রইসউদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, “মেয়েটাকে বাঁচাবেন।”
“মেয়েটার কি কিছু হয়েছে?”
“এখনও হয় নাই কিন্তু হবে।”
“যখন হবে তখন আসবেন।”
“তখন–তখন—” রইসউদ্দিন তোতলাতে তোতলাতে বললেন, “তখন কি দেরি হয়ে যাবে না?”
মানুষটি হঠাৎ কান চুলকানো বন্ধ করে খুব গম্ভীর মুখ করে বলল, “আমি কি আপনাকে গ্রেপ্তার করেছি?”
রইসউদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, “আমাকে? আমাকে কেন গ্রেপ্তার করবেন?”
”যদি আপনি কোনো ক্রাইম করেন সেজন্যে?”
রইসউদ্দিন মুখ হাঁ করে বসে রইলেন আর পুলিশের লোকটি মুখের মাঝে খুব একটা সবজান্তার ভাব করে বলল, “আপনাকে গ্রেপ্তার করি নাই। আপনি ভবিষ্যতে ক্রাইম করবেন সেজন্যে এখন গ্রেপ্তার করা যায় না। ক্রাইমটা আগে করতে হয়। এখানেও সেই এক ব্যাপার। এক লোক ভবিষ্যতে ক্রাইম করবে সেজন্যে তাকে অ্যাডভান্স গ্রেপ্তার করা যায় না। আগে করুক তখন গিয়ে কাঁক করে ধরব। শালার ব্যাটার টাকা-পয়সা কেমন আছে?”
রইসউদ্দিন হতবুদ্ধি হয়ে ফিরে এলেন। মনে হল এই প্রথমবার মতলুব মিয়াই পুলিশের ব্যাপারটা ঠিক বলেছিল। রইসউদ্দিন পরের কয়েকদিন ভালো করে খেতে পারলেন না, ঘুমাতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত একদিন বিকেলে ঠিক করলেন তিনি নিজেই যাবেন মোল্লা কফিলউদ্দিনের সাথে দেখা করার জন্যে। মানুষটাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিলে নিশ্চয়ই বুঝবে ব্যাপারটা।
বিকালবেলা রওনা দিলেন ট্রেনে। সারারাত ট্রেনে করে গিয়ে ভোরবেলা উঠলেন বাসে–বাস থেকে নেমে নৌকা এবং সবশেষে পাকা দুই মাইল হেঁটে যখন ঠিক জায়গায় পৌঁছালেন তখন বিকেল হয়ে গেছে। মোল্লা কফিলউদ্দিন বি.এ.বি.টি গ্রামের মাতবরগোছের মানুষ, তার বাড়ি খুঁজে পেতে কোনো সমস্যা হল না। রইসউদ্দিন বাড়ির ভিতরে খবর পাঠিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলেন। বাড়িটি গ্রামের আর দশটা বাড়ির মতো, পুরানো নকশাকাটা চেয়ার, মাটির ভিটে, সামনে টিউবওয়েল, পাশে খড়ের গাদা।
কিছুক্ষণের মাঝেই মোল্লা কফিলউদ্দিন বের হয়ে এলেন। রইসউদ্দিন ঠিক যেরকম একটা চেহারা কল্পনা করেছিলেন তার চেহারা ঠিক সেরকম। লম্বা শেয়ালের মতো মুখ, সেখানে ছাগলের মতো দাড়ি, শুকনো দড়ির মতো শরীর, কোটরাগত চোখ, মাথায় ময়লা তেল-চিটচিটে টুপি, পরনে রং-ওঠা নীল পাঞ্জাবি আর খাটো লুঙ্গি। রইসউদ্দিন দিকে তাকিয়ে খুব সন্দেহের চোখে বললেন, “আপনার কী দরকার?”
রইসউদ্দিন পকেট থেকে তাঁর লেখা চিঠিগুলো বের করে বললেন, “আপনি এই চিঠিগুলো লিখেছিলেন?”
মোল্লা কফিলউদ্দিন হঠাৎ কেমন জানি শক্ত হয়ে গেলেন। খানিকক্ষণ ভুরু
কুঁচকে রইসউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন এবং এ-সময়টাতে তাঁকে কেমন জানি ছুঁচোর মতো দেখাতে থাকে। রইসউদ্দিন বললেন, “আপনি লিখেছেন শিউলির কিডনি বিক্রি করবেন। কিন্তু—”
“আপনি কি শিউলির চাচা?”
“আমি কে সেটা ইম্পরট্যান্ট না।”
“তা হলে কোনটা ইম্পরট্যান্ট?”
“মানুষের কিডনি আলু-পটল না যে বাজারে বিক্রি করবেন–সেইটা ইম্পরট্যান্ট। আপনি লিখেছেন কিডনি কাটলে সেটা আবার টিকটিকির লেজের মতন গজায়–সেটা ঠিক না। আপনাকে যে এটা বুঝিয়েছে সে-ব্যাটা মহা বদমাইশ। সত্যি সত্যি যদি দুটো কিডনিই কেটে ফেলা হয় মেয়েটা মারা পড়বে। শুধু তাই না, আপনারাও ফাঁসি হয়ে যাবে।”
মোল্লা কফিলউদ্দিন পিটপিট করে রইসউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন, কিছু বললেন না। রইসউদ্দিন বললেন, “কী হল, আপনি কিছু বলছেন না কেন?”
“আপনি লেকচার দিতে এসেছেন লেকচার দিয়ে চলে যান, আমি কি বলব?”
মোল্লা কফিলউদ্দিনের কথা শুনে হঠাৎ রইসউদ্দিনের রাগ উঠে গেল। মেঘের মতো গর্জন করে বললেন, ‘আমি লেকচার দিতে আসি নাই। আমি একটা মেয়ের জান বাঁচাতে এসেছি।”
মোল্লা কফিলউদ্দিন পিচিক করে দাঁতের ফাঁক দিয়ে থুতু ফেলে বললেন, “সেই মেয়ের জন্যে দরদ এতদিন পরে উথলে উঠল কেন? এতদিন থেকে যে আমার কাছে থাকে খায় তখন কেউ খোঁজ নেয় নাই কেন?”
“কেউ খোঁজ পায় নাই তাই খোঁজ নেয় নাই।”
“এখন কিসের খোঁজ পেয়ে আপনি এসেছেন সেইটা আমি বুঝি নাই মনে করছেন? আমার বয়স তো কম হয় নাই, আমি মানুষ চিনি।”
মোল্লা কফিলউদ্দিন পাঞ্জাবির হাতায় ফাঁৎ করে নাক ঝেড়ে বললেন, “তবে আপনি দেরি করে ফেলেছেন।”
“দেরি?”
“হ্যাঁ। আবাগীর বেটি শিউলি পালিয়ে গেছে।”
“পালিয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ।”
রইসউদ্দিন হতবাক হয়ে মোল্লা কফিলউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মানুষটা যে মিথ্যে কথা বলছে সেটা বুঝতে তাঁর একটুও দেরি হল না। মাথা নেড়ে বললেন, “এতটুকুন মেয়ে পালিয়ে কোথায় যাবে?”
“সেটা আমি কী জানি? আর ঐ মেয়ে এইটুকুন হলে কী হবে, বেটি বজ্জাতের ঝাড়!”
রইসউদ্দিন কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। মোল্লা কফিলউদ্দিনের দাড়ি ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলার ইচ্ছে করল, ব্যাটা ছুঁচো কোথাকার, মিথ্যে বলবি তো মাথা ভেঙে ফেলব। কিন্তু সেটা তো আর সত্যি সত্যি বলা যায় না, তাই গলার স্বর শান্ত রেখে বললেন, “আপনার নিশ্চয়ই ভুল হয়েছে। বাড়িতে নিশ্চয়ই কোথাও আছে, খোঁজ করলেই পেয়ে যাবেন।”
“কী আমি মিথ্যে কথা বলছি?” মোল্লা কফিলউদ্দিন হুংকার দিয়ে বললেন, “আপনার কত বড় সাহস, আমার বাড়িতে এসে আমাকে মিথ্যেবাদী বলেন?”
“আমি মিথ্যেবাদী বলি নাই। আমি বলছি–”