বাড়িতে যাব। ঘুমাবার চেষ্টা করব। আমার মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হয়েছে।
কমলের পাশের কেবিনে ইচ্ছা করলে থাকতে পার।
মুনা বিরক্ত গলায় বললেন, তুমি ভালো করেই জানো আমি হাসপাতালে থাকি না।
বিশেষ বিশেষ প্রয়োজনে থাকতে হয়।
তেমন বিশেষ প্রয়োজন এখন তৈরি হয় নি।
ঠিক আছে যাও।
মুনা চলে যাচ্ছেন। সালেহ ইমরান সিগারেট ধরিয়েছেন। মতিন বেশ আগ্রহ নিয়ে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ভদ্রলোক তার স্ত্রীর উপর খুব বিরক্ত হয়েছেন। বিরক্ত মানুষের মুখের চামড়া শক্ত হয়ে যায়। এই ভদ্রলোকের তাই হয়েছে। তিনি সিগারেট টেনে টেনে মুখের চামড়া নরম করার চেষ্টা করছেন। কাজটা তেমন সহজ হচ্ছে না। কফিশপে বেশ বড় বড় করে লেখা No Smoking. তারপরেও কফিশপের কর্মচারীরা কিছু বলছে না। এটাও মতিনকে বিস্মিত করছে।
সালেহ ইমরান মতিনের দিকে সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, Have a smoke. তোমাকে কমলের কেবিনে নিয়ে যাওয়ার আগে তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলা দরকার।
মতিন বলল, স্যার, জায়গাটা নো স্মোকিং।
সালেহ ইমরান বললেন, কফিশপে নো স্মোকিং সাইন থাকা ঠিক না। স্মোকাররা চা-কফির সঙ্গে সিগারেট খেতে পছন্দ করে। এদের উচিত ছিল আলাদা একটা স্মোকিং কর্নার করা। যাই হোক, তুমি সিগারেট ধরাও, কেউ কিছু বলবে না।
মতিন বলল, কেন কেউ কিছু বলবে না?
সালেহ ইমরান ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কেউ কিছু বলবে না, কারণ এই ক্লিনিকটার মালিক মুনা।
মতিন সিগারেট ধরাল। সে লক্ষ করল, সালেহ ইমরান সাহেবের মুখের চামড়া আগের মতো হয়েছে। দৃষ্টির সেই কাঠিন্যও নেই। তিনি মতিনের দিকে সামান্য ঝুঁকে এলেন।
মতিন।
জি স্যার।
তুমি এসেছ আমি খুবই খুশি হয়েছি। থ্যাংকস। এখন তুমি কমল বিষয়ে দুএকটা কথা শুনে নাও। আগেও হয়তো বলেছি, আবারো বলি।
বলুন।
অ্যাপিলেপটিক সিজার কী তুমি নিশ্চয়ই জানো? জানো না?
জি-না।
মৃগী রোগী কখনো দেখ নি?
আমার পরিচিত কারোর মৃগী রোগ নেই, তবে রাস্তায় মৃগী রোগী পড়ে থাকতে দেখেছি। তারা ছটফট করছে, লোকজন চেষ্টা করছে জুতো শোঁকানোর। পুরনো জুতোর গন্ধে নাকি রোগের আরাম হয়।
মৃগী রোগের অনেক লোকজ চিকিৎসা প্রচলিত আছে। কোনোটাই অবশ্য কাজ করে না। যা হবার তাই হয়। তখন মস্তিষ্কে ইলেকট্রিক কারেন্টের একটা ঝড় বয়ে যায়। এই ঝড় অতি অল্প সময়ের জন্যেই হয়, কিন্তু রোগীকে চরম অবসন্নতায় ফেলে দিয়ে যায়। কমল এখন আছে এই অবস্থায়। এখন তাকে কিছুতেই উত্তেজিত করা যাবে না।
আমাকে কী করতে হবে সেটা বলে দিন।
আমি তো তাও জানি না। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করবে। সে তোমার জন্যে অতি ব্যস্ত হয়ে আছে। সে কী করবে বা করবে না সেটা সে জানে। তুমি শুধু একটা জিনিস করবে না–তার গায়ে হাত দেবে না। এই ধরনের শিশুরা নিজ ভুবনে থাকে। গায়ে হাত দেয়াটাকে তারা মনে করে তাদের ভুবনে অনুপ্রবেশ। বুঝতে পারছ?
পারছি।
কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার করছি। ভুবন, অনুপ্রবেশ। আমি নিজেও ক্লান্ত। ঠিক আছে, তুমি যাও দেখা করে এসো। তোমার জন্য গাড়ি রাখা আছে। তোমাকে তোমার মেসে নামিয়ে দেবে।
কমলের ঘরে আমি একা যাব?
হ্যাঁ একা যাবে। কেবিন নম্বর ১০১ and thank you again for coming. ভালো কথা বলতে ভুলে গেছি–তুমি ওর বিছানায় খবরদার বসবে না। তুমি বসবে চেয়ারে।
কমল দেয়ালের দিকে মুখ দিয়ে শুয়ে আছে। স্যালাইনের ব্যাগ ঝুলছে। তাকে স্যালাইন দেয়া হয়েছে। তার ঠোঁটে সেলাই করা হয়েছে। তার জিভও কেটেছে, জিভেও সেলাই করেছে। হাসপাতালের কেবিনে প্রচুর আলো থাকে। এই কেবিনে আলো কম। ঘরটা সাজানো হয়েছে হোটেলের কায়দায়। দেয়ালে পেইন্টিং আছে। বটগাছের ছায়ায় একদল গরু ঘাস খাচ্ছে। আকাশে কাক উড়ছে। পেইন্টিং তেমন সুন্দর না। মনে হয় আনাড়ি হাতের কাজ।
কমলের গায়ে হাসপাতালের পোশাক। অ্যাশ কালারের পায়জামা-পাঞ্জাবি। বিছানার চাদরটা ছাই রঙের। দরজায় পা দিয়ে মতিনের মনে হলো, ছাই রঙ পানির একটি দিঘিতে শুভ্র পদ্ম ফুটে আছে। এত সুন্দর হয় শিশুদের মুখ!
মতিন বলল, হ্যালো!
কমল পাশ ফিরে হাসল। ঠোঁটে সেলাই নিয়ে হাসা কষ্টকর, তবুও সে হাসছে।
শুনলাম তুমি আমাকে কিছু বলার জন্যে ডেকেছ। সেটা কী?
রিস তেলব ইচা।
আমার সঙ্গে উল্টো করে কথা না বললে হয় না? আমি তোমার মতো বুদ্ধিমান না। উল্টো কথা সোজা করতে আমার কষ্ট হয়। ঠিক আছে চেষ্টা করি। রিস হলে সরি, তেলব হলো বলতে, ইচা হলো চাই। তার মানে হলো সরি বলতে চাই। ঠিক আছে?
কমল বলল, রিস।
মতিন বলল, সরি বলা তো হয়েছে। এখন কি চলে যাব?
কমল বলল, না।
মতিন বলল, না-টা উল্টো করে বলছ না কেন? নার উল্টো হয় না?
কমল বলল, হয়। না হলো–আ-না।
মতিন বলল, রমাকান্তকামার-এর উল্টো কী?
কমল বলল, রমাকান্তকামার উল্টো করলে রমাকান্তকামার হয়। এটা কি কোনো ট্রিক?
হ্যাঁ ট্রিক।
আমি ট্রিক পছন্দ করি না। যারা ট্রিক করে তাদেরকেও আমি পছন্দ করি
মতিন বলল, আমি ট্রিক পছন্দ করি। যারা ট্রিক করে তাদের পছন্দ করি। তুমি ট্রিক পছন্দ কর না, কাজেই আমি তোমাকে পছন্দ করি না।
কমল বলল, তুমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলছ কেন? কাছে আস।
মতিন বলল, না। তুমি আমাকে পছন্দ কর না, এইজন্যে কাছে আসতে চাও না?
মতিন বলল, এইজন্যে না। আমি অনেককেই পছন্দ করি না, তারপরও তাদের কাছে যাই। তোমার কাছে যাচ্ছি না, কারণ তোমার কাছে গেলে আমার বসতে ইচ্ছা করবে। বিছানায় বসতে ইচ্ছা করবে। আমি সেটা করতে পারব না। কারণ তুমি তোমার বিছানায় কাউকে বসতে দাও না।