আজাদের মায়ের মৃত্যুর পরে আজাদের খালাতো বোন কচিরও কত কথা মনে পড়ে ৷ জন্মাবধি সে তার এই খালার কাছেই মানুষ ৷ ১৯৬৯-৭০ সালে তার বয়স কত আর হবে, ১০/১১ বছর ৷ এই সব সময়ের মধুর সব স্মৃতি তার মনে উঁকি দেয় ৷ তার মনে পড়ে, তাদের খালা সাফিয়া বেগম, যাকে তারা ডাকত আম্মা বলে, সব সময় শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতেন ৷ একবার কী উপলক্ষে কচি বলেছিল দুবলা ঘাস, আম্মা বলেছিলেন, ‘কী বললে, দুবলা নয়, বলবে দূর্বা ৷ শোনো, কলকাতার ভিখারিরাও সুন্দর করে কথা বলে ৷ এসে বলে, মা দুটো চাল দিন না মা! শুনতেও কত ভালো লাগে ৷’
আম্মা সব সময় বই পড়তেন ৷ শরৎচন্দ্র তাঁর ছিল সবচেয়ে প্রিয় লেখক ৷ রবীন্দ্রনাথের বই পড়তেন খুবই মন দিয়ে ৷ বাসায় উল্টোরথ রাখা হতো ৷ আম্মার হাতে থাকত এই পত্রিকাটা ৷ উল্টোরথ-এর গল্প-উপন্যাস তিনি মন দিয়ে পড়তেন ৷
কচিও ছিল গল্পের বইয়ের পোকা ৷ একটা নতুন বই বাসায় এলে কে আগে পড়বে, এই নিয়ে প্রতিযোগিতা হতো আম্মার সঙ্গে তার ৷ শেষে আম্মাও পড়ছেন, তিনি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে কচিও পড়ছে, এই রকম চলত ৷ তারপর আবার অবসর পেলে আম্মা পড়ার জন্যে বই হাতে নিতেন ৷ নিয়েই বলতেন, ‘কচি…’
‘জি আম্মা ৷’
‘আমার চিহ্ন কই ?’
কচি জিভে কামড় দিত ৷ আম্মা কোন পাতা পর্যন্ত পড়েছেন, একটা চিহ্ন দিয়ে রেখেছিলেন ৷ এটা সে হারিয়ে ফেলেছে ৷ আজকে যে প্রথম সে পেজ মার্কার হারাল, তা নয় ৷ প্রায়ই সে এই কর্মটি করছে ৷ আম্মার পেজ মার্কার হারিয়ে ফেলছে ৷ বা নিজে পড়তে পড়তে বিভোর হয়ে গিয়ে পেজ মার্কার ফেলে দিচ্ছে মাটিতে ৷ পরে সেটা তুলে যে পাতায় রাখছে, সেটা আর যা-ই হোক, আম্মার কাঙ্ক্ষিত পাতা নয় ৷
আজাদ দাদাও খুব বই পড়ত ৷ আজাদ দাদা শুধু যে ইংরেজি বই পড়ত, তা নয়, বাংলা বইও পড়ত খুব ৷ আর তার ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া বন্ধুদের বলত, তোদের জন্যে আমার খুব আফসোস হচ্ছে রে ৷ তোরা রবীন্দ্রনাথ পড়িস না! শরৎচন্দ্র পড়িস না! মানিক, তারাশঙ্কর পড়িস না! তোদের হবে কী ?
একবার আজাদ দাদা একটা মজার কাণ্ড করেছিল ৷ কচিরা গিয়েছিল জোনাকি সিনেমা হলে ছবি দেখতে ৷ মহুয়া, তার বর, আর সে ৷ তারা ফিরে আসার পরে আজাদ দাদার সঙ্গে দেখা ৷
‘কই গিয়েছিলি ?’ আজাদ দাদা বলে ৷
‘সিনেমা দেখতে’-কচি বাসার ভেতরে দৌড় ধরে ৷
‘এই এই, কই যাস ? এদিকে আয় ৷ শোন, হাতমুখ ধুয়ে খেয়েদেয়ে একটা রচনা লিখবি ৷ এই যে সিনেমা হলে যাওয়া থেকে শুরু করে পুরা সিনেমাটা কী দেখলি, এই অভিজ্ঞতাটা নিজের ভাষায় লিখবি ৷’
দাদার আদেশ, তারা ফেলতে পারে না ৷ কচিকে ঠিকই লিখতে বসতে হয় ৷ সিনেমা হলে রিকশায় চড়ে যাওয়া আর ফিরে আসা, মধ্যখানে বাদাম খাওয়া-এসব না হয় সে লিখল ৷ কিন্তু রাজ্জাক আর কবরীর মধ্যে যে ভাব-ভালোবাসা হলো, এই কাহিনী সে এখন কীভাবে লেখে ? রচনার ভেতরে সেসব লেখা যায় ? কচি খুবই মুশকিলে পড়ে যায় ৷
মাঝে মধ্যে আজাদ ডাকত কচিকে, ‘কচি, এদিকে আয় ৷ একটা গান শোনা তো ৷’
আজাদ দাদাকে গান শোনাতে কচির তেমন সংকোচ নাই ৷ কিন্তু পাশেই বাশার দাদা যে রয়ে গেছে ৷ বাইরের মানুষ ৷ তার সামনে কি কচির লজ্জা লাগে না!
‘কী, গা ৷’
কচি হাত কচলায় ৷
‘এখন গান না শোনালে সিনেমা দেখতে যাওয়া বন্ধ ৷ জোনাকিতে ভালো সিনেমা এসেছে ৷’
কচি বলে, ‘কোন গানটা শোনাব ?’
বাশার বলে, ‘ওইটা শোনাও ৷ আমি যে কেবল বলেই চলি, তুমি তো কিছুই বলো না ৷’
কচি আরো লজ্জা পায় ৷ এটা হলো আগন্তুক ছবিতে কবরীর গাওয়া গান ৷ এই গান এখানে গাওয়া যায় ? শেষে আজাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আর নতুন ছবি দেখতে যাওয়ার লোভে সে গলা খোলে, আমি যে কেবল বলেই চলি, তুমি তো কিছুই বলো না ৷
আর কচির মনে পড়ে, আম্মা তাদের ভাত তুলে খাওয়াতেন ৷ আম্মার প্রত্যেকটা আঙুল সে চেটে চেটে খেত ৷ তবে আম্মার সঙ্গে মাঝখানে তার আর থাকা হয়নি ৷ যুদ্ধের পরে নিজের পছন্দমতো বিয়ে করেছিল আম্মা রাগ করেছিলেন তার ওপরে ৷ কচি ওই বাসায় যায়নি বহুদিন ৷ এই তো কদিন আগে আম্মা তাঁর জীবনের শেষের দিকে এসে তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন ৷
২৬. মা
আজ ইলেকশন ৷ কিশোর জায়েদ বোঝে না, ইলেকশন কী ? তবে তার মধ্যে তীব্র কৌতূহল ৷ সে ইলেকশন দেখতে যাবে ৷ চারদিকে নৌকা মার্কার জয়জয়কার ৷ এবার নাকি নৌকার জয় হবে ৷ নৌকা ছাড়া মার্কা আছে হারিকেন ৷ এই কদিন শহরটা ইলেকশন ইলেকশন করে পাগল হয়ে গেছে ৷ মাঝে মধ্যেই মিছিল বের হয়, মার্কাটা কী ? নৌকা ৷ জাগো জাগো, বাঙালি জাগো ৷ তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা ৷ সেসব মিছিলে যাওয়ার তার খুব ইচ্ছা ছিল, একদিকে আম্মা, আরেক দিকে দাদা, এদের কঠোর শাসনে সেই খায়েশটা তার পূরণ হয়নি ৷ এদিকে টেলিভিশনেও ভালো অনুষ্ঠান কম ৷ কয়েক দিন প্রচার হলো শুধু ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের খবর ৷ কী বড় জলোচ্ছ্বাসটাই না হয়ে গেছে কদিন আগে ৷ ১০ লাখ লোক নাকি মারা গেছে ৷ যে সে কথা!
জায়েদ বাসায় কিছু না বলে বেরিয়ে যায় নির্বাচন দেখতে ৷ ডিসেম্বর মাস ৷ ১৯৭০ সাল ৷ বাইরে শীত পড়েছে ভেবে জায়েদ একটা সোয়েটার পরে ঘর থেকে বেরয় ৷ কিন্তু বাইরে এসে বোঝে সে একটা ভুল করেছে ৷ রোদ চড়চড় করছে ৷ সোয়েটারটা গায়ে রাখা যায় না ৷ সে সোয়েটার খুলে কাঁধে ঝোলায় ৷ মুশকিলটা হলো, তার শার্টের পকেটটার সেলাই খুলে গেছে ৷ পকেটটা বুকের কাছে ঝুলে আছে ৷ ওপরে সোয়েটার থাকবে ভেবে সে আর শার্টটা পাল্টায়নি ৷ কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সবাই তার ছেঁড়া পকেটটার দিকেই তাকিয়ে আছে ৷ সে গলায় পেঁচানো সোয়েটারের হাতাদুটো পকেটের ওপরে বারবার টেনে আনছে, যাতে এটা দেখা না যায় ৷ আস্তে আস্তে সে চলে আসে মগবাজারের মোড়ে ৷ ভোটটা হচ্ছে কোথায় ? সে দেখতে পায়, রিকশার গায়ে নানা সুন্দর সুন্দর পোস্টার লাগানো ৷ মনে হয় এই রিকশা ভোটের কাজ করছে ৷ সে রিকশাঅলাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ভোট হইতাছে কই ?’
‘ওই তো ইশকুলে’-রিকশাওয়ালা দেখিয়ে দেয় ৷
ওরেব্বাস ৷ স্কুলের সামনে ভিড় ৷ আর পোস্টার টাঙিয়ে এলাকাটাকে একেবারে ছেয়ে ফেলেছে দেখা যাচ্ছে ৷ গেটের কাছে লুঙ্গি, খাকি শার্ট আর খাকি জুতা পরা আনসার দেখা যাচ্ছে ৷ লুঙ্গির সঙ্গে জুতা পরায় তাদের দেখা যাচ্ছে হাস্যকর ৷ তাদের হাতে লাঠি ৷ জায়েদ এগোতে থাকে ৷ ভোটকেন্দ্রের চত্বরে দেখা যাচ্ছে সবার বুকে মার্কা-আঁকা ব্যাজ ৷ নৌকা মার্কার ব্যাজটা সুন্দর ৷ কাগজটা ঝকঝক করছে ৷ আর হ্যারিকেন মার্কার ব্যাজটা ম্যাটমেটে ৷ তার খুবই শখ হয় সে একটা নৌকা মার্কার ব্যাজ পরবে ৷ ওই যে আজাদ দাদার বন্ধু ফারুককে দেখা যাচ্ছে ৷ সে তাঁর কাছে যায় ৷ ‘ফারুক ভাই, একটা নৌকা মার্কা ব্যাজ দেন না ?’
ফারুক এদিক-ওদিক তাকায় ৷ ‘ব্যাজ তো আর নাই ৷’
এদিকে জায়েদের এক বন্ধু মিজানকে দেখা যাচ্ছে একটা নৌকা মার্কা আরেকটা হ্যারিকেন মার্কা ব্যাজ পরে আছে ৷
মিজান বলে, ‘কী রে জায়েদ, কী হইছে ?’
জায়েদ বলে, ‘ব্যাজ খুঁজতাছি ৷’
‘লাগাইবি ?’
‘হ ৷’
‘লাগা’-সে একটা হারিকেন মার্কা ব্যাজ এগিয়ে দেয় ৷
জায়েদ উৎসাহ পায় না ৷ সে নৌকা মার্কা ব্যাজ খুঁজছিল ৷
মিজান এসে তার বুকে হারিকেনের ব্যাজ পিন দিয়ে লাগাতে লাগাতে বলে, ‘কিরে, পকেট ছিঁড়ছস কেমনে ?’
জায়েদ বলে, ‘আরে ব্যাটা টাকার ভারে ছিঁইড়া গেছে ৷’
‘হ ৷ কত টাকা ৷ ল ৷ এই ব্যাজ দিয়া তোর দুই কাম হইল ৷ পকেটটাও জোড়া লাগান হইল, ফির ব্যাজও লাগান হইল ৷’
জায়েদ হারিকেন মার্কার ব্যাজ পরে খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ৷ তখন চারদিকের পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখে তার মনটা খারাপ হয়ে যায় ৷ নৌকা মার্কা জিততে যাচ্ছে ৷ হারিকেন হেরে যাবে একদম নিশ্চিত ৷ সে কেন তাহলে নৌকা মার্কার ব্যাজ পেল না ৷ সে হ্যারিকেনের ব্যাজটা খুলে ফেলে ৷ তারপর আস্তে করে ফেলে দেয় ৷
‘এই জায়েদ, তুই এখানে কী করিস ?’ আজাদ দাদার গলা ৷ সর্বনাশ ৷ সে সভয়ে তাকায় ৷ আজাদ দাদা তাঁর বন্ধুবান্ধব নিয়ে এদিকটাতেই আসছে ৷ বন্ধুরা গল্পে মশগুল ৷
‘এদিকে আয়’-আজাদ ডাকে ৷
জায়েদ এগিয়ে যায় ৷
‘কখন এসেছিস ?’
‘এই তো, পাঁচ মিনিট হইব ৷’
‘যা, বাড়ি যা ৷’
‘আচ্ছা ৷’
‘এই শোন, শার্ট ছিঁড়েছিস কেমন করে ?’
‘সেলাই খুইলা গেছে ৷’
‘যা, এমনি আসা নিষেধ, তার ওপর আবার ছেঁড়া শার্ট ৷ ভাগ ৷’
জায়েদ তাড়াতাড়ি স্কুল-চত্বর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে ৷
রাতের বেলা টেলিভিশনের অনুষ্ঠান মাঝে মধ্যেই বন্ধ করে দেখানো হচ্ছিল ভোটের ফল ৷ আজাদ আর বাশার বসে বসে টিভি দেখছে ৷ মোড়া নিয়ে এক কোণে বসে জায়েদও টিভি দেখে ৷ জায়েদ বুঝতে পারে, তার ধারণাই ঠিক ৷ সব নৌকা মার্কাই জিতে নিচ্ছে ৷ ভাগ্যিস সে তার হারিকেন মার্কার ব্যাজটা ফেলে দিয়েছিল ৷ এর মধ্যে সাফিয়া বেগম আসেন, কিরে, ইলেশকশনের কী খবর ?
আজাদ বলে, ‘ঠিক আছে ৷ একচেটিয়া নৌকা ৷ মা, দুই কাপ চা পাঠাবা ?’
মা হেসে সম্মতি জানান ৷
টিভি কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায় ৷ রেডিও খোলা থাকে ৷ কিন্তু রেডিওটা আছে আজাদ দাদার কাছে ৷ বাশার ভাইজান আর আজাদ দাদা গল্প করছে আর রেডিও শুনছে ৷ সেখানে গিয়ে রেডিও শোনার আশা বৃথা ৷
জায়েদ এর চেয়ে ঘুমিয়ে পড়াটাকেই শ্রেয় বলে মনে করে ৷
বিছানায় শুয়ে সে শুনতে পায়-বাইরে লোকেরা স্লোগান দিচ্ছে নৌকা নৌকা বলে ৷ মনে হচ্ছে বিজয়-মিছিল ৷ সেই মিছিলের শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে দূর রাত্রির গায়ে ৷ আর আস্তে আস্তে ঘুমের অতলে পৌঁছে যায় জায়েদ ৷
২৭. মা
১৯৭১ সাল ৷ ফেব্রুয়ারি মাস ৷ আজাদ বাসায় বসে পত্রিকা পড়ছিল ৷ একটা সুবিধা হয়েছে ইদানীং ৷ আবুল বাশার সাংবাদিক হওয়ায় দুটো পত্রিকা ফ্রি পাওয়া যায় ৷ আর একটা আজাদ পয়সা দিয়ে রাখে ৷ সকালবেলা তিনটা পত্রিকা পড়তে পড়তে অনেকটা সময় চলে যায় ৷ আজকে আজাদের বাইরে তেমন কোনো কাজও ছিল না ৷ বেলা ১১টা পর্যন্ত সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তিনটা পত্রিকাই পড়ে ৷ দেশের পরিস্থিতিও এমন যে, খবরের কাগজ না পড়লে আর ভালো লাগে না ৷
আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করেছে ৷ উভয় পাকিস্তান মিলে এটাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ৷ বাংলায় তো সংখ্যাগরিষ্ঠ বটেই ৷ আগামী ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে কী হয়, এটাই এখন দেখার বিষয় ৷ পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা ভুট্টো অবশ্য ইতিমধ্যেই ঢাকার অধিবেশনকে কসাইখানা বলে চিহ্নিত করেছেন ৷ আর বলে দিয়েছেন, আওয়ামী লীগ যদি ৬ দফা পুর্নবিন্যাসের আশ্বাস না দেয়, তাহলে তার দল জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যাবে না ৷
এইসব নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে ৷
পত্রিকা পড়া শেষ করে আজাদ বাথরুমে যায় গোসল করতে ৷
এই সময় সৈয়দ আশরাফুল হক আজাদদের বাসার সামনে আসে তার ভঙ্ ওয়াগনটা নিয়ে ৷ দু বার হর্ন বাজায় ৷ তারপর গাড়ি থেকে নেমে এসে ঢোকে বাসার ভেতরে ৷
সৈয়দ আশরাফুল হকের কোনো ঘটনাই নয় ৷ প্রায়ই আসে সে ৷ কিন্তু আজকে তার আগমনের মধ্যে একটা বিশেষ ব্যাপার আছে ৷ সে হাঁক পাড়ে, ‘মা, মা, আজাদ ভাই কই ?’
আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে সাফিয়া বেগম এগিয়ে আসেন-’আজাদ তো এ ঘরেই ছিল ৷ কই যে গেল ৷’
আশরাফুল সাফিয়া বেগমের পায়ের কাছে বসে পড়ে তাঁকে কদমবুসি করে ৷
সাফিয়া বেগম বলেন, ‘হঠাৎ সালাম যে ৷ কী ব্যাপার, বাবু ?’
আশরাফুল বলে, ‘আছে ব্যাপার ৷ আগে তোমাকে কওন যাইব না মা ৷ তুমি আবার আমার বাসায় কইয়া দিবা ৷ ইট্স আ সিক্রেট ৷’
আজাদ আসে ৷ তার হাতে তোয়ালে ৷ সে মাথা মুছছে ৷
সাফিয়া বেগম বলেন, ‘কী ব্যাপার আজাদ ৷ বাবু আমার পায়ে সালাম করল কেন রে ?’
আজাদ কিছু বুঝে উঠতে পারে না ৷ সে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, ‘ঘটনা কী ?’
আশরাফুল বলে, ‘আছে ঘটনা আজাদ ভাই, চলো ৷’
‘কই ?’
‘আরে গেলেই তো বুঝবা ৷ আগেই সব কথা কওন লাগব নাকি ? হারি আপ, লেটস গো ৷ মুভ ৷ মা, আমারে দোয়া কইরো ৷ প্রে ফর মি ৷ ইউ আর আ পিয়োর লেডি ৷ আল্লাহ উইল হিয়ার ইয়োর প্রেয়ার ৷’
আজাদ কাপড়-চোপড় গায়ে চাপায় ৷ জুতো পরে ৷ গায়ে সুগন্ধি স্প্রে করে ৷ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে নেয় নিজেকে ৷
সৈয়দ আশরাফুল বলে, ‘আরে, তোমারে এলভিস প্রিসলির মতনই দেখা যাইতেছে ৷ আর সাজতে হইব না ৷ টুডে ইজ নট ইয়োর ডে ৷ দিস ইজ মাই ডে ৷’
‘হোয়াটস দ্য ম্যাটার বাবু ?’ আজাদ চোখ সরু করে তাকায় আশরাফুলের দিকে-‘সাবেরা কই ?’
‘চলো তো তাড়াতাড়ি ৷’
তারা গেটের বাইরে আসে ৷ আজাদ দেখে, আশরাফুলের ভঙ্ ওয়াগন গাড়িটা দাঁড়িয়ে ৷ সে সামনের সিটে আশরাফুলের পাশে বসে ৷
‘কী ব্যাপার বলো তো ?’ আজাদ রিয়ার ভিউ মিররের দিকে হেলে পড়ে নিজের চেহারাটা দেখে নিয়ে বলে ৷
‘আছে ব্যাপার ৷ বিয়া করনের লাইগা যাইতাছি ৷’
‘বলো কি ?’
‘হ ৷ দেশের যে পরিস্থিতি, সাবেরা কই থাকব, আমি কই থাকুম, উই শুড নট টেক এনি রিস্ক, ইটস বেটার টু গেট ম্যারিড নাউ ৷ তার উপরে আবার নিউজিল্যান্ড টিম আসতেছে ৷ খেলা দেখতে হইব না ?’
‘ওকে ৷ শুভস্য শীঘ্রম ৷ দ্যাটস আ গুড নিউজ ৷ এখন আমরা কোনদিকে যাচ্ছি ?’
‘নিউমার্কেটের মোড় থাইকা সাবেরাকে তুলতে হইব ৷ হ্যারিস, জুয়েল, ফারুক-অরা সব মগবাজার কাজি অফিসে গেছে ৷ সবকিছু রেডি কইরা রাখব ৷ আমরা খালি যামু আর বিয়া পড়ুম ৷’
আজাদ চুপ করে থাকে ৷
‘ডোন্ট ইউ লাইক দিস আইডিয়া ?’
‘অফ কোর্স ৷ হোয়াই নট ৷ সাবেরা থাকবে তো ?’
‘শিয়োর ৷ ওরে ঘরের থন বাইর কইরা না আমি তোমারে নিতে আইলাম ৷’
‘আর যদি না আসে ?’
‘এ কথা ক্যান কইলা আজাদ ভাই ৷ তুমি তো সাবেরারে খুব ভালো কইরাই জানো ৷ সে কি যেমন-তেমন মেয়ে ? শি ইজ সিরিয়াস ৷’
‘আরে না ৷ বিয়ে সম্পর্কে মেয়েদের কতগুলো স্বপ্ন থাকে ৷ তারা বেশ ঘটা করে বউ-টউ সেজে গায়ে হলুদ করে বিয়ে করতে চায় ৷ সেই জন্যে বললাম আর কি ?’
‘সেটাও করন যাইব ৷ দ্যাট উই উইল শিয়োরলি ডু ৷ আগে রেজিস্ট্রি কইরা ফালাই তো ৷’
ভঙ্ ওয়াগন নিউমার্কেটের দিকে যাচ্ছে ৷ বসন্তকাল এসে গেছে ৷ রমনার সামনের রাস্তার গাছে গাছে বেগুনি রঙের ফুল, মনে হচ্ছে আশরাফুল আর সাবেরার বিয়ে উপলক্ষে এই বিশেষ আয়োজন ৷ গাড়ির জানালা দিয়ে আসা বাতাসটাও দারুণ আরামদায়ক ৷ আমগাছের পাশ দিয়ে গেলে মুকুলের গন্ধ এসে নাকে লাগে ৷ রাস্তায় একটা মিছিলও চোখে পড়ে ৷ কোনো একটা পেশাজীবী সংগঠনের মিছিল ৷ দু লাইনে সার বেঁধে খুবই ভদ্রতা বজায় রেখে যাচ্ছে ৷ সামনের ব্যানারে লেখা: ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা ৷’ আজাদও এই স্লোগানটা অনেকবার মিছিলে দিয়েছে বটে, কিন্তু মানেটা ঠিক বুঝতে পারেনি ৷ তবে ‘পিন্ডি না ঢাকা ? ঢাকা ঢাকা’-এই স্লোগানটার মানে তার কাছে স্পষ্ট ৷
নিউমার্কেটের আজিমপুরের দিকের গেটের সামনে এসে গাড়ি দাঁড়ায় ৷ এখানেই সাবেরার থাকার কথা ৷ কই কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না ? আশরাফুলের বুকটা কেঁপে ওঠে ৷
সে হর্ন দেয় ৷
তখনই নিউমার্কেটের ভেতর থেকে সাবেরা উদিত হয় ৷ শাড়ি পরা সাবেরাকে দেখতে সত্যি সুন্দর লাগছে ৷ বিয়ের আগে মেয়েরা কি বেশি সুন্দর হয়ে ওঠে ? আজাদ ভাবে ৷
আজাদ গাড়ি থেকে নামে ৷ বলে, ‘সাবেরা, ইউ বেটার সিট ইন দ্য ফ্রন্ট সিট ৷’
আশরাফুল ড্রাইভিং সিটে বসা, সে জানালা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে বলে, ‘না, না ৷ কেউ দেখে ফেলতে পারে ৷ সাবধানের মার নাই ৷ সাবেরা, তুমি পেছনে ওঠো ৷’
সাবেরা গাড়িতে উঠে বলে, ‘দ্যাখেন তো আজাদ ভাই, আশরাফুলের কাণ্ড…’
আজাদ বলে, ‘রাইট মোমেন্টে এটা হলো রাইট ডিসিশন ৷ ইউ আর ডুয়িং দ্য রাইট থিং ৷’
গাড়ি একটানে চলে আসে মগবাজার কাজি অফিসের সামনে ৷ জুয়েল এগিয়ে আসে, ‘হেই এত দেরি ক্যান ? আমি তো ভাবলাম, আমগো বসায়া রাইখা তোমরা গাছের মগডালে উইঠা পড়ছ, টোনাটুনি ডাকিয়া উঠিল, টুন-টুন-টুন ৷’
তারা কাজি অফিসের ভেতরে ঢোকে ৷ হ্যারিস, ফারুককেও দেখা যায় ভেতরে ৷
একটা অফিসঘরের মতো ঘর ৷ দেয়ালে মক্কা ও মদিনা শরিফের ছবি ৷ এক কোণে কাজি সাহেবের চেয়ার-টেবিল ৷ একটা দেয়ালের পাশে লম্বা সোফা ৷ কাজি সাহেব মধ্যবয়স্ক, শ্মশ্রুমণ্ডিত ৷ সম্ভবত দাড়িতে মেহেদি মাখা ৷ তার মুখটা হাসি হাসি ৷ মাথায় জিন্নাহ টুপি ৷ তাঁর চেহারার মধ্যে এমন কিছু আছে, দেখলে মনে হয় পান খেয়ে দাঁত লাল করে রেখেছেন ৷ কিন্তু আশ্চর্য যে তাঁর দাঁত খুবই পরিষ্কার ৷ মনে হয় তিনি পাঁচ ওয়াক্ত মেসওয়াক করেন ৷
জুয়েল বলে, ‘কাজি সাহেব, এই যে বর আর কন্যা আইসা পড়ছে ৷ নেন ৷ আল্লাহর নামে শুরু করেন ৷’
কাজি সাহেব তার মোটা রেজিস্ট্রি খাতা বের করেন ৷ আশরাফুল আর সাবেরার সামনে ফরম মেলে ধরেন ৷ তারা পূরণ করতে লেগে যায় ৷ হ্যারিস যায় মিষ্টি কিনে আনতে ৷
কাজি সাহেব বলেন, ‘মেয়ের ম্যাট্রিকের সার্টিফিকেট আনছেন ?’
‘না ৷ তা তো আনা হয় নাই’-আশরাফুল বলে ৷ তার বুক কেঁপে ওঠে ৷ তীরে এসে না তরী ডুবে যায় ৷
জুয়েল বলে, ‘ম্যাট্রিক পাস ছাড়া মেয়ে বিয়া দেওন যায় না, নাকি ? নতুন নিয়ম ? ইয়াহিয়া খানের ?’
কাজি সাহেব হেসে বলেন, ‘না, কনের বয়সের প্রমাণ ৷’
জুয়েল বলে, ‘ও তো আমগো চাইতে বড় ৷ আমরা সবাই বিএ পাস ৷ মেয়েও এমএ পাস ৷’
আজাদ বলে, ‘এই জুয়েল, ইয়ারকি কোরো না ৷ হুজুর পাজ্লড হয়ে যাবেন ৷’
ফরম পূরণ করা হয়ে গেলে সাক্ষীর ঘরে জুয়েল, আজাদ আর ফারুক স্বাক্ষর করে ৷
কাজি সাহেব দোয়া-দরুদ পড়তে শুরু করেন ৷ সাবেরা তার ঘোমটাটা বাড়িয়ে দেয় ৷ আশরাফুল একটা টুপি মাথায় চাপায় ৷
কাজি সাহেব মোনাজাতের সময় চমৎকার চমৎকার কথা বলেন ৷ হজরত আদমের সঙ্গে বিবি হাওয়ার যে সম্পর্ক ছিল, হজরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর সঙ্গে হজরত আয়েশা(রা)-র যে এশ্ক ছিল, সে রকম মহব্বত যেন এই মিয়া-বিবির মধ্যে পয়দা হয়, এবং রোজ কিয়ামত পর্যন্ত যেন তাদের এশ্ক অটুট থাকে, তিনি দোয়া করতে থাকেন ৷
দোয়া শেষ হলে ফারুক কাজি সাহেবের পাওনা বুঝিয়ে দেয় ৷
ব্যস ৷ বিয়ে হয়ে গেল ৷ আজাদ বিস্মিত ৷ বিয়ে করা এত সোজা ? এই জন্যে তো লোকে বলে, মিয়া-বিবি রাজি তো কিয়া করেগা কাজি ৷
জুয়েল বলে, ‘লেটস গো টু দি হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল ৷ উই উইল হ্যাভ আওয়ার লাঞ্চ দেয়ার ৷’
আশরাফুল বলে, ‘অত টাকা তো নাই ৷ কাজি সাহেবের ফি দিতেই তো ফতুর ৷ ক্যাফে ডি তাজে চলো, বিরিয়ানি খাওয়ায়া দেই ৷’
আজাদ বলে, ‘দরকার কী ? আমার বাসায় চলো সবাই ৷ মাকে বললেই তো মা নাচতে নাচতে রাঁধতে বসে যাবে ৷ চলো ৷’
‘সেই ভালো ৷ ইলিশ-পোলাও হইব ৷ আম্মার হাতের ইলিশ-পোলাও ? উফ্ ৷ মাই মাউথ ইজ অলরেডি ওয়াটার্ড’-জুয়েল বলে ৷
তারা আজাদদের বাসায় যায় ৷ আজাদ জায়েদকে কাওরানবাজারে পাঠায় ইলিশ মাছ কিনতে ৷
সৈয়দ আশরাফুল হক আর সাবেরা গিয়ে সালাম করে আজাদের মাকে ৷
মা হাসেন, ‘কী ব্যাপার ?’
আশরাফুল হেসে বলে, ‘আছে ব্যাপার ৷ ইলিশ-পোলাওটা আজকা স্পেশাল কইরা রাইন্ধো তো মা ৷’
মা আশরাফুল আর সাবেরার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ৷
২৮. মা
ক্রিকেট খেলা চলছে ঢাকা স্টেডিয়ামে ৷ পাকিস্তান বনাম নিউজিল্যান্ড ৷ ২৬শে ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ থেকে শুরু হয়েছে এই টেস্ট ৷ আজ ফোর্থ ডে ৷ পাকিস্তান দলে বাঙালি আছে প্রথম একাদশে রকিবুল হাসান ৷ টুয়েলভ্থ ম্যান হিসাবে সুযোগ পেয়েছে তান্না ৷ নিউজিল্যান্ডের টার্নার সেঞ্চুরি করেছে ৷ পাকিস্তান দলের পশ্চিম পাকিস্তানি খেলোয়াড়রা যে ব্যাট নিয়ে নেমেছে, তার পেছনে রঙিন হাতলটা চিকন হয়ে ব্যাটের ঘাড় থেকে পিঠের দিকে নেমে গেছে ৷ দেখতে তলোয়ারের মতো লাগে ৷ তলোয়ার ছিল ভুট্টোর পিপিপির নির্বাচনী প্রতীক ৷ স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে তাই নিয়ে গুঞ্জন ৷ দেখছস, মাউড়াগুলান তলোয়ার মার্কা ব্যাট নিয়া নামছে ৷ এবার দেখা যাক রকিবুল হাসান কী ব্যাট নিয়ে নামে ৷ সবার মধ্যে এই ঔৎসুক্য ছিল ৷ রকিবুল হাসান নেমেছিল জয় বাংলা লেখা ব্যাট নিয়ে ৷ গ্যালারি তালি দিয়ে উঠেছিল সোল্লাসে ৷ তবে এই তালি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি ৷ জিরো আর ১ রান করে দু ইনিংসে আউট হয়ে গিয়েছিল রকিবুল ৷
গ্যালারিতে বসে আছে আজাদ, কাজী কামাল আর হিউবার্ট রোজারিও ৷ তারা বাদাম চিবাচ্ছে ৷ একটা চানাচুরঅলা ঢুকে পড়েছে গ্যালারিতে ৷ তার পরনে লাল রঙের পোশাক, মাথায় কোণাকার টুপি, পায়ে ঘুঙুর ৷ তার হাতে চোঙ ৷ চোঙে মুখ লাগিয়ে সে হাঁক ছাড়ছে : চানাচুর গরম, জয় বাংলা চানাচুর ৷
কাজী কামাল সেদিকে দেখিয়ে হাসে-‘বেটা ব্যবসা ভালো বুঝেছে ৷’ একটা সিগারেটঅলা সিগারেট নিয়ে গ্যালারির আসনগুলোর ফাঁকে ফাঁকে দ্রুত পায়ে চলে যাচ্ছে ৷ আজাদ বলে, ‘কিরে, তোর সব সিগারেট কি জয় বাংলা নাকি!’
সিগারেটঅলা বুঝতে পারে না ৷ বোকার মতো হাসে ৷ আজাদ বলে, ‘বিদেশী সিগারেট আছে ?’
‘নাই স্যার’-সিগারেটঅলা লোকটা দ্রুত পায়ে চলে যায় ৷
কাজী কামাল বলে, ‘বাংলা সিগারেট আর বাংলা মদ, এসবের বেলায় জয় বাংলা না হইলেই ভালো ৷’
আজাদ বলে, ‘এসবের বেলায় পাকিস্তান জিন্দাবাদ কিন্তু আরো খারাপ ৷’
কামাল বলে, ‘ক্যান দোস্তো ৷ তুমি না করাচি থাইকা পইড়া আইলা ৷’
আজাদ বলে, ‘আরে দেখে এসেছি না ৷ দেখেশুনেই তো বলছি ৷ ওদের সাথে থাকা যাবে না ৷’
রুমী আর জামীকে দেখা যায় ৷ তারা চানাচুরঅলাটাকে ধরে নিয়ে এসেছে ৷
রুমী বলে, ‘আজাদ, খাবে নাকি! জয় বাংলা চানাচুর ৷’
আজাদ বলে, ‘নাও না দেখি ৷ কেমন লাগে!’
ছক্কা ৷ স্টেডিয়ামে হৈ ওঠে ৷ কে মারল ? লোকজন সব রেডিওতে কান পাতে ৷ অনেকেই সঙ্গে করে রেডিও নিয়ে এসেছে ৷ রেডিওঅলারা ভলুম বাড়াতে নব ঘোরায় ৷
জুয়েল আসে গ্যালারিতে ৷ জুয়েল পূর্ব পাকিস্তানের সেরা ব্যাটসম্যান ৷ আজাদ বয়েজে খেলেছে ৷ এখন খেলে মোহামেডানে ৷ তার খেলায় একটা মারকুটে ভাব আছে ৷ ৪৫ ওভারের সীমিত ম্যাচে সে ঝড়ের মতো পেটায় ৷ বল জিনিসটা যে পেটানোর জন্যে, এটা তার ব্যাটিং দেখলে বোঝা যায় ৷ উইকেটকিপিংও করে ৷ সে এসে বসে কাজী কামালের পাশে ৷ কাজী কামাল প্রদেশের সেরা বাস্কেটবল খেলোয়াড় ৷
জুয়েল বলে, ‘কামাল, তোরে নাকি পাকিস্তান ন্যাশনাল টিমে ডাকছে!’
‘হ ৷’
‘গেলি না ?’
‘কিয়ের ন্যাশনাল টিম ৷ ওয়েস্ট পাকিস্তানে যাব না ৷ জয় বাংলা টিম হইলে যাব ৷’
রুমী বলে, ‘এ্যাসেম্বলিতে যে কী হবে! ভুট্টো তো বলে দিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কেউ এলে কসাইখানা বানানো হবে ৷’
জুয়েল বলে, ‘জনা তিরিশেক নাকি আইসা গেছে অলরেডি পাকিস্তান থাইকা ৷’
আজাদ বলে, ‘ঢাকাকে রাজধানী বানাতে হবে ৷ সব হেডকোয়ার্টার ঢাকায় আনতে হবে ৷ আর্মিতে বেশি বেশি বাঙালি রিক্রুট করতে হবে ৷ পাটের টাকা সব বাংলায় আনতে হবে ৷ এত দিন ওরা আমাদেরকে কলোনি বানিয়ে রেখেছে, এবার আমরা ওদেরকে কলোনি বানাব ৷ তাইলে না শোধ হয় ৷’
রুমী বলে, ‘ওসব হবে না ৷ তার চেয়ে স্বাধীনতা ডিক্লেয়ার করে দেওয়া ভালো ৷ লেফ্টরা যে ফরমুলা দিয়েছে, ওটাই ভালো ৷ মাও সে তুং তো বলেই দিয়েছেন, বন্দুকের নল সব ক্ষমতার উৎস ৷’
আবার বাউন্ডারি ৷ দর্শকদের হৈ-হল্লা ৷
খেলায় এখন বিরতি ৷ লাঞ্চ পিরিয়ড চলছে ৷ রেডিওতে বারবার বলা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেবেন ৷ সবাই অধীর আগ্রহে রেডিও ধরে বসে আছে ৷ বেলা ১টার দিকে রেডিওতে ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা প্রচারিত হতে থাকে ৷ ইয়াহিয়ার নিজের মুখে নয় ৷ অন্য একজন পড়ে শোনায় ৷ পরশুদিন ৩ মার্চ ১৯৭১ থেকে জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন ঢাকায় বসার কথা ছিল, তা অনির্দিষ্ট কালের জন্যে স্থগিত করা হয়েছে ৷ ঘোষণা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো গ্যালারি একযোগে স্লোগান দিয়ে ওঠে, ‘ইয়াহিয়ার ঘোষণা, মানি না মানব না’ ৷ ‘ভুট্টোর পেটে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ ৷ ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ ৷ ‘জয় বাংলা’ ৷ তাকিয়ে দ্যাখো পূর্ব গ্যালারির দিকে ৷ সমস্ত গ্যালারি আগুনে জ্বলে উঠেছে যেন ৷ যার কাছে যা আছে, তাতেই আগুন লাগিয়ে দিয়েছে দর্শকরা ৷
আজাদ, জুয়েল, রুমী, জামী, কামাল, হিউবার্ট রোজারিও-সবাই সেই মিছিলের অংশ হয়ে যায় আপনা-আপনিই ৷ খেলা বন্ধ ৷ সবাই বেরিয়ে আসছে স্টেডিয়াম থেকে ৷ বিশাল মিছিল শুরু হয়ে যায় স্টেডিয়াম এলাকায় ৷
ঢাকার অন্য এলাকা থেকেও মিছিল আসতে থাকে ৷ পুরো ঢাকাই যেন একটা বিক্ষুব্ধ জনসমুদ্র ৷ ফুঁসছে, গর্জে উঠছে ৷
রুমী বলে, ‘জামী, চল তোকে আব্বার অফিসে রেখে আসি ৷ নাহলে আবার আব্বা চিন্তা করবে ৷’
রুমী আর জামী মিছিল থেকে বেরিয়ে যেতে চায় ৷ কিন্তু মিছিল থেকে বেরুনো কি সোজা কথা ? চারদিকেই তো মিছিল ৷ চারদিক থেকেই তো আসছে মানুষের স্রোত ৷ সহস্র কন্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে গগনবিদারী স্লোগান ৷ সবার হাতে লাঠি, রড ৷ মুখে স্লোগান, ‘বাঁশের লাঠি তৈরি করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ ৷
পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির মিটিং চলছে ৷ শেখ সাহেব ওখানে আছেন ৷ জনতা পূর্বাণী হোটেলের দিকে চলেছে ৷
আজাদ বলে, ‘এইখানে থেকে লাভ নাই ৷ চল, ইউনিভার্সিটি যাই ৷ ওখানে কী হয় দেখে আসি ৷’ জুয়েল, কাজী কামাল রাজি হয় ৷ তারা হাঁটতে হাঁটতে ইউনিভার্সিটির দিকে রওনা দেয় ৷ ওখানেও একই অবস্থা ৷ পুরোটা ক্যাম্পাস একটা বিশাল মিছিলে পরিণত হয়েছে ৷ ‘এক দাবি, এক দফা, বাংলার স্বাধীনতা’ ৷ ‘ভুট্টোর পেটে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ ৷
বাসায় ফিরতে ফিরতে মেলা রাত ৷ মা জায়নামাজে ৷ আজাদ এসেছে টের পেয়ে তিনি উঠে আসেন ৷ বলেন, ‘সারা দিন কই ছিলি না ছিলি কোনো খবর নাই ৷ চোখমুখের অবস্থা কী করেছিস! যা, হাতমুখ ধুয়ে আয়!’
আজাদ হাতমুখ ধুয়ে আসে ৷ মা টেবিলে খাবার বেড়ে দেন ৷ আজাদ টিভিটা ছেড়ে খানিক দেখে টেবিলে চলে আসে ৷ ছেলের প্লেটে তরকারি তুলে দিতে দিতে মা বলেন, ‘আজকেও মিছিলে গিয়েছিলি ?’
আজাদ হাসে ৷ ‘আজকে মা কাউকে মিছিলে যেতে হয় নাই ৷ যে যেইখানে ছিল, সেই জায়গাটাই মিছিল হয়ে গেছে ৷ আমি ছিলাম স্টেডিয়ামে গ্যালারিতে ৷ গ্যালারিটাই মিছিল হয়ে গেল ৷ তুমি তো স্টেডিয়াম থেকে বের হবে, মানুষের স্রোত ধরে বের হতে হবে, সবাই তো স্লোগান ধরেছে, তারপর রাস্তা, পুরা রাস্তাই মানুষে সয়লাব ৷’
মা বলেন, ‘জায়েদও গিয়েছিল মিছিলে ৷ বাবা রে, মিছিল করা কি তোদের কাজ ? তোরা কি পলিটিঙ্ করে মিনিস্টার হবি! মজিবর মন্ত্রী হলে আমাদের কী, আর ভুট্টো হলেই আমাদের কী!’
‘কী বলো ৷ ভুট্টো কেমনে মন্ত্রী হয়! শেখ মুজিব মেজরিটি পেয়েছে না! আর এইবারের সংগ্রাম তো কে মিনিস্টরা হবে তার জন্যে না, এইবার পাকিস্তানের সাথে বাঙালির ফাইট ৷ এটাতে মা আমাদের অনেক কিছু যায়-আসে ৷’
‘দ্যাখ বাবা ৷ তুই লেখাপড়া শিখেছিস ৷ এখন তো তুই আমার চেয়ে বেশিই বুঝবি ৷ কিন্তু তুই কোনো বিপদ-আপদের মাঝে যাবি না ৷ আহা রে, কত মায়ের ছেলে মারা গেছে জয় বাংলা জয় বাংলা করে ৷ খারাপ লাগে না! আমি তো আমাকে দিয়ে বুঝি ৷ তোর কিছু হলে, আল্লাহ না করুক, আমি সইতে পারব না ৷ শোন, দেশের যা পরিস্থিতি ৷ কখন কী হয়ে যায় ৷ আমি তোকে এমএ পাস করিয়েছি ৷ এখন আমি আমার শেষ কাজটা করে যেতে চাই ৷’
‘কী কাজ ?’ মুখে ভাত থাকতেই গেলাস তুলে পানি মুখে দিয়ে তারপর আজাদ বলে ৷
‘তোর জন্যে আমি পাত্রী দেখছি ৷ আশরাফুলও তো বিয়ে করে ফেলল ৷’
‘তুমি তো মা পাগল আছ ৷ আগে আমার ব্যবসাটা আরেকটু সেটল করুক ৷ হরতাল হরতাল করে তো ব্যবসার দিকে নজরই দিতে পারলাম না ৷’
‘ব্যবসা হবে ৷ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়াসাল্লাম বলে গেছেন, বিয়ে করলে ভাগ্য খোলে’-মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন ৷ হয়তো তাঁর নিজের জীবনের কথা মনে পড়ে যায় ৷ সবাই বলে, ইউনুস চৌধুরীর সৌভাগ্যের পেছনে ছিল সাফিয়া বেগমের অবদান ৷
‘জুরাইনের বড় হুজুরও বলে দিয়েছেন তোকে বিয়ে দিতে ৷’ মা আরেক চামচ তরকারি আজাদের পাতে তুলে দিতে দিতে বলেন ৷
‘হুজুররে কও আরেকটা বিয়া করতে ৷ তার কপাল খুলুক ৷’
‘তওবা তওবা, এটা তুই কী বললি ?’
‘না, আমি ঠিক তোমাকে হার্ট করার জন্যে বলি নাই ৷ কথার পিঠে বললাম আর -কি এই যে তওবা পড়লাম, তওবা, তওবা…’
২৯. মা
রুমী সকালবেলা উঠে এক কাপ ব্লাক কফি খায় ৷ হাতে থাকে টাটকা দৈনিক পত্রিকা ৷ ইত্তেফাকই তার বেশি প্রিয় ৷ তবে সঙ্গে দৈনিক পাকিস্তানটাও সে পড়ে থাকে ৷ আজকে পত্রিকা পড়তে গিয়ে সে উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করতে থাকে ৷ ‘আম্মা, আম্মা…’
জাহানারা ইমাম এগিয়ে আসেন ৷ ‘কী হলো রুমী!’
‘দ্যাখো সিকান্দার আবু জাফরের কী কবিতা বের হয়েছে পেপারে ৷’ রুমী গলা চড়িয়ে আবৃত্তি করতে শুরু করেছে:
অনেক মাপের অনেক জুতোর দামে
তোমার হাতে দিয়েছি ফুল হৃদয় সুরভিত
যে-ফুল খুঁজে পায়নি তোমার চিত্তরসের ছোঁয়া
পেয়েছে শুধু কঠিন জুতোর তলা ৷
আজকে যখন তাদের স্মৃতি অসম্মানের বিষে
তিক্ত প্রাণে শ্বাপদ নখের জ্বালা,
কাজ কি চোখের প্রসন্নতায়
লুকিয়ে রেখে প্রেতের অট্টহাসি!
আমার কাঁধেই দিলাম তুলে
আমার যত বোঝা :
তুমি আমার বাতাস থেকে
মোছো তোমার ধুলো
তুমি বাংলা ছাড়ো ৷
জাহানারা ইমাম ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন ৷ রুমী আবৃত্তিটা ভালোই করে ৷ করবেই ৷ সে তো ডিবেটে চ্যাম্পিয়ন ৷ কলেজের কালচারাল উইকে অনেকগুলো পুরস্কার পেয়েছে ৷ আবৃত্তি শুনতে শুনতে, বিশেষ করে যখন রুমী বলে উঠছে তুমি বাংলা ছাড়ো, জাহানারা ইমামের সমস্তটা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে ৷
আবৃত্তি শেষ হলে তিনি বলেন, ‘রুমী, আজকে তাড়াতাড়ি নাশতা করে নে ৷ তোরা তো রেসকোর্সের জনসভায় যাবি ৷ সুবহানও যাবে জেদ ধরেছে ৷ এর আগের দিন ‘না’ করেছি ৷ আজকে তো বাবা আর ‘না’ করা যায় না ৷ আজকে শেখ সাহেব নিশ্চয় ইম্পর্ট্যান্ট কিছু বলবেন ৷’
রুমী বলে, ‘ওকে ওকে ৷ আই অ্যাম গোয়িং টু হ্যাভ মাই ব্রেকফাস্ট ৷ বাট, আজকের পেপারটা পড়ে একটু বোঝা দরকার, শেখ মুজিব আজকে কী বলবেন, কিছু আঁচ অনুমান করা যায় কি না ৷’
টগর পড়ে জগন্নাথ কলেজে ৷ সে আজাদের আরেক খালাতো ভাই ৷ জায়েদেরও খালাতো ভাই সে ৷ আজাদদের মগবাজারের বাসায় থেকে সে জগন্নাথ কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে পড়ছে ৷ তার বাবার ব্যবসা পটুয়াখালীতে ৷ সেখানে সে পড়েছে স্কুলে ৷ সেখানে সে যুক্ত ছিল ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপের সঙ্গে ৷
আজাদ দাদা বয়সে তার চেয়ে অনেক বড় ৷ তার বন্ধুবান্ধবরাও আলাদা ৷ কাজেই টগরের সঙ্গে আজাদের সারা দিন দেখা হয় কেবল বাসাতেই ৷ সকালে বা গভীর রাতে ৷