কমল ফিরছে না। তাকে উল্টো করে ফিরে এসো বলা দরকার। তখন হয়তো বুঝবে। মতিন প্রাণপণে চেঁচালো, সোএ রেফি! সোএ রেফি! লমক সোএ রেফি। কমল ফিরে এসো।
মতিনের ঘুম ভেঙে গেল।
তার বুক ধড়ফড় করছে। ঘামে সারা শরীর ভেজা। তৃষ্ণায় ফুসফুস ছোট হয়ে গেছে এমন অবস্থা। মতিন ভীত গলায় বলল, পানি খাব। কেউ তার কথা শুনল না। চারদিকে অস্বাভাবিক নীরবতা। ফার্মেসির কর্মচারীদের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে না। এমন কি হতে পারে তার স্বপ্ন এখনো ভাভে নি? এখনো সে স্বপ্ন দেখে যাচ্ছে। খোলা দরজা দিয়ে দৈত্যটা আবার ঢুকবে।
তার স্বপ্নে মাঝে মাঝে এই ব্যাপারটা ঘটে। স্বপ্নের মধ্যেই মনে হয় স্বপ্ন শেষ হয়েছে। সে জেগে উঠেছে, অথচ স্বপ্ন তখনো চলছে।
সে যে সত্যি জেগেছে তার প্রমাণ কী? গায়ে চিমটি কেটে দেখবে? পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরাবে? জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে গায়ে ছ্যাকা দেবে?
মতিন পকেটে হাত দিল। পকেট থেকে বের হলো হলুদ রঙের খাম। যামের মুখ বন্ধ। খাম এখনো খোলা হয় নি। উপরে লেখা করিয়ার সার্ভিস। প্রেরক আশরাফ। আশরাফ তাকে চিঠি পাঠিয়েছে, সে না পড়ে পকেটে নিয়ে ঘুরছে, তা হয় না। অবশ্যই এটা স্বপ্ন। তবে খামের উপর কুরিয়ার সার্ভিস লেখা এবং একটা নাম্বার লেখা। স্বপ্নে এত ডিটেল থাকার কথা না।
মতিন, ঘুম ভেঙেছে?
হাবিবুর রহমান ঘরে ঢুকলেন। তার হাতে চায়ের কাপ। তিনি চায়ের কাপ। বিছানার পাশে রাখতে রাখতে বললেন, চা খাও।
মতিন বলল, কয়টা বাজে?
সন্ধ্যা ছয়টা। তুমি তো ম্যারাথন ঘুম দিয়ে দিলে। ঘুম আরামের হয়েছে?
ঘুম আরামেরই হয়েছে, তবে আরো কিছুক্ষণ ঘুমাব। আপনার ফার্মেসি নয়টার সময় বন্ধ হয় না? আপনি আপনার কর্মচারীদের বলে দিয়ে যান তারা যেন আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তারপর দোকান বন্ধ করে।
তুমি সত্যি সত্যি আবার ঘুমাবে?
হ্যাঁ। একটা মোমবাতি দিতে পারবেন?
মোমবাতি দিয়ে কী করবে?
আমার বন্ধুর একটা চিঠি এসেছে। তার চিঠি মোমবাতি জ্বালিয়ে পড়তে হয়। ইলেকট্রিকের আলোয় পড়া যাবে না।
হাবিবুর রহমান বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন?
ও থাকে নাইক্ষ্যংছড়ি নামের একটা জায়গায়। গহীন বন। তার ওখানে ইলেকট্রিসিটি নেই। সে মোমবাতির আলোয় চিঠি লেখে।
সে মোমবাতির আলোয় চিঠি লেখে বলে তোমাকেও মোমবাতির আলোতে চিঠি পড়তে হবে?
মতিন হাই তুলতে তুলতে বলল, হ্যাঁ। কবি নদ্দিউ নতিমের একটি কাব্যগ্রন্থ আছে নাম দুপুরের শিশির। এর কবিতাগুলি তিনি মশাল জ্বেলে মশালের আগুনে লিখেছিলেন। সেই কারণে তার কবিতা পড়তে হয় মশাল জ্বেলে।
ঢাকা শহরে তুমি মশাল পাবে কোথায়?
মতিন বলল, এইখানেই তো সমস্যা। মশালের অভাবে উনার দুপুরের শিশির কাব্যগ্রন্থটা পড়া হয় নি।
তোমার কাজকর্ম এবং কথাবার্তার বেশির ভাগই আমি বুঝি না। তোমার যে বন্ধু জঙ্গলে থাকে সে-ই কি প্রতিমাসে তোমাকে টাকা পাঠায়?
হ্যাঁ। মোমবাতি এনে দিন তো দুলাভাই, চিঠিটা পড়ি। দুদিন ধরে এই চিঠি পকেটে নিয়ে ঘুরছি। মোমবাতির অভাবে পড়তে পারছি না। চিঠির কথা ভুলেও গিয়েছিলাম। ভাগ্যিস দৈত্যকে দেখে ভয় পেয়ে পকেটে হাত দিয়ে চিঠির সন্ধান পেয়েছি। দৈত্য না দেখলে চিঠি পড়তে আরো দেরি হতো।
হাবিবুর রহমান দৈত্যের কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলেন না। জিজ্ঞেস করলেই আরো কিছু উদ্ভট কথা শুনতে হবে। দরকার কী!
চিঠিতে আশরাফ লিখেছে–
হ্যালো মতিন,
তোর চিঠি পেয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়া হয় নি। ট্রি হাউস বানানোয় ব্যস্ত ছিলাম। প্রায় এক মাসের পরিশ্রমে দেখার মতো একটা ট্রি হাউস বানিয়েছি। রেইনট্রি গাছের উপর বাসা। দড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। টু বেডরুম ফ্ল্যাট বলতে পারিস। বারান্দাও আছে। বারান্দাটা বেশ বড়। ওয়াল্ট ডিজনীর সুইস ফ্যামিলি রবিনসনে যে ট্রি হাউস আছে আমারটা তার কাছাকাছি। তুই দেখলে খুবই মজা পাবি।
তোকে বলেছিলাম না একটা পাহাড়ে কলার চাষ করেছি। এই প্রজেক্ট কাজ করে নি। কলা ভালো হয় নি। কলার কারণে দুনিয়ার বাঁদর এসে উপস্থিত হয়েছে। বদররা আমার কলাবাগান তছনছ করে বিদায় হয়েছে, তবে দুটা রয়ে গেছে। তারা আমার লগ হাউসের আশেপাশে থাকে। দূর থেকে আমাকে অনুসরণ করে। আমি যখন নদীতে গোসল করতে যাই এরা আমার পেছনে পেছনে আসে। আমি বাঁদর দুটির নাম দিয়েছি। একটার নাম মাসি, আরেকটার নাম পিসি।
দুটিই মেয়ে বাঁদর বলে এই নামকরণ। দুটি মেয়ে বদর একসঙ্গে জোট বাঁধল কেন বুঝতে পারছি না। বাদর দুটি টের পেয়েছে যে তাদের নাম আছে। তারা ডাকলে সাড়া দেয়, তবে আমার খুব কাছে আসে না।
তুই শুনলে খুশি হবি যে, আমি শঙ্খ নদীর পাড় ঘেষে আরো সত্তর একরের মতো জমি নব্বই বৃছরে জন্যে লিজ নিয়েছি। এখানে আমি কফি বাগান করব। আমাকে যা করতে হবে তা হলো ভালো জাতের কফি গাছের চারা। জোগাড় করা।
আমি ভালোই আছি। সুখে আছি। বিশাল জায়গায় মহারাজার মতো ঘুরে বেড়ানোয় আনন্দ আছে। পাহাড়ি লোকজন আমাকে তেমন অপছন্দ করে বলে মনে হয় না। এক মুরং হেডম্যানের সঙ্গে আমার ভালো সখ্য হয়েছে। তাকে আমি জানিয়েছি যে, আমার ইচ্ছা একটা পাহাড়ি মেয়ে। বিয়ে করা। সে যেন পাত্রী খুঁজে দেয়।
মতিন, আমি কিন্তু ঠাট্টা করছি না। ঢাকা শহরের চটপটি খাওয়া এবং পিৎজা খাওয়া কোনো মেয়ে জঙ্গলে এসে থাকতে পারবে না। আমার প্রয়োজন পাহাড়ি মেয়ে। যে আমার মতোই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কঠিন পরিশ্রম করবে।