হাবিবুর রহমান তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, হবে না কেন? এই বিষয়ে তোমার কি কোনো Second thought আছে?
মতিন বলল, আমার কোনো Second thought নেই, তৌহিদার তো থাকতে পারে। শেষ মুহূর্তে সে যদি মনে করে, বেকার ছেলে বিয়ে না করে ব্যাংকার বিয়ে করা ভালো, তখন যেন হাতে Option থাকে।
এটা খারাপ বলো নাই।
মতিন বলল, দুলাভাই, আপনি কিছু মনে না করলে খাট থেকে নামুন। চক্ষণ ঘুমাব। শীতলপাটি দেখে ঘুমুতে ইচ্ছা করছে। আমি আপনার এই ঘরটার একটা নাম দিলাম! ঘুম-ঘর।
ঘর অন্ধকার। মাথার উপর সিলিং ফ্যান। বাইরে মেঘলা দিন। বাতাস আর্দ্র ও শীতল। ঘুমুবার জন্যে আদর্শ ব্যবস্থা। মতিনের ঘুম আসছে না। সে এপাশ এপাশ করছে। সে অনেকবার লক্ষ করেছে, আয়োজন করে ঘুমাতে গেলেই তার ঘুম আসে না। তখন নদ্দিউ নতিম সাহেব ভর করেন। মাথার ভেতর এলোমেলো শব্দ নাচানাচি করে। এখন যেমন ঘুম-ঘর মাথায় ঘুরছে–
ঘুম-ঘরে শুয়ে আছি
ঘুম ঘুম চোখে–ডিঙ্গি বাই।
সিলিং-এ সিলিং ফ্যান ঘুম গান গায়–
শীতলপাটিটি ছিল ঘুমের নদীতে
আমার হৃদয়ে তবু কোনো নিদ্ৰা নাই–।।
অর্থহীন লাইন। এর হাত থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়, কারো সঙ্গে কথা বলা। মুখোমুখি কথা না, টেলিফোনে কথা। মুখোমুখি কথা বলা পরিশ্রমের কাজ। তখন যার সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে তার মুখের ভাব, চোখের ভাবের প্রতি লক্ষ রাখতে হয়। তার বডি ল্যাংগুয়েজ পরীক্ষা করতে হয়। সামনা সামনি কথা বলা মানে জটিল ভাইবা পরীক্ষা দেয়া। এরচে টেলিফোন নিরাপদ। কোনো এক পর্যায়ে কথাবার্তা যদি আর চালাতে ইচ্ছা না করে তাহলে লাইন কেটে দিলেই হলো। পরে দেখা হলে বলা, ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে চার্জার ছিল না। মোবাইল টেলিফোন আমাদের দ্রুত মিথ্যাবাদী বানাচ্ছে।
হ্যালো নিশু।
হুঁ।
কী করছ?
আমি কী করছি সেটা ইম্পোর্টেন্ট না। তুমি কী করছ?
আমি ঘুম-ঘরে শুয়ে আছি।
কী বলতে চাও পরিষ্কার করে বলো। ঘুম-ঘর মানে কী?
আমার দুলাভাই তার ফার্মেসির পেছনে একটা ঘুম-ঘর বানিয়েছেন। অত্যন্ত আরামদায়ক ব্যবস্থা। ঘরে পা দিলেই ঘুম এসে যায় বলে আমি ঘরের নাম দিয়েছি ঘুম-ঘর।
খুব ভালো। ঘুম-ঘরে শুয়ে ঘুমাও। যদি কখনো ঘুম ভাঙে বাবার সঙ্গে দেখা করো। বাবা কোনো একটা জরুরি বিষয় নিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলবেন।
জরুরি বিষয়টা কী তুমি জানো?
জানি, কিন্তু বাবার কাছ থেকেই শোন।
ভালো কথা, তোমার বিয়ের পাত্র কি পাওয়া গেছে?
পাওয়া গেছে। যে-কোনো একদিন বিয়ে করে ফেলব। বাবা ধুমধাম করতে চাচ্ছেন। আমি বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করছি–ধুমধামে টাকা নষ্ট করা। অর্থহীন।
মানব সভ্যতা বিকাশের প্রধান কারণ কিন্তু অর্থহীন কর্মকাণ্ডের প্রতি মানুষের প্রবল আগ্রহ।
জ্ঞানের কোনো কথা তোমার কাছে শুনতে আমি রাজি না। তুমি জ্ঞানী না। তুমি মূর্খদের একজন।
মানলাম। ঘুম-ঘর নিয়ে কয়েক লাইন কবিতা লিখেছি–শুনবে?
না। আমি তোমার জন্যে কিছু কাগজপত্র জোগাড় করেছি। বাবার কাছে রাখা আছে। উনার কাছ থেকে নিয়ে নিও।
কী কাগজপত্র?
তুমি Autistic children সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলে, সেই বিষয়ের কাগজপত্র।
আমি তোমার কাছে কোনো কাগজপত্র চাই নি। তারপরেও তোমাকে ধন্যবাদ।
আমি পেপারগুলি পড়েছি। Autistic children-দের কিছু বিষয় আমার কাছে দারুণ ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে। যেমন ধর, ওরা হাসে না।
তাই না-কি?
হ্যাঁ, ওরা হাসে না। একটা সেকেন্ড টেলিফোনটা ধরে রাখ, ওদের বিষয়ে সবচে ইন্টারেস্টিং জিনিসটা তোমাকে পড়ে শুনাই।
দরকার নেই। অবশ্যই দরকার আছে। শোন, আমি পড়ছি–
Autistic child might be obsessed with learning all about, train schedules, light houses, cars, vaccum cleaners. Often they show great interest in numbers, symbols, science, advanced math…
অ্যাই, তুমি কি আমার কথা শুনছ?
শুনছি, তবে মন দিয়ে শুনছি না।
Autistic বেবিরাও কিন্তু কখনো কোনো কথা মন দিয়ে শুনে না। তুমি কি জানো Mozart Autistic ছিল?
মতিন লাইন কেটে দিল। সে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। তৎক্ষণাৎ শুরু হলো স্বপ্ন দেখা। যেন সে ক্লাসে বসে আছে। বিরাট বড় ক্লাস। নানান বয়সের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী। যিনি ক্লাস নিচ্ছেন তার চেহারা দৈত্যের মতো। তিনি। পাঞ্জাবি পরে আছেন, তারপরেও কোনো এক অদ্ভুত কারণে তাঁর খালি গা দেখা যাচ্ছে। ভদ্রলোকের বুকভর্তি সাদা লোম। গালে চাপদাড়ি। তবে গালের দাড়ি বুকের ললামের মতো সাদা না। মেহেদি দিয়ে রাঙানো। দৈত্যাকৃতির এই লোকটির কণ্ঠস্বরও দৈত্যের মতো। ক্লাসরুম গমগম করছে। দৈত্যের হাতে বেত। সে বাতাসে কয়েকবার বেত নাচাল। শাঁ শাঁ শব্দ হলো। তারপর ক্লাসের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে যে প্রমাণ করতে পারে God বা ঈশ্বর বলে কিছু নেই? এই পৃথিবী, এই সৌরজগৎ, এই গ্যালাক্সি আপনাআপনি সৃষ্টি হয়েছে। আছে কেউ? যদি কেউ থাকে সে যেন এগিয়ে আসে। আমার কাছে চক আছে, ডাস্টার আছে, সে যেন প্রমাণ করে। একটাই শর্ত। প্রমাণ করতে না পারলে আমি তাকে শাস্তি দেব। আছে কেউ? আছে? সাহস দেখাও। উঠে আস।
কে যেন যাচ্ছে বোর্ডের দিকে। কে সে? আরে কমল না! করছে কী এই ছেলে? মতিন ঘুমের মধ্যে চেঁচিয়ে উঠল–স্টপ। স্টপ। কমল ফিরে এসো। এই দৈত্য তোমাকে মারবে।