শিউলি হাতে কিল দিয়ে বলল, “ঠিক বলেছিস!”
রইসউদ্দিনের চোখে কালো চশমা পরানোর পর দেখে মোটামুটিভাবে মনে হতে থাকে মানুষটা একটি রিভলবার হাতে ঘরের কোণায় বসে আছে। এইবারে নার্সিং হোমের লোকজনকে ডেকে আনার কাজ। দরজায় জোরে জোরে কয়েকটা লাথি দিলেই সেটা হয়ে যাবে বলে মনে হয়। কিন্তু তার দরকার হল না, হঠাৎ করে দরজা খুলে গেল এবং একটু আগে যারা রইসউদ্দিনের সাথে মারামারি করেছে তাদের কয়েকজন দরজায় উঁকি দিল। মনে হয় ধস্তাধস্তির সময়ে বল্টু যাদের পকেট মেরে দিয়েছে তারা তাদের জিনিসপত্র খুঁজতে এসেছে।
দরজা খোলামাত্রই শোনা গেল রইসউদ্দিন একটা প্রচণ্ড ধমক দিয়েছেন, “দুই হাত ওপরে তুলে দাঁড়াও বদমাইশের দল।“
মানুষগুলো হকচকিয়ে উঠে দৌড় দিতে গিয়ে থেমে গেল, হঠাৎ আবিষ্কার করল ঘরের কোণায় রইসউদ্দিন তাদের দিকে রিভলবার তাক করে বসে আছেন। রাত্রিবেলা কেন কালো চশমা করে আছেন, একেবারেই কেন নড়াচড়া করছেন না। এবং ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবার পরও মানুষটা কেমন করে এত তাড়াতাড়ি জেগে উঠল এই ব্যাপারগুলো নিয়ে তাদের মনে সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু কোনো সন্দেহ হল না। একটু আগে রইসউদ্দিনের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে তার সম্পর্কে একটা ভীতি জন্মে গেছে, তার ধমক খাবার পর তারা কেউ পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে পারছিল না।
রইসউদ্দিন আবার ধমক দিলেন, “হাত তুলে দাঁড়াও বদমাইশের দল। না হলে গুলি করে খুলি ফুটো করে দেব।”
কথা বলার সময় রইসউদ্দিনের কেন ঠোঁট নড়ছে না সেটা নিয়েও তাদের মনে কোনো সন্দেহ হল না। তারা হাত তুলে দাঁড়াল।
“শিউলি আর বল্টু, তোমরা বেঁধে ফেলো বদমাইশগুলোকে।”
“কী দিয়ে বাঁধব? বল্টু মাথা চুলকে বলল, “দড়ি কই? তার চেয়ে এক কাজ করি।”
“কী কাজ?”
“এদের প্যান্ট খুলে ফেলি। প্যান্ট খুলে রাখলে দৌড়ে পালাতে পারবে না।”
রইসউদ্দিন কিছু বলার আগেই চাপদাড়ি ডাক্তার হাজির হল, রইসউদ্দিন একটা হুংকার দিলেন, “ধর ব্যাটা বদমাইশকে। কত বড় সাহস, আমাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়নোর চেষ্টা করে!”
চাপদাড়ি ডাক্তার ঠিক বুঝতে পারছিল না, কী হচ্ছে, তখন চোখ-বুঝে যাওয়া মানুষটা ফিসফিস করে বলল, “মানুষটা জেগে গেছে।”
“জেগে গেছে! কী আশ্চর্য!”
“কথা বলে কে? হাত তোলো উপরে। না হলে গুলি করে ঘিলু বের করে ফেলব।”
চাপদাড়ি ডাক্তার পালানোর চেষ্টা করল কিন্তু ততক্ষণে শিউলি আর বল্টু তার উপরে লাফিয়ে পড়েছে, পা তুলে হাঁটুতে প্রচণ্ড লাথি মেরে তাকে শুইয়ে দিল।
“ভেরি গুড! রইসউদ্দিন বললেন, “তোমরা এখন বাইরে গিয়ে কয়েকজন মানুষকে ডেনে আনো।”
“এরা যদি পালিয়ে যায়?”
“পালাবে না। আমি দেখছি, একটু নড়লেই হুঁড়ি ফাঁসিয়ে দেব গুলি করে।”
শিউলি আর বল্টু ঘর থেকে বের হয়ে একটা ওয়েটিংরুমের মতো এলাকায় এল, সেখান থেকে একেবারে নার্সিং হোমের বাইরে। কাকে ডেকে আনা যায় চিন্তা করছে ঠিক, তখন সিঁড়িতে বুটের শব্দ শোনা গেল, শিউলি আর বল্টু দেখল পুলিশ এসেছে। এমনিতে পুলিশ দেখলেই বল্টুর বুক কেঁপে ওঠে, আজ অবিশ্যি ভিন্ন কথা। সে শিউলির সাথে সাথে ছুটে গেল পুলিশের কাছে। যখন হড়হড় করে পুলিশকে ব্যাপারটা বোঝনোর চেষ্টা করছে তখন দেখতে পেল পিছুপিছু গাগুকে কোলে নিয়ে শিরিন বানু এসেছেন। শিরিন বানুই নিয়ে এসেছেন পুলিশকে। আর কোনো ভয় নেই, শিউলি আনন্দে চিৎকার করে উঠল।
মার্সিং হোমের ভেতরে মানুষগুলোকে যখন পুলিশ অ্যারেস্ট করছে তখন শিরিন বানু রইসউদ্দিনের কাছে গিয়ে বললেন, “আপনি রাত্রিবেলা এই সানগ্লাস পরে বসেন আছেন কেন?”
রইসউদ্দিন কোনো কথা বললেন না। শিরিন বানু একটু কাছে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ রইসউদ্দিনের নাক ডাকার শব্দ শুনতে পেলেন। শিরিন বানু আরেকটু কাছে গিয়ে রইসউদ্দিনকে ডাকলেন, “রইস সাহেব!–”
রইসউদ্দিন এবারেও কোনো কথা বললেন না। শিরিন বানু হাত দিয়ে রইসউদ্দিনকে ছোট একটা ধাক্কা দিতেই হঠাৎ রইসউদ্দিন গড়িয়ে পড়ে গেলেন। ভয় পেয়ে চিৎকার করে শিরিন বানু লাফ দিয়ে পেছনে সরে গেলেন। শিউলি হি হি করে হেসে বলল, “রইস চাচা ঘুমাচ্ছেন আপা!”
“ঘুমাচ্ছেন! রিভলবার হাতে নিয়ে ঘুমাচ্ছেন?”
“হ্যাঁ আপা।”
ব্যাপারটা কী বুঝিয়ে বলার সময় চাপদাড়ি এবং তার সব সাঙ্গোপাঙ্গ কান খাড়া করে রাখল। একজন মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কীভাবে এতগুলো মানুষকে কাবু করে ফেলতে পারে সেটি নিজের কানে শুনেও তারা ঠিক বিশ্বাস করতে পারল বলে মনে হয় না।
১০. দুপুরবেলা বসার ঘরে রইসউদ্দিন
১০.
দুপুরবেলা বসার ঘরে রইসউদ্দিন খবরের কাগজ পড়ছেন, বল্টু আর খোকন বসে বসে যোলোগুটি খেলছে। শিউলি কার্পেটে পা ছড়িয়ে বসে আছে, গাগু মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে শিউলির পায়ের বুড়ো আঙুল নিজের মুখের মাঝে ঢুকিয়ে মাড়ি দিয়ে কামড়ানোর চেষ্টা করছে। দরজার কাছে বসেছিল মতলুব মিয়া, বরাবরের মতো তার মুখ অত্যন্ত বিরস, কেনে আঙুল কানে ঢুকিয়ে সে খুব দ্রুতগতিতে কান চুলকে যাচ্ছে। এরকম সময় দরজায় শব্দ হল। বল্টু ফ্যাকাশে-মুখে বলল, “সর্বনাশ! দারোগা আপা নাকি?”
মতলুব মিয়া দরজা খুলে দেখল দারোগা আপা নয়, পিয়ন চিঠি নিয়ে এসেছে। খাম দেখেই বোঝা গেল আমেরিকার চিঠি। শিউলি হাততালি দিয়ে বলল, “ছোট চাচার চিঠি! ছোট চাচার চিঠি!”