তৌহিদা চাপা গলায় শুধু বলল, জি আচ্ছা। মতিন চলে যাবার পরের এক ঘণ্টা সে তার নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল।
কথা মন দিয়ে শুনছেন
আপনি কি আমার কথা মন দিয়ে শুনছেন?
মতিন থতমত খেয়ে বলল, অবশ্যই অবশ্যই। যদিও সে মন দিয়ে শুনছিল না। তার সামনে বসা মুনা নামের অস্বাভাবিক রূপবতী মহিলা তার মধ্যে কিছু সমস্যা সৃষ্টি করেছে। সে মহিলার মুখের দিকে ঠিকমতো তাকাতে পারছে না, আবার চোখও ফিরিয়ে নিতে পারছে না। মুনার আজকের পোশাক আরো উগ্র। আবার এ-ও হতে পারে–ইনি যে সমাজে বাস করেন সেই সমাজে এই পোশাকই শালীন পোশাক।
মতিন সাহেব!
জি ম্যাডাম।
কমলের সঙ্গে আপনার দেখা করানোর আগে তার আচার-আচরণ সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা দেয়া প্রয়োজন। তাই না?
জি ম্যাডাম।
মতিন জি ম্যাডাম বলেছে ঠিকই, কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ বুঝতেই পারল না কমলটা কে। কমল নামটি অনেকবার তার সামনে উচ্চারিত হয়েছে। সে অটিসটিক শিশু কমলের সঙ্গী হিসেবে চাকরি পেয়েছে, এই ব্যাপারগুলি তার মাথায় স্থায়ী হচ্ছে না। তার সামনে বসা মহিলার রূপ আরেকটু কম হলে মতিনের জন্যে সুবিধা হতো। ব্লাউজের কাট এত না হলেও সুবিধা হতো। ব্লাউজের নিচে মহিলা কিছু পরেন নি তা বোঝা যাচ্ছে। এই সমাজে বোধহয় ব্রা পরার চল নেই।
মতিন সাহেব!
জি ম্যাডাম।
একটা ব্যাপার মাথায় রাখবেন, কমল অসম্ভব বুদ্ধিমান। সে অতি দ্রুত তার। বুদ্ধিতে আপনাকে বিচার করবে।
ও আচ্ছা!
আপনার ত্রুটিগুলি সে ধরতে চেষ্টা করবে। তারপর আপনার ত্রুটিগুলি সে আপনার বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে।
ত্রুটি মানে?
আপনি যদি ভীতু হন তাহলে সেটা আপনার একটা ক্রটি। আপনার ভীতিটা সে কাজে লাগাবে। আপনি যদি রাগী মানুষ হন সে আপনার রাগটা কাজে লাগাবে।
বুঝতে পারছি না।
একজন ভীতু মানুষকে সে কাবু করবে ভয় দেখিয়ে। একজন রাগী মানুষকে সে আরো রাগিয়ে দেবে। সে অগ্রসর হবে অতি ঠাণ্ডা মাথায়।
ও আচ্ছা!
আপনি যত সহজে ও আচ্ছা বললেন, বিষয়টা তত সহজ নয়। একটি Autistic শিশুর কিছু আচরণ পূর্ণবয়স্ক মানুষদের মতো।
Autistic সব শিশুই কি একরকম?
না, একেকজন একেক রকম, তবে তাদের কমন কিছু মিল আছে। যেমন, এরা অতি বুদ্ধিমান। তাদের প্রধান চেষ্টা থাকে আশেপাশের সবাইকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে। আপনাকে কিছু বইপত্র দেব, বইপত্রগুলি মন দিয়ে পড়বেন।
জি আচ্ছা।
ইন্টারনেটে এই ধরনের শিশুদের বিষয়ে বেশ কয়েকটা ওয়েবসাইট আছে, আপনি সেগুলি দেখতে পারেন।
ইন্টারনেট কীভাবে ব্যবহার করতে হয় আমি জানি না।
এমন কোনো জটিল ব্যাপার না। আপনাকে শিখিয়ে দেয়া হবে। আপনি কি এখন ছেলের সঙ্গে দেখা করার জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত?
জি ম্যাডাম।
আপনার মনে কি কোনো প্রশ্ন আছে?
মতিন ইতস্তত করে বলল, এই ধরনের শিশুরা কি ভায়োলেন্ট হয়?
মুনা বললেন, হয়। তবে বেশিরভাগ এই ভায়োলেন্স নিজের প্রতি দেখায়। অন্যের প্রতি না। কমল রেগে গিয়ে আপনাকে কামড়ে ধরবে এরকম মনে করার কোনো কারণ নেই। ভয় পাবেন না।
আমি ভয় পাচ্ছি না।
মুখে ভয় পাচ্ছি না বললেও মতিন ভয় পাচ্ছে। সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে পা থপথপ করে একটা ছেলে এসে চেয়ার ধরে দাঁড়াবে। তার চোখের দৃষ্টি অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ। সে দড়ি দিয়ে বাঁধা জন্তুর মতো থেমে থেমে বড় বড় নিঃশ্বাস নেবে। তার মুখ হা হয়ে থাকবে। মুখ থেকে মাঝে মধ্যেই লালা। গড়িয়ে পড়বে।
মুনা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আসুন আমার সঙ্গে।
মতিন উঠে দাঁড়াল, তবে তার মাথা সামান্য ঝিমঝিম করে উঠল। মুনা উঠে দাঁড়ানো মাত্র দমকা বাতাস গায়ে লাগার মতো সেন্টের গন্ধ নাকে এসে লেগেছে। গন্ধটার মধ্যেই গা ঝিম ধরানোর ব্যাপার আছে। মতিন ভেবে পাচ্ছে না, এই মহিলা উঠে দাঁড়ানো মাত্র গন্ধটা তার নাকে এসে লাগল কেন? তিনি গায়ে সেন্ট মেখেছেন, সেই সেন্ট তো বসে থাকা অবস্থাতেও গায়ে ছিল।
মতিন কমলের ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরটা বেশ বড়। মাঝখানে কাঠের পার্টিশন আছে। পার্টিশনে অতি সূক্ষ্ম কারুকাজ। নিশ্চয়ই খুব দামি জিনিস। পুরো ঘরে হালকা নীল রঙের কার্পেট। জানালার পর্দা নীল। দরজার পর্দাও নীল। মতিন
যে ঘরে দাঁড়িয়ে আছে এই ঘরটা মনে হয় কমলের খেলার ঘর। কিছু খেলনা। আছে। স্টাফড অ্যানিমেল। কম্পিউটার আছে। নিচু একটা টেবিল আছে। টেবিলে ছবি আঁকার রঙতুলি। কাগজ। বেশ কয়েকটা কাগজে গাঢ় হলুদ রঙ মাখানো।
পার্টিশনের ওপাশটা মনে হয় কমলের শোবার ঘর। বিছানার একটা কোনা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। বিছানার নিচে এবং উপরে প্রচুর বইপত্র ছড়ানো। দুটি বইয়ের নাম পড়া যাচ্ছে–FUN IN ALGEBRA, THE DARK BY PASS।
মতিন সাহেব!
জি ম্যাডাম।
আপনি পার্টিশনের এই পাশে থাকবেন। ঐ পাশে কখনো যাবেন না বা উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টাও করবেন না। কমল এটা পছন্দ করে না। একেবারেই পছন্দ করে না।
জি আচ্ছা।
মুনা গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, হ্যালো বাবু, এসো এদিকে।
পার্টিশনের ওপাশ থেকে শান্ত গলায় একটি শিশু বলল, No.
মনা বললেন, এসো বলছি। তোমার সঙ্গে একজনের পরিচয় করিয়ে দেব।
শিশুটি আগের মতোই শান্ত গলায় বলল, No,
যাকে নিয়ে এসেছি তার নাম মতিন। উনি তোমার খুব ভালো কোম্পানি হবেন। তুমি তার সঙ্গে গল্প করতে পারবে। উনি তোমার প্রশ্নের উত্তর দেবেন।