জি।
উজবেক মরমী কবি নদ্দিউ নতিমের বিষয়ে প্রবন্ধগুলো আপনার লেখা?
জি।
আরো নতুন কিছু এনেছেন?
উনার মৃত্যুচিন্তা নিয়ে ছোট একটা প্রবন্ধ এনেছি। চার-পাঁচ স্লিপের মতো হবে।
একটু বসুন, হাতের কাজ সারি।
মতিনের সামনে ভোরের স্বদেশ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক আজহার উল্লাহ সাহেব বসে আছেন। তার পেছনে দেয়ালে কম্পিউটার কম্পোজ করে নোটিশ টানানো আছে। নোটিশে বড় বড় অক্ষরে লেখা–
অকারণে বসে থেকে
আমাকে বিরক্ত করবেন না।
সময়ের মূল্য আছে।
আজহার উল্লাহ সাহেবের বয়স ষাটের উপর। তার মাথার চুল আইনস্টাইনের মতো ঝাকড়া ও ধবধবে সাদা। তার হাত কাঁপা রোগ আছে। কলম হাতে নিলে তার হাত কাঁপে। কলম রেখে দিলে হাত কাঁপা বন্ধ হয়ে যায়। উনি কিছুক্ষণ পরপর কলম হাতে নিচ্ছেন এবং কলম টেবিলের উপর রেখে কাকলাসের মতো চেহারার একজনের সঙ্গে ঝগড়া করছেন। মতিন অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেও এই দুজনের কথাবার্তা আগ্রহ নিয়ে শুনছে। কাকলাসের মতো চেহারার লোকটির নাম মঞ্জু। আজহার উল্লাহ সাহেব তাকে ডাকছেন। মনঝু নামে এবং ঝুর উপর যথেষ্ট জোর দিচ্ছেন।
আজহার উল্লাহ বললেন, আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা না করে এই কবিতা তুমি স্ত্রী মনে করে মেকাপ করতে দিলে? সাহিত্য পাতাটা কে দেখে? আমি দেখি?–কি তুমি দেখ?
আপনি দেখেন। বড় সাহেব নোট লিখে দিয়েছেন, এই কবিতা যেন ছাপা হয়।
সবকিছুতে বড় সাহেব নাক গলালে তো চলবে না।
সেটা বড় সাহেবকে বলেন। আমাকে বলে লাভ কী?
মনঝু, তুমি গলা নামিয়ে কথা বলো। আমার সঙ্গে চিৎকার করবে না।
আমাকে দেখলেই তো আপনার রাগ উঠে। আমি চলে যাই। কবিতাটা অফ করে দেই।
যাও অফ করে দাও। আলতু-ফালতু জিনিস লিখে পাঠালেই ছাপতে হবে? কবিতার নাম কি–শ্রীকৃষ্ণ ডট কম। এর অর্থ কী?
আধুনিক কবিতার আধুনিক নাম।
নামের অর্থ তো থাকতে হবে। কবিতাটা পড়।
আপনি তো কবিতাই অফ করে দিচ্ছেন। পড়ার দরকার কী?
তোমাকে পড়তে বলছি পড়।
যত দোষ নন্দ ঘোষ শ্রীকৃষ্ণ পিতা
দুধ পড়ে ভিজে গেছে ভগবত গীতা।
আর পড়তে হবে না। স্টপ। কবিতা অফ। আমি যতদিন এই পত্রিকায় আছি ততদিন দুধ পড়ে ভিজে গেছে ভগবত গীতা ছাপা হবে না।
বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলে নেবেন? একটা টেলিফোন করেন। শেষে উনি হৈচৈ করবেন। আমাকে দুষবেন।
আর কথা নাই। কবিতা অফ করতে বলেছি অফ। ঐ জায়গায় অন্য কোনো ম্যাটার দিয়ে দাও। তুমি নিজেও আমার সামনে থেকে অফ হও। দরজা চাপিয়ে দিয়ে যাও, আমি এই ভদ্রলোকদের সঙ্গে একান্তে কিছু কথা বলব।
মতিন অন্যদিকে ফিরে ছিল, এখন আজহার উল্লাহর দিকে তাকাল। মানুষটাকে যথেষ্টই ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। ভদ্রলোক দুপা তুলে উঁচু হয়ে চেয়ারে বসে আছেন। মতিন এর আগে কাউকে এভাবে বসতে দেখে নি। এই গরমেও তিনি হলুদ রঙের মোটা চাদর গায়ে দিয়ে আছেন। গায়ের চাঁদরের অর্ধেকটা মাটিতে ঝুলছে। তিনি মতিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, চা খাবেন?
মতিন বলল, জি-না।
লেখাটা দিন।
মতিন লেখা দিল। তিনি লেখার উপর কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে লেখাটা ড্রয়ারে রাখতে রাখতে ক্লান্ত গলায় বললেন, নদ্দিউ নতিম নামে কোনো উজবেক কবি নাই। আপনিই সেই উজবেক কিংবা উজবুক কবি। ঠিক না?
মতিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত গলায় বলল, ঠিক।
আজহার উল্লাহ ক্লান্ত গলায় বললেন, লেখকরা সম্পাদকদের ধোঁকা দিতে পছন্দ করে। আপনি ধোঁকা দিয়েছে। থব ভালো না। লেখাটা যখন আমি ছাপালাম তখন কিন্তু আপনি পাঠকদের ধোঁকা দিলেন। কাজটা ঠিক হয়েছে?
ঠিক হয় নাই।
আমি বৃদ্ধ মানুষ, বাইরের সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞান নাই। পড়াশোনার সুযোগ নাই, সময়ও নাই। যে কারণে আপনার ফাজলামি ধরতে পারি নাই। আপনার যুবা বয়স। আপনার প্রবন্ধ পড়লে বোঝা যায় প্রচুর পড়াশোনাও আছে। আপনার মতো মানুষ এমন কাজ কেন করবে? লেখালেখি আপনার কাছে একটা। খেলা, তাই না?
জি।
আপনি কি পোলাপান যে আপনি খেলা খেলবেন? লেখালেখি নিয়ে খেলা?
মতিন চুপ করে রইল। আজহার উল্লাহ চেয়ার থেকে পা নামিয়ে হতাশ এবং বিষণ্ণ গলায় বললেন, (এইবার তুমি তুমি করে) আমি আমার মেয়ের কাছে তোমার লেখার প্রশংসা করেছি। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ফিজিক্স। সাহিত্য-টাহিত্য পছন্দ করে না। তাকে জোর করে পড়িয়েছি। তাকে বলেছি, দেখো মা, কী রকম পড়াশোনা জানা লোক।
আপনি কখন জানলেন যে, নদ্দিউ নতিম বলে কেউ নেই?
সেটা তোমার জানার প্রয়োজন নাই। তোমার আগের দুটি লেখার সম্মানির টাকাটা নিয়ে যাও।
টাকা লাগবে না।
অবশ্যই লাগবে। টাকার প্রয়োজন আছে। আমরা একটা প্রবন্ধের জন্যে মেক্সিমাম এক হাজার টাকা দেই। বিশেষ বিবেচনায় তোমার জন্যে পনেরশ টাকা করে বিল করেছিলাম। বিল পাশ হয়েছে, টাকা নিয়ে যাও।
নদ্দিউ নতিমের মৃত্যুচিন্তা লেখাটা কি ফেরত নিয়ে যাব?
আজহার উল্লাহ হাই তুলতে তুলতে বললেন, না। আবর্জনা ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হয়। আবর্জনা পকেটে নিয়ে ঘুরতে হয় না।
আপনার টেবিলের ড্রয়ার তো ডাস্টবিন না।
যাবতীয় লেখা নামক আবর্জনা এই ড্রয়ারে রাখি, কাজেই ড্রয়ারটা ডাস্টবিন।
মতিনের পাঞ্জাবির পকেটে তিন হাজার টাকা। সবই একশ টাকার নোট। অনেকগুলি নোট। পকেট ভারি হয়ে আছে। টাকাগুলির জন্য মতিন এক ধরনের অস্বস্তিতে ভুগছে। তার মন বলছে, দ্রুত টাকাগুলির একটা ব্যবস্থা করে ঝাড়া হাত-পা হয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এতে মন খানিকটা শান্ত হবে। মতিন ট্যাক্সি নিয়ে নিল। ঘণ্টা চুক্তিতে ট্যাক্সি। চারশ টাকা ঘণ্টা। তিন হাজার টাকায় সাত ঘণ্টা ট্যাক্সি তার সাথে থাকবে। খারাপ কী? সে রওনা হলো তার দুলাভাইয়ের ফার্মেসির দিকে। নিউ সালেহা ফার্মেসি।