মতিন চিন্তিত মুখে হাঁটছে। তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে–সুর করি বারবার পড়ি বর্ষা অভিসার, অন্ধকার যমুনার তীর… তারপর কী? তারপর? তাকে এই মুহূর্তে নিশু বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে। নিশুকে জিজ্ঞেস করলেই সে গড়গড় করে বাকি লাইন বলে দেবে। মতিন কী করবে বুঝতে পারছে না। নিশুকে জিজ্ঞেস করে ঝামেলা শেষ করবে, না-কি নিজেই মনে করার চেষ্টা করবে? নিজের চেষ্টা করাই উচিত। মতিন রিকশা নিয়ে নিল। সে এখন যাবে নিশুদের বাসায়। রিকশা করে যেতে তার একঘণ্টার মতো লাগবে। এই একঘণ্টা চিন্তা করে বাকি লাইনগুলি বের করার চেষ্টা করা যেতে পারে।
রিকশা দ্রুত চলছে। রিকশার চলা আর রেলগাড়ির চলা এক না। রিকশার চলায় কোনো ছন্দ নেই। তারপরেও মতিনের মাথায় তালে তালে বাজছে–সুর করি বারবার পড়ি বর্ষা অভিসার…
নিশু বাসায় নেই। নিশুর বাবা রংপুর কারমাইকেল কলেজের প্রাক্তন অঙ্ক সক আজিজ আহমেদ বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে খবরের কাগজ তছেন। তিনি মতিনকে দেখে আনন্দিত চোখে তাকালেন। মতিন বলল, চাচা, নিশু কই?
আজিজ আহমেদ বললেন, সকালবেলা আমাকে নাশতা দিয়েই বের হয়ে গেছে। একবার ভাবলাম জিজ্ঞেস করি–মা, কোথায় যাও? শেষপর্যন্ত জিজ্ঞেস করি নি।
কেন জিজ্ঞেস করেন নি?
মেয়ে বড় হয়েছে। দুদিন পরে লন্ডন যাচ্ছে। সেই মেয়েকে তো কোথায় যাও, কী জন্যে যাও, কখন ফিরবে, এইসব জিজ্ঞেস করা যায় না। সে আমাকে সন্দেহপ্রবণ বাবা ভেবে বসতে পারে। ঠিক বলেছি না?
জানি না ঠিক বলেছেন কি-না। নিশুকে দরকার ছিল।
টেলিফোন কর। এখন তো মোবাইল টেলিফোন নামে এক বস্তু বের হয়েছে প্রাইভেসি শেষ। মতিন, তুমি কি চা খাবে?
চা খেতে চাচ্ছিলাম। বানাবে কে? কাজের মেয়ে আছে?
না। ছুটা কাজের মেয়ে ছিল, সে কাজ শেষ করে চলে গেছে। অসুবিধা নেই, আমি বানাব। তুমি তো চায়ে তিনচামচ চিনি খাও, ঠিক না?
জি ঠিক। আমার চায়ে দুটা টি-ব্যাগ দিবেন।
আজিজ আহমেদ খুশি মনে চা বানাতে গেলেন। চা বানানো, রান্নাবান্নার কাজগুলি তিনি অতি আনন্দের সঙ্গে করেন।
মতিন, তুমি কি দুপুরে এখানে খাবে?
ভালো কিছু থাকলে খাব। ডাল আলুভর্তা হলে না।
সকালে ধূপখোলার বাজার থেকে পদ্মার ফ্রেশ ইলিশ এনেছি। ইলিশ মাছের ঝোল, কাকরুল ভাজি। চলবে না?
ইলিশ মাছের সঙ্গে তরকারি কী?
আজিজ আহমেদ বিরক্ত গলায় বললেন, তোমরা এই একটা ভুল কর, ইলিশ মাছের সঙ্গে তরকারি খোঁজ। তুমি যে তরকারিই ইলিশ মাছের সঙ্গে দিবে, মাছের স্বাদ নষ্ট হবে। তরকারি হলো ইলিশ মাছের জন্য ইন্টারফেরেন্স। ইলিশ মাছ, গলদা চিংড়ি ইন্টারফেরেন্স পছন্দ করে না।
মতিন বলল, চাচা, আমি আমার চা পশ্চিমের বারান্দায় একা একা খাব। আপনার কোনো সমস্যা নেই তো?
সমস্যা নেই, তবে সিগারেটটা একটু কম খাও। It is a killer.
কমানোর চেষ্টা করছি চাচা। পারছি না। টাকা-পয়সা টুকটাক যা পাই সব সিগারেটের পেছনে চলে যায়।
সিগারেট তো আমিও খাই–কিন্তু আমার সব হিসাব করা। সকালের নাশতার পর একটা, দুপুরে ভাত খাবার পর একটা, রাতের ডিনারের পর। একটা। ঘরে সিগারেট রাখি না। প্রতিবার নিজে গিয়ে একটা করে সিগারেট কিনে আনি। এতে এক্সারসাইজও হয়।
চাচা, এখন কি চায়ের সঙ্গে একটা সিগারেট খাবেন? দেব?
দিতে পার।
বারান্দায় চা খেতে খেতে মতিন টেলিফোনে নিশুকে ধরবার চেষ্টা করল। যতবারই কল করা হয় ততবারই একটি মেয়েগলা বলে–এখন সংযোগ দেয়া যাচ্ছে না। পরে আবার চেষ্টা করুন।
আজিজ আহমেদ বিপুল উৎসাহে রান্নাবান্নায় নেমে পড়েছেন। তিনি নিজে খেতে পছন্দ করেন। নিশুর খাওয়া-দাওয়া বিষয়ে কোনো আগ্রহ নেই। রান্না করা ইলিশ মাছ এবং রুইমাছের তফাত সে ধরতে পারে না। তরকারিতে লবণ। কম-বেশি হলেও সে ধরতে পারে না। একবার তিনি ভুলে লবণ ছাড়া কই মাছের ঝোল বেঁধেছেন। এক নলা মুখে দিয়েই তার মেজাজ খুব খারাপ হলো। অথচ নিশু মাথা নিচু করে খেয়েই যাচ্ছে। তিনি বললেন, কই মাঝের ঝোল। খেতে কেমন হয়েছে? নিশু বলল, খেতে ভালো হয়েছে বাবা। কী একটা মসলা যেন বেশি হয়ে গেছে। কিন্তু খেতে ভালো হয়েছে।
খাওয়া-দাওয়া বিষয়ে যে মেয়ে এমন উদাসীন তার জন্যে ভালো-মন্দ রান্না করা অর্থহীন। তবে ভালো খাওয়া মতিন খুবই পছন্দ করে। সে রান্নার ভালো মন্দ বোঝে। তার জন্য রান্না করায় আনন্দ আছে।
মতিন কিছুক্ষণ রান্নার প্রক্রিয়া দেখল, তারপর বারান্দায় রাখা চেয়ার টেবিলে কাগজ-কলম নিয়ে বসল। বারান্দার একটা অংশ চিক খাঁটিয়ে আলাদা। করা। সেখানে চেয়ার-টেবিল আছে। একটা বইয়ের শেলফ আছে। বইয়ের শেলফে অবশ্যি ইংরেজি-বাংলা ডিকশনারি ছাড়া কিছুই নেই। জ্ঞানী মেয়ের জ্ঞানী বই। এটা হলো নিশুর দিনের পড়ার জায়গা। নিশু দিনেরবেলা ঘরের ভেতরে পড়তে পারে না।
মতিনের মাথায় নতুন একটা লেখা চলে এসেছে। লেখাটাকে দ্রুত মাথা কে নামিয়ে ফেলা দরকার। সে আগ্রহ নিয়ে লিখছে। এই সময় সিগারেট তেলে ভালো হতো। প্যাকেটের সিগারেট শেষ! দোকান থেকে সিগারেট কিনে আনা সম্ভব না। কারণ বৃষ্টি নেমে গেছে। নিশুদের বাসায় কোনো ছাতা নেই।
যে প্রবন্ধটি মতিন লিখছে তার শিরোনাম–
প্রখ্যাত উজবেক কবি নদ্দিউ নতিমের বিশেষ সাক্ষাৎকার
নদ্দিউ নতিম অন্তর্মুখী জগতের নিঃসঙ্গ বাসিন্দা। তাঁর জীবনচর্যা প্রকৃতি সম্পৃক্ততায় সিক্ত হলেও জনজীবন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এই মহান কবির একটি সাক্ষাৎকার সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন ফরাসি সাংবাদিক লেমি পিঁয়ারো। ফরাসি ভাষা থেকে মূল সাক্ষাৎকারটির সরাসরি বঙ্গানুবাদ পত্রস্থ করা হলো।