আমার মাথা ঘুরছে, আমি ছাদের এত কিনারায় যেতে পারব না। তুমি বরং আমার কাছে আসো।
কমল বলল, না। আমি যেখানে আছি সেখানে থাকব। এখান থেকে নিচে ঝাঁপ দিতে সহজ হবে।
নিচে ঝাঁপ দেবে?
হ্যাঁ। কারণ আমি চিন্তা করে বের করেছি, আমি মরে গেলে আমার জন্যে ভালো হবে।
কীভাবে?
তুমি কাছে এসো তারপর বলব। হাঁমাগুড়ি দিয়ে আসো। নিচে না তাকিয়ে আসো।
মতিন হাঁমাগুড়ি দিয়ে এগুলো! কমলের পাশে বসল। এক পলকের জন্যে চোখ গেল নিচে। মতিনের মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। তার মনে হলো, এক্ষুনি সে পড়ে যাবে। কমল বলল, তোমাকে বললাম না নিচে তাকাবে না। সবচে ভালো হয় যদি চোখ বন্ধ করে থাক।
মতিন সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেলল। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই ছাদের শেষপ্রান্তে এসে কামালের মতো পা ঝুলিয়ে বসল।
কমল বলল, এখন চোখ খোল।
মতিন বলল, আমি চোখ খুলব না। এখন তুমি বলো, কেন তুমি মরে গেলে তোমার জন্যে ভালো হবে? তোমার বাবা-মা কত কষ্ট পাবেন সেটা কি তুমি বুঝতে পারছ না?
বুঝতে পারছি না। মানুষ শরীরে ব্যথা না পেয়েও কেন কষ্ট পায় আমি বুঝি না।
এই কষ্টকে বলে মানসিক কষ্ট। মনের কষ্ট।
কমল বলল, মন বলে কিছু নেই। কাজেই মনের কষ্টও নেই। এই কষ্ট আমরা নিজেরা বানিয়েছি। এই নিয়ে আমি আর কথা বলব না।
তুমি কি ঠিক করে ফেলেছ যে, নিচে ঝাঁপ দেবে?
হ্যাঁ।
কখন ঝাঁপ দেবে?
পাঁচটা চল্লিশ মিনিটে।
পাঁচটা চল্লিশ মিনিটে কেন? এখন না কেন?
কমল বলল, আজ সানরাইজ হবে পাঁচটা চল্লিশে। আমি সানরাইজ দেখব। Sun-কে বলব, হ্যালো! তারপর ঝাঁপ দেব। আমি সূর্য পছন্দ করি।
মতিন বলল, তুমি তোমার প্রিয়জনদের আর দেখবে না, এটা ভেবে খারাপ লাগছে না?
শুধু সালেহ ইমরানের জন্যে খারাপ লাগছে।
বাবাকে নাম ধরে ডাকছ কেন কমল?
উনি আমার বাবা না। আহমেদ ফারুক আমার বাবা।
তুমি নিশ্চিত?
হ্যাঁ।
আহমেদ ফারুক যদি তোমার বাবা হন, তাতে সমস্যা কী? তুমি তোমার জীবন যাপন করছ। তোমার বাবার বা মার জীবন না।
কিন্তু আমার মন খারাপ।
একটু আগে তুমি বলেছ, মন বলে কিছু নেই। কাজেই মন খারাপও নেই।
আমি ভুল বলেছি। সরি।
কমল শোন, তুমি মানুষকে যন্ত্র ভাবো। মানুষ যন্ত্র না। মানুষ এমন যে, কোনো কারণ ছাড়াই সে কষ্ট পায়। আমি তোমার কেউ না, কিন্তু তুমি ঝাঁপ দিলে আমি প্রচণ্ড কষ্ট পাব।
কেন?
কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার মা যেমন তোমাকে ভালোবাসেন, তোমার বাবা যেমন তোমাকে ভালোবাসেন, আমিও বাসি। আমরা যে-কেউ তোমাকে বাঁচাবার জন্যে জীবন দিতে প্রস্তুত আছি।
তুমি কি সত্যি কথা বলছ? কেউ সত্যি কথা বলে না।
আমি সত্যি কথাই বলছি। আমি নিচে ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত আছি, যদি তুমি প্রমিজ করো আমি ঝাঁপ দেবার পর তুমি তোমার মার কাছে ফেরত যাবে। আমি কিন্তু ঝাঁপ দেব।
কমল ঠাণ্ডা গলায় বলল, তাহলে ঝাঁপ দাও। আমি দেখতে চাই তুমি সত্যি কথা বলছ।
মতিন বলল, পাঁচটা চল্লিশ মিনিট হোক। সূর্যটা দেখে যাই।
তুমি সূর্য ভালোবাস?
মতিন বলল, উজবেক কবি নদ্দিউ নতিম খুব ভালোবাসেন। আমি ততটা বাসি না। কমল, তুমি ঘড়ি ধরে থাক। পাঁচটা চল্লিশ বাজবার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বলবে।
কমল চোখের সামনে ঘড়ি ধরল।
মতিন উঠে দাঁড়াল। বসে থেকে ঝাঁপ দেয়া সমস্যা। দাঁড়িয়ে ঝাঁপ দেয়াই ভালো। মতিন তাকাল সালেহ ইমরানের দিকে। উঁচু গলায় বলল, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। পাঁচটা চল্লিশ বাজতেই কমল আপনাদের কাছে ফিরে যাবে।
গভীর আনন্দ নিয়ে মতিন অপেক্ষা করছে। এই আনন্দের উৎস কী সে জানে না। কে যেন তার মাথার ভেতর বলল, ভালো দেখিয়েছ। কে বলল কথাটা কে জানে?
পশ্চিম আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। পাঁচটা চল্লিশ বাজতে বেশি বাকি নেই।
পরিশিষ্ট
পরিশিষ্ট হাসপাতালের হিমশীতল একটি ঘর। মতিন শুয়ে আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে, সে যেন অনন্তকাল এভাবেই শুয়ে ছিল। তার চেতনার একটি অংশ কাজ করে। সে শব্দ পায়। একবার তার কাছে মনে হলো, কমল এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। কমল বলল, আমি সরি বলতে এসেছি। একবার মনে হলো, কে যেন তার গায়ে হাত রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, আমি মৃন্ময়ী। কেন এরকম করলেন? কেন? সালেহ ইমরান সাহেব একবার বললেন, কমল আমার সঙ্গে থাকবে। সে পড়াশোনা করতে যাচ্ছে সুইজারল্যান্ড। কমল বলেছে সে সাধারণ মানুষ হবার চেষ্টা করবে। আবার মাঝে মাঝে অস্পষ্ট ধোঁয়াটে জগৎ থেকে এক ছায়ামুর্তি বলে, আপনি হাসপাতালে শুয়ে থাকলে কে আমাকে খুঁজে বের করবে? আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন? মতিন ফিসফিস করে বলে, তুমি তৌ।
মতিনের সবচে ভালো লাগে যখন উজবেক কবি নদ্দিউ নতিম তার পাশে এসে বসেন। তাঁর গা থাকে আতরের গন্ধ ভেলে আসে। তিনি একের পর এক কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন। মতিনের মনে হয়, বাহ! এই জীবনটাও তো সুন্দর।