শিশুটি বলল, তাকে জিজ্ঞেস করো ফিবোন্নাক্কি সিরিজের ফোর্থ সংখ্যা কী?
মতিন হতভম্ব হয়ে মুনার দিকে তাকাল। ফিবোনাক্কি সিরিজের নাম সে তার জনো শোনে নি। মুনা তিনটা আঙুল বের করে মতিনকে দেখিয়ে ইশারা করছেন। মতিন যন্ত্রের মতো বলল, তিন।
তখনি কমল পার্টিশন ধরে দাঁড়াল। সে তাকিয়ে আছে মতিনের দিকে।
মতিন একটা ধাক্কার মতো খেল। এত সুন্দর শিশু সে তার জীবনে দেখে নি। কোনোদিন দেখবে এরকমও মনে হচ্ছে না। গায়ের রঙ কাঁচা হলুদের মতো বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। মতিন কাঁচা হলুদ কখনো দেখে নি, তবে এখন তার মনে হচ্ছে এই শিশুটির গায়ের রঙকেই কাঁচা হলুদ বলে। পাতলা ঠোঁট। দেখে মনে হচ্ছে একটু আগে হালকা গোলাপি রঙ দিয়ে কেউ ঠোঁট এঁকেছে। বড় বড় চোখ। সেই চোখ শান্ত এবং হয়তো বা কিছুটা বিষাদ মাখা। মাথাভর্তি এলোমেলো কোঁকড়ানো চুল। মতিনের ইচ্ছা করছে চিরুনি এনে ছেলের চুল আঁচড়ে দিতে।
মতিন বলল, কেমন আছ?
কমল বলল, পরাখা মিতু। পরাখা বখু মিতু!
মতিন হকচকিয়ে গেল। এর মানে কী? হিজিবিজি কী কথা সে বলছে? মতিন মুনার দিকে তাকাল। মুনা কিছু বলছেন না।
কমল বলল, ওযা লেচ। ওযা লেচ নিক্ষুএ।
মতিন এই বিচিত্র ভাষার অর্থ হঠাৎ করেই বের করে ফেলল। ছেলেটা উল্টো করে বাক্যগুলি বলছে।
পরাখা মিতু হলো–তুমি খারাপ। পরাখা বখু মিতু হলো–তুমি খুব খারাপ। একটু আগে সে বলেছে ওযা লেচ, এর অর্থ চলে যাও। ওযা লেচ নিক্ষুএ-র অর্থ এক্ষুনি চলে যাও।
যে উল্টো করে বাক্য বলছে তার সঙ্গে কথা বলতে হলে উল্টো করে বাক্য বলা দরকার। মতিন কী বলবে বুঝতে পারছে না। তুমি কেমন আছ? এই কথা জিজ্ঞেস করা যায়। তুমি কেমন আছর উল্টো কী হবে? ছআ নমকে মিতু? ঠিক আছে তো? মনে মনে পুরো বাক্য উল্টানো মুশকিল। কাগজে লিখতে পারলে ভালো হতো। কাগজে লিখে আয়নায় ধরা। আয়নায় লেখা যেভাবে আসে সেভাবে বলা।
মতিন বলল, ছআ নমকে মিতু?
কমল স্বাভাবিক গলায় বলল, আমি ভালো আছি। থ্যাংক য়্যু ফর আসকিং। ফিবোনাক্কি সিরিজের ফিফথ টার্মটা কী? সে এখন আর মা
কমল উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করছে। তবে সে এখন আর সামনের দিকে তাকিয়ে নেই। সে তাকিয়ে আছে তার হাতের গোল বলটার দিকে। বলটা আসলে একটা মিনিয়েচার গ্লোব। কাচের ভেতরের স্থলভাগ ও জলভাগ ঘুরছে। বলটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় পৃথিবী ঘুরছে, যদিও কাচের বলটা স্থির।
কমল আবারো বলল, দেরি করছ কেন? বলো ফিবোনাক্কি সিরিজের ফিফথ টার্মটা কী?
মতিন তাকাল মুনার দিকে। মুনা কিছু বলছেন না তবে তাকে সামান্য চিন্তিত মনে হচ্ছে। আঙুলের ইশারায় কিছু দেখালে মতিন সেখান থেকে কিছু বলতে পারত। তিনি কিছু দেখাচ্ছেন না। মতিন বলল, আমি জানি না।
কমল বলল, তুমি জানো না?
মতিন বলল, না। ফিবোনাক্কি সিরিজ কী, এইটাই আমি জানি না।
কমল বলল, ফোর্থ টার্মটা তো তুমি ঠিক বলেছ। তখন কি কেউ তোমাকে সাহায্য করেছে?
মতিন বিড়বিড় করে বলল, হ্যাঁ।
কমল বলল, তুমি একজন লায়ার। আমি লায়ার পছন্দ করি না।
মতিন চুপ করে রইল। কমল বলল, তুমি আমার সঙ্গে ট্রিকস করছ। আমি ট্রিকস পছন্দ করি না।
কমলের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎচমকের দ্রুততায় একটা ঘটনা ঘটল। কমল তার হাতের গ্লোব ছুড়ে মারল। লাগল বাঁ-দিকের কপালে। তার কাছে মনে হলো তার মাথা ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। সে হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। তারপর আর কিছু মনে নেই।
রাত দশটা।
মতিন বিছানায় শুয়ে আছে। রাজকীয় শয়ন বলা যেতে পারে। ঘরে এসি চলছে। গায়ে রাখা হালকা চাঁদরেও শীত মানছে না। মনে হচ্ছে চাদরটা আরেকটু ভারি হলে ভালো হতো।
বালিশের পাশে রাখা মোবাইল টেলিফোন বেশ কয়েকবার বেজেছে। মতিনের ধরতে ইচ্ছা করছে না। আরামদায়ক আলস্যে তার শরীর ডুবে আছে। উলিফোনে কথা বলে সে আলস্য নষ্ট করা ঠিক না। টেলিফোনে কথা বলার কাজটা যথেষ্টই পরিশ্রমের। পরিশ্রমটা মানসিক।
টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে। রিংটোনে সুন্দর বাজনা। এই বাজনা নিশুর ঠিক করে দেয়া। কিছুদিন পর পর সে বাজনা বদলে দেয়। এই ব্যাপারে তার যুক্তি হচ্ছে, কাপড় যেমন নোংরা হয়ে যায় বাজনাও তেমন নোংরা হয়। কাপড় ধোয়ার ব্যবস্থা আছে, বাজনা ধোয়ার ব্যবস্থা নেই বলেই বাজনা বদল।
কে বারবার টেলিফোন করছে? বোতাম টিপে ইচ্ছা করলেই জানা যায়, সেই ইচ্ছাটাও কেন জানি করছে না। যে তাকে ডাকছে সে ডাকতে থাকুক।
দরজায় ক্যাচ ক্যাচ শব্দ হচ্ছে। এটা একটা বিস্ময়কর ঘটনা। এমন আধুনিক বাড়ির দরজা হবে মাখনের মতো। নিঃশব্দে খুলবে। নিঃশব্দে বন্ধ হবে। ক্যাচক্যাচানি হবে না।
দরজা খুলেছে রহমত। রহমত তিনতলার খেদমতগার। তার শরীর কুস্তিগিরের মতো। কুস্তিগিরদের চোখের দৃষ্টিতে বোকা বোকা ভাব থাকে। কাঠিন্য থাকে না। রহমতের চোখের দৃষ্টি কঠিন। রহমতের সামনে চমৎকার একটা ট্রলিতে এককাপ কফি। এই কফির কাপ হাতে করে আনা যেত। তাতে অবশ্যি বড়লোকি কায়দার প্রকাশ ঘটত না।
মতিন বলল, আমি রাত দশটার পর চা-কফি কিছুই খাই না। এত রাতে চা-কফি খেলে ঘুম হয় না। ক্যাফিনঘটিত সমস্যা।
রহমত বলল, ডিকেফিনেটেড কফি দিব স্যার?
বেয়ারা শ্রেণীর কারো মুখে ডিকেফিনেটেড শব্দটা শুনলে ধাক্কার মতো লাগে। সে এই শব্দটা যে শুনে শুনে শিখেছে তা-না। সে এই শব্দের মানেও জানে।