লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে।
লিগামেন্টটা কী?
নিজেও পরিষ্কার জানি না। ডাক্তাররা জানে।
সারতে কতদিন লাগবে?
মতিন হতাশ ভঙ্গি করে বলল, এই জীবনে সারবে বলে মনে হচ্ছে না। বাকি জীবন ক্র্যাচে ভর দিয়েই চলতে হবে। এখনো সময় আছে, ভেবে দেখ।
কী ভেবে দেখব?
পঙ্গু স্বামী নিয়ে সংসার করতে পারবে কি-না।
তৌহিদার কান্না পাচ্ছে। সে চেষ্টা করছে চোখের পানি আটকাতে। বেশিক্ষণ পারবে এরকম মনে হচ্ছে না। তার ইচ্ছা করছে এক্ষুনি ছুটে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে কাঁদে। মানুষটাকে দরজার কাছে ফেলে যেতেও ইচ্ছা করছে না। বেচারা হাঁটতে পারছে না, তার উচিত সাহায্য করা। সে যদি এখন বলে, আপনি আমার শরীরে ভর দিয়ে ঘরে ঢুকুন, তাহলে কি অন্যায় হবে?
অন্যায় হলে হবে। লোকে তাকে খারাপ ভাবলে ভাববে। সে কিচ্ছু কেয়ার করে না।
মতিন হঠাৎ বিস্মিত হয়ে লক্ষ করল, তৌহিদা অন্যদিকে ফিরে কাঁদছে। তার প্রধান চেষ্টা কান্না আটকানোর। সে তা পারছে না। কান্না থামানোর প্রক্রিয়ায় সমস্ত শরীর ফুলে ফুলে উঠছে।
মতিন বলল, কাঁদছ কেন? সমস্যা কী?
তৌহিদা ছুটে পালিয়ে গেল।
সালেহা ছোট ভাইয়ের অবস্থা দেখে মনে হলো খুশি হয়েছেন। তাঁর চোখে মখে আনন্দ আনন্দ ভাব। তিনি বললেন, তোর যে এই অবস্থা হবে আমি জানতাম। তোর দুলাভাইকে বলেছি। বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করে দেখিস।
মতিন বলল, দুলাভাইকে কী বলেছ?
বলেছি যে তোর একটা বিপদ হবে।
বুঝলে কীভাবে? টেলিপ্যাথি?
স্বপ্নে দেখেছি। শেষরাতের স্বপ্ন। দেখলাম সাদা রঙের একটা সাপ আমার বাঁ পায়ে ছোবল দিয়েছে।
সাপ তোমার পায়ে ছোবল দিয়েছে, স্বপ্নের হিসাবে তোমার পায়ের লিগামেন্ট ছেড়ার কথা। আমারটা ছিঁড়ল কেন?
তৌহিদা এই কথায় খুব মজা পেল। একটু আগেই সে কেঁদে এসেছে। অশ্রুপাতের চিহ্ন এখন আর তার চেহারায় নেই।
সালেহা বললেন, নিজের উপর স্বপ্ন দেখলে অন্যের উপর ফলে। আমি যদি স্বপ্নে দেখি আমি মারা যাচ্ছি, তাহলে আমি ঠিকই বেঁচে থাকব। আমার নিকট আত্মীয়ের মধ্যে কেউ মারা যাবে।
মতিন বলল, আমার পায়ের লিগামেন্ট ফিগামেন্ট ছিঁড়ে একাকার, আর তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুশি। মুখভর্তি হাসি।
সালেহা বললেন, অবশ্যই আমি খুশি। এই অবস্থায় তোকে আমি ছাড়ব না। এখানে রেখে দেব। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত যেতে পারবি না।
সর্বনাশ! তোমার এই দুই রুমের বাড়িতে আমি ঘুমাব কোথায়?
তুই ঘুমাবি তৌহিদার ঘরে।
বিয়ের আগেই তার সঙ্গে ঘুমানো কি ঠিক হবে?
তৌহিদা এই কথায় এতই আনন্দ পেল যে, হাসির দমকে তার শরীর ফুলে ফুলে উঠতে লাগল। সালেহা ভাইকে ধমক দিলেন ফাজলামি কথা আমার সঙ্গে বলবি না। আমি তোর দুলাভাই না। তুই তৌহিদার ঘরে ঘুমাবি, তৌহিদা থাকবে আমার সাথে। আর তোর দুলাভাই ড্রয়িংরুমের সোফায় ঘুমাবে। সে যেখানে ইচ্ছা সেখানে ঘুমাতে পারে।
মতিন বলল, তাহলে তো সব সমস্যারই সমাধান। আমার ক্ষিধে লেগেছে। রান্নাবান্নার আয়োজন কর।
সালেহা বললেন, দুনিয়ার বাজার এনেছিস। রাঁধতে সময় লাগবে। আচ্ছা, তুই তিনটা গলদা চিংড়ি কোন হিসাবে কিনলি?
তোমাদের হিসাবে কিনেছি। দুলাভাইয়ের জন্যে একটা, তোমার জন্যে একটা, আর তৌ-এর জন্যে একটা। আমি গলদা চিংড়ি খাই না। হাই কলেস্টরেল।
তৌ ফৌ ডাকবি না। শুনতে জঘন্য লাগে। তৌহিদা, তুমি জোগাড়যন্ত্র করে দাও। আজ আমি রাঁধব।
মাতিন বলল, আপা, তুমি তো বাঁধতে পার না। সব নষ্ট করবে। তৌ রাঁধুক।
কথা বাড়াবি না। গোসলে যা। তোর গা দিয়ে ঘামের গন্ধ বের হচ্ছে।
মতিন বলল, মগভর্তি করে এককাপ চা দাও তো আপা। চা খেতে খেতে গোসল করব। শরীরের ভেতর ঢুকবে গরম চা, বাইরে ঠাণ্ডা পানি। ঠাণ্ডা গরমে মিলে সিরিয়াস রি-অ্যাকশন।
মতিন মগভর্তি চা নিয়ে বাথরুমে ঢুকেছে। রান্নাঘরে তৌহিদা এবং সালেহা। সালেহা সকালবেলাতেই দাঁতের ব্যথা এবং পেটের ব্যথায় কুঁ কুঁ করছিলেন। এখন মহানন্দে রান্নাবান্না করছেন। তৌহিদার সঙ্গে হাসিমুখে গল্প করছেন। গল্পের বিষয়বস্তু একটাই–মতিন।
আমার ভাইটার কীরকম পাগলা স্বভাব দেখেছিস? চা খেতে খেতে গোসল করবে। বিয়ের পর কী যে যন্ত্রণায় তুই পড়বি! তোর কলিজা ভাজা ভাজা করে দেবে। ঠিক বলছি না?
হুঁ।
ছোটবেলায় সে কিন্তু খুব শান্ত ছিল। যতই তার বয়স হচ্ছে ততই সে দুষ্ট প্রকৃতির হচ্ছে। তবে যত দুষ্টই হোক তার অন্তর দিঘির পানির মতো।
পরিষ্কার পানি, না ময়লা পানি?
তুইও দেখি মতিনের মতো কথা বলা শুরু করেছিস। ময়লা পানি কী জন্যে হবে? দিঘির টলটলা পানি।
তৌহিদা সালেহার কথায় বাধা দিয়ে হঠাৎ নিচু গলায় বলল, আপা, আমাদের বিয়েটা কবে হবে? বলেই লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল।
সালেহা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। তৌহিদা মরমে মরে যাচ্ছে। এরকম একটা লজ্জার কথা সে কীভাবে বলে ফেলল? তার কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? মনে হয় মাথা খারাপই হচ্ছে। মাথা খারাপ মানুষ দিনেদুপুরে চোখের সামনে অদ্ভুত জিনিস দেখে। সেও দেখে। কয়েকদিন আগে সে তার নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়েছিল। ঘুমাচ্ছিল না, জেগেই ছিল। হঠাৎ শুনল মতিনের গলা। মতিন বিছানার পাশ থেকে বলছে মিস তৌ, অসময়ে ঘুমাচ্ছ কেন? সে চমকে পেছনে ফিরে দেখে মতিন চেয়ারে বসে আছে। তার মুখ হাসি হাসি। তৌহিদা ধড়মড় করে উঠে বসে দেখে কিছু নেই। তৌহিদার ধারণা, সে কিছুদিনের মধ্যেই পুরোপুরি পাগল হয়ে যাব। পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে বেড়াবে, কিংবা হাতে একটা লাঠি নিয়ে রিকশা কন্ট্রোল করবে। রাতে চাদর মুড়ি দিয়ে ফুটপাতে শুয়ে থাকবে।