আজ ৭ই মার্চ ১৯৭১ ৷
টগর সকাল থেকেই উত্তেজিত ৷ আজ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেবেন ৷ ১লা মার্চই বঙ্গবন্ধু হোটেল পূর্বাণীতে ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ঘোষণা তিনি দেবেন ৭ই মার্চ, জনসভা করে, রেসকোর্স ময়দানে ৷ এরই মধ্যে দেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে ৷ পুরোটা দেশ যেন এক উত্তাল বিক্ষুব্ধ সমুদ্র, সব রাজপথ আজ যেন মিছিল, প্রতিটা মানুষ আজ মিছিলম্যান, প্রতিটা কন্ঠ আজ যেন স্লোগান ৷ মিছিল, মিটিং, প্রতিবাদ, ব্যারিকেড, কারফিউ-জারি, কারফিউ ভঙ্গ, গুলি ৷ রোজ রাজপথে গুলি খেয়ে মারা যাচ্ছে মানুষ ৷
এ অবস্থায় গতকাল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভাষণ দিয়েছেন ৷ তাতে নতুন কোনো কথা নাই ৷ ২ শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেছেন ৷ আর বলে দিয়েছেন, ‘আমি এখনও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আছি, পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক আছি ৷ আমি যতক্ষণ আছি, পাকিস্তানের পুরোপুরি অখণ্ডতা বজায় রাখার চেষ্টা আমি করবই ৷ আমি জেনেশুনেই পূর্ব পাকিস্তান কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছি যেন আইন অমান্যকারীদের লুট, হত্যা ও অগি্নসংযোগ করার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয় ৷’
তাঁর এই ধমক শুনে কি বঙ্গবন্ধু পিছিয়ে যাবেন ? নাকি আজ রেসকোর্সের ভাষণে তিনি বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন ? সর্বত্র এই আলোচনা ৷
তরুণ টগর যে এত কিছু বোঝে তা নয় ৷ সে শুধু বোঝে আজ রেসকোর্স ময়দানে যেতে হবে ৷
আজাদ বেরিয়ে গেছে দুপুরবেলাতেই ৷ তার সঙ্গে আছে তার বন্ধুরা ৷ আশরাফুল হক, জুয়েল, হ্যারিস, ইব্রাহিম সাবের প্রমুখ ৷ কে আছে এই ঢাকায়, যার যৌবন আছে, কিন্তু যে আজকের জনসভায় যাবে না ? আজকে সবাই উঠে গেছে রাজনীতির ঊর্ধে, দলের পরিচয়ের ঊর্ধে, রেসকোর্স ময়দানে সবাই যাচ্ছে দেশের টানে ৷
জুয়েল বলে, ‘আশরাফুল যখন বউ ছাইড়া আসতে পারছে, তখন সবাই আজকা মিটিংয়ে যাইব ৷ আইজকা আর মিটিংয়ে জায়গা পাওয়া যাইব না ৷’
ইব্রাহিম সাবের বলে, ‘আমার কিন্তু আজকে শেখ সাহেব কী বলেন, এইটা বড় ইন্টারেস্ট না ৷ আমার বড় ইন্টারেস্ট আরেকটা ৷ আমি চোখ-কান খোলা রাখব আর একজন নেতার দিকে ৷ বল তো কে ?’
আশরাফুল বলে, ‘কে ?’
ইব্রাহিম সাবের বলে, ‘নাজিম কামরান চৌধুরী ৷’
আজাদ, জুয়েল, হ্যারিস সবাই হো হো করে হেসে ওঠে ৷
আশরাফুল মুখে কৌতূহল ফুটিয়ে তুলে বলে, ‘ক্যান ?’
ইব্রাহিম সাবের বলে, আমাদের বন্ধু নাজিম কামরান চৌধুরী, ডাকসুর ডাকসাইটে নেতা, যিনি কিনা ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থান থাইকাই গণআন্দোলন সমর্থন করতেছেন, তিনি তার সিলেটি বচনে কেমন ভাষণ দেন, এটাই আমার প্রিন্সিপ্যাল অ্যাট্রাক্শন ৷
হ্যারিস বলে, ‘আমার মনে হয় না নাজিম ভাই আজকে ভাষণ দেবেন ৷ আজকে শুধু বঙ্গবন্ধু একাই বলবেন ৷ আর কোনো বক্তারই আজকে কোনো চান্স নাই ৷’
ইব্রাহিম সাবের বলে, ‘দেখি গিয়া ৷’
তারা হাঁটছে ৷ মার্চের আকাশ ঘন নীল ৷ রোদটা গায়ে মিষ্টিই লাগছে ৷ একটু একটু করে বইছে বসন্তের বিখ্যাত বাতাস ৷
জুয়েল বলে, ‘এই, দেখছস, বাতাসটা কত মজা লাগতেছে ৷ কপালের ঘামের মধ্যে বাতাস লাগলে মনে হইতেছে, বউ আঁচল দিয়া বাতাস করতেছে ৷ আশরাফুল, ক তো দেখি এই বাতাসের নাম কী ?’
আশরাফুল বলে, ‘বাতাসের আবার নাম কী ?’
জুয়েল বলে, ‘আছে ৷ এই বাতাসটার নাম হইল ছমিরন বিবি ৷’
আজাদ বলে, ‘যাহ্ ৷’
জুয়েল বলে, ‘আমরা কই ছমিরন বিবি ৷ আর বইয়ের ভাষায় সমীরণ ৷ মৃদুমন্দ সমীরণ ৷ হালায় মৃদুটা না হয় বুঝলাম, মন্দটা বুঝলাম না ? ছমিরন বিবির মনে হয় ক্যারেক্টার লুজ ৷’
আজাদরা হাঁটে ৷ মগবাজার থেকে রেসকোর্স ময়দান, বেশি দূর নয় ৷ আর পুরোটা ঢাকা যেন আজ ছুটে চলেছে রেসকোর্সের দিকে ৷ কত দূরদূরান্ত থেকে আসছে এইসব মানুষ-কে জানো ? সবার হাতে লাঠি, কারো কারো হাতে রড ৷ ওই যে টঙ্গী থেকে আসছে শ্রমিকদের মিছিল ৷
‘হায় হায় দ্যাখো দ্যাখো’-হ্যারিস আঙুল তুলে দেখায়, একটা শাদাছড়ি মিছিল যাচ্ছে ৷ সবাই অন্ধ ৷ অন্ধরাও যাচ্ছে আজ মিছিলে ৷
জায়েদ রওনা দিয়েছিল একটু বেলা করে ৷ মগবাজার থেকে রমনা পর্যন্ত এসে সে আর এগোতে পারে না ৷ কাকরাইল মোড় পর্যন্ত গিজগিজ করছে মানুষ ৷ সে ভিড়ের মধ্যে তার ছোট্ট শরীরটা সুইয়ের মতো গলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ৷ কিন্তু সমস্যা করছে পায়ের স্পঞ্জের স্যান্ডেলগুলো ৷ লোকের পায়ের পাড়া পড়ে স্যান্ডেলের গোড়ায়, স্বাধীনমতো এগোনো যায় না ৷ দুরো শালার স্যান্ডেল ৷ সে পা থেকে স্যান্ডেল দুটো খুলে হাতে নেয় ৷ তারপর তার এগোতে সুবিধা হয় বটে, কিন্তু পাবলিকের গায়ে স্যান্ডেলের ছোঁয়া লাগতে থাকে ৷ না, এটা অন্যায় হবে ৷ এরা সবাই জয় বাংলার লোক ৷ এদের গায়ে স্যান্ডেলের স্পর্শ লাগলে এদের অকল্যাণ হতে পারে ৷ সে স্যান্ডেল দুটো বিসর্জন দেয় জনতার ভিড়ে ৷
আকাশে হঠাৎই হেলিকপ্টার উড়তে দেখা যায় ৷ জনতা ক্ষণিকের জন্যে গুঞ্জরণ করে ওঠে ৷ তারা সবাই তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে ৷ ব্যাপার কী ? হেলিকপ্টার কেন ? বোমা ফেলবে নাকি ? নাকি বাঙালিকে ভয় দেখাচ্ছে ? বাঙালি ভয় পাওয়ার পাত্র নাকি ?
জাহানারা ইমাম তার বাড়ির ছাদে উঠেছেন রেডিও নিয়ে ৷ একটু আগেও রেডিওতে আমার সোনার বাংলা গান হচ্ছিল ৷ এখন কোনো সাড়াশব্দ নাই ৷ ব্যাপার কী ? তার স্বামী শরীফ ইমাম, তার দুই ছেলে রুমী আর জামী, বাড়ির কাজের লোক সবাই গেছে শেখ মুজিবের জনসভায় ৷ তিনি ভেবেছিলেন রেডিওতে এই ভাষণ সরাসরি প্রচার করা হবে যখন, তিনি রেডিওতেই শুনবেন ৷ এখন দেখি কোনো আওয়াজ হচ্ছে না ৷ ব্যাপার কী ? ছাদে উঠে তিনি দেখতে পান হেলিকপ্টারের চক্কর ৷ তার বুকটা একটু কেঁপে ওঠে ৷
টগর লম্বায় তেমন বেশি নয় ৷ এমন গাদাগাদি ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে মঞ্চটা দেখতে পাচ্ছে না ৷ সে এখন করেটা কী ? বঙ্গবন্ধুকে তার এক নজর দেখা চাই-ই চাই ৷ ওই তো একটা গাছ দেখা যায়, তাতে একজন দুজন ছেলে-ছোকরা উঠে পড়েছে ৷ সেও তো এই কাজটা পারে ৷ গাছে ওঠার ব্যাপারে তার দক্ষতা সে পটুয়াখালীর দিনগুলোতে প্রমাণ করেছে ৷ সে তাড়াতাড়ি গাছের নিচে চলে যায় ৷ একটা কৃষ্ণচূড়াগাছ ৷ গোড়াটা বেশ লকলকে, ডালপালাহীন ৷ চড়াটা সহজ হবে না ৷ সুপারিগাছে ওঠার মতো করে বেয়ে বেয়ে উঠতে হবে ৷ তাই সই ৷ টগর গাছে উঠতে লেগে যায় ৷ গাছের একটা সুবিধাজনক জায়গায় সে পৌঁছয় ৷ একটা ডালের ওপরে পা, একটা ডালের ওপরে তার পশ্চাদ্দেশ ঠেকিয়ে সামনে আরেকটা ডালকে সে হাতে ধরার জন্যে পেয়ে যায় ৷ এই জায়গায় এসে তার নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান আর বুদ্ধিমান বলে মনে হয় ৷ সে পুরোটা মাঠ, গাছের পাতার আড়ালে পড়া কিছু কিছু অংশ ছাড়া, বেশ আরামেই দেখতে পাচ্ছে ৷ ওই যে নৌকার মতো করে বানানো মঞ্চটা ৷ চারদিকে কলরেডির মাইক্রোফোন ৷ হায়, কত মানুষ এসেছে! মানুষ ছাড়া তো আর কিছুই দেখা যায় না ৷ ওই দ্যাখো, কত কত মহিলাও এসেছেন ৷ সবার হাতে লাঠি, অনেকের হাতে সবুজের পটে লাল সূর্যের ভেতরে সোনালি মানচিত্র-খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ৷
আর ওই দ্যাখো, গাছটার একটু ওপরের দিকে একটা পাখির বাসাও দেখা যাচ্ছে ৷ বসন্তকালে পাখিরা বুঝি ঘর বাঁধে! ভালো করে তাকিয়ে টগর বোঝার চেষ্টা করে ভেতরে ডিম আছে কি নাই ৷
বাঙালির একটা সমস্যা আছে ৷ একজনকে সে যা করতে দেখে, সে নিজেও তা-ই করে বসে ৷ তার দেখাদেখি আরো আরো মানুষ এই কৃষ্ণচূড়াগাছটায় ওঠার চেষ্টা করছে ৷ ‘ভাই, করেন কী ?’ টগর চিৎকার করে বলে, ‘এই ভাই, কৃষ্ণচূড়ার ডাল খুব নরম ৷ এত লোক উইঠেন না ৷ ভাইঙ্গা যাইব ৷’
কিন্তু মাইকের গগনবিদারী আওয়াজ, জনসমুদ্রের কল্লোলের তলায় তার একাকী কন্ঠ কোথায় মিলিয়ে যায় ৷
লোকেরা গাছ পেয়ে উঠতেই থাকে ৷
তারপর যা হওয়ার তা-ই হয় ৷ এক সময় তাকে নিয়ে গাছের একটা ডাল চড়চড় শব্দ করে ভাঙতে থাকে ৷ টগরের সুবিধা ছিল, সে আরেকটা ডাল ধরে ছিল ৷ সে সেই ডাল দু হাতে ধরে বাদুড়ের মতো ঝুলতে থাকে ৷ এবার সে আরেকটা ডালে পা রাখতে যাবে, কিন্তু তার আগে দেখতে পায় তার হাতে ধরা ডালটায় তার মতো আরো আরো মনুষ্য-বাদুড় ঝুলে আছে, আর এই চিকন ডালটাও সেই ভর সহ্য করতে না পেরে চড়চড় শব্দ করতে শুরু করেছে ৷ টগর বুকে সাহস সঞ্চয় করে ৷ ডালটা ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছে ৷ মাটির সঙ্গে তার দূরত্ব আসছে কমে ৷ সে একটা লাফ দেবার কথা ভাবে ৷ তাকে লাফ দিতে হয় না, শুধু হাতের মুঠো আপনা-আপনিই আলগা হয়ে এলে সে নিচে পড়ে যায় ৷ ভাগ্যি নিচে ঘাস ছিল ৷ আর ততক্ষণে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা জনতা পরিমড়ি করে চারপাশে ঝাপ্টা তুলে সরে গিয়েছে ৷ টগরের পা মাটিতে পড়ে ৷ আর টাল সামলাতে না পেরে সে সামনের দিকে উপুড় হয়ে পড়ে যায় ৷ এটাও তার জন্যে বিপরীতে হিত হয় ৷ সেকেন্ডখানেক পরই গাছের ডালটা এসে তার পায়ের ওপর পড়ে ৷ পা বলেই ব্যথাটা সহ্য করা যায় ৷ মাথা হলে সইত কি না, আল্লাহ জানে ৷ টগর উঠে বসে ৷ তাকে সাহায্য করতে দুজন হাত বাড়িয়ে দেয় ৷ একজনের হাত ধরে উঠতে গিয়ে তার চোখ পড়ে মাটিতে পড়ে থাকা একটা পাখির বাসার দিকে ৷ আহা, বাসাটা মাটিতে পড়ে গেছে ৷ ভেতরে ডিম দেখা যাচ্ছে ৷ মানুষের পায়ের চাপে না ডিম নষ্ট হয়ে যায় ৷ টগর পাখির বাসাটা কুড়িয়ে বুকের কাছে আলতো করে ধরে রাখে ৷ ভিড়টা একটু কমলে সে বাসাটাকে আবার গাছের ওপরের দিকের ডালে রেখে আসবে ৷ বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়েছেন ৷ মুহূর্তে সমস্ত জনসমুদ্র উৎকর্ণ হয়ে ওঠে ৷
বঙ্গবন্ধু জমাট জলের মেঘের মতো মায়া আর বজ্রমাখা কন্ঠে বলে ওঠেন : আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি ৷ আপনারা সবই জানেন, সবই বোঝেন ৷
নিজের পায়ের ব্যথা ভুলে গিয়ে টগর হা করে গিলছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ৷ সে সমস্ত ইন্দ্রিয় কেন্দ্রীভূত করে শুনতে চাইছে স্বাধীনতা শব্দটা ৷ ২৩ বছরে বাঙালির ওপর পরিচালিত পাকিস্তানিদের শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালির সংগ্রামের কাহিনী বর্ণনা করে শেখ মুজিব বলেন, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার মানুষকে হত্যা করা হয়, তোমাদের প্রতি আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ করে তোলো ৷ তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে…
রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব ৷ এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ ৷ এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম ৷ এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম ৷
তখন টগর যেন আর কিছুতেই নিজের মধ্যে থাকে না ৷ স্বাধীনতা শব্দটা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে তাকে আকাশে তুলে ধরে, সমস্তটা জনসমুদ্র একেবারে গর্জন করে উঠেছে, তার ঢেউয়ের মাথায় চড়ে টগর যেন ভাসছে আর ভাসছে… তখন আশ্চর্য হয়ে টগর লক্ষ করে, তার হাতে ধরে রাখা পাখির বাসায় ডিম দুটো ফেটে যায়, দুটো বাচ্চা বেরিয়ে আসে, আর দুটো খয়েরি রঙের পাখি বিমানের মতো নেমে আসে আকাশ থেকে, পা দুটো নামিয়ে তারা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যায় শাবক দুটোকে, আর আকাশে উড়ে গিয়ে চক্কর দিতে দিতে তারা চিৎকার করে ডেকে ওঠে স্বাধীনতা স্বাধীনতা বলে, তখন আরো আরো পাখি উড়ে ওঠে আকাশে, বিচিত্র সব পাখি, তারা একটা যেন আরেকটাকে ডেকে বলছে স্বাধীনতা স্বাধীনতা, টগরের সমস্ত পৃথিবীজুড়ে তখন আর কোনো শব্দ নাই, কেবল স্বাধীনতা ছাড়া…
জাহানারা ইমাম চিন্তিত ৷ রেডিওতে শেখ মুজিবের ভাষণ সরাসির প্রচারিত হওয়ার কথা ছিল, হলো না কেন ? কী বললেন শেখ সাহেব ? তিনি বাসায় একা একা পায়চারি করছেন ৷ আর তার সঙ্গে আছে কিটি, বিদেশিনী তরুণ-অতিথি ৷
ডোরবেল বেজে ওঠে ৷
জাহানারা দরজা খোলেন ৷ স্বামী শরীফ ইমাম, আর তাঁর বন্ধু ফখরুদ্দিন এসেছেন ৷ খানিক পরে আসে গৃহপরিচারক সুবহান ৷ আর সবার শেষে আসে রুমী আর জামী ৷
রুমী দরজা থেকেই নাটকীয় কায়দায় বলতে শুরু করে, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম ৷’
ফখরুদ্দিন বলেন, ‘ভাবি, চা খাওয়ান ৷’ সুবহান চা বানাতে রান্নাঘরে যায় ৷
তারপর শুরু হয় হিসাব-নিকাশ ৷ আজকে কত লোক হয়েছে ? ২০ লাখ নাকি ৩০ লাখ ?
এক সময় রুমী মাথা নাড়তে থাকে ৷ সে বলে, ‘আরে আজকে একটা বড় সুযোগ শেখ সাহেব মিস করলেন ৷ তাঁর উচিত ছিল আজকেই স্বাধীনতা ডিক্লেয়ার করে দেওয়া ৷’
ফখরুদ্দিন সাহেব বলেন, ‘চ্যাংড়া-প্যাংড়ারা কী রকম হঠকারী কথা বলে শুনছেন ৷ আজকে এইখানে স্বাধীনতা ডিক্লেয়ার করলে তো পাকিস্তানি মিলিটারি এখনই ঝাঁপিয়ে পড়ত ৷ সারা দুনিয়াকে বলত, দ্যাখো, ওরা রাষ্ট্রদ্রোহী, ওরা বিচ্ছিন্নতাবাদী ৷ বরং আমি মনে করি, শেখ সাহেবের ভাষণটা এর চেয়ে ভালো করে আর দেওয়া যেত না ৷ তিনি গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন ৷ যার যা আছে, তাই নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে হবে… না যেন কী বললেন না ৷ আর শেষ করলেন কী দিয়ে… এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ৷ স্বাধীনতাও ডিক্লেয়ার করা হলো, আবার দায়দায়িত্ব সব পশ্চিমাদের ঘাড়ে চাপানো হলো ৷ মাথা গরম করে তো কিছু হবে না ৷ ডিপ্লোম্যাটিক হতে হবে…’
রুমী ঠিক যেন এই যুক্তি মেনে নিতে পারছে না ৷ সুবহান ততক্ষণে চা দিয়ে গেছে ৷
জামী এল পাশের ঘর থেকে ৷ তার কাছে নতুন খবর ৷ ‘জানো মা, আজ বিকালের প্লেনে জেনারেল টিক্কা খান এসেছে গভর্নর হয়ে ৷’
সবাই খবরটার তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করছে ৷ এক সপ্তাহের মধ্যে দুবার গভর্নর বদল হলো ৷ ব্যাপার কী ?
আজাদ বাসায় ফিরে আসে গভীর রাতে ৷ বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে তারপর ৷
কাপড় পাল্টাতে পাল্টাতে বলে, ‘কই, বাশার কই ৷ তোমাদের কী খবর বলো তো ৷ আজকে মিটিংয়ে কত লোক হয়েছিল ?’
বাশার তখন একমনে একটা বই পড়ছিল ৷ বলল, ‘একটা সোর্স বলছে তিরিশ লাখ ৷ আমার বিশ্বাস হয় না ৷’
টগরকে সামনে পেয়ে আজাদ জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে তুই যাস নাই মিটিংয়ে ?’
‘গেছলাম ৷’
‘কই ছিলি ?’
‘গাছের উপরে উঠছিলাম ৷ ডাল ভাইঙ্গা নিচে পড়ছি ৷ তখন ব্যথা বুঝি নাই ৷ অহন তো হেভি ব্যথা করতেছে ৷’
‘পা ভাঙ্গিস নাই তো ?’
‘না ৷’
‘আয়োডেন লাগা ৷’
‘লাগাইছি ৷’
‘দাদা’-জায়েদ উঁকি দেয় ৷
আজাদ বলে, ‘কিরে জায়েদ, তুই যাস নাই মিটিংয়ে ?’
জায়েদ বলে, ‘রমনা পার্ক পর্যন্ত যাইতে পারছিলাম ৷ মাইনষের গুঁতায় আর যাইতে পারি নাই ৷’
মা আসেন এ ঘরে ৷ তার চোখেমুখে ঘুম ৷ তিনি শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে বলেন, ‘আজাদ এসেছিস ৷ ভাত খাবি না ?’
‘না মা ৷ ক্যাফে ডি তাজে খেয়েছি ৷ তুমি আবার উঠলা কেন ?’
‘দিনকাল ভালো না ৷ তোরা বাইরে থাকলে কি আর আমার ঘুম হয় ৷ এই, রেডিওতে না শেখ সাহেবের ভাষণ প্রচার করার কথা ছিল, করল না কেন ?’
আজাদ বলে, ‘বুঝতে পারলাম না ৷ বাশার, তোমাদের খবর কী বলো তো, রেডিও বন্ধ কেন ?’
বাশার বলে, ‘ভাষণ রিলে করার জন্যে রেডিওর লোকেরা রেডিই ছিল ৷ কিন্তু মার্শাল ল অথরিটি অর্ডার দিয়েছে ভাষণ প্রচার করা যাবে না ৷ এ জন্যে রেডিওর লোকেরা স্ট্রাইক করে সব প্রোগ্রামই বন্ধ করে দিয়েছে ৷’
মা বলেন, ‘তা-ই হবে ৷ তাই তো বলি রেডিওতে কোনো সাড়াশব্দ নাই কেন ? আজাদ, তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড় ৷ যা ৷’
পরদিন সকালবেলা ৷ রোদ এসে পড়েছে জানালার পর্দায়, পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরের মেঝেতে ৷ আজাদ আর আবুল বাশার আজকে তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে উঠেছে প্রধানত গতকালকের উত্তেজনাবশত ৷ কালকের এত এত ঘটনা ঘটে গেল দেশে, আজকের পত্রিকাগুলো সেগুলো নিয়ে কে কী লিখেছে, সেটা দেখা দরকার ৷
তবে আবুল বাশার মর্নিং নিউজ পত্রিকাটা হাতে নিয়েই প্রথমে খুঁজতে থাকে নিজের লেখা নিউজটা ৷ বহু কষ্টে সেটা খুঁজে পায় ৷ তার তৈরি করা খবরের ট্রিটমেন্ট দেখে ভুরু কুঁচকে ফেলে সে ৷ বিড়বিড় করে বলে, ‘থ্রি সি নিউজ করায়া নিয়া সিঙ্গেল কলাম ছাপানোর কী মানে ?’
আজাদের হাতে ইত্তেফাক ৷ তার সামনে চায়ের কাপ ৷ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আজাদ বলে, ‘শোনো, কালকে রেসকোর্সের পাবলিক মিটিং ছাড়া আর কিছু দুনিয়ায় ঘটে নাই ৷ তুমি যে নিউজ করেছ, এটা যে সিঙ্গেল কলাম দিয়েছে, এটাই বেশি ৷ এই দ্যাখো বাঙালি জেগে আছে, রেডিও সেন্টারে অলরেডি বোমা ছোড়া সারা ৷ দাঁড়াও তো রেডিওটা ছাড়ি ৷ আজকে কী অবস্থা, দেখা দরকার ৷’
রেডিওর নব ঘোরাতেই ঢাকা সেন্টার শোনা যায় ৷ খুলেছে তাহলে ৷ একটু পরে ঘোষণা, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাষণ প্রচার করা হবে আজ সকাল সাড়ে ৮টায় ৷’
আজাদ বিছানার কাছে গিয়ে বালিশের নিচ থেকে ঘড়িটা বের করে ৷ আরে, সাড়ে ৮টা তো প্রায় বাজেই ৷ ‘মা, মা’-সে চিৎকার করে ওঠে ৷ ‘মা, মা…’
রান্নাঘর থেকে মায়ের কন্ঠ শোনা যায়, ‘কী, বল ৷’
‘এদিকে আসো ৷ রেডিওতে শেখ সাহেবের ভাষণটা বাজাবে এখন ৷ শুনবা না ?’
‘হাত বন্ধ তো ৷ কচি, কচি, এদিকে আয় তো মা ৷ চচ্চড়িটা তুই একটু দেখ ৷ যেন তলায় না লেগে যায় ৷ নাড়া দিবি ৷’
কচি বলে, ‘তুমি কই যাও ?’
‘শেখ মুজিবরের ভাষণ নাকি হবে ৷ আজাদ ডাকে…’
‘আমি শুনব না ?’
‘তুইও শুনবি ?’
‘শুনব তো ৷’
‘আচ্ছা তাহলে চচ্চড়িটা নামিয়েই রাখি ৷’
আজাদের মা হাত ধুয়ে আঁচলে মুছতে মুছতে আজাদদের ঘরে আসেন ৷ ততক্ষণে ভাষণ শুরু হয়ে গেছে ৷ আজাদ ভলিউম বাড়িয়ে দেয় ৷ জায়েদ, টগর, টিসুও এসে দাঁড়ায় ঘরের ভেতরে ৷ বঙ্গবন্ধু বলে চলেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার মানুষকে হত্যা করা হয়, তোমাদের প্রতি আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো ৷ তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে… এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম…’ স্বাধীনতা কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আবারও টগরের মাথার ওপর দিয়ে হাজার হাজার পাখি উড়তে শুরু করে, যেন ডিম ভেঙে বেরিয়ে আসছে তারা, হাজারে হাজারে, আকাশ ঢেকে দিচ্ছে, আর স্বাধীনতা এই কলতানে মুখর করে তুলছে জগৎটাকে ৷
৩০. মা
‘আজাদ, কই যাস ?’ মা জিজ্ঞেস করেন ৷
‘এই তো, ইস্কাটনে’-আজাদ শার্টটা প্যান্টের ভেতরে ঢোকাতে ঢোকাতে বলে ৷
‘ইস্কাটনে ? ইস্কাটনে কার বাসায় ?’
‘আবুল খায়েরের বাসায় ৷ ক্রিকেট খেলতে ৷’
মা আশ্বস্ত হন ৷ দেশের অবস্থা খুবই খারাপ ৷ ইয়াহিয়া খান যে কী করছে, সে-ই জানে ৷ শেখ মুজিব ভোটে জিতেছে, তাকে তুমি গদি ছেড়ে দাও ৷ সে দেশ চালাক ৷ তা না ৷ ইয়াহিয়া চলছে ভুট্টোর কথামতো ৷ শেখ সাহেব কি সেটা মেনে নেবার মতো মানুষ! নাকি বাঙালিরা তাকে তা মানতে দেবে ৷ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন শেখ সাহেব ৷ সবকিছু তার কথামতো চলছে ৷ যদি মুজিবর বলে, বিকালবেলা অফিস বসবে, তো বিকালবেলাই বসছে ৷ হরতাল হচ্ছে ৷ কিন্তু ইয়াহিয়া কারফিউ দিলে সেটা কেউ মানছে না ৷ রাতের বেলা মিছিল বের হচ্ছে ৷ মিছিলে গুলি চলছে ৷ কতজন যে গুলিতে মারা গেল, ইয়ত্তা নাই ৷ মায়ের বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে ৷ কত মা আজ ছেলে ছেলে বলে কাঁদছে ৷ মা বেঁচে থাকতে ছেলের মৃত্যু, এর চেয়ে দুঃখের বিষয় আর কী আছে মায়ের কাছে ? আহা, আমার ছেলেটাকে সহিসালামতে রেখো মাবুদ ৷ অজানা আশঙ্কায় তাঁর বুকের ভেতরটা কেঁপে কেঁপে ওঠে ৷
আজাদ বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে নিউ ইস্কাটন রোডে আবুল খায়েরের বাসার উদ্দেশে ৷ আবুল খায়ের দারুণ ক্রিকেটার ৷ আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে খেলে নিয়মিত ৷ তাদের বাসার ছাদটাও যেন একটা ছোটখাটো ক্রিকেট মাঠ ৷ ওখানে বেশ ক্রিকেট প্রাকটিস করা চলে ৷ ক্রিকেটের পাশাপাশি চলে আড্ডা ৷ এ ছাড়া আর তাদের কী-ইবা করার আছে ৷ কলেজ, ইউনিভার্সিটি বন্ধ ৷ অফিস-আদালত বন্ধ ৷ রাস্তায় যানবাহন নাই ৷ শুধু আছে মিছিল আর মিটিং ৷ কত সভাই না হচ্ছে ৷ আওয়ামী লীগের, ছাত্রলীগের, ন্যাপের, ছাত্র ইউনিয়নের দু গ্রুপের, কমিউনিস্টদের, লেখক-শিল্পীদের, মিটিংয়ের কোনো শুমার নাই ৷ ধারাবাহিক মিটিং প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে ৷ প্রত্যেকটাতে লোকসমাগম হচ্ছে প্রচুর ৷ ইতিমধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার নকশা করা হয়ে গেছে, বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ছাত্রনেতারা সে পতাকা উত্তোলন করেছে আনুষ্ঠানিকভাবে, পতাকা ওড়ানো হচ্ছে চারদিকে, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি-কে বেছে নেওয়া হয়েছে ৷ বামদলগুলো আহ্বান জানাচ্ছে স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্যে ৷ তারা জনযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে লিফলেট ছড়াচ্ছে ৷ ছাত্ররাও শেখ মুজিবকে চাপ দিচ্ছে স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্যে ৷
সব ঠিক আছে ৷ কিন্তু আজাদরা কী করবে! তারা তো আর কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নয় ৷ কোনো মিটিং মিছিল তাদের জন্যে বসে নাই ৷ তারা তাই ক্রিকেট খেলে আর আড্ডা দেয় ৷ আজাদদের মগবাজারের বাসা থেকে নিউ ইস্কাটন, সামান্যই পথ ৷ হেঁটে যাওয়া চলে ৷ রাস্তাঘাট ফাঁকা ৷ শুধু বস্তির পিচ্চিদের একটা মিছিল দেখা যাচ্ছে ৷ তাদের স্লোগানও খুব মজার ৷ ‘ইয়াহিয়ার দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে’ ৷ দুই হাতে ছেঁড়া জুতা পরে নিয়ে তারা ডাম্বেলের মতো বাজাতে বাজাতে যাচ্ছে ৷
আবুল খায়েরদের বাসার ছাদে গিয়ে দেখা যায়, অনেকেই এসেছে ৷ ইব্রাহিম সাবের খোঁড়াচ্ছে ৷ খেলতে গিয়ে সে চোট পেয়েছে ৷ জুয়েল পরে এসেছে একটা নীল রঙের টিশার্ট ৷ চোখে একটা সানগ্লাস ৷ তাকে দেখাচ্ছে একেবারে ইংরেজি ছবির নায়কের মতো ৷ সৈয়দ আশরাফুল হকের বাসাও কাছেই ৷ সেও এসে গেছে ৷ আশরাফুলও দারুণ ক্রিকেট খেলে ৷ হাবিবুল আলম আসে খানিকক্ষণ পরে ৷ তার বাসা দিলু রোডে ৷ সবাই কাছাকাছিই থাকে ৷ শুধু জুয়েলের বাসা হাটখোলা ৷
আজাদ জিজ্ঞেস করে, ‘জুয়েল, কেমন করে আসলি ?’
জুয়েল বলে, ‘কেমন কইরা আসলাম মানে!’
আজাদ বলে, ‘হরতাল না! গাড়িঘোড়া কিছু আছে নাকি!’
‘পালকি চইড়া আসলাম ৷ ইয়াহিয়া খানের মাইয়ার লগে আমার বিয়ার কথা চলতেছে না ৷ পালকি কইরা নিয়া আইল ৷’
আজাদ বলে, ‘আরে আমি জিগাই হেঁটে আসলি নাকি!’
জুয়েল বলে, ‘না, ক্রলিং কইরা আসলাম ৷ যুদ্ধ শুরু হইলে ক্রলিং করতে হইব তো ৷ তাই হাটখোলা থাইকা চার মাইল রাস্তা ক্রলিং কইরা আসলাম ৷’
আজাদ বলে, ‘আরে জুয়েল খালি পেঁচায় ৷’
কাজী কামাল আসে ৷ লম্বা একটা ছেলে ৷ বাস্কেটবল খেলোয়াড়দের লম্বা হতে হয় ৷ আজাদ ভাবে-অথচ ছোটবেলায় কামাল আর আমি একই সমান ছিলাম ৷
আবুল খায়ের বলে, ‘জুয়েল তো জোকসের হাঁড়ি ৷ উইকেটকিপিং করতে করতে জুয়েল এমন সব জোক্স বলে, ব্যাটসম্যান হাসতে হাসতে আউট হইয়া যায় ৷’
কামাল বলে, ‘একটা জোক ছাড় না জুয়েল ৷’
আবুল খায়ের বলে, ‘সুপারিরটা ক, জুয়েল সুপারিরটা ক ৷’
জুয়েল গা মোচড়ায়-’আরে এক জোক কয়বার কমু ৷ ইয়াহিয়া, আইয়ুব, ভুট্টো-তিনজন গেছে পরকালে ৷ ওইখানে প্রত্যেকরে কওয়া হইছে একটা কইরা ফল আনতে ৷ আইয়ুব খান নিয়া গেছে একটা সুপারি ৷ তার পিছন দিয়া সুপারি দিছে ঢুকাইয়া ৷ তারপর আসছে ইয়াহিয়া ৷ সে নিয়া গেছে কদবেল ৷ তখন হেরা কয় বলে এত বড় ফল আনছ ৷ সর্বনাশ করছ ৷ এইটা তোমার পিছন দিয়া ঢুকাইতে হইব ৷ শুইনা ইয়াহিয়া হাসে ৷ আরে ব্যাক্কল, হাসিস কেন ? ইয়াহিয়া কয়, আমি তো কদবেল আনছি ৷ এরপর ভুট্টো আসতেছে ৷ সে আনছে নারকেল ৷’
জুয়েলের কৌতুক শুনে সবাই হাসে ৷ নির্দোষ হাসি, তা বলা যাবে না ৷ ইয়াহিয়া আর ভুট্টোর শরীরের সঙ্গে বাংলার বাঁশগুলোর কোনো একটা সম্পর্ক স্থাপন করার বাসনায় প্রত্যেকের মন দোষযুক্ত হয়ে আছে ৷
আশরাফুল ব্যাট নিয়ে নেমে গেছে ছাদের ওপরেই ৷ খায়ের বল করছে ৷ খায়ের আশরাফুলকে সাবধান করে দেয়, ‘বল ছাদ থেকে পড়ে গেলে কিন্তু আউট ৷ খালি আউট না, ৬ রান মাইনাস ৷ আর রেলিংয়ে লাগলে ৪ ৷’
কিছুক্ষণ ক্রিকেট খেলা চলে ৷ তারপর আবার সবাই বসে রেলিংয়ের ওপরে ৷ আবার জমে ওঠে আড্ডা ৷ দেশের কী হবে ? ইয়াহিয়া আসলে কী চায় ? ইন্টার কন্টিনেন্টালে আলোচনার নামে কী হচ্ছে! শেখ মুজিব কি ভুল করছেন! ছাত্রনেতারা, চার খলিফা কেন তাহলে চাপ দিয়ে স্বাধীনতা ডিক্লেয়ার করাচ্ছেন না ৷
রুমী আসে ৷ এলিফ্যান্ট রোড থেকে হেঁটে আসায় তার চোখমুখ লাল হয়ে গেছে ৷ তার গাল দুটো মেয়েদের মতো দেখাচ্ছে ৷ আসলে সে হলো সর্বকনিষ্ঠ ৷ কিন্তু তার কথাবার্তায় একটা বুদ্ধিজীবী-বুদ্ধিজীবী ভাব আছে ৷ সে বলে, ‘এভাবে হবে না ৷ লড়াই করে স্বাধীনতা আনতে হবে ৷ একদিকে আলোচনার নামে প্রহসন চলছে, আরেকদিকে প্লেনে করে মিলিটারি আনছে ৷ আমার কিছু ভালো লাগছে না ৷ ঘটনা খুব খারাপ দিকে মোড় নিচ্ছে ৷ মাও সে তুংয়ের লাইন নিতে হবে ৷ গণযুদ্ধের রণনীতি বইয়ে আছে না…
জুয়েল তার কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘আইসা পড়ছে আমাদের তাত্তি্বক ৷ শোনো, এক মাইয়া ৷ আমগো গাঁয়ের মাইয়া ৷ তার সাথে বিয়া হইছে এক প্রফেসরের ৷ মহাপণ্ডিত ৷ বাসর রাতে প্রফেসর সাব খালি লেকচার দেয় ৷ কয়, ফ্রয়েড বলেছেন… এইভাবে এক রাত যায়, দুই রাত যায়, ফ্রয়েড আর শেষ হয় না ৷ মাইয়া কয়, আপনের যন্ত্রপাতি সব ঠিক আছে তো… তাইলে লেকচার দেন ক্যান ?
প্রফেসর কয়, অহনও পূর্বরাগ চ্যাপ্টারই শেষ হয় নাই ৷ তারপর আইব ফোরপ্লে… তারপর… আস্তেধীরে আরো ২০০ পৃষ্ঠা পরে না অ্যাকশন… তা প্রফেসর সাহেব যখন ২০০ পৃষ্ঠা পড়ানো শেষ করলেন, মাইয়া তখন ৮ মাসের প্রেগন্যান্ট… প্রফেসর সাব কয় কেমনে হইল… আমি তো তোমারে টাচই করলাম না, মাইয়া কয় আপনে যে পড়াইছেন, এতেই হইয়া গেছে… প্রফেসর কয় হইতে পারে আমারই উচিত ছিল প্রিকশন লওয়া… ফ্যামিলি প্লানিং চ্যাপ্টার আগে না পড়ানোয় এই ভুলটা হইয়া গেছে… কী বুঝলা, থিয়োরি কপচাইবা না…’
রুমী বলে, ‘আমিও তো তাই বলি ৷ এখন আলোচনার সময় না, এখন চাই ডাইরেক্ট অ্যাকশন…’
এর মধ্যে এসে পড়েছে ফারুক ৷ সে বলে, ‘তোমরা লেফটিস্টরা যখন নানা রকমের থিয়োরি দিচ্ছ, বাংলার মানুষ কিন্তু তখন মুক্তির লাইনে অনেক দূর এগিয়ে গেছে, কম তো শুনলাম না, ভোটের আগে ভাত চাই, এখন শুনছি, এই লড়াই হলো দুই কুকুরের লড়াই, আসল কাজ হলো শ্রেণীশত্রু খতম করা, মানুষ এসবকে পাত্তা দেয় নাই, ছয় দফার পেছনে বঙ্গবন্ধুর পেছনে একযোগে দাঁড়িয়ে পড়েছে, এখন সামনে আর কোনো উপায় নাই, দেশ স্বাধীন হবেই, চারদিকে তো শুধু স্বাধীন বাংলার পতাকা…’
একজন বলে, ‘আরে ভোটের আগে ভাত চাই-এটা ভাসানী বলেছেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করেই, যাতে বাঙালি ভোট ভাগ না হয় সেজন্য তিনি সরে গেছেন, আসলে বঙ্গবন্ধু আর ভাসানীর সম্পর্ক তো গুরুশিষ্য, না হলে ধরো পিতাপুত্রের…
‘আচ্ছা, এত যে যুদ্ধ যুদ্ধ করতেছ, যুদ্ধ আরম্ভ হইলে কে কে যুদ্ধে যাবা ?’ একজন প্রশ্ন তোলে ৷
হাবিবুল আলম বলে, ‘আমি যাব ৷’
কাজী কামাল বলে, ‘আমিও যাব ৷’
জুয়েল বলে, ‘আমি সবার আগে থাকব ৷’
রুমী বলে, ‘আমাকে তো যেতেই হবে ৷ উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই…’
‘আজাদ, তুই কী করবি ?’
আজাদ বলে, ‘আমি মাকে গিয়ে বলব, মা, আমি যুদ্ধে যাব ৷ তুমি ‘না’ কোরো না ৷ মা যদি অনুমতি দেন, অবশ্যই যাব ৷ না দিলে কী করব, সেটা বলতে পারি না ৷ তোরা তো জানিসই, আমার মা বেঁচে আছে শুধু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে…’
আজাদ এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে পুরোটা আড্ডা নীরব হয়ে যায়, কারণ সবাই জানে আজাদের ব্যাপারটা, সবাই জানে এই ইস্কাটনের কোন বড়লোক বাড়ির ছেলে আজাদ, শুধু মায়ের সম্মান রক্ষার জন্যে মায়ের সঙ্গে মগবাজারের বাসায় একা পড়ে আছে ৷
সেই নীরবতা ভঙ্গ করে দূর থেকে মিছিলের স্লোগানের ধ্বনি ভেসে আসে, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো…’
৩১. মা
আজাদ নিজেকে সব সময়ই ননপলিটিক্যাল বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করত ৷ তবে ২৫শে মার্চ রাতে সে মগবাজারে পিকেটিং করছিল, ব্যারিকেড দিচ্ছিল রাস্তায়, এ কথা কাজী কামালের মনে আছে ৷ স্পষ্ট সাক্ষ্য পাওয়া যায় জায়েদেরও ৷ জায়েদ বলে, ২৫শে মার্চ রাতে মগবাজারে আজাদের সঙ্গে আশরাফুলসহ মগবাজার ইস্কাটন এলাকার বন্ধুরাও ছিল ৷ হাবিবুল আলমের মনে আছে, সেও ছিল মগবাজারের মোড়েই ৷ তার সঙ্গে ছিল শেখ কামাল ৷ মেলা রাত পর্যন্ত ৷ আর ছিল জনতা ৷ ছাত্র, যুবক, শ্রমিক ৷ সবার হাতে বাঁশের লাঠি ৷ রড ৷ পৌনে ১২টার দিকে শেখ কামাল চলে যায় ৷
আজাদের এ রাতে পিকেটিং করতে যাওয়ার পেছনে অন্যান্য কারণের সঙ্গে একটা প্রত্যক্ষ ব্যক্তিগত ক্ষোভও আছে ৷ আজাদ আর জায়েদ সম্প্রতি দিনের বেলা গিয়েছিল ফরাশগঞ্জে ৷ ওখানে আজাদের বাবার এক কর্মচারীর কাছ থেকে আজাদ মাসোহারার টাকা নিয়মিতভাবে তুলে থাকে ৷ অসহযোগের ভেতরে তার ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ যাওয়ায় একদিন হরতালের বিরতিতে আজাদ জায়েদকে নিয়ে গিয়েছিল ফরাশগঞ্জে, মাসোহারার টাকা তুলতে ৷ কর্মচারীটি টাকা দিতে আপত্তি জানিয়েছিল ৷ ওজর দেখিয়েছিল, ব্যাঙ্ক বন্ধ, হাতে টাকা নাই ৷ জায়েদ ‘হারামজাদা’ বলে চেয়ার তুলে ছুড়ে মেরেছিল কর্মচারীটার মাথা বরাবর ৷ তাতে কাজ হয়েছিল ৷ কর্মচারী বাপ বাপ বলে টাকা তুলে দিয়েছিল আজাদের হাতে ৷ দুজন টাকা নিয়ে বেবিট্যাক্সিতে ফিরছিল ৷ পথে একটা জায়গায় ব্যারিকেড ৷ তারা ব্যারিকেডের ওখানে নেমে রাস্তা পার হবে হেঁটে, ঠিক করেছিল ৷ ঠিক এই সময় কতগুলো পাঞ্জাবি সৈন্য তাদের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে তেড়ে এসেছিল ৷ বলেছিল, ব্যারিকেড নিকাল দো ৷ তারা তাদের রাইফেলের বাঁট দিয়ে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে বাধ্য করেছিল রাস্তার ব্যারিকেড অপসারণের কাজ করতে ৷ কাজটা করতে আজাদের মোটেও ভালো লাগছিল না ৷ আর হারামজাদা ধরনের গালি, সঙ্গে রাইফেলের বাঁটের মৃদু প্রহার মোটেও সম্মানজনক বলে তার কাছে মনে হচ্ছিল না ৷ সে দাঁতে দাঁত ঘষে পণ করেছিল, সুযোগ পেলেই এ বেটা পাঞ্জাবিদের ছ্যাঁচা দিতে হবে ৷
আসলে আজাদ, আশরাফুল, কাজী কামাল, হাবিবুল আলম, জুয়েল-এরা সবাই বা এদের মতো ঢাকার আরো অসংখ্য তরুণ, প্রায় সব তরুণ-যুবক অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিল, তার পেছনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য নয়, বরং কাজ করেছিল স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা, স্বতঃস্ফূর্ত দায়িত্ববোধ, যৌবনের স্বাভাবিক অপরাজেয় অপ্রতিরোধ্য প্রতিবাদী চেতনা ও স্বভাবধর্ম ৷ হেলাল হাফিজের ওই সময়ে রচিত ওই কবিতাটাতেই এই ব্যাপারটা অভ্রান্তভাবে ধরা পড়েছে :
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
২৫শে মার্চ ১৯৭১-এও যৌবনের স্বভাবধর্ম মিছিলে ব্যারিকেডে টেনে নিয়ে এসেছিল আজাদকে, জায়েদকে, টগরকে, কাজী কামালকে, হাবিবুল আলমকে, সৈয়দ আশরাফুল হককে, লক্ষ লক্ষ ঢাকাবাসীকে ৷ ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে পাকিস্তানি নেতাদের আলোচনা ভেঙে গেছে, ২৩শে মার্চ দেশব্যাপী প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়ে গেছে, বঙ্গবন্ধু নিজে তার বাসভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছেন ৷ ২৪শে মার্চ দিনটা ছিল থমথমে ৷ মানুষ রাস্তা পাহারা দিচ্ছে, আর স্থানে স্থানে গুলি হচ্ছে, সারা বাংলায় জনা পঞ্চাশেক মানুষ মারা গেছে সেনাবাহিনী ও পুলিশের গুলিতে ৷ এদিকে আওয়ামী লীগ ২৬ তারিখ থেকে সর্বাত্মক হরতাল ডেকেছে, ২৫শে মার্চ রাতে তারই সমর্থনে ছাত্রজনতা রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছে ৷
আজাদের মা বসে আছেন ভাত নিয়ে ৷ এশার নামাজ পড়া হয়ে গেছে ৷ তিনি তেলাওয়াত করেন প্রতিটা ওয়াক্তের নামাজের শেষে, জায়নামাজে বসে, আজ তাও সমাপ্ত ৷ রাত বাড়ছে ৷ আজাদ কেন এখনও ফেরে না ৷ জায়েদ ফিরে এসেছে ৷ সে উত্তেজিত-’আম্মা, একটা পানির ট্যাঙ্ক দিয়া ব্যারিকেড দিছে ৷ মগবাজারের মোড়ে ৷ হেভি হইছে ৷ অহন ইটা ফেলতাছে ৷ দাদারা স’মিল থাইকা গাছের গুঁড়ি আনতে গেছে ৷ গাছের গুঁড়ি ফেললে ব্যারিকেডটা সলিড হইব ৷’
মায়ের কেমন যেন ভয় ভয় লাগে ৷ কখন কী হয় ? যদি মিলিটারি গুলি করে!
রাত বাড়তে থাকলে রাস্তায় ভারি যানবাহন চলাচলের শব্দ শোনা যায় ৷ জায়েদ বাইরে থেকে খোঁজ নিয়ে এসে বলে, ‘ট্যাংক নামায়া দিছে ৷ বুলডোজার নামাইছে ৷’
গুলির শব্দ ৷ গোলার শব্দ ৷ জানালায় দাঁড়ালে আকাশে দেখা যাচ্ছে, আলো- বোমা ছোড়া হচ্ছে আকাশে ৷ সমস্ত আকাশ হঠাৎ হঠাৎ আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে ৷ আর শোনা যাচ্ছে সম্মিলিত মানুষের হৈ-হল্লা ৷ এত জোরে জোরে আওয়াজ হচ্ছে, যেন আজই কেয়ামত হয়ে যাবে ৷ মা বাসার সবাইকে খাটের নিচে শুইয়ে দেন ৷ কিন্তু নিজে বারবার ছুটে যান গেটের দিকে ৷ আজাদ কেন ফেরে না ৷ আজাদ কোথায় গেল ? তার কিছু হয় নি তো!
দরজায় ধাক্কার শব্দ ৷ মা দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলেন ৷ আজাদ নয়, বাশার ৷ মা বলেন, ‘এসেছ বাবা ৷’
বাশার বলে, ‘বাইরের অবস্থা খারাপ ৷’
‘আজাদকে দেখেছ ?’
বাশার উদ্বিগ্ন-‘আজাদ আসেনি ? ঠিক আছে, আমি দেখি, ও কোথায় ?’
মা বলেন, ‘না বাবা, তুমি যেও না ৷ কোথায় খুঁজতে যাবে ?’
এই সময় আজাদ ফেরে ৷ বলে, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে ৷ আর্মি নেমেছে ৷ মাইকে এনাউন্স করছে, যেখানেই ব্যারিকেড দেখবে, সেইখানেই গুলি চলবে ৷ আশপাশের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেবে ৷’
‘আরে, তোকে এত কিছু দেখতে শুনতে কে বলেছে! তুই মাটিতে শুয়ে পড়’-মা তাকে ধরে মেঝেতে শুইয়ে দেন ৷
বাড়ির সবাই মেঝেতে শুয়ে আছে ৷ বোমার আওয়াজ, মেশিনগানের আওয়াজ, রাইফেলের গুলির আওয়াজ, মানুষের আর্তনাদ, ভেসে ভেসে আসছে ৷ মনে হচ্ছে আকাশের সমস্ত মেঘ বিদ্যুৎ আর বজ্রসমেত ভেঙে পড়ছে পৃথিবীর ওপর ৷
আজাদ ওঠে ৷ জানালার ধারে যায় ৷ বাইরের আকাশে ট্রেসার হাউই উড়ছে মাঝে মধ্যে, আকাশ আলোকিত করে, আর চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা ৷ মা বকতে থাকেন, ‘আজাদ, জানালার ধারে যাস কেন, এদিকে আয় ৷ এদিকে আয় ৷ লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা পড় ৷ হে আল্লাহ, জালিমের জুলুম থেকে তুমি আমাদের রক্ষা করো ৷’
৩২. মা
১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ রাতে, এই ঢাকা শহরে পাকিস্তানি জান্তা তার সামরিক বাহিনীকে ট্যাঙ্ক, কামান, মর্টারসহ নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে গণহত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল, তার তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর একটাও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ আছে ৷ শুধু ২৫শে মার্চ রাতের ধ্বংসযজ্ঞ, নৃশংসতা, চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা, কামান দাগিয়ে উড়িয়ে দেওয়া ছাত্রাবাস, ছাত্রাবাস থেকে বের করে এনে কাতারবন্দি করে দাঁড় করিয়ে ছাত্রদের ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলা, যেন তারা পিঁপড়ার সারি, আর তুমি অ্যারোসল স্প্রে করে মারলে শত শত পিঁপড়াকে, গণকবর খুঁড়ে মাটিচাপা দেওয়া সেইসব লাশ, এখনও মারা না যাওয়া কোনো গুলিবিদ্ধ ছাত্রের মাটিচাপা পড়ে তলিয়ে যাওয়ার আগে মা বলে কেঁদে ওঠা শেষ চিৎকার, শিক্ষক-আবাসে ঢুকে নাম ধরে ডেকে ডেকে হত্যা করা শিক্ষকদের, তার শিশুসন্তানের সামনে, তার স্ত্রীর সামনে, কামানের তোপ দাগিয়ে উড়িয়ে দেওয়া পুড়িয়ে ভস্মীভূত করা সংবাদপত্র অফিস আর খুন করে ফেলা সাংবাদিকদের, আর আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া জনবসতি, ভেতরে পুড়ে যাচ্ছে মা আর তার স্তনবৃন্তে মুখ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়া শিশু, ভেতরে পুড়ে যাচ্ছে বৃদ্ধ, তার মুখ থেকে এখনও শেষ হয়নি বিপদতাড়ানিয়া আজানের আল্লাহু আকবার ধ্বনি, মাংস পোড়া গন্ধে ভারি হয়ে উঠছে বাতাস, আর সে-মাংস মানুষের, আর ভীতসন্ত্রস্ত পলায়নপর মানুষদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা, পুলিশ ব্যারাকে আগুন লাগিয়ে জীবন্ত দগ্ধ করে মারা বাঙালি পুলিশদের, ইপিআর ব্যারাকে হামলা চালিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে গুলি করে মারা বাঙালি ইপিআর সদস্যদের, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ঘেরাও করে ভেতরে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের নির্বিচারে পাখি মারার মতো করে হত্যা করা, লাশে আর রক্তে ভেসে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা, যেন হঠাৎ মাছের মড়ক লাগায় নদীতল ছেয়ে গেছে মরা মাছে, না, কোথাও পানি দেখা যাচ্ছে না, লাশ আর লাশ, আর সেসব মাছ নয়, মানুষ, ঢাকার সবগুলো পুলিশ স্টেশনে টেবিলের ওপরে উপুড় হয়ে আছে বাঙালি ডিউটি অফিসারের গুলি খাওয়া মৃতদেহ, দমকল বাহিনীর অফিসে ইউনিফরর্ম পরা দমকলকর্মীরা শুয়ে আছে, বসে আছে, গুলিবিদ্ধ হয়ে দেয়ালে আটকে আছে লাশ হয়ে, ঢাকার সবগুলো বাজারে আগুন দেওয়া-পাতার পর পাতা শুধু এই পৈশাচিকতার, এই আগুনের, লাশের, হত্যার, আর্তনাদের আর মানুষ মারার আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়া সৈনিকের অট্টহাসির, আর মদের গেলাস নিয়ে মাতাল কন্ঠে সাবাস সাবাস আরো খুন আরো আগুন আরো রেইপ বলে জেনারেলদের চিৎকারে ফেটে পড়ার বর্ণনা লেখা যাবে, শত পৃষ্ঠা, সহস্র পৃষ্ঠা, নিযুত পৃষ্ঠা, তবু বর্ণনা শেষ হবে না, তবু ওই বাস্তবতার প্রকৃত চিত্র আর ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হবে না ৷ কেই-বা সব দেখেছে একবারে, যে দেখেছে রাজারবাগে হামলা, তার কাছে ওই তো নরক, যে দেখেছে ইপিআরে হামলা, এক জীবনে সে আর কোনো দিনও স্বাভাবিক হতে পারবে না, যে অধ্যাপক ভিডিও করেছেন জগন্নাথ হলের মাঠে সারিবদ্ধ ছাত্রদের গুলি করে মেরে ফেলার দৃশ্য, তিনিও তো ঘটনার সামান্য অংশই চিত্রায়িত করতে পেরেছেন মাত্র, যে সায়মন ড্রিঙ্ক বিদেশী সাংবাদিকদের বহিষ্কার এড়িয়ে ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলের রান্নাঘর দিয়ে পালিয়ে গিয়ে লন্ডনের দি ডেইলি টেলিগ্রাফ-এ পাঠিয়েছিলেন ‘জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ, সাম উইটনেস অ্যাকাউন্টস, হাউ ড্যাক্কা পেইড ফর ইউনাইটেড পাকিস্তান’, তিনি নরকের বর্ণনার সামান্যই দিতে পেরেছিলেন ৷
৩৩. মা
২৫শে মার্চ রাতে সারাটা শহরে পাকিস্তান আর্মি কোন জাহান্নাম প্রতিষ্ঠা করেছে, তার বর্ণনা আস্তে আস্তে ঢাকাবাসী জানতে, বুঝতে, উপলব্ধি করতে শুরু করে ৷ ২৭শে মার্চ কারফিউ উঠিয়ে নেওয়ার পরে যারা রাস্তায় বেরোয়, তারা দেখতে পায় শুধু লাশ আর লাশ ৷ রাজারবাগের আশেপাশে যাদের বাসা ছিল, তারা ওই রাতে প্রত্যক্ষ করেছে, সারা রাত গুলির মধ্যে কোনো রকমে মাথা বাঁচিয়ে উপলব্ধি করেছে পাকিস্তানি সৈন্যদের নৃশংসতা ৷ কামান মর্টার দিয়ে গোলা তো ছোড়া হয়েইছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনে, চারদিক থেকে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের ক্যাম্পে ৷ পানির ট্যাঙ্কে যে বাঙালি পুলিশ পজিশন নিয়েছিল, তারা মারা গেছে ফুটন্ত পানিতে সেদ্ধ হয়ে ৷ আলতাফ মাহমুদের বাসা ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনের খুব কাছে ৷ তাঁরা দেখতে পেয়েছিলেন সেই দোজখের খানিকটা ৷ ভোর হতে না হতে প্রতিরোধকারী বাঙালি পুলিশরা আর টিকতে না পেরে একজন-দুজন করে পালিয়ে যাচ্ছিল এদিক-ওদিক ৷ তাদেরই দুজন আসে আলতাফ মাহমুদের বাসায় ৷ তারা তাদের পোশাক খুলে সাধারণ লুঙ্গি-শার্ট ধার নিয়ে পরে অস্ত্র রেখে পালিয়ে যায় ৷ এ রকম পলায়নপর বাঙালি পুলিশদের আশ্রয় দিয়েছিল, পোশাক দিয়েছিল আশপাশের অনেক বাঙালি পরিবার ৷ নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর মনে আছে, ২৫শে মার্চ রাতে রাস্তায় গাছ কেটে, সুয়ারেজ পাইপ ফেলে তারা ব্যারিকেড দিচ্ছিল ৷ ১১টা সাড়ে ১১টার দিকে ট্যাঙ্ক, আরমার্ড কার নিয়ে আর্মি রাস্তায় নেমে আসে গুলি করতে করতে ৷ রাতের বেলা জোনাকি সিনেমা হলের কাছে হাসানের বাসায় আশ্রয় নেয় সে, সারা রাত রাজারবাগে পুলিশের সঙ্গে পাকিস্তানি আর্মির যুদ্ধ হয়, ভোরবেলা বাচ্চু বেবির বাসা হয়ে পল্টন লাইনের নিজের বাসায় ফিরছে গলিপথে, দেখতে পায় বাঙালি পুলিশরা পালিয়ে যাচ্ছে ৷ বাচ্চুদের কাছেও তারা অস্ত্র রেখে যায় ৷ তখনও ধোঁয়া উড়ছে শান্তিনগরে, রাজারবাগে, জোনাকির সামনে রাস্তায় লাশ পড়ে আছে ৷
২৬শে মার্চ ১৯৭১ ৷ বাইরে কারফিউ ৷ আজাদ আর বাশার বাসায় বসে আছে ৷ কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না ৷ মায়ের কঠোর নিষেধ, বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করা যাবে না ৷ জায়েদ উসখুস করছে, তার মতলব একবার গলির মুখে গিয়ে দেখে ঘটনা কী ? মাঝে মধ্যে ট্যা-ট্যা করে গুলির শব্দ ভেসে আসছে ৷ ছাদে গিয়ে তাকালে এদিকে-ওদিকে ধোঁয়া দেখতে পাওয়া যায় ৷ আবার গোলাগুলির শব্দ ৷ খুব কাছে থেকে আসছে শব্দ ৷ মনে হয় শেল এসে পড়ছে এই বাসারই ওপরে ৷ আজাদের মা দৌড়ে আসেন ৷ ‘আজাদ কোথায় ? আয় ৷ আয় ৷ শুয়ে পড় ৷ জায়েদ কোথায় ? এই তুই আবার উঠে পড়ছিস কেন ? শো বলছি ৷’
একটু পরে আবার শব্দ থেমে যায় ৷ আজাদ রেডিও অন করে ৷ রেডিও পাকিস্তান থেকে একটা অপরিচিত কন্ঠ ভেসে আসছে ৷ কোনো অবাঙালি হবে হয়তো ৷ না ইংরেজি, না উর্দু, না বাংলা, এক অদ্ভুত ভাষায় সে ঘোষণা পাঠ করে চলেছে ৷ সবই সামরিক বিধি ৷ টিক্কা খানের সামরিক বিধি বমন করে চলেছে রেডিওটা ৷ কী করা যাবে, কী করা যাবে না, অ্যালার্ন হচ্ছে ৷ আর বলা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন ৷ আজাদ রেডিওর নব ঘোরাতে থাকে ৷ আকাশবাণী শোনা যায় ৷ এদের খবরটা শুনলে হয় ৷ আকাশবাণীর ইংরোজি খবরে বলা হয় : ওয়েস্ট পাকিস্তান হ্যাজ অ্যাটাক্ড ইস্ট পাকিস্তান ৷
আবার গুলির শব্দ ৷ সবাই চুপ করে আছে ৷
কিন্তু এরই মধ্যে হঠাৎ তাদের বাসার দরজায় কে যেন ধাক্কা দেয় ৷ কে ? এই ঘোর দুর্যোগের মধ্যে কে ?
বাসার সবার নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাবে, এমন নিস্তব্ধতা ৷
আবার কড়া নাড়ার শব্দ ৷
আজাদ বলে, ‘কে ?’ কিন্তু তার গলা থেকে শব্দ ঠিকমতো বেরুচ্ছে না ৷ সে কেশে গলা পরিষ্কার করে নেয় ৷ কে ? সে এবার স্পষ্ট গলায় বলে ৷
মা ছুটে আসেন ৷ ফিসফিস করে বলেন, ‘আজাদ, তুই ওই ঘরে যা ৷ আমি দেখছি ৷’ মা জানালার বদ্ধ কপাটের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেন কে ৷ বুঝতে পারেন না ৷
তারপর জানালাটা খুলে বারান্দায় তাকান ৷ না কেউ না ৷
২৭শে মার্চ ৷ আজ সকালে কারফিউ নাই ৷ দুপুর থেকে আবার শুরু হবে ৷ আজাদ আর বাশার বের হয় ৷ রেললাইনের পথ ধরে ছুটে চলেছে হাজার হাজার মানুষ ৷ নারী-পুরুষ, শিশু, আবালবৃদ্ধবনিতা ৷ প্রত্যেকের হাতে সাধ্যমতো ব্যাগ, সুটকেস, পোটলা ৷ কারো কোলে বাচ্চা ৷ সবার চোখেমুখে ভয় ৷ সবাই যেন এই মৃত্যুপুরী ছেড়ে পালিয়ে কোনো রকমে পেতে চাইছে একটুখানি জীবনের শরণ ৷ একটা ছোট্ট ছেলে মাথায় একটা বড় ট্রাঙ্ক নিয়ে চলেছে ৷ আজাদ আর বাশার কেউ কোনো কথা বলে না ৷ তারা আরেকটু এগিয়ে যায় ৷ আউটার সার্কুলার রোডে হোটেল দ্য প্যালেসের সামনে দেখতে পায় পড়ে আছে একটা লাশ ৷ আজাদ চমকে ওঠে ৷ কিন্তু এটা কিছুই নয় ৷ আরো অনেক লাশ তাদের দেখতে হবে ৷ তারা রাজারবাগের দিকে এগোয় ৷ পথে পথে ছড়িয়ে আছে লাশ ৷ গুলিবিদ্ধ শরীর থেকে বেরুনো রক্ত শুকিয়ে পড়ে আছে রাস্তায় ৷ পুলিশ ব্যারাক থেকে এখনও ধোঁয়া উঠছে ৷ কুকুরে টানাটানি করছে লাশ নিয়ে ৷ কত যে লাশ পড়ে আছে ইতস্তত, ইয়ত্তা নাই ৷
আজাদ আর বাশার এতক্ষণ কেউ কোনো কথা বলেনি ৷
হঠাৎ বাশার রাস্তার ধারে বসে পড়ে ৷
আজাদ জিজ্ঞেস করে, ‘কী হলো ?’
বাশার একবার ‘ওয়াক’ করে ওঠে ৷
‘খারাপ লাগছে ?’
‘হুঁ ৷’
আজাদ দেখতে পায়, বাশারের পুরোটা কপাল ঘামছে ৷ বোধহয় তার পেটের ভেতরটা গুলিয়ে উঠছে ৷ বমি করবে নাকি সে ? কিন্তু সকালে তারা নাশতা করে বের হয়নি ৷ দুজনেরই পেট খালি ৷ বমি হবে না ৷ শুধু পিত্ত উগড়ে উঠবে ৷ কষ্ট হবে ৷
আজাদ একটা কাগজ কুড়িয়ে এনে বাশারের মাথায় বাতাস করে ৷ সঙ্গীর বিবমিষা দেখে তারও বমি পাচ্ছে ৷
বাশারের চোখেমুখে একটু পানি ছিটাতে পারলে হয়তো ওর ভালো লাগত ৷ ওই যে দূরে রাস্তার ধারে একটা পানির কল দেখা যাচ্ছে ৷ আজাদ বলে, ‘দাঁড়াও, তোমার জন্যে একটু পানি নিয়ে আসি ৷ চোখেমুখে দেবে ৷’
পানির কলের কাছে সে যায় বটে, কিন্তু পানি সে নেবে কী করে ? আঁজলা ভরে পানি নিলেও বাশারের কাছে পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যাবে না ৷ সে পকেট থেকে রুমাল বের করে ৷ ভিজিয়ে নেয় রুমালটা ৷ তারপর বাশারের কাছে এসে ভেজা রুমাল দিয়ে বাশারের চোখ-মুখ-কান-ঘাড় মুছে দেয় ৷ বাশারের খানিকটা আরাম লাগে ৷ সে বলে, ‘এখন ঠিক আছি ৷ চলো বাসায় ফিরে যাই ৷’
তারা বাসায় ফিরে আসে ৷ মা চিল্লাচিলি্ল শুরু করে দিয়েছেন, ‘এই, তোরা কই গিয়েছিলি ? বলে যাবি না ? নাশতা না করে কেউ বাইরে যায়!’
দুপুরের আগে হঠাৎ তাদের বারান্দায় বুটের শব্দ ৷ দরজায় নক ৷ জায়েদ এগিয়ে গিয়েছিল ৷ জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে : সর্বনাশ ৷ দুইজন সৈন্য ৷ মিলিটারি সদস্য ৷ তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ৷ সে প্রমাদ গোনে ৷
জায়েদ দৌড়ে ভেতরে আসে ৷ আজাদ আর বাশার তখন রেডিওর নব ঘোরাচ্ছে ৷ কোন রেডিও কী বলে, শোনা দরকার ৷ আকাশবাণী, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, ঢাকা-সবই সে একের পর এক শুনছে ৷ জায়েদ গিয়ে হাজির সেখানে-’দাদা দাদা ৷’ জায়েদের কন্ঠে ফিসফিসানি ৷
‘কী হয়েছে ?’
‘দাদা’, জায়েদ কথা থামিয়ে প্রথমে একটা শ্বাস নেয়, তারপর বলে, ‘বাসাত মিলিটারি আইছে ৷’
‘মিলিটারি ?’ আজাদ আর বাশার একই সঙ্গে বলে ওঠে ৷ তাদের হতবিহ্বল দেখায় ৷ তারা এখন কী করবে ?
দরজা থেকে তখন শোনা যায়, ‘আজাদ, আজাদ আছ নাকি ?’
বাঙালির গলা ৷ আজাদ এগিয়ে যায় বারান্দার দরজায় ৷ ‘কে ?’ সে কন্ঠ উঁচিয়ে বলে ৷
‘আমি সালেক ৷ তোমার সেন্ট গ্রেগরির ফ্রেন্ড ৷’
আজাদ তাড়াতাড়ি দরজা খোলে ৷ সালেক চৌধুরী তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ৷ এ বাসাতেও সে একবার এসেছে ৷ আর্মিতে আছে ৷ ‘আসো, আসো ৷’
সালেক ভেতরে ঢোকে ৷ সেনাবাহিনীর পোশাকে তাকে একটু অন্যরকম যে লাগছে না, তা নয় ৷ তার সঙ্গে তার এক সহকর্মী হবে ৷
সালেক ঢুকেই বলে, ‘দরজা বন্ধ করে দাও ৷ ও আমার বন্ধু ক্যাপ্টেন মাহমুদ ৷ মাহমুদ, এই হলো আজাদ ৷ তোমাকে তো এর কথা বলেইছি ৷ আজাদ, শোনো ৷ ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা খারাপ ৷ আমরা পালিয়ে এসেছি ৷ পালিয়ে চলে যাব ৷ তুমি এক কাজ করো, আমাদের দুজনকে তোমার দু সেট কাপড় দাও ৷ কারফিউ আরম্ভ হওয়ার আগেই ঢাকা ছাড়তে হবে ৷’
আজাদ বলে, ‘বসো ৷ দিচ্ছি ৷’
মা এগিয়ে আসেন ৷ সব শোনেন ৷ তার চোখেমুখে উদ্বেগ ৷ তিনি বলেন, ‘বাবারা, তোমরা কিছু খেয়েছ ?’
সালেক বলে, ‘খালাম্মা, খেতে হবে না ৷ আগে ঢাকার বাইরে যেয়ে নিই ৷’
মা বলেন, ‘বাবা, আমি ভাত তুলে দিয়েছি ৷ ভাত খেয়ে তারপর যেও ৷’
সালেক বলে, ‘সময় হবে না খালাম্মা ৷’
জায়েদ তখন পাশের ঘরের দরজার সামনে দিয়ে বারবার হাঁটাচলা করছে, আর বোঝার চেষ্টা করছে, কারা এল ৷ পরে যখন বোঝে, এ তো সালেক ভাই, তখন সে ঢোকে এ ঘরে ৷ টেবিলের ওপরে দুটো অস্ত্র রাখা ৷ সেসবের দিকে তার অভিনিবেশ ৷
আজাদ তাদের দুজনকে প্যান্ট-শার্ট আর স্যান্ডেল দেয় ৷ তারা কাপড় পাল্টে নেয় ৷ অস্ত্র দুটো তারা নেয় একটা চটের বস্তায় ৷ তারপর সালেক বলে, ‘আজাদ উঠি রে ৷’
আজাদ বলে, ‘কোন দিকে যাবা ?’
সালেক বলে, ‘জানি না ৷ আল্লাহ ভরসা ৷’
মা আসেন ৷ ‘বাবা, আর পাঁচটা মিনিট বসো ৷ ভাত হয়ে এসেছে ৷’
সালেক আর মাহমুদ ঘড়ি দেখে ৷ ‘না খালাম্মা ৷ হাতে সময় আছে আর আধঘন্টা ৷ এর মধ্যে সদরঘাট দিয়ে নদী পার হয়ে যেতে চাই ৷’
‘তাহলে বাবা একটু চিঁড়া ভিজিয়ে দিই ৷ গুড় দিয়ে মেখে দিই ৷ খেয়ে যাও ৷’
মা দৌড়ে চিঁড়া ভেজাতে যান ৷ সালেক বলে, ‘খালাম্মা ৷ নাহ্ ৷ থাকুক, দেরি হয়ে যাবে ৷ আমরা যাই ৷’
চিঁড়া ভেজানোই থাকে ৷ সালেক আর মাহমুদ সিভিল ড্রেসে বেরিয়ে যায় ৷ ঘরে পড়ে থাকে তাদের সামরিক পোশাক, বেল্ট, জুতা, টুপি ৷
মা সেগুলো একটা বস্তায় ভরে রান্নাঘরের পেছনে কাঠের স্তূপের আড়ালে রেখে আসেন ৷
জায়েদের চোখ পড়েছে বেল্ট দুটোর দিকে ৷ এক ফাঁকে সে বেল্ট দুটো সরিয়ে নেবে, মনে মনে পরিকল্পনা আঁটে ৷
তবে এ পরিকল্পনা সে বাস্তবায়িত করতে পারে না ৷ দুদিন পরই কারফিউয়ের বিরতিতে আম্মার নির্দেশে পুরোটা বস্তা মাথায় করে নিয়ে সে ফেলে দিয়ে আসে এফডিসির পুকুরে ৷
২৭শে মার্চ দুপুরের দিকে, কয়েক ঘন্টার জন্যে কারফিউ তুলে নেওয়ার অবকাশে, জুয়েল এসে হাজির সৈয়দ আশরাফুল হকের বাসায় ৷ ডোরবেল টেপে ৷ বাসার লোকজন উঁকি দিয়ে দেখে, কে এল ৷ জুয়েলকে দেখে দারোয়ান বলে, ‘কে ?’
জুয়েল বলে, ‘আমি জুয়েল ৷ বাবু আছে ?’
সৈয়দ আশরাফুল এসে গেট খোলে ৷
‘কী ব্যাপার ?’
‘শোনো নাই, মুশতাক ভাইরে মাইরা ফেলছে!’
‘কোন মুশতাক ?’
‘তোমগো আজাদ বয়েজ ক্লাবের মুশতাক ভাই ৷’
‘কও কী ?’
আশরাফুলের মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে ৷ আজাদ বয়েজ ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ক্রীড়ানুরাগী মুশতাক ভাইকে মেরে ফেলেছে ? সে ভয়ার্ত গলায় বলে, ‘কেমনে ?’
‘ডিডিএসএর সামনে হের গুলি খাওয়া লাশ পইড়া আছে ৷ হাত দুইটা নাকি উপরে ধরা ৷ মনে হয় উর্দুতে কিছু একটা বুঝাইতে চাইছিল, পারে নাই ৷ অনেকে দেখতে যাইতেছে ৷ যাবা ?’
‘চলো ৷’
তারা দুজন বেরিয়ে পড়ে ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন কার্যালয়ের উদ্দেশে ৷
আশরাফুলের সামনে লাশের বর্ণনা দেবার সময়ও জুয়েল বুঝতে পারেনি আসলে গুলি খেয়ে মৃত্যু ব্যাপারটা কী! কিন্তু ডিডিএসএ কার্যালয়ে গিয়ে যখন মুশতাক ভাইয়ের চিৎ হওয়া উন্মুক্ত শরীরটা গুলিবিদ্ধ আর রক্তাক্ত অবস্থায় সে দেখে, তখন একটা মানুষের এ রকম অন্যায় প্রতিকারহীন মৃত্যু যেন সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না ৷ লোকটার সঙ্গে তিন দিন আগেও তাদের দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে ৷ এখন কীভাবে শুয়ে আছে দুদিনের বাসি লাশটা ৷
ঢাকার অনেক ক্রিকেটারকেই ক্রিকেট খেলতে উদ্বুদ্ধ করা, ক্রিকেটের বিষয়ে একাগ্র ও পরিশ্রমী হতে বলার কাজটা মুশতাক ভাই করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে ৷
সেই মুশতাক ভাইকে এভাবে মেরে ফেলা হবে ? জুয়েলের চোয়ালটা শক্ত হয়ে ওঠে ৷ সে কামড়ে ধরে নিচের ঠোঁট ৷
আর ভয়ে আশরাফুলের শরীর ওঠে গুলিয়ে ৷
হঠাৎ শোনা যায়, কে যেন ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল ৷
জুয়েল আর আশরাফুল লোকটার দিকে তাকায় ৷ আজাদ বয়েজ ক্লাবের পিয়ন খয়বার ৷ ওদিকে দেখা যাচ্ছে ক্রিকেটার রকিবুল হাসানও এসে গেছেন ৷
৩৪. মা
আজাদ ধীরে ধীরে জানতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সারি বেঁধে হত্যা করা হয়েছে ছাত্রদের, বাসায় গিয়ে গুলি করে খুন করা হয়েছে শিক্ষকদের, ছাত্রীহলে গিয়ে নারকীয় নির্যাতন করা হয়েছে মেয়েদের ৷ তার হাতের মুঠো শক্ত হয়ে আসে ৷ ক্রোধের আগুনে শরীর হয়ে ওঠে তপ্ত ৷ তবে রাজনীতির সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ না থাকায় ঠিক কী করা উচিত সে বুঝে উঠতে পারে না ৷ কিন্তু সে-সময়ই তার বন্ধুরা, পরবর্তীকালে যারা তার সহযোদ্ধা হবে, তাদের অনেকেই যুদ্ধের ময়দানের সন্ধানে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় ৷ শহীদুল্লাহ খান বাদল, আশফাকুস সামাদ, বদিউল আলম, মাসুদ ওমর-ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের চার ছাত্র বেরিয়ে পড়ে যুদ্ধের সন্ধানে, তারা শুনতে পায় গাজিপুরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা লড়াই করছে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে, সেখান থেকে তারা পিছু হটে ময়মনসিংহে যাবে, এটাই স্বাভাবিক, সুতরাং বাদল, আশফি, ওমর, বদি চার তরুণ কারফিউ তুলে নেওয়ার কয়েক ঘন্টার বিরতির মধ্যেই ঢাকা ছেড়ে ময়মনসিংহের পথে পা বাড়ায় ৷ বাচ্চু, আসাদ এবং লক্ষাধিক ঢাকাবাসী ২৭শে মার্চে কারফিউ তুলে নেওয়ার ফাঁকে তাদের সংগৃহীত অস্ত্রশস্ত্রসহ বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে আশ্রয় নেয় জিঞ্জিরায় ৷ সেখানেই তারা প্রথম শুনতে পায় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের ঘোষণা, এম এ হান্নান, মেজর জিয়া, শমসের মবিন ও ক্যাপ্টেন ভুঁইয়ার কন্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই এখনও মনে করতে পারে, মেজর জিয়ার কন্ঠস্বর তাদের অনুপ্রাণিত করেছিল খুবই, কারণ তারা আর্মি খুঁজছিল, বাঙালি আর্মি বিদ্রোহ করেছে শুনে তারা বুঝতে পেরেছিল যুদ্ধ সত্যই শুরু হয়ে গেছে ৷ রেডিওর এ ঘোষণা ত্রিমোহনীতে শুনতে পায় শাহাদত চৌধুরী আর ফতেহ, যারা সেখানে গিয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রের খোঁজে, রেডিওতে কান পেতে এ ঘোষণা শুনে যেন জেগে ওঠে ত্রিমোহনী, উৎসব শুরু হয় সেখানে ৷ ত্রিমোহনীতে তারা দেখা পায় রাজারবাগে যুদ্ধ করা চারজন পুলিশের ৷ তাদের সমস্ত অস্তিত্ব তখন প্রতিরোধ আর প্রতিশোধের জন্যে উন্মুখ ৷ তারাও খুঁজছে যুদ্ধক্ষেত্র ৷ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুই ট্রাক সৈন্য তারাবো পর্যন্ত এসে পড়লে সে খবর নিয়ে আসে ফতেহ চৌধুরী ৷
তবে যুদ্ধ ২৫শে মার্চ রাতেই শুরু হয়ে গিয়েছিল, রাজারবাগে পুলিশের প্রতিরোধে, পিলখানায় ইপিআরের নাছোড় সাহসিকতায়, নয়াবাজারের নাদির গুণ্ডার এলএমজির গুলিতে পাকিস্তানি সৈন্যদের ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া আর পিছু হটে যাওয়ার মধ্য দিয়ে, সারা দেশে বাঙালি সৈন্যদের বিদ্রোহ, আত্মত্যাগ আর প্রতিরোধে ৷ গাজীপুরে ২য় বেঙ্গল, চট্টগ্রামে ৮ম বেঙ্গল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৪র্থ বেঙ্গল বিদ্রোহ করে ৷ লড়তে থাকে বীরের মতো ৷ পাবনার ডিসি, মেহেরপুর কুষ্টিয়ার এসডিও, এসপি-এমনি করে অনেক জায়গায় বেসামরিক প্রশাসন আর জনগণ মিলেমিশে নিজ নিজ এলাকাকে দখল করে রেখে গড়ে তোলে প্রতিরোধ ৷ রংপুর দিনাজপুরের মাটিও দখল করে রাখে সাধারণ মানুষ, বাঙালি সাঁওতাল, ওরাঁও আদিবাসী মিলেমিশে ৷
২৫শে মার্চ রাতে শুধু ঢাকায় নয়, সারাদেশে পাকিস্তানি মিলিটারি ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে তোপের মুখে চিরকালের জন্যে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে ৷ শুধু ২৫শে মার্চ রাতে নয়, ২রা এপ্রিল জিঞ্জিরায় যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, তাকে এখনও বাচ্চু, আসাদ বা যে-কানো প্রত্যক্ষদর্শীর দোজখ দেখার দুঃসহ স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না ৷ প্রাণভয়ে ভীত আশ্রয়সন্ধানী প্রায় লাখখানেক ঢাকাবাসী আশ্রয় নিয়েছে বুড়িগঙ্গার ওপারে ৷ তাদের কারো কারো কাছে দেশি অস্ত্র ৷ একটা-দুটো বন্দুক ৷ পুলিশ কিংবা ইপিআরের ফেলে যাওয়া থ্রি নট থ্রি ৷ ভোরবেলা হঠাৎ পাকিস্তানি আর্মি লঞ্চ আর স্টিমারযোগে চলে আসে নদীর এপারে, অতর্কিতে, বাচ্চুরা টের পেয়ে পেছাতে পেছাতে সৈয়দপুরে সরে আসে, আর পেছনে তাকিয়ে দেখতে পায় আকাশে হেলিকপ্টার জেট উড়ছে, হাজার হাজার মানুষ পালাচ্ছে দিগ্বিদিক, আর আর্মিরা কী একটা পাউডার নাকি পাইপ দিয়ে ফুয়েল ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে, মানুষ পুড়ে যাচ্ছে আর ছুটে যাচ্ছে, ছুটন্ত মানুষ পুড়ছে, পুড়ন্ত মানুষ ছুটছে, ছুটন্ত মানুষ ফুটন্ত, জ্বলন্ত, হাজার হাজার ছুটন্ত অগি্নকুণ্ড, আর চিৎকার, পুরোটা জনপদ পুড়ছে, আর গুলি, রিকোয়েললেস রাইফেল থেকে, আর হেলিকপটার জেট থেকে, ছুটন্ত মানুষ পড়ে যাচ্ছে, ধরাশায়ী হচ্ছে, হাজার হাজার মানুষ পড়ে গেল, মরে গেল, মরে গেল তো বেঁচে গেল, অন্তত ১০ হাজার মানুষ সেদিন মারা পড়েছে জিঞ্জিরায়-এই বিবরণ আজাদ জানতে পারবে, আর তার মনে হবে ট্রুম্যানের কথা, হ্যারি এস ট্রুম্যানের আত্মজীবনীর একটা বই তাকে পড়তে হয়েছে এমএ ক্লাসের জন্য, আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক ক্লাসে, ইয়ার অব ডিসিশনস, হিরোশিমায় যখন অ্যাটম বোমা ফেলা হয় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান তখন বাইরে লাঞ্চ করছিলেন, বোমা ফেলার পরে তাকে জানানো হয় নিউক্লিয়ার টেস্টের চেয়েও এবার ধ্বংস হয়েছে অনেক বেশি, ট্রুম্যান বলেছিলেন, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জিনিস হলো এটা ৷ চলো, বাড়ি যাই ৷ এই বোমা ২০ হাজার টন টিএনটির সমান শক্তিশালী ৷ I was greatly moved… I said to the sailors around me, this is the greatest thing in the history it’s time for us to go home (আজাদের নিজের হাতের ৩.৪.৭০ তারিখে স্বাক্ষর করা এই বইটা রয়ে গেছে জায়েদের সংগ্রহে) ৷ জিঞ্জিরার দিকে পালাতে গিয়েই সঙ্গীতজ্ঞ বারীণ মজুমদার আর ইলা মজুমদারের আঙুল থেকে এক সময় খুলে যায় তাদের বছর সাতেক বয়সী মেয়ে মধুমিতার হাতের মুঠো, তারা তাকে ডাকতেন মিতু বলে, তারপর মিতু মিতু বলে ইলা মজুমদার কত ডাকলেন, বারীণ মজুমদার কত ডাকলেন, তাদের ছোট ছেলে পার্থ কত ডাকল, মিতু আর ফিরে এল না ৷ যে যায় সে আর ফিরে আসে না, কিন্তু মায়েরা প্রতীক্ষায় থাকে, তাদের প্রতীক্ষা দেশ স্বাধীন হওয়ার ১৪ বছর পরেও ফুরায় না ৷
৩৫. মা
প্রতিটা তরুণের নিজের ঘরদোর মা-বাবা ছেড়ে যুদ্ধে যাওয়ার আছে একেকটা স্মরণীয় গল্প ৷
বদিউল আলম ঢাকায় এক সময় বিখ্যাত বা কুখ্যাত ছিল এনএসএফ-এর নেতা হিসাবে ৷ কিশোরগঞ্জের ছেলে বদি ছাত্র হিসাবে ছিল দারুণ মেধাবী ৷ লম্বা, একটু ময়লাটে গায়ের রঙ ৷ ‘৭১ সালে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র ৷ ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে সে ১৯৬৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগে মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান অধিকার করেছিল ৷ এই উজ্জ্বল পটভূমি নিয়েও বদি যে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সমর্থক ও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এনএসএফে যোগ দিয়েছিল, তার কারণ খুব একটা রাজনৈতিক নয় ৷ এদের যোগ দেওয়ার কথা ছিল ছাত্র ইউনিয়নেই, কিন্তু কী একটা কথা কাটাকাটি থেকে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের কয়েক বন্ধু এনএসএফে ঢুকে পড়ে ৷ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা থাকায় ক্যাম্পাসে তারা চলাফেরা করত দাপটের সঙ্গে ৷ এই সময় জিন্নাহ হলের এনএসএফ নেতা বদি-সালেকের নাম উচ্চারিত হতো একই নিঃশ্বাসে, মধ্যখানে একটা ঊহ্য হাইফেনসমেত এবং ভয়ের সঙ্গেই ৷ সৈয়দ আশরাফুল হকের মনে পড়ে, ক্রিকেটার হিসেবে আশরাফুলকে বদি একটু প্রশ্রয়ের চোখে দেখত, ক্যাম্পাসে দেখা হলে জিজ্ঞেস করত, ‘কী আশরাফুল, কেমন আছ’, এতেই আশরাফুল শ্লাঘা অনুভব করত, ‘দেখছস, কত বড় গুণ্ডা আমার খোঁজখবর নিতাছে ৷’
অন্যদিকে শহীদুল্লাহ খান বাদল ছিল এসএসসি আর এইচএসসি দু পরীক্ষাতেই প্রথম স্থান অধিকারকারী এক অবিশ্বাস্য তরুণ ৷ সে যুক্ত ছিল বামপন্থী চিন্তা আর আদর্শের সঙ্গে ৷ বদির সঙ্গে তার গোলযোগ ছিল প্রকাশ্য ৷ অর্থনীতি বিভাগের নির্বাচনের সময় ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে এনএসএফের গণ্ডগোল বাধলে বাদল আর বদির দূরত্বও প্রায় শত্রুতায় পরিণত হয় ৷ এর পরে ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেরাও শরীরচর্চা ইত্যাদির দিকে মন দেয় ৷ একদিন জিমন্যাসিয়ামে বাদলরা ব্যায়াম করছে, তারা পড়ে যায় বদি ও তার দলের সামনে, বদিরা ধাওয়া দেয় বাদলদের ৷
‘৬৯-এর গণআন্দোলনের সময় থেকে বদিউল আলমরা এনএসএফে নিষ্ক্রিয় হতে থাকে ৷ ডাকসুর জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী এনএসএফের পক্ষ থেকে নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও গণআন্দোলন সমর্থন করেন এবং এরপর থেকে ছাত্রসমাজের স্বাধিকার তথা স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করতে থাকেন ৷ বদিউল আলমরাও মনেপ্রাণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থক হয়ে ওঠে ৷
২৫শে মার্চের গণহত্যাযজ্ঞ শুরুর পর ২৭শে মার্চ কারফিউ তুলে নেওয়া হলে বদি তার বন্ধু তৌহিদ সামাদকে নিয়ে হাজির হয় ধানমন্ডি ৫ নম্বরে শহীদুল্লাহ খান বাদলের ডেরায় ৷ তৌহিদ সামাদের বাসা ছিল ৪ নম্বরে ৷ বদিকে দেখে শহীদুল্লাহ খান বাদলের মনে নীরব প্রশ্ন জাগে : এই এনএসএফের গুণ্ডাটাকে কেন নিয়ে এসেছে তৌহিদ ?
বদিউল বলে বাদলকে, ‘লিসেন ৷ ইউ কমিউনিস্ট ৷ হয়্যার আর দি আর্মস ৷ লেট্স গো অ্যান্ড ফাইট ৷ নিশ্চয় যুদ্ধ হচ্ছে, নিশ্চয় আর্মস পাওয়া যাবে ৷ চলো ৷ যুদ্ধ করব ৷’
কিন্তু শহীদুল্লাহ খান বাদলের চোখমুখ থেকে বদিউল আলমের ব্যাপারে সন্দেহ দূরীভূত হয় না ৷ বদিকে এড়িয়ে যায় বাদল ৷ সে যায় মাসুদ ওমরের বাসায়, সঙ্গে আশফাকুস সামাদ, কী করা যায় এই নিয়ে আলোচনা করে তারা ৷ সেখানে আবার এসে হাজির হয় বদি ৷ অবাক হওয়া বাদলের মুখের দিকে তাকিয়ে বদি সন্দেহরেখা পড়ে ফেলে অন্তর্যামীর মতো ৷ তারপর সে তার পকেটে হাত দেয় ৷ বের করে একটা ব্লেড ৷ একটানে বদি নিজের হাত কেটে ফেলে খানিকটা ৷ ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয় তার হাত থেকে ৷ তারপর সে বাদলের হাত টেনে নিয়ে সামান্য কাটে ৷ বাদলের কাটা জায়গা থেকে রক্ত বেরিয়ে এলে বদি নিজের রক্ত মিশিয়ে দেয় বাদলের রক্তের সঙ্গে ৷ বলে, ‘ফ্রম টুডে উই আর ব্লাড ব্রাদারস ৷’
শহীদুল্লাহ খান বাদল, মুক্তিযুদ্ধের ১৪ বছর পরেও, আজাদের মাকে দাফন করে ফিরে আসবার পরের দিনগুলোয়, সেইসব কথা মনে করে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন ৷ তাঁর মনে পড়ে, এর পরে তার এতদিনকার প্রতিপক্ষ বদিউল আলমের সঙ্গে একই মোটরসাইকেলে চড়ে তারা ওই ২৭শে মার্চেই পুরোটা শহর প্রথমে চক্কর মারে ৷ প্রত্যক্ষ করে শহরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আগুন, ধোঁয়া, রক্ত, লাশের স্তূপ-পাকিস্তানিদের ভয়াবহ নৃশংসতার সাক্ষ্যগুলো ৷ তারা যুদ্ধের সন্ধানে যায় মেজর খালেদ মোশাররফের শ্বশুরবাড়িতে, বাদলদের আত্মীয় হন এই মেজর ৷ দূর থেকেই দেখতে পায় ইতিমধ্যে এ বাড়িতে হামলা চালিয়েছে পাকিস্তানি সৈন্যরা ৷ সেখানে উপায়ান্তর করতে না পেরে বদি প্রস্তাব দেয় কিশোরগঞ্জের দিকে যাত্রার ৷ একটা অনুমান হলো, ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী বাঙালি সৈন্যদের পাওয়া যেতে পারে কিশোরগঞ্জে ৷ বাদলের একটা আশা ছিল, কমিউনিস্টদের কতগুলো মুক্তাঞ্চল থাকে, সিলেটে এ রকম একটা মুক্তাঞ্চল আছে সুনীলদার ৷ ওখানে পৌঁছা গেলে একটা উপায় হবেই ৷
বন্ধু তৌহিদ সামাদের কাছ থেকে টাকা ধার নেয় তারা, ৩০০ বা ৪০০ টাকা, তারপর কিশোরগঞ্জের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ে তারা চারজন-বদি, বাদল, আশফাকুস সামাদ আশফি আর মাসুদ ওমর ৷
যুদ্ধে কাজী কামালের যাওয়ার কথা ফতেহ চৌধুরীর সঙ্গে ৷ নির্দিষ্ট দিন নির্দিষ্ট সময়ে একটু দেরি করে ফতেহ চৌধুরীর বাসায় পৌঁছায় কাজী কামাল ৷ ফতেহ নয়, দেখা পায় তার ভাই শাহাদত চৌধুরীর ৷ শাহাদত বলে, ‘তুমি দেরি করে ফেলেছ ৷ ওরা তো তোমার জন্যে ওয়েট করতে করতে শেষে চলে গেল ৷ এখনও সদরঘাট যাও ৷ দেখা পেতেও পারো ৷ মতলবের লঞ্চে খোঁজো ৷’
কাজী কামাল বেরিয়ে যায় ঝড়ের বেগে ৷ সদরঘাটে গিয়ে ঠিকই ধরা পায় সে ফতেহদের ৷ ফতেহ তাকে বলে, ‘আসছ, ভালো করছ ৷ কিন্তু প্রত্যেকের ১৭০ টাকা লাগবে পথের খরচ আর হাতখরচ হিসাবে ৷ তোমার টাকা আনছ!’ কাজী কামালের মুখ শুকিয়ে যায় ৷ সে তো টাকা আনেনি ৷ যুদ্ধে যেতে যে টাকা লাগে, তা সে জানবে কী করে! ‘আমি আইতাছি’ বলে সে লঞ্চ থেকে নেমে যায় ৷
ফতেহ চিন্তায় পড়ে যায় ৷ কাজী কি আবার টাকা জোগাড় করতে বাসায় ফিরে গেল নাকি ? লঞ্চ যদি ছেড়ে দেয় ? তাহলে তো তাদের কাজীকে ছেড়েই চলে যেতে হবে ৷
কাজী কামাল কিন্তু লঞ্চে ফিরে আসে মিনিট দশেকের মধ্যেই ৷ তার হাতে তখন টাকা ৷ সে টাকাটা ফতেহর হাতে তুলে দেয় ৷ ফতে বিস্মিত ৷ ‘টাকা পেলে কই ?’ কাজী কামাল তার বাঁ হাতের কব্জি দেখায় ৷ সেখানে ঘড়ির বেল্ট পরার শাদা দাগটা রয়ে গেছে, কিন্তু ঘড়িটা নাই ৷ ‘বুঝলা না, ফুটপাতে নাইমা ঘড়িটা বেইচা দিয়া আইলাম ৷’ তার মুখে বিজয়ীর হাসি ৷
রুমী তার মা জাহানারা ইমামকে বলে, ‘মা, আমি যুদ্ধে যাব ৷’ জাহানারা ইমাম মুশকিলে পড়েন ৷ তার ছেলের কী-বা এমন বয়স ৷ কেবল আইএসসি পাস করে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে ৷ আবার আমেরিকার ইলিনয় ইনস্টিটিটিউট অফ টেকনোলজিতেও সে ভর্তি হয়ে গেছে ৷ ৫ মাস পরে ওখানে তার ক্লাস শুরু হবে ৷ কদিন পরই তার আমেরিকার উদ্দেশে ফ্লাই করার কথা, সে কিনা বলছে যুদ্ধে যাবে ৷ জাহানারা ইমামের মাতৃহৃদয় বলে, না, রুমী যুদ্ধে যাবে না ৷ সে আমেরিকা যাবে পড়তে, নিরাপদে থাকতে, দেশে ফিরে এসে স্বাধীন দেশের সেবা করবে ৷ অন্যদিকে তাঁর সচেতন দেশপ্রেমিক স্বার্থত্যাগী হৃদয় বলছে, এ শুধুই স্বার্থপরের মতো কথা ৷ দেশের জন্যে দেশের ছেলে তো যুদ্ধে যাবেই ৷ তুমি কেন তাকে আটকে রাখতে চাও ৷ মা বলে ? আর ছেলেরা মায়ের ছেলে নয়! তখন, জাহানারা ইমামের মনে হয়, অন্য ছেলেদের মতো যদি রুমী বিছানায় কোলবালিশ শুইয়ে রেখে চুপিসারে চলে যেত, তাঁকে আর এই যন্ত্রণা সহ্য করতে হতো না ৷ কিন্তু ছোটবেলা থেকেই তিনি ছেলেকে শিখিয়েছেন, মাকে লুকিয়ে কোনো কিছু করতে যেও না ৷ যা করতে চাও, মাকে জানিয়ে কোরো ৷ এখন ? রুমী বিতর্কে চ্যাম্পিয়ন, সে যুদ্ধে যাওয়ার সপক্ষে যুক্তি দেয়, সে যুক্তির তোড়ে হেরে যান মা, শেষে বলেন, ‘যা, তোকে দেশের জন্যে কুরবানি করে দিলাম ৷ যা তুই যুদ্ধে যা ৷’
মুক্তিযোদ্ধারা জানে, পরে বহুদিন রুমীর মা জাহানারা ইমাম তার এই উক্তির জন্য আফসোস করেছেন, অবোধ মাতৃহৃদয় বারবার দগ্ধ হয়েছে অনুশোচনায়, কেন তিনি কুরবানি কথাটা বলতে গেলেন, আল্লাহ বুঝি তার কুরবানি কথাটাই কবুল করে নিয়েছিলেন ৷
আর হাবিবুল আলমের মনে পড়ে যায় যে পাশবালিশ বিছানায় শুইয়ে রেখে এক ভোরে তিনিও পালিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অজানা প্রান্তর আর অনিশ্চিত জীবনের উদ্দেশে ৷
এপ্রিলের ৭ বা ৮ তারিখ ৷ আহমেদ জিয়া, আলমদেরই এক বন্ধু, আলমদের ইস্কাটনের বাসায় আসে ৷ বলে, ‘দোস্ত, একটু রাজশাহী হাউসে আসতে পারবি ?’
‘ক্যান রে ?’
‘আছে, ঘটনা আছে ৷’ জিয়া কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে, ‘মেজর খালেদ মোশাররফ ডাকছে ৷’
‘কই ?’
‘ফ্রন্টে ৷ উনি তো ওনার ফোর বেঙ্গল নিয়া ২৭শে মার্চেই রিভোল্ট করছে ৷ মুক্তিবাহিনীতে উনি ঢাকার ছাত্র চান ৷ তুই যাবি কি যাবি না, এটা আলোচনা করব ৷ আরো দুই-একজন আসবে ৷ তুই আয় ৷ তুই তো স্কাউট ৷’
হাবিবুল আলম বলে, ‘মেজর খালেদ মোশাররফের নাম তো শুনি নাই ৷ মেজর জিয়াউর রহমানের ঘোষণাটা শুনছি রেডিওতে ৷ ওনার ঘোষণা শুনেই বুঝছি বাঙালি সৈন্যরা যুদ্ধ করতেছে ৷ আমাদেরকেও যেতে হবে ৷’
‘আয় বিকালে রাজশাহী হাউসে ৷ চিনেছিস তো, রমনা থানার কাছে ৷’
‘চিনি ৷ লিচ্যাংয়ের বাসা তো ?’
বিকালবেলা রাজশাহী হাউসে মিটিং ৷ হাবিবুল আলমের অস্থির লাগে ৷ সে কল্পনায় নিজেকে দেখতে পায় যুদ্ধের ময়দানে ৷ কিন্তু কে এই মেজর খালেদ মোশাররফ ? তাকে সে চেনে না ৷ তার নাম শোনেনি ৷ কিন্তু মেজর জিয়াউর রহমানের ঘোষণাটা তার কানে বাজছে ৷
বিকালবেলা হাবিব হাজির হয় রাজশাহী হাউসে ৷ তারা ছাদে ওঠে ৷ কাইয়ুম, জিয়া, লিচ্যাং আর হাবিব ৷ লিচ্যাং-ও তাদের কমন বন্ধু ৷ তার ভালো নাম ইরতিজা রেজা চৌধুরী ৷ সে একটু শারীরিকভাবে আনফিট ৷ সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ৷ বয়স কুড়ির কোঠায় ৷ কেউ হয়তো ২১, কেউ ২২ ৷ চৈত্র মাস শেষ হয়ে আসছে ৷ আজকের বিকালটা বেশ গুমোট ৷ সবাই ঘামছে ৷ তবে হঠাৎ করেই হাওয়া বইতে শুরু করে ৷ বসন্তের বিখ্যাত বাতাস ৷ কপালের ঘামে বুলিয়ে দেয় শীতল পরশ ৷ তাদের আরাম লাগে ৷
জিয়া মুখ খোলে-’আমি মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর টু থেকে আসতেছি ৷ ওখানে আমি ট্রেনিং নিচ্ছি ৷ আমাকে পাঠাইছেন ক্যাপ্টেন হায়দার ৷ আমার সাথে আসছে আশফি ৷ আশফাকুস সামাদ ৷ খালেদ ফোর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে রেগুলার আর্মি গঠন করছেন ৷ তার সাথে যোগ দিছেন বর্ডারের ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল্স ৷ ঢাকা থাকবে খালেদ মোশাররফের আওতায় ৷ এখন ঢাকার ছেলে দরকার ৷ মেজর খালেদ মোশাররফ ক্যাপ্টেন হায়দারকে বলছেন, ঢাকায় ছাত্র পাঠাও ৷ ঢাকা থেকে আরো আরো ছাত্রকে নিয়া আসো ৷ আসলে ওনারা চাইছেন ঢাকায় গেরিলা অপারেশন শুরু করতে ৷ যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ৷ এ জন্য ঢাকার ছাত্র দরকার ৷ ক্যাপ্টেন হায়দারকে একবার দেখলেই তোদের পছন্দ হবে ৷ যুদ্ধের শুরুতেই সিলেটে ক্যাপ্টেন হায়দারের হাতে গুলি লাগে ৷ তার বাম হাতে প্লাস্টার আছে ৷ সেই জন্য উনি ফ্রন্টে যেতে পারতেছেন না ৷ হেডকোয়ার্টারে থেকে যুদ্ধের পরিকল্পনা করতেছেন ৷ এখন বল তোরা, যাবি কি-না ৷’
অবশ্যই যেতে হবে ৷ আলম ভাবে ৷ না যাওয়ার প্রশ্নই আসে না ৷ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময় ৷ লিচ্যাং বলে, ‘আমার কী হবে ? আমিও তো যেতে চাই ৷’
হঠাৎ নীরবতা নেমে আসে ওই আড্ডায় ৷ লিচ্যাং যেতে চায় ৷ কিন্তু ও তো খানিকটা শারীরিক প্রতিবন্ধী ৷ ওকে নেওয়া তো ঠিক হবে না ৷
জিয়াই নীরবতা ভঙ্গ করে ৷ বলে, ‘লিচ্যাং তুই ঢাকাতেই থাক ৷ এখন যুদ্ধ মানে তো শুধু বন্দুক দিয়ে গুলি ছোড়া নয় ৷ আরো নানাভাবে যুদ্ধ করা যায় ৷ ঢাকায় যখন ফ্রিডম ফাইটাররা ঢুকবে, তুই তাদেরকে আশ্রয় দিবি ৷ খবর দিবি ৷ এই যে তোর বাসায় আজকে মিটিং হচ্ছে, এটাও তো মুক্তিযুদ্ধেই অংশ নেওয়া ৷’
পরদিন হাবিবুল আলমের বাসায় মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ জিয়া আসে ৷ কীভাবে তারা পাড়ি দেবে সীমান্ত, এ বিষয়ে শলা করতে ৷ সঙ্গে আসে যমজ ভাই মুনির ও মিজান ৷ ঠিক হয়, আলম খবর দেবে কাইয়ুমকে, কাইয়ুম শ্যামলকে, জিয়া নিজেই খবর দেবে মুনীর চৌধুরীর ছেলে ভাষণকে, আর তারা যাত্রা শুরু করবে পরদিন সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ৭টার মধ্যে হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরির কাছের পেট্রলপাম্প থেকে ৷
আগামীকাল যাত্রা ৷ হাবিব আলম রাত্রিবেলা দু চোখের পাতাই এক করতে পারে না ৷ তার বাসা থেকে সে বিদায় নেবে কী করে ? আব্বা-আম্মাকে বলে বিদায় নেওয়ার প্রশ্নই আসে না ৷ সে হলো বাড়ির একমাত্র ছেলে ৷ আর তার বোন আছে চারটা ৷ বড়বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, তিনি থাকেন তিন সন্তানসহ খুলনায়, স্বামী পাকিস্তান নেভির অফিসার ৷ এ বাসায় থাকে তিন বোন ৷ তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাসা থেকে বের হওয়াও মুশকিল ৷ তার ওপর হাবিবুল আলম থাকে বাসার দোতলায় ৷ কাঠের খাড়া সিঁড়ি দোতলা থেকে সোজা নেমে গেছে নিচতলার যে জায়গাটায়, সেখানে সারাক্ষণই কেউ না কেউ বসে থাকে, আসা-যাওয়া করে, কাজ করে ৷
হাবিব একটা ছোট্ট পিআইএ মার্কা ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছে ৷ এটা সে ব্যবহার করেছিল স্কাউটের প্রতিনিধি হিসাবে গত ডিসেম্বরে তার অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় ৷
ভোরের আজান হচ্ছে ৷ হাবিবুল আলম বিছানা ছাড়ে ৷ মশারি টানানোই থাকুক ৷ সে পাশবালিশটাকে শুইয়ে দেয় বিছানায় ৷ ঢেকে দেয় একটা চাদর দিয়ে ৷ তারপর একটা চিঠি লেখে বাসার সবার উদ্দেশে ৷ ‘আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে যাচ্ছি ৷ আমার জন্যে চিন্তা কোরো না ৷ দোয়া কোরো ৷’ চিঠিটা পড়ার টেবিলে রেখে একটা বই দিয়ে চাপা দেয় সে ৷ তারপর কাঁধে ব্যাগটা ফেলে আস্তে করে দরজাটা বন্ধ করে বাইরে বারান্দায় আসে ৷ একটা টিনের চালা পার হতে হবে ৷ তারপর কাঠের ফ্রেম ৷ সেখান থেকে একটা লাফ দিয়ে নিচতলায় নামা যাবে ৷ তাহলেই কেবল সিঁড়িটা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ৷ একটা একটা করে পা বিড়ালের মতো সতর্কতায় ফেলে সে কার্নিশে চলে আসে ৷ তারপর দোতলার মেঝেসমান উচ্চতা থেকে একটা লাফ দিয়ে এসে পড়ে দিলু রোডের সরু-গলিতে ৷ মাটিতে পড়ে যায় সে, ওঠে, তারপর হাত ঝেড়ে রওনা হয় অজানার উদ্দেশে ৷
সীমান্ত পেরিয়ে তারা এসে পৌঁছায় মতিনগরে ৷ সেক্টর টুর হেডকোয়ার্টারে ৷ সেখান থেকে তাদের পাঠানো হয় কাঁঠালিয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবিরে ৷ তারা যোগ দেয় ২ নম্বর প্লাটুনে ৷ তার মানে এরই মধ্যে ১ নম্বর প্লাটুন গড়ে উঠেছে, যারা আগে এসেছে তারা তাতে যোগ দিয়েছে ৷ ১ নম্বর প্লাটুনের কমান্ডার হলেন আজিজ ৷ ছাত্রলীগের ঢাকা কলেজের ভিপি ৷ ২ নম্বর প্লাটুনের কমান্ডার হয় জিয়া ৷
জিয়াসহ হাবিব আলমেরা সেকেন্ড প্লাটুনের সবুজ রঙের তাঁবুতে ঢোকে ৷ দেখতে পায় আরো ৭/৮ জন সেখানে আছে ৷ অর্থাৎ সব মিলে দাঁড়াল ১২/১৩ জন ৷ তাঁবুর এক পাশের ঢাকনা খুলে রাখা হয়েছে ৷ তবু তাঁবুর ভেতরটা গরম ৷
একদিন পরে, ২ নম্বর প্লাটুনের ছাত্রযোদ্ধাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন তখনকার কিংবদন্তি সেক্টর টু-র প্রধান মেজর খালেদ মোশাররফ ৷ সঙ্গে আসেন ক্যাপ্টেন হায়দার, শহীদুল্লাহ খান বাদল প্রমুখ ৷ খালেদ মোশাররফ লম্বা, ফরসা, তার পরনে নীল রঙের ট্রাউজার, গায়ে হলদে রঙের ফুলহাতা শার্ট, কোমরে পিস্তল ৷ ছাত্রযোদ্ধাদের সামনে তিনি দেন এক সম্মোহনী ভাষণ ৷ তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানি হানাদার শাসকদের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করব তিনভাবে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর সামরিক ক্ষেত্রে ৷ এ লড়াইয়ে ছাত্রদের ভূমিকা হবে খুবই গুরুত্বপর্ণ ৷ তোমাদের দিয়েই চলবে আমাদের গেরিলা ওয়ারফেয়ার অব সেক্টর টু ৷ তোমরা যারা এসেছ, তারা মনে রেখো, একবার শুরু করলে ফিরে যাওয়ার কোনো পথ নেই, এখনও চলে যেতে পারো, পরে আর পারবে না, হয় জিততে হবে, নয়তো মরতে হবে ৷ তবে মনে রেখো, স্বাধীন দেশের সরকার জীবিত গেরিলাদের চায় না, নো গভর্নমেনট ওয়ান্টস অ্যান অ্যালাইভ গেরিলা, নিতে পারে না, দেশ স্বাধীন হলে তোমাদের কী হবে আমি বলতে পারব না, তবে যদি তোমরা আত্মত্যাগ করো, যদি শহীদ হও, তাহলে সেটা হবে তোমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ ব্যবহার, এই মৃত্যু হবে বীরের মৃত্যু, দেশের জন্য মৃত্যু, মাতৃভূমির জন্যে মৃত্যু, মায়ের জন্যে মৃত্যু ৷’
শাহাদত চৌধুরী ওরফে শাচৌকে যে মেজর খালেদ তাঁর কাছে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন, তার একটা কারণ ছিল ৷ সেটা হলো শাচৌয়ের সঙ্গে ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলের স্বাভাবিক যোগাযোগ ৷ শাচৌ, দেখা যাচ্ছে, ঢাকা গেলে সঙ্গে করে আনেন আলতাফ মাহমুদের সুর করা নতুন গান, আরো পরমাশ্চর্য, তিনি একবার সঙ্গে করে আনলেন দুটি কবিতা ৷ সেই কবির নাম বলা বারণ, কিন্তু খালেদ মোশাররফকে বলতে তো মানা নাই ৷ শামসুর রাহমান ৷ শামসুর রাহমান রয়ে গেছেন অবরুদ্ধ বাংলাদেশে, কিন্তু গোপনে লিখে শাচৌয়ের হাতে পাঠিয়েছেন একজোড়া আশ্চর্য কবিতা ৷ গোপনে সেই কবিতা বয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মেলাঘরের ক্যাম্পে খালেদের হাতে পৌঁছে দিলেন শাচৌ ৷ সুলতানা কামাল পড়ে শোনাল কবিতা দুটো, খালেদসহ মুক্তিযোদ্ধাদের ৷
স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা অবিনাশী গান
স্বাধীনতা তুমি কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুলের বাবড়ি দোলানো
মহান পুরুষ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-
আর
তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতকাল ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতকাল দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
সকিনা বিবির কপাল ভাঙল
সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর ৷
কবিতা দুটো শুনে পুরো ক্যাম্প উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিল ৷ এর পরে শাচৌ আর আলম অবসর পেলে যেতেন কবি শামসুর রাহমানের বাড়ি ৷ কবিও খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করতেন গেরিলাদের ৷ এই গেরিলাদের দেখেই শামসুর রাহমান লেখেন তাঁর আরেকটা অসাধারণ কবিতা-গেরিলা ৷ ওই কবিতাটা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিলেন শাচৌ, যখন পড়ে শোনানো হলো, আবেগে চোখ ভিজে এসেছিল অনেকেরই ৷
দেখতে কেমন তুমি ? কী রকম পোশাক আশাক
পরে করো চলাফেরা ? মাথায় আছে কি জটাজাল ?
পেছনে দেখতে পারো জ্যোতিশ্চক্র সন্তের মতন ?
টুপিতে পালক গুঁজে অথবা জবরজং ঢোলা
পাজামা কামিজ গায়ে মগডালে একা শিস দাও
পাখির মতন কিংবা চাখানায় বসো ছায়াচ্ছন্ন ৷
দেখতে কেমন তুমি ?-অনেকেই প্রশ্ন করে, খোঁজে
কুলুজি তোমার আঁতিপাঁতি ৷ তোমার সন্ধানে ঘোরে
ঝানু গুপ্তচর, সৈন্য, পাড়ায় পাড়ায় ৷ তন্ন তন্ন
করে খোঁজে প্রতিঘর ৷ পারলে নীলিমা চিরে বের
করত তোমাকে ওরা, দিত ডুব গহন পাতালে ৷
তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছ হাত ধরে পরস্পর ৷
সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ-তাড়ানিয়া;
তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন, সন্তান আমার ৷
শাহাদত চৌধুরী আজ যুদ্ধের ১৪ বছর পরেও স্মরণ করতে পারেন, ভাই আর সন্তান বলে সম্বোধন করার এই শেষ পঙ্ক্তিটা তাদের শরীরে কী রকম বিদ্যুৎ খেলিয়ে দিয়েছিল ৷
ট্রেনিং শেষে হাবিবুল আলমের প্রথম ঢাকা আগমন আর ঢাকায় প্রথম অপারেশন ছিল মেজর নূরুল ইসলাম শিশুর স্ত্রী আর দু কন্যাকে ঢাকা থেকে মতিনগর নিয়ে যাওয়া ৷ এ জন্যে নুরুল ইসলাম পুরস্কার হিসেবে হাবিবুল আলমকে দিতে চেয়েছেন একটা চায়নিজ এসএমজি আর কাজী কামালকে একটা চায়নিজ পিস্তল ৷ এর আগে কাজী কামাল কাইয়ুমকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় এসে মেজর শাফায়াত জামিলের স্ত্রী ও দু পুত্রকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার সাফল্য দেখিয়েছে ৷ এবার মেজর নুরুল ইসলাম শিশুর পরিবারকে নিতে কাজী কামালের ডাক পড়লে হাবিবও তার সঙ্গে যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করে, কারণ হাবিব শিশুর বাসাটা আগে থেকেই চেনে ৷ আর কাজী কামালকে হাবিবুল আলম আগে থেকেই চেনে বাস্কেটবল খেলোয়াড় হিসাবে, তাকে ডাকে কাজী ভাই বলে, হাবিবুল আলম নিজেও ফার্স্ট ডিভিশন লিগে হকি খেলে থাকে ৷
এই পিস্তলটা কাজী জিতে নিতে সক্ষম হয়, হাবিবও জিতে নেয় এসএমজিটা, মেজর নুরুল ইসলামের পরিবারকে তারা সীমান্তের ওপারে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে পারে সাফল্যের সঙ্গে ৷ এই পিস্তলটার কথা ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষভাবে মনে পড়ে যায় এ জন্য যে, জুয়েলের খুব লোভ ছিল পিস্তলটার ওপর ৷ আজাদদের বাসা থেকে ধরা পড়ার দিনও জুয়েল তার পাশে এই পিস্তলটা রেখেছিল ৷ ওখান থেকেই কাজী কামাল পিস্তলটাকে হারায় আর হারায় আজাদকে, জুয়েলকে, বাশারকে ৷
৩৬. মা
২৫শে মার্চ রাতে রাজারবাগে কী ঘটেছিল, সেটা আজাদ আর বাশার কিছুটা নিজের চোখে দেখেছিল ৷ আর এপ্রিল মে মাসে কী ঘটছে সেখানে, তার বিবরণ তারা পেয়েছিল এক পুলিশ সুবেদারের কাছ থেকে ৷ এই পুলিশ সুবেদারের বাড়ি ছিল মাওয়ায় ৷ আজাদরা তাকে ডাকত খলিল মামা বলে ৷
মা তাঁর কথা মাঝে মধ্যেই স্মরণ করতেন, ‘খলিলটা যে আর আসে না ৷ বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে কে জানে ? আজাদ, একটু খোঁজ নিস তো ৷ খলিল বেঁচে আছে নাকি ?’
এপ্রিলের মাঝামাঝি পুলিশের সুবেদার খলিল একদিন আসেন আজাদদের বাসায় ৷
মা বলেন, ‘আল্লাহ মালিক ৷ তুমি বেঁচে আছ খলিল ৷’
‘জি বুবু ৷ হায়াত আছে ৷ আপনাদের দোয়ায় বাঁইচা আছি ৷’
আজাদের সঙ্গেও তাঁর দেখা হয় ৷ মা তাঁর জন্যে চাল চড়িয়ে দেন চুলায় ৷
মা বলেন, ‘তোমার কোনো খবর পাই না ৷ বড় দুশ্চিন্তা হচ্ছিল ৷ চারদিক থেকে কত দুঃসংবাদ আসছে ৷’
খলিল বলেন, “বুবু, কী দেখলাম এই জীবনে ৷ দোজখ দেখা হইয়া গেছে ৷ মার্চ মাসের ২৯ তারিখে কোতোয়ালি থানায় পোস্টিং হইল ৷ আমরা আটজন ৷ থানায় গিয়া দেখি, কী কবো বুবু, দেওয়ালে, মেঝেতে চাপ চাপ রক্ত, থানার দেওয়াল মনে করেন গুলির আঘাতে ঝাঁজরা হইয়া আছে ৷ বুড়িগঙ্গার পাড়ে গিয়া খাড়াইলাম ৷ খালি লাশ আর লাশ ৷ নদীর পানি দেখা যায় না ৷ মনে করেন পুকুরে বিষ দিলে যেমন মাছে পানি ঢাইকা থাকে, বুড়িগঙ্গায় খালি মরা মানুষ ভাসতেছে ৷ একটা পুলিশের লাশ দেইখা আগায়া গেছি ৷ দেখি, আমাদের পিআরএফের কনস্টেবল আবু তাহের ৷ আমি চোখের পানি আটকাইতে পারি না ৷ আরো বহু সিপাহির ক্ষত-বিক্ষত লাশ ভাসতেছে ৷ আমি তাহেরের বডি ধরতে গেছি, বেহুঁশের মতো, পেছন থাইকা এক পাঞ্জাবি সোলজার চিল্লায়া উঠল, ‘শুয়র কা বাচ্চা, তুমকো ভি পাকড়াতা হায়, কুত্তা কা বাচ্চা, তুমকো ভি সাথ মে গুলি করেগা ৷’ আমি মনে মনে কই, আমি সাব ইন্সপেক্টর আর তুমি একজন সোলজার, আমার সাথে কুকুরের মতো ব্যবহার করতেছ, করো ৷ আল্লাহ বিচার করবে ৷”
মা বলেন, ‘মহুয়া, দ্যাখো তো, চুলায় ভাতের কী অবস্থা ৷ আঁচটা একটু কমিয়ে দিও মা ৷ হ্যাঁ ভাই, বলো ৷’
খলিল বলে চলেন, ‘কোতোয়ালি থানার বরাবর সোজাসুজি গিয়া বুড়ীগঙ্গার লঞ্চঘাটটা আছে না, সেই পারে খাড়াইলাম ৷ দেখলাম বুড়িগঙ্গার পাড়ে লাশ, খালি লাশ, পইচা-গইলা যাইতেছে, বেশুমার মানুষের লাশ ভাসতেছে ৷ দেখলাম কত মানুষ মইরা ভাইসা আছে ৷ বাচ্চা, বুড়া, ছেলে, মেয়ে ৷ যতদূর চোখ যায়, দেখলাম বাদামতলি ঘাট থাইকা শ্যামবাজার ঘাট পর্যন্ত নদীর পাড়ে অগণিত মানুষের পচা-গলা লাশ ৷ বুবু, ভাইগ্না এখানে আছে, কওয়া যায় না আবার না কইয়াও পারি না, অনেক উলঙ্গ মহিলার লাশ দেখলাম, পাকিস্তানিরা অত্যাচার কইরা মারছে, দেইখাই বোঝা যাইতেছে ৷ ছোট ছোট মাসুম বাচ্চাদের মনে হইল আছাড় মাইরা খুন করছে ৷ সদরঘাট টার্মিনালের শেডের মধ্যে ঢুইকা খালি রক্ত আর রক্ত দেখলাম…দেখলাম মানুষের তাজা রক্ত এই বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে ৷ বহু মানুষরে ধইরা আইনা টার্মিনালে জবাই করছে ৷ বেটন আর বেয়নেট দিয়া খোঁচায়া মাইরা টাইনা হেঁচড়ায়া পানিতে ফেইলা দিছে ৷ শেডের বাইরের খোলা জায়গাটায় গিয়া দেখি, কাক আর শকুনে ছা্ইয়া গেছে ৷ সদরঘাট টার্মিনাল থাইকা পূর্ব দিকে পাক মিলিটারির সদর আউটপোস্টটা আছে না, সেই দিকে তাকাইলে দেখবেন নদীর পাড়ের সমস্ত বাড়িঘর ছাই কইরা ফেলছে ৷ দেখলাম রাস্তার পাশে ঢাকা মিউনিসিপালিটির কয়েকটা ময়লা পরিষ্কার করার ট্রাক খাড়ায়া আছে, সুইপাররা হাত-পা ধইরা টাইনা হেঁচড়ায়া ট্রাকে লাশ উঠাইতেছে ৷ কাপড়ের বাজারের চারদিকে রূপমহল সিনেমা হলের সামনে খালি লাশ ৷ খ্রিষ্টান মিশনারি অফিসের সামনে, সদরঘাট বাসস্টপেজের চারদিকে, কলেজিয়েট হাইস্কুল, জগন্নাথ কলেজ, পগোজ হাইস্কুল, ঢাকা জজকোর্ট, পুরাতন স্টেট ব্যাংক বিল্ডিং, তারপরে ধরেন সদরঘাট গির্জা, নওয়াবপুর রোডের চারদিকে, ক্যাথলিক মিশনের বাইরে ভিতরে, আদালতের সামনে বহু মানুষের ডেড বডি পইড়া আছে ৷’
আজাদ মাথা নিচু করে সব শুনছে ৷ মায়ের চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়ছে ৷
মা ভাত বাড়েন ৷ আজাদ আর খলিল একসঙ্গে ভাত খেতে বসে ৷ খলিল এমনভাবে গোগ্রাসে খেতে থাকেন যে কতদিন তিনি খান না ৷ আজাদ ভাতের থালায় ভাত নাড়েচাড়ে. কিন্তু ভাত তুলে মুখে দিতে পারে না ৷ তার নাকে এসে লাগে লাশের গন্ধ ৷
আজাদের এই খলিল মামা পরে আবার আসেন তাদের বাসায় ৷ বাশার ছিল সেদিন ৷ আজাদ তাঁকে তাদের ঘরে নিয়ে আসে ৷ বলে, ‘খলিল মামা, কী অবস্থা বলেন তো ৷’
তিনি বলেন, ‘বাশার সাহেব তো আবার সাংবাদিক, সাংবাদিক মানে হইল সাংঘাতিক ৷ আমি তার সামনে কিছু বলব না ৷’
বাশার বলে, ‘মামা, আমি এসব লিখব না ৷ শুধু শুনে রাখি, দেশ যদি কোনো দিন স্বাধীন হয়, তখন লিখব ৷’
খলিল মামা বলেন, ‘বাবা রে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আছি ৷ যা দেখতেছি, তা আল্লাহ কেমনে সহ্য করতেছে, বুঝতেছি না ৷ পাঞ্জাবি সৈন্যরা ট্রাকে কইরা, জিপে কইরা ডেলি স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির ছাত্রীদের ধইরা আনে ৷ ঢাকার নানান জায়গা থাইকা বাচ্চামেয়ে ইয়ং মেয়ে সুন্দরী মহিলাদের ধইরা আনে ৷ হাতে বইখাতা দেইখাই বোঝা যায় স্টুডেন্ট ৷ মিলিটারি জিপে ট্রাকে যখন মেয়েদের পুলিশ লাইনে আনা হয়, তখন পুলিশ লাইনে হৈচৈ পইড়া যায় ৷ পাকিস্তানি পুলিশ জিভ চাটতে চাটতে ট্রাকের সামনে আইসা মেয়েদের টাইনা হেঁচড়ায়া নামায়া কাপড়-চোপড় ছিঁইড়া-খুঁইড়া উলঙ্গ কইরা আমাদের চোখের সামনেই মাটিতে ফেইলা কুত্তার মতো অত্যাচার করে ৷ সারা দিন নির্বিচারে রেইপ করার পর বৈকালে পুলিশ হেডকোয়ার্টার বিল্ডিংয়ের উপর চুলের সাথে লম্বা লোহার রড বাইন্ধা রাখে ৷ আবার রাতের বেলায় শুরু হয় অত্যাচার ৷ গভীর রাতে আমাদের কোয়ার্টারে মেয়েদের কান্না শুইনা সবাই ঘুম থাইকা জাইগা জাইগা উঠি ৷’ খলিল সাহেব কাঁদতে থাকেন ৷
আজাদ আর বাশার নীরব ৷
তারা বুঝতে পারে না, খলিল মামাকে তারা কীভাবে সান্ত্বনা দেবে ? তাদেরকেই বা সান্ত্বনা দেয় কে ? আজাদ ভেতরে ভেতের ফুঁসতে থাকে ৷ এই অত্যাচার মুখ বুজে যে সহ্য করে, সে কি মানুষ ?
৩৭. মা
বর্ষা এবার প্রলম্বিত হচ্ছে ৷ একেক দিন বৃষ্টি শুরু হলে আর থামতেই চায় না ৷ আর বৃষ্টি না হলে পড়ে গরম ৷ সেটা আরো অসহ্য ৷ আজাদদের মগবাজারের বাসার দু বাসা পরের বাসাটার সামনের বাগানে বেলিফুলের ঝাড়ে ফুল ফুটে থাকে ৷ একেকটা রাতে তার ঘ্রাণ এসে নাকে লাগে আজাদের ৷ আজাদের কেমন ঘোর ঘোর লাগে ৷ বেলির গন্ধের সঙ্গে রাজারবাগে দেখা লাশের গন্ধ যেন মিশে যায় ৷
এক দুপুরে কাজী কামালের সঙ্গে দেখা আজাদের ৷ ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সামনে একটা সিগারেটের দোকানে ৷ এটা আজাদের প্রিয় একটা সিগারেটের দোকান ৷ ৩ টাকার সিগারেট কেনার জন্য আজাদ এখানে আসে ৩ টাকা বেবিট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে হলেও ৷
কাজী কামালকে দেখেই আজাদ উল্লসিত, ‘আরে কাজী, তুমি কই হারিয়ে গেলে ৷ দেখা পাই না ৷’
কাজী কামাল সন্ত্রস্ত ৷ পাগল কী বলে! এইভাবে প্রকাশ্য রাজপথে এই ধরনের কথা বলার মানে ধরা পড়ে যাওয়া ৷ কাজী কামাল কথা ঘোরানোর জন্য বলে, ‘এরামে চলো ৷ তোমারে সব কইতেছি ৷’
এরাম রেস্তোরাঁ এবং বার ৷ দিনের বেলাতেও খোলা থাকে ৷ আজাদ আর কাজী কামাল সেখানে যায় ৷ বারটা এখন ফাঁকা ৷ একটা কোনায় তারা দুজন বসে পড়ে ৷
কাজী কামাল বলে, ‘আজাদ ৷ তোমার একটু হেল্প দরকার ৷ আমি তো ট্রেনিং নিয়া আসছি ৷ গেরিলা ট্রেনিং ৷’
আজাদ বলে, ‘এটা তুমি কী করলা ? আমাকে ফেলে রেখে একা একা চলে গেলা ৷ তুমি ওঠো ৷ যাও ৷ তোমাকে আমি কিছুই খাওয়াব না ৷’
কাজী কামাল বলে, ‘আরে পাগলামো কইরো না ৷ তুমি এখানে থাইকাই যুদ্ধ করতে পার ৷ হেল্প আস ৷’
আজাদ বলে, ‘কী ধরনের হেল্প ?’
‘এবার আমরা অনেক অস্ত্রশস্ত্র আনছি ৷ রাখার জায়গা নাই ৷ আবার আমাদেরও থাকার জায়গা লাগে ৷ হাইড আউট ৷ তোমার বাসায় আমাদের জায়গা দিতে পার ৷’
‘অফ কোর্স ৷’
‘বুইঝা বলো ৷ এখনই বলার দরকার নাই ৷ তোমার মায়ের পারমিশন নাও ৷ বাসায় বাইরের ছেলেরা থাকবে ৷ অস্ত্রপাতি থাকবে ৷ খালাম্মাকে না জানায়া এসব করা উচিত হবে না ৷’
‘মা কিছু বলবে না ৷ রাজি হয়েই আছে ৷’
‘তবুও তুমি মারে জিগাও ৷ রান্নাবান্না কইরা খাওয়াইতে তো হবে ৷’
‘মা তো খাওয়ানোর লোক পেলে খুশি হয় ৷’
‘আরে তুমি জিগাও তো ৷ আমি তোমার বাসায় কালকা আসতেছি ৷ জুয়েলকেও নিয়া আসব ৷ সকাল ১০টায় বাসায় থাইকো ৷’
‘জুয়েলও গিয়েছিল নাকি ?’
‘হ ৷ আরো কে কে আছে আমগো লগে, দেখলে বেহুঁশ হইয়া যাবা ৷ হা-হা-হা ৷’
দুজন খদ্দের এসে তাদের পাশের টেবিলে বসে ৷ তারা আর আলাপ করতে পারে না ৷ গেলাস শেষ করে উঠে পড়ে ৷ আজাদ বিল মিটিয়ে দেয় ৷
আজাদ বাসায় যায় ৷ মাকে বলে, ‘মা শোনো, তোমার সাথে কথা আছে ৷’
মা রান্নাঘরে ছিলেন ৷ তার কপালে ঘাম ৷ তিনি আঁচল দিয়ে ঘাম মোছেন ৷ হাতের হলুদ তার মুখে লেগে যায় ৷ ‘বল, কী বলবি, চুলায় রান্না ৷’
‘বসো ৷ বসে মন দিয়া শোনো ৷’
‘বলে ফেল ৷’
‘আগে বলো, না করবা না ৷’
‘আরে তুই আগে বলে ফেল না ৷’
‘মা, আমার কয়জন বন্ধুবান্ধব আমাদের বাড়িতে এসে থাকবে ৷’
‘থাকবে থাকুক ৷ এটা আবার জিজ্ঞেস করার কথা ৷ বন্ধুগুলো কারা ?’
‘এই ধরো কাজী কামাল, জুয়েল ৷’
‘কাজী, জুয়েল এরা অনেক দিন আমাদের বাসায় আসে না ৷ আসতে বল ৷ ওদের বাড়িতে কি অসুবিধা হয়েছে কোনো ?’
আজাদ কন্ঠস্বর নামিয়ে বলে, ‘ওরা তো যুদ্ধ করছে ৷ শুনছ না, ঢাকায় গেরিলা অপারেশন হচ্ছে ৷ ওরাই করছে ৷ তাই নিজের বাসায় থাকা নিরাপদ না ৷ সাথে কিছু অস্ত্রশস্ত্রও থাকে তো ৷’ আজাদ শেষের কথাটা বলে রাখে ইচ্ছা করেই ৷ অস্ত্র রাখার অনুমতিটাও এই সুযোগে নিয়ে রাখা দরকার ৷
মা স্থির হয়ে যান খানিকক্ষণের জন্যে ৷ তাঁর কপালে ঘামের বিন্দুগুলো শিশিরের মতো জমতে থাকে ৷ এবার তিনি কী বলবেন ?
একটামাত্র ছেলে তাঁর ৷ এই ছেলেকে মানুষ করার জন্যেই যেন তিনি বেঁচে আছেন ৷ ছেলে তাঁর এমএ পাস করেছে ৷ এখন তার জীবন, তার নিজের জীবন ৷ সত্য বটে, ছেলে তাঁর এখন আয়-রোজগার করবে, এখন মায়ের কষ্ট করে জমি আবাদ করার দিন শেষ, বীজ বোনা, নিড়ানি দেওয়া সব সমাপ্ত, এখন তাঁর ফসল ঘরে তোলার দিন ৷ এখন সংসারে তাঁর লাগার কথা নবান্নের আনন্দের ঢেউ, নতুন ভাতের গন্ধের মতোই আনন্দের হিল্লোলে তাঁর ঘরে মৌ-মৌ করার কথা ৷
ইতিমধ্যেই তিনি ছেলের জন্যে একটা বউ দেখে রেখেছেন ৷ আলাপ-আলোচনা কেবল শুরু হয়েছে ৷ আজাদকে নিয়ে তিনি একদিন যাবেন মেয়ের বাসায়, বেড়াতে যাওয়ার ছলে দেখে আসবেন মেয়েকে ৷
এর মধ্যে এ কোন প্রস্তাব!
কিন্তু তিনি নাই-বা করেন কোন মুখে! জুয়েলের মাও তো ছেড়েছে জুয়েলকে, কাজী কামালের মা কাজী কামালকে! আর তা ছাড়া ২৫শে মার্চের পরে ঢাকা শহরের ওপরে পাকিস্তানি মিলিটারি কী অত্যাচার নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে, সে খবর কি তিনি পাচ্ছেন না! বিনা দোষে মারা পড়ছে হাজার হাজার মানুষ ৷ রোজ মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে ক্যান্টনমেন্টে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে, অত্যাচার করছে মেয়েদের ওপর ৷ তার জুরাইনের পীরসাহেব বলেন, ‘মেয়েদের ওপরে অত্যাচার যখন শুরু হয়েছে, পাকিস্তান আর্মি তখন পারবে না ৷ আল্লাহতালা এই অত্যাচার সহ্য করবেন না ৷’
না ৷ এই অত্যাচার চলতে দেওয়া যায় না ৷ এটা অধর্ম ৷ তাঁর অবশ্যই উচিত মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা ৷ রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে একটা গান শোনা যায় : মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি… হ্যাঁ, একটা ফুলকে, একটা দেশকে, দেশের মানুষকে তো বাঁচাতে হবে, আর বাঁচাতে হলে যুদ্ধ তো করতেই হবে ৷ আজাদের বন্ধুরা যুদ্ধ করছে, সারা বাংলার কত কত তরুণ-যুবক, কত কত মায়ের সন্তান যুদ্ধে গেছে, আর তার ছেলে যোদ্ধাদের সাহায্য করবে না ?
তিনি কপালের ঘাম মুছে বলেন, ‘নিয়ে আসিস তোর বন্ধুদের ৷’
আজাদ খুশি হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে ৷ বলে, ‘মা, তোমার কপালে হলুদ লেগেছে, সুন্দর দেখাচ্ছে ৷’
কাজী কামাল আসে পরদিন সকাল ১০টায় ৷ মা তার সামনে আসেন ৷ বলেন, ‘কেমন আছ বাবা ৷ কী খাবে ? আজাদ আমাকে বলে কামাল, জুয়েল এরা এসে বাসায় থাকবে ৷ এ জন্য কি পারমিশন নিতে হয় নাকি! তোমরা আমার ছেলের মতো না ? আসবে ৷ যখন সুবিধা মনে করবে আসবে ৷’
জায়েদের মনে পড়ে, আজাদদের মগবাজারের বাসাটা ছিল একটা ছোটখাটো ক্যান্টনমেন্ট ৷ প্রচুর অস্ত্র গোলাবারুদ আসত এ বাসায় ৷ আবার এখান থেকে বিভিন্ন বাসায় সেসব চালান হয়েও যেত ৷ সে নিজেও বস্তায় ভরে অস্ত্র নিয়ে গেছে আশপাশের বাসায় ৷ দিলু রোডের হাবিবুল আলমের বাসায় যেমন ৷
তার এই বীরত্ব নিয়ে কৌতুক করত মর্নিং নিউজের সাংবাদিক আবুল বাশার ৷ বলত, কিরে, ভয় পেয়েছিস নাকি! আয় তো, এদিকে আয় ৷ জায়েদের প্যান্ট একটানে খুলে বলত, দেখি, প্যান্টের মধ্যে হেগে ফেলেছিস নাকি!’
জায়েদ খুবই বিরক্ত হতো ৷ সে কত কষ্ট করে পিঠে বয়ে রেললাইন ধরে এগিয়ে গিয়ে দিলু রোডের পেছন দিয়ে ঢুকে অস্ত্র রেখে এল ৷ আর তার সঙ্গে কিনা এই ইয়ারকি ৷ বাশারের লুঙ্গিটা ধরে একটা টান দেবে নাকি সে!
দাদার বন্ধু ৷ সে কিছু বলতেও সাহস পায় না ৷
আজাদের আরেক খালাতো ছোট ভাই টিসুর মনে পড়ে, একবার আজাদ ধরে নিয়ে এল এক পুরনো খবরের কাগজের ফেরিঅলাকে ৷ তাকে নিয়ে গেল ঘরের মধ্যে ৷ টিসুর ছিল কতগুলো পুরোনো বইখাতা, সেসব বিক্রি করার উদ্দেশ্যে সে ওই ঘরে গিয়ে দেখে ফেরিআলার ডালায় কাগজপত্রের নিচে সব আগ্নেয়াস্ত্র ৷ ফেরিঅলাটাও আসলে এক মুক্তিযোদ্ধা ৷ টিসুর আর বইখাতা বিক্রি করা হয় না ৷
আর সৈয়দ আশরাফুল হকের মনে পড়ে, যুদ্ধের সময় তাদের ইস্কাটনের বাড়িতে বদিউল আলম আর স্বপন ছিল দুই মাসের মতো ৷ আশরাফুলের বাবা নান্না মিয়া কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা ছিলেন বলে ধরেই নেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের সন্দেহের তালিকায় এই বাসা থাকবে না ৷ এটা হতে পারে মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ৷ যুদ্ধের মধ্যে একদিন কাজী কামাল উদ্দিন, জুয়েল, বদি তাদের বাসায় আসে ৷ সঙ্গে আজাদও ছিল ৷
জুয়েল বলে, ‘আমরা তো সব যুদ্ধে ইনভল্ভ্ড হয়ে গেছি ৷ তুমি কী করবা ?’
সৈয়দ আশরাফুল একই সঙ্গে ভয়ে কাঁপে, আবার বিস্ময়ে চোখের পাতা পিটপিট করতে থাকে, কারা কারা জড়িয়ে পড়ছে যুদ্ধের সঙ্গে, সব খেলোয়াড়, সব ভালো ছেলে, সে লক্ষ করে, এই গেরিলারা নিজেদের মধ্যে সব সময় কথা বলে ইংরেজিতে… আর বদিকে দেখে তার বিস্ময় আরো ব্যাপক, বদি ভাই! এনএসএফের গুণ্ডা বদি ভাই, তিনিও ট্রেনিং নিয়ে এসেছেন!
সৈয়দ আশরাফুল জবাব দেয়, ‘আপনাদের যা যা সাহায্য করন লাগে, করুম ৷ বাট আই উইল নট গো টু ইন্ডিয়া…’
বদিউল আলম আর স্বপন-এই দুই যোদ্ধা আশরাফুল হকের বাড়িতে যখন ছিল, তখন বদির এক অসাধারণ গুণ পর্যবেক্ষণ করে আশরাফুল ৷ আশরাফুলের এক বোন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, তাঁর সংগ্রহে ছিল প্রচুর বই, দেশী-বিদেশী বই, বদি দুই মাসে পুরো লাইব্রেরির অর্ধেকটা পড়ে সাবাড় করে ফেলে ৷ একটা বই হাতে নিয়ে সে ঘন্টা তিন-চারেক একেবারে দুনিয়াদারির বাইরে চলে যেত, পড়া শেষ করে তারপর যেন ফিরে আসত মর্ত্যে ৷
সৈয়দ আশরাফুল হকের এও মনে পড়ে, একাত্তরে আজাদ ভাইদের বাসাটা ছিল একটা মুক্তিযোদ্ধা মেসের মতো ৷ প্রায়ই বিনা নোটিসে আজাদের মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুরা চলে আসত বাসায় ৷ থাকার দরকার হলে থাকত, খাওয়ার দরকার না হলেও খেতে বাধ্য হতো ৷ কারণ আজাদের মা না খাইয়ে ছাড়তেন না তাদের ৷
জুয়েল আর কাজী কামাল মাঝে মধ্যেই আজাদদের বাসায় আসে ৷ রাতে থাকে ৷ কোনো অপারেশন না থাকলে তাস খেলে ৷ টিভি দেখে ৷ আর আজাদের সঙ্গে গল্প করে ৷
জুয়েল বলে, ‘দোস্তো, যখন তুই আর্মস হাতে নিবি, ফায়ার করবি, তখন কিন্তু ইরেকশন হয় ৷ ঠিক কি না কাজী ভাই ?’
কাজী কামাল স্বীকার করে, ‘হয় ৷’
জুয়েল বলে, ‘আজাদ, তুমি তো দোস্তো বুঝবা না ৷ তুমি তো আর্মস নাড়ো নাই ৷’
আজাদ হাসে ৷ ‘কী কয় ৷ আমাদের আর্মসের দোকান ছিল না ? আমার টার্গেট তোদের চাইতে ভালো ৷ আরে আমি যতগুলান পাখি শিকার করছি, আর কেউ করতে পারছে ?’
জুয়েল হাসে ৷ ‘পাখি শিকার করা আর পাক আর্মি মারা আলাদা ব্যাপার ৷ পাঞ্জাবি হইলেও তো মানুষ ৷’
আজাদ বলে, ‘দ্যাখো ৷ পাখি মারতে মায়া লাগে ৷ পাঞ্জাবি মারতে আবার মায়া কী রে! ওরা কেমন করে মারছে!’
আজ মনে হয় তাদের গল্পে পেয়েছে ৷ জুয়েল আর কাজী কামাল আজাদকে শোনাচ্ছে তাদের অপারেশনের কথা ৷
জুয়েল শোনায় তাদের ফার্মগেট অপারেশনের বিস্তারিত বিবরণ ৷
ধানমন্ডি ২৮-এর হাইড আউটে মিটিং ৷ আলম, বদি, স্বপন, চুল্লু ভাই ছাড়াও মিটিংয়ে ছিলেন শাহাদত চৌধুরী ৷ ঠিক হলো ফার্মগেটের আর্মি চেকপোস্ট অ্যাটাক করা হবে ৷ সবচেয়ে বেশি উৎসাহ বদির ৷ এক সপ্তাহ ধরে রেকি করা হলো ৷ তারপর আবার মিটিং ৷ সে মিটিংয়ে ঠিক হলো ফার্মগেটের সঙ্গে সঙ্গে দারুল কাবাবেও আক্রমণ চালানো হবে ৷ ওটাও একই ময়মনসিংহ রোডে ৷ দুটো গ্রুপ গঠন করা হলো ৷ ফার্মগেট অপারেশনে থাকবে বদি, আলম, জুয়েল, পুলু আর সামাদ ভাই ৷ আহমেদ জিয়ার নেতৃত্বে চুল্লু ভাই, গাজি থাকবে দারুল কাবাব ঘর অপারেশনে ৷ ফার্মগেট অপারেশন শেষ হলে গ্রেনেড চার্জ করা হবে, এটাই হবে দারুল কাবাবে হামলা করার সংকেত ৷
সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে ফার্মগেটে মিলিটারি ক্যাম্পে হামলা করার সময় ঠিক হলো ৷ ওই দিন বিকালে সবাই মিলিত হলো সামাদ ভাইয়ের মগবাজারের বাসায় ৷ আলমের হাতে মেজর নুরুল ইসলাম শিশুর দেওয়া এসএমজি ৷ অন্য সবার হাতে থাকে স্টেনগান ৷ অপারেশন করতে দু-তিন মিনিট লাগার কথা ৷ এর মধ্যে আলম একটা ঝামেলা করে ফেলে ৷ তার সাব মেশিনগান পরিষ্কার করতে গিয়ে পরিষ্কার করার নিজস্ব উদ্ভাবিত পুল নলের ভেতরে আটকে যায় ৷ সময় পেরিয়ে যাচ্ছে ৷ সাড়ে ৬টা বাজে ৷ সবাই উৎকন্ঠিত ৷ এসএমজি চালু না হলে আজকের অপারেশনই হবে না ৷ শেষে কেরোসিন ঢেলে ভেতরে আটকে যাওয়া দড়ির গিঁটে আগুন লাগিয়ে ওটাকে জঞ্জালমুক্ত করা যায় ৷
নিয়ন সাইনের মালিক সামাদ ভাই গাড়ি চালাবেন ৷ বদি আর আলম থাকবে সামনের সিটে ৷ জানালার ধারে থাকবে আলম ৷ পেছনের সিটে স্বপন, জুয়েল আর পুলু ৷ এর আগে আলম, বদি, সামাদ ভাই ফার্মগেট এলাকা অনেকবার রেকি করেছে ৷ এমনকি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ওখানে পাকিস্তানি সৈন্যরা কে কী করে, তাও তারা জানে ৷
এখনও কিছু সময় বাকি আছে ৷ জুয়েল স্বভাবমতো চুটকি বলতে শুরু করে ৷ সামাদ ভাই মেটালিক সবুজ টয়োটা সেডান গাড়িটা শেষবারের মতো চেক করে নেন ৷ ৭টা ১৫ মিনিট ৷ সবাই তাদের পোশাক-আশাক পরিপাটি করে নেয় ৷ কেশবিন্যাস করে ৷ এর কারণ এলোমেলো পোশাকে গাড়িতে গেলে তাদের সন্দেহ করা হতে পারে ৷ ঢাকার গেরিলারা সব সময় ভালো শার্ট, ভালো প্যান্ট পরে ৷ ঠিক সাড়ে ৭টায় তারা গাড়িতে উঠে বসে ৷ আলমের হাতে এসএমজি, অন্যদের হাতে স্টেন, এ ছাড়া জুয়েল আর পুলুর হাতে ফসফরাস গ্রেনেড ৷ আরেকটা ইন্ডিয়ান পাইনঅ্যাপেল গ্রেনেড ৷ দেখতে আনারসের মতো বলে এই নাম ৷ ওপেনিং কম্যান্ড দেবে বদি ৷ ফেরার কম্যান্ড দেবে স্বপন ৷
গাড়ি চলতে শুরু করেছে ৷ মগবাজার থেকে ধীরে ধীরে এসে পড়ছে ময়মনসিংহ রোডে ৷ রাস্তায় পাকিস্তানি আর্মির গাড়ি চলাচল করছে ৷ শত্রুর গাড়ির কাছে আসতেই মুক্তিযোদ্ধাদের হাত আপনা-আপনিই অস্ত্রের গায়ে চলে যাচ্ছে ৷ তারা ধীরে ধীরে দারুল কাবাব পেরিয়ে ফার্মগেট মোড়ে যায় ৷ ডান দিকেই তাদের লক্ষ্যবস্তু ৷ আর্মি চেকপোস্ট ৷ দুটো তাঁবু ৷ দুজন সৈন্য নিজেদের মধ্যে গল্প করছে ৷ আরেকজন সৈন্য একটা বেবিট্যাক্সি থামিয়ে এক যাত্রীকে তল্লাশি করছে ৷ বাকি সৈন্যরা হয়তো তাঁবুতে রাতের খাবার খাচ্ছে, বা বিশ্রাম নিচ্ছে ৷ তাদের গাড়ি ডানে ঘুরে তেজগাঁও সড়কে পড়ে ৷ কিছুদূর গিয়ে সামাদ ভাই গাড়ি ঘুরিয়ে ফেলেন ৷ তারপর গাড়ির হেডলাইট নিভিয়ে স্টার্ট বন্ধ করে গাড়ির নিজস্ব গতিজড়তায় গাড়িটাকে এনে দাঁড় করান হলিক্রস কলেজের গেটের কাছে ৷ পানের দোকানে বিকিকিনি চলছে যথারীতি ৷ সামাদ ভাই বলেন, ‘আল্লাহ ভরসা ৷’ পাঁচজন নেমে পড়ে ৷ এক মিনিটের মধ্যে সবাই যার যার পজিশন নিয়ে ফেলে ৷ দুজন সৈন্য এখনও গল্প করছে ৷ তৃতীয় সৈন্যটিও তাদের কাছে এসে গল্প জুড়ে দেয় ৷ গেরিলাদের বুক কাঁপছে ৷ বদি নির্দেশ দেয় : ‘ফায়ার ৷’ আলম গুলি চালায় তিন সেন্ট্রিকে লক্ষ্য করে ৷ সেন্ট্রিরা সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে ৷ আর বাকি চারজন গেরিলা একযোগে ব্রাশফায়ার করতে থাকে দুই তাঁবু লক্ষ্য করে ৷ তিনজন প্রহরারত সৈন্যকে ধরাশায়ী করে আলমও তাক করে তাঁবু দুটো ৷ রচিত হয় গুলির মালা ৷ স্বপন নির্দেশ দেয় : ‘রিট্রিট’ ৷ জুয়েল আর পুলু বোমা চার্জ করে ৷ সবাই দৌড়ে এসে উঠে পড়ে গাড়ি ৷ সামাদ ভাই গাড়িতে টান দেন ৷ ময়মনসিংহ সড়ক ধরে গাড়ি এগিয়ে চলে ৷ তখন সবার খেয়াল হয় গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হয়নি ৷ দারুল কাবাব ঘরের অপারেশন তাই হতে পারে না ৷
জুয়েল তাদের এই অপারেশনের বিবরণ পেশ করে বিশদভাবে, রসিয়ে রসিয়ে ৷
আজাদ বলে, ‘কয়জন মিলিটারি মারা গেল, বুঝলি কেমনে!’
জুয়েল বলে, ‘১২ জন সোলজার মারা গেছে ৷ আমরা পরদিন গেলাম আশরাফুলের বাড়ি ৷ ওইখানে আমগো বন্ধু হিউবার্ট রোজারিও সব কইল ৷ অর বোন হলিক্রসের টিচার না ? উনিই সব দেখছে ৷ সারা রাত আর্মিরা লাশ লইতে আসতেও সাহস পায় নাই ৷ ভোরবেলা আসছে ৷ হিউবার্টের বোন ১২ বার বুকে কপালে ক্রস করছে ৷ মানে ১২টা লাশ লইয়া গেছে ৷ চিন্তা কর ৷ এরা নাকি দুনিয়ার সবচাইতে সাহসী সোলজার ৷ সারা রাত সৈন্যরা পইড়া থাকল, কেউ তো উন্ডেডও থাকতে পারে, আইসা দ্যাখ, হসপিটালে লইয়া যা, ঢাকা শহরের মধ্যে এই সাহসটা পাইল না ৷ আরে নিউজ শুইনা নাকি ক্যান্টনমেন্টে সব সোলজারগো পিশাব পাইছে, একলগে এতজন বাথরুমে যাইব কেমনে, সব কাপড় নষ্ট কইরা ফেলাইছে, মুতের গন্ধে ক্যান্টনমেন্ট যাওয়া যাইতেছে না…’
শুনে আজাদ উত্তেজিত-’জুয়েল, যুদ্ধ যখন শেষ হবে, তোদেরকে অনেক অ্যাওয়ার্ড দেবে রে ৷ শোন, আমিও যাব নেঙ্ট অপারেশনে ৷ আমাকে তোরা অবশ্যই নিবি ৷’
‘যেতে চাইলে যাবি ৷ কিন্তু আম্মার পারমিশন লাগবে ৷ আম্মার পারমিশন ছাড়া তরে নেওন যাইব না’-জুয়েল বলে ৷ জুয়েল আজাদের মাকে আম্মা বলে, কারণ তার চাচাতো ভাই টগর আম্মা বলে ডাকে তাঁকে ৷
‘মা ঠিক পারমিশন দিবে ৷ ঘরে অস্ত্রশস্ত্র রাখতেছি ৷ তাতে যখন আপত্তি করে নাই, তখন…’
সেই রাতেই ভাত খেতে খেতে আজাদ মাকে বলে, ‘মা, এরা এরপর যেই অপারেশনে যাবে, আমি সেটাতে যেতে চাই ৷ এত বড় জোয়ান ছেলে, ঘরে বসে থাকে, আর দেশের মানুষ মার খায়, এটা হতে পারে না ৷’
মা কথার জবাব দেন না ৷
‘এই দ্যাখ মার অ্যাপ্রুভাল আছে ৷ মা আপত্তি করল না’-আজাদ কায়দা করে ৷
মা বলেন, ‘আমি কালকে তোকে ফাইনাল কথাটা বলব ৷ আজকের রাতটা সবুর কর ৷’
‘ঠিক আছে ৷ কিন্তু দ্যাখো মা, না কোরো না ৷’
মা সারা রাত বিছানায় ছটফট করেন ৷ কী বলবেন তিনি ছেলেকে ৷ যুদ্ধে যাও! পরে যদি ছেলের কিছু হয় ৷ এই ছেলে তাঁর বহু সাধনার ধন ৷ তাঁর প্রথম সন্তানটা একটা মেয়ে ৷ কানপুরেই জন্ম হয়েছিল মেয়েটার ৷ চৌধুরী সাহেব মেয়ের নাম রেখেছিল বিন্দু ৷ সেই মেয়ে এক বছর বয়সে মারা যায় ৷ প্রথম সন্তান বিয়োগের কষ্ট যে কী কষ্ট! বহু রাত সাফিয়া বেগম কেঁদেছেন ৷ মেয়েটা তাঁর কথা শিখেছিল ৷ ‘মা মা, দাদা দাদা’ বলতে পারত ৷ সুন্দর করে হাসত ৷ চৌধুরী সাহেব বলতেন, ফেরেশতারা হাসাচ্ছে ৷ বিন্দু তাঁর সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে ছিল ৷ সেই মেয়ে বসন্ত হয়ে মারা গেল ৷ সাফিয়া বেগমের মনে হলো সমস্ত জগৎই শূন্য ৷ জীবনের কোনো মানে নাই ৷ বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়া সমান কথা ৷ বিন্দু মারা যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর পেটে সন্তান এসে গেল ৷ নতুন করে তিনি মাতৃত্বের স্বপ্ন বুনতে লাগলেন ৷ জন্ম নিল আজাদ ৷ তখন আজাদির স্বপ্নে পুরো ভারতই উত্তাল ৷ তাই ছেলের নাম, চৌধুরী রাখলেন আজাদ ৷ আজাদকে তিনি যত্ন করেছেন অনেকটা আদেখলার মতো করে ৷ সারাক্ষণ কপালে টিপ পরিয়ে রেখেছেন, যেন কারো নজর না লাগে ৷ মাজারে গিয়ে মানত করেছেন তার সুস্থতার জন্যে ৷ আজাদের কোনো অসুখ-বিসুখ হলে তিনি পাগলের মতো করতেন ৷ তাঁরা পাকিস্তানে চলে আসার পরে তাঁর শাশুড়ি এসবকে বাড়াবাড়ি বলে সমালোচনা করতেন ৷ কিন্তু তাঁর কীই-বা করার ছিল ৷ ছেলের অমঙ্গল-আশঙ্কায় সর্বদা তাঁর মন কুপিত হয়ে থাকত ৷ আজাদের পরেও তাঁর কোলে একটা বাচ্চা এসেছিল ৷ সেও তো বাঁচেনি ৷ আজাদ তাঁর সর্বস্ব ৷ তাকে বুকের মধ্যে আগলে না রেখে তিনি পারেন ?
সেই ছেলে আজ কেমন ডাগরটি হয়েছে ৷ মাশাল্লা স্বাস্থ্য-টাস্থ্য সুন্দর ৷ ছেলের জন্য তিনি মেয়ে দেখে রেখেছেন ৷ ছেলের বিয়ে দিতে পারলে তাঁর দায়িত্ব পালন সম্পূর্ণ হয় ৷ পুত্রপালনের দায়িত্ব তিনি স্বেচ্ছায় একা কাঁধে তুলে নিয়েছেন ৷ এই দায়িত্ব কঠিন ৷ আজকে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত তাঁকে নিতে হবে ৷ এই সিদ্ধান্ত তিনি কী করে একা নেবেন ? ছেলের বাবার সঙ্গে পরামর্শ করতে পারলে ভালো হতো ৷ তা তিনি জীবন থাকতেও করবেন না ৷ যে বাবা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েও স্থূল বাসনা থেকে নিজেকে নিরত রাখতে পারে না, সে আবার বাবা কিসের ? সাফিয়া বেগম আজ সত্যি অগি্নপরীক্ষার মুখোমুখি ৷
কিন্তু দেশ যখন তাঁর ছেলেকে চাইছে, তখন মা হয়ে কি তিনি ছেলেকে আটকে রাখতে পারেন ? বলতে পারেন, আমার একটামাত্র ছেলে, আর কেউ নাই ত্রিজগতে, আমার ছেলেকে ছাড় দাও ৷ এই কথা বলার জন্যে কি তিনি ইস্কাটনের বাসা ছেড়েছিলেন ? এই সুবিধা নেওয়ার জন্যে ? না ৷ ওটা ছিল তাঁর নিজস্ব সংগ্রাম ৷ আজকে দেশ অন্যায় শাসনে জর্জরিত ৷ সাফিয়া বেগম যতটুকু বোঝেন, রেডিও শুনে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনে, ছেলেদের আলোচনা শুনে, বাসায় আগত লোকদের কথাবার্তা যতটুকু তার কানে আসে তা বিচার-বিশ্লেষণ করে, আর পুলিশ সুবেদার খলিলের বয়ান শুনে, তাতে পাঞ্জাবিদের এই জুলুম মেনে নেওয়া যায় না, মেনে নেওয়া উচিত না ৷ তিনি ছেলেকে মানুষ করেছেন কি নিজে ছেলের আয়-রোজগার আরাম করে ভোগ করবেন বলে! কক্ষনো নয় ৷ এটা তিনি ছেলেকে চিঠিতেও লিখে জানিয়েছেন, ছেলেকে তিনি মানুষ করেছেন মানুষের যা কিছু কর্তব্য তাই করবে বলে ৷ দেশ আর দশের কাজে লাগবে বলে ৷
অমঙ্গল-আশঙ্কায় আবার তাঁর বুক কেঁপে ওঠে, সমস্ত অন্তরাত্মা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে যায় ৷ যদি ছেলের কিছু হয়! তিনি কল্পনা করার চেষ্টা করেন, কেউ এসে তাঁকে খবর দিচ্ছে যে তার ছেলের গায়ে গুলি লেগেছে, না, তিনি কল্পনা করতে পারেন না, অশ্রুর প্লাবন এসে তাঁর দু চোখ আর সমস্ত ভাবনা ভাসিয়ে নিয়ে যায় ৷
একজন কারো সঙ্গে পরামর্শ করতে পারলে ভালো হতো ৷ কিন্তু কার সঙ্গে! হঠাৎই মায়ের মনে পড়ে যায় জুরাইনের পীরসাহেবের কথা ৷ বড় হুজুর আর তাঁর স্ত্রী দুজনই বড় ভালো মানুষ ৷ তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করলেই তো চলে ৷
মা সকালবেলা রওনা দেন জুরাইন মাজার শরিফ অভিমুখে ৷ পীর সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন ৷ তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ছেলে যুদ্ধে যেতে চায়, তিনি কি অনুমতি দেবেন ?
পীরসাহেব বলেন, ‘ছেলেকে যেতে দাও ৷ পাকিস্তানিরা বড় অন্যায় করতেছে ৷ জুলুম করতেছে ৷ আর তা ছাড়া, ছেলে বড় হলে তাকে আটকায়া রাখার চেষ্টা করে ফল নাই ৷ তুমি না করলেও সে যুদ্ধে যাবেই ৷’
মায়ের মন থেকে সব দ্বিধা দূর হয়ে যায় ৷ ফিরে এসে তিনি আজাদকে ডাকেন ৷ বলেন, ‘ঠিক আছে, তুই যুদ্ধে যেতে পারিস ৷ আমার দোয়া থাকল ৷’
ছেলে মায়ের মুখের দিকে ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে থাকে ৷ বোঝার চেষ্টা করে, মা কি অনুমতিটা রেগে দিচ্ছেন, নাকি আসলেই দিচ্ছেন ৷
‘মা, তুমি কি অন্তর থেকে পারমিশন দিচ্ছ, নাকি রাগের মাথায় ?’
‘আরে রাগ করব ক্যান ৷ দেশ স্বাধীন করতে হবে না ?’
‘থ্যাঙ্ক ইউ মা ৷ আমি জানি তোমার মতো মা আর হয় না ৷ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে একটা গান হয় না, আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি, তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী, ওগো মা… তুমি হলে সেই মা ৷’