না।
কমল চুপ করে গেল। সে এতক্ষণ বাবার দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল, এখন তাকালো টিভি স্ক্রিনের দিকে। সালেহ ইমরান স্বস্তি বোধ করলেন। ছেলের মাথা থেকে মতিনের অংশ দূর হয়েছে। এখন ছবির দিকে মন দেয়া যায়। পুত্রের সঙ্গে ছবি দেখার এই অংশটি তার জন্যে অত্যন্ত ক্লান্তিকর। তারপরেও প্রতি সপ্তাহে এই কাজটা তাঁকে করতে হয়।
সালেহ ইমরান বললেন, ছবি কি শুরু করব?
কমল বলল, মা দেখবে না?
না। সে একটা কাজে গিয়েছে।
মা কাজে যায় নি। মা ঘরে আছে। তুমি মিথ্যা কথা বলেছ।
আমি বলতে চেয়েছি সে কোনো একটা জরুরি কাজে ব্যস্ত।
মা কোনো জরুরি কাজে ব্যস্ত না। মা ম্যাগাজিন পড়ছে। ম্যাগাজিনের নাম–News Week..
News Week পড়াটাই হয়তো তার জন্যে এই মুহূর্তে ছবি দেখার চেয়ে জরুরী।
কমল বাবার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল, মা ছবি দেখতে পছন্দ করে না, এই জন্যে ছবি দেখে না।
সালেহ ইমরান বললেন, হতে পারে।
কমল বলল, তুমিও ছবি দেখতে পছন্দ কর না।
সালেহ ইমরান বললেন, পুরোপুরি ঠিক না হলেও কথাটা আংশিক সত্য।
আংশিক সত্য কথাটার মানে কী?
আংশিক সত্য মানে কিছুটা সত্য।
সেটা কীভাবে হবে? একটা সংখ্যার কিছুটা সত্য কিছুটা মিথ্যা হবে না। পাঁচ একটা সংখ্যা। পাঁচের কিছুটা সত্য কিছুটা মিথ্যা হবে? পাঁচের চার পর্যন্ত সত্য এক মিথ্যা তা হবে না।
মানুষের কথা এবং অংকের সংখ্যা এক না।
কমল কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে আবার পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে গেল। শীতল গলায় বলল, আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
কার সঙ্গে কথা বলতে চাও?
মতিন।
কমল শোন, তুমি চাইলেই সবকিছু হবে না। এখন তুমি যদি আকাশের চাঁদ হাতে নিয়ে দেখতে চাও তুমি কি পারবে? তোমাকে দেখতে হবে খালি চোখে। কিংবা দূরবিন দিয়ে।
আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
মতিন চলে গেছে। সে কোথায় গেছে আমি জানি না।
আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
তুমি চাইলেই তো সবকিছু হবে না। তাকেও চাইতে হবে।
আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
সালেহ ইমরান শান্ত গলায় বললেন, কমল, তুমি বুদ্ধিমান ছেলে। তোমার মাথায় লজিক আছে। লজিক দিয়ে বুঝতে চেষ্টা কর যে, চাইলেই সবকিছু হয় না।
কমল চাপা গলায় বলতেই থাকল, আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
কমল, ডিয়ার সান প্লিজ। প্লিজ স্টপ। আই বেগ ইউ।
কমল চুপ করে গেল। সালেহ ইমরান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। আর দেরি না করে ছবিটা শুরু করা দরকার। তিনি ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, বাবা, ছবি শুরু করি?
কমল বলল, বাবা, আমি একটা ভুল করেছি।
সালেহ ইমরান বিস্মিত হয়ে বললেন, কী ভুল?
বড় ভুল।
বলো শুনি কী ভুল?
আমি বলেছিলাম একটা সংখ্যার কিছুটা সত্য কিছুটা মিথ্যা হয় না। আসলে হয়।
সালেহ ইমরান বললেন, কমল, আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।
কমল বলল, ৮ একটা সংখ্যা। আটের কিছুটা সত্য, কিছুটা মিথ্যা হতে পারে।
এখনো বুঝতে পারছি না, বুঝিয়ে বলো।
কমল কাগজে লিখল–
৮ = ২ X (২ √-১) X (২ √-১)
লেখা শেষ করে বাবার দিকে কাগজ উঁচু করে ধরে বলল, এখানে ২ সত্য কিন্তু (২ √-১) মিথ্যা। আট সত্য, কিন্তু আটের তিনটা অংশের মধ্যে দুটা অংশ মিথ্যা।
সালেহ ইমরান বললেন, আমি এখনো কিছু বুঝতে পারছি না। অঙ্ক আমার বিষয় না।
এটা সহজ অঙ্ক।
তোমার কাছে হয়তো সহজ, আমার কাছে না।
কমল বলল, আমি যে ভুল কথা বলেছিলাম এটা কি বুঝতে পারছ?
সালেহ ইমরান বললেন, তুমি যখন বলছ ভুল তখন নিশ্চয়ই ভুল, তবে আমি এখনো বুঝতে পারছি না। এইসব জটিল বিষয় থাকুক, এসো ছবি দেখি।
কমল বলল, আমি উনার সঙ্গে ছবি দেখব।
কার সঙ্গে?
উনার নাম মতিন।
কমল, বাবা শোন, তোমাকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছি এটা সম্ভব না। তুমি অঙ্ক বুঝতে পার, যুক্তি বুঝবে না কেন?
আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই। তার সঙ্গে কথা বলতে চাই। সঙ্গে কথা বলতে চাই। কথা বলতে চাই। বলতে চাই। চাই।
কমল কমল। প্লিজ বেবি, প্লিজ।
কমলের মুখ লাল, চোখ রক্তবর্ণ। তার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস অতি দ্রুত। শরীর ঘামছে। সে তার হাতের মুঠি বন্ধ করছে খুলছে। এক্ষুনি তার অ্যাপিলেপটিক সিজারের মতো হবে। তখন তার জিভে কামড় পড়তে পারে। সালেহ ইমরানের উচিত এই মুহূর্তে কমলের দুই দাঁতের ফাঁকে কঠিন কিছু ঢুকিয়ে দেয়া।
কমল কথা উল্টো করে বলা শুরু করল। তার গলার স্বর হয়েছে তীব্র সাপের শিসের মতো। উল্টো করে বলায় মনে হচ্ছে সে ভিনগ্রহের কোনো প্রাণীদের অচেনা অদ্ভুত ভাষায় কথা বলছে–
ইচা তেলব থাক ঙ্গেস রতা মিআ। ইচা তেলব থাক ঙ্গেস রতা মিআ। ইচা তেলব থাক ঙ্গেস রতা মিআ…
সালেহ ইমরান ছেলের পিঠে হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে তার অ্যাপিলেপটিক সিজার হলো। তিনি চাপা গলায় বলতে থাকলেন, Oh god! Oh god! Oh god!
মতিন শোবার আয়োজন করছে। আয়োজন ব্যাপক। সে প্রথমে বিছানায় একটা শীতলপাটি বিছায়। ভেজা গামছায় শীতলপাটি মোছা হয়। জানালা খুলে সিলিং ফ্যান ছাড়ে। ফ্যানের বাতাসে শীতলপাটি ঠাণ্ডা হবার পর সে খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দিনের শেষ সিগারেটটা খায়। সিগারেট শেষ হবার পর হাই উঠার জন্য অপেক্ষা করে। সে হাই না উঠা পর্যন্ত বিছানায় যায় না।
আজ সে তার দিনের শেষ সিগারেটটা ধরিয়েছে। সিগারেট শেষ হবার আগেই হাই উঠে গেছে। সে ইচ্ছা করলেই আধখাওয়া সিগারেট ফেলে দিয়ে বিছানায় চলে যেতে পারে। এই সময় দরজায় টোকা পড়ল। সাবধানী ভদ্র টোকা। নিশ্চয়ই বাইরের কেউ। মেসের লোকজন দরজায় টোকা দেয় না। ধাক্কা দেয়।