ক্র্যাচ জোড়া নিয়ে যা, আমার দেখতে ভালো লাগছে না।
নিয়ে যাচ্ছি।
মতিনের কোনো খবর পাওয়া গেছে? তার সঙ্গে আমার জরুরি আলাপ ছিল।
এক সপ্তাহ ধরে তার কোনো খোজ নেই। সে কোথায় গেছে জানি না। তার মেসে গিয়েছিলাম, সেখানে নেই। মোবাইলে অনেকবার টেলিফোন করেছি। রিং হয় কিন্তু ধরে না।
ও আচ্ছা।
এখন বলো, মতিনের জ্ঞান-বুদ্ধি কি ঠিক আছে? না-কি সেও জ্ঞান-বুদ্ধি শূন্য।
আজিজ আহমেদ জবাব দিলেন না।
নিশু চলে গেল। সঙ্গে ক্র্যাচ নিয়ে গেল না। আজিজ আহমেদ রাগী চোখে ক্র্যাচের দিকে তাকিয়ে সময় পার করতে লাগলেন। ডান পায়ে তিনি ভালোই ব্যথা পেয়েছেন। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় সমস্যাটা হয়েছে। যে ধাপে পা ফেলতে চেয়েছেন সেই ধাপে না ফেলে তার পরের ধাপে ফেলেছেন। মস্তিষ্ক কো-অর্ডিনেটে সমস্যা করেছে। মস্তিষ্কের বয়স হয়েছে। সে ক্লান্ত। এ ধরনের ভুল সে আরো করবে। তিনি রাস্তা পার হচ্ছেন, দৈত্যের মতো ট্রাক আসছে। হন বাজাচ্ছে। মস্তিষ্ক তাকে সাবধান করতে ভুলে যাবে। লোকজন আহা আহা করে ছুটে আসবে। একজন ছুটবে ট্রাক ড্রাইভার এবং হেল্পারের পেছনে। ট্রাক ড্রাইভার ধরা পড়বে না, কিন্তু অল্পবয়স্ক হেল্পারটা ধরা পড়ে যাবে। তাকে তৎক্ষণাৎ মেরে ফেলা হবে। যারা তাকে মেরে ফেলবে তারা কিন্তু খুবই স্বাভাবিক মানুষ। অফিস শেষে বাসায় ফিরে মেয়েকে অঙ্ক শেখায়। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বেইলি রোডে নাটক দেখতে যায়।
চাচাজি!
আজিজ আহমেদ ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। এত চমকানোর মতো কিছু হয় নি। তার সামনে মতিন দাঁড়িয়ে আছে। মতিনের হাতে বাজারের ব্যাগ। ব্যাগভর্তি বাজার। দুই কেজি খাসির মাংস, খাসির কলিজা। বিশাল সাইজের একটা ইলিশ। তিনটা গলদা চিংড়ি।
মতিন বলল, চাচাজি, আপনি কি ধ্যান করছেন? কতক্ষণ ধরে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আপনি দেখেও দেখছেন না। কী চিন্তা করছিলেন?
কিছু না।
আপনার পায়ে কী হয়েছে?
পায়ে কিছু হয় নাই। সামান্য মচকেছে।
ক্র্যাচ-ফাচ দেখতে পাচ্ছি।
নিশুর কাণ্ড। তুমি অবশ্যই আজ যাবার সময় ক্র্যাচ দুটি নিয়ে যাবে। It is an order.
মতিন বলল, চাচাজি, আপনি কি কোনো কারণে রেগে আছেন?
আমি রেগে আছি। যতবার ক্র্যাচ দুটি চোখে পড়ছে ততবারই রাগ বাড়ছে।
চাচাজি, আপনি মাথা থেকে ক্র্যাচের ব্যাপারটা দূর করে দিন। আমি যাবার সময় এই দুই বস্তু নিয়ে যাব। কিছুদিন ক্র্যাচ বগলে দিয়ে হাঁটব।
আজিজ আহমেদ ভুরু কুঁচকে বললেন, কেন?
পঙ্গু জীবন যাপন করে দেখি কেমন লাগে। মানুষদের সহানুভূতি নিয়ে জীবন যাপন। পঙ্গুদের প্রতি সমাজের সহানুভূতি আছে। চাচাজি, আপনি কি জানেন, পঙ্গুদের পৃথিবীর কোনো দেশেই ক্যাপিটেল পানিশমেন্ট দেয়ার বিধান নেই?
জানি না তো!
বাংলাদেশেও নেই।
তুমি এতদিন ছিলে কোথায়?
ডুব দিয়ে ছিলাম চাচাজি। এখন ভেসে উঠেছি।
আবার কবে ডুব দেবে?
জানি না। চাচাজি, চলুন রান্নাবান্নায় নেমে পড়ি। হঠাৎ কিছু টাকা পেয়ে গলাম, বাজার নিয়ে এসেছি। একটা ইলিশ মাছ এনেছি ফাটাফাটি। সে ইলিশ সাম্রাজ্যের রানী। খাঁটি পদ্মার ইলিশ। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছাকাছি ধরা পড়েছে। ইলিশের নাক পর্যন্ত বোঁচা। মনে হয় ব্রিজের স্প্যানের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে।
আজিজ আহমেদ বিরক্ত মুখে বললেন, আজ রান্নাবান্না হবে না। নিশু না করে দিয়েছে। সে না-কি খাবার নিয়ে আসবে। আমি নিশুকে রাগাতে চাচ্ছি না।
বাজার কি ফ্রিজে রেখে দেব?
ফ্রিজ নষ্ট।
আমি কি চলে যাব?
চলে যাও। ক্র্যাচ সঙ্গে নিয়ে যাও। বাজার যা এনেছ তাও নিয়ে যাও।
আপনার মেজাজ কি বেশি খারাপ?
হুঁ।
মেজাজ কখন ঠিক হবে কিছু বুঝতে পারছেন? ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে মেজাজ ঠিক হলে বসতাম।
তুমি চলে যাও। বাজার যা এনেছ নিয়ে যাও।
আপনি রাগ করেছেন নিশুর উপর, সেই রাগ দেখাচ্ছেন আমাকে। এটা কি ঠিক হচ্ছে?
আজিজ আহমেদ জবাব দিলেন না।
সিগারেট খাবেন চাচাজি? একটা সিগারেট দেই। প্রচণ্ড রাগের সময় সিগারেট ধরালে রাগটা কমে। এটা পরীক্ষিত।
আজিজ আহমেদ টেবিলে রাখা খবরের কাগজ হাত বাড়িয়ে নিলেন। এই কাজটি করার জন্যে তাঁকে সামান্য ঝুঁকতে হলো। সেই সামান্য ঝুঁকিতেই পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা বোধ হলো। গরম পানিতে পা ডুবিয়ে রাখলে আরাম হতো। মতিনকে বললেই সে গরম পানি করে দিবে। তার কাউকেই কিছু বলতে ইচ্ছা। করছে না। তার ইচ্ছা করছে বাড়িঘর ছেড়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা করতে।
মতিন ক্র্যাচে ভর দিয়ে ঢাকা শহরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। লোকজন তার দিকে তাকাচ্ছে, তবে মতিন যে-রকম ভেবেছিল সেরকম হচ্ছে না। কেউ তাকে বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না। গাঢ় সহানুভূতির তেমন কোনো দৃষ্টি তার প্রতি নেই। হাতে বাজারের ব্যাগটাও সমস্যা করছে। ক্র্যাচে হুকের মতো কিছু থাকলে ভালো হতো। সেই হুকে বাজারের থলি ঝুলানো যেত। যারা ক্র্যাচ নিয়ে ঘোরাফেরা করে তাদের মাথায় এই বুদ্ধিটা আসে না কেন!
এক পা দুলিয়ে ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটার প্রক্রিয়া মতিন রপ্ত করে ফেলেছে। তার ভালো লাগছে। দুটি ক্র্যাচে ভর দিলে শরীর দোলনার মতো সামান্য দোলে–তখন ভালো লাগে। মতিন ঠিক করে ফেলল সে হেঁটে হেঁটেই বোনের বাসায় যাবে। সময় লাগবে? লাগুক। তার হাতে অফুরন্ত সময়।
দরজা খুলল তৌহিদা। মতিন বলল, মিস তৌ, বাজারের ব্যাগটা ধর তো।
তৌহিদা বাজারের ব্যাগ ধরল না। হতভম্ব গলায় বলল, আপনার পায়ে কী হয়েছে?