রইসউদ্দিন খাম খুলে চিঠি বের করে পড়তে শুরু করলেন। শিউলি দেখতে পেল পড়তে পড়তে রইস চাচার মুখ কেমন জানি দুঃখি-দুঃখি হয়ে গেল। শিউলি একটু ভয়-পাওয়া গলায় বলল, “কী হয়েছে রইস চাচা? কী লেখা আছে চিঠিতে?”
রইসউদ্দিন খুব কষ্ট করে হেসে বললেন, “তোমার ছোট চাচা তোমাকে নিতে আসছেন।”
“সত্যি? শিউলি হঠাৎ আবিষ্কার করল তার গলার স্বরেও আনন্দের বদলে কেমন যেন একধরনের দুঃখ-দুঃখ ভাব ফুটে উঠল।
খোকন যোলোগুটি খেলার একটা মোক্ষম চাল বন্ধ করে রেখে শিউলির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি আমেরিকা চলে যাবে আপু?”
শিউলি কোনো কথা না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।
বল্টু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “হ্যাঁ। শিউলি আপা যাবে আমেরিকা। আমরাও যার যার জায়গায় যাব।”
“গাগু? গাগু কোথায় যাবে?”
মতলুব মিয়া তার কান চুলকাতে চুলকাতে বলল, “এতিমখানায়। ভালো এতিমখানা আছে। পর্দা-পুশিদা ভালো।”
শিউলি গাগুকে কোলে তুলে নিয়ে তার বুকে চেপে ধরে রাখল, এই ছোট শিশুটিকে এতিমখানায় ছেড়ে সে আমেরিকা চলে যাবে? হঠাৎ করে তার চোখে পানি এসে যেতে চায়, শিউলি কষ্ট করে চোখের পানি আটকে রাখল। সবার সামনে কেঁদে ফেললে কী-একটা লজ্জার ব্যাপার হবে!
“শিউলি আপু–” খোকন এগিয়ে এসে বলল, “তুমি আমেরিকা থেকে আমাদের কাছে চিঠি লিখবে?”
“চিঠি!” বল্টু মুখ বাঁকা করে হেসে বলল, “আমাদের কি কোনো ঠিকানা আছে চিঠি লেখার? তুই থাকবি কোনো জঙ্গলে আমি থাকব কোনো রাস্তায়–”
“তা হলে? তা হলে আমরা জানব কেমন করে শিউলি আপা কেমন আছে?”
“জানতে হবে তোকে কে বলেছে? আমরা কি সত্যিকার ভাইবোন?”
খোকন কেমন যেন ব্যথিত চোখে বল্টুর দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হল হঠাৎ করে সে যেন এই প্রথমবার বুঝতে পারল তারা আসলে সত্যিকারের ভাইবোন নয়। কয়েকদিনের জন্যে তারা একসাথে এসেছিল, সময় ফুরিয়ে গেলে যার যেখানে যাবার কথা ছিল সে সেখানে চলে যাবে।
খোকনের চোখে হঠাৎ পানি এসে যায়, অনেক কষ্ট করে সে কান্না আটকে রাখার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। তার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি বের হয়ে এল। শিউলি বলল, “কাঁদছিস কেন গাধা, তোর যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাবি, স্কুলে যেতে হবে না, কিছু না–”
বলতে বলতে শিউলি নিজেই হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। খোকনকে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “তুই কেন আমার এত মন-খারাপ করিয়ে দিচ্ছিস? কেন? বোকার মতো কেন কাঁদছিস?”
খোকন চোখ মুখে বলল, “ঠিক আছে আপু আর কাঁদব না।”
কিন্তু তার পরেও সে আরও কিছুক্ষণ কাঁদল। গাগু বুঝতে পারল না কেন হঠাৎ করে সবাই কাঁদতে শুরু করেছে। সে হাত দিয়ে শিউলির চোখ মুখে তাকে আনন্দ দেবার জন্যে মাড়ি বের করে চোখ ছোট ছোট করে হাসার চেষ্টা করল।
বল্টু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “পৃথিবীতে সবাই কি আর সবসময় একসাথে থাকতে পারে? পারে না।”
রইসউদ্দিন এতক্ষণ চুপ করে বসে এদের কথা শুনছিলেন, এবারে গলা পরিষ্কার করে বললেন, “বল্টু আর খোকন, শিউলির ছোট চাচা যখন শিউলিকে নিয়ে যাচ্ছেন তাকে নিয়ে আর চিন্তার কিছু নেই। এতদিন একসাথে ছিল, মায়া পড়ে গেছে, তাই চলে গেলে খুব কষ্ট হবে। কিন্তু কী আর করা? আমার কষ্ট হবে বলে তো জীবন থেমে থাকবে না!”
কেউ কোনো কথা বলল না, রইসউদ্দিন দিকে তাকিয়ে রইল। রইসউদ্দিন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “যা বলছিলাম, বল্টু আর খোকন, তোমাদের সবার জন্যেই মায়া পড়ে গেছে, তোমরা সবাই একসাথে চলে গেলে আমার খুব খারাপ লাগবে। তাই আমার মনে হয়–”
রইসউদ্দিন বল্টু আর খোকনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমরা আমার সাথে থেকে যাও। আমি একা মানুষ, তোমরা থাকলে ভালো লাগবে। আমার তো কখনো ছেলেপুলে ছিল না, তাই ছেলেপুলের উপরে কেমন মায়া হয় জানতাম না। তোমাদের দেখে বুঝেছি–ছেলেপুলের জন্যে মায়া কেমন।”
রইসউদ্দিনের গলা ধরে গেল, তিনি চুপ করে গেলেন। রইসউদ্দিন মানুষটা একটু কাঠখোট্টা ধরনের। এ-ধরনের কথা বলা তার জন্যে খুব সহজ নয়। বল্টু আর খোকন একধরনের বিস্ময় নিয়ে রইসউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে রইল, তখন মতলুব মিয়া মাথা নেড়ে নেড়ে বলল, “না-না-না ভাই, আপনি এটা কী ধরনের কথা বললেন? রাস্তা থেকে দুইজন ধরে এনে নিজের ছেলে বলে রেখে দেবেন? কী বংশ কী জাত কিছু জানেন না। খোঁজখবর নিবেন না–”
রইসউদ্দিন মতলুব মিয়াকে থামিয়ে দিলে বললেন, “মতলুব মিয়া, কিছু-কিছু ব্যাপার তুমি কোনোদিন বুঝবে না। সেইটা নিয়ে খামাকো কথা বোলো না। তোমার সময় নষ্ট আমাদের সময় নষ্ট। এরা আমার জন্যে যা করেছে নিজের ছেলেমেয়েরাও তা করে না। এদের যদি আমি নিজের ছেলেমেয়ে না ভাবি পৃথিবীতে আর আমার কোনো আপন মানুষ থাকবে না।”
ধমক খেয়ে মতলুব মিয়া চুপ করে গেল। রইসউদ্দিন আবার ঘুরে তাকালেন বল্টু আর খোকনের দিকে, বললেন, “কী হল বল্টু আর খোকন? থাকবে আমার সাথে?”
বল্টু আর খোকন কিছু বলার আগে শিউলি হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল, চোখ বড় বড় করে বলল, “বল্টু আর খোকনের সাথে আমিও থাকতে পারি?”
“তুমি?” রইসউদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, “তুমি?”
“হ্যাঁ। আমি?”
“আর তোমার ছোট চাচা?”
“আমি যাব না ছোট চাচার সাথে, আমি তোমার সাথে থাকব। প্লিজ তুমি না কোরো না।” শিউলি কাতর গলায় বলল, “প্লি-ই-ই-জ!”