তোমার পক্ষে কি সম্ভব ক্লিনিকে এসে আমাদের উপহারটা নিয়ে যাওয়া? তোমার স্ত্রী বিয়ের দিন গয়নাটা পরল। আমাদের ক্লিনিকটা কিন্তু তোমার মেস থেকে দূরে না।
ঠিক আছে, চলে আসছি।
তুমি কি তোমার স্ত্রীকে গয়না টয়না কিছু দিচ্ছ?
পাগল! আমি গয়না পাব কোথায়!
তোমাকে একটা ছোট্ট উপদেশ দেই?
দাও।
তোমার স্ত্রীকে আমাদের এই গয়নার সেটটা দিয়ে বলল এটা তুমি দিয়েছ।
তাতে লাভ?
স্বামীর দেয়া উপহার স্ত্রীর কাছে অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
তুমি জানলে কীভাবে? তুমি তো বিয়ে করো নি।
আমি বিয়ে না করলেও আমার মা বিয়ে করেছিলেন। মাকে দেখেছি বাবার দেয়া সামান্য দুগাছি সোনার চুড়ি তিনি কীভাবে সারাজীবন যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছেন।
সেই দুগাছি চুড়ি কোথায়?
ট্রাংকে তোলা আছে। মা বলে দিয়েছেন আমার বিয়ের দিন আমাকে এই দুগাছি চুড়ি পরতে হবে। কথা বলে সময় নষ্ট করছ। তুমি টেলিফোন রেখে চলে এসো। ঠিকানাটা মনে রেখ–চৌধুরী ক্লিনিক। আঠারো বি মালিবাগ। পেট্রোল পাম্পের গলি। মনে থাকবে?
থাকবে।
মতিন টেলিফোন রেখে লিখতে বসল। আজ লেখার মুড এসেছে। সবসময় এরকম আসে না।
নদ্দিউ নতিম বাড়ি ফিরলেন বিষণ্ণ হৃদয়ে। তিনি লেখার টেবিলে বসলেন। দুটা মোমবাতি জ্বালালেন। মনে মনে ভাবলেন, মোমবাতি দুটির একটি পুরুষ অন্যটি রমণী। এরা দুজন আলো জ্বেলে একে অন্যকে পথ দেখাচ্ছে। হঠাৎ পুরুষ মোমবাতির আলো নিভে গেল। এখন শুধু মেয়েটির আলো জ্বলছে। পুরুষ তাকিয়ে আছে আলোর রমণীর দিকে। নদ্দিউ নতিমের হৃদয়ে কবিতা ভর করল। তিনি লিখলেন তাঁর অতি বিখ্যাত কবিতা কে কথা কয়?
ক্লান্ত দুপুর, মধ্য রজনীতে
প্রথম সকাল প্রথম সন্ধ্যারাতে
কে কথা কয়
ফিসফিসিয়ে আমার কথার সাথে?
তাকে চিনি
সত্যি চিনি না-কি?
তাকে চেনার কতটুকু বাকি?
নাকি সে স্বপ্নসম ফাঁকি?
…
মতিন ফুঁ দিয়ে একটি মোমবাতি নিভিয়ে দিল। নদ্দিউ নতিম একটি মোমবাতি জ্বেলে কবিতা লিখেছেন। সে দুটি জ্বালাতে পারে না। ।
কাজি সাহেব রাত এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে চলে গেলেন। বাড়তি সময় বসিয়ে রাখার জন্য কাজি সাহেবকে আলাদা টাকা দিতে হলো। তাকে বাড়ি ফেরার ট্যাক্সি ভাড়া দিতে হলো।
হাবিবুর রহমান প্লাস্টিকের বাটিতে কাজি সাহেবের জন্যে খাসির মাংসের তেহারি দিয়ে দিলেন। তৌহিদার বিয়ে উপলক্ষে তিনি বাবুর্চি দিয়ে খাসির মাংসের তেহারি রান্না করিয়েছেন। কাজি সাহেব চলে যাবার আগমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ভেবেছেন মতিন তার মত বদলাবে। ট্যাক্সি করে বাসায় চলে এসে মাথা নিচু করে বলবে, সরি। হাবিবুর রহমানের মতে মতিন তার বোনের কাছে চিঠিটি লিখে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছে। তারপরেও সে চলে এলে তিনি তাকে ক্ষমা করতে প্রস্তুত ছিলেন।
তৌহিদা বিয়ের সাজ-পোশাক খুলে সাধারণ ঘরে পরার শাড়ি পরেছে। সাবান দিয়ে মুখ ধুয়েছে। চোখের কাজল পুরোপুরি যায় নি। দুটি চোখেই কাজল লেপ্টে তাকে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে।
তৌহিদার খুবই ক্ষিধে লেগেছিল। সে হাবিবুর রহমানের সঙ্গে সহজভাবেই খেতে বসল। সালেহা কিছু খাবেন না। তার শরীর ভয়ঙ্কর খারাপ করেছে। সন্ধ্যাবেলায় দুবার বমি করে তিনি নেতিয়ে পড়েছেন! গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না।
হাবিবুর রহমান তৌহিদার প্লেটে তেহারি তুলে দিতে দিতে বললেন, মন। খারাপ করিস না। বিয়েশাদি আল্লাহ পাকের হাতে। তিনি পাঁচটা জিনিস নিজের হাতে রেখেছেন, ধন-দৌলত, রিজিক, হায়াত, মউত এবং বিবাহ। যখন কারো বিয়ে ভেঙে যায় তখন বুঝতে হয় আল্লাহপাক চান না বিয়েটা হোক। বুঝেছিস?
তৌহিদা বলল, বুঝেছি ভাইজান।
হাবিবুর রহমান বললেন, যে সব মেয়ের বিয়ে ভেঙে যায় তাদের পরে খুবই ভালো বিবাহ হয় এটা পরীক্ষিত তোর ইনশাল্লাহ এমন বিয়ে হলে যে, অঞ্চলে সাড়া পড়ে যাবে। বুঝেছিস?
জি।
আর মতিনের জন্যে আমি কী ব্যবস্থা করে রেখেছি শুনে রাখ। তাকে যদি কানে ধরে আমি দশবার উঠবোস না করাই আমার নাম হাবিবুর রহমান না। আমার নাম হাবা রহমান। ভোতা দায়ে ধার উঠলে মারাত্মক ব্যাপার হয়। ভোতা দায়ে ধার উঠে না। একবার উঠে গেলে সর্বনাশ। চারিদিকে কাটাকাটি। আমি হলাম ভোতা দা। মতিনের কী অবস্থা হয় দেখ। দেখ আমি কী করি।
কিছু করতে হবে না ভাইজান।
অবশ্যই করতে হবে। আমি ছাড়ার পাত্র না। তৌহিদা শোন, তুই আজ একা ঘুমাবি না। তোর বুবুর সাথে ঘুমাবি। একা ঘুমাতে গেলে সারারাত ফুস ফুস করে কাঁদবি। এইসব চলবে না।
ভাইজান, কোনো সমস্যা নেই। আমি কাঁদব না।
গুড। ভেরি গুড। তেহারি কেমন হয়েছে বল?
ভালো হয়েছে।
ভালো তো হবেই, এক্সট্রা ঘি দিতে বলেছি।
তৌহিদা তার ঘরে ঘুমুতে গেল। এই ঘরেই বাসর হবার কথা ছিল। ঘর সামান্য সাজানো হয়েছে। তেমন কিছু না। বিছানার চারদিকে বেলিফুলের ঝালর। কিছু লাল-নীল বেলুন। বিছানার উপর গোলাপের পাপড়ি ছিটানো।
একা একা গোলাপের পাপড়ির উপর শুয়ে থাকার কোনো মানে হয় না। তৌহিদার খুবই ক্লান্তি লাগছে। এখন আর বিছানা ঝাড়তে ইচ্ছা করছে না। সে বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল আর তখনই শুনল কলিংবেল বাজছে। হাবিবুর রহমান বললেন, কে?
বাইরে থেকে মতিন বলল, দুলাভাই আমি।
কী চাও?
কী আশ্চর্য কথা দুলাভাই! আজ না আমার বিয়ে!
আমার সঙ্গে ফাজলামি কর? একঘণ্টা আগে কাজি চলে গেছে।
দরজাটা খুলুন দুলাভাই।