একটা চকলেট–কিটকেট।
একটা বিসকিট। বিসকিটের নাম–Danisa Tradional Butter Cookies.
একগ্লাস অরেঞ্জ জুস।
দুটা পনেরো মিনিটে সে রুবিক কিউব নিয়ে বসল। পাজলটা সে তিনবার সলভ করল। তার সময় লাগল–
প্রথমবার ৬ মিনিট ২ সেকেন্ড
দ্বিতীয়বার ৫ মিনিট ০ সেকেন্ড
তৃতীয়বার ৫ মিনিট ১০ সেকেন্ড
এরপর সে দরজা খুলে বের হলো। তখন সময় ২টা ৩১ মিনিট ১২ সেকেন্ড। সে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়িঘরের ছাদে পা ঝুলিয়ে বসতে সময় নিল বার মিনিট। ছাদে বসেই সে ঘড়ি দেখল। রেডিয়াম ডায়াল ঘড়ি অন্ধকারে দেখা যায়। ঘড়িতে বাজে দুটা তেতাল্লিশ মিনিট তের সেকেন্ড।
কমল সিঁড়িঘরের ছাদের শেষপ্রান্তে বসেছে। এখান থেকে পড়লে সাড়ে চারতলা থেকে পড়া হবে। তার মোটেই ভয় করছে না। কারণ তার Batophobia নেই। তার আছে–
Acousticophobia : Fear of noise.
Broutophobia : Fear of thunder storms.
Demophobia : Fear of crowds.
Ophthalmophobia : Fear of being stared at.
Osmophobia : Fear of smells.
ছাদের উপর জায়গাটা ঠাণ্ডা। সামনের দিক থেকে বাতাস দিচ্ছে। এটা ভালো। পেছন দিক থেকে বাতাস দিলে সে ঝুপ করে নিচে পড়ে যেত। উপর থেকে নিচের রাস্তা দেখতে ভালো লাগছে। যখন রাস্তায় মানুষ থাকে তখন দেখতে অন্যরকম লাগে। যখন মানুষ থাকে না, তখন আবার আরেকরকম লাগে। এখন রাস্তাটাকে নদীর মতো লাগছে। মনে হচ্ছে, একটা নদী সাপের মতো এঁকেবেঁকে গেছে। নদীর দুপাশে উঁচু উঁচু বিল্ডিং।
কমল পকেট থেকে মোবাইল টেলিফোন বের করল। এই টেলিফোন তার মা তাকে দিয়েছেন। সে এই টেলিফোন কখনো ব্যবহার করে না। আজ মাকে টেলিফোন করল। অনেকেই ঘুমুবার সময় টেলিফোন বন্ধ করে ঘুমায়। কমলের মা বলেছেন, তিনি কখনো তা করবেন না। টেলিফোন সবসময় হাতের কাছে রাখবেন। কমলের যখন দরকার হয়, তখনই যেন সে মার সঙ্গে যোগাযোগ। করতে পারে।
চারবার রিং বাজার পর মুনা ঘুম ঘুম গলায় বললেন, কে? কমল?
হ্যাঁ, মা।
এত রাতে তোমার টেলিফোন! কী সমস্যা? এত রাত পর্যন্ত জেগে আছ কেন?
কমল বলল, আমি চিন্তা করছি। চিন্তা করার সময় জেগে থাকতে হয়। ঘুমিয়ে চিন্তা করা যায় না।
দিনেরবেলা চিন্তা করবে। এখন ঘুমুতে যাও। আমি এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনব। এর মধ্যে তুমি বাতি নিভিয়ে বালিশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়বে। এক… দুই…
মা শোন, তিন পর্যন্ত গোনার মধ্যে আমি বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারব। এক থেকে তিন গুনতে সময় লাগবে তিন সেকেন্ড। আমি যেখানে আছি সেখান থেকে ঘরে গিয়ে বালিশে মাথা রেখে শুতে সময় লাগবে বার মিনিট।
তুমি কোথায় আছ?
সিঁড়িঘরের ছাদে।
Oh my God! তুমি সেখানে কী করছ?
তোমাকে তো বলেছি, চিন্তা করছি।
তুমি এক্ষুনি নেমে এসো। এক্ষুনি।
না। চিন্তা শেষ না করে নামব না। এমন হতে পারে চিন্তা শেষ করার পরেও নামব না। আমার এখানে বসে থাকতে ভালো লাগছে।
প্লিজ কমল, তুমি এসব কী বলছ? আমার হাত-পা কাঁপছে। তুমি কী নিয়ে চিন্তা করছ?
কমল বলল, আমি বেঁচে থাকলে আমার জন্যে ভালো হবে, না মরে গেলে আমার জন্যে ভালো হবে–এইটা নিয়ে চিন্তা করছি।
মুনা হতভম্ব গলায় বললেন, তুমি যে এখানে বসে আছ তোমার বাবা জানেন?
এই সময় কমল শুনল, পাশ থেকে কে যেন বলল, সমস্যা কী? কমল গলা চিনতে পারল, আহমেদ ফারুকের গলা। তিনি এত রাতে মার সঙ্গে আছেন? কমল বলল, মা, টেলিফোনটা আহমেদ ফারুককে দাও।
মুনা টেলিফোন রেখে দিলেন। কিংবা তার হাত থেকে টেলিফোন পড়ে গেল।
কমল ঘড়ি দেখল।
রাত তিনটা চল্লিশ মিনিট।
কমল আগের জায়গাতেই আছে। রাস্তায় পুলিশের একটা গাড়ি। দমকল বাহিনীর দুটা গাড়ি। কিছু লোকজনও দেখা যাচ্ছে। ছাদে সালেহ ইমরান দাঁড়িয়ে আছেন। সালেহ ইমরানের পাশে মুনা। মুনার চোখ লাল। তিনি একটু পরপর চোখ মুছছেন। একটু দূরে আহমেদ ফারুক। ফারুকের সঙ্গে দুজন পুলিশ অফিসার। পুলিশ অফিসার দুজন নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। তারা কেউ সিঁড়িঘরের ছাদের দিকে যাচ্ছেন না। কারণ কমল জানিয়ে দিয়েছে, কাউকে সে যদি ছাদের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দেখে তাহলে সে উপর থেকে আঁপ দেবে। সালেহ ইমরান পুলিশ অফিসারকে জানিয়েছেন, কমল যা বলছে তা করবে। সে কখনো কাউকে ভয় দেখানোর জন্যে কিছু করে না।
তিনটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে মতিন এসে পৌঁছল। সে কারো সঙ্গেই কোনো কথা বলল না। সরাসরি সিঁড়িঘরের লোহার সিঁড়ির গোড়ায় গিয়ে দাঁড়াল। স্বাভাবিক গলায় বলল, লমক মিআ কি বসআ? (কমল আমি কি আসব?)
কমল বলল, নকে বেসআ? (কেন আসবে?) ছিরক ন্তাচি মিআ। (আমি চিন্তা করছি।)
মতিন বলল, প্লিজ আমাকে তোমার সঙ্গে কথা বলতে দাও।
না।
মতিন বলল, মানুষ কেন আনন্দ পায়, কেন ভয় পায়, এটা আমি বের করেছি।
কমল বলল, সোআ লেহতা। (তাহলে আসো।)
মতিন সিঁড়ির দিকে না গিয়ে সালেহ ইমরানের দিকে এগিয়ে গেল। সালেহ ইমরান ধরা গলায় বললেন, প্লিজ লুক আফটার মাই সান।
মতিন এগিয়ে যাচ্ছে। তার পা টলছে। কমল বলল, তোমার কি Batophobia আছে?
Batophobia কী?
উচ্চতা ভীতি।
হ্যাঁ, আমার উচ্চতা ভীতি আছে। আমি দোতলা থেকে নিচে তাকাতে পারি না।
তুমি নিচের দিকে তাকিও না, তুমি আই লেভেলে তাকাও। আমার পাশে এসে বসো। কিন্তু খুব কাছে না। এমনভাবে বসবে যেন হাত দিয়ে আমাকে ছুঁতে না পার।