আজিজ আহমেদ মতিনকে নিয়ে খেতে বসেছেন। তিনি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কুমড়া ফুলের বড়া কেমন হয়েছে?
মতিন বলল, ছোটগল্পের মতো হয়েছে।
মানে বুঝলাম না!
মতিন বলল, ছোটগল্পের ডেফিনেশন ভুলে গেছেন চাচা? শেষ হইয়াও হইল না শেষ–এই অবস্থা। কুমড়া ফুলের বড়া শেষ হবার পরেও তার স্বাদ জিভে লেগে থাকছে।
ভালো বলেছ।
নিশু খাবে না?
না। মেজাজি মেয়ে। আছে মেজাজ নিয়ে। এই মেয়ে এত মেজাজ কোথায় পেল সেটাও বুঝি না। আমি নিজে খুবই ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ। তোমার চাচি ছিলেন আমার চেয়েও ঠাণ্ডা। মাঝখান থেকে মেয়ে হয়ে গেল ধানি মরিচ।
বিয়ের পর জামাইয়ের ক্যাঁচা খেয়ে ঠিক হয়ে যাবে।
আজিজ আহমেদ চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, সে কি তার বিয়ের কথা তোমাকে কিছু বলেছে?
মতিন বলল, না।
আমাকে তো বলেছে ইংল্যান্ড যাবার আগে বিয়ে করবে। হাসবেন্ড সঙ্গে নিয়ে যাবে। কমনওয়েলথ স্কলারশিপে তো স্পাউস সঙ্গে নেবার ব্যবস্থা আছে।
আপনাকে যখন বলেছে তখন অবশ্যই বিয়ে করবে। নিশু হচ্ছে রোবটের মতো। রোবটরা কমান্ডে চলে। নিশু তার নিজের কমান্ড নিজেই দেয়। কমান্ড ইস্যু হবার পর সেই কমান্ডে চলে।
নিশুর পছন্দের কেউ কি আছে?
অনেকেই আছে।
আজিজ আহমেদ বললেন, যাকে সে বিয়ে করবে তাকে আমার সঙ্গে পরিচয় করাবে না? চা খেতে নিয়ে এলো। একসঙ্গে চা-টা খেলাম, হালকা কথাবার্তা বললাম।
নিশুর কিছু প্লানিং নিশ্চয়ই আছে। পরিকল্পনার বাইরে সে কিছু করবে না।
এটাও ঠিক বলেছ। মেয়েটা অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক যন্ত্র। ইলিশ মাছের তরকারিটা কেমন হয়েছে?
দেবদাস টাইপ হয়েছে।
তার মানে?
দেবদাসের শেষ লাইনগুলি মনে আছে চাচা? মরণে ক্ষতি নাই, কিন্তু সে সময় যেন একটি সুখ করস্পর্শ কপালে আসিয়া পৌঁছে। যেন একটি দয়ার্দ্র স্নেহময় মুখ দেখিতে দেখিতে জীবনের ইতি হয়।
আজিজ আহমেদ বিস্মিত গলায় বললেন, এর সঙ্গে ইলিশ মাছের ঝোলের সম্পর্ক কী?
সম্পর্ক আছে–মরণে ক্ষতি নাই, কিন্তু সে-সময় যেন একটি ইলিশ মাছের পিস মুখে আসিয়া পৌঁছে। যেন সরষে ইলিশের ঝোল টানিতে টানিতে জীবনের ইতি হয়।
আজিজ আহমেদ হতাশ গলায় বললেন, বাবা, সবসময় জোকারি করা ঠিক না। সবসময় জোকারি করলে তুমি মানুষের সামনে পাতলা হয়ে যাবে। তুমি কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেও মানুষ গুরুত্ব দিবে না। ভাববে জোকারি করছ।
ঠিক বলেছেন চাচা, আর জোকারি করব না। ইলিশ মাছটা খুব ভালো হয়েছে। আমি আরেক পিস নিব।
নিশুর যখন ঘুম ভাঙল তখন সন্ধ্যা। ঘড়িতে বাজছে সাতটা। আজিজ আহমেদ মাত্র মাগরিবের নামাজ শেষ করেছেন। মেয়ের ঘুম ভাঙলে মেয়েকে নিয়ে চা খাবেন। নিশু এসে বাবার সামনে দাঁড়িয়েছে। তার মুখ থমথম করছে।
বাবা, তোমাকে পাঁচটার সময় ডেকে দিতে বলেছিলাম, তুমি ডাক নি কেন?
তুই এত আরাম করে ঘুমাচ্ছিলি, ডাকতে মায়া লাগল। বোস, চা খা।
চা খাব না। তোমাকে একটা দায়িত্ব দিয়েছিলাম। দায়িত্ব পালন করতে পারলে না। আমার অ্যাপয়নমেন্ট ছিল মতিনের সঙ্গে। জরুরি কথা ছিল। বাবা, আমার খুব খারাপ লাগছে।
মা রে, ভুল হয়ে গেছে! তুই টেলিফোনে তার সঙ্গে কথা বল।
আমি সামনা-সামনি কথা বলতে চেয়েছিলাম।
তাকে আসতে বল। ডাকলেই চলে আসবে। মা শোন, মেজাজ ঠাণ্ডা করে বোস। একসঙ্গে চা খাই। দুদিন পরে চলে যাবি।
নিশু বাবার সামনে থেকে সরে গেল। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। তার ঘুম পুরোপুরি কাটে নি। সে আবার শুয়ে পড়বে। ঘুম নিয়ে তার এই ব্যাপারটা আছে। মাঝে মাঝে ঘুমের স্পেল আসে। খেয়ে না-খেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুমায়। আবার মাঝে মাঝে আছে জেগে থাকার স্পেল। একবার তিনদিন। তিন রাত সে এক মিনিটের জন্যেও ঘুমায় নি। তাতে তার তেমন কোনো
অসুবিধাও হয় নি।
নিশু মতিনকে টেলিফোন করল বিছানায় শুয়ে। ঘর অন্ধকার। বাইরে বৃষ্টি নতুন করে শুরু হয়েছে। জানালা সামান্য খোলা। পর্দা বাতাসে কাঁপছে। মাঝে মাঝে বৃষ্টির ছাট এসে চোখে-মুখে লাগছে। নিশুর চমৎকার লাগছে।
মতিন শোন, তোমার মনে কি এমন কোনো ভ্রান্ত ধারণা আছে যে, আমি তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি?
মতিন বলল, না, নেই। তুমি মূল কথাটা বলে ফেল। প্যাঁচানোর দরকার নেই।
নিশু বলল, আমি বাবাকে কথা দিয়েছিলাম যে, দেশের বাইরে যাবার আগে বিয়ে করব।
কথা রাখ। বিয়ে করা কঠিন কাজ না। পিএইচডি করার চেয়ে সহজ।
সমস্যা হচ্ছে, একটি ছেলে আমার পাশে শুয়ে আছে–এই চিন্তাটাই আমার কাছে আগলি লাগে।
ও আচ্ছা!
আমার একটা টেকনিক্যাল বিয়ে করা দরকার। এমন একজনকে স্বামী হিসেবে আমার দরকার যে আমার সমস্যা বুঝবে। তাকে যখন বলব, ডিল ইজ অফ–সে সরে দাঁড়াবে। স্ত্রীর উপর স্বামীর অধিকার খাটানোর কোনো চিন্তা যার মাথায় থাকবে না।
আমি কি সেই ভাঙা কুলা?
হ্যাঁ।
আমাকে তোমার সঙ্গে ইংল্যান্ডে যেতে হবে?
অবশ্যই না। তুমি তোমার মতো এখানেই থাকবে। নদ্দিউ নতিমের উপর গবেষণা করবে। তার গল্পের অনুবাদ প্রকাশ করবে। তুমি কি রাজি?
চিন্তা করে দেখি।
এত চিন্তার কী আছে?
চিন্তার কিছু নেই?
অবশ্যই না। তুমি আমাকে সাহায্য করবে। তুমি তোমার কুৎসিত মেসটা ছেড়ে বাবার সঙ্গে থাকবে।
জামাই-শ্বশুর এক বাড়িতে?
হ্যাঁ। বাবার বয়স হয়েছে। এখন নানান উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা করেন। তুমি বাবার সঙ্গে থাকলে আমি নিশ্চিন্ত থাকি।