রইসউদ্দিনের খুব মন-খারাপ হল। তিনি ছোট বাচ্চাদের খুব ভয় পান। তারা যদি দুষ্টু হয় তা হলে শুধু যে ভয় পান তাই নয়, তাদের থেকে একশো হাত দূরে থাকেন। কিন্তু এরকম একটা ব্যাপারে তো কিছু না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায় না। কী করবেন সেটা নিয়ে রইসউদ্দিন খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন।
রইসউদ্দিন যখন কোনোকিছু নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে যান তখন তিনি ব্যাপারটি নিয়ে মাঝে মাঝে মতলুব মিয়ার সাথে কথা বলেন–আজকেও তাই তার সাথে কথা বলতে শুরু করলেন।
মতলুব মিয়া রইসউদ্দিনের কাজকর্মে সাহায্য করার মানুষ, তার সাথে গত পঁচিশ বছর থেকে আছে। সাধারণত যারা খুব বিশ্বাসী এবং কাজের মানুষ তারা একজন আরেকজনের সাথে বিশ-পঁচিশ বৎসর থাকে, কিন্তু মতলুব মিয়ার বেলায় সেটা একবারে সত্যি নয়। সে অলস এবং নির্ধমা। তার মাথায় কখনো ভালো জিনিস আসে না কিন্তু সারাক্ষণ নানা ধরনের ফিচলে বুদ্ধি কাজ করে। রইসউদ্দিন যখন মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন তখন মতলুব মিয়ার সাথে তার পরিচয় হয়েছিল। যুদ্ধের নয়টা মাস সে গুলির বাক্স টানাটানি করেছে এবং সারাক্ষণ কোনো-না-কোনো বিষয়ে নিয়ে কারও-না-কারও কাছে ঘ্যানঘ্যান করেছে। প্রায় রাতেই সে মাথা নেড়ে নেড়ে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলত, “ধুত্তেরি ছাই! মুক্তিবাহিনীতে না এসে রাজাকারবাহিনীতে যোগ দেওয়া উচিত ছিল। তা হলে শালার এক প্যাক-কাদার মাঝে গুলির বাক্স টানাটানি করতে হত না।”
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা সবাই যখন অস্ত্র জমা দিচ্ছে তখন মতলুব মিয়া একটা অস্ত্র সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তাকে নাকি কে খবর দিয়েছে যুদ্ধ শেষ হবার পর ডাকাত বাহিনী তৈরি হবে–তাদের কাছে মোটা দামে অস্ত্র বিক্রি করা যাবে। রইসউদ্দিন ধমক দিয়ে তাকে থামিয়েছিলেন। তখন অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে মতলুব মিয়া রইসউদ্দিনের সাথে ঢাকা চলে এল। রইউদ্দিন ভেবেছিলেন দেশের যোগাযোগ-ব্যবস্থা ঠিক হওয়ার পর সে বাড়ি যাবে, কিন্তু তার কোনো নিশানা দেখা গেল না। এই ‘যাচ্ছি’ ‘যাব’ করে করে সে পঁচিশ বছর কাটিয়ে দিল। রইসউদ্দিন তাকে বাসার কাজকর্ম, বাজারপাতি, রান্নাবান্না, এ ধরনের কাজে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন কিন্তু খুব একটা লাভ হয় না। মতলুব মিয়া আশ্চর্যরকম আলসে এবং নির্ধমা। পৃথিবীর কোনো বিষয়ে তার কোনোরকম কৌতূহল নেই, কোনো আগ্রহ নেই। কোনো ব্যাপারে তাই তার কোনো ধারণাও নেই। দেশে কোন পার্টি ক্ষমতায় আছে বা কে প্রধানমন্ত্রী সেটাও সে ভালো করে জানে বলে মনে হয় না। মানুষ যে বানর থেকে এসেছে মতলুব মিয়াকে দেখলে ডারউইন সাহেব সেই থিওরিটা আরও দশ বছর আগে দিতে পারতেন।
গভীর কোনো সমস্যা হলে রইসউদ্দিন মতলুব মিয়ার সাথে সেটি নিয়ে আলোচনা করেন। সে তখন এমন অকাট মূখের মতো কথা বলে যে, সেগুলো শুনে মাঝেমাঝেই রইসউদ্দিনের মাথায় বিচিত্র সমাধান বের হয়ে আসে। আজকেও রইসউদ্দিন তাকে ডেকে বললেন, “মতলুব মিয়া–”
“জে?”
“তোমাকে শিউলি নামে একটা দুষ্টু মেয়ের কথা বলেছিলাম মনে আছে? ঐ যে তার চাচার কাছে লেখা চিঠিগুলো আমার কাছে চলে আসছিল?”
মতলুব মিয়া মেঝেতে থুতু ফেলে বলল, “জে, মনে আছে। পোস্টঅফিস ডিপার্টমেন্টটাই তুলে দেওয়া উচিত। খালি সময় নষ্ট।”
রইসউদ্দিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তা হলে চিঠিপত্র যাবে কেমন করে?”
মতলুব মিয়া উদাস-মুখে বলল, “দরকার কী চিঠিপত্র লেখার? লিখতে সময় নষ্ট, পড়তে সময় নষ্ট। কিছু জানতে হলে টেলিগ্রাম করলেই হয়।”
রইসউদ্দিন কষ্ট করে ধৈর্য ধরে রেখে বললেন, “যা-ই হোক সেটা নিয়ে কথা হচ্ছে না। আমি বলছিলাম কি–”
“বলেন।”
“শিউলি মেয়েটা যে-লোকের সাথে আছে সেই লোক শিউলির কিডনি বিক্রি করার চেষ্টা করছে।”
মতলুব মিয়া মাথা নেড়ে মুখ গম্ভীর করে বলল, “কত করে হালি?”
“কিডনি হালি হিসেবে বিক্রি হয় না। মানুষের কিডনি থাকেই দুটি।”
“তা হলে কত করে জোড়া?” রইসউদ্দিন মুখ শক্ত করে বললেন, “আমি কিডনির দরদাম নিয়ে কথা বলছি। এই যে মেয়েটার কিডনি কেটে ফেলছে, মেয়েটা তো বাঁচবে না।” মতলুব মিয়া নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “জন্ম-মৃত্যু আল্লাহর হাতে।”
রইসউদ্দিন ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কী মনে হয়? ব্যাপারটা কি পুলিশকে জানানো উচিত?”
“সব্বোনাশ!” মতলুব মিয়া আঁতকে উঠে বলল, “পুলিশের ধারেকাছে যাওয়া ঠিক না। পুলিশ ছুঁলে আগেই ছিল আঠারো ঘা, এখন একশো ছত্রিশ ঘা।”
রইসউদ্দিন তখন মনে মনে-একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তার মানে এখন তাঁর পুলিশের কাছেই যাওয়া উচিত। মতলুব মিয়া যেটা বলবে তার উলটোটাই হচ্ছে ঠিক।
রইসউদ্দিন কিন্তু পুলিশের কাছে গিয়ে বিপদে পড়ে গেলেন। যে-লোকটি ফাঁইলপত্র নিয়ে বসেছিল সে রইসউদ্দিনের কথা শুনতে শুনতে খুব মনোযোগ দিয়ে নাকের লোম ছিঁড়তে লাগল। যখন রইসউদ্দিনের মনে হল তিনি পুরো ব্যাপারটা বেশ ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছেন তখন পুলিশের লোকটা হাই তুলে বলল, “তা, কী হয়েছে সমস্যা?”
রইসউদ্দিন একটু থতমত খেয়ে পুরো ব্যাপারটা আবার গোড়া থেকে বুঝিয়ে বললেন। এবার মানুষটা একটা দেয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে কান চুলকাতে লাগল। রইসউদ্দিন মোটামুটি নিশ্চিত ছিলেন মানুষটা এবারেও কোনো কথা শোনেনি, তাঁকে আবার পুরোটা বলতে হবে। কিন্তু দেখা গেল এবারে সে শুনেছে। মাথা নেড়ে বিকট হাই তুলে বলল, “আমি কী করব?”