পিঁয়ারো : কবি, আপনি কেমন আছেন?
কবি : আমি বিষণ্ণ আছি। মানুষ হয় ভালো থাকে, নয় মন্দ থাকে। আমি থাকি বিষণ্ণ।
পিঁয়ারো : কেন বিষণ্ণ থাকেন?
কবি ; প্রকৃতি বিষণ্ণ বলেই আমি বিষণ্ণ। পিঁয়ারো : প্রকৃতি কি বিষণ্ণ?
কবি : অবশ্যই। প্রকৃতির উৎসে আছে বিষণ্ণতার মহান সঙ্গীত। প্রকৃতি কেন বিষণ্ণ জানো? প্রকৃতি বিষণ্ণ সৃষ্টিশীলতার বেদনায়। সৃষ্টির প্রধান শর্ত বেদনা। বেদনার হাত ধরে থাকে বিষণ্ণতা।
পিঁয়ারো : এই বিষয়ে আরো কিছু বলুন–
কবি : আনন্দ এবং বেদনা সমগ্র প্রাণিকুলেই আছে। কিন্তু বিষণ্ণতা মানব জাতির নিজস্ব বিষয়। একটা কাক হয় আনন্দে থাকে, নয় বেদনায় থাকে। বিষণ্ণতায় কখনো থাকে না।
পিঁয়ারো : আপনি কী করে এত নিশ্চিত হলেন? হয়তো কাকদের জগতেও বিষণ্ণতা আছে!
[আমার এই কথায় কবি মনে হলো কিঞ্চিৎ আহত হলেন। তার কপালের চামড়ায় ভাঁজ পড়ল। ভুরু কুঁচকে গেল। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে তিনি শান্তগলায় তার একটি বিখ্যাত কবিতার কয়েক পঙক্তি আওড়ালেন।]
প্রজাপতির ডানায় তুমি বিষণ্ণতা খুঁজতে যেও না।
প্রজাপতির বাণিজ্য বেদনায়।
তার দুটি ডানার একটিতে লাভ
অন্যটিতে লোকসান।…
মতিন তরতর করে লিখে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এক বৈঠকেই লেখা নেমে যাবে।
প্রজাপতি বিষয়ক কবিতাটা আরো দুর্বোধ্য করতে হবে। নদ্দিউ নতিমের সব কবিতাই তার লেখা। ব্যারিস্টার সাহেবের বাড়িতে কেন সে হুট করে নিশুর নাম বলে ফেলল কে জানে! নিশুর নাম মাথায় ঘুরঘুর করছিল বলেই হয়তো বলেছে। কিংবা তার সাবকনশাস মস্তিষ্ক নিশুকে কবি হিসেবে দেখতে পছন্দ করছে। তাকে আজ একবার বাংলাবাজারে যেতে হবে। নদ্দিউ নতিমের একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশের চেষ্টা সে করছে। এক গা প্রকাশক (গাধা প্রকাশক) যথেষ্ট আগ্রহ দেখাচ্ছে। সেই গা প্রকাশক মতিনের প্রবন্ধ দুটার ফটোকপি গম্ভীর মুখে দেখল। কয়েক লাইন পড়ল।
মতিন বলল, আপনি নিশ্চয় উজবেক এই মহান কবির নাম শুনেছেন।
গা প্রকাশক ভুরু কুঁচকে বলল, অবশ্যই শুনেছি। উনার নাম জানব না এটা কেমন কথা বললেন! সৃজনশীল লেখার খোঁজখবর আমাদের রাখতে হয়।
এই মহান কবি সারা জীবনে মাত্র ছয়টি গল্প লিখেছেন। আমি অনুবাদ করেছি। আপনারা কি ছাপবেন?
গল্প ছাপব না। বাংলাদেশে ছোটগল্প চলে না। উপন্যাস হলে ভেবে দেখতাম।
মতিন বলল, উনার গল্প না ছাপাই ভালো। কিছুই বলা যায় না, হয়তো গভর্নমেন্ট নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেবে। খুবই ইরোটিক গল্প।
অশ্লীল?
চূড়ান্ত অশ্লীল। গল্পগ্রন্থের নামই নদ্দিউ নতিমের ছয়টি বাজেয়াপ্ত অশ্লীল গল্প। কবি নিজেই নিজের গল্প বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করেন। পরে অবশ্যি উজবেকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়। জার্মানি এবং ইংল্যান্ডেও নিষিদ্ধ। শুধু ফরাসি গভর্নমেন্ট নিষিদ্ধ করে নি। ওরা উদার জাতি।
গা প্রকাশক সঙ্গে সঙ্গে বলল, পাণ্ডুলিপি নিয়ে বুধবারে আসুন।
আজ বুধবার।
নিশু বাসায় ফিরল দেড়টায়। সে বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গিয়েছে। তার গা ভর্তি কাদা। কাদা লেগেছে কিছুক্ষণ আগে। ফুটপাত ধরে আসছিল। পাশ দিয়ে শা করে ট্রাক চলে গেল। রাস্তায় জমে থাকা কাদা-পানির সবটাই এসে পড়ল নিকার গায়ে। এই দৃশ্য দেখে ট্রাকের হেল্পার মোহিত। সে জানালা দিয়ে মুখ বের করে হে হে করে হাসছে। নিশু তার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল, চুপ শালা!
যে মেয়ে অনার্স এমএ দুটিতেই প্রথম শ্রেণীতে প্রথম তার মুখে চুপ শালা গালি মানায় না। কিন্তু নিশুর মুখে মানিয়েছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পথচারী (তার অবস্থা কাহিল, সেও মাখামাখি) হৃষ্ট গলায় বলল, উচিত কথা বলেছেন আপা। এইভাবেই এদের শিক্ষা দিতে হয়।
আজিজ আহমেদ মেয়েকে দেখে বললেন, একী ব্যাপার! দেখে মনে হচ্ছে। ডােবা থেকে উঠে এসেছিস। যা, ভালো করে সাবান ডলে গোসল করে ফেল। গরম পানি দেব?
গরম পানি লাগবে না। আমি ছাদে বৃষ্টিতে গোসল করব।
চট করে গোসল করে আয়। রান্না শেষ। আজ একটা স্পেশাল আইটেম আছে–কুমড়া ফুলের বড়া। বেসন মাখিয়ে রেখে দিয়েছি। খেতে বসলে গরম গরম ভেজে দেব।
আমি খাব না।
খাবি না কেন?
খেয়ে এসেছি। পুরান ঢাকায় গিয়েছিলাম, হাফ প্লেট তেহারি খেয়েছি। ত্রিশ টাকা করে প্লেট। সঙ্গে অর্ধেকটা সিদ্ধ ডিম দেয়।
সামান্য খা।
না। ফুলের ভাজি তোমরা খাও। আর বাবা শোন, আমি তোমাকে বলেছি আমার বারান্দার পড়ার জায়গায় অন্য কেউ বসলে আমার রাগ লাগে! বলেছি না?
বলেছিস।
মতিন যে কাগজ-কলম নিয়ে বসে গেল। বিরাট স্কলার হয়ে গেল। তুমি না করতে পারলে না?
আজিজ আহমেদ ব্ৰিত গলায় বললেন, ও যে ঐখানে বসেছে খেয়াল করি নি।
নিশু কঠিন গলায় বলল, আমি গোসল সেরে দরজা বন্ধ করে ঘুমাব। আমাকে পাঁচটা না বাজা পর্যন্ত ডাকবে না। আর কয়েকটা কুমড়া ফুল আমার জন্যে রেখে দেবে, রাতে খাব। সাবান আর টাওয়েল এনে দাও।
সাধারণত দেখা যায় বৃষ্টিতে গোসলের জন্যে ছাদে উঠলেই বৃষ্টি থেমে যায়। কিংবা ঝিরঝির শুরু হয়। নিশুর বেলায় উল্টো হলো–ঝুম বৃষ্টি নামল। নিশু ঠিক করে ফেলল যতক্ষণ এমন ঝুম বৃষ্টি থাকবে ততক্ষণই সে ভিজবে। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত বৃষ্টি থাকলে পাঁচটা পর্যন্তই ভিজবে। আজকের বিকেল পাঁচটা তার জন্য ইম্পোর্টেন্ট। বিকেল পাঁচটায় সে মতিনকে কিছু জরুরি কথা। বলবে। সময়টা পাঁচটা না হয়ে ছটা হতে পারত, সাতটাও হতে পারত, কিন্তু একবার নিশু যখন ঠিক করেছে পাঁচটা তখন পাঁচটাই। সময়ের ব্যাপারে এই সমস্যাটা তার আছে।