“আপনি কী বলেছেন আমার শোনার দরকার নাই।” কফিলউদ্দিন মাটিতে থুতু ফেলে বললেন, “বাপ-খাগি মা-খাগি আবাগীর বেটি ছয় মাস আমার বাড়িতে আছে, কারও খোঁজ নাই, এখন আসছেন দরদ দেখাতে? ঐ ছেমড়ি গেছে জাহান্নামে, তারে খুঁজতে হলে আপনি জাহান্নামে যান।”
রইসউদ্দিন দাঁত-কিড়মিড় করে বললেন, “দেখেন মোল্লা কফিলউদ্দিন সাহেব, আমি কোথায় যাব সেটা আমিই ঠিক করব। তবে এই মেয়ের যদি কিছু হয় তা হলে আপনি শুনে রাখুন–”
“কী শুনে রাখব?”
“আপনার গলায় ফাঁসির দড়ি লাগানোর সব প্রমাণ আমার কাছে আছে।“
কফিলউদ্দিন কুতকুতে চোখে রইসউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন আর রইসউদ্দিন রেগেমেগে সেখান থেকে বের হয়ে এলেন। গ্রামের পথে আবার দুই মাইল হেঁটে নৌকায় উঠলেন, নৌকা করে ঘণ্টাদুয়েক গিয়ে বাস, বাসে ঘণ্টাখানেক যাওয়ার পর ট্রেন। সারাদিনে দুটো ট্রেন। সকালেরটা চলে গেছে, পরের ট্রেন রাত নয়টায়, এখনও ঘণ্টাদুয়েক বাকি।
রইসউদ্দিন স্টেশনের কাছে একটা রেস্টুরেন্টে ভাত খেয়ে রেলস্টেশনের বেঞ্চে বসে রইলেন। শিউলি নামের এই বাচ্চা মেয়েটাকে কীভাবে পিশাচ মোল্লা কফিলউদ্দিনের হাত থেকে বাঁচানো যায় সেটা ভাবছিলেন। দেশ তো এখনও মগের মুলুক হয়ে যায়নি, নিশ্চয়ই কোনো-না-কোনো উপায় আছে। এমনিতে থানা-পুলিশ যদি উৎসাহ না দেখায়, নারী সংগঠন, শিশু সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন–এসব বড় বড় জায়গায় যাওয়া যাবে। তার কাছে কফিলউদ্দিনের নিজের হাতে লেখা তিন-তিনটে চিঠি আছে। কাউকে বিশ্বাস করানো কোনো ব্যাপারই না।
কী করা যায় ভেবে ভেবে রইসউদ্দিনের যখন প্রায় মাথা-গরম হয়ে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ মনে হল কেউ-একজন যেন তাঁর শার্টের কোনা ধরে টানছে। রইসউদ্দিন মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলেন আট-নয় বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে। রইসউদ্দিন বাচ্চাকাচ্চাকে খুব ভয় পান তাই একেবারে চমকে উঠলেন। কাঁপা গলায় বললেন, “কে?”
মেয়েটা দাঁত বের করে হেসে বলল, “আমি শিউলি।”
০২. রইসউদ্দিন যখন মোল্লা
০২.
রইসউদ্দিন যখন মোল্লা কফিলউদ্দিনের সাথে কথা বলছিলেন তখন বাঁশের বেড়ার অন্য পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শিউলি তাঁদের কথাবার্তা শুনছিল। পাগল ধরনের একটা মানুষ তাকে বাঁচানোর জন্যে সেই কোথা থেকে এখানে চলে এসেছে চিন্তা করে শিউলির চোখে পানি এসে গেল। শিউলি চোখ মুছে বাঁশের বেড়ার ফোকর দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে শুনতে পেল কফিলউদ্দিন বলছেন যে সে পালিয়ে গেছে। তারপর শুনল যে সে নাকি বজ্জাতের ঝাড়, বাপ-খাড়ি মা-খাগি আবাগীর বেটি। শুনে হঠাৎ শিউলির মাথায় রক্ত উঠে গেল। ইচ্ছে হল ছুটে গিয়ে কফিলউদ্দিনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নখ দিয়ে মুখ আঁচড়ে দেয়। কিন্তু সে কিছুই করল না। গত ছয় মাসে সে যেসব জিনিস শিখেছে তার মাঝে এক নম্বর হচ্ছে যে, সবসময় মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়। মাথা-গরম করে কোনোকিছুই করা যায় না, কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা রেখে সবকিছু করা যায়।
যেমন ধরা যাক বিড়ালের দুধ খাওয়ার ঘটনাটা। মাসখানেক আগে এক সন্ধ্যেবেলা দেখা গেল রান্নাঘরে বিড়াল এসে দুধ খেয়ে, দুধের ডেকচি উলটে সব দুধ ফেলে গেছে। হালকা-পাতলা কফিলউদ্দিনের পাহাড়ের মতো স্ত্রী এসে শিউলির ঘাড়ে ধরে গালে একটা চড় কষিয়ে দিয়ে বললেন, “হারামজাদি, চোখের মাথা খেয়ে ফেলেছিস নাকি? পাকঘরেরর দরজা খুলে রাখলি যে?”
শিউলি বলল, “চাচি, আমি ভোলা রাখি নাই।”
পাহাড়ের মতো বিশাল মহিলা তার শরীর ঝাঁকিয়ে ছুটে এসে শিউলির পিঠে গুমগুম করে কয়েকটা কিল বসিয়ে দিয়ে বললেন, “আবাগীর বেটি–আমার মুখের উপরে কথা!”
শিউলি তাই কোনো কথা বলল না। তার নিজের আম্মার কথা মনে পড়ে চোখ ফেটে পানি এসে যাচ্ছিল, কিন্তু সে একটুও কাঁদল না। চাচির দিকে তাকিয়ে মনে-মনে বলল, “দেখা যাবে কে আবাগীর বেটি! আমি তোমারে এমন শিক্ষা দেব চাচি তুমি জন্মের মতো সিধা হয়ে যাবে।”
চাচিকে কীভাবে শাস্তি দেওয়া যায় শিউলি তখন সেইটা নিয়ে কয়েকদিন চিন্তা করল। যেহেতু চাচি ছোটখাটো পাহাড়ের মতো বিশাল তাই তার উচিত শাস্তি হবে যদি তাকে খানিকক্ষণ দৌড়িয়ে নিয়ে বেড়ানো যায়। একজন মোটা মানুষ নিজে থেকে কখনো দৌড়াবে না, তাকে দৌড়ানোর উপায় হচ্ছে ভয় দেখানো। চাচি সবচেয়ে যে-জিনিসটাকে ভয় পান সেটা হচ্ছে মাকড়শা। ঘরে যদি ছোট একটা মাকড়শাও থাকে তা হলে চাচি চিৎকার হৈচৈ শুরু করে দেন যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ-একজন এসে সেটাকে আঁটাপেটা করে ঘরছাড়া না করছে। কাজেই শিউলি ঠিক করল চাচিকে আর একটা বিশাল গোবদা মাকড়শাকে এক জায়গায় রাখতে হবে। সেই জায়গাটি কী হতে পারে সেটা নিয়ে কয়েকদিন চিন্তা করে শিউলির মনে হল যে সবচেয়ে ভালো হয় যদি মাড়কশাটাকে তাঁর মশারির ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। মশারির ভেতরে মাকড়শাটা ছুটে বেড়াবে। চাচি ষাড়ের মতো চাচাতে চাঁচাতে মশারি ছিঁড়ে নিচে এসে পড়বে, সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে একটা বিতিকিচ্ছি ব্যাপার হবে। তখন তার উচিত শিক্ষা হবে।
এই পুরো ব্যাপারটার একমাত্র কঠিন অংশটুকু হচ্ছে মশারির ভেতরে মাকড়শাটাকে ঢোকানো। লুকিয়ে একটা মাকড়শা ছেড়ে দিলে লাভ নেই–চাচি হয়তো খেয়ালও করবে না। মাকড়শাটাকে ছাড়তে হলে তাকে দেখিয়ে একেবারে তার চোখের সামনে।