড় হয়, তাহলে সে সবাইকে জানাবে তার মায়ের কথা৷ রচনা করবে তাঁর জীবনী! আজাদ অনেক বড় হয়েছে, এত বড় যে তার সমান আর কেই-বা হতে পারে, নামকরা হয়েছে, এর চেয়ে বেশি নামকরা আর কীভাবে হওয়া যাবে ? এখন আজাদের বাবা বেঁচে নাই, ইস্কাটনের বাসাটাও বিক্রি ও ভাঙা হয়ে গেছে, ওখানে উঠছে বড় অ্যাপার্টমেন্ট, ৩৯ মগবাজারের বাসাটা একই রকম আছে, কামরুজ্জামান মারা গেছে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে ভুগে ভুগে৷ শহীদ ক্রিকেটার জুয়েলের নামে প্রতি বছর গঠন করা হয় শহীদ জুয়েল স্মৃতি একাদশ আর শহীদ মুশতাকের নামে গড়া হয় শহীদ মুশতাক একাদশ, দুদলের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় স্বাধীনতা দিবস ক্রিকেট টুর্নামেন্ট৷
জাহানারা ইমাম আর বেঁচে নাই, কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর একাত্তরের দিনগুলি, মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই আছেন, কেউ কেউ নাই, বাংলাদেশ আছে, স্বাধীনতা আছে, কী জানি, এই বাংলাদেশ তাঁদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের সঙ্গে মেলে কি না, টগর চাকরি করে ব্যাঙ্কে, তাদের দুলাভাই শহীদ মনোয়ার হোসেনের নামে একটা স্টেডিয়ামের নামকরণ হয়েছিল খিলগাঁও মসজিদের পশ্চিম দিকে মুক্তিযুদ্ধের পরপর, সেটা আর নাই, তাঁর মেয়ে লীনার বয়স এখন ৩১ কি ৩২, জায়েদ ও চঞ্চল দাঁড়িয়ে গেছে নিজের পায়ে, তাদের আম্মার দোয়ায় তারা এখন সচ্ছল, আর তারা তাদের আম্মার কবরটা পাকা করে টাইলস্-শোভিত করে রেখেছে আম্মারই রেখে যাওয়া টাকা দিয়ে; আজও যদি কেউ যায় জুরাইন গোরস্তানে, দেখতে পাবে কবরটা, আর দেখতে পাবে প্রস্তরফলকে উৎকীর্ণ মায়ের পরিচয় : মোসাম্মৎ সাফিয়া বেগম, শহীদ আজাদের মা৷