তোমার নামটা তো অনেক বড়। ছোট করে কী ডাকা যায় বলো তো?
মতিন ডাকতে পারেন স্যার।
মতিন তোমার ডাকনাম?
জি-না, আমার ডাকনাম মতি।
তুমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। আমার স্ত্রী চলে আসবে, তখন দুজনে মিলে তোমার সঙ্গে কথা বলব। এর মধ্যে চা খাও। আমি তোমাকে চা দিতে বলে দিচ্ছি।
স্যার, আমার একটু বাথরুমে যাওয়া দরকার, বড়টা না, ছোটটা।
অফকোর্স। যে চা নিয়ে আসবে সে তোমাকে বাথরুম দেখিয়ে দেবে। ফিল ফ্রি।
ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। মতিনের ইচ্ছা করছে নিজেকেই নিজে লাথি মারে। উনার সঙ্গে বাথরুম নিয়ে এত কথা বলার কিছুই ছিল না। উনি তো চলেই যাচ্ছেন। উনি চলে যাওয়া মানেই ফাকা ঘর। তখন সে দারোয়ান, বয় বাবুর্চি টাইপ যে-কোনো একজনকে বলতে পারত–ভাই, আপনাদের বাথরুমটা কোন দিকে? আমার হাত-মুখ ধোয়া দরকার। তা না বলে সে বলেছে, আমার একটু বাথরুমে যাওয়া দরকার। বড়টা না, ছোটটা। বাথরুমে গিয়ে সে কী করবে সেটা তার ব্যাপার এত ব্যাখ্যা কেন? তবে এখনো পুরোপুরি নিরাশ হবার মতো ঘটনা ঘটে নি। মূল ইন্টারভিউ বেগম সাহেবের অ অপেক্ষা করছে আসল চাবিকাঠি নিশ্চয়ই তার হাতে। রাজা দেশ চালালেও চাবি থাকে রানীর কাছে। অবশ্যি রানী দেশ চালালে চাবি তাঁর কাছেই থাকে। তারা কখনো রাজাকে চাবি দেন না। রানীরা চাবি হাতছাড়া করেন না।
মতিনের জন্য চা এসেছে। মাঝারি সাইজের কাচের ট্রেতে চায়ের কাপ। ট্রে এবং চায়ের কাপের মধ্যে যোগাযোগ আছে। যে ডিজাইনের ট্রে, একই ডিজাইনের চায়ের কাপ। এত সুন্দর লাগছে দেখতে! মতিন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। সব সৌন্দর্য ক্ষমতাবানদের হাতে চলে যাচ্ছে। মহান কোনো শিল্পী অপূর্ব কোনো ছবি আঁকলেন, সেই ছবির স্থান হলো গার্মেন্টসের মালিকের বসার ঘরে।
বেয়ারা টাইপ লোকটি চায়ের ট্রে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, স্যার, আসেন আমার সঙ্গে।
মতিন অবাক হয়ে বলল, কোথায় যাব?
বড় সাহেব বলেছিলেন, আপনি বাথরুমে যাবেন।
ও আচ্ছা আচ্ছা। গুড। চল যাই। তোমার নাম কী?
লোকটি নাম বলল না। বিরক্ত মুখে সে হাঁটছে। মতিন তার পেছনে পেছনে যাচ্ছে। অতি ধনবানদের কাজের লোকরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপ আলোচনায় যায় না। ব্যাপারটা মতিনের মনে ছিল না। মনে থাকলে নাম জানার ঝামেলায় যেত না।
বাথরুম দেখে মতিনের চোখ ঝলসে গেল। এমন একটা সুন্দর জায়গায় ছোট বাথরুম করা গেলেও বড় বাথরুম করা সম্ভবই না। মতিন কাজ সারলো। চোখে-মুখে পানি দিল। বাথটাবের এক কোনায় বসল। এ জাতীয় বাথরুমে আবার আসার সুযোগ নাও আসতে পারে। সুযোগটা কাজে লাগানো দরকার। যেখানে সে বসেছে সেখানে কাচের জারে একগাদা সাবান। কোনোটা মাছের মতো, কোনোটা ফুলের মতো। একটা সাবান পকেটে ঢুকিয়ে ফেলা খুব কি অন্যায় হবে? সাবানের হিসাব কি তাদের কাছে আছে? চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি বের হয়ে চায়ে চুমুক দেয়া দরকার। চায়ের কথা মনে হতেই মতিনের সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়ে গেল। বাথরুমের কোথাও লেখা নেই–নো স্মোকিং। একটা সিগারেট ধরিয়ে দ্রুত কয়েকটা টান দেয়া যায় না? বাথরুম গান্ধা হয়ে যাবে? বাথরুম তো গান্ধা হবার জন্যেই। কমোডে যে জিনিস ফেলা হয় তা থেকে নিশ্চয়ই কর্পূরের সুবাস বের হয় না!
মতিন সিগারেট ভেবে প্যান্টের পকেট থেকে যে জিনিস বের করল তার নাম মোবাইল সেট। মোবাইল টেলিফোন নিয়ে ঘুরে বেড়াবার মতো আর্থিক অবস্থা মতিনের না। এই বস্তুটি তাকে দিয়েছে নিশু। নিশু তার সঙ্গেই পড়তো। মতিন ছিটকে বের হয়ে এসেছে, নিশু বের হয় নি। সে এমএ শেষ করেছে। এখন তার ইংল্যান্ডে যাবার ব্যবস্থা হচ্ছে। সে ফনেটিক্সে পিএইচডি করবে। নিশুকে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই সে ফাটাফাটি ভালো ছাত্রী। অনার্স, এমএ দুটোতেই ফার্স্ট ক্লাস।
নিশুর সঙ্গে মিনিটখানিক কথা বললে কেমন হয়? এক মিনিটে চা আর কতটা ঠাণ্ডা হবে? হলে হবে।
হ্যালো নিশু!
তুমি কোথায়?
আমি টাট্টিখানায়।
টাট্টিখানায় মানে? টাট্টিখানা কী?
টাট্টিখানা শব্দটি প্রায় লুপ্ত। এটা কোনো তৎসম শব্দ না। আদি বাংলা শব্দ। এর অর্থ বাথরুম। আমি এই মুহূর্তে বাথরুমে বসে আছি। হাইফাই ধরনের বাথরুম।
বাথরুম থেকে টেলিফোন করেছ কেন?
খুবই জরুরি কারণে টেলিফোন করেছি। Autistic শব্দটার মানে জানো?
কেন জানব না! Autistic শব্দটা এসেছে Autism থেকে। বিশেষ একধরনের মানসিক ব্যাধি। Austistic children. যে সব শিশুর এই সমস্যা থাকে তারা নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে থাকে। নিজেদের একটা আলাদা জগৎ তৈরি করে নেয়। Autistic শিশুদের কিছু বিশেষ বিশেষ গুণ দেখা যায়। এরা সাধারণত খুব মেধাবী হয়। অঙ্ক ভালোবাসে। এতে হবে, না-কি আরো বলব?
এতেই হবে। নিশু, তুমি এত জ্ঞানী কেন? যার সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে। তার কপালে দুঃখ আছে। স্বামীরা আর যাই পছন্দ করুক, জ্ঞানী স্ত্রী পছন্দ করে না। স্বামীদের পছন্দের তালিকায় একনম্বরে আছে ফর্সা, হাবা টাইপ স্ত্রী।
মতিন, তুমি কি বিকেলে আমাদের বাসায় আসতে পারবে?
পারব।
ঠিক পাঁচটায় আসবে। কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটায়। আচ্ছা, তুমি কি সত্যি বাথরুম থেকে কথা বলছ?
হুঁ। বিশ্বাস না হয় আমি এখন ফ্ল্যাস টানব। ফ্ল্যাসের শব্দ শুনবে। রেডি, ওয়ান-টু-থ্রি।
মতিন ফ্ল্যাস টানল।
মতিনের ইন্টারভিউ শুরু হয়েছে। ব্যারিস্টার সালেহ ইমরান সাহেবের পাশে যে তরুণী বসে আছেন ইনিই বোধহয় তার স্ত্রী। ব্যারিস্টার সাহেবের বয়স পঞ্চাশের উপরে হলেও তাঁর স্ত্রীর বয়স তেইশ-চব্বিশের বেশি হবার কোনোই কারণ নেই। মতিনের মনে হলো সে তার জীবনে এমন রূপবতী মেয়ে দেখে নি। তবে সে এই তরুণীর দিকে তাকাতে পারছে না। ইনি অতিরিক্ত লো-কাট ব্লাউজ পরেছেন। মতিনের তাকাতে লজ্জা লাগছে। সে নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করছে এই তরুণীর দিকে তাকিয়ে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। এই তরুণী কী ধরনের ব্লাউজ পরেছেন তা তিনি জানেন। এ ধরনের ব্লাউজ পরলে পুরুষরা তাঁর দিকে কীভাবে তাকাবে তাও জানেন। তাহলে মতিনের লজ্জা পাবার কী আছে!