দরজা অবশ্যই খুলব। তারপর দশবার তোমাকে কানে ধরে উঠবোস করাব।
তৌহিদা নিঃশ্বাস বন্ধ করে দরজা খোলার শব্দ শুনল। তারপর শুনল তার ভাইজানের কঠিন গলা।
কোনো কথা নেই। উঠবোস। কানে ধরে উঠবোস। আগে কানে ধরে উঠবোস, তারপর কথা। এক, দুই, তিন…
তৌহিদা ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল। এটা কোনো কথা? বরকে কেউ কানে ধরে উঠবোস করায়? ভাইজানের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল! তৌহিদা দরজা খুলে বাইরে এসে দেখে চারদিকে সুনসান নীরবতা। পুরো বাড়ি অন্ধকার। সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। কেউ আসে নি।
হ্যালো মতিন
হ্যালো মতিন,
তোর সর্বশেষ চিঠিতে জানলাম তুই বিয়ে করতে যাচ্ছিস। কনের নাম তৌ। এমন অদ্ভুত নামের মেয়ে তুই জোগাড় করলি কোত্থেকে? নাম শুনেই মেয়েটিকে রহস্যময় মনে হচ্ছে। আচ্ছা, ওর নাক কি চাপা? উপজাতীয় মেয়েদের এরকম এক অক্ষরের নাম হয়? তোর তৌ কি এরকম কেউ?
চিঠি যখন পাবি তখন আমার হিসেব মতো তোদের বিয়ে হয়ে গেছে। তবে তোর বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না। তোকে যতটুকু চিনি তুই বিবাহ করিয়া সুখে ঘর-সংসার করিতে লাগিল টাইপ না। নদ্দিউ নতিম সাহেব কি বিবাহ করেছিলেন? ভালো কথা, নদ্দিউ নতিম সাহেবের। নতুন কিছু কি বের হচ্ছে? এসেছে কোনো আইডিয়া? তুই তৌকে নিয়ে (যদি বিয়ে সত্যি সত্যি হয়ে গিয়ে থাকে) আমার এখানে হানিমুন করতে চলে আয়। দুজনে মিলে Tree house-এ থাকবি। গাছের উপর থেকে পৃথিবী দেখবি। গাছ-ঘরে কাগজ-কলম দেয়া থাকবে। তুই নতুন প্রবন্ধ ফাদবি–নদ্দিউ নতিমের বৃক্ষজীবন। তবে শোন, আমার এখানে এলে কিন্তু ফিরে যেতে পারবি না। One way ticket. এখানেই থেকে যাবি। শুরু হবে আমাদের জঙ্গল জীবন।
এখন বলি আমার খবর। মাসি-পিসি পুরোপুরি পোষ মেনে গেছে। এরা নির্বিকার ভঙ্গিতে আমার ঘরে ঢোকে। জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করে। ধমক দিলে বিরক্ত হয়ে তাকায়। আমার কিছু কথাবার্তা বুঝতেও পারে। যেমন আমি যখন বলি–Get lost. ওরা ঘর ছেড়ে চলে যায়। যদি ডাক দেই মাসি। মাসি উঁকি দেয়। পিসি বললে পিসি উঁকি দেয়। একদিন পিসির হাতে একটা ভেজা টাওয়েল দিয়ে বললাম, তারের উপর শুকাতে দিয়ে আস। বলে তারের দিকে ইশারা করলাম। সে ঠিকই ভেজা টাওয়েল শুকাতে দিল। ব্যাপারটা কাকতালীয় হতে পারে। আবার এও হতে পারে যে, এদের যথেষ্ট বুদ্ধি-শুদ্ধি আছে! একজন ভালো ট্রেইনার পেলে কাজ হতো, ওদের শেখাতে পারত। মাসির শেখার আগ্রহ তেমন নেই, তবে পিসির আছে।
মাসি-পিসি প্রসঙ্গ শেষ। এখন আসি হস্তীশাবক প্রসঙ্গে। আমাদের এখানে মাঝেমধ্যেই বার্মার ঘন জঙ্গল থেকে হাতির পাল আসে। বিষয়টা আনন্দময় না, ভীতিকর। বন্যহাতি ভয়ঙ্কর প্রাণী। এরকম একটা হাতির পাল খাগরাছড়িতে এসেছিল। এরা চলে যাবার পর দেখা গেল একটা হাতির বাচ্চা ফেলে চলে গেছে। হাতির পাল এই কাজ কখনো করবে না। এরা শিশু ফেলে চলে যাবে না। তারা কাজটা করল, কারণ হাতির বাচ্চার পা কী কারণে যেন। ভেঙে গেছে। তার হাঁটার ক্ষমতা নেই।
আমি হাতির বাচ্চাটাকে নিয়ে এসেছি। বান্দরবান থেকে পশুডাক্তার আনিয়ে হাতির পায়ে প্লাস্টার করানো হলো। পশুডাক্তার বললেন, কোনো লাভ হবে না, হাতি-ঘোড়ার পা ভাঙলে সারে না। তারা ভাঙা পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে চায় বলে পা কখনো জোড়া লাগে না। আমি দড়ি দিয়ে হাতির বাচ্চাটাকে এমনভাবে বাঁধার ব্যবস্থা করলাম যেন উঠে দাঁড়াতে না পারে। তার জন্যে দৈনিক বিশ লিটার দুধ বরাদ্দ। করা হলো। এর মধ্যে একরাতে ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটল। শো শো শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। দরজা খুলে বাইরে এসে দেখি হাতির বাচ্চার কাছে পাহাড়ের মতো কী যেন দাঁড়িয়ে আছে। দুপা এগিয়ে থমকে গেলাম। পর্বত সদৃশ জিনিসটা যে হাতি তা বুঝতে পেরে কলিজা শুকিয়ে গেল। আমার ধারণা এটা বাচ্চা হাতিটার মা। গন্ধ শুকে শুকে চলে এসেছে। এ কী করবে কে জানে? তার সন্তানকে বেঁধে রেখেছি, এই অপরাধে সে অনায়াসেই চারদিক লণ্ডভণ্ড করে আমাকে পায়ের নিচে ফেলে মেরে ফেলতে পারে। হাতি যত বুদ্ধিমানই হোক তার বোঝার কথা না যে আমি তার সন্তানের মঙ্গলের কারণেই তাকে বেঁধে রেখেছি।
তুই লেখকমানুষ। দৃশ্যটা কল্পনা কর। আমি একটা বন্য হাতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। আকাশে চাঁদ। চাঁদের আলোয় সবকিছু রহস্যময় মনে হচ্ছে। বাচ্চা হাতিটাকে হাতি শুড় দিয়ে আদর করছে। পশুর আদরের এই দৃশ্য। থেকেও চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছি না। অথচ আমার উচিত দ্রুত কোনো নিরাপদ জায়গায় চলে যাওয়া।
মা-হাতিটা পনেরো বিশ মিনিট থেকে জঙ্গলের দিকে চলে গেল। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এখন মা হাতিটা রোজই রাতে একবার করে আসছে। আমি একবার চেষ্টা করলাম কাছে যেতে। মা-হাতি বিকট গর্জন করল, আমি তৎক্ষণাৎ পিছিয়ে এলাম। হস্তী এবং হস্তীশাবকের এই অদ্ভুত দৃশ্য তুই এসে দেখে যা। তুই লেখকমানুষ, তোর দেখায় কাজ হবে। আমি জংলিমানুষ, আমার দেখা না-দেখা একই।
এখন তোকে কিছু ভালো খবর দেয়া যাক। তিন হাজার কফির চারা লাগিয়েছিলাম। দুইশ নষ্ট হয়েছে। বাকিগুলোর অবস্থা বেশ ভালো। বৃষ্টির পানি পেয়ে তরতর করে উঠছে। দেখলেই মন ভরে যায়। তোকে একবার বলেছিলাম না। আমার এলাকায় লেকের মতো জায়গা আছে। শীতের সময় তেমন পানি থাকে না, বর্ষায় পানি আসে। এই লেক কানায় কানায় পূর্ণ। আমি কোনো মাছ ছাড়ি নি, তারপরেও প্রচুর মাছ। মাছ কোত্থেকে এসেছে কে জানে।