মতিন দরজা খুলল। দরজার ওপাশে বিব্রত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা বললেন, আপনি কি আমাকে চিনেছেন?
মতিন বলল, চিনেছি। আপনার নাম আহমেদ ফারুক। আপনি ব্যারিস্টার সালেহ ইমরান সাহেবের জুনিয়র। আপনি আমাকে একটা মার্লবরো লাইট সিগারেট দিয়েছিলেন এবং পল্লবীতে আমার বোনের বাসায় নামিয়ে দিয়েছিলেন। সেদিনও আপনার গায়ে হাফ হাওয়াই সার্ট ছিল। সার্টের রঙ ছিল হালকা নীল। তবে সেদিন আপনার হাতে সোনালি বেল্টের ঘড়ি ছিল। আজকের ঘড়ির বেল্ট চামড়ার। আপনার কি অনেকগুলি রিস্টওয়াচ?
আহমেদ ফারুক বললেন, আপনার স্মৃতিশক্তি অসম্ভব ভালো। আমি কি ভেতরে আসতে পারি?
মতিন বলল, না। আমি ঘুমাবার জন্যে তৈরি। এখন বিছানায় যাব। আপনার যা বলার দরজা থেকে বলুন এবং সংক্ষেপে বলুন।
কমলের ব্যাপারে কিছু কথা বলতে এসেছিলাম। সে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে।
মতিন বলল, আমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে বলেই রাত এগারোটায় তার কাছে ছুটে যাব এরকম মনে করছেন কেন? সে কৃষ্ণ না যে কৃষ্ণের বাঁশি বেজেছে আমি শ্রী রাধিকা ছুটে যাচ্ছি।
ছেলেটা অসুস্থ।
তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। আমি ডাক্তার না।
তাকে একটা ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। অ্যাপিলেপটিক সিজার হয়েছিল। সেই সময় জিভ কেটে যায়। জিভ সেলাই করা হয়েছে।
তাহলে চিকিৎসা তো হয়েছেই। এখন ডাক্তারদের বলুন কড়া ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে।
তাকে ঘুমের ওষুধ দেয়া হয়েছে। সে ঘুমাচ্ছে না। আপনাকে চাচ্ছে। এই ধরনের শিশুদের মাথায় কিছু ঢুকে গেলে সহজে দূর হয় না। প্লিজ, আপনি একটু আসুন।
মতিন বলল, দরবার করে লাভ হবে না ভাই, আমি যাব না। কেন যাব না। তার পেছনেও আমার শক্ত যুক্তি আছে। যুক্তিটা শুনবেন?
বলুন শুনি।
আজ যদি তার কাছে যাই তাহলে কয়েকদিন পর আবার সে আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইবে। আবার তার কাছে ছুটে যেতে হবে। তারপর আবার। তারপর আবার। আমাকে থাকতে হবে ধারাবাহিক আসা-যাওয়ার মধ্যে। যুক্তি কি মানছেন?
মানছি।
তাইলে বিদায়। গুড নাইট। শুভ রাত্রি।
আহমেদ ফারুক হতাশ গলায় বললেন, আপনি কি দুই মিনিটের জন্যে রাস্তায় আসবেন?
মতিন বিস্মিত গলায় বলল, কেন?
আহমেদ ফারুক বলেন, গাড়িতে ম্যাডাম বসে আছেন, উনি আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।
ম্যাডাম মানে কি কমলের মা? মিসেস মুনা?
জি।
শুরুতে এই কথাটা না বলে এতক্ষণ ভ্যাজর ভ্যাজর করলেন কেন?
সরি।
মতিন বিরক্ত মুখে পাঞ্জাবি গায়ে দিল। তার পরনে লুঙ্গি। তার উচিত লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পরা। সে তা করল না। প্যান্ট পরা থাকলে এই মহিলা বলে বসতে পারেন–গাড়িতে উঠুন। সেই সুযোগ মতিন এই মহিলাকে দিতে রাজি না। ক্ষমতাধররা সবসময় অন্যদের তুচ্ছ করবে তা হয় না।
গাড়ির কাচ উঠানো। ভেতরে এসি চলছে। মুনা পেছনের সিটে গা এলিয়ে পড়ে ছিলেন। তাঁর চোখ বন্ধ। মতিন এসে জানালার পাশে দাঁড়াতেই চোখ খুললেন। গাড়ির দরজা খুলে বললেন, উঠে আসুন।
মতিন বলল, গাড়িতে উঠব?
মুনা বললেন, জি। আমি আমার ছেলেকে কথা দিয়েছি আপনাকে নিয়ে যাব। আমি কাউকে কথা দিলে কথা রাখি।
মতিন বলল, আমি কিন্তু কাউকে কোনো কথা দেই নি।
মুনা বললেন, প্লিজ। প্লিজ।
মতিন বলল, লুঙ্গি বদলে আসি।
মুনা বললেন, লুঙ্গি বদলাতে হবে না। আপনাকে লুঙ্গিতে মানিয়েছে!
ঢাকা শহরের অনেক উন্নতি হয়েছে! সুন্দর সুন্দর দালান। রাস্তার দুপাশে শোভাবর্ধক গাছপালা, ফুলের বাগান। বিদেশী ছবির মতো হাইওয়ে পেট্রল কার। কালো কুকুর হাতে কালো পোশাকের র্যাব। শত শত ফাস্ট ফুডের দোকান। ঢাকা শহরবাসী এখন আর নতুন কিছু দেখলে ভড়কায় না। কিন্তু মতিন গুলশান এলাকার এই ক্লিনিক দেখে ভড়কাচ্ছে। ফাইভ স্টার হোটেলের ভাবভঙ্গি। রিসিপশনে পানির ফোয়ারা। ফোয়ারায় লাল-নীল মাছ। দুজন রিসিপশনিস্ট সেজেগুজে বসা। একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে। দুজনের মুখেই ফাইভ স্টার হোটেলের রিসিপশনিস্টদের মতো ঝকঝকে নকল হাসি।
মতিনকে দেখে রিসিপশনিস্ট দুজনই ভুরু কুঁচকে ফেলল। মতিনের ধারণা হলো, তার আগে কেউ লুঙ্গি পরে রিসিপশন রুমের মার্বেল পাথরের মেঝেতে দাঁড়ায় নি। তবে রিসিপশনিস্টরা কিছু বলল না। আহমেদ ফারুক তাদের কাছে এগিয়ে গেলেন। মিসেস মুনা বললেন, আসুন আগে এককাপ কফি খাই।
মতিন বলল, আমি কফি কম খাই।
মুনা বললেন, আপনি কমলের বাবার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে তারপর কমলকে দেখতে যাবেন। কফি খাওয়ার কথা এইজন্যেই বলেছি। কফিশপ দোতলায়, আসুন হেঁটে উঠি। আমার লিফট ফোবিয়া আছে।
মতিন বলল, লুঙ্গি পরে এইসব জায়গায় হাঁটাহাঁটি করা খুবই অস্বস্তিকর ব্যাপার।
মুনা বললেন, নেংটি পরে মহাত্মা গান্ধী যদি ইউরোপ ঘুরে আসতে পারেন তাহলে আপনার সমস্যা কী?
মতিন বলল, আমি মহাত্মা গান্ধী না। এটাই আমার সমস্যা। দেখুন সবাই তাকাচ্ছে।
মুনা বললেন, আপনার দিকে কেউ তাকাচ্ছে না। তাকাচ্ছে আমার দিকে। রূপবতী কোনো মেয়ে যদি কোনো ছেলের সঙ্গে হাঁটে তখন লোকজন মেয়েটিকেই দেখে। ছেলের দিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করে না।
কফিশপটা খালি। এক কোনায় সালেহ ইমরান সাহেব বসে আছেন। তার হাতে টাইম পত্রিকা। তিনি বেশ মনোযোগ দিয়েই পত্রিকা পড়ছিলেন। মতিনকে দেখে পত্রিকা বন্ধ করলেন। মুনা বললেন, আমার দায়িত্ব শেষ, আমি এখন চলে যাব।
সালেহ ইমরান বললেন, কোথায় যাবে?