আজাদের সঙ্গে রুমীর দেখা হয়ে যায় ধানমন্ডির হাইডআউটেই ৷ এটার কোড-নাম ২৮ নম্বর ৷ এটা একটা ওষুধ কোম্পানির ছেড়ে যাওয়া অফিস ৷ এখানে থাকেন শাচৌ আর আলম ৷ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তখন একত্র হয়েছে ৷ উলফত, হ্যারিস, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, কাজী কামাল, আলম আর রুমী ৷ মেলাঘর থেকে নতুন অস্ত্র আসবে ৷ আসবে আরো আরো বিস্ফোরক ৷ ঢাকায় গেরিলাদের অভিযান এখন একটা নতুন মাত্রা পেয়েছে ৷ ফার্মগেট অপারেশনের পর গেরিলাদের মনোবল এখন তুঙ্গে ৷ তারা এখন বড় অ্যাটাকে যেতে চায় ৷ যদিও শাহাদত চৌধুরী বারবার সাবধান করে জানিয়ে দিচ্ছেন ক্যাপ্টেন হায়দারের উক্তি-গেরিলারা কিন্তু পাকিস্তানি মিলিটারির সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ করবে না, তারা হঠাৎ আক্রমণ করবে, লুকিয়ে যাবে জনারণ্যে ৷ স্মরণ করিয়ে দেন মেজর খালেদ মোশাররফের রণকৌশল, আক্রমণ হবে তিন দিক থেকে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর সামরিক ৷
কিন্তু গেরিলারা এখন সামরিক আক্রমণের জন্যে অস্থির ৷
আজাদ আসে ৷ শাচৌয়ের কথা শোনে ৷ কে এই ক্যাপ্টেন হায়দার ৷ দেখতে কেমন তিনি ৷ শোনা যায়, দাড়ি ছিল, এখন ক্লিন শেভ্ড ৷ প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে যায় ৷ মেলাঘরে একবার যাওয়া দরকার ৷ আর মেজর খালেদ মোশাররফ ৷ ২ নম্বর সেক্টরের প্রধান ৷ তাকে তো ছেলেরা একেবারে হিরোর মতো দেখে ৷ কিংবদন্তি যেন তিনি ৷ শাহাদত চৌধুরী তো বলেন, প্রথম দেখার দিনটায় খালেদ মোশাররফকে তাঁর মনে হয়েছিল গ্রিক দেবতার মতো, বিকালবেলা তাঁকে প্রথম দেখেন শাচৌ, জিপ থেকে নামছেন গোমতী নদীর এমবারক্মেন্টে, পেছনে অস্তগামী সূর্যটা লাল আর গোল, সোনালি রঙের গ্রিক দেবতা নেমে এলেন…
শাচৌ অনেক কথা বলেন ৷ বুঝিয়ে বলেন, ঢাকার যুদ্ধটা কনভেনশনাল যুদ্ধ নয় ৷ এটা সাইকোলজিক্যাল যুদ্ধ ৷ এই যুদ্ধে জয় বা মাটি দখল উদ্দেশ্য নয় ৷ উদ্দেশ্য হলো, মানুষের মনোবল অক্ষুণ্ন রাখা ৷
পরিবেশটা গম্ভীর ৷ এখানে জুয়েল থাকলে ভালো হতো ৷ এখনই একটা কৌতুক বলে পরিবেশটা জমিয়ে তুলতে পারত ৷
‘এই আজাদ তুমি ?’
একটা জুনিয়র ছেলে তাকে তুমি করে বলছে ব্যাপার কী! ছেলেটা আবার দেখতে রুমীর মতো ৷ ‘হ্যাঁ ৷ তুমি ?’
‘চিনতে পারছ না ৷ আশ্চর্য তো! আমি রুমী!’
‘রুমী! এই, তোমার কী চেহারা হয়েছে ৷’
‘মেলাঘরে ট্রেনিং নিতে গেছলাম না ৷ বোঝোই তো ৷ আমার শরীরে কি ওই সব সহ্য হয় ৷ এই, খালাম্মা কেমন আছেন ?’
‘আছেন ভালো ৷ তোমার মা ?’
‘আছেন ৷ মার সঙ্গে দেখা করতে বাসায় চলো ৷ কাজী, জুয়েল ওরা থাকে তো মাঝে মধ্যে ৷ আজকে আমার সঙ্গে চলো ৷ তোমাকে একটা জিনিস দেব ৷’
‘কী জিনিস ?’ রুমী জিজ্ঞস করে ৷
‘তুমি না গান ভালোবাসো ৷ রেকর্ড শোনো ৷ আমাদের বাসা থেকেও তো রেকর্ড ধার নিতা!’
‘হ্যাঁ ৷ তো ?’
‘একটা গান দেব তোমাকে ৷’
‘রেকর্ড!’
‘না রেকর্ডটা পাই নাই ৷ গানের লিরিকটা পেয়েছি ৷ আমি কপি করে রেখেছি ৷ তোমাকেও দেব এখন ৷’
‘কোন গান, বলো তো!’
‘জর্জ হ্যারিসনের ৷ কনসার্ট ফর বাংলা দেশ ৷’
‘ও মাই গড ৷ তুমি ওর রেকর্ড পেয়েছ ?’
‘রেকর্ড পাই নাই ৷ জর্জ হ্যারিসনের গানের কপিটা পেয়েছি ৷ বাংলা দেশ বাংলা দেশ ৷’
‘চলো ৷ এখনই যাই ৷ শাহাদত ভাই, আমি একটু আজাদের বাসায় যেতে পারি ?’
‘কেন ?’
‘আগেই বলব না ৷ আগে আনি, তারপরে আপনাদের সবাইকে দেব ৷’
‘কী জিনিস ?’
‘জর্জ হ্যারিসনের গানের লিরিক ৷ কনসার্ট ফর বাংলা দেশ ৷’
‘বলো কি!’ শাচৌ উত্তেজিত বোধ করেন ৷
শাচৌও খুব গান শোনেন ৷ তবে গানের ব্যাপারে, সাহিত্যের ব্যাপারে তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না ৷ তিনি মনে করেন, জনপ্রিয়তা আর শিল্পের উৎকর্ষ সমার্থক নয় ৷ তার ঝোঁক ক্লাসিকের দিকে ৷ যুদ্ধ আস্তে আস্তে তার মনোভাব পাল্টে দিচ্ছে, এটা তিনি লক্ষ করছেন ৷ জনরুচির প্রতি শ্রদ্ধা তাঁর বাড়ছে ৷ হয়তো জনগণের কাছাকাছি থাকতে গিয়ে তাঁর এই পরিবর্তন ৷ কনসার্ট ফর বাংলা দেশ সম্পর্কে তিনি জানেন ৷ পহেলা আগস্ট এই কনসার্ট হয়েছে ৷ আমেরিকায় মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ৷ জর্জ হ্যারিসন, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, বব ডিলান, এরিখ ক্লাপটন ৷ একেকজন দিকপাল ৷ এরা সবাই মিলে খোদ আমেরিকায় করেছে এই কনসার্ট ৷ হাজার হাজার তরুণ-তরুণী অংশ নিয়েছে এই কনসার্টে ৷ ভয়েস অব আমেরিকা, বিবিসি, আকাশবাণী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-সর্বত্র ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে এই কনসার্টের খবর ৷
শাচৌ বলেন, ‘এই, একটা কপি করে আমাকেও দিও তো ৷’
রুমী বেরিয়ে পড়ে আজাদের সঙ্গে ৷ রিকশায় সহজেই চলে যাওয়া যায় মগবাজার ৷ রেললাইনের ধারে বাসাটা ৷
মাকে ডাকে আজাদ-’মা দ্যাখো ৷ কাকে এনেছি ৷’
মা মাথায় কাপড় দিতে দিতে এগিয়ে আসেন ৷ ‘কে ?’
রুমী সালাম দেয় ৷ মা সালামের জবাব দেন ৷ আজাদ বলে, ‘রুমী ৷’
মা বিস্মিত! রুমীর চেহারা এতটা রোদে পোড়া হলো কী করে! কুশল বিনিময় শেষ করে মা রুমীর জন্যে নাশতা আনতে যান ৷ রুমী আর আজাদকে তার ব্যক্তিগত বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে না ৷ বরং তার উৎসাহ জর্জ হ্যারিসনের বাংলাদেশ গানটা নিয়ে ৷
আজাদ একটা বইয়ের ভেতর থেকে একটা কাগজ বের করে ৷ সেই কাগজে সে কপি করে রেখেছে গানটা ৷ তাকেও সে কাগজ-কলম এগিয়ে দেয় ৷ রুমী কপি করার আগে গানটা একবার পড়ে নেয় ৷
Oh friends came to me
With sadness his eyes
(রুমী ভাবে, আজাদ কপি করতে একটু ভুল করেছে ৷ ফ্রেন্ডস না হয়ে ফ্রেন্ড হলে তো গ্রামারটা ঠিক থাকে ৷)
He told me that he wanted help
Before his country dies
Although I couldn`t feel the pain
I knew I had to try
Now I am asking all of you
To help us save some lives
Bangla Desh, Bangla Desh
Where so many people
Are dying fast.
And it sure looks like a mess
I have never seen such distress.
I want you lend your hand
Try to understand
Relieve the people of Bangla Desh
Bangla Desh Bangla Desh
Such a great disaster
I don`t understand
But it sure looks like mess
I never known such distress
Please don`t turn away
I wanna hear you say
Relieve the people of Bangla Desh…
রুমী পড়ে ৷ তার দু চোখে পানি এসে যায় ৷ বলে, ‘কত দূরে বসে একজন গায়ক বাংলাদেশের মানুষের জন্যে ভাবছে, লিখছে, গান করছে, ফান্ড কালেক্ট করছে, মানুষ যখন মানুষের জন্য করে, তখন কেমন লাগে, না!’ সে কাগজকলম নিয়ে বসে পড়ে অনুলিপি করতে ৷ আজাদও কপি করতে থাকে অন্য সহযোদ্ধাদের জন্যে ৷
মা বলেন, ‘আজাদ, চা হয়েছে ৷’
আজাদ বলে, ‘আসছি ৷’ সেও কপি করতে থাকে ৷ শাচৌকে দিতে হবে ৷ জুয়েল, কাজী কামাল-ওরাও তো চাইবে এর কপি ৷
জাহানারা ইমাম ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছেন ৷ বিকালবেলা ৷ রুমী বলেছে, ‘আম্মা, চলো তোমাকে এক বাসায় নিয়ে যাই ৷ তোমার মন একদম ভালো হয়ে যাবে ৷’
‘কোথায় ?’
‘আগে থেকে বলব না ৷ সারপ্রাইজ ৷’
মগবাজার চৌমাথা থেকে তেজগাঁও ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ার দিকে একটু এগিয়েই রেললাইন পার হয়ে গাড়ি খানিক সামনে গিয়ে ডানে একটা গলিতে ঢোকে ৷ আরো একটুখানি গিয়ে আবার ডানে ঢুকে থামে একটা একতলা বাড়ির সামনে ৷ ৩৯ বড় মগবাজার ৷ দু ধাপ সিঁড়ি উঠেই ছোট্ট একটা বারান্দা-রেলিংঘেরা ৷ এ কার বাসায় যে রুমী আনল তাকে-জাহানারা ইমাম ভাবেন ৷ তিনি দেখতে পান, বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে এক স্বাস্থ্যবান যুবক ৷ উঠে দাঁড়িয়ে আদাব দেয় তাকে ৷ রুমী বলে, ‘মা, এ হলো আজাদ ৷ একে তুমি এর ছোটবেলায় অনেক দেখেছ ৷ আগে আমরা এদের বাসায় আসতাম ৷ দাওয়াত খেতাম ৷’
জাহানারা ইমাম আজাদের মুখের দিকে ভালো করে তাকান ৷ কিন্তু মনে করতে পারেন না ৷ তিনি বারান্দা পেরিয়ে ভেতরে যান ৷ আজাদের মা তার সামনে আসেন ৷ ‘আরে, এ যে সাফিয়া আপা ৷’ জাহানারা ইমাম উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন ৷ আজাদের মাকে জড়িয়ে ধরেন ৷ বলেন, ‘কত দিন পরে আপনার সাথে দেখা হলো বলেন তো দশবারো বছর তো হবেই ৷’
আজাদের মা বলেন, ‘তাই হবে ৷’
জাহানারা ইমামের মনে পড়ে, তিনি শুনেছিলেন বটে যে আজাদের আব্বা আরেকটা বিয়ে করেছে ৷ তাই রাগ করে আজাদের মা ছেলেকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেছেন ৷
আজাদের মা চা করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ৷ জাহানারা ইমাম বলেন, ‘আপনি বসুন, আপনার সাথে গল্প করি ৷’
আজাদের মা হাঁক ছাড়েন, ‘কচি, একটু শুনে যেও ৷ খালাম্মাকে কী খাওয়াবে ৷’ তারপর জাহানারার দিকে চেয়ে বলেন, ‘আমিও আজাদকে নিয়ে আলাদা হয়েছি, আমার বোনটাও মারা গেছে, ওর ছেলেমেয়েদের নিজের কাছে রেখেছি ৷ মাঝখানে কয়েক বছর অনেক কষ্ট করেছি আপা ৷ এখন তো মনে করেন আজাদ এমএ পাস করেছে ৷ দেশের পরিস্থিতি ভালো হলে ব্যবসাপাতি করবে ৷ এখন তো ভালোই আছি ইনশাল্লাহ আপনাদের দোয়ায় ৷’
জাহানারা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকেন সাফিয়ার দিকে ৷ তাঁকে তাঁর বরাবরই মনে হয়েছে বাইরে নম্র মৃদুভাষিণী, আর ভেতরে ভেতরে দৃঢ়চেতা, কিন্তু তাই বলে এই মহিলা যে এতটা একরোখা, তা তো তিনি আগে বোঝেননি ৷ এখন আজাদের মা অনেক শুকিয়ে গেছেন ৷ আগে তাঁর ছিল স্বাস্থ্য-সুখী কান্তি ৷ এখন পরনে সরুপাড় শাদা শাড়ি, গায়ে কোনো গয়না নাই, আগে ছিল শরীরভরা গয়না, দামি শাড়ি, মুখে পান আর মৃদু হাসি, আঁচলে চাবি ৷ কী কনট্রাস্ট ৷
তবে আজাদ ছেলেটাকে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায় ৷ সুন্দর হয়েছে ছেলেটা, স্বাস্থ্যবান ৷ মায়ের মতোই মুখে সব সময় হাসি লেগে আছে ৷
রুমী আর আজাদ অন্য ঘরে গল্প করছে ৷ এরই মধ্যে আরেকজন ছেলে আসে ৷ লম্বা ৷ ফরসা ৷ রুমী মাকে ওইঘরে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দেয় তার সঙ্গে, ‘আম্মা, এনাকে চেন ৷ কাজী কামাল উদ্দিন ৷ উনি প্রভিন্সিয়াল বাস্কটবল টিমের খেলোয়াড় ৷ ন্যাশনাল টিমেও ডাক পেয়েছিলো ৷ কাজী ভাই যান নাই ৷ ওনার সাথে আমার দেখা হয়েছে মেলাঘরে, ট্রেনিং ক্যাম্পে ৷ এখানেও কাজী ভাইয়ের অনেক নাম ৷ হিরোইক ফাইটার ৷’
৩৯. মা
গাড়িতে ফিরতে ফিরতে আশরাফুল হকের মনে পড়ে যায় বিগত দিনের নানা স্মৃতি ৷
একেকটা সফল অপারেশন করে ফিরত গেরিলারা, আর সেই বিজয়টাকে উদ্যাপন করত দুদিন ধরে ৷ আশরাফুলদের বাসাতেও হয়েছে এ রকম আড্ডা ৷ সবাই চলে আসত সেই ভোজসভায় ৷ আজাদ আসত ৷ রুমী আসত ৷
রুমীকে প্রথম দিন দেখে তো আশরাফুলের আকাশ থেকে পড়ার যোগাড় ৷ এ তো একদম বাচ্চাছেলে ৷ এ কি যুদ্ধ করবে ? এও ট্রেনিং নিয়ে এসেছে মেলাঘর থেকে ?
বদি আর রুমীর একটা বিষয়ে ছিল খুবই মিল ৷ দুজনই ছিল রোমাঞ্চপ্রিয় ৷ আবার দুজনেই ছিল মেধাবী ৷ বিভিন্ন ঘটনা তারা তাত্তি্বকভাবে বিশ্লেষণ করত ৷ একদিন বদি তাকে বলে তার ভঙ্ ওয়াগনে একটা লিফট্ দিতে ৷ আশরাফুল বের হয় গাড়ি নিয়ে ৷ সে গাড়ি চালাচ্ছে, যাত্রী বদি আর স্বপন ৷ বদির কাছে কেবল একটা পিস্তল ৷ ধানমন্ডি ২৮ নম্বরে রেকিট অ্যান্ড কোলম্যানের অফিসের সামনে গাড়ি দাঁড় করানো হয় ৷ চুল্লু ভাই দুটো বস্তা আনে ৷ আশরাফুল বলে, ‘এর মধ্যে কী ?’
বদি বলে, ‘ইউ গেজ ৷’
আশরাফুলের সমস্তটা শরীর কাঁপতে থাকে ৷ বদি বলে, ‘লেট্স মুভ ৷’
মিরপুর রোডে উঠতেই দেখা যায় সামনে চেকপোস্ট ৷ আশরাফুলের কপালে ঘাম জমে ৷ সে বোঝে, আজই শেষ ৷ বদি কিন্তু নির্বিকার ৷ সে বলে, ‘ইফ দ্য বাস্টার্ডস স্টপ আস, আই উইল জাস্ট ফায়ার ৷ অ্যান্ড ইউ হ্যাভ টু ডু ইয়োর ওন বিজনেস ৷ তোরা কী করবি, তোরা বুইঝা নিস ৷’
শুনে আশরাফুলের সমস্তটা শরীর দুষ্টু ছেলের হাতে ধরা পড়া চড়ুইপাখির ছানার বুকের মতো কাঁপে ৷
গাড়ি চেকপোস্টের সামনে আসে ৷ সৈন্যরা গাড়ি থামাতে বললে তারা থামায় ৷ উর্দুতে কথাবার্তা হয় ৷ তারা জানতে চায় তারা কী করে, কোথায় যাচ্ছে ৷ সামান্য জিজ্ঞাসাবাদের পর সৈন্যরা গাড়ি চেক করার কষ্ট স্বীকার না করে হাত ইশারায় তাদের চলে যেতে বলে ৷
সেই দুপুরটাই তো আশরাফুলের জীবনের শেষ দুপুর হতে পারত ৷ বদিরও হতে পারত ৷ কিন্তু বদি ছিল নির্বিকার ৷ মৃত্যুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলা খেলতে পছন্দ করত সে ৷ তার ছিল অপরিসীম সাহস ৷
আশরাফুলের অত সাহস ছিল না ৷ সে মনেপ্রাণে ছিল গেরিলাদের সঙ্গেই, কিন্তু যুদ্ধে সরাসরি যাওয়ার বা ট্রেনিং নিতে ভারত যাওয়ার কথা ভাবেনি ৷ তবে তার বাবা যেহেতু কৃষক শ্রমিক পার্টি করতেন, পাকিস্তানিরা তাদের সন্দেহের দৃষ্টির বাইরে রাখত, সে কারণে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অন্যতম আশ্রয়স্থল হিসাবে বেছে নিয়েছিল তাদের বাড়িটাকেও ৷
আর ঢাকার গেরিলারা নিজেদের মধ্যে কথা বলত ইংরেজিতে ৷ তারা ভালো পোশাক পরত, সব সময় থাকত ধোপদুরস্ত, যাতে পথেঘাটে চলাচলের সময় কেউ তাদের গেরিলা বলে সন্দেহ না করে ৷
এই ইংরেজি বলা সচ্ছল তরুণ গেরিলাদের সঙ্গেই যোগ দিয়েছিল কমলাপুর রেলস্টশনের কুলি সর্দার রশিদ ৷ শাহাদত চৌধুরীর মতো অভিজাতপন্থী লোক তার সঙ্গে একই সিগারেট ভাগ করে খায়-এটা শুনে আশরাফুলের বিস্ময় আকাশ স্পর্শ করে ৷
৪০. মা
মা বলেন, ‘কোথায় যাচ্ছিস ?’
আজাদ বলে, ‘যাব একদিকে ৷ দোয়া কোরো ৷ ইনশাল্লাহ কালকে ফিরে আসব ৷’
মা বলেন, ‘একা যাবি ?’
আজাদ বলে, ‘না ৷ কাজী, জুয়েল ওরাও যাবে ৷ মা, আর কিছু জিজ্ঞেস কোরো না ৷’
মায়ের বুকটা ধক করে ওঠে ৷ শরীরটা অবশ অবশ লাগে ৷ তিনি বুঝতে পারেন, ছেলে আজকে এমন কোথাও যাবে, যেটা ঠিক সে বলতে চায় না ৷ তিনিও আর বাড়তি কিছু জিজ্ঞেস করেন না ৷
শেভ করা হয়ে গেলে ছেলের মুখের দিকে তিনি তাকান ৷ ছেলের ফরসা গাল ৷ শেভ করার পরে সবুজ হয়ে আছে ৷ তিনি বলেন, ‘ভাত খেয়ে যাবে তো ?’
আজাদ বলে, ‘হুঁ ৷’
মা তাড়াতাড়ি করে ভাত বাড়েন ৷ আজকে তরকারি তেমন ভালো নয় ৷ যুদ্ধের কারণে আজাদের ব্যবসাপাতি বন্ধ ৷ ঘরে টানাটানি চলছে ৷ বাজার তেমন করে আর করা হয় না ৷ ছেলে তাঁর কী খেয়ে যাবে ? তিনি তাড়াতাড়ি একটা ডিম ভাজতে চলে যান ৷ তখন তাঁর মনে হয়, ছেলের পরীক্ষার দিনে তিনি তাকে কিছুতেই ডিম খেতে দিতেন না, দেখতেও দিতেন না ৷ আজ ছেলে তাঁর যে অগি্নপরীক্ষার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, তাতে তো ডিম খেতে অসুবিধা নাই ৷ নিশ্চয় নাই ৷
আজাদেরও মনের মধ্যে উত্তেজনা ৷ উত্তেজনা বেশি হলে তার বারবার পেশাব পায় ৷ সে এরই মধ্যে দুবার জলবিয়োগ করে এসেছে ৷ সে কোনো দিকে তাকাচ্ছে না ৷ ঘাড় না ঘুরিয়ে সামনে নাকের দিকে তাকিয়ে থাকছে ৷ ব্যাপারটা আর কারো চোখে ধরা পড়ছে না বটে, মায়ের চোখে ঠিকই পড়ছে ৷ মা অবশ্য কিছুই বলছেন না ৷
আজাদের বাঁ চোখের পাতা লাফাতে শুরু করে দেয় ৷ এটা কেন হচ্ছে ? এর মানে কী ?
আজাদ ভাত খেতে বসে ৷ ভাতও সে খাচ্ছে মুখ নিচু করে ৷ মা লক্ষ করেন, আজাদ ভাত মুখে নিয়ে চিবোচ্ছে না, গিলে ফেলছে, বারবার গেলাসে করে পানি খাচ্ছে ৷ মা মুখটা হাসি হাসি করে বলেন, ‘আস্তে আস্তে খাও বাবা, চিবিয়ে চিবিয়ে খাও ৷ পানি পরে খেও ৷’
মা যখন সিরিয়াস হয়ে যান, তখন আজাদকে ‘তুমি’ করে বলেন ৷
ভাত খেয়ে উঠে আজাদ কাপড়-চোপড় গোছাতে থাকে ৷ একটা ছোট্ট হাতব্যাগে দুটো ঘরে-পরার কাপড় নেয় ৷ কাজটা করার সময় সে গুনগুন করে গান গাইতে থাকে, এলভিস প্রিসলির গান ৷
তারপর বোনদের ঘরে উঁকি দেয় ৷ মহুয়ার একটা বাচ্চা হয়েছে ৷ সে ঘরে যাওয়া যাবে কি না, কে জানে ৷ দরজায় দাঁড়িয়ে সে গানের আওয়াজ বাড়িয়ে দিয়ে তারপর গলা খাঁকারি দেয় ৷ তারপর বলে, ‘মহুয়া, শরীর ঠিক আছে ?’
‘জি দাদা ৷’
‘বাবুটা রাতে খুব কেঁদেছে মনে হলো ?’
‘জি দাদা ৷ কী যে হইছিল ৷’
‘কিরে কচি, তোর কী অবস্থা ? রোজ দশটা করে অঙ্ক করতে বলেছিলাম, করেছিস ?’
‘জি দাদা ৷’ কচি ভয়ে ভয়ে জবাব দেয় ৷ দাদা যদি এখন খাতা আনতে বলে তাহলেই সে ধরা পড়ে যাবে ৷
দাদা তেমন কিছুই বলে না ৷ সে বেঁচে যায় ৷
‘জায়েদ কই ?’ আজাদ বলে ৷
মা বলেন, ‘ও তো বাইরে গেছে ৷’
আজাদ বলে, ‘ওকে বেশি বাইরে যেতে মানা কোরো ৷’
মা বলেন, ‘ও তোকে মানে বেশি ৷ তুই একদিন ভালো করে কড়া করে বুঝিয়ে বলিস ৷’
‘আচ্ছা ৷’ আজাদ তার ঘরে আসে আবার ৷ জর্জ হ্যারিসনের গান লেখা কাগজটা সঙ্গে নেয় ৷ সিগারেটের প্যাকেট, লাইটার ঠিক আছে কিনা পরখ করে ৷ তারপর মায়ের সামনে এসে তাঁর মুখের দিকে তাকায় ৷ এই প্রথম সে গত এক ঘন্টায় মায়ের মুখের দিকে তাকাল ৷ ঠোঁটটা কামড়ে ধরে মুখে একটা ঝাঁকি দিয়ে সে বলে, ‘যাই তাহলে ৷’
মা বলেন, ‘বাবা, যাই না, বলো আসি ৷’
আজাদ বলে, ‘আসি ৷ দোয়া কোরো ৷’
মা বলেন, ‘সাবধানে থেকো ৷ সাবধানে চোলো ৷ বিসমিল্লাহ করে বের হয়ো ৷ বিপদে লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সোবহানাকা পোড়ো ৷ মাথা ঠাণ্ডা রেখো ৷’
আজাদ একটা বড় শ্বাস টেনে নিয়ে বলে, ‘ওকে ওকে ৷’
সে আর পেছনে তাকায় না ৷ সোজা বের হয়ে বেবিট্যাক্সি স্টান্ডের দিকে যায় ৷
মা তাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেন ৷ ছেলে অদৃশ্য হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থাকেন তার চলে যাওয়ার দিকে ৷
কাজী কামালের নেতৃত্বে জনা-দশেক মুক্তিযোদ্ধা যাচ্ছে সিদ্ধিরগঞ্জে পাওয়ার স্টেশন কীভাবে উড়িয়ে দেওয়া যায়, সেটা সার্ভে করতে ৷ মেজর খালেদ মোশাররফ কাজী কামালকে মেলাঘর থেকে অস্ত্রশস্ত্র আর লোকজন দিয়ে পাঠিয়েছেনই সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ৷ এটা করতে পারলে ঢাকা শহরের বেশির ভাগটা অন্ধকার হয়ে পড়বে ৷ এর আগে দুবার যোদ্ধারা চেষ্টা করেছিল এটা উড়িয়ে দিতে, পারেনি ৷ এবার কাজী কামালের দল বেশ ভারী ৷ ১০ জনের গ্রুপ নিয়ে সে ঢুকেছে ঢাকায় ৷ একটা সাড়ে তিন ইঞ্চি রকেট লাঞ্চারও আনা হয়েছে ৷ ৮ টা রকেট শেল ৷ ভীষণ ভারী ৷ রকেট লাঞ্চার চালানোর জন্যে আর্টিলারির গানার দেওয়া হয়েছে ৷ তার নাম ল্যান্স নায়েক নুরুল ইসলাম ৷ আর আছে কানা ইব্রাহিম ৷ এক চোখ কানা তার ৷ কোনোভাবে যদি পাওয়ার স্টেশনের ভেতরে ঢোকা না যায়, বাজার থেকে শেল মারলে কী হয়! এই হলো মেলাঘরের পরামর্শ ৷ অস্ত্রের মধ্যে আরো আছে দুটো এসএলআর, সঙ্গে আন্যার্গা লাঞ্চার ৷ প্রত্যেকের জন্যে একটা করে স্টেনগান, চারটা ম্যাগাজিন, দুটো গ্রেনেড আর অসংখ্য বুলেট ৷
ভাদ্র মাস ৷ আকাশে মেঘ ৷ তাই একটা গুমোট ভাব ৷ সন্ধ্যার পরে বাড্ডার ওপারের পিরুলিয়া গ্রামের হাইড আউট থেকে দুটো নৌকাযোগে গেরিলারা রওনা হয় সিদ্ধিরগঞ্জের দিকে ৷ বেরুনোর আগে আজাদ বুকপকেট থেকে বের করে একবার দেখে নেয় জর্জ হ্যারিসনের গানের কপিটা ৷ তারপর আবার সেটা রাখে যথাস্থানে ৷ তারা দুটো নৌকায় ওঠে ৷ একটা নৌকায় বদি, কাজী, জুয়েল, আরো দুজন ৷ আরেকটা নৌকায় আজাদ, জিয়া, ইব্রাহিম, রুমী ৷ নৌকা চলতে শুরু করলে বাতাস এসে গায়ে স্পর্শ রাখে, একটুখানি শীতল হয় শরীর ৷ এখনও অন্ধকার তেমন ঘন হয়ে নামেনি ৷ আজাদ উত্তেজিত ৷ তার হাতে একটা স্টেনগান ৷ বলা যায় না, হয়তো আজই তার শত্রুর দিকে গুলি ছোড়ার উদ্বোধন হতে পারে ৷ উত্তেজনা গোপন করতে সে গান ধরেছে, তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে, আমরা কজন নায়ের মাঝি, হাল ধরেছি, শক্ত করে রে ৷ সামনের নৌকা থেকে তার গান শুনে জুয়েল বলে, ‘ঢেউয়ের সাগর নারে, এইটা আসলে ডোবা ৷ গানটা হইব : ব্যাঙ-ডাকা এই রামপুরা বিল পাড়ি দিমু রে, আমরা কয়জন কাউবয়…’
সামনে কাজী কামালদের নৌকা ৷ সবাই যার যার স্টেনগান নৌকার পাটাতনে নামিয়ে রেখেছে ৷ কারণ কেউ অস্ত্র দেখে ফেললে তাদের আসার উদ্দেশ্যই মাটি হয়ে যাবে ৷ কিন্তু বদি কিছুতেই তার স্টেনগান নামিয়ে রাখবে না ৷ সে রেখেছে তার কোলের ওপরে ৷
কাজী কামাল এই অপারশেনের কমান্ডার ৷ সে বলে, ‘বদি, স্টেনটা নামায়া রাখো ৷’
বদি গম্ভীর গলায় বলে, ‘আপনেরা নামায়া রাখছেন রাখেন ৷ আমারে কন ক্যান ৷ আর্মি আসলে কি বুড়া আঙুল টাইনা ইনডেঙ্ দিয়া গুলি করব ? নেভার ৷ আই অ্যাম আ ফাইটার অ্যান্ড আই অ্যাম অলওয়েজ রেডি টু শুট…’
আজাদ বদির কথা শুনে অবাক ৷ কাজী না এই অপারেশনের কমান্ডার ৷ তার আদেশ কি বদির মেনে নেওয়া উচিত ছিল না ৷
দুই নৌকা ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে পাওয়ার স্টেশনের কাছাকাছি ৷ সব নিস্তব্ধ ৷ কেবল নৌকার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না ৷ অন্ধকার ধীরে ধীরে বাড়ছে ৷ আকাশে মেঘ থাকায় তারা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না ৷ তবে এখানে-ওখানে বিলের মধ্যে ঝোপের ওপরে জোনাকি দেখা যাচ্ছে ৷ আর একটা কিটিকিটি শব্দও যেন আছে ৷ ঝোপেঝাড়ে কি ঝিঁঝিও ডাকছে নাকি ? এর মধ্যে আবার শেয়ালের ডাকও কানে আসে ৷ সামনের নৌকায় কাজী সিগারেট ধরায় ৷ লাইটারের আলোয় হঠাৎ চমকে ওঠে আজাদ ৷ কাজীর মুখে লাইটারের আলো পড়ায় ওর মুখটা কিছুক্ষণের জন্যে ভেসে ওঠে আজাদের চোখে ৷ বন্ধুর মুখ দেখে সে খানিকটা স্বস্তি বোধ করে ৷
আজাদ বলে, ‘আমি কি একটা সিগারেট ধরাতে পারি ?’
‘ও শিয়োর’-জিয়া জবাব দেয় ৷
আজাদ একটা সিগারেট ধরায় ৷ তার কাছে ব্যাপারটাকে বেশ রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছে ৷ নাজ বা গুলিস্তান সিনেমা হলে সে কত কত যুদ্ধ-চলচ্চিত্র দেখেছে ৷ আজকে সে নিজেই এক যুদ্ধ-অভিযানের কুশীলব ৷
তাদের নৌকা দুটো এগিয়েই চলেছে ৷ সবাই একদম চুপ ৷ কারণ তারা প্রায় সিদ্ধিরগঞ্জের কাছাকাছি এসে পড়েছে ৷ দূরে পাওয়ার স্টেশনের আলো দেখা যাচ্ছে ৷ ওখানে আছে পাকিস্তানি সৈন্যদের সতর্ক প্রহরা ৷ তাদের জন্যে এটা খুবই স্পর্শকাতর ও সংরক্ষিত এলাকা, সন্দেহ নাই ৷
ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ৷ এতক্ষণে অন্ধকারের সঙ্গে চোখ খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে ৷ অন্ধকারের মধ্যেও নিজেদের কে কোথায় বসে আছে, দেখা যাচ্ছে ৷
আজাদ একটা শ্বাস নেয় জোরে ৷ সেই শ্বাস নেওয়ার শব্দটাও তার কানে প্রবলভাবে বাজে ৷ সে কি ভয় পাচ্ছে ?
হঠাৎই সামনে একটা নৌকার মতো নড়তে দেখা যায় ৷ কী নৌকা, কাদের নৌকা, অন্ধকারে কিছু বোঝা যায় না ৷ তবে তাদের মাঝি বাঙালি ৷ সে হাঁক ছাড়ে, ‘কে যায়!’ রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেদ করে সেই হাঁক প্রলম্বিত হয়ে বিলের ঢেউয়ে ঢেউয়ে যেন আছড়ে পড়ে ৷
আজাদ ভাবে, হয়তো কোনো সাধারণ নৌকা ৷ বাঙালি কেউ যাচ্ছে ৷ কাজী জবাব দেয়, ‘সামনে যাই ৷’
কাজীর গলার স্বরটাকে যেন খানিকটা, মাঝির স্বরের তুলনায়ও এই পরিবেশে, আগন্তুকের মতো শোনায় ৷
ওই নৌকাটা কাছে আসতেই দেখা যায় : সর্বনাশ ৷ ওই নৌকায় পাকিস্তানি মিলিটারি ৷ একটা মুহূর্ত সময় শুধু ৷ আজাদ এখন কী করবে ? তার সামনে কাজীদের নৌকা ৷ সে ফায়ার ওপেন করলে তো কাজীরা মারা পড়বে ৷ তার নিজেকে দিশেহারা লাগে ৷ বদি কারো নির্দেশের অপেক্ষা না করে স্টেন তুলে ব্রাশফায়ার করে ৷ পুরো ম্যাগাজিন খালি করে দেয় ৷ এই শান্ত নিরিবিলি অন্ধকারে অসাড় হয়ে শুয়ে থাকা বিলটার ওপরে আর মেঘভারে নিথর আকাশটার নিচের সমস্ত স্তব্ধতা তখন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় ৷ প্রতিপক্ষ নৌকা থেকেও গুলি বর্ষিত হয় ৷ অন্ধকারে ফুটে ওঠে আগুনের ফুলকি ৷ বারুদের গন্ধ বাতাসের ভেজা গন্ধে এসে মেশে ৷
আজাদ ঠকঠক করে কাঁপে ৷ সামনে শোনা যায় নৌকার ডুবে যাওয়ার শব্দ আর মানুষের আর্তনাদ ৷ মানুষ সাঁতার কাটার চেষ্টা করছে, তাই জলে উঠছে আলোড়ন ৷
আজাদ এরই মধ্যে নৌকার পাটাতনে রাখা অস্ত্র তুলে নিয়েছে ৷ ফায়ার করার জন্যে সে প্রস্তুত ৷ কিন্তু কমান্ডারের অর্ডার ছাড়া ফায়ার করাটা উচিত হবে না ৷ সে চিৎকার করে অর্ডার চায়, ‘কাজী, কাজী…’
কাজী তাড়াতাড়ি বলে, ‘ডোন্ট ফায়ার, ডোন্ট ফায়ার ৷’
আজাদ বলে, ‘ওকে ৷ ওকে ৷’
কাজী বলে, ‘এই, ওই নৌকা এদিকে আনো ৷ এইটা ফুটা হইয়া গেছে ৷ পানি উঠতেছে ৷ কাম শার্প ৷’
আজাদদের নৌকা তাড়াতাড়ি সামনে যায় ৷ এদিকে অন্ধকারে বদির গলা, ‘হেল্প মি, আই অ্যাম গোয়িং টু বি ড্রাউন্ড ৷’ টর্চের আলোয় দেখা যায় বদি পানিতে ভাসছে ৷ ও বোধহয় পড়ে গিয়েছিল ৷ ভাসমান বদিকে নৌকায় তোলা হয় ৷ কাজীরাও নৌকা বদল করে উঠে পড়ে আজাদদেরটায় ৷ ওরা এসে আজাদদের নৌকায় উঠতে না উঠতেই প্রথম নৌকাটা ডুবে যায় ৷
কাজী বলে, ‘দেয়ার বোট হ্যাজ বিন টোটালি ডেস্ট্রয়েড ৷ লেট্স রিট্রিট ৷ স্পিডবোট নিয়া আবার অ্যাটাক করতে আইতে পারে ৷’
পাকিস্তানি সৈন্যদের নৌকাটা ডুবে গেছে ৷ সৈন্যরা হয় গুলিবিদ্ধ অথবা নিমজ্জিত ৷
চারদিক অন্ধকার ৷
একমাত্র নৌকাটি দ্রুত বাইতে বাইতে তারা ফিরে আসছে ৷ দুই নৌকার মাঝি একই নৌকায় ৷ তারা জোরে জোরে দাঁড় বাইছে ৷
জুয়েল বলে, ‘আমার আঙুলে কী যেন হইছে রে ৷’
পেন্সিল টর্চ জ্বালিয়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখা যায়, ডান হাতের তিনটা আঙুল গুলিতে জখম ৷ রক্তে জায়গাটা একাকার ৷ মনে হয় গুলি আঙুল ভেদ করে বেরিয়ে গেছে ৷
আজাদের শরীর কাঁপছে ৷ উত্তেজনায় ৷ জুয়েলের হাতে রক্ত দেখে সে বুঝতে পারে, তারা মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরছে ৷
দুই মাঝি নৌকা বাইছে ৷ মনে হচ্ছে, তবুও নৌকার গতি বড় শ্লথ ৷ আজাদ আর জিয়া পানি সেচা থালা হাতে নিয়ে বৈঠা বাওয়ার কাজ করছে ৷
কাজী কামাল হ্যা-হ্যা করে হাসে ৷ ‘আজাদ, আওয়ার এলভিস প্রিসলি, ইজ রোয়িং দ্য বোট ৷ দিস ইজ ফানি ৷’
আজাদ বলে, ‘আরে আমি বিক্রমপুরের পোলা না ? গ্রামে গিয়ে কত নৌকা বেয়েছি ৷’ এবার নৌকা সত্যি দ্রুত এগোচ্ছে ৷ অবশেষে বিলের শেষে ডাঙা দেখা যায় ৷ আকাশে মেঘের ফাঁকে একটা চাঁদ দেখা যাচ্ছে ৷ শাদা পেয়ালায় পানি নিয়ে রংমাখা তুলি ছেড়ে দিলে যেমন রঙগুলো ছড়াতে থাকে, চাঁদের ওপরে মেঘগুলোকে দেখা যাচ্ছে তেমনি ৷ শেয়ালের ডাক কানে আসছে, কুকুরদের সম্মিলিত প্রতিবাদধ্বনিও ৷ জোনাকি এখন অনেক ৷
ডাঙা এসে গেছে ৷ নৌকা ঘাটে ভিড়লে সবাই নৌকা থেকে অবতীর্ণ হয় ৷
রাতটা পিরুলিয়া গ্রামের হাইড আউটেই কাটায় তারা ৷ এটাও আজাদের জন্যে এক নতুন অভিজ্ঞতা ৷ কাঁচা ঘর ৷ প্রাকৃতিক শৌচাগার ৷
জুয়েলের দিকে তাকিয়ে আজাদের মায়া লাগতে শুরু করে ৷ তার হাতের রক্তপাত বন্ধ হচ্ছে না ৷ আহা বেচারা এর পরে ব্যাট করতে পারবে তো ৷
হারিকেনের আলোয় জুয়েলের রক্তকে মনে হচ্ছে খয়েরি ৷
এই হারিকেনের আলোতেই বদি একটা চটিবই মনোযোগ দিয়ে পড়ছে ৷ কী বই ? আজাদ এগিয়ে যায় ৷ দেখে আলবেয়ার কামুর দি আউট সাইডার ৷ বদির বই পড়ার বাতিকটা গেল না!
কাজী কামাল বেরিয়ে যায় ফার্স্ট এইডের জন্যে সরঞ্জাম জোগাড় করতে ৷ আজাদ বলে, ‘জুয়েল, ব্যথা করছে ?’
জুয়েল বলে, ‘হেভি আরাম লাগতেছে ৷ দেশের জন্যে রক্ত দেওয়াও হইল, আবার জানটাও রাখা হইল ৷ কইয়া বেড়াইতে পারুম, দেশের জন্যে যুদ্ধ কইরা আঙুল শহীদ হইছিল ৷ হা-হা-হা ৷’
আজাদ জুয়েলের কথায় হাসতে পারে না ৷ বোঝাই যাচ্ছে তার খুবই ব্যথা লাগছে ৷ সে ব্যথা ভোলার জন্যে রসিকতা করার চেষ্টা করছে ৷
কাজী কামাল তুলা আর ডেটল জোগাড় করে আনে ৷ জুয়েলের হাতে ফার্স্ট এইড দেওয়া হয় ৷
৪১. মা
কুটু বলে, ‘আংকেল ৷ ওর হাতটা একটু দেখতেন যদি…’
‘কী হয়েছে ?’
ডাক্তারকে কি মিথ্যা বলা যায় ? কাজী বলে, ‘গুলি লাগছে ৷’
রশিদ উদ্দিন বলেন, ‘এহ্ ৷ একেবারে থেঁতলে গেছে ৷ হাড় ভেঙেছে কি না কে জানে! গুলি লাগল কী করে!’
‘এই কেমন কইরা জানি লাগল আর-কি!’ জুয়েল বলে ৷
ডা. রশিদ বলেন, ‘আমার এখানে তো ও.টি. নাই ৷ তোমরা এক কাজ করো ৷ রাজারবাগে ডা. মতিনের ক্লিনিকে নিয়ে যাও ৷ আমি আসছি ৷’
‘রাজারবাগ!’ কাজী কামাল ঢোক গেলে ৷ ‘ও তো বিপজ্জনক জায়গা!’
ডা. রশিদ উদ্দিন বুঝে ফেলেন ৷ বলেন, ‘ঠিক আছে ৷ আমি আমার গাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছি ৷’
ডা. রশিদ তাঁর রেডক্রস চিহ্ন আঁকা গাড়িতে করে জুয়েলকে নিয়ে যান রাজারবাগে ডা. মতিনের ক্লিনিকে ৷ ওখানে অপারেশন থিয়েটারে জুয়েলের হাতে তিনি ব্যান্ডেজ করে দেন ৷ সেখান থেকে জুয়েলকে নিয়ে যাওয়া হয় দিলু রোডে হাবিবুল আলমের বাসায় ৷ হাবিবুল আলমের তিন বোন জুয়েলের যত্নের ভার নেয় ৷ বড় বোন আসমা তাকে ড্রেসিং করে দেয় নিয়মিত ৷
তবে ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসক ছিলেন ডা. আজিজুর রহমান ৷ জুয়েলের হাতে আঙুলের অবস্থা খারাপ দেখে তাকে ডা. আজিজের এলিফ্যান্ট রোডের পলি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয় ৷
ডা. আজিজ আর তাঁর স্ত্রী ডা. সুলতানা জুয়েলের হাতের ব্যান্ডেজ খোলেন ৷ আঙুলের অবস্থা দেখে আঁতকে ওঠেন ৷ আজিজ বলেন, ‘তিনটা আঙুল একসাথে ব্যান্ডেজ করেছে কেন! আর ব্যান্ডেজ এত বড়ই বা কেন ৷’ তিনি তিনটা আঙুল আলাদা আলাদা করে ব্যান্ডেজ করে দেন ৷’
জুয়েল বলে, ‘স্যার, দেশ স্বাধীন হলে আমি হব ন্যাশনাল ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন ৷ আঙুল তিনটা রাইখেন ৷’
মিটিং বসেছে ২৮ নম্বরের হাইড আউটে ৷ শাচৌ, বদি, আলম, কাজী উপস্থিত সেখানে ৷ সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কি ওড়ানো যাবে না ? মেজর খালেদ মোশাররফ, ক্যাপ্টেন হায়দার-এরা খুবই চান যে ওটা উড়ে যাক ৷ কিন্তু কীভাবে!
আলম বলে, ‘ওখানে আর্মিরা যেভাবে বাঙ্কার করে পজিশন নিয়ে সব সময় অ্যালার্ট থাকে, অ্যাটাক করে ওদেরকে সরানো যাবে না ৷ তার চেয়ে গেরিলা ওয়ারফেয়ার করব গেরিলা কায়দায় ৷ আমরা ওখানকার স্টাফদের সঙ্গে যোগাযোগ করি ৷ দুইজন কর্মচারীর সঙ্গে তো আমাদের যোগাযোগ আছেই ৷ ওদেরকে ট্রেনিং দিয়ে ওদের হাতে এক্সপ্লোসিভ পাঠিয়ে দিয়ে ওদের দ্বারাই ওগুলো ব্লাস্ট করানো হবে ৷’
আলম এক্সপ্লোসিভের ব্যাপারটা খুব ভালো বোঝে ৷ সে বলে যায়, ‘এখন ৮০/৯০ পাউন্ড পি.কে. (প্লাস্টিক এঙ্প্লোসিভ) লাগবে ৷ এতটা পি.কে. ভেতরে নিয়ে যাওয়া যাবে কী করে ?’
অনেক আলোচনার পর ঠিক হয়, পাওয়ার স্টেশনের ইঞ্জিনিয়ারের জিপের দরজার ভেতরের দিকের হার্ডবোর্ড কভার খুলে পি.কে. নিয়ে যাওয়া হবে ৷ একবারে ৮/১০ পাউন্ড পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যাবে ৷
যাক, সিদ্ধিরগঞ্জ বিষয়ে তবু একটা ফয়সালা হলো ৷ কিন্তু বিশেষ ট্রেনিং নিয়ে এসে গেরিলারা কি শুধু বসে থাকবে ? ‘তা হবে না ৷ চলো, একটা কিছু করি’-বদির উত্তেজনা সবচেয়ে বেশি ৷
কাজী কামাল বলে, ‘খালি প্যাচাল না পাইড়া কিছু একটা অ্যাকশন করি ৷ হাতে-পায়ে জং ধইরা যাইতেছে তো ৷’
ঠিক হয়, তারা আবার বেরিয়ে পড়বে ৷ একসঙ্গে একই সময় দুটো গ্রুপে ৷ একটা আলমের নেতৃত্বে ৷ আরেকটা জিয়ার নেতৃত্বে ৷ আলমের গ্রুপে থাকবে আলম, বদি, কাজী কামাল, রুমী আর স্বপন ৷ দ্বিতীয় গ্রুপে হ্যারিস, মুখতার, জিয়া, আনু, চুল্লু ভাই আর আজাদ ৷
বদি আর আলম মিলে ধানমন্ডি থেকে হাইজ্যাক করে একটা মাজদা গাড়ি ৷ গাড়িটার কাগজপত্রে দেখা যায় গাড়ির মালিক মাহবুব আনাম ৷ অন্যদিকে হ্যারিস আর মুখতার হাইজ্যাক করে ফিয়াট ৬০০ গাড়ি ৷
আজাদরা অপেক্ষা করছে ধানমন্ডির হাইড আউটে ৷ বদি আর আলম গেছে এক গ্রুপের জন্যে গাড়ি হাইজ্যাক করতে ৷ হ্যারিস আর মুখতার গেছে তাদের গ্রুপের জন্যে গাড়ি হাইজ্যাক করতে ৷ বদি আর আলম চলে আসে আগে ৷ তারা হাইজ্যাক করেছে একটা শাদা মাজদা ৷ তাতে উঠে কাজী কামাল, রুমী, স্বপন বিদায় নেয় ৷ আজাদ, আনু, চুল্লু ভাই অপেক্ষা করছে হ্যারিস আর মুখতারের জন্যে ৷ হ্যারিস আর মুখতার আসে ফিয়াট ৬০০ গাড়ি নিয়ে ৷ তাতে উঠে পড়ে আজাদরা ৷ সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে ৷ রাস্তার লাইটগুলো জ্বলছে ৷ হ্যারিসদের কাজ হলো রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কাছে থাকা ৷ আর আলমরা ধানমন্ডি এলাকায় চীনা কূটনীতিকের বাসার সামনে প্রহরারত সৈন্যদের ওপর হামলা করে ওদিকেই ১৮ নম্বর রোডে আরেকটা বাসায় শেখ মুজিব পরিবারকে নজরবন্দি রাখা প্রহরারত পুলিশ আর সৈন্যদের ওপর চড়াও হবে ৷ তারপর এসে জিয়াদের সঙ্গে যোগ দেবে ৷ তখন দুটো গ্রুপ একসঙ্গে আরো কিছু অভিযান পরিচালনা করবে ৷ বেরুনোর আগে শাচৌ যখন জানতে চেয়েছেন এই অপারেশনের নাম কী, তখন আলম বলেছে, এর নাম অপারেশন আননোন ডেসটিনেশন ৷
আজাদদের গাড়ি চালাচ্ছে হ্যারিস ৷ সে গাড়ি নিয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সামনে একটা চক্কর দেয় ৷
হ্যারিস বলে, ‘কী করব ৷ ইঞ্জিন গরম হয়ে যাচ্ছে ৷ রেডিয়েটরে মনে হয় পানি নাই ৷ মিটারে হট দেখাচ্ছে ৷’
জিয়া বলে, ‘কোথাও থেকে পানি নিলে হবে ?’
হ্যারিস বলে, ‘হবে ৷’
মুখতার বলে, ‘শাহজাহানপুরে চলেন ৷ আমার চেনা পানের দোকান আছে ৷ ওখান থাইকা পানি নেওন যাইব ৷’
হ্যারিস গাড়ি থামায় শাহজাহানপুরে, মুখতারের দেখিয়ে দেওয়া পানের দোকানের সামনে ৷ স্টেন হাতে সবাই নামে ৷ এলাকায় চাঞ্চল্য দেখা যায় ৷
আজাদ একটা পান কেনে ৷ দোকানদার কিছুতেই দাম নেবে না ৷ বলে, ‘স্যার মুক্তি গো কাছ থাইকা দাম লই না ৷’ ইঞ্জিনে পানি ভরে নিয়ে ওরা আবার আসে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের গেটে ৷ দুটো চক্কর দেয় ৷ ‘আরে, আলমদের কী হলো! ওরা আসে না কেন!’
জিয়া বলে, ‘চল, আমরা নিজেরাই একটা অ্যাকশন করি ৷ দারুল কাবাবের দিকে যাই ৷’
কাকরাইলের মোড়ে আসতেই কয়েকজন বাঙালি পুলিশ বলে ওঠে, ‘হল্ট ৷’ ওরা গাড়ি থামায় ৷ জিয়া ঘাড় বাড়িয়ে বলে, ‘সরেন তো ৷ আমরা বাঙালি পুলিশ মারি না ৷’
পুলিশও উঁকি দিয়ে দেখে, এদের হাতে যে অস্ত্র, তাতে বাড়াবাড়ি করা মানেই মৃত্যু ৷ বলে, ‘ওরে বাবা, মুক্তিবাহিনী ৷’ তারা সরে এসে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে ৷ যেন তারা কিছুই দেখেনি ৷
আজাদরা ময়মনসিংহ রোডে এসে পড়ে ৷ চলে যায় দারুল কাবাবের দিকে ৷ দারুল কাবাবের সামনে একটা আর্মির জিপ দাঁড় করানো ৷ এটাকে আক্রমণ করা যায় ৷ আজাদের হাত স্টেনগানে চলে যায় ৷ জিয়া বলে, ‘গাড়িটা ইউ টার্ন করে ঘুরিয়ে আন ৷ তাহলে মগবাজার দিয়ে পালিয়ে যেতে সুবিধা হবে ৷’ হ্যারিস গাড়িটাকে ইউ টার্ন করে ঘুরিয়ে আনে খানিকটা দূরে গিয়ে ৷ ফিরে এসে দেখা যায়, আর্মির জিপটা চলে গেছে ৷
তারা সোজা চলে আসে পিজি হাসপাতালের মোড়ে ৷ সেখান থেকে এলিফ্যান্ট রোড হয়ে মিরপুর রোডে পড়তে যাবে ৷ সামনে দেখা যায়, একটা আর্মির জিপ ৷ হ্যারিস বলে, ‘লেট্স অ্যাটাক দি জিপ ৷’ জিয়া বলে, ‘দাঁড়াও ৷ পেছনে আলো নেভানো কতগুলো আর্মির ট্রাক আছে ৷ মিরপুর রোডেও গাড়ি দাঁড় করিয়ে চেক হচ্ছে ৷ হ্যারিস, গাড়ি ২ নন্বর দিয়ে সাতমসজিদ রোডে নাও ৷’
আজকের অপারেশনেও কোনো গুলি করতে না পেরে আজাদ হতাশ ৷ ২৮ নম্বরে তারা তাদের হাইড আউটে যায় ৷
২৮ নম্বরে পরে যখন সবাই মিলিত হয়, তখন জিয়ারা আলমদেরকে বকাবকি করে তাদের সঙ্গে তারা কেন রাজারবাগে যোগ দেয়নি!
আলমরা তাদের অপারেশনের যে গল্প করে, তা শুনে আজাদের রোম খাড়া হয়ে যায় ৷ এ যে সিনেমাকেও হার মানায়!
আলম বলে, “আমি মাজদার ড্রাইভিং সিটে বসলাম ৷ আমার এসএমজিটা দিলাম বদিকে ৷ বদি আমার বাঁ পাশে ফ্রন্ট সিটে বসল ৷ পেছনে বাঁয়ে কাজী, মধ্যখানে রুমী আর ডান দিকে স্বপন ৷ ২৮ নম্বর থেকে বেরিয়ে মাঠের কাছে চায়নিজ ডিপ্লোম্যাটের বাসার সামনে গেলাম ৷ গিয়ে দেখি কোনো সেন্ট্রি নাই ৷ ধানমণ্ডি ১৮ নম্বর রোডে পাকিস্তানি আর্মির হোমরা-চোমরার বাড়ির সামনে গিয়ে দেখি সাত-আট জন সেন্ট্রি রাইফেল কাঁধে, তাদের জনা-দুয়েক দাঁড়িয়ে, বাকিরা বসে, সবাই গল্পগুজব হাসিঠাট্টায় মশগুল ৷ আমি বললাম, ‘ওকে ফ্রেন্ডস, জন্তুরা আমাদের হাতের নাগালে, আর ঠিক তিন মিনিট সময় আমাদের হাতে ৷’
সাতমসজিদ রোডে গিয়ে আমি গাড়ি ঘুরিয়ে নিলাম ৷ এতে সুবিধাও হলো ৷ আমাদের শত্রুরা আমাদের বাঁয়ে পড়ল ৷ বদি আর কাজী তাদের বাঁয়ের জানালা ব্যবহার করতে পারবে ৷ আমি স্বপন আর রুমীকে বললাম, ‘তোমরা রাস্তা দ্যাখো ৷ রুমী পেছনটা ৷ স্বপন সামনেরটা ৷’
সেন্ট্রিদের খুব কাছে চলে আসলাম ৷ মাজদার সুবিধা হলো শব্দ করে না ৷ গাড়ি স্লো করে বললাম, ফায়ার ৷ বদি পেট বরাবর, কাজী বুক বরাবর গুলির মালা রচনা করল তাদের স্টেনগান আর মেশিনগান দিয়ে ৷ সৈন্যরা মুহূর্তে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে ৷ কোনো প্রতিরোধ করার ফুরসত পেল না ৷ রুমী বলল, ‘লেট্স কালেক্ট দ্য উইপন ৷’ আমি বললাম, ‘মাথা খারাপ নাকি ৷ প্রতিটা সেকেন্ড মূল্যবান ৷’ সেখান থেকে গাড়ি টান দিয়ে চীনা ডিপ্লোম্যাটের বাসভবনে আবার গিয়ে দাঁড়ালাম কিন্তু কোনো শিকার পেলাম না ৷ স্বপন আর রুমী বলল, ‘এটা কি, আমাদের তো শুটিং প্রাকটিসই হলো না ৷’ আমি আবার মিরপুর রোডে উঠলাম ৷ যাচ্ছি নিউমার্কেটের দিকে ৷ ৫ নম্বরের কাছে এসে দেখি, আর্মি চেকপোস্ট বসিয়েছে ৷ দুটো ট্রাক আর একটা জিপ আমাদের দিকেই মুখ করে দাঁড়ানো ৷ রাস্তায় দুজন সৈন্য শুয়ে পড়ে লাইট মেশিনগান নিয়ে পজিশন নিয়েছে ৷ চার-পাঁচটা গাড়ি দাঁড় করিয়ে আর্মি চেক করছে ৷ ভয়ে আমার কলজে শুকিয়ে এল ৷ এখন আর থামিয়ে গাড়ি ঘোরানোরও সময় নাই ৷ একমাত্র উপায় ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাওয়া ৷ আমি বললাম, ‘বাঁচার একমাত্র উপায় হলো আমরা গাড়ি না থামিয়ে বাঁয়ে চলে যাব ৷ স্বপন, এলএমজিম্যানকে সাবাড় করবা ৷ বদি, কাজী, রাস্তার বায়ে দাঁড়ানো সৈন্যদের টার্গেট করবা ৷ আমি গাড়ি বাঁয়ে ঘোরানোর সাথে সাথে ফায়ার করবা ৷ আমি শুধু একবারই বলব, ফায়ার ৷’
আমি গাড়ি স্লো করে দাঁড়ানো গাড়িগুলো কাটিয়ে সামনে চলে গেলাম ৷ তিনজন সেন্ট্রি হাত উঁচিয়ে বলল, ‘হল্ট ৷’ আমি হেডলাইট বন্ধ করে ডান দিকে যাওয়ার ইনডিকেটর জ্বালালাম ৷ ডানে ঘোরানোর একটু ভানও করলাম ৷ সেন্ট্রি চিৎকার করে বলল, ‘হারামজাদা, কিধার যাতা হ্যায়, রোকো,’ আমি এক্সসেলেটরে চাপ দিয়ে গাড়ি বাঁয়ে ৫ নম্বরের দিকে নিতে নিতে বললাম, ‘ফায়ার, ফায়ার ৷’
স্বপনের গুলি এলএমজিম্যানকে শেষ করে দিল নিশ্চয় ৷ নইলে কোনো পাল্টা গুলি তো হলো না ৷ একই সাথে বদি আর কাজীর গুলি শেষ করে দিল বাঁয়ের সৈন্যদের ৷ আমার ঘাড়ের মধ্যে স্বপনের ছোড়া গুলির খালি কাতর্ুজ এসে পড়ল ৷ গরমে ঘাড়ে ফোস্কা পড়ে গেল ৷ আমি গাড়ি নিয়ে গ্রীন রোডে পড়লাম ৷ ইনডিকেটরে বাঁ দিক দেখিয়ে গাড়ি ঘোরালাম ডান দিকে ৷ মিরপুর রোডের দিকেই ৷ হেডলাইট নেভানো ৷ হঠাৎই রুমী বলল, ‘লুক লুক, দেয়ার ইজ আ জিপ, দি বাস্টার্ডস আর ট্রায়িং টু ফলোয়িং আস ৷’
রুমীকে কোনো নির্দেশ দিতে হলো না ৷ সে নিজেই স্টেনের বাঁট দিয়ে গাড়ির পেছনের কাচ ভেঙে ফেলল ৷ তারপর স্টেন বাড়িয়ে টার্গেট করল জিপের ড্রাইভারকে ৷ তার টার্গেট, উরেব্বাস ৷ জিপটা গিয়ে একটা ল্যাম্পপোস্টের গায়ে ধাক্কা খেল ৷ পেছনে তাকিয়ে রুমীরা দেখল আরো একটা জিপ আর দুটো ট্রাক গ্রীন রোড ধরে ফার্মগেটের দিকে যাচ্ছে ৷ আমরা মিরপুর রোড ধরে এলিফ্যান্ট রোডের দিকে চলে এলাম ৷”
আলমের বর্ণনা শেষ হলো ৷
আজাদ আলমের মুখে সব শুনে তার বন্ধুদের সাফল্যে আর সাহসিকতায় মুগ্ধ ৷ বলে, ‘ইস্, আমি যে কবে নিজ হাতে পাক আর্মি মারতে পারব ৷ তোরা ভাই হেভি দেখাচ্ছিস ৷’
৪২. মা
জুয়েলের ভালো নাম আবদুল হালিম চৌধুরী ৷ তার বাবা আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী অ্যাকাউনটেন্ট পদে চাকরি করেন একটা বেসরকারি প্রাইভেট ফার্মে ৷ জুয়েলরা চার বোন আর তিন ভাই ৷ এর মধ্যে বড় ভাই মারা গেছে ছোটবেলাতেই ৷ জুয়েলই এখন বড় ৷ ‘৬৯ সালে সে জগন্নাথ কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেছে ৷ এখন চাকরি করে সাত্তার গ্লাস ওয়ার্কে এনালিস্ট কেমিস্ট হিসেবে ৷ ইচ্ছা আছে, দেশ স্বাধীন হলে সে এই বিষয়ে ট্রেনিং নিতে বিদেশে যাবে ৷ তবে তার আসল পরিচয় সে ক্রিকেটার ৷ আজাদ বয়েজে খেলেছে ৷ মোহামেডানে খেলেছে ৷ আজাদ বয়েজ থেকে মোহামেডানে যাওয়ার পেছনেও কারণ ছিল ৷ ১৯৬৭ সালে লন্ডন থেকে এমসিসি দল ঢাকায় খেলতে এলে যে টিম তাদের সঙ্গে খেলতে নেমেছিল, তাতে জুয়েলকে নেওয়া হয়নি ৷ নির্বাচকমণ্ডলীর এই সিদ্ধান্তের পেছনে আজাদ বয়েজের কর্মকর্তাদের হাত আছে ভেবে রাগ করে জুয়েল মোহামেডানে যায় ৷
নিউজিল্যান্ড টিমের বিরুদ্ধে খেলার জন্যে অল পাকিস্তান দলের ক্যাম্পেও সে ডাক পেয়েছিল ৷ চূড়ান্ত টিমে অবশ্য তার জায়গা হয় নাই ৷ সে ট্রেনিং নিতে আগরতলা বর্ডার অতিক্রম করতে বাসা ছাড়ে ৩১শে মে ৷ বাসার কাউকে কিছু বলে যায়নি ৷
জুয়েলের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পেছনে একটা বড় কারণ ছিল শহীদ ক্রিকেটার মুশতাকের লাশ দর্শন ৷
২৭শে মার্চ সৈয়দ আশরাফুল হক আর জুয়েল গিয়েছিল ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের সামনে মুশতাকের মরদেহ দেখতে ৷ মুশতাকের মরামুখটা জুয়েলের মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল ৷ একটা মানুষ একটু আগেও ছিল মানুষ, তার কত আশা, কত স্বপ্ন, কত সার্থকতা, এই মুখটাই তো ক্রিকেট খেলত, জয়-পরাজয় নিয়ে কত হিসাব-নিকাশ, কত অধ্যবসায়, আর দ্যাখো এখন সে শুয়ে আছে সবকিছুর অন্য পারে ৷ জুয়েল নীরবে শুধু মাথা নাড়ছিল, দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছিল নিচের ঠোঁট ৷ তখনই সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, একটা কিছু করতে হবে, শুধু শুধু বিনা প্রতিরোধে লাশের কাফেলায় শুয়ে পড়ার কোনো মানে হয় না ৷
ফার্মগেট অপারেশনের পরে বাসার চার বোনের জন্যে জুয়েলের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয় ৷ এ কারণে তাদেরকে সে পাঠিয়ে দিয়েছে গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুরে ৷ এখন অবশ্য সে ঝাড়া হাত-পা ৷ মাঝখানে ঝামেলা হলো নিজের ডান হাতের আঙুল জখম হওয়ায় ৷ তার প্রধান চিন্তা, সে কি আর ক্রিকেট খেলতে পারবে ? তবে মুখে সে এই কথা কাউকে বলে না ৷ নিজেও হাসিমুখ করে থাকে ৷ সঙ্গীদেরও হাসায় ৷
ড্রেসিং করার সময় জুয়েল যেন ব্যথা টের না পায়, সেজন্য আসমা জুয়েলের সঙ্গে নানা গল্প করে ৷ এর মধ্যে একটা হলো ক্রিকেট ৷ জুয়েল ঢাকা শহরের ব্যাটিংয়ে তুফান বলে খ্যাত ৷ সে ব্যাট করে ঝড়ের গতিতে ৷ যতক্ষণ সে উইকেটে থাকে, ততক্ষণ রানের চাকা ঘোরে ৷ শুধু ঘোরে না, বনবন করে ঘোরে ৷
আসমা জিজ্ঞেস করে, ‘জুয়েল, রকিবুল হাসান তো অল পাকিস্তান টিমে চান্স পেয়েছে ৷ তুমি পাবে না ?’
জুয়েল কিন্তু স্বভাবে জন্মরসিক ৷ ‘আরে, আমারে এইবার নিউজিল্যান্ডের এগেইনস্টে নিল না বইলাই তো আমি অল পাকিস্তানই ভাইঙ্গা দিতেছি ৷ দেশটা স্বাধীন হইলে আমরা বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম বানাব ৷ এইটাতে আমি ঠিকই চান্স পাব, দেইখেন মেজপা ৷’
আসমা বলে, ‘তা তো পাবেই ৷ পাকিস্তান টিমেও চান্স পেতে ৷’
জুয়েল বলে, ‘আরে আবার পাকিস্তান ৷ পাকিস্তানকে বোল্ড কইরা দিতেছি ৷ মিডল স্টাম্প আউট ৷ উফ্ ৷ ব্যথা লাগে তো ৷’
আসমা পুরনো তুলাটা সরিয়ে একটা পরিষ্কার তুলা নেয় ৷ জুয়েলের ক্ষতস্থান মুছে দেয় ডেটল-ভেজা তুলা দিয়ে ৷ জুয়েলকে বলে, ‘তোমার বাসা না টিকাটুলিতে ৷ বেঙ্গল স্টুডিওর পাশে ৷ নায়িকাদের দেখ না!’
জুয়েল বলে, ‘গেটের সামনে পাবলিকে ভিড় কইরা থাকে ৷ একদিন দেখি আজিম-সুজাতা ঢুকতেছে ৷’
জুয়েল আজিম-সুজাতার ঢোকার দৃশ্যটা মনে করতে না করতেই আসমার ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষ হয়ে আসে ৷
তো জুয়েল দিলু রোডে ভালোই ছিল ৷ কিন্তু ওখানে একা একা আটকে থাকাটা কতক্ষণ সম্ভব ? একটু সিগারেট খাওয়া, একটু কার্ড খেলা-এসব করতে ইচ্ছা করে কিনা! আজাদদের বাসা এদিক থেকে উত্তম ৷
২৯শে আগস্ট ১৯৭১ ৷
দুপুরবেলা ইব্রাহিম সাবের আসে আজাদদের বাসায় ৷ আজাদের মায়ের রান্না দুপুরে খাওয়াটা তার কাছে একটা দারুণ আনন্দের ব্যাপার বলে মনে হয় ৷
আজাদদের বাসায় যাতায়াতের রাস্তায় একটা দোকান ৷ তাতে তিনজন যুবক বসে ৷ তারা মাথা বের করে দেখছে কে যায় আজাদদের বাসায় ৷ মনে হয় যেন ফলো করছে ৷ সাবেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে তাদের একজন বলে, ‘ভৈরব ব্রিজটা পাহারা দিতেছে পাকিস্তানি আর্মিরা, ওই আর্মিগো অ্যাটাক করতে হইলে আমি সাহায্য করতে পারি ৷’ শুনে ইব্রাহিম সাবেরের সন্দেহ হয়, এরা আর্মির ইনফরমার নয় তো ৷ আজাদদের বাসায় ঢুকে সাবের প্রথমেই আজাদকে বলে, ‘দোস্তো, আজকের রাতটা তোরা এখানে থাকিস না ৷’
আজাদ বলে, ‘কেন ?’
‘দোকানে দেখলাম…’
‘আরে না ৷ চোরের মন তো, তাই সবাইকে পুলিশ পুলিশ লাগে ৷’ আজাদ হেসেই উড়িয়ে দেয় কথাটা ৷ দুপুরের খাওয়াটা ভালোই হয় সাবেরের ৷ খেয়েদেয়ে সে বেলাবেলি ফিরে যায় নিজের বাসায় ৷
জুয়েলের সঙ্গে আর দেখা হয় না সাবেরের ৷ জুয়েল আবার আজকের দুপুরবেলাটা কাটাচ্ছে সৈয়দ আশরাফুল হকের বাসায় ৷
বিকালবেলা আজাদদের বাসায় কাজী কামাল, বাকি, হ্যারিস, হিউবার্ট রোজারিও-সবাই একসঙ্গে এসেছে ৷ বাকি অনেকক্ষণ ছিল, রাত ৮টার দিকে চলে গেছে ৷ হ্যারিস অবশ্য চলে গেছে খানিকক্ষণ পরই ৷ রোজারিও ইদানীং প্রায়ই রাতে থাকে আজাদদের বাসায় ৷ কিন্তু আজকে রাতে সে থাকবে না ৷ তার মাকে দেখতে নাকি যেতেই হবে ৷ সেও রওনা হয়ে গেছে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই ৷ বিকালেই জায়েদ একবার ঢোকে আজাদের ঘরে, আড্ডার মধ্যে রসভঙ্গ করে বলে, ‘দাদা, কামরুজ্জামানরে চিনো না ৷ ওই বেটা তো আর্মির দালাল ৷ আজকা কিন্তু খানিক আগে ওই বেটা আইসা বাসার সামনে থাইকা ঘুইরা গেছে ৷ আমার কেমুন সন্দেহ হয় ৷ আইজকা রাইতে এই বাসায় থাকাটা নিরাপদ না ৷’
‘আরে রাখ তো ৷ কামরুজ্জামান ৷ কামরুজ্জামানরে কামান বানায়া দেব ৷ কত কামরুজ্জামান আসল গেল ৷ ওই এমনি ঘোরে ৷ ইস্কাটনের বাসায় তো কাজ করে ৷’ আজাদ পাত্তাই দেয় না জায়েদের কথায় ৷
‘আরে না ৷ ওই বেটা আর্মির ইনফরমার ৷ সবাই জানে’-জায়েদ ঘাড় গোজ করে বলে ৷
‘তরে কইছে সবাই জানে ৷ আজাইরা কথা বলিস না তো ভাগ ৷’ আজাদ তাকে হাত নেড়ে কেটে পড়ার সংকেত দেয় ৷ জায়েদ বেরিয়ে যায় ৷
জুয়েল চলে আসে আশরাফুল হকদের বাসা থেকে ৷ আশরাফুল তাকে নিষেধ করে, ‘যাস না ৷ থাইকা যা ৷’
জুয়েল বলে, ‘আজাদগো বাসায় রাইতে কার্ড খেলা যাইব ৷ আর তা ছাড়া আম্মা আমারে না দেখলে চিন্তা করব ৷’
জুয়েল আর টগর আবার চাচাতো ভাই ৷ টগররা যেহেতু সাফিয়া বেগমকে আম্মা বলে ডাকে, জুয়েলও তাই ডাকে তাঁকে ৷
জুয়েল গায়ে শার্ট চাপাতে চাপাতে বলে, ‘বদি থাকলে থাকন যাইত এইহানেই ৷’
আশরাফুল বলে, ‘হ, বদি ভাইয়ের ব্যাপারটা বুঝলাম না ৷ দুই দিন ধইরা গায়েব ৷ কই না কই আছে ৷’
‘যাই রে ৷’ জুয়েল বেরিয়ে যায় ৷
আশরাফুলদের ইস্কাটনের বাসা থেকে আজাদদের মগবাজারের বাসা খুবই কাছে ৷ গলি দিয়ে গলি দিয়েই সহজে জুয়েল পৌঁছে যায় সেখানে ৷
ওই সময় আড্ডা জমে ওঠে খুব আজাদদের বাসায় ৷
আজাদ বলে, ‘কাজী, শাহাদত ভাই মেলাঘরে গেছে না ?’
কাজী কামাল বলে, ‘গেছে ৷ আলমও সাথে গেছে ৷’
‘মেজর খালেদ মোশাররফ আর ক্যাপ্টেন হায়দার যখন জিজ্ঞেস করবে, সিদ্ধিরগঞ্জে কী করলা, কী জবাব দেবে!’ আজাদ ফোঁড়ন কাটে ৷
‘আছে, জবাব আছে ৷ সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের ব্যাপারে একটা প্লান করা হইছে ৷ ওই স্টেশনের দুই কর্মচারী ইব্রাহিম আর শামসুল হককে ট্রেনিং দেওয়া হইতেছে ৷ ট্রেনিং চলতেছে ধানমন্ডি ২ নম্বরের একটা আর্ট গ্যালারিতে ৷ চিনছ তো বাসাটা ৷ ভাস্কর আবদুল্লাহ খালিদ যেইখানে বসে ৷ ট্রেনিং চলতেছে ৷ এই ধরো টাইম পেন্সিল ব্যবহার করা ৷ পি.কে. ফিট করা ৷ এইসব ৷ ওই গ্যালারিতে তো এখন কেউ যায় না ৷ কেউ বুঝব না’-কাজী কামাল জবাব দেয় ৷
জুয়েল বলে, ‘ওই দুইজনকে তো তোরা খরচের খাতায় ধইরা রাখছস ৷ যদি পাওয়ার স্টেশন উড়ে তাইলেও অগো পাকিস্তানি আর্মি ছাড়ব না ৷’
কাজী কামাল বলে, ‘অরাও জাইনা-শুইনাই আইছে ৷ সাহস আছে ৷ তবে অগো ঢাকার কোনো হাইডআউট, কোনো গেরিলার নাম-ঠিকানা জানানো হয় নাই ৷ খালি আলম, শাচৌ এই রকম একজন-দুইজনের নাম জানে ৷ কওয়া যায় না, সাবধানের মাইর নাই ৷’
আজাদ বলে, ‘তাইলে তো তোর মুখরক্ষা ৷’
কাজী কামাল বলে, ‘ক্যান ৷ ঢাকা শহরটা যে কাঁপায়া দিলাম, মাউড়াগুলানের যে হাঁটুকাঁপা রোগ শুরু হইছে, তার কী হইব ৷ এইটার একটা এপ্রিসিয়েশন দিব না!’
তা অবশ্য দেওয়াই উচিত ৷ ঢাকার চারটা পাওয়ার স্টেশনের দুটো উড়ে গেছে ৷ আলমের দল পিজির পাশে এলিফ্যান্ট রোডের স্টেশন ওড়াতে গিয়ে কাউন্টার অ্যাটাকে পড়ে গিয়ে লড়াই করে বেরিয়ে এসেছে ৷ পাওয়ার স্টেশন ওড়ানোর পরিকল্পনা ব্যর্থ হলেও খালেদ মোশাররফ সবচেয়ে খুশি হন এটার জন্যেই ৷ কারণ পৃথিবীর বহু কাগজে বাংলাদেশ খবর হয়ে আসে : ঢাকায় গেরিলারা স্ট্রিট ফাইটে নেমে পড়েছে ৷ এ ছাড়া স্ট্রিট ফাইট হয়েছে গ্রিন রোডে, উড়ে গেছে ফার্মগেটের আর্মিক্যাম্প ৷ আজিজের দল গ্রিন রোডে উড়িয়ে দিয়েছে আর্মিবহর ৷ ঢাকার ছেলেরা এখন তুচ্ছ মনে করছে সবকিছুকে ৷ ঢাকাবাসীর মনোবল ফিরে এসেছে ৷ ভয়টা এখন পাকিস্তানি আর্মির ৷ এসব খবর তো খালেদ মোশাররফের অজানা নয় ৷
এখন রাত ৮টার পরে জমে উঠেছে তাস খেলা ৷ আজাদ, জুয়েল, কাজী কামাল আর সেকেন্দার ৷ জয়েন সেক্রেটারির ছেলে সেকেন্দার এসেছিল টিভি দেখতে ৷ তাসের টানে সে বসে পড়েছে ৷
মর্নিং নিউজের রিপোর্টার বাশার আসে রাত ৯টার পরে ৷ এসেই এই ঘরে উঁকি দেয় ৷ ‘কী ভাই, কেমন চলছে ৷’
জুয়েল বলে, ‘বাশার, তোমাদের মর্নিং নিউজ ফিউজ হইয়া গেছে ৷ বাল্বটা বদলাও ৷’
বাশার শার্ট খুলতে খুলতে বলে, ‘বুঝলাম না ৷’
জুয়েল বলে, ‘তোমরা তো রাজাকারেরও অধম হইয়া গেছ ৷ এত মিথ্যা কথা লেখো কেমনে!’
বাশার বলে, ‘পিছন দিয়া বন্দুকের নলা ঢুকায়া দিলে মুখ দিয়া আপনি যা চাইবেন তা-ই বাইর করতে পারবেন ৷’
জুয়েল বলে, ‘মর্নিং নিউজরে একটু নাইট নিউজ বানাইয়া দিতে হইব ৷ দুইটা পাইন অ্যাপেল গড়ায়া দিলেই তো বোঝা যাইব পেন ইজ মাইটার দ্যান সোর্ড, উইকার দ্যান গান ৷’
‘পাইন অ্যাপেল মানে কী ? বাশার কও তো!’ আজাদ বলে ৷
‘আনারস যে না এটা বুঝি’-বাশার উত্তর দেয় ৷
‘হ্যান্ড গ্রেনেডের নিকনেম-আজাদ জানিয়ে দেয় ৷’
কাজী কামাল কোনো কথা বলছে না ৷ সে একমনে তার হাতে পাওয়া তাসগুলো পর্যবেক্ষণ করে ক্রমানুসারে সাজিয়ে নিচ্ছে ৷
জুয়েলের ডান হাতে ব্যান্ডেজ ৷ অন্য হাত দিয়েই সে চমৎকার তাস বাটতে পারে, ধরতে পারে ৷
আজাদ বলে, ‘তুই তো জুয়েল একটা জিনিয়াস ৷ ওয়ান্ডারফুল বয় ৷ এক হাতে কেমন করে শাফল করছিস!’
জুয়েল বলে, ‘আরে আমি তো ভাবতেছি এক হাতে ব্যাট চালাব ৷’
তখন ঘরে নীরবতা নেমে আসে ৷ এত ভালো একটা ক্রিকেটারের তিনটা আঙুল মোটামুটি থেঁতলে গেছে ৷ সে কি আর এ জীবনে ক্রিকেট খেলতে পারবে!
জায়েদ আসে ঘরে ৷ সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘরে ঢোকা মুশকিল ৷ বলে, ‘দাদা, ওঠেন ৷ খেলায় বিরতি দ্যান ৷ আম্মা ভাত নিয়া বইসা আছে ৷’
আজাদ বলে, ‘আরেক দান ৷ এই, তোরা খেয়েছিস ?’
জায়েদ বলে, ‘খাইছি ৷’
আজাদ বলে, ‘টগর, চঞ্চল, কচি, মহুয়া, টিসু-সবাই খেয়েছে ?’
‘হ ৷’
‘মনোয়ার দুলাভাই খেয়েছে ?’
‘জি খাইছে ৷’
তারা আরেক দানের নাম করে তিন-দান খেলে ফেলে ৷ তখন ও-র থেকে মায়ের গলা ভেসে আসে, ‘আজাদ, খাবি না তোরা ?’
আজাদ বলে, ‘মা ডাকছে ৷ এইবার উঠতেই হয় ৷ এই ওঠো ৷’
খাবার টেবিলটা ছোট ৷ একসঙ্গে ছয়জনের বেশি বসা যায় না ৷ বড় টেবিল যে ফেলা হবে, তার জায়গাই বা কোথায়! বাসাটাই তো ছোট ৷ আগে, ইস্কাটনের বাসায় তাদের ডাইনিং টেবিলে একসঙ্গে ১০ জন বসতে পারত ৷ সেসব দিনের জন্যে সাফিয়া বেগমের মনে কি একটা ছোট্ট গোপন আফসোস রয়ে গেছে ? সাফিয়া বেগম তা স্বীকার করবেন না ৷ যুদ্ধ বেধে যাওয়ার পর আজাদও আর টাকা-পয়সা দিতে পারছে না ৷ গয়না বিক্রি করতে হচ্ছে ৷ এখন ঘরের আত্মীয়স্বজন বাদ দিয়েও বাসায় রোজই আজাদের বন্ধুবান্ধব ভিড় করে থাকে ৷ তারা খায়দায় ৷ গাদাগাদি করে এখানেই শোয় ৷ আজাদের মায়ের এটাই ভালো লাগে ৷ লোকজন খাওয়ানোটা তাঁর প্রিয় একটা শখ ৷ আর নিজের ছেলের বন্ধুবান্ধবদের তদারকি করতে পারা, আদর-যত্ন করতে পারাটায় এক ধরনের তৃপ্তি পাওয়া যায় ৷ কলজের মধ্যে এক ধরনের আরাম লাগে ৷
গতকাল যেমন তিনি মালিবাগ থেকে দাওয়াত করে এনেছেন তার বোন মাবিয়ার মেয়ে দুলু, মেয়ের জামাই মনোয়ার হোসেনকে ৷ তাদের ছোট্ট মেয়ে লীনাটা কেমন ঘুরছে সবার কোলে কোলে ৷ এত রাত হলো, মেয়েটার চোখে ঘুম নাই ৷ রাতের বেলা জন্মালে বাচ্চারা রাতে জেগে থাকে ৷ দুলুর বোন ফুলুও এসেছে বেড়াতে, তারও সঙ্গে আছে তার ছোট্ট মেয়ে বিভা ৷
টেবিলে প্লেট বিছিয়ে ভাত-তরকারি বেড়ে আজাদের মা অপেক্ষা করছেন ৷ জুয়েল, আজাদ, কাজী কামাল, সেকেন্দার আসে ৷ বেসিনের কলটা নষ্ট ৷ তিনি একটা গামলা দিয়েছেন টেবিলে ৷ বলেন, ‘সবাই গামলায় হাত ধুয়ে নাও ৷’ তিনি পানি এগিয়ে দেন ৷ গামলাটা একজনের সামনে থেকে নিয়ে ধরেন আরেকজনের সামনে ৷ শুধু জুয়েলের হাত ধোয়ার দরকার পড়ে না ৷ তার ডান হাতের তিন আঙুলে ব্যান্ডেজ ৷ সে বাকি দু আঙুলে চামচ দিয়ে তুলে খাবে ৷ মা বলেন, ‘বাশার কই বাশার ? তুমিও আসো ৷ খেয়ে নাও ৷ ঠাণ্ডা হয়ে গেলে আর ভালো লাগবে না ৷’ বাশার আসে ৷
‘কী হয় ? টিভিতে শাহনাজ বেগমের গান হয় নাকি!’ আজাদ বাশারকে খেপানোর চেষ্টা করে ৷
রান্না হয়েছে গরুর মাংস, আলুভর্তা, পটলভাজা, লাউশাক আর ডাল ৷
এত অল্প তরকারি দিয়ে ভাত দিতেও সাফিয়ার লজ্জা লজ্জা লাগে ৷ কিন্তু কিছুই করার নাই ৷ একে তো আয় বুঝে ব্যয় করতে হয়, তার ওপর মাছ খাওয়া বন্ধ ৷ দেশের সব নদীতে এখন শুধু মানুষের লাশ ভাসে ৷ মানুষের লাশ ঠুকরে খেয়ে খেয়ে মাছগুলো হচ্ছেও বেশ নধরকান্তি ৷ মাছ খেলে কলেরা না হয়েই যায় না ৷ তাই মাছ খাওয়া সবাই বন্ধ করে দিয়েছে ৷ তার ওপর গতকাল মনোয়ার জামাইয়ের আগমন উপলক্ষে ভালো খাবারের আয়োজন ছিল ৷
সবাই খেতে বসেছে ৷ জুয়েল ছেলেটা সব সময় রসিকতা করতে পছন্দ করে ৷ সে বলে, ‘আম্মা, আপনি নিজে রানছেন!’
‘হ্যাঁ বাবা ৷’
‘আর কত দিন কষ্ট করবেন আম্মা ৷ আজাদরে একটা বিয়াশাদি দ্যান ৷ বউয়ের হাতের সেবাযত্ন খান ৷’
‘দ্যাখো, তোমরা পাত্রী দ্যাখো ৷ বিয়ে তো দিতেই হবে ৷’ মা যে একটা মেয়ে ঠিক করে রেখেছেন, এটা আর বলেন না ৷
‘তা আম্মা যৌতুক হিসাবে কী নিবেন ? ডিম্যান্ড কী ?’
‘না না ৷ ছেলে বিক্রি করতে পারব না ৷’
‘না ৷ এই যুদ্ধের বাজারে এই কথা কইবেনই না ৷ আপনার ডিম্যান্ড না থাকতে পারে ৷ আমাদের আছে ৷ ছেলেকে একটা অন্তত এলএমজি আর চারটা ম্যাগাজিন আর ২ হাজার রাউন্ড গুলি দিতে হইব ৷’
বাশার বলে, ‘একেবারে ট্যাঙ্ক ডিম্যান্ড করো ৷ ট্যাঙ্ক চাইলে পিস্তল পেতেও পারো ৷’
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবাই ওঠে ৷ মা গামছা পর্যন্ত এগিয়ে দেন ৷
তারা সবাই আবার আজাদের ঘরে গিয়ে ঢোকে ৷ মা বলেন, ‘পানের অভ্যাস থাকলে বলো ৷ পান দিতে পারি ৷’
বাশার বলে, ‘দ্যান ৷ যার লাগে সে খাবে ৷’
তারা ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে আবার আজাদের ঘরে আসে ৷
বাশার বলে, ‘ঘরে সিগারেট আছে ? রাতে লাগবে না ? আজাদ চলো, সিগারেট আনি!’
আজাদ বলে, ‘জায়েদরে দিয়া আনাই ৷’
বাশার বলে, ‘আরে চলো না ৷ তোমার সাথে কথা আছে ৷’
আজাদ আর বাশার ঘর থেকে বের হয় ৷ এরই মধ্যে রাস্তাঘাট সব ফাঁকা হয়ে পড়েছে ৷ হওয়ারই কথা ৷ গেরিলারা প্রায় প্রতিদিনই ঢাকার নানা জায়গায় নানা অপারেশন চালাচ্ছে ৷ গাড়ির চাকার নিচে ছোট ছোট মাইন পুঁতে গাড়ির চাকা সশব্দে ব্লাস্ট করা থেকে শুরু করে একেবারে সুসজ্জিত আর্মি শিবিরে হামলা করা পর্যন্ত ৷ আর মিলিটারিও হয়ে পড়েছে পাগলা কুকুরের মতো ৷ কখন যে কাকে ধরে নিয়ে যাবে, তার ঠিক নাই ৷ তার ওপর কারফিউ ৷
বাশার বলে, ‘শোনো, মিলি নাকি দেশে ফিরেছে ৷’
মিলির কথায় আজাদের বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে ৷ হাত-পা অবশ হয়ে যায় ৷ সে অতি কষ্টে স্বাভাবিক থাকার ভঙ্গি করে বলে, ‘তাতে আমার কী!’
‘আছে ৷ তোমারও কিছু আছে ৷ মিলির আসলে বিয়ে হয়নি ৷ তোমার কাছ থেকে দূরে রাখার জন্য মিথ্যা কথা বলেছিল ৷’
‘বলো কি!’
‘দেশে এসেছে’-বাশার একটু ভাবগম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে ৷
‘তুমি কেমন করে জানলা!’
‘জানলাম ৷ খবরের কাগজে চাকরি করি ৷ সব খবরই রাখতে হয় ৷ তবে আরেকটা অসমর্থিত সূত্রের খবর, মিলির ডিভোর্স হয়ে গেছে ৷’
‘তার মানে বিয়া হইছিল ৷’
‘হ্যাঁ ৷ তার ইচ্ছার এগেইনস্টে ৷’
‘তুমি এটা কী শোনাচ্ছ ৷ আমার তো হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতেছে ৷ বাট আই জাস্ট ক্যাননট বিলিভ দিস নিউজ অ্যটঅল ৷’
‘ওকে ৷ উই ক্যান চেক ইট ৷’
‘পুরানা পল্টনে বাসা ৷ চেক তো করাই যায় ৷ তুমি যাবা ৷ তোমার সাথে তো আর কোনো সমস্যা নাই ৷’
‘ঠিক আছে যাব ৷’
‘তুমি আমারটা খোঁজখবর করো ৷ আমি তোমারটা দেখছি ৷ তোমাকে আর কষ্ট করে পাত্রী খুঁজতে হবে না ৷ পাত্রী আমাদের বাসা থেকেই বের করে ফেলব ৷’
বাশার লজ্জা পায় ৷ গলির ভেতরে একটা হোটেলের মধ্যে একটামাত্র দোকান আছে ৷ দোকানটা বাইরে থেকে বন্ধই থাকে ৷ তবে টুক টুক করে টোকা দিলে একটা ছোট্ট জানালা খুলে যায় ৷ টাকা দিলে সিগারেট বেরোয় ৷ এখানেই কেবল রাত্রিবেলা সিগারেট পাওয়া যায় ৷ বেনসন অ্যান্ড হেজেস-এর প্যাকেট কেনে আজাদ ৷
সিগারেট জ্বালিয়ে টানতে টানতে ফিরে আসে ৷ রাস্তায় শুধু কুকুর ৷ গলির মুখটা অন্ধকার ৷ আকাশে পোয়াখানেক চাঁদও দেখা যাচ্ছে ৷ নিজেকে কেমন তুচ্ছ, সামান্য লাগে আজাদের ৷ সে আরো জোরে সিগারেটে টান দেয় ৷ মনে হচ্ছে সিগারেটের মুখের আগুনটুকুকে সে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিতে চায় ৷ অন্ধকারে প্রতিটা টানে তার মুখে লাল আভা পড়ে ৷
মহুয়া, কচি, দুলু, ফুলু, আজাদের খালাতো বোনেরা, আর আজাদের মা এক ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছিল ৷ মহুয়ার কোলের কাছে তার অল্পদিন আগে জন্ম নেওয়া মেয়ে ৷ দুলু, ফুলুর সঙ্গেও তাদের ছোট বাচ্চারা ৷ এর মধ্যে বালিকা কচির ঘুম ভেঙে যায় কিসের যেন শব্দে ৷ সে দেখতে পায়, ঘরে আলো ৷ আর আলোর মধ্যে সে দেখতে পায়, চোখে সুরমা, ফরসা, যেন চাঁদের আলো দিয়ে তার দেহ গড়া, লম্বা, স্বাস্থ্যবান এক যুবক, যেন রাজপুত্র, বিছানার ধারে দাঁড়িয়ে আছে ৷ সে মহুয়াকে ধাক্কা দেয়, বলে, ‘বুজি দ্যাখো, কী সুন্দর’ সে বুঝতে পারে না সে স্বপ্ন দেখছে নাকি এই দৃশ্য বাস্তবে ঘটছে ৷ মহুয়ার ঘুম ভেঙে যায়, সে ঘরের মধ্যে মিলিটারি দেখে ভয়ে কুঁকড়ে যায় আর কচির মুখ চেপে ধরে ৷
তারও আগে নিঃশব্দ আততায়ীর মতো পাকিস্তানি সৈন্যরা এসে ৩৯ মগবাজারের বাসাটা, হাজি মনিরুদ্দিন ভিলা, ঘিরে ফেলে ৷ তারা দরজায় সজোরে ধাক্কা দিতে থাকে ৷ তখন আজাদের ঘরে জুয়েল বিছানায় শোয়া ৷ কাজী কামালের পিস্তলটা, যেটা মেজর নুরুল ইসলাম শিশু তাকে দিয়েছিল, জুয়েলের কাছে ৷ এটার প্রতি তার লোভ ছিল ৷ বিকালেই কাজী কামাল বলেছে, ‘থাকুক, পিস্তলটা তোর কাছেই থাকুক ৷’ সেটাকে সে বিছানার ওপরেই রেখে শুয়েছিল ৷ নিচে পাটিতে বসে তাস খেলছে কাজী কামাল, আজাদ, সেকেন্দার আর বাশার ৷ ভাদ্রের মাসের রাত, ভাপসা গরম ৷ কাজী কামালের পরনে একটা লুঙ্গি মাত্র, শরীরে আর কিছু নাই ৷ মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছে ৷ আজাদের খালাতো ভাইরা, জায়েদ, টগর, চঞ্চল, টিসু আর খালাতো দুলাভাই মনোয়ার হোসেন শুয়েছে আরেক ঘরে ৷ দরজায় আঘাতটা বেড়েই চলেছে ৷ আজাদরা তখন হকচকিত ৷ জায়েদের ঘুম ভেঙে যায় ৷ সে ভাবে, শব্দ হয় কেন ? মাথা তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে দাদাদের রুমে এখনও আলো জ্বলছে ৷ দরজায় আবার প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা ৷ জায়েদ বিছানা ছাড়ে ৷ দাদারা জেগে আছে, দরজা খোলে না কেন ? উঠে জানালার পর্দাটা ফাঁক করে জায়েদ, তখন তার বয়স সতেরোর মতো, বাইরে তাকায়, দেখতে পায়, সাক্ষাৎ সর্বনাশ বাইরে দাঁড়িয়ে ৷ জায়েদ কী করবে বুঝতে পারে না ৷ পাশের ঘরে যায়, দেখে আম্মা সবাইকে নিয়ে কই লুকাবেন কী করবেন বুঝতে পারছেন না ৷ আর জুয়েলের পিস্তলটা আলুর বস্তার পেছনে ফেলা হচ্ছে ৷ জায়েদের একটা গোপন দরজা আছে, মেথরদের আসার চোরা রাস্তা ৷ ওই রাস্তা দিয়ে সে অনেকবার অস্ত্র নিয়ে পৌঁছে দিয়েছে আলমদের দিলু রোডের বাড়িতে ৷ ওই দরজা খুলে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে সে পালানোর চেষ্টা করে ৷ কিন্তু সামনে যমদূতের মতো খাড়া হয়ে আছে পাকিস্তানি আর্মি ৷ হ্যান্ডস আপ ৷ জায়েদ হাত উঁচু করে ৷ দরজা খোলা পেয়ে জায়েদকে বন্দুকের মুখে ঠেলে ভেতরে নিয়ে আসে সৈন্যরা ৷ এসে সামনের দরজা খুলে দেয় ৷ একে একে ঢুকে যায় বেশ কজন ৷ একজন কমান্ডো ধরনের ৷ তার বুকে লেখা : মেজর সরফরাজ ৷ একজনের বুকে লেখা : ক্যাপ্টেন বুখারি ৷ ক্যাপ্টেন বুখারির হাতে স্টেনগান ৷
সৈন্যরা এসেই বলে, ‘আজাদ কোন হ্যায় ৷’
কেউ স্বীকার করে না ৷
আজাদকে ওরা জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমারা নাম কিয়া ?’
আজাদ বলে, ‘মাগফার আহমেদ চৌধুরী হ্যায় ৷’
কম্যান্ডো ধরনের লোকটা বলে, ‘তুম আজাদ হ্যায় ৷’
‘মে আজাদ নেহি হ্যায় ৷’
‘শালা মাদারচোত, তুম নাম কিউ নিদানা হ্যায় ৷’ সে আজাদের ঘাড়ে প্রচণ্ড জোরে একটা ঘুসি মারে ৷
ইতিমধ্যে অন্য ঘর থেকে টগর, চঞ্চল, মনোয়ারকেও এনে একপাশে লাইনে দাঁড় করানো হয়েছে ৷ মোট আটজন বাঙালি বিভিন্ন বয়সের পুরুষ এখানে বলির পাঁঠার মতো লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, কাজী কামাল খেয়াল করে ৷ আজাদ, জুয়েল, বাশার, সেকেন্দার, মনোয়ার হোসেন, জায়েদ, টগর, চঞ্চল ৷ কাজী কামালের মনে হয়, তাকে ল্যান্স নায়েক নুরুল ইসলাম সব সময় বলেছে, ‘স্যার, দুইজন সেন্ট্রি দাঁড় করায়া রাখেন ৷ এইভাবে সেন্ট্রি ছাড়া আপনারা থাকেন ৷ কোন দিন জানি বিপদে পড়েন ৷’ ইস্, দুইজন গার্ড যদি বাইরে দাঁড় করানো থাকত, পজিশন নেওয়ার সময় পেলে ওদের গুলি করেই উড়িয়ে দেওয়া যেত ৷ এভাবে বিনা চ্যালেঞ্জে মরতে হতো না ৷
‘আর্মস কিধার হ্যায় ?’ বুখারি নির্দেশ দিচ্ছে ৷ স্টিলের একটা আলমারি আছে ঘরে ৷ আজাদের মা আঁচল থেকে চাবি খুলে দিলে একজন সৈন্য আলমারি খোলে ৷ সবাই আগ্রহভরে অস্ত্র খুঁজছে ৷
হঠাৎই ক্যাপ্টেন বুখারি লক্ষ করে, একটা ছেলের হাতের আঙুলে ব্যান্ডেজ দেখা যায় ৷ সে জুয়েলের জখমি জায়গাটা চেপে ধর বলে, ‘বাস্টার্ড, হয়ার আর দি আর্মস ?’
ব্যথায় জুয়েল ‘ও মাগো’ বলে কুঁকিয়ে ওঠে ৷ কাজী কামালের মাথায় রক্ত উঠে যায় ৷ সে নিজের ডান হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে, আয়ুরেখা বড় আর স্পষ্ট ৷ তার মানে এখানে তার মরণ নাই ৷ সে হঠাৎই মেজরের হাতের স্টেনগানটার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে দু হাতে স্টেন ধরে ফেলে ৷ মুহূর্তের মধ্যে এ কাণ্ড ঘটে যায় ৷ স্টেনের দখল কে নেবে এই নিয়ে টানাটানি হতে থাকে ৷ ট্রিগারে কাজীর হাত ৷ গুলি বেরুতে থাকে ৷ রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে যায় গুলির শব্দে ৷ কাজীর পরনের একমাত্র বস্ত্র লুঙ্গিটা ধস্তাধস্তিতে যায় খুলে ৷ ক্যাপ্টেন আর কাজী দুজনেই খাটে পড়ে গেলে খাট ভেঙে পড়ে যায় মেঝেতে ৷ ক্যাপ্টেন আহত হয়ে মেঝেতে গড়ায় ৷ স্টিলের আলমারির সামনের সৈন্যটা গুলিবিদ্ধ হয় আর পড়ে যায় ৷ ওপাশে মেজর সরফরাজ ফায়ার ওপেন করলে জায়েদ আর টগর গুলিবিদ্ধ হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে ৷ কাজী জানে এখানে ধরা পড়ার মানে হলো মৃত্যু ৷ সে সোজা খোলা দরজা দিয়ে বাইরে আসে ৷ সম্পূর্ণ উলঙ্গ কাজী গেট দিয়ে বাইরে যায় ৷ বাইরে বাউন্ডারি দেয়ালের কাছে দুপাশে দুজন সৈন্য দাঁড়িয়ে ৷ চাঁদের আলোয় এক নগ্ন লম্বা ফরসা যুবককে দেখে তারা মুহূর্তের জন্য বিভ্রান্ত হয় হয়তো ৷ নইলে কেন তারা তাকে চার্জ করেনি, ১৪ বছর পরও কাজী সেটা অনুমান করতে পারে না ৷ কাজী একদৌড়ে বেরিয়ে রেললাইন ধরে সোজা দিলু রোডে চলে যায় ৷
রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে ৷ জায়েদ আর টগর বুঝি মারাই গেছে ৷ তিনজন মিলিটারিও রক্তাক্ত ৷ আরো মিলিটারি প্রবেশ করে ঘরে ৷ তারা আজাদ, জুয়েল, বাশার, মনোয়ার, সেকেন্দার আর চঞ্চলকে ধরে নিয়ে প্রচণ্ড মার দিতে দিতে গাড়ির দিকে চলে যায় ৷ আজাদের মুখ দিয়ে রক্ত ঝরতে তাকে, বাশারের হাত ভেঙে যায়, জুয়েলেরও নাকমুখ দিয়ে রক্ত ঝরে ৷
আজাদের মা দেখেন তাঁর চোখের সামনে থেকে তাঁর ছেলে চলে যাচ্ছে ৷ তিনি কেঁদে ফেলেন ৷ আর্তনাদের সুরে বলেন, ‘আজাদ, তুই চলে গেলে আমি কাকে নিয়ে থাকব ৷’
আজাদ বলে, ‘আল্লাহ আল্লাহ করো মা ৷’ আরেক দফা মার তার ঘাড়ে এসে পড়লে সে সেটা সহ্য করে শেষবারের মতো তার মায়ের দিকে তাকায় ৷
চঞ্চল তখন খুবই ছোট ৷ নিতান্তই বালক ৷ তাকে কেন আর্মি ধরে নিয়ে গাড়িতে তুলছে ৷ সে তো যুদ্ধ করেনি ৷ কোনো পক্ষ-বিপক্ষ বোঝেও না ৷ সৈন্যরা তার পেটে ঘুসি মারছে আর বলছে, ‘বাতাও, হাতিয়ার কিধার হ্যায়’, সে চিৎকার করে বলছে, ‘হাম বেকসুর হ্যায়, হাম বেগুনা (নিষ্পাপ) হ্যায় ৷’ আজাদের মা দৌড়ে যান গাড়ির কাছে, ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে আসেন চঞ্চলকে ৷
গুলিবিদ্ধ, আহত অথবা নিহত তিন পাকিস্তানি সৈন্যকে ওরা একটা গাড়িতে তোলে ৷ বন্দি সবাইকে গাড়িতে তুলে নিয়ে পাকসেনারা বিদায় হলে হঠাৎ করেই পুরো পাড়া নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে ৷
টগরের আজও মনে পড়ে, ঘটনার ১৪ বছর পরও, যখন গুলি এসে লাগল তার পেটে, তার মনে হচ্ছিল, যেন লক্ষ লক্ষ ব্লেড ঢুকে যাচ্ছে পেটের ভেতরে, এত যন্ত্রণা, আর মনে হচ্ছে, তার বুকের ভেতরটা মরুভূমি হয়ে গেছে, তার পানি চাই, এত তৃষ্ণা যেন কলসের পরে কলস পানি খেলেও তার পিপাসা মিটবে না, সে চিৎকার করছে, ‘আম্মা পানি, আম্মা পানি…’ তখন লক্ষ লক্ষ পাখি ছেয়ে ফেলে তার আকাশটা, তারা একযোগে মুখর হয়ে ওঠে পানি পানি বলে, আর আজাদের মা এসে ঢোকেন ঘরে ৷
তিনি আজাদের ঘরের মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখেন শুধু রক্ত আর রক্ত ৷ যেন রক্তের পুকুরে ভেসে আছে জায়েদ আর টগর ৷ তারই মধ্যে রক্তের মধ্যে বসে আপন মনে খেলছে মনোয়ার হোসেন ও দুলুর ছোট্ট মেয়ে লীনা, যে কিনা কেবল হামাগুড়ি দিতে শিখেছে ৷ কে কার দিকে খেয়াল করে, এ এমন এক দুর্যোগময় মুহূর্ত ৷ আজাদের মা দৌড়ে জগ নিয়ে আসেন ৷ পানি ঢালেন টগরের মুখে ৷ টগর পানি খেয়ে বলে, ‘পানি, আম্মা পানি…’ আর পাখিরা ডেকে ওঠে আম্মা পানি, আম্মা পানি, বলে…
জায়েদ বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে কে জানে! টগরের লক্ষণও তো সুবিধার মনে হচ্ছে না, এও বুঝি মারা যাবে ৷ আজাদের মা ধপাস করে পড়ে যান, জ্ঞান হারান ৷ তাঁর ভাগি্নরা তাঁর মাথায় পানি ঢেলে তাঁকে সুস্থ করে তুললে তিনি উঠে কর্তব্য স্থির করেন ৷
টগর আর জায়েদকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে ৷ তিনি পাশের বাসায় গিয়ে হাজির হন, যেখানে টেলিফোন আছে ৷ পাশের বাসায় থাকতেন একজন মাড়োয়ারি মহিলা ৷ মা মাড়োয়ারির বাসার দরজায় ধাক্কা দেন ৷ কিন্তু মহিলা দরজা খোলে না ৷ মা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখেন মহিলা কোরআন শরিফ নিয়ে বসেছে ৷ তিনি আরেকবার ধাক্কা দেন ৷ মহিলা কোরান শরিফ থেকে মুখ তোলে না ৷ মা জানালার ধারে দাঁড়িয়েই থাকেন ৷ মহিলা কোরআন শরিফ পড়েই চলেন ৷ মহূর্ত মুহূর্ত করে ঘন্টা চলে যায় ৷ মহিলা কোরআন শরিফ থেকে চোখ সরায় না ৷ আজাদের মাও জানালা থেকে সরেন না ৷ ফজরের আজানের ধ্বনি শোনা যায় ৷ মহিলা মুখ তোলে ৷ আজাদের মা বলেন, ‘বুবু দরজা খোলেন ৷ একটা ফোন করব ৷’
তখন একা বাসায় তিনটা মেয়ে, তার মধ্যে কচি ভাবে, তার স্বপ্নের রাজপুত্ররা ঘরে ঢুকে এ কোন রক্তের খেলা খেলে গেল ৷ তাহলে ওরা কি রাজপুত্র ছিল না, ছিল রাজপুত্রের ছদ্মবেশে দুষ্ট রাক্ষস!
৪৩. মা
হাফিজুল আলম, আলমের বাবা, বলেন, ‘কাজী, তুমি পালাও ৷ এখন আর অস্ত্র নেওয়ার দরকার নাই ৷ আর আমরা দেখি নিজেরা কী করতে পারি ৷’ কাজীকে ওরা ধাক্কা দিয়ে পেছনের দেয়াল পার করিয়ে দেন ৷ হাফিজুল আলমকেও তাঁর মেয়েরা পাশের বাড়ির দেয়ালের ওপারে ঠেলে পাঠায় ৷ কাজী ইস্কাটনের রাস্তায় আসতেই দেখে দুটো ট্রাক আর একটা জিপ দিলু রোডে আলমের বাড়ির দিকেই যাচ্ছে ৷ কাজী পাশের ড্রেনের মধ্যে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে ৷ জায়গাটা অন্ধকার ৷ তাকে হয়তো দেখা যাবে না ৷ কনভয় পাশ দিয়ে পার হয়ে যায় ৷ গাড়ির শব্দের চেয়ে কাজীর বুকের শব্দ যেন আরো জোরে জোরে বাজে ৷ সেখান থেকে সে যায় সৈয়দ আশরাফুল হকের বাড়িতে ৷ দরজায় নক করে ৷ আশরাফুলের ঘুম ভেঙে যায় ৷ সে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলে, ‘কে ?’
‘বাবু, শেষ শেষ, সব শেষ…’ কাজী কামালের গলা ৷ আশরাফুল দেখতে পায় গেটের লাইটের আলোয় খালিগা, পেটিকোট পরা কাজীকে ৷
সে দরজা খোলে ৷ ‘কী হইছে ?’
‘আজাদগো বাড়ি রেইড দিছে ৷ আলমগো বাড়িও ঘেরাও দেওয়া শেষ ৷ সব শেষ ৷ সব শেষ…’ কাজী কাঁপছে ৷
আশরাফুল তাকে নিয়ে লুকিয়ে রাখে গ্যারাজের ওপরে ড্রাইভারদের থাকবার জায়গায়, বলে, ‘এইখানে বইসা থাকো ৷ খাড়াও, তোমারে শার্ট-প্যান্ট আইনা দেই ৷’
পরে সেই জায়গাটাও নিরাপদ মনে না হওয়ায় কাজী বেরিয়ে পড়ে-এখন যেখানে সোহাগ কমিউনিটি সেন্টার সেখানে-আশরাফুলের বড় ভাইয়ের বাসার উদ্দেশে ৷ তখন ভোর ৫টা ৷ আশরাফুল তার এই চলে যাওয়ার দৃশ্যটা আর কোনো দিন ভুলতে পারবে না ৷ আশরাফুলের দেওয়া শার্ট-প্যান্ট পরে কাজী কামাল দরজা খুলে বেরিয়ে যায়, পেছনে তাকিয়ে হ্যা-হ্যা করে হাসে আর হাত নাড়ে, ‘টাটা টাটা, যাইগা…টাটা…’
সৈন্যরা আলমদের বাসায় ঢুকে প্রথমেই জানতে চায় রান্নাঘর কোথায়, রান্নাঘরের মেঝের নিচে গোপন কুঠুরিতে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ লুকানো ছিল ৷ শাবল দিয়ে মেঝে ভেঙে তারা এইসব অস্ত্র উদ্ধার করে ৷ আর বাসায় বেড়াতে আসা আলমের চাচা আর চাচাতো ভাইকে ধরে নিয়ে যায় ৷
২৯শে আগস্টের সকাল ১১টার দিকে বদি ধরা পড়ে ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপ্যাল জালাল উদ্দিনের বাসা থেকে ৷ প্রিন্সিপ্যালের ছেলে ফরিদ ছিল বদির বন্ধু ৷ প্রচণ্ড মারের মুখে বদি বলে দেয় সামাদ ভাই আর চুল্লু ভাইয়ের নাম ৷ বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ধরা পড়েন সামাদ ভাই ৷ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অমানুষিক নির্যাতন আর জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়েন সামাদ ভাই, আলতাফ মাহমুদের বাসা চিনিয়ে দিতে সৈন্যরা তাকেই বাধ্য করে সহ্যাতীত নির্যাতনের মুখে ৷
৩০শে আগস্টের ভোর ৷ রাজারবাগের বাসায় শিমুল বিল্লাহর মা তখনও ফজরের নামাজ শেষে জায়নামাজে বসে তসবিহ গুনছেন ৷ শিমুল বিল্লাহ, তখন কিশোরী, সকালের রেওয়াজ করছে ৷ শিমুল দেখতে পায়, তাদের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা ৷ সে দৌড়ে তার মায়ের কাছে যায়, মা মোনাজাত করছেন ৷ পাকসেনারা নেটের দরজা ভেঙে ফেলে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে ৷ তাদের একজন শিমুলের বুক বরাবর অস্ত্র উঁচিয়ে ধরলে শিমুল তারস্বরে চিৎকার করে ওঠে, আর বাড়ির চারদিকে এক দল কাক কা কা রবে ডেকে উঠে পাখার ঝাপ্টায় আকাশ মাতায় ৷ সৈন্যরা ধাতবস্বরে বলে ওঠে, ‘মিউজিক ডিরেক্টর সাব কৌন হ্যায় ? কিধার হ্যায় ?’ তখন, চাল ধোয়া পানির মতো ভোরের পবিত্র আলো সত্তায় মেখে দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসেন আলতাফ মাহমুদ : ‘আমি ৷’
‘হয়্যার আর দি আর্মস অ্যান্ড এমুনিশেনস ? হাতিয়ার কিধার হ্যায় ?’
আলতাফ মাহমুদ বুঝতে পারেন, তারা সবকিছু জেনেই এসেছে ৷ তিনি বুঝতে পারেন, এ বাড়ির আর সবাইকে বাঁচাতে হলে সবকিছুর দায়দায়িত্ব তাঁকেই নিতে হবে, যা কিছু তিনি একজীবনে আর একাত্তরের মার্চের পরে করেছেন ৷ তিনি সুর দিয়েছেন আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গানে, যুক্ত ছিলেন বাম রাজনীতির সঙ্গে, তিনি ২৫ মার্চের রাতে প্রত্যক্ষ করেছেন কীভাবে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা পুলিশ ব্যারাকে হামলা চালিয়েছে, আগুন লাগিয়েছে, বাঙালি পুলিশ কীভাবে পাক-আক্রমণ প্রতিরোধ করতে চেয়েছে শুধু রাইফেল দিয়ে, বাঙালি পুলিশেরা পজিশন নিয়েছিল তাদের আর পড়শিদের বাসার ছাদেও, ভোরে টিকতে না পেরে চলে গেছে অস্ত্র আর ইউনফির্ম ফেলে, সেই অস্ত্র আলতাফ মাহমুদ তুলে দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ৷ শাহাদত চৌধুরী মেলাঘর থেকে জুলাইয়ে এসেছে তাঁর কাছে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য গান রেকর্ড করে তার টেপ নিয়ে যাওয়ার জন্যে, তাঁর কাছে এসেছে মুক্তিযোদ্ধা গাজী দস্তগীর, ঢাকায় মেলাঘর থেকে খালেদ মোশাররফ আর হায়দার যে ১৭ জনকে পাঠিয়েছিলেন হাবিবুল আলমের নেতৃত্বে , তাদেরই একজন এই দস্তগীর ৷ সামাদ ভাই অনেকবার এসেছে তাঁর কাছে ৷ শাচৌ পূর্বপরিচিত আলতাফ মাহমুদের, যুদ্ধের মধ্যে একদিন রাস্তা থেকে আলতাফ মাহমুদ ধরে আনেন শাচৌ আর আলমকে ৷ তিনি নিজেই যুক্ত হয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ৷ তাঁর বাড়ি হয়ে ওঠে ঢাকার যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটা দুর্গ ৷ ফতেহ আর বাকেরও এসেছে ৷ অস্ত্র রাখতে হবে, এ প্রস্তাব শুনে আলতাফ মাহমুদ নিজে গাড়ি চালিয়ে গাড়ির বুটে করে নিয়ে এসেছেন দু ট্রাঙ্ক অস্ত্র, সেগুলো পুঁতে রাখা হয়েছে তাঁদের পড়শির বাসার পেছনের লেবুগাছটার নিচে আঙিনায়, মুক্তিযোদ্ধাদের দেখলেই তিনি খুশি হতেন, বলতেন, ‘আমার যা সাহায্য লাগবে তোমরা আমাকে বলবে, আমি অবশ্যই করব ৷’
তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের বলেন, ‘তোমরা কেন এসেছ, আমি বুঝতে পারছি ৷ আমি ছাড়া আর কেউ জানে না ৷ এসো ৷ এই গাছের নিচে আছে দুটো ট্রাঙ্ক ৷’
সৈন্যরা তাঁর হাতেই তুলে দেয় কোদাল, একা আলতাফ মাহমুদ খুঁড়তে থাকেন মাটি, কিন্তু তিনি ক্লান্তি বা অনিচ্ছা বোধ করছিলেন, একজন সৈন্য রাইফেলের বাঁট দিয়ে তার মুখে আঘাত করে, তার একটা দাঁত ভেঙে মাটিতে পড়ে যায়, তিনি আবার খুঁড়ে চলেন উঠোন, একজন পাকিস্তানি সৈন্য বেয়নেট চার্জ করলে আলতাফ মাহমুদের কপালের চামড়া কেটে গিয়ে তার চোখের ওপরে ঝুলতে থাকে ৷
দুই ট্রাঙ্ক অস্ত্র উদ্ধার করে আলতাফ মাহমুদ, তাঁর শ্যালক নুহেল, খনু, লিনু, দিনু বিল্লাহ আর আগের রাতে বেড়াতে এসে কারফিউয়ের ফাঁদে আটকে পড়া মুক্তিযোদ্ধা-শিল্পী আবুল বারক আলভীকে, আর যন্ত্রশিল্পী হাফিজকে, আরো দুজন পড়শিকে ধরে নিয়ে গাড়িতে তোলে মিলিটারিরা, তখন প্রতিবাদে ভীষণ কান্না জুড়ে দেয় আলতাফ মাহমুদের চার বছরের কন্যা শাওন ৷ বাড়ির চারপাশের গাছাছালির ডাল থেকে কাকগুলো আকাশে চক্কর দিতে থাকে আর কা কা রবে পুনর্বার ডেকে ওঠে তারস্বরে ৷
একই রাতে, ২১টা বাসায় হানা দেয় পাকিস্তানি মিলিটারি ৷ বদি আর সামাদ ভাইয়ের গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে ২৯শে আগস্ট বিকালেই মুক্তিযোদ্ধা উলফত চক্কর মেরে ঘুরতে থাকে বিভিন্ন হাইড আউটে, সে বেবিট্যাক্সিতে চড়ে যায় শাহাদত চৌধুরীদের ৩০ হাটখোলার বাসায়, শাচৌ বাড়ি নাই, গতকালই চলে গেছেন মেলাঘর, তাঁর ভাই মুক্তিযোদ্ধা ফতেহকে উলফত পেয়ে যায় গেটের কাছেই, দ্রুত তাকে জানিয়ে দেয় দুঃসংবাদ, রেইড আসন্ন ৷ এই বাড়িটা মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অন্যতম আশ্রয়স্থল, একটা দুর্গ, শাচৌ ফতেহর তিন বোন মারিয়াম, ঝিমলি আর ডানা আর তাঁদের বাবা-মা অস্ত্রশস্ত্র রাখা, মুক্তিযোদ্ধাদের দেখভাল করার কাজটা এমনভাবে করতেন যে তাঁরা নিজেরাই হয়ে উঠেছিলেন একেকজন নীরব মুক্তিযোদ্ধা ৷ উলফতের কাছে খবর পেয়ে তার আনা বেবিট্যাক্সিতে চড়েই ফতেহ আর তিন বোন চলে যায় তাদের আরেক বোনের বাসায় ৷ শাহাদত আর ফতেহ চৌধুরীর বাবা অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ আব্দুল হক চৌধুরীর অভ্যাস ছিল রাত ১২টা পর্যন্ত কোরআন শরিফ পাঠ, সেদিন তিনি আর জায়নামাজ থেকে ওঠেন না ৷ পাকিস্তানি আর্মি তাঁর বাসায় হানা দেয় রাত ২টায় ৷ তারা তাঁর কাছে তাঁর পরিচয় জানতে চায় ৷ চৌধুরী সাহেব জানান, তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ ৷ তখন আর্মি অফিসার তাঁকে স্যালুট করে ৷ জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার ছেলেরা কোথায় ?’
তিনি বলেন, ‘জানি না ৷’
‘তারা কি ভারতে গেছে ?’
‘যেতেও পারে ৷’
‘যুদ্ধে গেছে ?’
‘আমার জানামতে গ্রামে গেছে থাকতে ৷ তবে যুদ্ধে গেলে যেতেও পারে ৷ আমি তাদের সিকিউরিটি দিতে পারব না, তাই তাদের আটকে রাখতেও পারি না ৷’
অফিসারটি বিস্মিত হয়ে চৌধুরী সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকেন, তারপর বলেন, ‘আপনার কথা আমি আমার ওপরের অফিসারকে জানাব ৷’
আর রাত ২টায় বাসা ঘেরাও করে কাউকে না পেয়ে বাড়ির জামাতা করাচি থেকে বেড়াতে আসা বেলায়েত হোসেন চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যায় পাকবাহিনী ৷
ধানমন্ডি ২৮-এর আশ্রয়স্থলটাও তল্লাশির আওতায় পড়ে, কাউকে না পেয়ে মালি জামানকে প্রচণ্ড মারধর করে আর্মিরা ৷ রাত ২টায় হানা দেয় চুল্লু ভাইয়ের ভাই এএসএইচকে সাদেকের বাসায়, ধরে নিয়ে যায় চুল্লু ভাইকে, কিন্তু ওয়ারড্রবের ভেতরে কাপড়ের আড়ালে রাখা অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করতে পারে না ৷ ফতেহ আলী চৌধুরী বোনদের বড় বোনের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চলে যায় এলিফ্যান্ট রোডে জাহানারা ইমামের বাসার খোঁজে, কিন্তু সে বাসাটা চিনত না বলে খুঁজে না পেয়ে ফিরে যায়, আর রাত ২টায় চারদিক থেকে কণিকা নামের বাসাটা ঘিরে ফেলে আর্মিরা, ধরে নিয়ে যায় রুমী, জামী, তাদের বাবা শরীফ ইমাম, কাজিন মাসুম, বন্ধু হাফিজকে ৷ স্বপনের বাড়ি ঘেরাও হওয়ার সময় টের পেয়ে স্বপন বাড়ির পেছনের গোয়ালে ঢুকে পড়ে গরুর পেছনে আশ্রয় নিলে কোনোমতে বেঁচে যায় ৷ মেলাঘরের আরেক গেরিলা উলফতকে না পেয়ে তার বাড়ি থেকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায় তার বাবা আজিজুস সামাদকে ৷
এইসব খবর নিয়ে ফতেহ, তার ভাই ডাক্তারির ছাত্র মোরশেদ আর তার ইডেন কলেজের অধ্যাপিকা সহমুক্তিযোদ্ধা জাকিয়া চলে যায় সীমান্ত পেরিয়ে মেলাঘরে ৷
সেখানে আলম আর শাচৌ ইতিমধ্যে পদোন্নতি পাওয়া লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফ আর মেজর হায়দারকে শোনাচ্ছে ঢাকায় সেক্টর টু-র গেরিলা ওয়ারফেয়ারের সাফল্যের একেকটা অভিযানকাহিনী, তাঁদের দুজনই দারুণ খুশি এই সাফল্যে, এবং তাঁরা রাজি ঢাকার গেরিলাদের হাতে আরো ভারী অস্ত্র আর গোলাবারুদ দিতে, তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে শহীদুল্লাহ খান বাদল, পরিকল্পনা হচ্ছে আর কী কী করা যায় ঢাকায় ৷
একটা সিগারেট ধরাবেন বলে শাচৌ বেরিয়ে আসেন তাঁবু থেকে, তার মাথায় চিন্তা, ৬ই সেপ্টেম্বরের আগেই ঢাকায় পৌঁছতে হবে ৷ সিগারেট ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছাড়তেই তিনি ধোঁয়ার কুন্ডলীর ভেতর দিয়ে সামনে দেখতে পান, পাহাড় থেকে নেমে আসছে ফতেহ ৷ আরে, ফতেহ এখানে কেন ? ওর তো ঢাকার অ্যাকশনে থাকার কথা ৷
ফতেহ বলে, ‘সব শেষ হয়ে গেছে ৷’
এই বিয়োগান্ত খবর শুনে খালেদ মোশাররফ আর হায়দার থমকে থাকেন, তারপর খালেদ মোশাররফের চাউনির বাইরে চলে যান হায়দার, ঢুকে পড়েন নিজের তাঁবুতে, দাঁড়িয়ে থাকে বিপন্ন বাদল, আর যে-মেজর হায়দারকে কেউ কোনো দিনও এক ফোঁটা জল ফেলতে দেখেনি, সেই শক্ত যোদ্ধাটি সোজা বিছানায় চলে যান, বালিশ চাপা দেন মুখে, তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন : মাই বয়েজ, মাই বয়েজ…,
পুরো মেলাঘরে নেমে আসে শোকের ছায়া ৷
৪৪. মা
‘তাই চলো ৷’
টগর আর জায়েদকে হলি ফ্যামিলিতে ভর্তি করানো হয় ৷ তারা অজ্ঞান অবস্থায় শুয়ে থাকে হাসপাতালের বিছানায় ৷ আজাদের মায়ের দিনগুলো যে তখন কী করে কাটছে! দুটো ভাগ্নে, তারা তার ছেলের মতোই, হাসপাতালে, বাঁচে কি মরে ঠিক নাই ৷ তাদের জন্য ওষুধপাতি, রক্ত জোগাড় করা, হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করা-এসব তাঁকে করতে হচ্ছে ৷ ওদিকে তাঁর নিজের ছেলে ধরা পড়েছে আর্মিদের হাতে ৷ একই সঙ্গে ধরা পড়েছে ভাগি্নজামাই, আর তাঁর ছেলের তিনজন বন্ধু ৷ একা একটা মানুষ তিনি কী করবেন, কোথায় যাবেন ৷ এক ফাঁকে প্রথম সুযোগে তিনি তাঁর বাসায় গোপন জায়গায় লুকিয়ে রাখা অস্ত্রশস্ত্রগুলো সরিয়ে ফেলেন হাঁড়ির মধ্যে ভরে, ভাগ্নে টিসুর মাথায় চাপিয়ে দিয়ে ৷ আর তখনই মেডিক্যাল ছাত্র সাজ্জাদুল আলম কুটু স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে আসে জুয়েলের হাতের ক্ষত ড্রেসিং করে দেবে বলে, সাফিয়া বেগম মুহূর্তে কর্তব্য স্থির করেন ৷ চারদিকে গোয়েন্দা আর পাকিস্তানিদের চর গিজগিজ করছে ৷ এই নির্দোষ ছেলেটা না আবার ধরা পড়ে ৷ তিনি তাকে ডেকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যান, আর বলেন, ‘বাবা, আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না বলেই তোমাকে খবর দিয়ে আনিয়েছি, আমার ব্লাড প্রেসারটা মেপে দ্যাখো তো…’ গোয়েন্দারা তাকিয়ে দেখে কুটু সাফিয়া বেগমের ব্লাড প্রেসার মাপছে, আর হাতে ব্লাড প্রেসার মাপক যন্ত্রের কাপড় পেঁচানো অবস্থায় আজাদের মা বিড়বিড় করে বলে চলেন, ‘বাবা, তুমি তাড়াতাড়ি সটকে পড়ো, জানো না, রাতে ওদের সবাইকে ধরে নিয়ে গেছে আর্মিরা…’
৪৫. মা
এখন রাত কত হবে, আজাদ জানে না ৷ সময়ের হিসাব এখন তাদের কাছে গৌণ হয়ে গেছে ৷ তাকে একটা ঘরে আলাদা করে নেওয়া হয়েছে ৷ ধরা পড়ার পর থেকেই তার ওপরে মারটা বেশি পড়ছে ৷ তাদের বাড়িতে পাকিস্তান আর্মির যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তারই রেশ ধরে তার ওপর দিয়েই ঝড়টা যাচ্ছে বেশি ৷ পিটিয়ে তার মুখ ক্ষতবিক্ষত করে ফেলা হয়েছে ৷ সমস্ত শরীরে ব্যথা ৷ ওই ঘরে যখন সবাই মিলে এক জায়গায় ছিল, তখন থেকেই শুরু হয়েছে মারধর ৷ বুকে পেটে মুখে লাথি ৷ ঘুসি ৷ বেত, চাবুক, লাঠি দিয়ে বেধড়ক পিটুনি ৷ বিশেষ করে গিঁটে গিঁটে, কনুইয়ে, হাঁটুতে, কব্জিতে মার ৷ চারদিকে বাঙালির আর্তনাদ, চিৎকার ৷ গোঙানি ৷
এরপর আজাদকে একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হয় ৷ এঘরে একজন বসে আছে ৷ অফিসার ৷ নেমপ্লেটে লেখা নাম : ক্যাপ্টেন হেজাজি ৷
‘তুম আজাদ হ্যায় ৷’
আজাদ বলে, ‘নেহি, হাম মাগফার হ্যায় ৷’
সঙ্গে সঙ্গে হান্টারের বাড়ি এসে পড়ে গায়ে, পিঠে, ঘাড়ে, মাথায় ৷
‘ফের ঝুট বলতা হ্যায়!’
এরপর একজনকে আনা হয় ৷ তার মুখ কাপড়ে ঢাকা ৷ তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘এ আজাদ ?’
মুখ-ঢাকা মাথা নেড়ে বোঝায়, হ্যাঁ ৷ এ-ই আজাদ ৷
আবার শুরু হয় জেরা ৷
‘তুমি ইন্ডিয়া কবে গেছ ?’
‘যাই নাই ৷’
‘কোন জায়গায় ট্রেনিং নিয়েছ ?’
‘নেই নাই ৷’
আবার মার ৷ মারতে মারতে মেঝেতে ফেলে দেওয়া হয় আজাদকে ৷ তারপর জেরাকারী বুটসহ উঠে পড়ে তার গায়ে পায়ে মাথায়! প্রথম প্রথম এই মার অসহ্য লাগে ৷ তারপর একটা সময় আর কোনো বোধশক্তি থাকে না ৷ ব্যথাও লাগে না ৷ আজাদ পড়েই থাকে মেঝেতে ৷ খানিকক্ষণ বিরতি দেয় জওয়ানটা ৷
আজাদের চোখ বন্ধ ৷ সে প্রায় সংজ্ঞাহীন ৷ পানি এনে ছিটানো হয় তার চোখেমুখে ৷ আবার চোখ মেলতেই আজাদকে বসানো হয় মেঝেতে ৷
‘কোন কোন অপারেশনে গিয়েছিলে ?’
‘যাই নাই ৷’
‘আর কে কে মুক্তিযোদ্ধা আছে তোমার সাথে ?’
‘জানি না ৷’
আবার মার ৷ প্রচণ্ড ৷ কিন্তু আশ্চর্য, কিছুই টের পাচ্ছে না আজাদ ৷
‘শোনো ৷ সব স্বীকার করো ৷ বন্ধুদের নাম বলে দাও ৷ অস্ত্র কোথায় লুকিয়ে রেখেছ, বলে দাও ৷ তাহলে কথা দিচ্ছি, তোমাকে ছেড়ে দেব ৷’
‘আমি কিছু জানি না ৷ আমি নির্দোষ ৷’
‘জানো না ? তোমার বন্ধুরাই তোমার কথা বলেছে ৷ তোমার বাসা দেখিয়ে দিয়েছে ৷ তোমাকে চিনিয়ে দিয়েছে ৷ যে সব স্বীকার করছে, তাকে আমরা ছেড়ে দেব ৷ তাহলে তুমি কেন বোকার মতো মরবে ৷ স্বীকার করো ৷’
‘আমি কিছু জানি না ৷ তোমরা ভুল করছ!’
আবার প্রচণ্ড জোরে মার ৷ দড়ির মতো করে পাকানো তার দিয়ে ৷ হাত চলে যায় অজান্তেই, পিঠে ৷ হাতের আঙুলে গিয়ে পড়ে চাবুক ৷ আঙুল থেঁতলে যায় ৷ নখগুলো মনে হয় খুলে খুলে পড়বে ৷
আজাদ ‘ওরে বাবা রে ওরে মা রে’ বলে কেঁদে ওঠে ৷ তখন তার নিজেরই বিস্ময় লাগে ৷ যে বাবাকে সে দুই চোখে দেখতে পারে না, যে বাবাকে সে স্বেচ্ছায় ছেড়ে এসেছে, যার ওপরে তার অনেক রাগ, তাকে কেন তার মহান মায়ের সঙ্গে এক করে ডাকল ৷
তার ওপর দিয়ে মারের ঝড় বয়ে যাচ্ছে ৷ যাক ৷ আজাদ এসব কথা মনে করবে না ৷ সে অন্য কিছু ভাববে ৷ সে তার মাকে ভাববে ৷ তার মায়ের মুখ মনে করবে ৷ তার মা দেখতে খুব সুন্দর ৷ তার সব সময়ই মায়ের মুখটা মিষ্টি লেগেছে ৷ তার মায়ের মুখে সব সময় হাসি লেগেই থাকে ৷ এটাই সে সুখে-দুখে দেখে এসেছে ৷ সে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে ৷ সে শুধু তার মায়ের মুখটা মানসচোখে ফুটিয়ে তুলতে চায় ৷ এই তো তার মা ৷ সেই ঠোঁট, সেই মুখ ৷ সেই পান-খাওয়া লাল ঠোঁট ৷ মা তার মিটিমিটি হাসছে ৷ সেদিন কেন সে জানে না, হঠাৎ করেই দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে বলেছে, ‘মা, তুমি কিন্তু আমাকে কোনো দিনও মারো নাই, আশ্চর্য, না! এমন মা বাংলাদেশে আছে, যে মা তার সন্তানকে কোনো দিনও মারে নাই! আমার মা আছেন ৷ তিনি তাঁর সন্তানকে কোনো দিনও মারেন নাই ৷ কিন্তু বিনিময়ে মাকে সে কী দিয়েছে! শুধুই অবাধ্যতা! মাকে জড়িয়ে ধরে সে কোনো দিনও বলেনি, মা, আমি তোমাকে ভালোবাসি ৷ অনেক ছেলের সঙ্গেই মায়ের এ রকম সম্পর্ক আছে ৷ তার মায়ের সঙ্গে তার নাই ৷ কিন্তু মা কি তার বোঝে না, এই জগতে মা ছাড়া তার আর কেউ নাই ৷ সে তো ইচ্ছা করলে বাবার কাছে চলে যেতে পারত ৷ তার ছোটমা তাকে নানাভাবে আদর করতে চেয়েছেন ৷ কিন্তু সে তো সেই আদর, সেই প্রাচুর্য ভোগ করবে বলে মাকে ফেলে চলে যায়নি ৷ বা, ফেলেই বা চলে যেতে হবে কেন, সে তো মাকেও বলতে পারত, মা পাগলামো করে না, কতজনই তো দ্বিতীয় বিয়ে করে, তাদের সবার প্রথম স্ত্রী কি সংসার ছেড়ে চলে গেছে! করাচিতে তার হোস্টেলের তিন রুমমেটের বাবাই তো দ্বিতীয়বার সৎকার্য করেছিল, সে চিঠি লিখে সেটা জানিয়েওছিল ৷ সে তো বলতে পারত, চলো মা, বাবার সঙ্গে একটা আপসরফা করে নিই ৷ কোনো দিন বলেনি তো! বলবার কথাও ভাবেনি ৷ বাবার সঙ্গে তার তো কোনো গোলযোগ হয়নি ৷ বাবা তাকে আদরই করতেন ৷ কিন্তু সে বাবাকে ছেড়েছে শুধু তার মায়ের অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে ৷ বাবাকে ছাড়া মানে তো শুধু বাবাকে ছাড়া নয়, আরাম-আয়েশ অর্থ-প্রতিপত্তি গাড়ি-বাড়ি, সম্পত্তির উত্তরাধিকারের মোহ-সব ছাড়া ৷ সে ছেড়েছে তো সব ৷ প্রথম প্রথম অসুবিধা হয়েছে ৷ কিন্তু মেনে কি সে নেয়নি ? ‘মা, এর মধ্য দিয়েই আমার বলা হয়ে গেছে যে আমি তোমাকে ভালোবাসি ৷ মা, তুমি কি তা বুঝেছ ৷ মা, যদি আমি আর ছাড়া না পাই, তাহলে তোমার আর কী থাকবে মা ? আমি জানি, তুমি শুধু আমাকেই মানুষ করতে চেয়েছ ৷ আর তার বিনিময়ে আমার কাছ থেকে কিছুই প্রত্যাশা তুমি করো না ৷ এটা তুমি চিঠিতেও লিখেছিলে ৷ কিন্তু আমি তো তোমার পাশে থাকতে চাই ৷ না, তোমার ভালোবাসার প্রতিদান দেওয়ার জন্যে নয়, তোমাকে খুব ভালোবাসি বলে ৷’
প্রথম রাতের নির্যাতনে আজাদের মুখ থেকে কোনো কথাই আদায় করা যায় না ৷
সময় কীভাবে, কোথা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে, আজাদ টের পায় না ৷ এক সময় দেখতে পায়-বদি, রুমী, চুল্লু ভাই, সামাদ ভাই, আলতাফ মাহমুদ, আবুল বারক আলভী, বাশার, জুয়েল, সেকেন্দার, মনোয়ার দুলাভাই, আলতাফ মাহমুদের শ্যালকেরা, রুমীর বাবা, ভাই, আরো অনেকের সঙ্গে সেও একই ঘরে ৷ তার কী রকম একটা অভয় অভয় লাগে ৷ একই সঙ্গে এতগুলো পরিচিত, অভিন্ন-লক্ষ্য মানুষ, সতীর্থ মানুষ ৷
আলতাফ মাহমুদ শিখিয়ে দেন তাঁর শ্যালকদের, আলভীকে, একই সঙ্গে ধরা পড়া তাঁর দুই পড়শিকে, ‘তোমরা বলবে তোমরা কিছু জানো না ৷ যা জানার আমিই জানি ৷’
রুমী শিখিয়ে দেয় তার বাবাকে, ভাইকে, বন্ধুকে, ‘তোমরা কিছু জানো না ৷ বলবে, ছেলে কোথায় কী করে বেড়ায় আমরা জানি না ৷ ব্যস ৷’
গাদাগাদি করে বসে আছে সবাই ৷ পানির পিপাসায় সবার অবস্থা খারাপ ৷ পানি পানি করে চিৎকার করে ওঠে একজন ৷ তখন সবার মনে পড়ে, সবাই বড় তৃষ্ণার্ত ৷ একজন সেন্ট্রি দরজার ওপারে ৷ কিন্তু তার কানে এই আবেদন পৌঁছুচ্ছে বলে মনে হয় না ৷ ঘরের ভেতরেই একটা পানির কল আছে ৷ কেউ দেখেনি ৷ একজনের চোখে পড়ে ৷ তখন সবাই এক এক করে উপুড় হয়ে আঁজলা ভরে পানি খায় ৷ প্রত্যেকের চেহারা বিধ্বস্ত ৷ আলতাফ মাহমুদের গেঞ্জিভরা রক্তের দাগ ৷ আবুল বারক আলভীর নখ মারের চোটে খুলে খুলে যাচ্ছে ৷ যারা আগে মার খেয়েছে, তাদের গা ফেটে বেরুনো রক্ত শুকিয়ে আরো বীভৎস দেখাচ্ছে ৷ বাশারের হাত ভাঙা ৷ বোঝাই যাচ্ছে যে ওটা ভেঙে গেছে মাঝ বরাবর ৷ বাশারের মুখে আঁজলা ভরে পানি দেয় আজাদ ৷
আজাদকে ধরা হয়েছে গতকাল রাত ১২টার পরে ৷ এখন সন্ধ্যা ৷ প্রায় ১৮ ঘন্টা হয়ে গেছে তাদেরকে কিছুই খেতে দেওয়া হয়নি ৷
জাহানারা ইমাম সারা দিন চেষ্টা করেছেন ফোনে, আর্মি এঙ্চেঞ্জে ৷ তিনি ক্যাপ্টেন কাইয়ুমকে চাইছেন ৷ কিন্তু ক্যাপ্টেন কাইয়ুমকে কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছে না ৷ এই ক্যাপ্টেন গত রাতে তাদের বাসায় রেইডের নেতৃত্বে ছিলেন ৷ আর এ বাসায় এসেছিল সুবেদার সফিন গুল ৷ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে জাহানারা ইমাম সুবেদার সফিন গুলকে পেয়ে যান ৷ এই সুবেদার বলে গিয়েছিল, ‘এক ঘন্টা পরে ইন্টারোগেশন শেষে সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হবে ৷’
জাহানারা বলেন, ‘কী এত ইন্টারোগেশন ৷ ওদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে না কেন ? ওরা কেমন আছে ? আমি কি ওদের কারো সাথে কথা বলতে পারি ?’
সফিন গুল জামীকে ডেকে দেন ৷
জামী সংক্ষেপে সারে ৷ ‘হ্যালো, ভালো আছি ৷ আমাদের ছেড়ে দেবে ৷’
‘তোরা খেয়েছিস কিছু ?’
‘না ৷’
‘দে তো, সুবেদার সাহেবকে ফোনটা দে ৷’
জাহানারা মিনতি করে আল্লার দোহাই পেড়ে সুবেদারকে অনুরোধ করেন ওদের কিছু খেতে দিতে৷
এই সুবেদার, নাকি অন্য কেউ, আবুল বারক আলভী বহুদিন তার কথা ভুলতে পারবে না যে, তাদের মেস থেকে হাতে বেলা রুটি আর চিনি এনে দিয়েছিল খেতে৷ তাকে আলভীর মনে হয়েছিল সাক্ষাৎ দেবদূত৷ তবে প্রত্যেকের মুখে প্রহারের ক্ষত থাকায় কেউই কিছু খেতে পারেনি৷
ওরা যখন এক ঘরে, কখনও খানসেনারা আসে, দলে দলে বা জোড়ায় জোড়ায়, ইচ্ছামতো পেটাতে থাকে ওদের, যেন ওরা খেলার সামগ্রী, বা ব্যাটিং প্রাকটিস করার বস্তা৷
রাত ১১টার পরে রুমীকে বাদ দিয়ে সবাইকে রমনা থানায় আনা হয়৷
রমনা থানায় দুটো সেল৷ দুটো লাইন করা হয়েছে৷
আবুল বারক আলভী, তখন সবে আর্ট কলেজ থেকে পাস করে বেরিয়েছে, তাকে দেখতে বালকের মতো দেখায়, মেলাঘর থেকে এসেছে, ভাবে, ‘আমাকে আলতাফ মাহমুদের ফ্যামিলির সঙ্গে দাঁড়াতে হবে৷’ সে নিজে থেকে গিয়ে আলতাফ মাহমুদের পরিবারের লাইনে ভিড়ে যায়৷ আর মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, তার নাম সে বলবে সৈয়দ আবুল বারক৷ আলতাফ মাহমুদের বাসায় এসেছে নিতান্তই আত্মীয় হিসাবে, বেড়াতে, সে তার শ্বশুরপক্ষের আত্মীয়৷
সৈন্যরা এক এক করে ডেকে ডেকে নাম এন্ট্রি করছে, আলভী তার নামের প্রথম অংশ বলে, বাকিটা আর বলে না৷ সবাইকে সেলে ঢোকানো সাঙ্গ করে সৈন্যরা চলে যায়৷ সঙ্গে সঙ্গে এতক্ষণ সেলে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকা আগে থেকে ঢোকানো আসামীরা জেগে ওঠে৷ তাদের কেউ হয়তো চোর, কেউবা পকেটমার৷ তারা জানে রোজ রাতে মুক্তিরা আসে, তারা দিনের বেলা তাদের আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে নোভালজিন ট্যাবলেট, আয়োডেঙ্ এসব নিয়ে রেখে দিয়েছে৷ তারা সবাই মুক্তিদের সেবায় লেগে যায়৷ আজাদের সারা গায়ে আয়োডেঙ্ লাগায় একজন৷ বলে, ‘ভাইজান, আমি পকেট মারার কেসে ধরা পড়ছি, অনেক মাইর খাইছি, হাটুরা মাইর, আপনাগো মতো মাইর খাই নাই৷’
বাশারের হাতে রুমাল বেঁধে দেয় একজন৷
নিজের গামছা খুলে পুরোটা মেঝে মুছে দেয় কেউ৷ তারা শিখিয়ে দেয় মার থেকে বাঁচার উপায়, বলে, ‘প্রথমে দু-এক ঘা মাইর খাওনের সাথে সাথে অজ্ঞান হওনের ভান কইরা পইড়া যাইবেন, চোখ উল্টায়া রাখবেন, দেখবেন তাইলে মাইর থামায়া চোখেমুখে পানি ছিটাইব৷’
ভাত আর তরকারি আসে কিছু৷ দু চামচ করে ভাত, একটু করে নিরামিষ তরকারি৷ বন্দিরা খায়৷ তারপর হাজতিরা পুলিশকে টাকা-পয়সা দিয়ে এদের জন্যে পান আর সিগারেট জোগাড় করে৷
অল্প ভাত৷ সবাই ভাগাভাগি করে খায়৷ আজাদ গিয়েছিল হাতমুখ ধুতে৷ এসে দেখে ভাত ফুরিয়ে গেছে৷ তার রেজেকে ভাত নাই! কী আর করা! সে পান মুখে দেয়৷ তার মা খুব পান পছন্দ করে৷ কী জানি, মা এখন কী করছে!
৪৬. মা
রক্ত জোগাড় করা দরকার৷ জায়েদ-টগরকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে রক্ত আর স্যালাইন দিয়ে৷ টাকা সংগ্রহ করতে হবে৷ হাতে কোনো নগদ টাকা নাই৷ এর মধ্যে আবার চেষ্টাচরিত করতে হবে আজাদ, মনোয়ার, বাশারকে ছাড়িয়ে আনার৷ তিনি কার কাছে যাবেন ? টাকা জোগাড়ের সহজ পথ সোনার গয়না বিক্রি করা৷ ওটা করা যাবে৷ রক্তও যে কার কাছে পাওয়া যাবে, খোদা জানেন৷ তিনি নিজেই দিতে পারেন, কিন্তু ডাক্তাররা তাঁর রক্ত নিতে চায় না৷ কেন যে নিতে চায় না কে জানে৷
ডাক্তাররা তাঁর কাছে একটা ফরম নিয়ে আসে-’জায়েদের পা কেটে ফেলতে হবে৷ আপনি গার্জিয়ান হিসাবে পারমিশন দেন৷ এখানে আপনার সাইন লাগবে৷ সাইন করেন৷’
পা কেটে ফেলতে হবে ? আজাদের মা চিন্তায় পড়েন৷ ছেলে তাঁর নয়৷ ছেলের মা বেঁচে থাকলে সে-ই সিদ্ধান্ত দিতে পারত৷ ছেলের বাবা তো থেকেও নাই৷ এখন এই সিদ্ধান্ত তিনি কীভাবে দেবেন৷ তখন তাঁর মনে পড়ে যায় জুরাইনের মাজার শরিফের বড় হুজুরের কথা৷ আজাদকে যুদ্ধে যেতে দেবেন কি দেবেন না, এই দোটানায় যখন তিনি ভুগছিলেন, তখন তিনি হুজুরের কাছে গিয়েছিলেন৷ হুজুর তাঁকে অনুমতি দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘আজাদকে যুদ্ধে পাঠাও৷’ এখন তার এই দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় হুজুরের কাছে বুদ্ধি নেওয়া যেতে পারে৷
আমি একটু বুদ্ধিপরামর্শ নিয়ে আসি৷
তিনি জুরাইনে চলে যান৷ বড় হুজুরের সঙ্গে দেখা করেন৷ হুজুরপাকের স্ত্রীর সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্ক৷ তাঁর সঙ্গেও দেখা করেন৷ তাঁদের খুলে বলেন তাঁর বিপদের কথা৷ ছেলেকে, ছেলের বন্ধুকে, ভাগি্নজামাইকে ধরে নিয়ে গেছে আর্মিরা৷ আর্মির গুলিতে দুই ভাগ্নে মরণাপন্ন৷ ছেলে কি তাঁর ফিরে আসবে না ? আর জায়েদের পা কাটার অনুমতি তিনি দেবেন কি দেবেন না!
হুজুর বলেন, ‘উসকো পাও মাত কাটো৷’
ব্যস৷ মা তাঁর সিদ্ধান্ত পেয়ে যান৷ ‘আর আমার ছেলে আজাদের কী হবে হুজুর!’
‘ও আপাস আয়েগা৷ আসবে৷ ফিরে আসবে৷ সহিসালামতেই ফিরে আসবে৷’
আজাদের মা কিছুটা আশ্বস্ত হন৷ হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ফিরে আসেন৷ ডাক্তারদের বলেন, ‘না, জায়েদের পা কাটতে পারবেন না৷ আমার অনুমতি নাই৷’ শুনে ডাক্তাররা বিরক্ত হয়৷ পায়ে গুলি লেগেছে৷ পা না কাটলে এ ছেলেকে তো বাঁচানোই যাবে না৷
জায়েদ এ কথা চিরদিনের মতো স্মরণ করে রাখবে যে, জুরাইনের হুজুরের জন্যে তার পা-টা আজও আছে৷ নইলে তো কবেই সেটা কেটে ফেলে দিতেন হলি ফ্যামিলির ডাক্তাররা৷
আজাদের মা বাসায় ফেরেন৷ ঘরের মধ্যে এখনও পড়ে আছে ভাঙা খাট৷ ইস্পাতের আলমারি এখনও গুলিতে ছঁ্যাদা হয়ে আছে৷ মেঝেতে রক্ত জমে কালো হয়ে গেছে, কে মুছবে আর এসব!
হঠাৎ করে কামরুজ্জামান আসে আজাদের মায়ের কাছে, তাকে জায়েদ সব সময়ই সন্দেহ করে এসেছে আর্মির ইনফরমার বলে, তার সঙ্গে আরেকজন ছেলে, সেই ছেলে বলে, ‘নানি, অস্ত্রগুলা দ্যান৷’
আজাদের মা বলেন, ‘তুমি কে ?’
‘আমি বদির মামা৷ আজাদের বন্ধু৷ আজাদদের সাথে ছিলাম৷’
আজাদের মায়ের মাথায় মুহূর্তে এ প্রশ্ন উদিত হয় যে, আজাদের কোনো বন্ধু তো তাকে নানি বলে না৷ এ কে ? কেন এসেছে ? তিনি বলেন, ‘বাবা, এ বাসায় তো কোনো অস্ত্র নাই৷ তুমি ভুল শুনেছ!’ কামরুজ্জামান আগন্তুককে নিয়ে চলে যায়৷ আজাদের মা ভাবেন, ভাগ্যিস অস্ত্রগুলো তিনি আগেই সরিয়ে ফেলেছিলেন৷
মা সারাক্ষণ ব্যস্ততার মধ্যে থাকেন৷ এর মধ্যে যতটুকু সময় পান তিনি নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন, আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করেন।
৪৭. মা
আজাদের পালা আসে৷ একজন অফিসার নাম ধরে ডাকে৷ ‘আজাদ৷’ আজাদ ওঠে না৷ ‘আজাদ আলিয়াস মাগফার৷’ আজাদ ওঠে৷
আজাদকে একটা কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়৷ এখানে তিনজন অফিসার একসঙ্গে ঘিরে ধরে আজাদকে৷
‘আজাদ৷’
আজাদ কোনো কথা বলে না৷
‘তোমাকে তোমার বন্ধুরা দেখিয়ে দিয়েছে তুমি আজাদ, তুমি সেটাই স্বীকার করছ না৷ এটা ঠিক না৷ আমাদের কাছে সবকিছুর রেকর্ড আছে৷ তুমি সিদ্ধিরগঞ্জ অপারেশনে গিয়েছিলে৷ ২৫ তারিখে তুমি রাজারবাগ অপারেশনে ছিলে৷ প্রথমটার কম্যান্ডার ছিল কাজী কামাল৷ পরেরটার আহমেদ জিয়া৷’
‘এসব ঠিক নয়৷ আমার নাম মাগফার৷ ওরা আমার বাসায় এসেছিল তাস খেলতে৷ ওরা তাসটা ভালো খেলে৷ এছাড়া আমি ওরা কোথায় কী করে না করে কিচ্ছু জানি না৷’
‘হারামজাদা৷’ সিপাইদের ডেকে তার হাওলায় সমর্পণ করা হয় আজাদকে, ‘আচ্ছা করকে বানাও৷’ দুজন সিপাই এসে আজাদের পায়ে দড়ি বাঁধে৷ তারপর তাকে ঝোলায় সিলিং ফ্যানের সঙ্গে উল্টো করে৷ ফ্যান ছেড়ে দেয়৷ আজাদ উল্টো হয়ে ঝুলছে, ঘুরতে থাকে ফ্যানের সঙ্গে সঙ্গে৷ আর চলতে থাকে চড়-কিল-ঘুসি৷ আজাদ ‘মা মা’ বলতে বলতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে৷
তাকে নামিয়ে তার চোখেমুখে পানি দেওয়া হয়৷ জ্ঞান ফিরে পেলে সে প্রথম যা বলে, তা হলো, ‘মা৷’ যেন সে মায়ের কোলে শুয়ে আছে৷
অফিসাররা আজাদের ফাইলটা আবার দেখে৷ মায়ের সঙ্গে বাবার সম্পর্ক নাই৷ মায়ের একমাত্র ছেলে৷ মায়ের সঙ্গে একা থাকে৷
অফিসার বলেন, ‘তুমি মাকে দেখতে চাও ?’
‘হুঁ৷’
‘মায়ের কাছে যেতে চাও ?’
‘হুঁ৷’
‘তাহলে তুমি বলো, অস্ত্র কোথায় রেখেছ ?’
আজাদ বলে, ‘জানি না৷’
আবার একপ্রস্থ প্রহার চলে৷
আজাদ আবার তার মায়ের মুখ মনে করে নির্যাতন ভোলার চেষ্টা করে৷
‘ওকে৷ তোমার মা বললে তুমি সব বলবে ?’
‘বলব৷’
‘ঠিক আছে৷ তোমার মাকে আনা হবে৷’
অফিসার ইনটেলিজেন্সের এক লোককে ডেকে বলেন, ‘এর মাকে আনো৷’
আবুল বারক আলভী দেখে একে একে আলতাফ মাহমুদের বাসার সবাইকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে, তাকে তো ডাকে না৷ সে নিজেই উঠে যায়, বলে, ‘আমাকে যে ডাকলেন না! আমি তো ওই বাসায় গেস্ট হিসাবে ছিলাম৷’
তাকে ডাকা হয়৷ অফিসার বলেন, ‘তোমার নাম কী!’
সে বলে, ‘সৈয়দ আবুল বারক৷’
অফিসার তালিকায় তার নাম পান না৷ ‘তোমাকে কেন ধরেছে ?’
‘জানি না৷ আমি মিউজিক ডিরেক্টর সাহেবের বউয়ের পক্ষের আত্মীয়৷ কালকে বেড়াতে এসেছিলাম এ বাসায়৷ আমাকে ভুল করে ধরে এনেছে৷’
আবুল বারক আলভীর চেহারা প্রতারণাময়, বয়স বোঝা যায় না, তার ওপর আগের দিনের মারে সমস্ত শরীরে কাটা কাটা দাগ, রক্ত শুকিয়ে ভয়াবহ দেখাচ্ছে, চোখমুখ ফোলা, ঠোঁট কাটা, হাতের আঙুল থেকে নখ বের হয়ে আসছে…
কর্নেলকে অনেক সহানুভূতিসম্পন্ন মনে হচ্ছে; এমন সময় আগের দিন ও রাতে যে সিপাইটা প্রচণ্ড মেরেছিল, তাকে দেখা যায় এদিকে আসছে, আবুল বারক প্রমাদ গোনে, কারণ ওই সিপাইটা সব জানে, সে জানে যে তার নামই আসলে আলভী, আর একজন মুক্তিযোদ্ধা তাকে আলভী বলে শনাক্ত করে গেছে৷
আরো খানিকক্ষণ চলে জিজ্ঞাসাবাদ, আবুল বারক জানায় তার চাকুরিস্থলের কথা, সে রোজ অফিসে যায়, ‘এই যে ফোন নম্বর, ফোন করেন,’ এটা সে বলে আত্মবিশ্বাস থেকে যে তার অফিসে কেউ খোঁজ করলে তার সহকর্মী বা বড় কর্তা তাকে বিপদে ফেলবে না…
কর্নেল তাকে চলে যাওয়ার অনুমতি দেন৷
আবুল বারক বেরিয়ে আসে৷ সে হাঁটতে পারছে না৷ তার ওপর ওই দূরে সেই ভয়ঙ্কর সিপাইটাকে দেখা যাচ্ছে৷ সে ভালো মানুষ সুবেদারটাকে পেয়ে যায়৷ এই সুবেদারটাকে পরশু থেকেই তার ফেরেশতা বলে মনে হচ্ছে৷ প্রথম দিন যখন ওই কসাই টাইপের সিপাইটা প্রচণ্ড মার মারছিল, তখন এক সময় এই সুবেদার সিপাইটাকে বলেছিল, ‘ইতনা মার মাত মারো৷’ আজ সুবেদার সাহেবকে সামনে পেয়ে আবুল বারক বলে, ‘আমি তো দাঁড়াতেই পারছি না৷ আমাকে কি তুমি রোড পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারো!’
শুনে সুবেদার বলে, ‘আমি দোয়া করি তুমি একাই হেঁটে যেতে পারবে৷’
‘পারতেছি না চাচাজি৷’
সুবেদার আরেকজন সিপাইকে বলে, ‘ওকে পার করে দিয়ে আসো৷’
আবুল বারক হেঁটে হেঁেট সিপাইয়ের সঙ্গে রাস্তায় আসে৷ দূর থেকে সেই ভয়ঙ্কর সিপাইটা তাকিয়ে দেখে তাকে৷ আবুল বারক আলভীর রক্ত হিম হয়ে আসে৷
আবুল বারক এখনও নিশ্চিত নয়, তাকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, নাকি ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ এই সৈন্যটা তাকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে বলে, ‘বাসায় গিয়ে একজন ভালো ডাক্তার দেখাবে৷’ আবুল বারকের মনে হয় সে নবজীবন লাভ করল৷ এয়ারপোর্ট রোডে আসে সে৷ দেখে একটা গাড়ি যাচ্ছে৷ সে হাত তোলে৷ গাড়িটা তাকে অতিক্রম করে চলে যায়৷ তারপর ব্রেক কষে৷ আবার ফেরে৷ আলভী ভয় পায়৷ গাড়ি থেকে বলা হয় : ‘গাড়িতে ওঠো৷’
আবুল বারক আলভী দেখতে পায়, গাড়ির চালক তার বন্ধু রানা ও নিমা রহমানের বাবা লুৎফর রহমান৷ আলতাফ মাহমুদের বাসার পাশে থাকেন৷ বড় পাট ব্যবসায়ী৷ আলভী তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে আলতাফ মাহমুদের বাসায় আসে৷ মহিলা-মহলে সাড়া পড়ে যায়৷ নিমার মা এসে সব মহিলার সামনে আবুল বারক আলভীকে খালিগা করে শুশ্রূষা করতে থাকেন৷ আলভী লজ্জা পায়, আবার মহিলাদের এই আদর সে উপভোগও করে৷
ঘরে ফিরে আসে জামী, রুমীর বাবা শরীফ ইমাম৷ রুমী আসে না৷
এইভাবে কেউ ছাড়া পায়, কেউ পায় না৷
আজাদের মা মগবাজারের বাসায় পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই মহুয়া বলে, ‘আম্মা, আপনে কই আছিলেন৷ কামরুজ্জামানে এক লোকরে আনছিল৷ কয় বলে, আজাদের মা কই৷ জরুরি দরকার আছে৷ আজাদরে ছাড়নের ব্যাপারে কথা আছে৷’
মায়ের বুকের ভেতরটা যেন লাফিয়ে ওঠে৷ আজাদকে ছাড়িয়ে আনা যাবে! ফিরে আসবে তাঁর আজাদ৷ আশার সঞ্চার হয় খানিক৷ পরক্ষণেই কামরুজ্জামানের নাম শুনে তিনি খানিকটা হতাশ হন৷ মিলিটারির দালাল লোকটা৷ ইউনুস চৌধুরীর বাসাতেও ঘুরঘুর করে৷ সে কী মতলবে এসেছিল, আল্লাইই জানে! মহুয়া বলে, ‘আপনেরে থাকতে কইছে৷ আজকা বিকালে ফির আইব৷’
বিকালের জন্যে অপেক্ষা করেন মা৷ তাঁর বুক দুরুদুরু করে কাঁপছে৷ কিছুই ভালো লাগছে না৷ মহুয়ার কোলে ছোট মেয়েটা কাঁদে, মহুয়া তাকে স্তন্য পান করায়, মেয়েটা তখন চুপ করে, এই দৃশ্যের দিকে আজাদের মা তাকিয়ে থাকেন৷ তাঁর বুকের ভেতরটায় হাহাকার করে ওঠে৷ কোথায় তাঁর আজাদ!
বিকালবেলা কামরুজ্জামান আসে৷ দরজায় আওয়াজ শুনে মা দৌড়ে দরজা খোলেন৷ কামরুজ্জামানের সঙ্গে আরো একটা লোক৷ কামরুজ্জামান বলে, ‘চাচি৷ আল্লাহর কাছে শুকর করেন৷ আমি রইছি বইলা না সুযোগ আইছে৷ আজাদরে ছাইড়া দেওনের একটা ভাও করছি৷ ওনারে ক্যাপ্টেন স্যারে পাঠাইছে৷ কী কয়, মন দিয়া শুনেন৷’
আজাদের মা তাদেরকে ঘরের ভেতরে আনেন৷ বসতে দেন৷ কামরুজ্জামানের সঙ্গের লোকটার মুখের দিকে তাকান৷ কালো প্যান্ট, শাদা শার্ট পরা৷ চুল ছোট৷ ছোট করে ছাঁটা গোঁফ৷ চেহারাটা পেটানো৷
লোকটা বলে, ‘আজাদের সঙ্গে দেখা করতে চান ?’
‘জি৷’ মায়ের বুক এমনভাবে কাঁপছে, যেন তা তাঁর শরীরের অংশে আর নাই৷
‘ছেলেকে ছাড়ায়া আনতে চান ?’
‘জি৷’
‘আজকা রাতে আজাদ রমনা থানায় আসবে৷ আপনারে আমি দেখা করায়া দেব৷ বুঝলেন ?’
‘জি৷’
‘তার সঙ্গে দেখা করবেন৷ দেখা করে কী বলবেন ?’
‘জি!’
‘দেখা করে বলবেন, সে যেন সবার নাম বলে দেয়!’
‘জি ?’
‘শোনেন, ছেলেকে যদি ফিরে পেতে চান, তাকে বলবেন, সে যেন সবার নাম বলে দেয়৷ বুঝেছেন ?’
‘হুঁ৷’
‘অস্ত্র কোথায় রেখেছে, সে যেন বলে দেয়৷ বুঝেছেন ?’
‘হুঁ৷’
‘সে যদি সব স্বীকার করে, তাকে রাজসাক্ষী বানানো হবে৷ বুঝেছেন ?’
আজাদের মা তার মুখের দিকে তাকায়৷ শূন্য তাঁর দৃষ্টি৷
কামরুজ্জামান বলে, ‘রাজসাক্ষী মানে হে সবাইরে ধরায়া দিব৷ যারা যারা আসল ক্রিমিনাল তাগো বিরুদ্ধে সাক্ষী দিব৷ পুরস্কার হিসাবে হেরে ক্ষমা কইরা দিব৷ আপনের ছেলেরে ছাইড়া দিব৷ আমি কইছি, আজাদ ভালো ছেলে৷ হে ইন্ডিয়া যায় নাই৷ আরে বন্ধুবান্ধবগো পাল্লায় পইড়া…’
আজাদের মা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন৷
লোকটা বলে, ‘আপনি বললে আপনার ছেলে আপনার কথা শুনবে৷ আমাদের কথা শুতেছে না৷ বাজে ছেলেদের সাথে মিশে ও কিছু ভুল করেছে৷ সব স্বীকার করলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে৷ এরপর ছেলেকে দেখে রাখবেন৷ আর যেন খারাপ ছেলেদের সাথে না মেশে৷’
যাওয়ার আগে কামরুজ্জামান বলে যায়, ‘রাতের বেলা রমনা থানায় যাইয়েন৷ আজাদ থাকব৷ যা যা কইছে, ঠিকমতন কইরেন৷ বুঝছেন৷’
তারা চলে যায়৷ কচি এসে বলে, ‘কী কইল আম্মা, আজাদ দাদাকে ছেড়ে দিবে ? ও আম্মা৷’
মা কিছুই বলেন না৷ একদিকে তাকিয়ে থাকেন৷ মহুয়ার মেয়েটা আবার কাঁদছে৷ কেন, কাঁদছে কেন৷ মহুয়া কি কাছে নাই ? সে তাকে দুধ দিচ্ছে না কেন!
রাত্রিবেলা৷ গরাদের এপারে আজাদ৷ ওপারে তার মা৷ ছেলেকে দেখে মায়ের সর্বান্তকরণ কেঁপে ওঠে৷ কেঁদে ওঠে৷ কিন্তু তিনি ছেলেকে কিছু বুঝতে দিতে চান না৷ আজাদের চোখমুখ ফোলা৷ ঠোঁট কেটে গেছে৷ চোখের ওপরে ভুরুর কাছটা কাটা৷ সমস্ত শরীরে মারের দাগ৷ মেরে মেরে ফুলিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ কাটা জায়গাগুলোয় রক্ত শুকিয়ে দেখাচ্ছে ভয়াবহ৷
এখন আজাদকে তিনি কী বলবেন ? বলবেন, রাজসাক্ষী হও৷ সব স্বীকার করো৷ এটা তিনি তো বলতেই পারেন৷ ওর বাবা ইউনুস আহমেদ চৌধুরী এই শহরে এখনও সবচেয়ে ক্ষমতাবান লোকদের একজন৷ গভর্নরের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব৷ আর্মির অফিসাররা তার ইয়ার-বান্ধব৷ আজাদের ছোটমা, তিনি শুনতে পান, কর্নেল রিজভী নামের একজনকে ভাই ডেকেছে৷ কর্নেলের ছোট বোনের নামের সঙ্গে নাকি তার নাম মিলে গেছে৷ সাফিয়া বেগম যদি ইঙ্গিতেও চৌধুরীর কাছে ছেলের জন্যে তদবির করেন, তাহলেও তো ছেলে তাঁর মুক্তি পাবে৷ আবার চৌধুরীর নিজের ভাই আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক৷ ওই দিক থেকেও তাঁদের কোনো সমস্যা নাই৷ আজাদের ছোটমা নাকি আজাদের চাচাসহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে গাড়িতে করে নদীতীরে পৌঁছে দিয়েছেন৷
কিন্তু তাঁর ছেলেকে তিনি রাজসাক্ষী হতে বলবেন ? অন্যের ছেলেদের ফাঁসানোর জন্য ? মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে ? মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রগুলো পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্যে ?
ছেলে তাঁর যুদ্ধে যাওয়ার পরে একদিন বলে, ‘মা, তুমি কিন্তু আমাকে কোনো দিনও মারো নাই৷’ হ্যাঁ, তাঁর ছেলেকে তিনি কোনো দিনও ফুলের টোকাও দেননি৷ সেই ছেলেকে ওরা কী মারটাই না মেরেছে! আর ছেলে তাঁর করাচি থেকে চিঠি লিখেছিল, ‘মা, ওরা আর আমরা আলাদা জাতি৷ অনেক ব্যবধান৷’
না৷ তিনি আর যা-ই হন না কেন, বেইমান হতে পারবেন না৷ ছেলেকে যুদ্ধে যেতে তিনিই অনুমতি দিয়েছেন৷
আজাদ বলে, ‘মা, কী করব ? এরা তো খুব মারে৷ স্বীকার করতে বলে৷ সবার নাম বলতে বলে৷’
‘বাবা, তুমি কারো নাম বলোনি তো!’
‘না মা, বলি নাই৷ কিন্তু ভয় লাগে, যদি আরো মারে, যদি বলে ফেলি৷’
‘বাবা রে, যখন মারবে, তুমি শক্ত হয়ে থেকো৷ সহ্য কোরো৷ কারো নাম যেন বলে দিও না৷’
‘আচ্ছা৷ মা, ভাত খেতে ইচ্ছা করে৷ দুই দিন ভাত খাই না৷ কালকে ভাত দিয়েছিল, আমি ভাগ পাই নাই৷’
‘আচ্ছা, কালকে যখন আসব, তোমার জন্যে ভাত নিয়ে আসব৷’
সেন্ট্রি এসে যায়৷ বলে, ‘সময় শেষ৷ যানগা৷’
মা হাঁটতে হাঁটতে কান্না চেপে ঘরে ফিরে আসেন৷ পাশেই হলি ফ্যামিলি, জায়েদ আর টগর সেখানে চিকিৎসাধীন আছে, কিন্তু সেখানে যেতে তাঁর ইচ্ছা করছে না৷
সকালবেলা, যথারীতি গাড়ি এসে বন্দিদের নিয়ে যায় এমপি হোস্টেলের ইন্টারোগেশন সেন্টারে৷
বদির ওপরে চলছে অকথ্য নির্যাতন, সে আর সহ্য করতে পারছে না, এক সময় সে দৌড়ে ঘরের ভেতরে ইলেকট্রিক লাইনের ভেতরে হাত ঢোকানোর চেষ্টা করে, চেষ্টা করে সকেটের দুই ফুটোর মধ্যে দু আঙুল ঢোকানোর, ব্যর্থ হয়ে সকেট ভেঙে ফেলতে আরম্ভ করে, শব্দ পেয়ে সেন্ট্রিরা এসে তার দু হাত পেছন দিক থেকে বেঁধে ফেলে৷ তখন সে ভাবে, পালানোর চেষ্টা করলে নিশ্চয় গুলি করবে৷ তাকে যখন এক ঘর থেকে আরেক ঘরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন সে অকস্মাৎ দৌড়ে গেটের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে, এ আশায় যে তাকে গুলি করা হবে, কিন্তু সৈন্যরা অতটা উদারতার পরিচয় দেয় না, তাকে ধরে নিয়ে এসে উল্টো রাইফেলের বাঁট দিয়ে প্রচণ্ড জোরে মারতে থাকে৷
আজাদকে আবার নিয়ে যাওয়া হয় কর্নেলের সামনে৷ কর্নেল কাগজ দেখেন৷ আজাদকে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করানো হয়ে গেছে৷ ইন্টেলিজেন্সের রিপোর্ট৷ এখন নিশ্চয় সে স্বীকার করবে সবকিছু৷ জানিয়ে দেবে অস্ত্রের ঠিকুজি৷
‘আজাদ, বলো, সিদ্ধিরগঞ্জ অপারেশনে আর কে কে ছিল ?’
আজাদ বলে, ‘জানি না৷’
‘বলো, সিদ্ধিরগঞ্জ অপারেশনের পরে রকেট লাঞ্চারটা কোথায় রাখা হয়েছে ?’
‘জানি না৷’
কর্নেল ইঙ্গিত দেন৷ আজরাইলের মতো দেখতে একজন সৈনিক এগিয়ে আসে৷ আজাদের ঘাড়ে এমনভাবে হাত লাগায় যে মনে হয় ঘাড় মটকে যাবে৷ তাকে ধরে একটা চেয়ারে বসানো হয়৷ তাকে বাঁধা হয় চেয়ারের সঙ্গে৷ বিদ্যুতের তার খোলামেলাভাবে আজাদের চোখের সামনে খুলে বাঁধা হচ্ছে চেয়ারের সঙ্গে, তার পায়ের সঙ্গে৷ তাকে এখন শক দেওয়া হবে৷ আজাদের একবার মনে হয় ফারুক ইকবালের কথা, ৩রা মার্চ রামপুরা থেকে পুরানা পল্টনের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিটিংয়ে আসার জন্যে মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছিল সে, টেলিভিশন ভবনের সামনে আর্মি গুলি চালায়, গুলিবিদ্ধ হয়ে রাজপথে লুটিয়ে পড়ে ফারুক ইকবালের শরীর, তখন সারাটা শহরে জনরব ছড়িয়ে পড়ে যে ফারুক ইকবাল নিজের বুকের রক্ত দিয়ে রাস্তায় মৃত্যুর আগে লিখেছিল ‘জয় বাংলা’, তখন খবরটা বিশ্বাস হয়নি আজাদের, এখন ঠিক অবিশ্বাস হচ্ছে না৷ তার মনে পড়ে লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের মৃত্যুর বর্ণনা, যা সারাটা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে কিংবদন্তির মতো, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার দু নম্বর আসামি লে. কম্যান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের বাসায় ২৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে আর্মি ঢুকে পড়ে, তাঁকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমহারা নাম কিয়া’, তিনি বলেন ‘কম্যান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন’, তারা বলে, ‘বলো পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, তিনি বলেন, ‘এক দফা জিন্দাবাদ’, পুরোটা মার্চে যখন নানা রকমের আলোচনা চলছিল, তখন মোয়াজ্জেম হোসেন এই এক দফার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছিলেন, ‘এক দাবি এক দফা বাংলার স্বাধীনতা…’ সৈন্যরা গুলি করল, লুটিয়ে পড়ল তাঁর দেহ…
প্রচণ্ড অত্যাচার চলছে আজাদের ওপর দিয়ে, কিন্তু আজাদ নির্বিকার, সে শুধু মনে করে আছে তার মায়ের মুখ, মা বলেছেন, ‘বাবা, শক্ত হয়ে থেকো… কারো নাম বোলো না…’
এক সময় কর্নেল তাঁর হাতের কাগজ রাগে ছুড়ে ফেলেন, তারপর নির্দেশ দেন চূড়ান্ত শাস্তির… আজাদের ঠোঁট তখন নড়ে ওঠে, কারণ সে জানে চূড়ান্ত শাস্তি মানে এই শারীরিক যন্ত্রণার চির উপশম, আজাদের মন এই টর্চারের হাত থেকে বাঁচার সম্ভাবনায় আশ্বস্ত হয়ে ওঠে৷
পরদিন, কখন রাত হবে, কখন তিনি ভাত নিয়ে যাবেন রমনা থানায়, সারা দিন অস্থির থাকেন মা৷ দুপুরে তিনি আর ভাত মুখে দিতে পারেন না৷ তার ছেলে ভাত খেতে পায় না৷ তিনি বাসায় বসে আরাম করে ভাত খাবেন! তা কি হয়!
সন্ধ্যা হতে না হতেই তিনি চাল ধুতে লেগে পড়েন৷ দিনের বেলায়ই ঠিক করে জোগাড়যন্ত্র করে রেখেছেন কী রাঁধবেন! মুরগির মাংস, ভাত, আলুভর্তা, বেগুনভাজি৷ একটা টিফিন-ক্যারিয়ারে নেবেন৷ নাকি দুটোয়! তার কেমন যেন লাগে৷
রাত নেমে আসে৷ সারাটা শহর নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে৷ কারফিউ দেওয়ার আগেই ভাত নিয়ে তিনি হলি ফ্যামিলিতে আশ্রয় নেন৷ রাত আরেকটু বেড়ে গেলে দুটো টিফিন-ক্যারিয়ারে ভাত নিয়ে তিনি যান রমনা থানায়৷
দাঁড়িয়ে থাকেন, কখন আসবে গাড়ি৷ কখন এমপি হোস্টেল থেকে নিয়ে আসা হবে আজাদদের৷ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর গাড়ি আসে৷ একজন একজন করে নামে বন্দিরা৷ কই, এর মধ্যে তো তার আজাদ নাই৷ আর্মিরা চলে গেলে তিনি পুলিশের কাছে যান৷ ‘আমার আজাদ কই ?’
পুলিশকর্তা নামের তালিকা দেখেন৷ বলেন, ‘না, আজাদ তো আজকে আসে নাই৷’
‘মাগফার চৌধুরী ?’
‘না৷ এ নামেও কেউ নাই৷’
‘আর কি আসতে পারে ?’
‘আজ রাতে ? নাহ্৷’
‘কালকে ?’
‘বলতে পারি না৷’
টিফিন-ক্যারিয়ারে ভাত নিয়ে আজাদের মা কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো দঁাঁড়িয়ে থাকেন৷ সারা রাত৷ থানার চত্বরে৷ বাইরে বাঙ্কারে পাকিস্তানি সেনাদের চোখ এলএমজির পেছনে ঢুলুঢুলু হয়ে আসে, ভেতরে পুলিশের প্রহরী মশা মারে গায়ে চাপড় দিতে দিতে, বিচারপতির বাসভবনের উল্টোদিকের গির্জায় ঘন্টা বাজে, মা দাঁড়িয়ে থাকেন টিফিন-ক্যারিয়ার হাতে, তাঁর কেবলই মনে হতে থাকে সেই দিনগুলোর কথা, বিন্দু মারা যাওয়ার পরে যখন তাঁর পেটে আবার সন্তান এল, প্রতিটা মুহূর্ত তিনি কী রকম যত্ন আর উৎকন্ঠা নিয়ে ভেতরের জীবনটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন, আর সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরে কানপুরের ক্লিনিকেই চৌধুরী সাহেব আজান দিয়েছিলেন, আর ভারতবর্ষের আজাদির স্বপ্নে ছেলের নাম রেখেছিলেন আজাদ, তাঁর পেটের ভেতরটা গুড়গুড় করছে, যেন তিনি আজাদকে আবার এই পৃথিবীর সমস্ত বিপদ-আপদ-শঙ্কার প্রকোপ থেকে বাঁচাতে তাঁর মাতৃগর্ভে নিয়ে নেবেন, যদি তিনি পাখি হতেন, এখনই তাঁর পাখা দুটো প্রসারিত করে আজাদকে তার বুকের নিচে টেনে নিতেন৷ আস্সালাতু খায়রুম মিনান্নাউম, ভোরের আজান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি দৌড় ধরেন তেজগাঁও থানার দিকে৷ ওখানে যদি তাঁর আজাদ থাকে! ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরে, ছোট ছোট ছাঁদে, তিনি কিছুই টের পান না, তেজগাঁও থানার চত্বরে হাজির হন৷ তখনও তাঁর হাতে দুটো টিফিন-ক্যারিয়ার৷
পুলিশকে দুটো টাকা চা খাওয়ার জন্যে উপহার দিয়ে তিনি আজকের হাজতিদের পুরো তালিকা দেখেন৷ গরাদের এ পাশে দাঁড়িয়ে হাজতিদের প্রত্যেকের মুখ আলাদা আলাদা করে নিরীক্ষণ করেন৷ না, আজাদ নাই৷
এখান থেকে এমপি হোস্টেল বেশি দূরে নয়৷ তিনি এমপি হোস্টেলের দিকে দৌড় ধরেন৷ একজন সুবেদারের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর৷ সুবেদারকে বলেন, ‘আজাদ কোথায় ? আমি আজাদের মা৷’
সুবেদার বলে, ‘মাইজি, উনি তো এখানে নাই৷ ক্যান্টনমেন্টে আছেন৷ আপনি বাড়ি চলে যান৷’
মা কী করবেন, বুঝে উঠতে পারেন না৷ তাঁর হাতের ভাত ততক্ষণে পচে উঠে গন্ধ ছড়াচ্ছে৷ তাঁর নিজের পরিপাকতন্ত্রের ভেতরে থাকা পরশুদিনের ভাতও যেন পচে উঠছে…
‘মাইজি, আপনি বাড়ি চলে যান৷’
মা এক সময় বাসায় চলে আসেন৷ তাঁকে পাথরের মতো দেখায়৷ তিনি মহুয়াকে, কচিকে সংসারের স্বাভাবিক কাজকর্ম দেখিয়ে দেন, কিন্তু তবু মনে হয় সমস্তটা পৃথিবী গুমোট হয়ে আছে, কী অসহ্য ভাপসা গরম, বৃষ্টি হলে কি জগৎটা একটু স্বাভাবিক হতো! তিনি হাসপাতালে যান, দেখতে পান, জায়েদের জ্ঞান ফিরে এসেছে, টগরের অবস্থাও উন্নতির দিকে, তিনি জুরাইনের বড় হুজুরের কাছে, বেগম সাহেবার কাছে যান, তাঁরা তাঁকে আশ্বাস দেন যে আজাদ বেঁচে আছে, আজাদ ফিরে আসবে৷ ‘ঘাবড়াও মাত৷ ও আপসা আয়ে গা৷’
মহুয়া বলে, ‘আম্মা কিছু খান, না খেয়ে খেয়ে কি আপনি মারা যাবেন, আজাদ দাদা ফিরা আসবে তো!’
মা কিছুই খান না৷ একদিন, দুদিন৷
মহুয়া বলে, ‘আম্মা, আপনি কি আত্মহত্যা করতে চান ? আত্মহত্যা মহাপাপ৷ আপনি মারা গেলে আমরা কার কাছে থাকব আম্মা৷’
মায়ের হুঁশ হয়৷ তিনি তাঁর চোখের সামনে দেখতে থাকেন তাঁর ভাগ্নে-ভাগি্ন চঞ্চল, কচি, টিসুর অপ্রাপ্তবয়স্ক মুখ, জায়েদ, টগরের শয্যাশায়ী শরীর, তিনি মরে গেলে এরা কোথায় যাবে, কার কাছে থাকবে ?
মহুয়া একটা থালায় ভাত বেড়ে টেবিলে রাখে৷ তাঁকে ধরে জোর করে এনে খাবার টেবিলে বসায়৷ মা খাবেন বলেই আসেন৷ দুদিন খান না৷ পেটে খিদেও আছে৷ তাঁর সামনে থালায় ভাত৷ মহুয়া আনতে গেছে তরকারি৷ ভাত৷ ভাতের দিকে তাকিয়ে মায়ের পুরো হৃৎদপিণ্ডখানি যেন গলা দিয়ে দুঃখ হয়ে, শোক হয়ে, শোচনা হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে৷ তিনি ভাতগুলো নাড়েন-চাড়েন৷ তাঁর মনে পড়ে যায়, রমনা থানার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আজাদ কেমন করে বলেছিল, ‘মা, ভাত খেতে ইচ্ছা করে৷ দুই দিন ছেলে আমার ভাত খায় না৷ তারপরেও তো কেটে যাচ্ছে দিনের পর দিন৷ তাঁর চোখ দিয়ে জল গড়াতে থাকে৷ এই প্রথম, আজাদ নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পরে, তিনি কাঁদেন৷
তাঁকে কাঁদতে দেখে বাড়ির ছেলেমেয়েরাও বিনবিনিয়ে কাঁদতে থাকে৷ আজাদের মায়ের আর ভাত খাওয়া হয়ে ওঠে না৷ তখন সারাটা দুনিয়ায় যেন আর কোনো শব্দ নাই৷ কেবল কয়েকজন বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের কান্নার শব্দ শোনা যায়৷ তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছে চোখের জল সামলাতে, বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা রোদনধ্বনি দমন করতে, তারা পারে না৷
রাত্রিবেলা সবাই ভাত খাচ্ছে৷ মহুয়া মায়ের কাছে যায়৷ ‘আম্মা, দুইটা রুটি সেঁকে দেই৷ খাবেন ?’
মা মাথা নাড়েন৷ খাবেন৷
তাঁকে রুটি গড়িয়ে দেওয়া হয়৷ একটুখানি নিরামিষ তরকারি দিয়ে তিনি রুটি গলায় চালান করেন৷
খাওয়ার পরে, শোয়ার সময় তিনি আর খাটে শোন না; মহুয়া, কচি, টিসু অবাক হয়ে দেখছে গত দু রাত ধরে আম্মা মেঝেতে পাটি বিছিয়ে শুইছেন৷ তারা বিস্মিত হয়, বলে, ‘আম্মা, এইটা কী করেন, আপনে মাটিতে শুইলে আমরা বিছানায় শুই কেমনে’, কিন্তু আম্মা কোনো জবাব না দিয়ে মেঝেতেই শুয়ে পড়েন৷ মাথায় বালিশের বদলে দেন একটা পিঁড়ি৷
তখন কচি, ১১ বছর বয়স, মহুয়াকে বোঝায়, ‘আম্মা যে দেখছে রমনা থানায় দাদা মেঝেতে শুইয়া আছে, এই কারণে উনি আর বিছানায় শোয় না, না বুজি!’
এর পরে আজাদের মা বেঁচে থাকেন আরো ১৪ বছর, ১৯৮৫ সালের ৩০শে আগস্ট পর্যন্ত, এই ১৪ বছর তিনি কোনো দিন মুখে ভাত দেননি৷ একবেলা রুটি খেয়েছেন, কখনও কখনও পাউরুটি খেয়েছেন পানি দিয়ে ভিজিয়ে৷ মাঝে মধ্যে আটার মধ্যে পেঁয়াজ-মরিচ মিশিয়ে বিশেষ ধরনের রুটি বানিয়েও হয়তো খেয়েছেন৷ কিন্তু ভাত নয়৷ এই ১৪ বছর তিনি কোনো দিন বিছানায় শোননি৷
তিনি আবার যান জুরাইনের মাজার শরিফের হুজুরের কাছে, হুজুরাইনের কাছে৷ হুজুর তাঁকে অভয় দিয়ে বলেন, ‘ইনশাল্লাহ, আজাদ ফিরে আসবে৷ শিগগিরই আসবে৷’
একদিন জাহানারা ইমাম আসেন আজাদের মায়ের কাছে৷ তাঁরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেন৷ অনেকক্ষণ কেউ কথা বলতে পারেন না৷ তারপর আজাদের মা মুখ খোলেন, ‘বোন, কী সর্বনাশ হয়ে গেল৷ আপনার রুমীকেও নাকি ধরে নিয়ে গেছে!’
আজাদের মার মুখে আজাদকে কীভাবে ধরা হলো, তার বৃত্তান্ত শোনেন জাহানারা ইমাম৷ তারপর আজাদের মা তাঁকে দেখান সেই ঘরটা, স্টিলের আলমারিতে এখনও রয়ে গেছে গুলির দাগ৷ মেঝেতে রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে আছে৷ দেয়ালে গুলি আর রক্তের চিহ্ন৷
‘বোন রে, বড় মেরেছে আমার আজাদকে৷ চোখমুখ ফুলে গেছে৷ সারা গায়ে মেরে ফাটিয়ে দিয়েছে৷ গায়ে রক্তের দাগ৷ মারের দাগ৷’ আজাদের মা বলেন৷
‘আপনি দেখেছেন আজাদকে ?’
‘হ্যাঁ৷ রমনা থানায়৷’
‘দেখা করতে দিল আপনাকে!’
‘হ্যাঁ৷’
‘কী বলল সে আপনাকে ?’
‘বলল, মা, খুব মারে৷ ভয় লাগে, যদি মারের চোটে বলে দেই সবকিছু৷
‘আপনি কী বললেন ?’
‘বললাম, বাবা, কারো নাম বলোনি তো৷ বোলো না৷ যখন মারবে, শক্ত হয়ে থেকে সহ্য কোরো৷’
জাহানারা ইমাম ইস্পাতের মতো শক্ত হয়ে যান৷ কী শুনছেন তিনি এই মহিলার কাছে ? তাঁকে তিনি শক্তই ভেবেছিলেন, কিন্তু এত শক্ত! গভীর আবেগে জাহানারা ইমামের দু চোখ দিয়ে জল গড়াতে থাকে৷ তিনি আবারও সাফিয়া বেগমকে জড়িয়ে ধরেন৷
জুয়েলের মা ফিরোজা বেগম আসেন আজাদদের বাসায়৷ টগরের চাচি হিসেবে তিনি সাফিয়া বেগমের পূর্ব পরিচিত৷ এখন পরিস্থিতি তাদের আরেক অভিন্ন তলে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে৷ তাদের দুজনের ছেলেই ধরা পড়েছে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে৷
দুজন দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন নীরবে৷ কী করা যায়, এই বিষয়ে তারা মৃদুকন্ঠে শলাপরামর্শ করেন৷
তারা একদিন দুজনে মিলে যান সৈয়দ আশরাফুল হকদের বাসায়৷ আশারফুলের মাকে বলেন, বাবু (আশরাফুলের ডাকনাম) যেন বাসায় না থাকে৷ পারলে যেন ইন্ডিয়া চলে যায়…
আশরাফুল অবশ্য তার আগেই তার বাসা থেকে চলে গেছে অন্য গোপন আশ্রয়ে৷
৪৮. মা
লক্ষ লক্ষ পাখি স্বাধীনতা স্বাধীনতা বলে কানের কাছে কলকলিয়ে উঠতে শুরু করে৷ টগর বুঝতে পারে, তার জ্ঞান ফিরে আসছে৷
খানিকটা ধাতস্থ হলে তার মনে পড়ে, পাশের বিছানায় জায়েদেরও শুয়ে থাকবার কথা৷ সে ঘাড় ঘোরায়৷ ওই তো জায়েদ৷
সে বলে, ‘জায়েদ, পা তো নাড়াইতে পারি না৷ তুই পারিস ?’
টগরের বাবা আলাউদ্দিন চৌধুরী আসেন কার্গো-ভরা সুপারি নিয়ে, পটুয়াখালী থেকে সদরঘাটে৷ ঢাকায় পা রেখেই শুনতে পান দুঃসংবাদটা৷ ছেলে তার গুলিবিদ্ধ৷ তিনি দৌড়ে যান হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে৷
ধীরে ধীরে জায়েদ আর টগর অনেকটা সেরে ওঠে৷ তাদের এই হাসপাতাল থেকে যত তাড়াতাড়ি সরিয়ে নেওয়া যায় ততই মঙ্গল৷ ডিসচার্জ করার কাগজপত্র সব তৈরি করাচ্ছেন টগরের বাবা আলাউদ্দিন চৌধুরী৷ হলি ফ্যামিলির ডাক্তাররা আর ফাদাররা যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন এবং করছেন৷ তারা বিল কয়েক হাজার টাকা কমিয়ে দিয়েছেন৷
এই সময় টগর হাসপাতালের বিছানায় উঠে বসে৷ নিজের পেটের কাছে ক্ষতস্থানে হাত বুলোতে বুলোতে হঠাৎই দেখে, শক্তমতোন কী যেন দেখা যায়৷ ব্যাপার কী ?
সে বলে, ‘বাবা বাবা, আমার পেটে এটা কী দেখেন তো ? শক্ত৷’
বাবা আসেন৷ দেখেন৷ বুঝতে পারেন না ছেলের পেটে জিনিসটা কী আসলে৷ তিনি ডাক্তার ধরে আনেন একজন৷ ডাক্তার সাহেব টগরের পেটে হাত দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলেন, ‘ওটা কিছু না৷ বুলেট৷’
‘বুলেট ? বলেন কী ?’ টগরের বাবা আঁতকে ওঠেন৷
ডাক্তার ভাবলেশহীন মুখে বলেন, ‘ওতে কোনো ক্ষতি হবে না৷ থাকুক৷’
‘পরে যদি অসুবিধা হয় ?’ আলাউদ্দিন চৌধুরীর কন্ঠে উদ্বেগ৷
‘পরেও হওয়ার কথা নয়৷ হলে আমরা তো আছিই৷’
‘না না৷ পরে আর আসা যাবে না৷ আপনারা এখনই এটা বের করার ব্যবস্থা নিন৷’
ডাক্তার হেসে বলেন, ‘কী টগর৷ তুমি কী বলো ? বুলেটটা পেটে রাখবে, না বের করবে ?’
টগরও ঘাড় শক্ত করে বলে, ‘বার করব৷’
‘আচ্ছা তাহলে তুমি বসো৷ আমি ব্যবস্থা করছি৷’ ডাক্তার সাহেব বাইরে যান৷
কী বলেন ডাক্তার সাহেব৷ এখনই করবে নাকি ? টগর বিস্মিত৷
ডাক্তার এসে বলেন, ‘এখানে তো এঙ্-রে মেশিন নষ্ট৷ আপনি বাইরে থেকে এঙ্-রে করিয়ে আনেন৷’
টগরের বাবা টগরকে নিয়ে গিয়ে এঙ্-রে করিয়ে আনান৷ ডাক্তার সাহেব রিপোর্ট দেখে বলেন, ‘আরেকটা অপারেশন করতে হবে৷ তবে এটা ছোট অপারেশন৷ পেটের বাইরের দিকে আছে বুলেটটা৷
লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে ডাক্তাররা টগরের পেটে অস্ত্রোপচার করেন৷ টগর সব বুঝতে পারে৷ বুলেটটা বের করে ডাক্তার সাহেব টগরের হাতে দিয়ে বলেন, ‘ধরে থাকো৷’
টগর ওটা ধরেই থাকে৷ সেই বিকালেই টগরকে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে টগরের বাবা নিয়ে যান আজাদদের মগবাজারের বাসায়৷ টগরের হাতে তখনও ধরা আছে বুলেটটা৷ আজাদদের বাসার কাছেই শিল্পী আবদুল জব্বারের বাসা৷ তার সামনে একটা সজনে গাছ৷ সেই গাছের কাছে এসে কী মনে করে টগর বুলেটটা ফেলে দেয় গাছের গোড়াটা লক্ষ্য করে৷
এর পরে টগরকে তার বাবা নিয়ে যায় বরিশালে৷
ইতিমধ্যে জায়েদকেও হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে এনেছেন সাফিয়া বেগম৷
৪৯. মা
দিন কেটে যাচ্ছে৷ একটা একটা করে দিন কেটে যায়৷ আজ ৫০ দিন হলো রুমীকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে৷ ‘রুমী, আজ ৫০টা দিন হলো তোমাকে আমি দেখি না, ভাবা যায়!’ জাহানারা ইমাম দীর্ঘশ্বাস ফেলেন৷ তাদের পরিবারে সবারই মনের অবস্থা খারাপ৷ দুঃখ, হতাশা, নিষ্ফল ক্রোধ, ভয়, ভীতি-সব মিলে তাদেরকে কি পাগল বানিয়ে ছাড়বে ? তাঁর স্বামী শরীফ ইমামের শরীর দ্রুত ওজন হারাচ্ছে৷ তিনিও শুকিয়ে যাচ্ছেন৷ তবে সবাই বলে, রুমীর মাকে নিয়ে ভয় নাই, কারণ তিনি কাঁদেন, হাহুতাশ করেন, মনের বাষ্প বের করে দেন৷ কিন্তু রুমীর বাবা শরীফ কথা বলেন কম, কাঁদেন না, হা-হুতাশ করেন না৷ দৈনন্দিন সব কাজ তিনি করে চলেছেন নিখুঁতভাবে, সকালে উঠে শেভ, গোসল, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনা, অফিস, বিকালে টেনিস, সন্ধ্যায় আবার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনা, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা-সবই তিনি এমনভাবে করছেন, যেন তাঁর মনে কোনো দুঃখ নাই, যেন তাঁর ছেলেকে সৈন্যরা ধরে নিয়ে যায়নি৷
কিন্তু জাহানারা ইমাম এতটা শান্ত ভাব বজায় রাখতে পারেন না৷ ছেলের ছবির দিকে তাকিয়ে তিনি বিড়বিড় করতে থাকেন : ‘এই কি ছিল বিধিলিপি, রুমী ? তুমি কি কেবল ছবি হয়েই থাকবে আমাদের জীবনে ?’
রুমীর ধরা পড়ার রাতেই, জাহানারা ইমাম যখন রুমীর মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছিলেন, হঠাৎ রেডিওতে গান বেজে উঠল, খুদিরামের সেই বিখ্যাত ফাঁসির গান, একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি, হাসি হাসি পরব ফাঁসি, দেখবে জগৎবাসী…
তবে কি রুমী চলেই গেল ? ফিরে আসবে মাসীর ঘরে, গলায় ফাঁসির দাগ দেখে তাকে চিনে নিতে হবে ?
তা কি হয় ? রুমী কি চলে যেতে পারে ? এই অল্প বয়সে ? কেবল আইএসসি পাস একটা ছেলে ? কেবল ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে যে ভর্তি হয়েছে!
রুমী আবৃত্তি করত খুব ভালো৷ জীবনানন্দ দাশের এই কবিতাটাও তার গলায় দারুণ ফুটে উঠত
আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়-হয়তো বা শঙ্খচিল মানুষের বেশে
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন এ কাঁঠাল ছায়ায়…
জাহানারা ইমামের দু চোখ জলে ভিজে আসছে৷ তিনি বিড়বিড় করেন, রুমী, তোমাকে ফিরে আসতেই হবে, আসতেই হবে৷
চোখ মুছে ছবিটার নিচে এক টুকরো কাগজে বড় বড় অক্ষরে তিনি লেখেন : আবার আসিব ফিরে-এই বাংলায়৷ ফটোটা তিনি রাখেন নিচতলায় বসবার ঘরে, কোনার টেবিলে৷ আগামীকাল ২০ নভেম্বর, ঈদ৷ অনেক মানুষ আসবে এই বাসায়৷ সবাই দেখুক, কোমরে হাত দিয়ে দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়ানো রুমী কীভাবে সদর্পে ঘোষণা করছে-আবার আসিব ফিরে-এই বাংলায়৷
৫০. মা
জুরাইনের বড় হুজুর বলেছেন, আজাদ জিন্দা আছে৷ সহি-সালামতে আছে৷ তিনি দিব্যচোখে না দেখতে পেলে কেন বলবেন ? তাঁর মিথ্যা কথা বলার কী আছে ? জুয়েলের মাও আসে এই বাসায়৷ রুমীর মা আসে৷ সেকেন্দারের মা আসে৷ সেকেন্দারের বাবা তো জয়েন সেক্রেটারি৷ সবাই তো চেষ্টা কম করছেন না৷ এত তদবির উপেক্ষা করে কি ছেলেগুলোর অনিষ্ট করা সম্ভব ?
আর তাঁর বুকটা কেঁপে ওঠে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে৷ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তিনি শুনতে পান ছক্কু মিয়ার বিচ্চুগুলার নানা কাণ্ডকীর্তির কথা৷ মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে পাকিস্তানি সৈন্যদের৷ ওদের দিন আসছে ফুরিয়ে৷ দেশ স্বাধীন হবেই৷ জুরাইনের বড় হুজুরও তা-ই বলেন৷ ওরা নাকি মসজিদে পর্যন্ত গুলি করেছে৷ মেয়েদের ওপর অত্যাচার করছে৷ এই অত্যাচার আল্লাহ কেন সহ্য করবেন৷
মহুয়া কচি এরা কিছু বোঝে না৷ তারা তাঁকে বলে ভাত খেতে৷ আবার কচি বলে, ‘আম্মা, তুমি কি আর কোনো দিনও ভাত খাইবা না ?’ আরে খাব না কেন ? নিশ্চয় খাব৷ আজাদ ফিরে আসবে৷ ও খুবই ভাতের পাগল৷ এসেই তো ভাত খেতে চাইবে৷ এখন কি কাওরানবাজারে পাবদা মাছ পাওয়া যাবে ? জায়েদ অসুস্থ হওয়ায় হয়েছে অসুবিধা৷ ওকে আর আগের মতো কথায় কথায় বাজারে পাঠানো যাচ্ছে না৷ আজাদ ফিরে এলে পাঠাতে হবে৷ পাবদা মাছের পাতলা ঝোল করতে হবে৷ বাজারে টমেটো উঠেছে৷ টমেটো ধনেপাতা দিয়ে সুন্দর করে রাঁধতে হবে৷ আজাদ ভাত খাবে৷ আ দেখব৷ তারপর আজাদ নিজেই আমার মুখে এক গ্রাস ভাত তুলে দেবে৷ ও যা পাগল৷ ও সব পারে৷
দেশ যখন স্বাধীন হবে, তখন কি আর ওরা ওকে আটকে রাখতে পারবে ? পারবে না৷ আল্লাহ মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে তুমি থেকো আল্লাহ৷ এরা ন্যায়ের পক্ষ৷ এদের ট্রেনিং কম, অস্ত্র কম, সব ছাত্রমানুষ, কিষান-মজুর-এরা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা! এদের পাশে থাকতে হবে, হে আল্লাহ, তোমাকে৷ তাই তো তুমি আছ৷ তাই তো শুধু খবর আসছে এখানে ওখানে প্রচণ্ড যুদ্ধের আর মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের৷
আজাদের মায়ের চোখ দুটো একটু ধরে আসে৷ দূরে কোথায় যেন গোলাগুলির শব্দ হয়৷ তাঁর ঘুম আবার যায় ভেঙে৷
৫১. মা
সারা বাংলাদেশ যুদ্ধ করছে৷ শাহাদত চৌধুরীর মাকে তাঁর এক গণিতজ্ঞ ভাই কিছুদিন আগে বলেছিলেন, ‘আমাকে অঙ্কের হিসাবে বলো, এক পরিবারের কয়জন গেছে মুক্তিযুদ্ধে, ঢাকার রাস্তায় কয়টা পটকা ফোটালেই একটা প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীকে হারানো যায় না, ধরো তোমার ছয় ছেলে, কয়জন যুদ্ধে গেছে, আমার চার ছেলে, তারা তো বাসাতেই বসে আছে, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার মায়ের মুখ থেকে শুনতে চাই, আমার ছেলে যুদ্ধে গেছে৷’ তাঁকে মা তখন কিছু বলেননি; ৩০শে আগস্ট ৭১ তাঁর বাড়িতে পাকিস্তানি সৈন্যরা হানা দিয়ে তাঁর জামাতা বেলায়েতকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি আশ্রয় নেন তাঁর এই গণিতজ্ঞ ভাইয়ের বাড়িতেই৷ এবার তিনি ভাইয়ের পুরনো প্রশ্নের জবাব বুঝিয়ে দেন, ‘আপনি মুক্তিযোদ্ধার মাকে দেখতে চেয়েছিলেন, আমাকে দেখেন, আমার ছয় ছেলের তিনজনই গেছে মুক্তিযুদ্ধে, আমি অঙ্কের হিসাবে দেখি দু কোটি যুবকের এক কোটিই যোদ্ধা, বলেন, দেশ স্বাধীন হবে কি না ?’
আজাদের মা ভাত খান না, বিছানায় শোন না, ঢাকায় এক রাতে ধরা পড়ে অনেক গেরিলা, অনেক অস্ত্রশস্ত্র, কিন্তু আবারও ঢাকায় ঢুকে পড়ে গেরিলারা, রাইসুল ইসলাম আসাদের নেতৃত্বে ওই তো এগিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধারা বায়তুল মোকাররমে, সেনাবাহিনীর দুটো লরির মধ্যে হাইজ্যাক করা গাড়িতে বোমা পেতে রেখে একই সঙ্গে উড়িয়ে দিচ্ছে দুটো লরিই, বোমা বিস্ফোরিত হয় টিভি ভবনের ছয় তলায়, ঢাকার উত্তরে মানিক বাহিনীর তৎপরতা, আর দক্ষিণে ক্রাক প্লাটুন, ভায়াডুবি ব্রিজ ওড়াতে গিয়ে শত্রু বাহিনীর গুলি ভেদ করে মানিকের শরীর, পানি থেকে তার রক্তাক্ত গরম শরীরটাকে তোলে সহযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, মৃত্যুর আগে ঠোঁট নেড়ে কী যেন বলতে চায় মানিক, কিন্তু কথা শেষ হওয়ার আগেই ঠোঁটের স্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়, বাচ্চুর বিশ্বাস হয় না মানিক নাই, কিন্তু মানিক ততক্ষণে শহীদ, মানিক নাই, মানিকেরা থাকে না, কিন্তু যুদ্ধ এগোতে থাকে, তখন সেকেন্ড ইন কম্যান্ড বাচ্চু গ্রহণ করে নেতৃত্ব; পানির নিচে নেমে যাচ্ছে নৌ কম্যান্ডোরা, একই সময়ে চট্টগ্রাম, খুলনা, চাঁদপুর, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকায় ডুবিয়ে দেওয়া হবে জাহাজ, তিনশ নৌ কম্যান্ডো অপেক্ষা করছে কখন আকাশবাণীতে বাজবে আমি তোমায় শুনিয়েছিলাম আমার যত গান, নেমে গেল যোদ্ধারা জলে, আবার অপেক্ষা পরের গানের জন্যে, আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি, জিরো আওয়ার, আঘাত করো, একসঙ্গে হঠাৎই ডুবে গেল ১০টা জাহাজ : অপারেশন জ্যাকপট, সেপ্টেম্বরে আবার পরিচালিত হয় অপারেশন জ্যাকপট-২, ধীরে ধীরে ঘেরাও হতে থাকে ঢাকা, চারদিকে ১৬ হাজার গেরিলা… সাভারের উপকন্ঠে অ্যাম্বুশ করে আছেন বাচ্চুরা, ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ, ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ফিরে আসছে আহত ব্যাঘ্রের ক্ষোভ আর ক্রোধ নিয়ে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ থেকে, তাদের আক্রমণ করতে, বাচ্চুদের সঙ্গে আজ আছে একটা কিশোর ছেলে টিটো, ও ঠিক যোদ্ধা নয়, অপারেশনে অতটুকুন ছেলের আসার কথা নয়, সে ক্যাম্পে থাকে, নানা কাজকর্মে সাহায্য করে, এ-ই তো যথেষ্ট এক কিশোরের জন্যে, ও কেন এসেছে, শুরু হয় ঘোরতর যুদ্ধ, মাথার ওপর দিয়ে শিস দিয়ে যাচ্ছে শত্রুর ছোড়া গোলাগুলি, একটা খবর জানানো দরকার মুক্তিযোদ্ধাদের একটা রিজার্ভড অংশকে, টিটোকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু ও তো ছোট, ও তো যুদ্ধের নিয়মকানুন জানে না, হায় আল্লাহ, ওকে বাঁচিয়ে রাখো, ওই তো বাচ্চুর চোখের সামনে হাত তিরিশেক দূরে লুটিয়ে পড়ল টিটোর শরীর, ততক্ষণে টিটো অবশ্য তার ওপরে অর্পিত কাজটা সম্পন্ন করেছে, সঙ্গীদের জানিয়ে দিয়েছে তখনকার কর্তব্যনির্দেশ, শত্রুরা পিছিয়ে যায়, ছন্নছাড়া হয়, টিটোর রক্তাক্ত ছোট্ট শরীরটা আনা হয় ক্যাম্পে, টিটো বাঁচতে চায়, সে দেখতে চায় স্বাধীনতা, ‘আমাকে বাঁচান, আমি স্বাধীনতা দেখতে চাই’, কিন্তু টিটো মরে যায়, সাভারের মাটিতে তাকে সমাহিত করে রাখে সহযোদ্ধারা, তারপর এগোতে থাকে ঢাকার দিকে, এগিয়ে আসে মিত্রবাহিনী-মুক্তিবাহিনী…
সম্মুখসমরে ২৭ জন পাকিস্তানি সৈন্য খতম করে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া আর ফতেহ চৌধুরীরা খানিক পিছিয়ে আসে বালু নদী থেকে৷ মধ্য ডিসেম্বরের এই সময়টায় বেশ কুয়াশা পড়ছে৷ ভোরের আলো ফোটবার সঙ্গে সঙ্গে তারা দেখতে পায় মেজর হায়দারকে৷ তাঁর পরনে পুরো কম্যান্ডো পোশাক৷ মেজর হায়দার বলেন: ‘এবার ফাইনাল আঘাত৷ ঢাকা দখল৷ সবাই প্রস্তুত৷’
আজাদের মাকে শুভার্থীরা পরামর্শ দেন মগবাজারের বাসা ছেড়ে দিতে, কেননা ওখানে থাকা নিরাপদ নয়, তিনি বাসাটা ভাড়া নেওয়া ছাড়েন না, নিয়মিত ভাড়া দেন, যদি আজাদ ছাড়া পায়, যদি এসে দেখে বাসায় কেউ নাই, কিন্তু তাঁরা চলে যান মালিবাগে, যাওয়ার আগে পড়শিদের ভালো করে বুঝিয়ে বলে যান, আজাদ এলে যেন তাকে তারা বলে যে মালিবাগের আগের বাসায় গেলেই হবে, ‘৭২ সাল পর্যন্ত মগবাজারের বাসার ভাড়া গুনেছেন তিনি, অবশেষে ছেড়ে দেন, এদিকে চৌধুরী সাহেবের পক্ষ থেকে কামরুজ্জামান আসতে থাকে আজাদের মায়ের কাছে, এখনও চলেন চৌধুরীর কাছে, আজাদের বাবাও তাঁর প্রথম ছেলেকে হারিয়ে মুষড়ে পড়েছেন, তিনি নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েও ছেলের খোঁজ বের করতে পারেন না, আজাদের বাবার পানাসক্তি বেড়ে যায়, একেকটা রাতে তিনি ‘আজাদ আজাদ’ বলে নিজের চুল ছেঁড়েন, আজাদের ছোটমাকে অভিযুক্ত করেন নানা অভিযোগে, লোক পাঠিয়ে দেন সাফিয়া বেগমের কাছে, নানাভাবে মিনতি করেন যেন সাফিয়া বেগম তাঁর বাড়িতে ফিরে যান, কিন্তু আজাদের মা অনড়, প্রশ্নই আসে না চৌধুরীর কাছে ফিরে যাওয়ার, এ তাঁর নিজের যুদ্ধ, এ যুদ্ধে তিনি হেরে যেতে পারেন না৷
আজাদের মা ভাত খান না, বিছানায় শোন না, অপেক্ষায় থাকেন ছেলে আসবে বলে, আর খোঁজ বের করার চেষ্টা করেন ছেলের, রমনা থানায় যান, তেজগাঁও থানায় যান, এমপি হোস্টেলে যান, ছেলের খবর পাওয়া যায় না, অথচ বড় হুজুর আশ্বাস দিয়েছেন আজাদ বেঁচে আছে, সে ফিরে আসবেই৷
এই আশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকেন, দিন গুজরান করেন মহিলা৷
রুমীর কোনো খবর নাই, প্রতিদিন মগবাজারের পাগলাবাবার দরবারে যান জাহানারা ইমাম৷ সেখানে গিয়ে দেখতে পান আলতাফ মাহমুদের আত্মীয়স্বজনদের, ঝিনু মাহমুদ, মোশফেকা মাহমুদ, দেখতে পান চট্টগ্রাম দুর্নীতি দমন বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর নাজমুল হকের স্ত্রীকে, বরিশালের এডিসি আজিজুল ইসলামের স্ত্রীকে, কুমিল্লার ডিসি শামসুল হক খানের স্ত্রীকে, রাজশাহীর রেডিও ইঞ্জিনিয়ার মহসীন আলীর স্ত্রীকে, চট্টগ্রামের চিফ প্লানিং রেলওয়ে অফিসার শফি আহমেদের স্ত্রীকে, কুমিল্লার লে. ক. জাহাঙ্গীরের স্ত্রীকে, কুমিল্লার মেজর আনোয়ারুল ইসলামের স্ত্রীকে এবং এ রকম বহু৷ এদের সবারই স্বামী নিখোঁজ৷ তাঁরা পরস্পরের দুঃখের কাহিনী শোনেন৷ এদের মধ্যে থেকে জাহানারা ইমাম তাঁর নিজের ছেলেকে হারানোর শোক অনেকটা ভুলে থাকতে পারেন৷ পিএসপি আওয়াল সাহেবের স্ত্রী আসেন ছোট ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে, জাহানারা জানেন তাঁর তিন ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গেছে, কিন্তু ভুলেও সে কথা তারা আলোচনা করেন না, উলফতের বাবা আজিজুস সামাদ ছাড়া পাওয়ার পরে তাঁর স্ত্রী তাঁকে আনেন পাগলাবাবার কাছে, কিন্তু ভুলেও জাহানারা তাঁকে শুধান না উলফত বা আশফাকুস সামাদের কথা৷
এরই মধ্যে একদিন খবর আসে, ৪ঠা সেপ্টেম্বর রাতে, ইয়াহিয়ার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগের রাতে, ঢাকায় শখানেক মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে৷ জাহানারা ইমাম ছুটে যান আজাদের মায়ের কাছে, আজাদের মা আজাদের কোনো খবর আর পাননি৷ জাহানারা ইমামের মনে এই আশঙ্কা জাগে যে, কেউ নাই, রুমী নাই, বদি নাই, বাকের নাই, জুয়েল নাই, আজাদ নাই, বাশার নাই, আলতাফ মাহমুদ নাই…
রুমীর মা অপেক্ষায় থাকেন যে রুমী ফিরে আসবে, আজাদের মা ভাত বেড়ে নিয়ে বসে থাকেন যে তাঁর ছেলে এসেই ভাত খেতে চাইবে, রুমী আসে না, আজাদ আসে না, জুয়েলের মা দিন গোনেন কবে ফিরে আসবে তার ছেলে, জুয়েল ফেরে না, বদির মা জানে না ছেলে তার কোন জেলখানায়, তার দিন যেন কাটতে চায় না, বাশারের মা ছেলেকে স্বপ্নে দেখে কেঁদে ওঠেন ঘুমের ভেতরে, জয়েন সেক্রেটারি এ আর খানের ছেলে সেকেন্দার হায়াত খান ফেরে না আর বাড়ি, তার মাও অপেক্ষা করেন, স্বামীকে মিনতি করেন আরেকটু সচেষ্ট হতে, ছেলেকে উদ্ধার করতে, তিনি এসে দেখা করেন আজাদের মায়ের সঙ্গে, মনোয়ার হোসেনের স্ত্রী দুলু রাতের বেলা বিনবিনিয়ে কাঁদে, লীনার বয়স বাড়ে একটু একটু করে মুক্তিযুদ্ধের বয়সের মতোই, আর স্বাধীনতা নিকটবর্তী হতে থাকে, ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করে, মুক্তিবাহিনী আর মিত্র বাহিনী দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকে ঢাকার দিকে, গভর্নর হাউসে মিটিং চলাকালে আকাশ থেকে এসে পড়ে ভারতীয় বিমানের বোমা৷
৫২. মা
বলেন, ‘আমার এক আত্মীয় অ্যারেস্ট হইছিল৷ খোঁজ পাওয়া যাইতেছে না৷ দেখেন তো আছে নাকি ?’
‘নাম বলেন৷ পিতার নামসহ…’
‘মাগফার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী আজাদ, পিতা ইউনুস আহমেদ চৌধুরী ?’
অফিসারটি বন্দিদের নামের তালিকা উল্টেপাল্টে দেখেন৷ ‘না, নাই তো ?’
‘আবুল বাশার চৌধুরী ?’ খলিল সাহেব আজাদের মায়ের নিজের হাতে লেখা তালিকাটা পকেট থেকে বের করে পড়েন৷
‘না নাই৷’
‘বদিউল আলম ?’
‘নাই৷’
‘আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল ?’
‘নাই৷’
‘চুল্লু ?
‘আছেন’-কর্তাটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে৷
‘সামাদ ?’
‘আছেন’-কর্তাটির মুখ হাসি হাসি৷ ‘মুক্তিযোদ্ধা আরো আছেন৷ বরিশালের কাজী ইকবাল…’
খলিল সাহেব শঙ্কিত বোধ করেন৷ তিনি তো বলেননি যে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে এসেছেন…
কর্তাটি তাঁর মুখের ভাষা পড়তে পারেন৷ বলেন, ‘আর বেশি দেরি নাই৷ দেশ স্বাধীন হতে চলেছে…’
খলিল সাহেব বলেন, ‘আর সবাই কোথায় ?’
‘অন্য জেলে থাকতে পারে৷’
‘তা পারে৷’ খলিল সাহেব মাথা নাড়েন৷
এই একটা সান্ত্বনা হয়তো তিনি সাফিয়া বেগমকে দিতে পারবেন৷ ঢাকা জেলে আজাদ নাই৷ অন্য কোনো জেলে থাকতে পারে৷ তিনি ধীরে ধীরে কারাগার চত্বর ত্যাগ করেন৷
মালিবাগে যান আজাদের মায়ের কাছে৷
সাফিয়া বেগম দরজা খুলে তাঁর দিকে তাকান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে৷ তিনি বোঝার চেষ্টা করেন, কী নিয়ে এসেছে খলিল৷ সুসংবাদ, নাকি দুঃসংবাদ৷
‘কী খবর খলিল, কোনো খোঁজ পেলে ?’ তিনি কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেন৷
‘না৷ এই জেলখানায় নাই৷’
‘তাহলে অন্য কোনো জেলখানায় রেখেছে!’ সাফিয়া বেগম অকম্পিত স্বরে বলেন৷
খলিল জোরে বলে ওঠেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ বুবু৷ অরা তা-ই কইল৷ বরিশালের মুক্তিযোদ্ধারে আইনা রাখছে ঢাকায়, ঢাকার ছেলেদের ঢাকার বাইরে পাঠায়া দিছে৷’
‘তুমি বসো৷ তোমাকে চা দেই৷’ সাফিয়া বেগম রান্নাঘরের দিকে চলে গেলে খলিল একটা বড় শ্বাস ফেলে যেন মুক্তির আস্বাদ পান৷
এই মুহূর্তটা বড় কঠিন হবে বলে তিনি ভেবেছিলেন৷ কী করে তিনি আজাদের মাকে বলবেন যে আজাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি, এই নিয়ে তিনি সারাটা পথ ভেবে ভেবে সারা হয়ে যাচ্ছিলেন৷
কী রকম শক্ত একজন মহিলা হতে পারেন, খলিল ভাবেন৷
৫৩. মা
৫৪. মা
‘এখন যাইবা৷ চারদিকে গোলাগুলির আওয়াজ, এর মাঝে ?’
‘হ্যাঁ৷’
‘কাইলকা যাই চলো৷’
‘না৷ আজকেই যাব৷’
ডালু জানে তার খালার জেদ, তার খালার তেজ, সে আর ‘না’ করে না৷ সাফিয়া বেগম একটা থলেতে করে মগবাজারে বাসায় যাওয়ার জন্যে জিনিসপত্র গোছগাছ করেন৷ রিকশা জোগাড় করে সাফিয়া বেগমকে নিয়ে ডালু রওনা হয় মগবাজারের বাসার দিকে৷ একটা দোকানের সামনে এসে সাফিয়া বেগম বলেন, ‘এই রিকশা, একটু দাঁড়ান না৷’
ডালু বলে, ‘কেন ?’
সাফিয়া বেগম তার হাতে ১০টা টাকা দিয়ে বলে, ‘দু সের ভালো চাল কেনো তো বাবা৷ আলু পেঁয়াজ মরিচ তেল সাথেই আছে৷’
ডালু কোনো কথা না বলে চাল কিনে আনে৷
ততক্ষণে সন্ধ্যা ঝুপ করে নেমে এসেছে এই ঢাকায়৷ শীতও পড়েছে প্রচণ্ড৷ চারদিকে জনতার কন্ঠে জয় বাংলা ধ্বনি৷ মাঝে মধ্যে গুলির শব্দে প্রকাশ পাচ্ছে জয়োল্লাস৷
মগবাজারের বাসায় আসতে আসতে অন্ধকার ঘন হয়ে নামে৷ বারান্দাটা অন্ধকার, অন্ধকারেই তালা খুলতে গিয়ে আজাদের মা বোঝেন তালার ওপরে ধুলার আস্তর পড়ে গেছে৷ তালা খুলে ভেতরে ঢুকে লাইটের সুইচ অন করলে বোঝা যায় বিদ্যুৎ নাই৷ ডালু দোকানে গিয়ে মোমবাতি কিনে আনে৷ দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে মোমবাতি জ্বালানো হয়৷ ঘরদোরেও ধুলার প্রলেপ পড়ে গেছে৷ মা ঘরদোর সাফসুতরো করে ফেলেন দ্রুত৷ ছেলে ফিরে এসে দেখুক ঘর অপরিষ্কার, এটা হতে দেওয়া যায় না৷ মোমবাতি হাতে নিয়ে মা রান্নাঘরে যান৷ হাঁড়ি-পাতিল এখানে যে কটা ছিল সেসব মাকড়সার জালে ছেয়ে গেছে৷ তিনি একটা হাঁড়ি পেড়ে নিয়ে লেগে পড়েন চাল ধুতে৷
ডালু জিজ্ঞেস করে, ‘আম্মা, কী করো ?’
‘একটু ভাত রাঁধি৷’
ডালু আর কথা বাড়ায় না৷ খালা তার কার জন্যে ভাত রাঁধছে, এ সে ভালো করেই জানে৷ সে চোখের জল গোপন করে৷ বাইরে তখনও হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার ভেসে আসছে : জয় বাংলা৷
ভাতের চাল সেদ্ধ হচ্ছে৷ বলক উঠেছে৷ ভাতের মাড়ের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে রান্নাঘরের বাতাসে৷ মা অনেক যত্ন করে রাঁধছেন এই ভাতটুকু৷ ভাত হয়ে গেলে তিনি হাঁড়িটা মুছে আবার চুলার ওপরই রেখে দেন৷ কিছুক্ষণ গরম থাকবে৷ আজাদ কখন আসবে, বলা তো যায় না৷
চুলার আগুন এক সময় নিভে আসে৷ ডিসেম্বরের শীতের স্পর্শে ভাত ঠাণ্ডা হয়ে আসে হাঁড়িতেই৷ সারা রাত কেটে যায় আশায় আশায়৷ মোমবাতি ক্ষয় হতে হতে এক সময় শেষ হয়ে যায়, আলো যায় নিভে৷ মেঝেতে একটা পাটি আর পাটির ওপরে একটা চাদরে বিছিয়ে শুয়ে থাকেন সাফিয়া বেগম৷ দু চোখের পাতা তাঁর কখনও এক হয় না৷ মাঝে মধ্যে উঠে বসেন৷ রাত ভোর হয়, ফজরের আজান ভেসে আসে মগবাজারের মসজিদ থেকে৷ আজাদ ফেরে না৷
সকালবেলা রোদ উঠলে সাফিয়ার বোনের ছেলেমেয়েরাও চলে আসে এই বাসায়৷ চঞ্চল বলে, ‘আম্মা, মগবাজারের মোড়ে পাড়ার পোলাপান আজাদ ভাইয়ের নামে ব্যানার টাঙাইছে৷’
‘কেন ? চল তো দেখে আসি৷’
‘চলো৷’
চঞ্চলের সঙ্গে মা হাঁটতে থাকেন৷
মগবাজারের চৌরাস্তায় এসে দেখেন, পাড়ার ছেলেরা ব্যানার তুলেছে, ‘শহীদ আজাদ, অমর হোক’৷ তিনি বলেন, ‘এইসব কী তুলেছ, এইসব নামাও, আজাদ তো বেঁচে আছে, ও তো ফিরবে!’
৫৫. মা
মুক্তিযোদ্ধারা বেরিয়ে আসে৷ কাজী ইকবাল, মাহবুবুল্লাহসহ অনেককেই দেখা যায় সেই দলে৷ তারা হাবিবুল আলম আর ফতেহর সঙ্গে মোলাকাত করে৷ শাহনাজ তাদের হাতে ফুল তুলে দেয়৷ মুক্তিপ্রাপ্ত অন্য মুক্তিযোদ্ধা আর যুদ্ধবন্দিরাও তাদের ঘিরে ধরে৷ তারা চিৎকার করে ওঠে : জয় বাংলা৷ তাদেরকেও ফুল দিয়ে বরণ করে শাহনাজ৷ তাদের অনেকেরই চোখে জল৷ তারা কেউ কেউ জেলখানা চত্বরে হাঁটু গেড়ে বসে মাথাটা ঠেকায় মাটিতে, মাটিকে চুমু দেয়, মুক্ত ভূমিকে, দু হাত মাটিতে বুলিয়ে নিয়ে সেই হাত বোলায় চোখে মুখে মাথায়…
শাহনাজ, হাবিবুল আলম আর ফতেহ তাদের জিপে ফিরে আসে৷ সঙ্গে নিয়ে আসে চুল্লু ভাই আর সামাদ ভাইকে৷ গত কয়েক মাসে শাহনাজসহ হাবিবুল আলমের বোনেরা তাদের দিলু রোডের বাসায় এত অস্ত্র নেড়েছে, পরিষ্কার করেছে যে, একেকজন পরিণত হয়েছে একেকটা অস্ত্র-বিশেষজ্ঞে৷ আবার মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বাসায় আসত, বিশেষ করে আহত হওয়ার পরে কয়েক দিন জুয়েল ছিল তাদের বাসায়, সেই সূত্রে জুয়েল, বদি, রুমী, আজাদদের জন্যে তাদের এক ধরনের মায়া জমে গেছে৷ শাহনাজ আগে থেকেই জানত, ঢাকা কারাগারে চুল্লু ভাই আর সামাদ ভাই ছাড়া ঢাকার গেরিলাদের আর কেউ নাই৷ তবু তার একটা ক্ষীণ আশা ছিল, হয়তো জুয়েল ভাইকে পাওয়া যাবে, রুমী-বদি-আজাদদের দেখা মিলবে৷ কিন্তু যখন বাস্তবতা এসে তার সেই ক্ষীণ আশাটুকুকে উড়িয়ে নিয়ে গেল, শাহনাজ কিন্তু ভেতরে ভেতরে মন খারাপ করে৷ জিপে উঠে সে আলমের হাত থেকে স্টেনগান তুলে নিজের হাতে নেয়৷ তারপর যে হাতে এত দিন সে শুধু অস্ত্র পরিষ্কারই করেছে, আজ মুক্ত বাংলাদেশের আকাশ লক্ষ্য করে সেই হাত দিয়ে সে গুলি ছুড়তে থাকে৷ তাকে গুলি করতে দেখে মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিরা আবার চিৎকার করে ওঠে : জয় বাংলা৷ সবাই ধরেই নেয় শাহনাজের মতো মেয়ে গুলি ছুড়ছে আনন্দে৷ কিন্তু শাহনাজ জানে না, গুলি কেন সে ছুড়ছে ? বিজয়ের আনন্দে, ভাইকে ফিরে পাওয়ার প্রশান্তিতে, নাকি অন্য সব গেরিলাকে খুঁজে না পাওয়ার ক্ষোভে! গুলির আওয়াজে জেলখানার সানশেডে বাসা বানানো পায়রাগুলো উড়ে উঠে ছেয়ে ফেলে নাজিমুদ্দিন রোডের আকাশ-বাতাস৷
জিপ স্টার্ট নেয়৷ একটু একটু করে তারা ছেড়ে আসছে জেলখানা চত্বর৷ ১৭ই ডিসেম্বরের এই দুপুর রোদে এমনভাবে ঝলকাচ্ছে, যেন বিজয়ের জমক এসে লেগেছে আকাশে-বাতাসে৷ মুক্ত পায়রাগুলো যেন ছড়াচ্ছে শান্তির আশ্বাস৷ শাহনাজ স্টেনগানটা হাতে নিয়েই বারবার পেছনে তাকায়, কারাগারের দরজার দিকে তার চোখ যেন আরো কাউকে কাউকে খোঁজে৷
এক সময় কারাগারের দেয়াল তার দৃষ্টিসীমা থেকে অদৃষ্ট হয়ে যায়৷
৫৬. মা
সন্ধ্যার পরে বিদ্যুৎ নাই বলে মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে আছেন জাহানারা ইমাম, তাঁর দু বাহুর ভেতরে জামী, বাইরে গাড়ির শব্দ, তারপর দরজায় করাঘাত, কাঁধে স্টেন ঝুলিয়ে কয়েকটা তরুণ দাঁড়িয়ে, তিনি বলেন, ‘এসো বাবারা এসো৷’
‘আমি মেজর হায়দার, এ শাহাদত, এ আলম, এ আনু, ফতেহ, জিয়া আর এই যে চুল্লু৷’
বড় গোঁফ, জুলফি নেমে এসেছে দাড়ির ধরনে, মিলে গেছে গোঁফের সঙ্গে, আলম বলে, ‘চুল্লু জেলে ছিল ৷ আমি নিজেই এদের রিলিজ অর্ডারে সাইন করে এদের ছাড়িয়ে নিয়ে এলাম৷’
আলমের চাইনিজ স্টেনগানটা জাহানারা ইমাম নিজের হাতে তুলে নেন৷ তারপর তুলে দেন জামীর হাতে৷
৫৭. মা
তার দুঃখের কারণ কেউ সঠিকভাবে বলতে পারে না৷ তবে নাগরিকেরা অনুমান করে, যুদ্ধের পরে সব মুক্তিযোদ্ধাই তো একে একে ফিরে আসছে, ফিরে এসেছে, হয়তো এই মেয়েটি যাঁর জন্যে অপেক্ষা করছিল, সে ফেরেনি৷
কার জন্যে অপেক্ষা করছিল মেয়েটা ?
নগরবাসী সেটা আর অনুমান করতে পারে না৷ কারণ যারা মিলিকে চেনে, তারা আজাদকে চেনে না৷ আর যারা আজাদের কথা জানে, তারা মিলির কথা জানে না৷
আর মিলিই তো একমাত্র মেয়ে নয় এই নগরে, যে পথের দিকে তাকিয়ে থেকে অশ্রু বিসর্জন করছে ? আর আজাদই তো একমাত্র ছেলে নয় যে যুদ্ধের পরে দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে কিন্তু ফিরে আসছে না৷
নগরবাসী একদিন মিলির কথা ভুলেই যায়৷
১৪ বছর পর, আজাদের মায়ের মৃত্যু মুক্তিযোদ্ধাদের আবার একত্র আর আজাদের বিষয়েই স্মৃতিদষ্ট করে তোলার পরে, কারো কারো মনে হতে থাকে, তাই তো, এ রকম একটা মেয়ে তো ছিল, কী যেন নাম, যে শুধু কাঁদত৷
মিলি হয়তো নীরবে অশ্রুবর্ষণ করেছে, মুখে শব্দ করেনি, কিন্তু এমন মেয়েও তো কিছু থেকে থাকবে, যারা প্রকাশ্যে অশ্রুও বর্ষণ করেনি, দীর্ঘশ্বাসটুকুও চেষ্টা করেছে গোপন করতে, অশ্রুটুকু বিসর্জন দিয়েছে গোপনভাবে, নিভৃতে, কাউকে জানতে না দিয়ে…
বাশারের জন্যে কি কেউ কাঁদেনি, জুয়েলের জন্যে, রুমীর জন্যে, বদির জন্যে, কী সুন্দর থোকা থোকা গুচ্ছ গুচ্ছ নাম, নক্ষত্রপুঞ্জের মতো, অসংখ্য নাম, নিযুত শহীদের নাম, এদের প্রত্যেকের জন্যে, অনেকের জন্যে…নিশ্চয় কেঁদেছে, সম্মিলিত, একাকী, প্রকাশ্য, সংগোপন কত কান্না কত অশ্রু ভাপ হয়ে মিশে গেছে আকাশে বাতাসে, কে তার হিসাব রেখেছে ?
তরুণীদের কান্নার হিসাব কেউ রাখেনি, কিন্তু শহীদদের মায়েদের প্রকাশ্য কান্না, অশ্রুপাত, ব্যক্তিগত প্রতীক্ষা আর দীর্ঘশ্বাসের চিহ্নগুলোই বা কাল কোথায় ধরে রেখেছে ?
জাহানারা ইমাম আসেন আজাদের মায়ের মালিবাগের ডেরায়৷ জাহানারা ইমাম খোঁজখবর নেন অন্য মায়েদের, জুয়েলের মা কোথায়, বদির মা কোথায়, বাকেরের মা কোথায়, এইসব৷ আজাদের মা সবাইকে বলেন, আজাদ অবশ্যই বেঁচে আছে৷ সে ফিরে আসবেই৷ এই বিশ্বাস তিনি পান জুরাইনের বড় হুজুরের কাছ থেকে, আর তখন নানা জনরব শোনা যেতে থাকে, একজন এসে বলে সে আজাদকে দেখেছে লন্ডনে, টিউব রেলে, তার পাশের আসনেই বসা; আজমির শরিফ থেকে একজন আত্মীয় ফিরে এসে বলেন, ওখানকার খাদেম বলেছে, আজাদ বেঁচে আছে, ফিরে আসবে… একজন পাওয়া যায় প্রত্যক্ষদর্শী, পেশোয়ারে আজাদকে দেখা গেছে…