মানুষটা ঘরে ঢুকছে। সে বসে আছে খাটে। সে তাকিয়ে আছে অন্যদিকে, কিন্তু লক্ষ রাখছে লোকটা কী করছে। লোকটা দরজা বন্ধ করে তার দিকে তাকাল। সে তখন হাই তুলতে তুলতে এবং সামান্য পা নাচাতে নাচাতে বলল, অ্যাই, কয়টা বাজে একটু দেখ তো!
লোকটা থতমত খেয়ে ঘড়ি দেখে বলল, এগারোটা।
সে তখন বলবে, সর্বনাশ, এত রাত হয়ে গেছে। কাল সারারাত আমার ঘুম হয় নি। আজ না ঘুমালে শরীর খারাপ করবে। ভয় নেই, বেশিক্ষণ ঘুমাব না। দুঘণ্টা ঘুমাব। তুমি ঘড়ি হাতে আমার পাশে বসে থাকবে। দুঘণ্টা পর আমাকে ডেকে দেবে। তখন আমরা গল্প করব। পারবে না?
লোকটা বিস্মিত গলায় বলবে, পারব।
এখন তুমি পাঁচ মিনিট চোখ বন্ধ করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাক। সকাল থেকে বেনারসি শাড়ি পরে আছি, গরমে ঘেমে যাচ্ছি। আমি শাড়ি বদলাব। তাকাও অন্যদিকে। চোখ বন্ধ। খবরদার, আমি না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবে না। Good boy.
লোকটা চোখ বন্ধ করে বসে আছে। সে শাড়ি বদলাচ্ছে। শাড়ি বদলাতে বদলাতে হালকা মেজাজে গল্প করছে, অ্যাই শোন, তোমার এক বান্ধবী আছে না, নিশু না-কি শিশু নাম। ওকে একদিন খবর দিয়ে এনো তো।
লোকটা বলবে, কেন?
সে বলবে, আমি ঐ শাকচুন্নিটার দুই গালে দুটা থাপ্পড় দেব।
এইসব কী ধরনের কথা বলছ?
আমার কথা শুনতে ভালো লাগছে না, ঐ শাকচুন্নির কথা শুনতে ভালো লাগছে? যাও তাহলে আর কথা বলব না। এখন চোখ খোল।
লোকটা চোখ খুলে হয়ে যাবে হতভম্ব। কারণ সে গা থেকে বেনারসি শাড়ি ঠিকই খুলেছে, তবে অন্য শাড়ি পরতে ভুলে গেছে।…
চিন্তাটা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। খারাপ দিকে। তৌহিদার গা ঝিমঝিম করছে। শরীর কাঁপছে। আচ্ছা সে কি খুব খারাপ মেয়ে? সে এত খারাপ মেয়ে। কীভাবে হয়ে গেল! সে বিছানা থেকে নামল। একগ্লাস পানি খাবে। মাথার তালুতে সামান্য পানি দেবে।
রান্নাঘরের দিকে যাবার আগে সে সালেহার ঘরে উঁকি দিল। সালেহা পা। ছড়িয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসা। তার দৃষ্টি স্থির। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। তৌহিদা বলল, বুবু, আপনার কি শরীর খারাপ?
সালেহা অস্পষ্টভাবে বললেন, হুঁ।
পায়ে তেল মালিশ করে দেব?
না।
পানি খাবেন? একগ্লাস পানি এনে দেই?
না।
সালেহা ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। তার ধারণা যে-কোনো সময় তার নিঃশ্বাস আটকে যাবে। তার হাতের মুঠিতে একটা কুঁচকানো কাগজ। মতিনের লেখা চিঠি। মতিন লোক দিয়ে এই চিঠি তার দুলাভাইয়ের ফার্মেসিতে পাঠিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে ফার্মেসির সেলসম্যান এসে চিঠি দিয়ে গেছে। মতিন লিখেছে–
আপা,
আমি বিয়েটা করতে পারব না! আমি বিয়ে করা টাইপ পুরুষ না। পাকেচক্রে রাজি হয়ে বিরাট ঝামেলা করে ফেলেছি। আমি তৌহিদার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।
মতিন
মেইন গ্রিডে কোথাও কোনো সমস্যা হয়েছে। সন্ধ্যা থেকে ঢাকা শহরে ইলেকট্রিসিটি নেই। অন্ধকারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঝড়-বৃষ্টি। বৃষ্টি দুপুর থেকেই পড়ছিল। বৃষ্টির সঙ্গে ঝড় যুক্ত হয়েছে সন্ধ্যার পর। মতিন মোমবাতি কিনে এনেছে। তার টেবিলে দুটি মোমবাতি। সে কাগজ-কলম নিয়ে বসেছে। নদ্দিউ নতিমকে নিয়ে নতুন প্রবন্ধে হাত দিয়েছে। প্রবন্ধের শিরোনাম–
নদ্দিউ নতিমের ব্যক্তিগত জীবন
প্রথম বিবাহ বিষয়ক জটিলতা
এই প্রবন্ধে নদ্দিউ নতিম বিয়ের আসর থেকে হঠাৎ কী কারণে উঠে আসেন এবং সেই রাতেই পর পর তিনটি দীর্ঘ কবিতা লিখেন তার বর্ণনা আছে। নদ্দিউ নতিমকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি কেন বিয়ের আসর থেকে উঠে এলেন? তিনি জবাব দিলেন, এক স্ত্রী থাকলে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ বৈধ না। কবিতা আমার স্ত্রী ও প্রণয়িনী। যেদিন থেকে আমার জীবনে কবিতা থাকবে না শুধু সেদিনই আমি দ্বিতীয় বিবাহ নিয়ে চিন্তা করব।
মতিনকে আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে। বিয়ে উপলক্ষে সে চুল কাটিয়েছে। চুলে শ্যাম্পু দিয়েছে। তার গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি। মোমের আলোতে পাঞ্জাবি চকচক করছে।
প্রবন্ধের শুরুতেই নিশুর টেলিফোন। মতিন টেলিফোন ধরল।
হ্যালো, তোমাদের ওদিকে কি ঝড় হচ্ছে?
মতিন বলল, ঝড় না হলেও বাতাস হচ্ছে। জানালা খটখট করছে।
আজ তো তোমার বিয়ে?
হুঁ।
আমি বলেছিলাম তোমার বিয়েতে থাকব! থাকতে পারছি না।
অসুবিধা নেই।
কেন থাকতে পারছি না জানতে চাইলে না?
থাকতে পারছ না এটাই বড় কথা। কারণ জেনে কী হবে! যুদ্ধে কামান দাগা হয় নি এটাই মুখ্য। কেন দাগ হয় নি এটা গৌণ।
বিয়ে কোনো কামান দাগাদাগি না। মতিন শোন, আমি তোমার বিয়েতে যেতে পারছি না, কারণ বাবাকে ক্লিনিকে ভর্তি করিয়েছি।
কেন?
উনার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। শেষে এমন হলো নিঃশ্বাস নিতে পারেন না।
এখন কী অবস্থা?
এখন অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছেন। মতিন শোন, তোমার স্ত্রীর জন্যে আমি একটা উপহার কিনে রেখেছি। গলার এবং কানের একটা সেট।
গলার এবং কানের সেট মানে কী?
গয়না।
সোনার গয়না?
গয়না তো সোনারই হবে।
দাম কত?
উপহারের দাম এবং চাকরির বেতন জিজ্ঞেস করতে হয় না, এটা জানো।?
জানি। কৌতূহল সামলাতে পারছি না।
উনিশ হাজার সাতশ টাকা।
কী সর্বনাশ, এত দাম!
সেটের অনেক দাম হয়, এটা মোটামুটি কম দাম। বাবা টাকাটা আমাকে দিয়েছেন। উনি চাচ্ছিলেন তোমার বিয়েতে যেন দামি কিছু দেয়া হয়। বাবা যে তোমাকে আমার চেয়ে অনেক বেশি পছন্দ করেন, এটা তুমি জানো?
জানি। বরযাত্রী কখন রওনা হবে?
ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে তো, টাইম ঠিক থাকবে বলে মনে হয় না। দেরি হতে পারে।