তৌহিদা চুপচাপ ধরনের মেয়ে। সে নিজের মনে সংসারের সব কাজ সামাল দেয়। যথাসময়ে কলেজে যায়। তার কলেজ বাসার খুব কাছে না। হেঁটে যেতে আধঘণ্টার মতো লাগে। সে হেঁটে যায় আসে। কলেজে যাওয়া-আসার জন্য ভাইয়ের কাছে বাড়তি টাকা চাইতে তার খুবই লজ্জা লাগে।
হাবিবর রহমান একটা ফার্মেসির মালিক। ফার্মেসির আগে নাম ছিল নিউ হাবিব ফার্মেসি। বিয়ের পর পর স্ত্রীর নামে ফার্মেসির নামকরণ করেছেন। এখন নাম নিউ সালেহা ফার্মেসি। বছর দুই আগে একটা দরজির দোকান করেছেন। তার নাম নিউ সালেহা টেইলারিং। প্রতিটি দোকানের নামের আগে তিনি নিউ ব্যবহার করেন। কারণ নিউ শব্দটা তার জন্যে লাকি। তার তিনটি বেবিটেক্সি আছে (দি নিউ সালেহা পরিবহন)। প্রতিদিন একেকটা বেবিটেক্সি থেকে তিনি তিনশ টাকা করে পান।
হাবিবুর রহমানকে একজন সফল মানুষ বলা যেতে পারে। সফল মানুষরা চিররুগ্ন স্ত্রী নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে না। হাবিবুর রহমান সতুষ্ট। তার কোনোরকম বদ নেশা নেই। রাত নয়টায় তিনি দোকান বন্ধ করে বাসায় চলে আসেন। এশার নামাজ পড়ে রাতের খাবার শেষ করে টিভি দেখতে বসেন। কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান দেখেন তা না। টিভিতে যা চলে তা-ই তার ভালো লাগে। তবে সাড়ে দশটা বাজতে না বাজতেই তাঁর হাই উঠতে থাকে। রাত এগারোটার দিকে বেবিটেক্সির ড্রাইভাররা তাঁকে দিনের ভাড়া দিয়ে যায়। তিনি টাকা স্টিলের আলমারিতে তুলে ঘুমাতে যান। এক ঘুমে তাঁর রাত কাটে। তিনি সুখী মানুষদের দলে।
মতিন তার বোনের বাসার কলিংবেল টিপছে। অনেকক্ষণ ধরেই টিপছে, দরজা খুলছে না। মতিনের মনে হলো বাসায় তার বড়বোন ছাড়া কেউ নেই। বড়বোন। বিছানায়। বিছানা থেকে নামতে পারছেন না বলে দরজা খুলছে না। আধঘণ্টা ধরে কলিংবেল টেপার অর্থ হয় না। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। দুটা কাজ করা যায়–এক. ফিরে যাওয়া, দুই. কোনো একটা চায়ের দোকান থেকে এককাপ চা খেয়ে নব উদ্যমে কলিংবেল টেপা শুরু করা। দুটার কোনটা করবে এই সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই দরজা খুলল। দরজার ওপাশে তৌহিদা। সে সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে ফেলল। যেন সে এক বিরাট লজ্জায় পড়েছে। মতিন বলল, মিস তৌ, কী খবর?
তৌহিদা অস্পষ্ট গলায় বলল, ভালো।
আমার আপার অবস্থা কী? সে কি নতুন কোনো ব্যাধিতে আক্রান্ত? না কি এখনো পুরনো অসুখ নিয়েই আছে?
তোহিদা জবাব দিল না। মতিন বলল, চট করে চা খাওয়াও। বেশিক্ষণ থাকব না। আপাকে চোখের দেখা দেখেই বিদায়। আপা কই?
তৌহিদা কাপা কাঁপা গলায় বলল, বুবু বাসায় নাই।
কোথায় গেছে?
ভাইজান উনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছেন। বুবুর বুকে ব্যথা, ইসিজি করবেন।
ঘরে শুধু তুমি আর আমি?
তৌহিদা এই প্রশ্নের জবাব দিল না। তার কেমন জানি লাগছে। মনে হচ্ছে। ঘরবাড়ি দুলছে। মাথার ভিতর ভোঁ ভোঁ শব্দ হচ্ছে। খুবই পিপাসা পাচ্ছে। তার উচিত এক্ষুনি ছুটে গিয়ে ঠাণ্ডা একগ্লাস পানি খাওয়া। পানি খেয়েই মতিন নামের মানুষটার জন্যে চা বানানো। কিন্তু সে নড়তেও পারছে না। তার পা ভারি হয়ে। আছে। মতিন নামের মানুষটা আশেপাশে থাকলেই তার এরকম হয়। স্বামীর আশেপাশে দাঁড়ালে কি সব মেয়ের এরকম হয়? মতিন অবশ্যি এখনো তার। স্বামী না। কিন্তু একদিন তো হবে।
মতিন বলল, কী হলো মিস তৌ! তুমি এরকম জম্বির মতো হয়ে গেছ কেন? জম্বি কী জানো?
না।
মৃত মানুষ আবার জীবন ফিরে পেলে যা হয় তার নাম জম্বি।
তৌহিদা মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু তার কথা বুঝতে পারছে না। মৃত মানুষ জীবিত মানুষ এইসব কী বলছে!
মতিন বলল, বসো। আপা যখন নেই তখন তোমার সঙ্গেই কথা বলি। এত দূরে বসতে হবে না। আমার কাছে বসো। খালি বাসা, কেউ দেখবে না।
তৌহিদার শরীর ঝনঝন করছে। মানুষটা এইসব কী বলছে–খালি বাসা, কেউ দেখবে না। কী কেউ দেখবে না? আচ্ছা এই মানুষটা কি তার গায়ে হাত দিতে চায়? গায়ে হাত দিতে চাইলে সে কি নিষেধ করবে? নিষেধ করা মোটেই ঠিক হবে না। কারণ মানুষটা তার স্বামী। স্বামীরা যখন ইচ্ছা তখন তার স্ত্রীর গায়ে হাত দিতে পারে।
মিস তৌ!
জি।
তোমার কি শরীর খারাপ?
জি-না।
এরকম ঘামছ কেন?
জানি না।
আপা কতক্ষণ আগে গেছেন বলো তো?
জানি না।
জানি না বলে তৌহিদা চমকে উঠল। সে অবশ্যই জানে। কেন জানবে না। আধঘণ্টা আগে গিয়েছে। তাহলে সে কেন বলল–জানে না?
মিস তৌ!
জি।
আমার কাজ আছে, আমি উঠলাম। আপাকে বলবে আমি একটা চাকরি পেয়েছি। পার্মানেন্ট কিছু না। টেম্পোরারি। তবে বেতন ভালো। মাসে পনেরো হাজার। বলতে পারবে না?
জি পারব।
তৌহিদা মুখে বলেছে জি পারব, কিন্তু কী পারবে এটা সে এখন বুঝতে পারছে না। মানুষটা বলেছে আমার কাজ আছে আমি উঠলাম। তাহলে একটু আগে কেন বলল, খালি বাসা কেউ দেখবে না? মানুষটা চা খেতে চেয়েছিল। এখন কি সে চা খেতে চাচ্ছে না? সে উঠে দাঁড়িয়েছে। তৌহিদা এখন যদি বলে, চা না খেয়ে আপনি যেতে পারবেন না, তাহলে কি খুব খারাপ হবে? কেন খারাপ হবে? তৌহিদা অবশ্যই তাকে চা খেতে বলবে। শুধু যে বলবে তা-না, সে মানুষটার হাত ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে তাকে বসিয়ে দেবে। মানুষটা বসে যাবার পরও সে তার হাত ছাড়িয়ে নেবে না। একজন স্ত্রী তার স্বামীর হাত ধরে। বসে থাকবে, এর মধ্যে দোষের কিছু নেই।
মিস তৌ, তুমি দরজা লাগিয়ে দাও, আমি যাচ্ছি।