মতিন বলল, তোমার পড়াশোনা কী?
রহমত বলল, ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছি।
ভালো করেছ, এখন ট্রলি নিয়ে বিদায় হও, আমি ঘুমাব।
রহমত বলল, বড় সাহেব কিছুক্ষণ আগে ফিরেছেন। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন।
কী কথা?
উনি কী কথা বলবেন সেটা তো স্যার আমি জানি না। তবে মনে হয় আজকের ঘটনা নিয়ে কথা বলবেন। এই যে আপনার মাথা ফাটল, স্টিচ দেয়া। লাগল।
মতিন বলল, তুমি তোমার বড় সাহেবকে বলল যে, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি।
রাতে আর কথা হবে না।
মিথ্যা কথা বলব স্যার?
তুমি মিথ্যা বলো না?
নিজের কারণে বলি, অন্যের কারণে বলি না।
তাহলে যাও সত্য কথাটাই বলো।
সত্য কথাটা কী?
সত্য কথাটা হলো, আমি এখন কথা বলতে চাচ্ছি না। একটা ঘটনা ঘটেছে, ঘটনাটা হজম করছি। গুরুপাক ঘটনা তো, হজম করতে সময় লাগছে। এই কথাটা গুছিয়ে বলতে পারবে?
পারব স্যার।
মতিন শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বলল, রহমত, তোমার কি কফি খাওয়ার অভ্যাস আছে?
জি স্যার আছে।
রাত দশটার পর কফি খাও?
জি স্যার খাই।
তাহলে চেয়ারটা টেনে আমার সামনে বসো। কফি খাও। তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করি।
রহমত বলল, চেয়ারে বসতে হবে না স্যার। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কফি খাব।
মতিন বলল, তুমি চেয়ারে বসে আরাম করে কফি খাও। এতে আমার সম্মানের কোনো হানি হবে না। আমি কোনো সম্মানিত ব্যক্তি না। বেকার গ্রাজুয়েট। বেকার গ্রাজুয়েটকে সম্মান করতে হয় না।
রহমত চেয়ারে বসতে বসতে বলল, শুকরিয়া।
মতিন বলল, কতদিন ধরে এ বাড়িতে আছ?
রহমত কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, তিন বছর।
কমল ছেলেটির সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে?
আছে।
যোগাযোগটা কোন পর্যায়ের? ভালো যোগাযোগ?
জি স্যার। উনি আমাকে ডাকেন আংকেল ফলিয়া।
ফলিয়াটা কে?
জানি না। উনি নিজের মনে অনেক কিছু বানান।
তোমার সঙ্গে তার গল্প হয়?
জি স্যার।
কী নিয়ে গল্প?
উনি যখন যেই বই পড়েন সেই বই নিয়ে গল্প।
ফিবোনাক্কি সিরিয়েল কী জানেন?
জি স্যার। ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, …। ছোট সাহেব আমাকে বলেছেন, আমি মুখস্থ করেছি।
এই সংখ্যাগুলির বিশেষত্ব কি তুমি জানো?
জানি স্যার। ছোট সাহেব বলেছেন, এর প্রতিটি সংখ্যা আগের দুটা সংখ্যার যোগফল।
এরকম সিরিয়েল আরো আছে?
জি স্যার আছে। যেমন ১, ৪, ৯, ১৬, ২৫…
এর বিশেষত্ব কী?
বিশেষত্ব জানি না স্যার।
অঙ্ক ফঙ্ক ছাড়া আর কী নিয়ে কথা হয়?
নানান বিষয়।
আজ কথা হয়েছে?
জি হয়েছে।
কী নিয়ে কথা হলো?
বিজ্ঞানের কথা।
বিজ্ঞানের কথাটা কী?
শব্দের গতি।
শব্দের গতি মানে কী?
রহমত কফির কাপ ট্রলিতে রাখতে রাখতে বলল, শব্দ ঘণ্টায় সাতশ পঞ্চাশ মাইল বেগে যায়। শব্দের গতি এর চেয়ে বেশি হলে আমাদের কী সুবিধা হতো এই নিয়ে কথা।
কী সুবিধা হতো?
ছোট সাহেব বলেছেন কী সুবিধা হতো। আমি বুঝতে পারি নাই। উনার বেশিরভাগ কথাই আমি বুঝতে পারি না।
কিন্তু তুমি ভাব কর যেন বুঝতে পারছ।
জি ভাব করি, কিন্তু ছোট সাহেব বুঝতে পারেন যে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
আজকের ঘটনা নিয়ে কথা হয়েছে? আমার মাথা ফাটার ঘটনা?
জি-না।
আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি এখন যাও।
রাতে স্ন্যাকস জাতীয় কিছু খাবেন স্যার? দিয়ে যাব?
না, শুধু এসিটা এমন করে দাও যেন ঘর আরো ঠাণ্ডা হয়।
একুশ সেন্টিগ্রেডে দেয়া আছে।
এমন কর যেন শীতে কাঁপতে কাঁপতে ঘুমাতে পারি।
আঠারো দেই?
দাও।
রহমত বলল, টেম্পারেচার কীভাবে কন্ট্রোল করে আপনাকে শিখিয়ে দেই স্যার–যদি বেশি ঠাণ্ডা লাগে তাহলে নিজে নিজে ঠিক করতে পারবেন।
না। আমি শিখব না। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা শিখতে চায় না। আমি তাদের দলে।
রহমত ঘর থেকে বের হবার আগে আগে অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলল, বড় সাহেব লাইব্রেরি ঘরে আছেন। দুই মিনিটের জন্যে কি আসবেন? বড় সাহেব খুব খুশি হবেন।
মতিন হাই তুলতে তুলতে বলল, উনার সঙ্গে এখন দেখা হলে আমি খুব অখুশি হবো। আমার কাছে আমার খুশিটা অনেক ইম্পোর্টেন্ট। কাজেই দেখা হবে না।
জি আচ্ছা স্যার।
ঘর অতি দ্রুত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মতিনের গায়ের চাঁদরে শীত মানছে না। কাবার্ডে হলুদ রঙের একটা কম্বল আছে। মনে হচ্ছে কম্বল গায়ে দিতে হবে। মতিনের মোবাইল টেলিফোন আবার বাজছে। ধরব না ধরব না করেই মতিন টেলিফোন ধরল। তার ধারণা ছিল নিশু টেলিফোন করেছে। তা-না, টেলিফোন করেছেন মতিনের বড় বোন সালেহা। তাঁর গলা কাঁপা কাঁপা।
এই নিয়ে তোকে এগারোবার টেলিফোন করলাম। তুই কোথায়?
মতিন বলল, বড় আপা, আমি একটা ডিপ ফ্রিজের ভেতর শুয়ে আছি।
সালেহা আতঙ্কিত গলায় বললেন, কোথায়?
ডিপ ফ্রিজের ভেতর। তোমরা যেখানে মাছ-মাংস রেখে বাসি কর সেখানে।
তোর কোন কথাটা সত্যি, কোনটা মিথ্যা, কোনটা ঠাট্টা কোনটা সিরিয়াস আমি কিছুই বুঝি না। এখন আর বুঝতে চাই না। তৌহিদার কাছ থেকে শুনলাম তুই বাসায় এসেছিলি। কী জন্যে?
ফ্রিজের ভেতর ঢোকার আগে তোমার কাছ থেকে দোয়া নিতে এসেছিলাম।
ফাইজলামি রেখে সত্যি কথা বল, তোর টাকার দরকার?
না।
দরকার থাকলে বল।
দরকার নেই।
তুই তৌহিদাকে কিছু বলেছিস?
কী বলব?
সেটা তো আমি জানি না। কিছু বলেছিস কি-না? সে কান্নাকাটি করছে। আমি যতবার বলি, কী হয়েছে, ততবারই ফুঁপিয়ে ওঠে। তোদের মধ্যে কোনো সমস্যা হয়েছে?
সমস্যা হবার জন্যে সামান্য হলেও ঘনিষ্ঠতা লাগে। সেই ঘনিষ্ঠতা তো তৌ-এর সঙ্গে আমার নেই।
তৌটা কে?
তৌহিদাকে ছোট করে তৌ ডাকি। তৌ যে হবে আমার বৌ।