বাবার পাশে বসার জন্যে। আমাকে ঘণ্টা তিনেকের জন্যে বের হতে হবে। এই ঘণ্টা তিনেক তুমি বাবার সঙ্গে থাকবে। আমি কেন সাজগোজ করেছি সেই রহস্য কি পরিষ্কার হয়েছে?
মতিন কিছু বলল না। নিশু বলল, নিজেকে স্মার্ট ভেব না। তুমি স্মার্ট না। তুমি অ্যাভারেজ IQ-এর একজন অ্যাভারেজ মানুষ। I am not.
নিশু খাবার টেবিল থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, দয়া করে থালাবাসন ধুয়ে দিয়ে যাও। বাবার কাছে একটু বসো। আমার দেরি হয়ে গেছে। এক্ষুনি বের হবো।
কোথায় যাচ্ছ?
That’s none of your business.
মতিন আজিজ সাহেবের ঘরে বসে আছে। একটু আগে তাঁর জ্বর মাপা হয়েছে। জ্বর একশ তিন পয়েন্ট ফাইভ। তিনি ঝিম ধরে আছেন। টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছেন। শ্বাস নেবার ভঙ্গি বলে দিচ্ছে তার সামান্য হলেও শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তিনি মতিনের দিকে ফিরে চাপা গলায় বললেন, নিশু কোথায় গেছে তুমি জানো?
মতিন না-সূচক মাথা নাড়ল।
তার কাজ কারবার কিছুই বুঝি না। সে কোথায় যায় কী করে তাও বুঝি। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমি মেয়েটার মাথায় বোঝার মতো চেপে আছি।
মতিন বলল, নিজেকে সিন্দাবাদের দৈত্য মনে হয়?
ঠিক বলেছ, সিন্দাবাদের দৈত্য। ঘাড়ে চেপে বসেছি, আর নামব না। বুঝেছ। মতিন, আমরা সবাই কোনো-না-কোনো অর্থে সিন্দাবাদের দৈত্য। এর তার ঘাড়ে চেপে আছি।
চাচাজি, আপনি কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে থাকুন। আমি আপনার মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করছি।
পানি ঢালার ব্যবস্থা করতে হবে না। তুমি যেখানে বসে আছ সেখানে বসে থাক। তোমার সঙ্গে গল্প করি। আমার গল্প করার লোক নেই। আমার মেয়ে আমার সঙ্গে গল্প করে না। সে আছে তার জগৎ নিয়ে। ভালো কথা, শুনলাম তুমি বিয়ে করছ?
জি।
বেকার ছেলেদের বিয়ের ব্যাপারে খুব উৎসাহ থাকে। বিয়ের কথা শুনলেই তারা এক পায়ে খাড়া। বিয়ের পর সে বউকে কী খাওয়াবে এই নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তুমি আবার আমার কথায় কিছু মনে করো না।
আমি কিছু মনে করছি না।
মেয়ের নাম কী?
তার নাম তৌ।
তৌ আবার কেমন নাম!
আসল নাম তৌহিদা। আমি শর্ট করে তৌ ডাকি।
শর্ট করে ডাকার দরকার কী?
সামান্য ঢং করছি।
বুঝতে পারছি। বেকার ছেলেরা ঢং ঠাট্টা তামাশায় একনম্বর। আসল কাজে লবডঙ্কা। লবডঙ্কা শব্দের মানে জানো?
জানি।
বলো, মানে বলো।
লব শব্দের মানে ছিদ্র। ছেদন। লবডঙ্কা মানে ছিদ্র হওয়া ঢোল। ছিদ্র করা ঢেলে কোনো শব্দ হয় না।
তুমি তো বাংলা ভালো জানো। বেকার ছেলেরা অপ্রয়োজনীয় বিষয় ভালো জানে। কাজ চলবার মতো বাংলা জানলেই তোমার চলত। চলত কি-না?
জি চলত।
মতিন, আমার নিঃশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে।
আপনাকে দেখে বুঝতে পারছি। জানালা খুলে দেই।
না। জানালা বন্ধ থাকুক। নিজেকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা করছে। তোমার কাছে। সিগারেট আছে? সিগারেট থাকলে ধরিয়ে আমার হাতে দাও। শ্বাসকষ্টের মধ্যে সিগারেট, এতে কষ্টটা আরো বাড়বে। নিজেকে কষ্ট দেয়ার মধ্যেও আনন্দ। আছে। বুঝেছ? নিজেকে কষ্ট দিতে চাচ্ছি।
চাচাজি, আমার কাছে সিগারেট নেই। আপনি চাইলে এনে দিতে পারি।
দরকার নেই, তুমি এখানে বসে থাক। তুমি বেকার মানুষ। তোমার ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকায় তো কোনো সমস্যা নেই।
জি-না, সমস্যা নেই।
এক থেকে দশের ভেতর একটা সংখ্যা বলো।
পাঁচ।
আজিজ সাহেব হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, বোকা ধরনের মানুষদের যদি এক থেকে দশের ভেতর কোনো সংখ্যা ধরতে বলা হয় সে মাঝখানেরটা ধরে। সে কখনো এক ধরে না বা দশ ধরে না। তুমি একজন বোকা মানুষ। বোকা এবং বেকার, সংক্ষেপে হলো বোবে। ইংরেজিতে হবে BB.
মতিন থার্মোমিটার হাতে নিল। মানুষটা ভুল বকতে শুরু করেছে। তার জ্বর আবার দেখা দরকার।
মতিন।
জি চাচাজি।
জানালা দরজা সব খুলে দাও। নিঃশ্বাসের কষ্টটা বাড়ছে।
মতিন জানালা খুলল! বৃষ্টি খুব বেড়েছে। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট টুকছে। আজিজ সাহেব হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। তার বুক হাপরের মতো ওঠা-নামা করছে। চোখ রক্তবর্ণ।
তৌহিদা নিজের ঘরে বসে আছে। তার গায়েহলুদ হয়ে গেছে। হলুদের মান ও সম্পন্ন। হলুদ স্নান মনে হয় ভালো হয় নি। গা থেকে কাঁচা হলুদের গন্ধ আসছে। গন্ধটা তৌহিদার ভালো লাগছে। গন্ধটার মধ্যেই যেন একধরনের রহস্য।
গায়েহলুদের বাড়িতে লোকজন থাকবে, হৈচৈ হবে। গান বাজনা হবে। সরকম কিছুই হচ্ছে না। তৌহিদা তার কলেজের কোনো বান্ধবীকে কিছু বলে নি। তার লজ্জা লাগছিল, বান্ধবীরা এসে দেখবে ফকির ফকির গায়েহলুদ। তারা হাসাহাসি করবে। দরকার কী? তার নিরিবিলি গায়েহলুদই ভালো। নিরিবিলি গায়েহলুদ নিরিবিলি বিয়ে। তার মন বলছে একদিন তার অনেক টাকা-পয়সা হবে। নিজের ফ্ল্যাট বাড়ি থাকবে। লাল রঙের একটা গাড়ি থাকবে। তার ছেলেমেয়েরা গাড়িতে করে স্কুলে যাবে। তখন সে বড় বড় অনুষ্ঠান করবে। ছাদে শামিয়ানা খাঁটিয়ে বড় মেয়ের জন্মদিন। কিংবা তাদের ম্যারেজ ডে।
এই যে সে এখন জানালার পাশে বসে বৃষ্টি দেখছে তার তো মোটেও খারাপ লাগছে না। বরং ভালো লাগছে। একা আছে বলেই সে সুন্দর সুন্দর চিন্তা করতে পারছে। বিয়ের রাতে সে কী করবে এটা নিয়ে সে অনেকবার ভেবেছে। একেকবার একেকরকম করে ভেবেছে। আজ আবার ভাববে। আজকের ভাবনাটা হবে আরেকরকম। তৌহিদা ভাবতে বসল। সে ঠিক করল বিয়ের রাতে সে জবুথবু হয়ে থাকবে না। লজ্জায় নুয়ে পড়া লবঙ্গ লতিকা না। সে ফুটফট করে। কথা বলবে যেন মানুষটা চমকে যায় এবং ভাবে এই মেয়ে তো মুখ ফুটে একটা কথাও বলত না। আজ এমন ফটফট করছে কেন? ব্যাপার কী?