ব্যারিস্টার সাহেব কোনো কথা বললেন না। কথা শুরু করলেন তাঁর স্ত্রী।
Autistic children এই বিষয়টি সম্পর্কে আপনি পরিচিত?
মতিন জবাব দেবার আগেই ব্যারিস্টার সাহেব বললেন, মুনা, এটা সে জানে না। তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে।
মতিন বলল, স্যার, এখন আমি জানি। এটা শিশুদের একধরনের মানসিক পীড়া।
মুনা বললেন, আমাদের একটাই ছেলে। বয়স টেন প্লাস। সে Autistic child. আমরা তার জন্যে একজন সার্বক্ষণিক সঙ্গী খুঁজছি। পত্রিকার বিজ্ঞাপনে এই বিষয়টি আমরা অবশ্যি ব্যাখ্যা করি নি।
মতিন সামান্য হকচকিয়ে গেল। পত্রিকার বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছিল–একজন সার্বক্ষণিক টিউটর প্রয়োজন। টিউটরের সৃজনশীলতা বিশেষ যোগ্যতা হিসেবে ধরা হবে। বেতন আকর্ষণীয়।
তার কোনোরকম সৃজনশীলতা আছে বলে সে মনে করে না। অবশ্যি একটি দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় তার দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধের বিষয় উজবেক কবি নদ্দিউ নতিমর কাব্যভাবনা। খুবই খটমটে ধরনের প্রবন্ধ। চাকরির দরখাস্তের সঙ্গে দুটি প্রবন্ধের ফটোকপিও সে দিয়ে দিয়েছে। তাকে ইন্টারভিউতে কেন ডাকা হয়েছে সে বুঝতে পারছে না। মানসিক প্রতিবন্ধী একটি শিশুর সঙ্গে উজবেক কবি নতিমের কাব্যভাবনার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না।
ব্যারিস্টার সাহেব এইবার কথা বললেন। এই ভদ্রলোকের গলার স্বর ভারি। তিনি থেমে থেমে প্রতিটি শব্দ আলাদা উচ্চারণ করে কথা বলেন। শুনতে ভালো লাগে।
মতিন সাহেব!
জি স্যার।
আপনি যদি টিউটরশিপটা নিতে রাজি হন, আপনাকে এখানেই থাকতে হবে। তার মানে এই না যে, দিনরাত চব্বিশঘণ্টা আপনাকে এ বাড়িতেই থাকতে হবে। অবশ্যই আপনি আপনার নিজস্ব কাজকর্ম করবেন। তবে আশা করব রাতটা এখানে কাটাবেন। আমরা আপনাকে মাসে পনেরো হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি আছি। টাকার পরিমাণটা কি ঠিক আছে?
মতিন হড়বড় করে বলল, জি ঠিক আছে। আপনারা কি এই চাকরিটা আমাকে দিচ্ছেন?
ব্যারিস্টার সাহেব বললেন, চাকরি ভাবা ঠিক হবে না। আমি আমার ছেলের জন্যে একজন সৃজনশীল সঙ্গী খুঁজছি। আমি আপনার দুটি প্রবন্ধই খুব মন দিয়ে পড়েছি। কবির কবিতার ব্যাখ্যা আপনি সুন্দর দিয়েছেন।
মতিন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, স্যার, আপনাকে একটা কথা বলা দরকার। কথাটা আপনি কীভাবে নেবেন আমি জানি না। দুটি প্রবন্ধই ভুয়া।
ভুয়া মানে?
মতিন বলল, নদ্দিউ নতিম নামে উজবেকিস্তানের কোনো কবি নেই। পুরোটাই আমার বানানো। ফাজলামি করে লেখা। নদ্দিউ নতিম উল্টালে হবে মতিন উদ্দিন। আমিই সেই মতিন উদ্দিন।
ব্যারিস্টার সাহেব তার স্ত্রীর সঙ্গে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। ব্যারিস্টার সাহেবের স্ত্রীর ঠোঁটে ক্ষীণ হাসির রেখা দেখা গেলেও তিনি সঙ্গে সঙ্গে তা মুছে ফলে গম্ভীর হয়ে গেলেন। ব্যারিস্টার সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, এই কাজটা কেন করেছেন জানতে পারি?
মতিন বলল, পত্রিকাওয়ালারা নতুনদের গল্প, কবিতা কিছুই ছাপায় না। তবে বিদেশী কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে লেখা ভারি ভারি প্রবন্ধ আগ্রহ করে ছাপায়। টাকাও দেয়।
নদ্দিউ নতিমের কবিতাগুলি আপনার লেখা?
জি-না। কবিতাগুলি নিশুর লেখা। আমি কবিতা লিখতে পারি না।
নিশু কে?
আমার ক্লাসমেট ছিল। খুবই ভালো ছাত্রী। এখন পিএইচডি করতে লন্ডনের এবারডিন ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে।
মুনা বললেন, নিশু ছেলে না মেয়ে?
মেয়ে।
আপনার প্রেমিকা?
জি-না, সাধারণ বান্ধবী। সে আমার প্রেমিকা হবে এত যোগ্যতা আমার নেই।
আপনার ধারণা আপনি খুবই সাধারণ?
জি।
ব্যারিস্টার সাহেবের স্ত্রী বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি যেতে পারেন। আপনি কষ্ট করে এসেছেন, আপনার সময় নষ্ট হয়েছে, তার জন্যে আমরা দুঃখিত।
আমাকে আপনারা নিচ্ছেন না?
মুনা বললেন, না। আপনি বুদ্ধিমান, কিন্তু ডিসঅনেস্ট। একজনের চরিত্রে যখন ডিসঅনেস্টি থাকে তখন সেই ডিসঅনেস্টি নানানভাবে প্রকাশ পায়। Autistic children-রা এই বিষয়টা চট করে ধরে ফেলে। তারা Revolt করে। তখন তাদের মানসিক সমস্যা তীব্র হয়। অ্যাপিলেপটিক অ্যাটাক হয়। আমি আমার বাচ্চার মঙ্গল চাই। অমঙ্গল চাই না। আপনি কিছু মনে করবেন না।
আমি কিছু মনে করছি না।
মাসে পনের হাজার টাকা হাতের আঙুলের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে গেছে। তার জন্যে মতিনের তেমন খারাপ লাগছে না। বরং তার খানিকটা স্বস্তি লাগছে। মানসিক প্রতিবন্ধী একজনের সঙ্গী হওয়া জগতের প্রিয় কাজের একটি হতে। পারে না। মতিনের চোখের সামনে ভাসছে মাথা মোটা একটা ছেলে থপথপ। করে আসবে। হু হু করে চিৎকার করবে। যখন চিৎকার করবে তখন মুখ দিয়ে। লালা পড়বে। মতিনকেই টিস্যু পেপার দিয়ে মুখের লালা পরিষ্কার করতে হবে। কিছুই বলা যায় না, সেই ছেলে তখন তার হাত কামড়ে ধরতে পারে। মতিন। আনন্দ নিয়েই উঠে দাঁড়াল। মুনার দিকে তাকিয়ে বলল, ম্যাডাম, উঠি?
বেলা এগারোটা। দিনের সবে শুরু। ব্যারিস্টার সাহেবের রোজ ভ্যালি নামক বিশাল বাড়ি থেকে বের হয়ে মতিনের মন আরো ভালো হয়ে গেল। আকাশ মেঘলা। দিনের আলোতে কোমল ভাব। জ্যৈষ্ঠের শেষ। আষাঢ় এখনো শুরু হয় নি। তবে আসি আসি করছে। যে-কোনোদিন শুরু হয়ে যাবে। সেই দিনটা আজও হতে পারে। মতিন শব্দ করেই আওড়াল–
সুর করি বারবার পড়ি বর্ষা অভিসার
অন্ধকার যমুনার তীর…
বাকি লাইনগুলি আর মনে আসছে না। এই সমস্যাটা তার ইদানীং হচ্ছে। কবিতার লাইন মনে আসছে না। অতি পরিচিত মানুষদের নাম ভুলে যাচ্ছে। সে নিজেও কি মানসিক প্রতিবন্ধীদের একজন হয়ে যাচ্ছে? কিছুদিন পর মুখ দিয়ে লালা পড়বে। হুঁ হুঁ করবে। বন্ধু-বান্ধবদের হাতে কামড় দেবে। বিচিত্র কিছুই না।