আপনি ভালো থাকুন।
বিনীত–
এস, ইমরান
আহমেদ ফারুক গাড়িতে বসে ছিলেন না। তিনি গাড়ির চারপাশে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। তার হাতে সিগারেট। তবে জ্বলন্ত সিগারেট না। আগুন ছাড়া সিগারেট। তিনি সিগারেট ছাড়ার চেষ্টা করছেন। সিগারেট ছাড়ার প্রথম ধাপ যখন সিগারেটের তৃষ্ণা চাপবে তখন আগুনবিহীন সিগারেট ঠোঁটে দিয়ে টানতে হবে। মতিনকে আসতে দেখে ফারুক আগ্রহ নিয়ে তাকালেন। মতিনের হাতে কোনো খাম বা কাগজ দেখা যাচ্ছে না। ফারুকের ভুরু কুঁচকে গেল। এই উদ্ভট মানুষটা কি এখনো চিঠি পড়ে নি? তার ফাজলামি ধরনের গা-জ্বালানো কথা আরো কিছুক্ষণ শুনতে হবে?
মতিন বলল, আপনার কি সিগারেট ধরানোর জন্যে দেয়াশলাই লাগবে?
না লাগবে না। আপনি চিঠির জবাব এনেছেন?
এনেছি।
কই দিন। আমার অনেক দেরি হয়ে গেছে।
মতিন বলল, আমাকে একটু পল্লবী নামিয়ে দিতে পারেন?
কোথায়?
পল্লবী। মীরপুরের পরে। আমার বড় বোনের বাসা। দুপুরে তার ওখানে আমার খাওয়ার কথা।
পল্লবী নামিয়ে দিতে হবে?
নামিয়ে যে দিতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। আমি একটা সিএনজি ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাব। যদিও এই মুহূর্তে ট্যাক্সি ভাড়া দেয়ার সামর্থ্য আমার নেই। সেটাও সমস্যা না। ট্যাক্সি ভাড়া বড় আপা দিয়ে দেবে। তবে তার সামান্য মন খারাপ হবে এই ভেবে যে, তার আদরের ভাইটার ট্যাক্সি ভাড়া দেবার সামর্থ্যও নেই।
আপনি গাড়িতে উঠুন।
ধন্যবাদ। আপনি সিগারেটটা যদি না খান আমাকে দিয়ে দিতে পারেন। আজ নাশতার পর সিগারেট খাওয়া হয় নি। সিগারেটের প্যাকেটে চারটা সিগারেট ছিল। প্যাকেটটাই খুঁজে পাচ্ছি না।
ফারুক হাতের সিগারেট দিয়ে দিল। গম্ভীর গলায় বলল, সিগারেট এখানেই শেষ করুন। গাড়িতে এসি চলবে। তখন সিগারেট খাওয়া যাবে না।
মতিন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আপনার স্যারের ছেলের বিষয়টা বলুন।
ফারুক বিরক্ত গলায় বলল, কী বিষয় বলব?
সে কি ভয়ঙ্কর?
মেজাজ খারাপ হলে যে-কোনো মানুষই ভয়ঙ্কর হয়। হয় না? বেশিরভাগ মানুষই মেজাজ কন্ট্রোল করতে পারে। যারা Autistic children, কিংবা যাদের ডাউন সিনড্রম আছে তারা মেজাজ কন্ট্রোল করতে পারে না।
ডাউন সিনড্রম আবার কী?
এটাও একধরনের অসুখ। ডাউন সিনড্রমে শিশুরা একটা বাড়তি ক্রোমোজম নিয়ে জন্মায়। এখন আপনি নিশ্চয়ই আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না, ক্রোমোজম কী?
ক্রোমোজম কী?
ডিটেইলে আপনাকে বলতে পারব না। আমি নিজেও জানি না। সব মানষের থাকে ৪৬টা করে ক্রোমোজম। ২৩টা সে পায় বাবার কাছ থেকে, ২৩টা পায় মার কাছ থেকে।
মতিন বলল, ক্রোমোজমের প্রসঙ্গ থাক। মূল জায়গায় আসুন–ছেলে কি ভয়ঙ্কর?
যখন রেগে যায় তখন।
ভয়ঙ্কর হলে কী করে? কামড়ায়?
বেশির ভাগ সময় অ্যাপিলেপটিক সিজার হয়ে যায়, তবে মাঝে মধ্যে আশেপাশের মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
কখন তার মেজাজ খারাপ হয়?
বলা মুশকিল। তার অপছন্দের কিছু ঘটলেই মেজাজ খারাপ হয়।
কী কী তার অপছন্দ?
উঁচু শব্দ অপছন্দ। মেঝেতে চেয়ার টানার শব্দ, চায়ের কাপে চামচের শব্দ।
সব শব্দ বন্ধ? কাজকর্ম কীভাবে চলে, ইশারায়?
সব শব্দ বন্ধ না। উঁচু শব্দ বন্ধ।
মেজাজ যখন খারাপ হয় তখন তা ঠিক করার উপায় কী?
গান বাজালে মেজাজ ঠিক হয়। সে সুগন্ধ খুব পছন্দ করে। তাও সব সুগন্ধ না। যেমন ধরুন লেবু। সে লেবু বা লেবু ফুলের গন্ধ সহ্যই করতে পারে না।
মতিন সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বলল, কোন ধরনের গান সে পছন্দ করে? রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল, না-কি ভাটিয়ালি?
ফারুক গম্ভীর গলায় বলল, আপনার কথা বলার ভঙ্গির মধ্যে ঠাট্টা-ভাব আছে। আমি কিন্তু ঠাট্টা করছি না।
মতিন বলল, আমি এইভাবেই কথা বলি। কী গান ঐ ছেলে পছন্দ করে?
ফারুক বলল, ললা নোটের যে-কোনো মিউজিকই তার পছন্দ। তবে সে হাই নোটস নিতে পারে না। উঠুন গাড়িতে উঠুন।
মতিন গাড়িতে উঠল। ফারুক বলল, আপনি কি কমলের সঙ্গী হবার প্রস্তাবটা নিচ্ছেন?
মতিন হাই তুলতে তুলতে বলল, না। ঐ পাগলা ছেলের কামড় খাওয়ার। কোনো শখ আমার নেই। এখন কি আপনি গাড়ি থেকে আমাকে নামিয়ে দেবেন?
না। আপনাকে পল্লবীতে নামিয়ে দেব।
থ্যাংক য়্যু। শুরুতে আপনাকে আমার যতটা খারাপ মানুষ মনে হয়েছিল। আপনি তত খারাপ না। আপনার স্যারকে বলবেন–আমি চাকরিটা নেব। সতেরো তারিখ বোচকা-বুচকি নিয়ে উপস্থিত হবো।
মতিনের বড়বোনের নাম সালেহা। বয়স চল্লিশের উপরে।
চিররুগ্ন মহিলা। সপ্তাহে তিনদিন তিনি বিছানায় শুয়ে থাকেন। কখনো তিনি জ্বরে কাতর। কখনো বুকে ব্যথা। অমাবস্যা পূর্ণিমাতে বাতের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে থাকেন। তাকে তখন প্রায় কোলে করে বাথরুমে আনা নেয়া করতে হয়। তার ডিসপেপসিয়াও আছে। জাউ ভাত ছাড়া কিছুই খেতে পারেন না। ষােল বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল, স্বামীর সঙ্গে চব্বিশ বছর কাটিয়ে তিনি এখন ক্লান্ত। সংসারে কোনো সন্তান আসে নি। এই নিয়েও সালেহার মনে তেমন। কোনো দুঃখবোধ আছে বলে মনে হয় না। তৌহিদা নামের যে মেয়েটি তার দেখাশোনা করে তাকে তিনি প্রায়ই বলেন–আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। আমার শরীরের যে অবস্থা ছেলেমেয়ে হলে উপায় কী হতে বল!
তৌহিদা সালেহার স্বামী হাবিবুর রহমানের মামাতো বোন। সে অনেক দিন। ধরে তার ভাইয়ের সংসারে আছে। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় এসেছিল, এখন। সে লালমাটিয়া কলেজে পড়ে। আগামী বছর বিএ পরীক্ষা দেবে। মেয়েটির গায়ের রঙ ময়লা হলেও সে অত্যন্ত সুশ্রী। তার কলেজের বান্ধবীরা প্রায়ই তার বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে সালেহার কাছে আসে। তিনি তাদের সবাইকে বলেন, তৌহিদার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। আমার ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে। ওর বিয়ে নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না।