সালেহা বললেন, তৌহিদা, কী চিন্তা কর?
তৌহিদা নিচু গলায় বলল, কিছু চিন্তা করি না।
সালেহা বললেন, তোমার বিয়ের দায়িত্ব আমি নিয়েছি। যথাসময়ে বিয়ে দেব। বিয়েতে খরচপাতিও করব। তোমার তিনকুলে কেউ নাই বলেই হাতে সুতা বেঁধে বিয়ে হবে তা না। একসেট গয়নাও দিব। তবে একটা শর্ত আছে।
কী শর্ত!
তোমাদের একটা সন্তান আমাকে দিয়ে দিবে। আমি পালব। সে আমাকে মা ডাকবে। তোমাকে না।
তৌহিদা গাঢ় স্বরে বলল, আপনি যা বলবেন তাই হবে।
মতিন নিজের গায়ে পানি ঢালার আগে ক্র্যাচ দুটা সাবান দিয়ে ধুয়ে নিল। একটা ক্রাচে দাগ পড়ে গিয়েছিল, অনেকক্ষণ চেষ্টা করল দাগ উঠানোর।
সামান্য কিছু সময় ক্র্যাচের সঙ্গে কাটানোর জন্যেই কি মতিনের ক্র্যাচ দুটির প্রতি এত মায়া জন্মেছে? মানুষের মায়া শুধু যে মানুষের এবং জীবজন্তুর দিকেই প্রবাহিত হয় তা-না, জড়বস্তুর দিকে প্রবাহিত হয়। মতিন ঠিক করে ফেলেছে
ক্র্যাচের আত্মকাহিনী নামের একটা লেখা লিখবে। স্যাটায়ার টাইপ লেখা–
আমি কে? কী আমার পরিচয়? আমি একটা ক্র্যাচ। মানুষের বগলে ঘামের দুর্গন্ধে আমার দিন কাটে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন–আমার এই দেহখানি তুলে ধর। তখন কি তার মনের কোথাও ক্র্যাচ নামক বস্তুটি ছিল? তিনি কাকে দেহখানি তুলে ধরার গুরুদায়িত্ব দিয়েছিলেন–ক্র্যাচকে?
বাথরুমের দরজায় টুকটুক করে টোকা পড়ছে। মতিন বলল, কে?
আমি তৌহিদা।
কী চাও মিস তৌ?
আপনার কি আরো চা লাগবে?
তুমি চা নিয়ে এসেছ?
হুঁ।
ভেরি গুড। তুমি একজন পঙ্গু মানুষের দোয়া পেয়ে গেলে। তুমি বড়ই ভাগ্যবতী মেয়ে।
তৌহিদার চোখে আবারো পানি এসে যাচ্ছে। সে অবশ্যই ভাগ্যবতী। শুধু ভাগ্যবতী না, অসীম ভাগ্যবতী। অসীম ভাগ্যের কারণেই এমন একজনের সঙ্গে তার বিয়ে হচ্ছে।
অনেকক্ষণ হলো তৌহিদা বাথরুমের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার উচিত সালেহা আপাকে রান্নায় সাহায্য করা। কিন্তু সে এখান থেকে নড়তে পারছে না।
এত পদ রান্না হয়েছে, মতিন কিছুই খেল না। তার না-কি ক্ষুধা মরে গেছে। সালেহা বিরক্ত হয়ে বললেন, ক্ষুধা কেন মরে যাবে? মতিন বলল, ক্ষুধা হচ্ছে। একটা প্রাণীর মতো। তার জন্ম আছে, মৃত্যুও আছে। ক্ষুধা শৈশব থেকে যখন যৌবনে আসে তখন তার বিয়ে হয়, বাচ্চাকাচ্চাও হয়। তখনই ক্ষুধা প্রচণ্ড হয়। এখন বুঝেছ?
সালেহা বললেন, না।
না বুঝলে কিছু করার নাই। আমি উঠলাম এবং চললাম।
মতিন ক্র্যাচ ফেলে হেঁটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তৌহিদা এবং সালেহা মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। যে মানুষটা ক্র্যাচে ভর না দিয়ে এক পা ফেলতে পারছিল না সে কেমন গটগট করে দরজা খুলে চলে গেল।
বিকাল পাঁচটা। আজিজ সাহেব ঠিক আগের জায়গাতেই বসে আছেন। কথা ছিল নিশু তার জন্যে খাবার নিয়ে আসবে। নিশু আসে নি। হয়তো ভুলে গেছে। আজিজ আহমেদের পায়ের ব্যথা বেড়েছে। পা ফুলে উঠেছে।
কমল তার বাবার পাশে বসে আছে
কমল তার বাবার পাশে বসে আছে। কাছাকাছি বসেছে। সালেহ ইমরান ইচ্ছা। করলেই ছেলের গায়ে হাত রাখতে পারেন। তবে এই কাজ তিনি কখনো করবেন না। Autistic শিশুরা গায়ে হাত রাখা খুব অপছন্দ করে। তারা নিজেরা অন্যদের গায়ে হাত রাখে না। অন্যদেরও তাদের গায়ে হাত দিতে দেয় না। শরীরে হাত দেয়াকে তারা মনে করে তাদের নিজস্ব ভুবনে আক্রমণ।
কমলের দৃষ্টি স্থির এবং কিছুটা বিষণ্ণ। সে তাকিয়ে আছে টিভি স্ক্রিনের দিকে। আজ মুভি নাইট। সব ঠিক করা আছে। এখনই ছবি শুরু হবে। রিমোট কন্ট্রোল সালেহ ইমরানের হাতে। ছবির নাম The Ninth Gate. রোমান পলনস্কির ছবি। সালেহ ইমরান ছবির বিষয়বস্তু নিয়ে কিছুটা চিন্তিত। ভূত প্রেতের ছবি হলে কমলের সমস্যা হবে। সে লজিক দিয়ে যখন কিছু ব্যাখ্যা করতে পারে না তখনই অস্থির বোধ করে। সালেহ ইমরান ছবি শুরু করার আগে সবসময় কিছুক্ষণ ছেলের সঙ্গে কথা বলেন। কথা বলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
হ্যালো কমল!
হ্যালো।
আমি কি অল্প কিছু সময়ের জন্যে তোমার পিঠে হাত রাখতে পারি?
No.
সন্তানের পিঠে হাত রেখে কথা বলা একজন পিতার জন্যে খুবই আনন্দের ব্যাপার।
আনন্দের ব্যাপার কেন?
পৃথিবীর সব বাবাই সন্তানের প্রতি তার স্নেহ দেখাতে চান। সন্তানকে স্পর্শ করা স্নেহ প্রদর্শনের অংশ।
তুমি আমার পিঠে হাত রেখে স্নেহ দেখাবে। কাকে দেখাবে? এখানে। আমরা দুজন ছাড়া কেউ নেই। কে দেখবে?
আমরা দেখব।
আমরা দুজন তো স্নেহের ব্যাপারটা জানি। আমাদের আবার জানানোর দরকার কী?
তুমি যখন কাউকে ভালোবাস তখন শুধু একবার I love you বলো না। বারবার বলো। একবার বললেই তো হয়। বারবার বলো কেন?
কমল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, LOVE শব্দটা চব্বিশভাবে বলা। যায়।
সালেহ ইমরান বললেন, চব্বিশভাবে মানে? বুঝতে পারছি না।
কাগজে লিখলে বুঝতে পারবে।
কাগজে লিখে আমাকে দেখাও।
সালেহ ইমরান কাগজ এনে দিলেন। কমল অতি দ্রুত লিখতে লাগল। LOVE LVOE LEOV OLVE OVLE OVEL…
সালেহ ইমরান বললেন, আর লিখতে হবে না, বুঝতে পারছি।
কমল বলল, SORRY শব্দটা ষাটভাবে লেখা যায়। তবে আমি একজনকে উনষাটভাবে বলেছি।
ষাটভাবে বলো নি কেন?
আমার ইচ্ছা।
সেই একজনের নাম কি মতিন?
হ্যাঁ। সে মনে হয় আমার SORRY বুঝতে পারে নি।
বুঝতে পেরেছে। আমাকে বলে গেছে।
সে আর আসবে না?